Class 10 History Solution
সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া
1. MCQs Question Answer
1. সর্বপ্রথম কোন্ পত্রিকায় বাঙালি মধ্যবিত্তদের কথা বলা হয়?
a) হিন্দু প্যাট্রিয়ট
(b) সোমপ্রকাশ
(c) ইন্দু প্রকাশ
(d) বঙ্গদূত ✔
2. ভারতে ব্রিটিশ শাসনকালে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব ঘটেছিল বলে মনে করেন-
(a) ইকতিদার আলম খান
(b) নরেন্দ্রকৃয় সিংহ
(c) বি. বি. মিশ্র✔
(d) যদুনাথ সরকার
3. ব্রিটিশ সরকার কবে ঘোষণা করে যে, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ইংরেজি জ্ঞানকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে?
(a) ১৮২৯ খ্রি.✔
(b) ১৮৩৪ খ্রি.
(c) ১৮৪০ খ্রি.
(d) ১৮৪৪ খ্রি
4. এ. আর. দেশাই ‘আধুনিক ভারতের দ্রষ্টা’ বলে উল্লেখ করেছেন-
(a) বাঙালিদের
(b) মধ্যবিত্তদের✔
(c) নিম্নবিত্তদের
(d) পাঞ্জাবিদের
5. ভারতে এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন-
(a) ওয়ারেন হেস্টিংস
(b) জোনাথান ডানকান
(c) উইলিয়াম জোন্স ✔
(d) রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
6. প্রথম বাংলা সংবাদপত্র হল-
(a) সমাচার দর্পণ✔
(b) সোমপ্রকাশ
(c) হিন্দু পেট্রিয়ট
(d) বন্দেমাতরম
7. ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ডেভিড হেয়ার প্রতিষ্ঠিত ‘পটলডাঙা অ্যাকাডেমি’র বর্তমান নাম হল-
(a) প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি
(b) স্কটিশ চার্চ কলেজ
(c) হেয়ার স্কুল✔
(d) সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ
8. ‘স্কুল বুক সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করেন-
(a) আলেকজান্ডার ডাফ
(b) ডেভিড হেয়ার✔
(c) জোনাথন ডানকান
(d) বিদ্যাসাগর
9. জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশন-এর বর্তমান নাম হল-
(a) লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ
(b) সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ
(c) স্কটিশ চার্চ কলেজ✔
(d) প্রেসিডেন্সি কলেজ
10. ভারতের নবজাগরণের অগ্রদূত ছিলেন-
(a) রামমোহন রায়✔
(b) বিদ্যাসাগর
(c) বিবেকানন্দ
(d) ডিরোজিও
11. আত্মীয় সভা প্রতিষ্ঠিত হয়-
(a) ১৮১৩ খ্রি.
(b) ১৮১৫ খ্রি.✔
(c) ১৮২৮ খ্রি.
(d) ১৮৩৩ খ্রি.
12. কলকাতার ‘হিন্দু কলেজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল-
(a) ১৮১৭ খ্রি.✔
(b) ১৮১৫ খ্রি.
(c) ১৮১৮ খ্রি.
(d) ১৮২০ খ্রি.
13. হিন্দু কলেজের বর্তমান নাম কী?
(a) স্কটিশ চার্চ কলেজ
(b) লরেটো কলেজ
(c) সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ
(d) প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি✔
14. উডের ডেসপ্যাচ প্রকাশিত হয়-
(a) ১৮৩৫ খ্রি.
(b) ১৮১৩ খ্রি.
(c) ১৮৫৪ খ্রি.✔
(d) ১৮৩৩ খ্রি.
15. উডের ডেসপ্যাচ কার আমলে প্রকাশিত হয়?
(a) ক্যানিং
(b) ওয়ারেন হেস্টিংস
(c) ডালহৌসি✔
(d) বেন্টিঙ্ক
16. ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার ম্যাগনাকার্টা বলা হয়-
(a) উডের ডেসপ্যাচকে✔
(b) মেকলে মিনিটকে
(c) হান্টার কমিশনকে
(d) চার্টার আইনকে
17. কোন্ আইন অনুসারে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের জনশিক্ষার জন্য প্রতি বছর ১ লক্ষ টাকা ব্যয়ের সিদ্ধান্ত নেয়?
(a) কাউন্সিল আইন
(b) চার্টার আইন✔
(c) রেগুলেটিং আইন
(d) পিটের ভারত শাসন আইন
18. চুঁইয়ে পড়া নীতি’র প্রবর্তক হলেন-
(a) মেকলে✔
(b) রামমোহন রায়
(c) লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক
(d) ডেভিড হেয়ার
19. কলকাতা মেডিকেল কলেজ কবে প্রতিষ্ঠিত হয়?
(a) ১৭৯২ খ্রি.
(b) ১৮৩৫ খ্রি.✔
(c) ১৮৪৭ খ্রি.
(d) ১৮৫৭ খ্রি.
20. রাজা রামমোহন রায় পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের দাবি করে কত খ্রিস্টাব্দে লর্ড আমহার্স্টকে চিঠি লেখেন?
(a) ১৮১৭
(b) ১৮১৮
(c) ১৮২৩✔
(d) ১৮২৮
21. হান্টার কমিশনের সুপারিশগুলি প্রকাশিত হয়-
(a) ১৮৮২✔
(b) ১৮৫৭ খ্রি.
(c) ১৮৮৩
(d) ১৮৮৭
22. কাদের নিয়ে ব্রিটিশদের ‘সহযোগী শ্রেণি’ গড়ে উঠেছিল?
(a) মধ্যবিত্তদের✔
(b)নিম্নবিত্তদের
(c) হিন্দুদের
(d) মুসলিমদের
23. শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের সংস্কার আন্দোলনকে ‘এলিটিস্ট আন্দোলন’ বলে অভিহিত করেছেন-
(a) বি. বি. মিশ্র
(b) ড. অনীল শীল✔
(c) তপন রায়চৌধুরী
(d) সুমিত সরকার
24. ‘গুলামগিরি’ গ্রন্থটি রচনা করেন-
(a) জ্যোতিবা ফুলে✔
(b) শ্রীনারায়ণ গুরু
(c) স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী
(d) আসারঙ্গ
25. তুহফাৎ উল-মুয়াহিদিন-এর প্রণেতা-
(a) স্যার সৈয়দ আহমেদ খান
(b) রাজা রামমোহন রায়✔
(c) বীরসালিঙ্গম পান্ডুলু
(d) মহাদেব গোবিন্দ রানাডে
26. কাকে ‘বাংলা গদ্যসাহিত্যের জনক’ বলা হয়?
(a) রামমোহন রায়কে✔
(b) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে
(c) বঙ্কিমচন্দ্রকে
(d) রবীন্দ্রনাথকে
27. ‘আধুনিক ভারতের জনক’ বলা হয়-
(a) রামমোহন রায়কে✔
(b) ডিরোজিওকে
(c) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে
(d) স্বামী বিবেকানন্দকে
28. ড. বিপানচন্দ্র কাকে ‘ভারতীয় সাংবাদিকতার অগ্রদূত’ বলে অভিহিত করেছেন?
(a) রামমোহন রায়কে✔
(b) অক্ষয়কুমার দত্তকে
(c) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে
(d) বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে
29. কে রাজা রামমোহন রায়কে ‘ভারত পথিক’ বলে অভিহিত করেছেন?
(a) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
(b) বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
(c) স্বামী বিবেকানন্দ
(d) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর✔
30. কে রাজা রামমোহন রায়কে ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জনক’ বলে অভিহিত করেছেন?
(a) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে
(b) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
(c) জওহরলাল নেহরু✔
(d) সুভাষচন্দ্র বসু
31. আত্মীয় সভা প্রতিষ্ঠা করেন-
(a) বিদ্যাসাগর
(b) রামমোহন রায়✔
(c) বিবেকানন্দ
(d) দয়ানন্দ সরস্বতী
32. রামমোহন রায়কে কে ‘রাজা’ উপাধি দিয়েছিলেন?
(a) লর্ড মিন্টো
(b) মুঘল সম্রাট ‘দ্বিতীয় আকবর’
(c) সম্রাট বাহাদুর শাহ ✔
(d) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
33. কে কেশবচন্দ্রকে ‘ব্রহ্মানন্দ’ উপাধি দেন?
(a) রামমোহন রায়
(b) রামকৃয়দেব
(c) দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর✔
(d) স্বামী বিবেকানন্দ
34. কেশবচন্দ্র ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেন-
(a) ১৮৫৭ খ্রি.✔
(b) ১৮৬০ খ্রি.
(c) ১৮৬১ খ্রি.
(d) ১৮৬২ খ্রি.
35. আদি ব্রাহ্মসমাজের নেতা ছিলেন- ④ রামমোহন রায়
(a) রামমোহন রায়
(b) দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ✔
(c) কেশবচন্দ্র সেন
(d) শিবনাথ শাস্ত্রী
36. ডিরোজিও শিক্ষকতা করতেন-
(a) হেয়ার স্কুল
(b) হিন্দু কলেজ ✔
(c) বেথুন কলেজ
(d) সংস্কৃত কলেজ
37. ‘স্বদেশের প্রতি’ কবিতাটি রচনা করেন-
(a) ডিরোজিও ✔
(b) রামমোহন
(c) বিদ্যাসাগর
(d) রবীন্দ্রনাথ
38. ‘হিন্দু পাইওনিয়ার’ পত্রিকাটি প্রকাশ করেন-
(a) নব্যবঙ্গ ✔
(b) প্রার্থনা সমাজ
(c) আর্যসমাজ
(d) ব্রাহ্মসমাজ
39. ‘যত মত তত পথ’ আদর্শের প্রবর্তক কে ছিলেন?
(a) শ্রীরামকৃয় ✔
(b) স্বামী বিবেকানন্দ
(c) স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী
(d) আত্মারাম পান্ডুরঙ্গ
40. সতীদাহপ্রথা নিষিদ্ধ করেন-
(a) ডালহৌসি
(b) মিন্টো
(c) বেন্টিক ✔
(d) কর্নওয়ালিশ
41. ‘বর্তমান ভারত’ রচনা করেন-
(a) বিবেকানন্দ ✔
(b) বিদ্যাসাগর
(c) রামমোহন
(d) রবীন্দ্রনাথ
42. ‘মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশন’ কে প্রতিষ্ঠা করেন?
(a) রাজা রামমোহন রায়
(b) রাধাকান্ত দেব
(c) দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
(d) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ✔
43. মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশনের বর্তমান নাম-
(a) বিদ্যাসাগর কলেজ ✔
(b) সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ
(c) বেথুন কলেজ
(d) স্কটিশচার্চ কলেজ
44. সর্বশুভকরী সভা প্রতিষ্ঠা করেন-
(a) রাজা রামমোহন রায়
(b) ডিরোজিও
(c) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ✔
(d) স্বামী বিবেকানন্দ
45. বিধবাবিবাহ আইন কত খ্রিস্টাব্দে পাস হয়েছিল?
(a) ১৮২৯ খ্রি.
(b) ১৮৪৮ খ্রি.
(c) ১৮৫৬ খ্রি. ✔
(d) ১৮৫৭ খ্রি.
46. ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়-
(a) উডের ডেসপ্যাচ
(b) চার্টার আইন
(c) মহারানির ঘোষণাপত্র ✔
(d) পুলিশ আইন
47. ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ প্রকাশ করেন-
(a) রামমোহন রায়
(b) দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ✔
(c) কেশবচন্দ্র সেন
(d) ডিরোজিও
48. ‘হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুইটি ফান্ড’ (১৮৭২ খ্রি.) স্থাপন করেন- রামমোহন রায় ডিরোজিও
(a) রামমোহন রায়
(b) ডিরোজিও
(c) কেশবচন্দ্র সেন
(d) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ✔
49. দেশীয় ভাষার সংবাদপত্র আইন (১৮৭৮) প্রণীত হয়-
(a) লর্ড বেন্টিঙ্কের সময়ে
(b) লর্ড কার্জনের সময়ে
(c) লর্ড লিটনের সময়ে ✔
(d) লর্ড রিপনের সময়ে
50. ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’-এর প্রতিষ্ঠা করেন-
(a) মহেন্দ্রলাল সরকার। ✔
(b) রামমোহন রায়
(c) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
(d) ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়
51. বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন-
(a) অ্যানি বেসান্ত ✔
(b) কেশবচন্দ্র সেন
(c) ডিরোজিও
(d) নারায়ণ গুরু
52. স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর সকল ধর্মীয় আদর্শের মূল ভিত্তি ছিল-
(a) বেদ ✔
(b) উপনিষদ
(c) মনুসংহিতা
(d) গার্গী সংহিতা
53. ‘সত্যার্থ প্রকাশ’ ও ‘বেদভাষা’ গ্রন্থ দুটি রচনা করেন-
(a) স্বামী বিবেকানন্দ
(b) স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী ✔
(c) মহাদেব গোবিন্দ রানাডে
(d) অ্যানি বেসান্ত
54. “বৈদিক শাস্ত্রে ফিরে যাও”-এটি কার উক্তি?
(a) স্বামী বিবেকানন্দ
(b) জ্যোতিবা ফুলে
(c) মহাদেব গোবিন্দ রানাডে
(d) দয়ানন্দ সরস্বতী ✔
55. শুদ্ধি আন্দোলনের প্রবর্তক ছিলেন-
(a) দয়ানন্দ সরস্বতী ✔
(b) গাম্বিজি
(c) দাদাভাই নওরোজি
(d) সুরেন্দ্রনাথ
56. সত্যশোধক সভা প্রতিষ্ঠিত করেন-
(a) দয়ানন্দ সরস্বতী
(b) কেশবচন্দ্র সেন
(c) জ্যোতিবা ফুলে ✔
(d) রামমোহন রায়
57. “এক জাতি, এক ধর্ম এবং এক ঈশ্বর”-কার মূল আদর্শ ছিল?
(a) জ্যোতিবা ফুলের
(b) নারায়ণ গুরুর ✔
(c) মহাদেব গোবিন্দ রানাডের
(d) বীরসালিঙ্গমের
58. কার নেতৃত্বে ভাইকম সত্যাগ্রহ (১৯২৪ খ্রি.) শুরু হয়?
(a) শ্রীনারায়ণ গুরুর ✔
(b) মহাদেব গোবিন্দ রানাডের
(c) আত্মারাম পান্ডুরঙ্গের
(d) জ্যোতিবা ফুলের
59. ভাইকম সত্যাগ্রহের অন্যতম নেতা ছিলেন-
(a) কেলাপ্পান
(b) ড. আম্বেদকর
(c) এ. কে. গোপালন
(d) কেশব মেনন। ✔
60. বীরসালিঙ্গম কর্তৃক প্রকাশিত সংবাদপত্রটি ছিল-
(a) হরিজন
(b) চিন্তামণি ✔
(c) কেশরী
(d) পার্থেনন
61. ভাইকম-এর ‘মন্দির প্রবেশ’ আন্দোলনের নেতৃত্ব কে দেন?
(a) ড. আম্বেদকর
(b) এ কে গোপালন
(c) জ্যোতিবা ফুলে
(d) কে পি কেশব মেনন ✔
62. ‘রাজামুন্দ্রি সমাজসংস্কার সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করেন-
(a) মহাদেব গোবিন্দ রানাডে
(b) রামকৃয় ভান্ডারকর
(c)জ্যোতিবা ফুলে
(d) বীরসালিঙ্গম ✔
63. ‘দক্ষিণী বিদ্যাসাগর’ কাকে বলা হত?
(a) বীরসালিঙ্গম পান্ডুলু ✔
(b) শ্রী নারায়ণ পুরু
(c) বিশ্বনাথ সত্যরাম
(d) উন্নভা লক্ষ্মীনারায়ণ
64. বিধবাবিবাহ সমিতি ও বিধবাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন-
(a) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
(b) জ্যোতিবা ফুলে
(c) বীরসালিঙ্গম ✔
(d) নারায়ণ গুরু
65. ‘দীনবন্ধু’ ও ‘দীনমিত্র’ নামে দুটি সংবাদপত্র প্রকাশ করেন-
(a) আত্মারাম পান্ডুরা
(b) জ্যোতিবা ফুলে ✔
(c) দয়ানন্দ সরস্বতী
(d) নারায়ণ গুরু
66. কোন্ আন্দোলনে থিয়োডোর বেক-এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল?
(a) আলিগড় আন্দোলনে ✔
(b) ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলন
(c) ভাইকম আন্দোলনে
(d) বিধবাবিবাহ আন্দোলনে
67. আলিগড় কলেজের ইংরেজ অধ্যক্ষ ছিলেন-
(a) সৌকত আলি
(b) থিওডোর বেক ✔
(c) সৈয়দ আহমেদ খান
(d) মহম্মদ আলি
68. কার উদ্যোগে আলিগড়ে ‘ইউনাইটেড ইন্ডিয়ান প্যাট্রিয়টিক অ্যাসোসিয়েশন’ (১৮৮৮ খ্রি.) প্রতিষ্ঠিত হয়?
(a) স্যার সৈয়দ আহমেদ খানের
(b) থিওডোর বেক-এর ✔
(c) খুদা বক্স-এর
(d) হোসেন আলির
69. কোন্ সমাজের সংস্কারের উদ্দেশ্যে ‘রেহনুমাই মাজদায়াসন সভা’ প্রতিষ্ঠিত হয়?
(a) পারসি ✔
(b) গুজরাটি
(c) মারাঠি
(d) শিখ
70. পারসি বিবাহ সম্মতি আইন (১৮৯১ খ্রি.) রূপায়ণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন-
(a) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগার
(b) কেশবচন্দ্র সেন
(c) বেহরামজি মেরওয়ানজি মালাবারি ✔
(d) এস. এস. বেঙ্গলি
71. নিরাকারী আন্দোলনের সূচনা করেন-
(a) বরবারা সিংহ
(b) লালা হংসরাজ
(c) লালা হরদয়াল
(d) বাবা দয়াল সিংহ ✔
72. নামধারী আন্দোলনের সূচনা করেন-
(a) বাবা দয়াল সিংহ
(b) লালা হরদয়াল
(c) বাবা রাম সিংহ ✔
(d) লালা মুনসিরাম
73. শিখ গুরুদ্বার আইন পাস হয়-
(a) ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে
(b) ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে
(c) ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে
(d) ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ✔
74. ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে সায়েন্টিফিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন-
(a) জ্যোতিবা ফুলে
(b) বীরসালিঙ্গম
(c) থিওডোর বেক
সৈয়দ আহমেদ খান ✔
75. ভারতের প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন কোন্টি?
(a) গিরনি কামগার ইউনিয়ন
(b) নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস
(c) ইন্ডিয়ান ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন
(d) মাদ্রাজ লেবার ইউনিয়ন ✔
76. ‘সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা’ নীতি ঘোষণা করেন-
(a) চার্চিল
(b) এটলি
(c) ম্যাকডোনাল্ড ✔
(d) মাউন্টব্যাটেন
77. মেকলের ‘মিনিট’ পেশ করা হয়-
(a) ১৮২৯
(b) ১৮৩০
(c) ১৮৩৪
(d) ১৮৩৫ ✔
78. কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ছিলেন-
(a) মেকলে
(b) চার্লস উড
(c) বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়
(d) স্যার জেমস উইলিয়াম কোলভিল ✔
79. ‘Man-making Religion’-এ বিশ্বাস করতেন-
(a) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
(b) শ্রীরামকৃয়দেব
(c) স্বামী বিবেকানন্দ ✔
(d) দয়ানন্দ সরস্বতী
80. ভাইকম সত্যাগ্রহের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন-
(a) শ্রীনারায়ণ গুরু ✔
(b) বীরসালিঙ্গম পানতুলু
(c) জ্যোতিবা ফুলে
(d) সাবিত্রীবাঈ
81. কলকাতা সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়-
(a) ১৮১৭ খ্রি.
(b) ১৮২৪ খ্রি. ✔
(c) ১৮৩৬ খ্রি.
(d) ১৮৬৬ খ্রি.
82. কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল-
(a) ১৮৩৭ খ্রি.
(b) ১৭৮১ খ্রি.
(c) ১৮৩৫ খ্রি.
(d) ১৮৫৭ খ্রি ✔
83. কলকাতা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন-
(a) লর্ড ক্লাইভ
(b) রাজা রামমোহন রায়
(c) লর্ড ওয়েলেসলি
(d) ওয়ারেন হেস্টিংস ✔
84. ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন-
(a) উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক
(b) উইলিয়ম পিট
(c) লর্ড ওয়েলেসলি ✔
(d) ওয়ারেন হেস্টিংস
85. ‘স্কুল বুক সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠিত হয়-
(a) ১৮৩৭ খ্রি.
(b) ১৮৭১ খ্রি.
(c) ১৮১৭ খ্রি. ✔
(d) ১৭১৭ খ্রি.
86.প্রার্থনা সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন-
(a) আত্মারাম পান্ডুরঙ্গ
(b) মহাদেব গোবিন্দ রানাডে ✔
(c) আর জি ভান্ডারকর
(d) কেশব কার্ডে
87. ‘কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন’-এর সভাপতি ছিলেন-
মেকলে ✔
(b) চার্লস উড
(c) কোলব্রুক
(d) জেম্স মিল
88. গুজরাটে পতিদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করত-
(A) কুনবি-রা ✔
(B) কুনিক-রা
(C) কুলকার্ণি-রা
(D) ইঝাবা-রা
89. পতিদাররা কোন্ রাজনৈতিক দলের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে?
(A) স্বতন্ত্র পার্টির
(B) কংগ্রেসের ✔
(C) কমিউনিস্ট পার্টির
(D) কৃষক দলের
90. সাউকারদের প্রধান কাজ ছিল-
(A) সুদের কারবার ✔
(B) কৃষিকার্য
(C) বাণিজ্য
(D) কর আদায়
91. সাউকাররা ছিলেন-
(A) সুদখোর মহাজন ✔
(B) ঠিকাদার
(C) জমিদার
ব্রিটিশ কর্মচারী
92. সাউকার-বিরোধী দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছিল-
(A) ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে
(B) ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে
(C) ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে ✔
(D) ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে
93. সাধারণভাবে পতিদার নামে পরিচিত হত-
(A) কৃষকরা
(B) জমিদাররা
(C) ভূমিরাজস্ব আদায়কারীরা ✔
94. পতিদারদের একটি পৃথক সত্তা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় যে বছরের আদমশুমারিতে তা হল-
(A) ১৯৩০
(B) ১৯৩১ ✔
(C) ১৯৩২
(D) ১৯৩৪
95. গুজরাটের খেদা জেলার দরিদ্র কৃষক কী নামে পরিচিত ছিল?
(A) হরিজন
(B) কুনবি
(C) পতিদার ✔
(D) বর্গাদার
96. দাক্ষিণাত্যের সুদখোর মহাজনরা পরিচিত ছিল-
(A) পতিদার নামে
(B) সাউকার নামে ✔
(C) প্যাটেল নামে
(D) মোড়ল নামে
97. নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (AITUC) গঠিত হয়-
(A) ১৯২০ খ্রি. ✔
(B) ১৯২২ খ্রি.
(C) ১৯২৫ খ্রি.
(D) ১৯২৯ খ্রি.
98. নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (AITUC)-এর সভাপতি ছিলেন-
(A) সুভাষচন্দ্র বসু
(B) চিত্তরঞ্জন দাশ
(C) বাল গঙ্গাধর তিলক
(D) লালা লাজপত রায় ✔
99. ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়-
(A) ১৯২২ খ্রি.
(B) ১৯২০ খ্রি.
(C) ১৯২৫ খ্রি. ✔
(D) ১৯২৮ খ্রি.
100. ‘গণবাণী’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন-
(A) হেমন্তকুমার সরকার
(B) নজরুল ইসলাম ✔
(C) এস. এ. ডাঙ্গে
(D) মুজাফ্ফর আহমেদ
101. ‘সোশ্যালিস্ট’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন-
(A) এস. এ. ডাঙ্গে ✔
(B) পি. সি. যোশি
(C) হেমন্তকুমার সরকার
(D) মুজাফ্ফর আহমেদ
102. ভারতের প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন কোন্টি?
(A) গিরনি-কামগাড় ইউনিয়ন
(B) নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস
(C) ইন্ডিয়ান ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন
(D) মাদ্রাজ লেবার ইউনিয়ন ✔
103. শ্রীরামপুরত্রয়ী নামে পরিচিত কারা-
(A) কেরি-হিকি-ওয়ার্ড
(B) ডাফ-কেরি-মার্শম্যান
(C) হেয়ার-ডাফ-কেরি
(D) কেরি-মার্শম্যান-ওয়ার্ড ✔
104. ব্রিটিশ শাসনকালে বাংলার দলিত আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিল-
(A) কায়স্থ সম্প্রদায়
(B) আদিবাসী সম্প্রদায়
(C) নমঃশূদ্র সম্প্রদায় ✔
(D) মাহিষ্য সম্প্রদায়
105. ‘নিম্নবর্ণ’ বা ‘Subaltern’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন-
(A) রণজিৎ গুহ
(B) অ্যান্তনিও গ্রামসি ✔
(C) পার্থ চট্টোপাধ্যায়
(D) গৌতম ভদ্র
106. ‘দামিন-ই-কোহ’ শব্দটি যে বিদ্রোহের সঙ্গে যুক্ত সেটি হল-
(A) কোল
(B) পাইক
(C) সাঁওতাল ✔
(D) নীল
107. গান্ধি প্রবর্তিত ‘হরিজন’-এর অর্থ-
(A) অস্পৃশ্য
(B) নিপীড়িত
(C) ঈশ্বরের সন্তান ✔
(D) তপশিলি জাতি
108. গুজরাটের অচ্ছুৎ আদিবাসীদের বলা হত-
(A) কালিপরাজ
(B) কোনোটিই নয়
(C) রাজাপরাজ ✔
(D) উজালিপরাজ
109. কলারাম মন্দিরে দলিত শ্রেণির প্রবেশের দাবিতে আন্দোলন করেন-
(A) বাবা রামচন্দ্র
(B) পান্ডুরাম
(C) বি. আর. আম্বেদকর ✔
(D) গান্ধিজি
110. ভারতে অনগ্রসর শ্রেণির আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন-
(A) প্রমথরঞ্জন ঠাকুর
(B) গান্ধিজি
(C) যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল
(D) ড. বি. আর. আম্বেদকর ✔
111. সর্বভারতীয় নিপীড়িত শ্রেণির কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন-
(A) যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল
(B) আম্বেদকর ✔
(C) প্রমথরঞ্জন ঠাকুর
(D) গান্ধিজি
112. সর্বভারতীয় নিপীড়িত সমিতির (১৯২৬ খ্রি.) সভাপতি নির্বাচিত হন-
(A) এম. সি. রাজা ✔
(B) গান্ধিজি
(C) আম্বেদকর
(D)নারায়ণ গুরু
113. ‘জাস্টিস পার্টি’ (১৯১৬ খ্রি.) কাদের রাজনৈতিক দল ছিল?
(A) ব্রাহ্মণদের
(B) কায়স্থদের
(C) মুসলিমদের
(D) দলিত হিন্দুদের ✔
2. Very Short Question Answer
প্রশ্ন1. কবে, কার উদ্যোগে কলকাতা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়? অথবা, কার উদ্যোগে কলকাতা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত
উত্তর- ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে বড়োলাট লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংসের উদ্যোগে কলকাতা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়।
হয়
প্রশ্ন2. কবে, কার উদ্যোগে বারাণসীতে সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়?
উত্তর- ১৭৯১ খ্রি. (মতান্তরে ১৭৯২ খ্রি.) জোনাথান ডানকানের উদ্যোগে বারাণসীতে সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রশ্ন3. কে, কবে, কোথায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর- বড়োলাট লর্ড ওয়েলেসলি ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের ১০ জুলাই কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রশ্ন4. কাদের উদ্যোগে শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন প্রতিষ্ঠিত হয়?
উত্তর- খ্রিস্টান মিশনারি মার্শম্যান, উইলিয়াম ওয়ার্ড ও উইলিয়াম কেরি ১৮০০ খ্রিস্টাব্ে শ্রীরামপুরে ব্যাপটিস্ট মিশন প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রশ্ন5. ‘শ্রীরামপুর ত্রয়ী’ কাদের বলা হয়?
উত্তর- জোশুয়া মার্শম্যান, উইলিয়াম ওয়ার্ড ও উইলিয়াম কেরিকে ‘শ্রীরামপুর ত্রয়ী’ বলা হয়।
প্রশ্ন6. জেসুইট মিশনারিদের উদ্যোগে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত দুটি কলেজের নাম লেখো।
উত্তর- জেসুইট মিশনারিদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত দুটি কলেজ হল সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ এবং লরেটো হাউস কলেজ।
প্রশ্ন7. কে, কবে পটলডাঙ্গা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর-ডেভিড হেয়ার ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় পটলভাঙ্গা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রশ্ন8. কার উদ্যোগে এবং কী উদ্দেশ্যে ‘ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠিত হয়?
উত্তর- ডেভিড হেয়ারের উদ্যোগে ‘ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি’ (১৮১৭ খ্রি.) প্রতিষ্ঠিত হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজি ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচনা করা।
প্রশ্ন9. ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতে কোন্ কোন্ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল?
উত্তর- ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতের কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে মোট তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রশ্ন10. কে, কবে ‘ব্রাহ্মসভা’ প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর- রাজা রামমোহন রায় ১৮২৮ (মতান্তরে ১৮২৯) খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মসভা প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রশ্ন11. স্বামী বিবেকানন্দের লেখা দুটি গ্রন্থের নাম লেখো।
উত্তর- স্বামী বিবেকানন্দের লেখা দুটি গ্রন্থ হল-[i] ‘পরিব্রাজক’, [ii] ‘বর্তমান ভারত’।
প্রশ্ন12. সংস্কৃত শিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদ্যাসাগর কর্তৃক রচিত দুটি গ্রন্থের নাম লেখো।
উত্তর- সংস্কৃত শিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদ্যাসাগর কর্তৃক রচিত দুটি অন্যতম গ্রন্থ হল ‘সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা’ ও ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’।
প্রশ্ন13. কে, কবে মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশন প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশন প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রশ্ন14. ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত কয়েকটি গ্রন্থের নাম লেখো।
উত্তর- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ হল ‘বর্ণমালা’, ‘কথামালা, ‘বোধোদয়’, ‘নীতিবোধ’, ‘শকুন্তলা’, ‘সীতার বনবাস’ প্রভৃতি।
প্রশ্ন15. কে, কবে এবং কোথায় দয়ানন্দ অ্যাংলো-বৈদিক কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর- লালা হংসরাজ ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে লাহোরে দয়ানন্দ অ্যাংলো-বৈদিক কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রশ্ন16. কে ‘গুরুকুল আশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর- স্বামী শ্রদ্ধানন্দ ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে হরিদ্বারে গুরুকুল আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রশ্ন17. জ্যোতিবা ফুলে রচিত কয়েকটি গ্রন্থের নাম লেখো।
উত্তর- জ্যোতিবা ফুলে রচিত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ হল ‘ব্রাহ্মণাচে কসাব’, ‘শ্বেতকার্যচ অসুদ’ এবং ‘গুলামগিরি’।
প্রশ্ন18. কে, কবে ‘শ্রীনারায়ণ ধর্ম প্রতিপালন যোগম’ প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর- শ্রীনারায়ণ গুরু ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে ‘শ্রীনারায়ণ ধর্ম পরিপালন যোগম’ প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রশ্ন19. বীরসালিঙ্গম কর্তৃক প্রকাশিত কয়েকটি সংবাদপত্রের নাম লেখো।
উত্তর- বীরসালিঙ্গম কর্তৃক প্রকাশিত কয়েকটি সংবাদপত্র ছিল ‘চিন্তামণি’, ‘সতীহিতবোধিনী’, ‘সত্যবাদী’ প্রভৃতি।
প্রশ্ন20. কে, কবে অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন?
অথবা, আলিগড় অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ’ কবে প্রতিষ্ঠিত হয়?
উত্তর- স্যার সৈয়দ আহমেদ খান ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে আলিগড়ে ‘অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রশ্ন21. দেশীয় ভাষায় সংবাদপত্র আইন কত খ্রিস্টাব্দে কোন বড়োলাট পাস করেন?
উত্তর- দেশীয় ভাষায় সংবাদপত্র আইন ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে বড়োলাট লর্ড লিটন পাস করেন।
প্রশ্ন22. কবে, কাদের উদ্যোগে ‘শ্রীগুরু সিংহসভা’ স্থাপিত হয়?
উত্তর- ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে সর্দার ঠাকুর সিংহ, বাবা শ্রীখেম সিংহ বেদি ও বিক্রম সিংহ প্রমুখের উদ্যোগে পাঞ্জাবের অমৃতসরে ‘শ্রীগুরু সিংহসভা’ স্থাপিত হয়।
প্রশ্ন23. কবে, কার উদ্যোগে লাহোরে সিংহসভা স্থাপিত হয়?
উত্তর- ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে অধ্যাপক গুরুমুখ সিংহের উদ্যোগে লাহোরে সিংহসভা স্থাপিত হয়।
প্রশ্ন24. র্যালে কমিশন কত সালে গঠিত হয়? এর অপর নাম কী?
উত্তর- ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে র্যালে কমিশন গঠিত হয়। র্যালে কমিশনের অপর নাম ছিল ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন।
প্রশ্ন25. কবে, কী উদ্দেশ্যে হুইটলি কমিশন নিয়োগ করা হয়?
উত্তর- ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে হুইটলি কমিশন নিয়োগ করা হয়। এই কমিশনের উদ্দেশ্য ছিল শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি করা।
প্রশ্ন26. প্রাচ্যবিদ্যার গবেষণার কয়েকজন পথপ্রদর্শকের নাম লেখো।
উত্তর- প্রাচ্যবিদ্যার গবেষণার কয়েকজন পথপ্রদর্শক ছিলেন স্যার উইলিয়াম জোনস, ম্যাক্সমুলার, কানিংহাম, প্রিন্সেপ, রাজেন্দ্রলাল মিত্র প্রমুখ।
প্রশ্ন27. খালসা কলেজ কবে, কোথায় স্থাপিত হয়?
উত্তর- ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবের অমৃতসরে খালসা কলেজ স্থাপিত হয়।
প্রশ্ন28. কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য কে ছিলেন?
উত্তর- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ছিলেন জেমস উইলিয়াম কোলভিল।
প্রশ্ন29. কবে এবং কেন স্যাডলার কমিশন গঠিত হয়?
উত্তর- ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার পরিকল্পনা রূপায়নের লক্ষ্যে ব্রিটিশ সরকার ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে স্যাডলার কমিশন গঠন করে।
প্রশ্ন30. মানুষ গড়ার আদর্শে কে বিশ্বাসী ছিলেন?
উত্তর- মানবতাবাদী স্বামী বিবেকানন্দ মানুষ গড়ার আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। এই আদর্শ রূপায়নের জন্যই তিনি রামকৃয় মঠ ও মিশন প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।
প্রশ্ন31. কেরালায় কে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন?
উত্তর- কেরালায় শ্রী নারায়ণ গুরু অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন।
প্রশ্ন32. কে, কবে প্রার্থনা সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর- ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে আত্মারাম পান্ডুরঙ্গ প্রার্থনা সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রশ্ন31. কলকাতাতে বিদ্যালয় গড়ে তুলেছিলেন এমন কয়েকজন বিদেশির নাম লেখো।
উত্তর- কলকাতাতে বিদ্যালয় গড়ে তুলেছিলেন এমন কয়েকজন বিদেশির নাম হল-শেরবোর্ন, মার্টিন বো, আরটুন পিটার্স, ডেভিড ড্রামন্ড প্রমুখ।
প্রশ্ন32. বাঙালিদেরকে ‘ভারতমাতার মুকুট’ বলে সম্মানিত করেছিলেন কোন্ রাজনীতিবিদ?
উত্তর- বাঙালিদেরকে ‘ভারতমাতার মুকুট’ বলে সম্মানিত করেছিলেন স্যার সৈয়দ আহমেদ খান।
প্রশ্ন33. ‘আধুনিক অস্ত্রের জনক’ এবং ‘অন্ধ্র নবজাগরণের অগ্রদূত’ নামে কে পরিচিত?
উত্তর- কান্দুকুরি বীরসালিঙ্গম পান্ডুলুকে ‘আধুনিক অশ্বের জনক’ এবং ‘অন্ধ্র নবজাগরণের অগ্রদূত’ বলা হয়।
প্রশ্ন34. শ্রীশ্রী রামকৃয়ের ধর্ম দর্শনের মূল কথা কী ছিল?
উত্তর- শ্রীশ্রী রামকৃয়ের ধর্ম দর্শনের মূল কথা ছিল-সকল ধর্মের উদ্দেশ্য ঈশ্বর লাভ, শুধু পথ আলাদা।
প্রশ্ন35. কে বিবেকানন্দকে ‘চিরন্তন মহাপরিব্রাজক’ বলে অভিহিত করেছিলেন?
উত্তর- ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠি বিবেকানন্দকে ‘চিরন্তন মহাপরিব্রাজক’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
প্রশ্ন36. নারীদের মধ্যে শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে অন্ধ্রপ্রদেশে ‘হিতকারিণী’ সংগঠন কে গড়ে তোলেন?
উত্তর- নারীদের মধ্যে শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে অস্ত্রপ্রদেশে ‘হিতকারিণী’ সংগঠন গড়ে তোলেন কান্দুকুরি বীরসালিঙ্গম পান্ডুলু।
প্রশ্ন37. ‘ব্রাহ্মণচে কসাব’ (পুরোহিততন্ত্রের স্বরূপ প্রকাশ) এবং ‘শ্বেতকার্যচ অসুদ’ (কৃষকদের চাবুক) নামক গ্রন্থ দুটি কে রচনা করেন?
উত্তর- ‘ব্রাহ্মণচে কসাব’ (পুরোহিততন্ত্রের স্বরূপ প্রকাশ) এবং ‘শ্বেতকার্যচ অসুদ’ (কৃষকদের চাবুক) নামক গ্রন্থ দুটি জ্যোতিবা ফুলে রচনা করেন।
প্রশ্ন38. স্বামীজি কবে শিকাগো বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনে হিন্দু ধর্মের উপর আলোকপাত করেন? অথবা, স্বামী বিবেকানন্দের লেখা দুটি বইয়ের নাম লেখো।
উত্তর- স্বামীজি ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে ১১-২৭ সেপ্টেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে আয়োজিত বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনে হিন্দু ধর্মের উপর আলোকপাত করেন।
প্রশ্ন39. স্বামীজির লেখা কয়েকটি গ্রন্থের নাম লেখো।
উত্তর- স্বামীজির লেখা কয়েকটি গ্রন্থের নাম হল- ‘বর্তমান ভারত’, ‘পরিব্রাজক’, ‘জ্ঞানযোগ’, ‘রাজযোগ’ ইত্যাদি।
প্রশ্ন40. কে, কবে, কোথায় বিধবাবিবাহ সমিতি গঠন করেন?
উত্তর- মহাদেব গোবিন্দ রানাডে মহারাষ্ট্রে ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে বিধবাবিবাহ সমিতি গঠন করেন।
প্রশ্ন41. ‘থিওসফিক্যাল সোসাইটি’ কথাটির অর্থ কী?
উত্তর- ‘থিওসফিক্যাল সোসাইটি’ কথাটির অর্থ হল ব্রহ্মবিদ্যাচর্চার প্রতিষ্ঠান।
প্রশ্ন42. কার আমলে চিনের মহাবিদ্যালয়টি ইম্পিরিয়াল ইউনিভার্সিটিতে রূপান্তরিত হয়?
উত্তর- চিনা সম্রাট কোয়াংসু-র আমলে চিনের মহাবিদ্যালয়টি পিকিং ইম্পিরিয়াল ইউনিভার্সিটিতে রূপান্তরিত হয়।
প্রশ্ন43. ‘সত্যার্থ প্রকাশ’ ও ‘বেদভাষ্য’ গ্রন্থ দুটি কে রচনা করেন?
উত্তর- ‘সত্যার্থ প্রকাশ’ ও ‘বেদভাষ্য’ গ্রন্থ দুটি স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী রচনা করেন।
প্রশ্ন44. কার উদ্যোগে, কবে, কোথায় ‘দয়ানন্দ-ইঙ্গ-বৈদিক কলেজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়?
উত্তর- লালা হংসরাজের উদ্যোগে ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে লাহোরে ‘দয়ানন্দ-ইঙ্গ-বৈদিক কলেজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রশ্ন45. কোথায়, কার উদ্যোগে একটি বেদচর্চার প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়?
উত্তর- স্বামী শ্রদ্ধানন্দের উদ্যোগে হরিদ্বারে ‘গুরুকুল বিদ্যালয়’ নামে একটি বেদচর্চার প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়।
প্রশ্ন46. কত খ্রিস্টাব্দে কে ‘গৌ-রক্ষিণী সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর- ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী ‘গৌ-রক্ষিণী সভা’ (Cow Protection Association) প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রশ্ন47. গো হত্যার নিন্দা করে লেখা স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর গ্রন্থটির নাম কী?
উত্তর- গো হত্যার নিন্দা করে লেখা স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর গ্রন্থের নাম হল-‘গো-করুণানিধি’।
প্রশ্ন48. ‘পন্ডিত দয়ানন্দের উন্মোচন’ গ্রন্থটি কে রচনা করেন?
উত্তর- ‘পন্ডিত দয়ানন্দের উন্মোচন’ গ্রন্থটি ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে শিবনারায়ণ অগ্নিহোত্রী রচনা করেন।
প্রশ্ন49. কত খ্রিস্টাব্দে, কোথায় ‘হিন্দু মহাসভা’ রাজনৈতিক গোষ্ঠী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে?
উত্তর- ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে হরিদ্বারের কুম্ভমেলায় ‘হিন্দু মহাসভা’ রাজনৈতিক গোষ্ঠী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
প্রশ্ন50. ব্রহ্মানন্দ শিবযোগীর লেখা দুটি গ্রন্থের নাম লেখো।
উত্তর- ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে হরিদ্বারের কুম্ভমেলায় ‘হিন্দু মহাসভা’ রাজনৈতিক গোষ্ঠী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
প্রশ্ন51. বীরসালিঙ্গম পান্ডুলু-র সম্পাদিত পত্রপত্রিকাগুলির নাম উল্লেখ করো।
উত্তর- ব্রহ্মানন্দ শিবযোগীর লেখা দুটি গ্রন্থের নাম ‘মোক্ষপ্রদীপম্’, ‘আনন্দসূত্রম’ ইত্যাদি।
প্রশ্ন52. পুরুষদের বহুবিবাহের (Polygamy) প্রতিবাদে বীরসালিঙ্গম পান্ডুলু-র লেখা নাটকটির নাম কী?
উত্তর- বীরসালিঙ্গম পান্ডুলু-র সম্পাদিত পত্রপত্রিকাগুলির নাম হল-‘বিবেকবধিনী’, ‘চিন্তামনি’, ‘সত্যবাদী’, ‘সতীহিতবোধিনী’ ইত্যাদি।
প্রশ্ন53. ‘এজাভা শিবলিঙ্গম’ (Ezhava Shiva Lingam) কী?
উত্তর- পুরুষদের বহুবিবাহের (Polygamy) প্রতিবাদে বীরসালিঙ্গম পান্ডুলু-র লেখা নাটকটির নাম হল-‘সত্যরাজাচার্য পূর্বদেশ যাত্রালু’।
প্রশ্ন54. ভারতের সুপ্রিমকোর্টের প্রথম বিচারপতি কে ছিলেন?
উত্তর- এলিজা ইম্পে ভারতের সুপ্রিমকোর্টের প্রথম বিচারপতি ছিলেন।
প্রশ্ন55. কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ কে প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর- কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক।
প্রশ্ন56. কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কে প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন আলেকজান্ডার ডাফ (২৪ জানুয়ারি ১৮৫৭খ্রি.)।
প্রশ্ন57. কে, কবে এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর- উইলিয়াম জোনস ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে ১৫ জানুয়ারি এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রশ্ন58. ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় কী প্রতিষ্ঠিত হয়?
উত্তর- ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম জোনসের উদ্যোগে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রশ্ন59. মেকলে কে ছিলেন?
উত্তর- টমাস ব্যাবিংটন মেকলে ছিলেন বড়োলাট উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের আইনসচিব। তিনি তাঁর বিখ্যাত ‘মিনিট’ বা ‘প্রস্তাব’-এ পাশ্চাত্য শিক্ষার পক্ষে অভিমত দেন।
প্রশ্ন60. নববিধান ব্রাহ্ম সমাজ কে প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর- নববিধান ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন কেশবচন্দ্র সেন (১৮৮০ খ্রি.)।
প্রশ্ন61. দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কাকে ‘ব্রহ্মানন্দ’ উপাধি দিয়েছিলেন?
উত্তর- দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কেশবচন্দ্র সেনকে ‘ব্রহ্মানন্দ’ উপাধি দিয়েছিলেন (১৮৬২ খ্রি.)।
প্রশ্ন62. কে, কাকে ভারতের রাজনৈতিক ‘পুনরুজ্জীবনের জনক’ বলে অভিহিত করেছেন?
উত্তর- বিপিনচন্দ্র পাল রামমোহন রায়কে ভারতের রাজনৈতিক ‘পুনরুজ্জীবনের জনক’ বলে অভিহিত করেছেন।
প্রশ্ন63. বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম সংবাদপত্র কোন্টি?
উত্তর- বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম সংবাদপত্র সমাচার দর্পণ।
প্রশ্ন64. আর্যসমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী ছিল?
উত্তর- আর্যসমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুধর্মের ওপর অন্য ধর্মের আক্রমণ প্রতিরোধ কর এবং হিন্দুধর্মের অভ্যন্তরীণ সংস্কার ঘটানো।
প্রশ্ন65. আলিগড় কলেজের বিভেদপন্থী অধ্যক্ষ কে ছিলেন?
উত্তর- আলিগড় কলেজের বিভেদপন্থী অধ্যক্ষ ছিলেন থিয়োডর বেক।
প্রশ্ন66. ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি কে রচনা করেন?
উত্তর- ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি দীনবন্ধু মিত্র রচনা করেন।
3. Short Question Answer
প্রশ্ন 1. মোগল সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের সময় ভারতের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা কয়েকটি আঞ্চলিক শক্তির নাম উল্লেখ করো।
উত্তর- মোগল সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের সময় ভারতের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা উল্লেখযোগ কয়েকটি আঞ্চলিক শক্তি ছিল বাংলা, হায়দ্রাবাদ, মহীশূর, মারাঠা, পাঞ্জাব প্রভৃতি।
প্রশ্ন2. অষ্টাদশ শতকে ভারতে আগত কয়েকটি ইউরোপীয় বণিক জাতির নাম লেখো।
উত্তর- অষ্টাদশ শতকে ভারতে আগত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ইউরোপীয় বণিক জাতি ছিল পোর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ইংরেজ, ফরাসি, দিনেমার প্রভৃতি।
প্রশ্ন3. কবে, কাদের মধ্যে পলাশির যুদ্ধ হয়েছিল?
উত্তর- পলাশির যুদ্ধ ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন হয়েছিল। এই যুদ্ধে একদিকে ছিল বাংলার নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলা ও তাঁর ফরাসি জোট এবং অন্যদিকে ছিল কলকাতার বিট্রিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।
প্রশ্ন4. বক্সারের যুদ্ধ কবে, কাদের মধ্যে হয়েছিল?
উত্তর- বক্সারের যুদ্ধ ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দের ২২ অক্টোবর হয়েছিল। এই যুদ্ধে একদিকে ছিল বাংলার নবাব মিরকাশিম, অযোধ্যার নবাব সুজা-উদ্দৌলা ও দিল্লির বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ আলমের মিলিত বাহিনী এবং অন্যদিকে ছিল কলকাতার হেক্টর মুনরো-এর নেতৃত্বে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।
প্রশ্ন5. মোগল আমলে ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অস্তিত্ব ছিল বলে মনে করেন এমন একজনের বক্তব্য উল্লেখ করো।
উত্তর- ইকতিদার আলম খান তাঁর ‘দ্য মিডল ক্লাসেস ইন দ্য মোগল এম্পায়ার’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে, মোগল আমলে সরকারি কর্মচারী, উকিল, শিক্ষক, হাকিম, বৈদ্য প্রভৃতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল।
প্রশ্ন6. নবাবি আমলে বাংলায় মধ্যবিত্ত শ্রেণির অস্তিত্ব ছিল বলে মনে করেন এমন একজনের বক্তব্য উল্লেখ করো।
উত্তর- অধ্যাপক নরেন্দ্রকৃয় সিংহ মনে করেন যে, নবাবি আমলে বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অস্তিত্ব ছিল। বাংলায় ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা, শাসন পরিচালনা, পুলিশ বিভাগ, বিচার ব্যবস্থা প্রভৃতির সঙ্গে যুক্ত লোকজন ছাড়াও পেশাদার ব্যাংকের মালিক, বণিক, মহাজন, কবি সাহিত্যিক, দরবেশ, হাকিম, বৈদ্য প্রমুখ এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল।
প্রশ্ন7. কবে, কাদের উদ্যোগে কলকাতায় হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়?
উত্তর-১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে ডেভিড হেয়ার, রাজা রামমোহন রায়, বর্ধমানের মহারাজা তেজচন্দ্র রায়, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, বদ্দিনাথ মুখোপাধ্যায়, রাজা রাধাকান্ত দেব, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়, স্যার এডওয়ার্ড হাইড ইস্ট প্রমুখের উদ্যোগে কলকাতায় হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। অবশ্য হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায় রামমোহন রায়ের অবদানের কথা ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার অস্বীকার করেছেন।
প্রশ্ন8. আলেকজান্ডার ডাফ কে ছিলেন?
উত্তর-আলেকজান্ডার ডাফ ছিলেন একজন স্কটিশ মিশনারি। তিনি ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটাতে উদ্যোগ নেন এবং কলকাতায় স্কটিশ চার্চ কলেজ স্থাপন করেন।
প্রশ্ন9. কে. কবে ‘কলকাতা স্কুল সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর- ডেভিড হেয়ার ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর ‘কলকাতা স্কুল সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রশ্ন10. ভারতের ব্রিটিশ সরকার কবে, কার উদ্যোগে এদেশে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারকে সরকারি নীতি হিসেবে ঘোষণা করে?
উত্তর- ভারতের ব্রিটিশ সরকার ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে বড়োলটি লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের সহায়তায় এবং কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন-এর সভাপতি টমাস ব্যাবিংটন মেকলের উদ্যোগে এদেশে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারকে সরকারি নীতি হিসেবে ঘোষণা করে।
প্রশ্ন11. চুঁইয়ে পড়া নীতি বা ‘ক্রমনিম্ন পরিশ্রুত নীতি’ বলতে কী বোঝায়? অথবা, ‘টুইয়ে পড়া’ নীতি বলতে কী বোঝ?
উত্তর- কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন-এর সভাপতি মেকলে বলেন যে, ভারতে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটলে তা মধ্যবিত্তদের মাধ্যমে ক্রমে সাধারণ জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। মেকলের এই পরিকল্পিত নীতি ‘চুঁইয়ে পড়া নীতি’ বা ‘ক্রমনিম্ন পরিশ্রুত নীতি’ (Downward Filtration Theory) নামে পরিচিত।
প্রশ্ন12. উড-এর ডেসপ্যাচ কী?
উত্তর- ভারতে ব্রিটিশ সরকারের বোর্ড অব কন্ট্রোলের সভাপতি চার্লস উড ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষা সংক্রান্ত এক নির্দেশনামা প্রকাশ করেন যা ‘উড-এর ডেসপ্যাচ’ (Wood’s Despatch) নামে পরিচিত। এই নির্দেশনামা অনুসারে আধুনিক ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।
প্রশ্ন13. ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের কয়েকজন সমাজ ও ধর্মসংস্কারকের নাম লেখো।
উত্তর- ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য সমাজ ও ধর্মসংস্কারক ছিলেন রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র সেন, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্যোতিবা ফুলে, নারায়ণ গুরু, বীরসালিঙ্গম, স্যার সৈয়দ আহমেদ খান প্রমুখ।
প্রশ্ন14. কে, কবে আত্মীয় সভা প্রতিষ্ঠা করেন? এই সভার উল্লেখযোগ্য সদস্য কারা ছিলেন?
উত্তর- রাজা রামমোহন রায় ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় আত্মীয় সভা প্রতিষ্ঠা করেন। আত্মীয় সভার সদস্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, নন্দকিশোর বসু, রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ প্রমুখ।
প্রশ্ন15. ব্রাহ্মসভা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী ছিল?
উত্তর- ব্রাহ্মসভা প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পৌত্তলিকতা ত্যাগ করে নিরাকার পরম ব্রহ্মের উপাসনা। ব্রাহ্মসভা ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ‘ব্রাহ্মসমাজ’ নাম ধারণ করে।
প্রশ্ন16. কে, কবে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করেন?
উত্তর- রাজা রামমোহন রায়ের সহায়তায় বড়োলাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর এক আইনের মাধ্যমে সতীদাহপ্রথা নিষিদ্ধ করেন।
প্রশ্ন17. রাজা রামমোহন রায় কর্তৃক প্রকাশিত দুটি সংবাদপত্রের নাম লেখো।
উত্তর- রাজা রামমোহন রায় কর্তৃক প্রকাশিত দুটি সংবাদপত্র হল বাংলা ভাষায় ‘সম্বাদ কৌমুদী’ (১৮২১ খ্রি.) এবং ফারসি ভাষায় ‘মিরাৎ-উল-আখবর’ (১৮২২ খ্রি.)।
প্রশ্ন18. কেশবচন্দ্র সেন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি সংগঠনের নাম লেখো।
উত্তর- কেশবচন্দ্র সেন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি সংগঠন হল ‘ব্রাহ্মবন্ধু সভা’ (১৮৬০ খ্রি.), ‘সংগত সভা’ (১৮৬০ খ্রি.), ‘ক্যালকাটা কলেজ’ (১৮৬২ খ্রি.), ‘বামাবোধিনী সভা’ (১৮৬৩ খ্রি.), ‘ব্রাত্মিকা সমাজ’ (১৮৬৫ খ্রি.) প্রভৃতি।
প্রশ্ন19. কবে, কাদের উদ্যোগে ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়?
উত্তর- দেবেন্দ্রনাথ কর্তৃক বহিষ্কৃত হওয়ার পর কেশবচন্দ্র সেন ও তাঁর অনুগামী শিবনাথ শাস্ত্রী, রামকুমার বিদ্যারত্ন, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, শশীপদ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রশ্ন20. কবে, কারা ‘সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর- শিবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, দুর্গামোহন দাস প্রমুখ তরুণ ব্রাহ্ম ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের ১৫ মে ‘সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রশ্ন21. ‘নববিধান’ কী? কে, কবে এই নীতি ঘোষণা করেন। অথবা, নববিধান কী?
উত্তর- সর্বধর্ম সমন্বয়ের আদর্শ হল ‘নববিধান’। ব্রাহ্ম আন্দোলনের নেতা কেশবচন্দ্র সেন ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে ‘নববিধান’ ঘোষণা করেন।
প্রশ্ন22. নব্যবঙ্গ আন্দোলন বলতে কী বোঝায়? অথবা, নব্যবঙ্গীয় কারা?
অথবা, ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলন বলতে কী বোঝ?
উত্তর- উনিশ শতকে ডিরোজিওর নেতৃত্বে একদল তরুণ পুরোনো যুক্তিহীন এবং প্রচলিত হিন্দুধর্মের কুসংস্কারগুলি অন্যায় সামাজিক প্রথাগুলিকে সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলে নতুন সমাজ করেন। এই তরুণরা ইয়ং বেঙ্গল বা নব্যবঙ্গ তাঁদের আন্দোলন ‘নব্যবঙ্গ আন্দোলন’ নামে পরিচিত।
প্রশ্ন23. কে, কবে আকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠানের মুখপত্রের নাম কী ছিল?
উত্তর- হয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের নেতা হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দ্ধে ইয়াং কোমল আলোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠানের মুখপত্রের নাম লি ‘এথেনিয়াম’।
প্রশ্ন24. কে, কবে ‘পার্থেনন’ পত্রিকাটি প্রকাশ করেন।
উত্তর- রাখে বিজ্ঞান আন্দোলনের অন্যতম নেতা ডিরোজিও ও তাঁর ছাত্ররা মিলে ১৮৩০ খ্রিস্টায়ে ‘পার্থেনন’ নামে পত্রিকাটি প্রকাশ করেন।
প্রশ্ন25. ডিরোজিও-র উদ্যোগে প্রকাশিত কয়েকটি
উত্তর- ডিরোজিও-র উদ্যোগে প্রকাশিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংবাদপত্র ছিল ‘এথেনিয়াম জিমেনিন’, ‘ক্যালাইডোস্কোপ’, ‘হেসপেরাস’, ‘ক্যালকাটা লিটারারি গেজেট’ প্রভৃতি।
প্রশ্ন26 সংবাদপত্রের নাম লেখোং ইয়ং বেলাল আন্দোলনের অন্যতম কয়েকজন সদস্যের নাম লেখো।
উত্তর- ডিরোজিও-র অনুপামী এবং ইয়ং বেঙ্গল আপোলান্ডের মিত্র, কিশোরীচাঁদ মিতা ছিলেন ডিরোজিওর অনুগামীর, রামগোপাল ঘোষ, প্যারীচাঁদ মিত্র, কিলোমি কয়মোহন ফণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রসিককৃয় মল্লিক, তারাচাঁদ চক্রবর্তী, শিবচন্দ্র দে প্রমুখ।
প্রশ্ন27. ডিরোজিও-র অনুগামীদের প্রকাশিত কয়েকটি সংবাদপত্রের
উত্তর- ডিরোজিও-র অনুগামীদের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পত্রিকা হল ‘জ্ঞানান্বেষণ ‘এনকোয়ারার’, ‘বেঙ্গল স্পেকটেটর’, ‘হিন্দু পাইওনিয়ার’ প্রভৃতি।
প্রশ্ন28. ডিরোজিওর নামলোমাদের প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি সংগঠনের নাম লেখো।
উত্তর- ডিরোজিওর অনুগামীদের প্রতিষ্ঠিত সংগঠনগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ‘সাধারণ ডিনোপার্জনী সভা’ (১৮৩৬ খ্রি.) এবং ‘বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি’ (১৮৪৩ খ্রি.)।
প্রশ্ন29. ভারতের কোন সন্ন্যাসী কবে শিকাগোর বিশ্বধর্ম সম্মেলনে অদ্বৈত বেদান্তবাদের জয় ঘোষণা করেন?
উত্তর- ভারতের স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে শিকাগোর বিশ্বধর্ম সম্মেলনে অদ্বৈত বেদান্তবাদের জয় ঘোষণা করেন।
প্রশ্ন30. কে. কী উদ্দেশ্যে রামকৃয় মিশন প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর- স্বামী বিবেকানন্দ মানবিক আদর্শ ও সমাজ কল্যাণের উদ্দেশ্যে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১মে রামকৃয় মিশন প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রশ্ন31. কে. কবে বিধবাবিবাহ আইন পাস করেন? অথবা, হিন্দু বিধবা পুনর্বিবাহ আইন কোন্ সালে প্রবর্তিত হয়?
উত্তর- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সহায়তায় বড়োলাট লর্ড ডালহৌসি ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জুলাই হিন্দু বিধবা পুনর্বিবাহ আইন বা বিধবাবিবাহ আইন পাস করেন।
প্রশ্ন32. বাংলায় প্রথম কবে, কাদের মধ্যে বিধবাবিবাহ অনুষ্ঠিত হয়?
উত্তর- বাংলায় প্রথম ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে (৭ ডিসেম্বর) শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন ও কালীমতী দেবীর মধে বিধবাবিবাহ অনুষ্ঠিত হয়।
প্রশ্ন33. কে, কাকে ‘একজন ঐতিহ্যবাহী আধুনিকতাবাদের প্রবক্তা’ বলে অভিহিত করেছেন?
উত্তর- ঐতিহাসিক ড. অমলেশ ত্রিপাঠী পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে ‘একজন ঐতিহ্যবাহী আধুনিকতাবাদের প্রবত্ত্বা’ বলে অভিহিত করেছেন।
প্রশ্ন34. উপনিবেশিক আমলে বাংলার বাইরে সমাজসংস্কার আন্দোলনের কয়েকজন নেতার নাম লেখো।
উত্তর- ঔপনিবেশিক আমলে বাংলার বাইরে সমাজসংস্কার আন্দোলনের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য নেতা ছিলেন জ্যোতিবা ফুলে, শ্রীনারায়ণ গুরু, বীরসালিঙ্গম, স্যার সৈয়দ আহমেদ খান প্রমুখ।
প্রশ্ন35. প্রার্থনা সমাজ কে প্রতিষ্ঠা করেন?
অথবা, প্রার্থনা সমাজ কবে প্রতিষ্ঠিত হয়?
উত্তর- মহারাষ্ট্রের সমাজসংস্কারক আত্মারাম পান্ডুরঙ্গ ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে মহারাষ্ট্রে ‘প্রার্থনা সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রশ্ন36. কে, কবে প্রার্থনা সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন? এই সমাজের অন্য দুজন নেতার নাম লেখো।
উত্তর- মহারাষ্ট্রের সমাজসংস্কারক আত্মারাম পান্ডুরঙ্গ ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে মহারাষ্ট্রে ‘প্রার্থনা সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই সমাজের অন্য দুজন নেতা ছিলেন বিচারপতি মহাদেব গোবিন্দ রানাডে ও ঐতিহাসিক রামকৃয় ভান্ডারকর।
প্রশ্ন37. কে, কবে দাক্ষিণাত্য শিক্ষাসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন? এই সমাজের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত দুটি কলেজের নাম লেখো।
উত্তর- প্রার্থনা সমাজের অন্যতম নেতা মহাদেব গোবিন্দ রানাডে ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে ‘দাক্ষিণাত্য শিক্ষাসমাজ’ বা ডেকান এডুকেশন সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই সমাজের উদ্যোগে পুনার ‘ফারগুসন কলেজ’ (১৮৮৫ খ্রি.) এবং সাংলি-র ‘উইলিংডন কলেজ’ (১৯১৯ খ্রি.) প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রশ্ন38. কে, কবে, কোথায় ‘সর্বজনিক সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর- প্রার্থনা সমাজের অন্যতম নেতা মহাদেব গোবিন্দ রানাডে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে পুনায় ‘সর্বজনিক সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রশ্ন39. দাদোবা পরমহংসমণ্ডলী সমাজ কে কোন সালে গঠন করেন?
উত্তর- দাদোবা পাণ্ডুরঙ্গ, মেহতাজি দুর্গারাম এবং তাঁদের কতিপয় সঙ্গী মিলে ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে সুরাটে দাদোবা পরমহংসমণ্ডলী সমাজ গঠন করেন।
প্রশ্ন40. কারা, কবে এবং কোথায় প্রথম থিওসফিক্যাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর- হেলেনা ব্লাভাটস্কি, কর্নেল এইচ, এস, ওলকট ও উইলিয়াম কোয়ান জাজ ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে ‘থিওসফিক্যাল সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রশ্ন41. কে, কবে আর্যসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন?
অথবা, আর্যসমাজ কবে প্রতিষ্ঠিত হয়?
উত্তর- মহারাষ্ট্রের অন্যতম সমাজসংস্কারক স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে (৭ এপ্রিল) বোম্বাইতে ‘আর্যসমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রশ্ন42. স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর পরবর্তীকালে আর্যসমাজের কয়েকজন নেতার নাম লেখো।
উত্তর- স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর পরবর্তীকালে আর্যসমাজের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য নেতা ছিলেন লালা হংসরাজ, পন্ডিত গুরু দত্ত, লালা লাজপত রায়, স্বামী শ্রদ্ধানন্দ।
প্রশ্ন43. ‘Home for Prevention of Infanticide’ প্রতিষ্ঠান কে, কবে গঠন করে?
উত্তর- ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে জ্যোতিবা গোবিন্দরাও ফুলে এবং তাঁর স্ত্রী সাবিত্রীবাঈ ‘Home for Prevention of Infanticide’ গঠন করেন।
প্রশ্ন44. কে, কবে ‘সত্যশোধক সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং এই সমাজের মুখপত্রের নাম কী ছিল?
উত্তর- মহারাষ্ট্রের সমাজসংস্কারক জ্যোতিবা ফুলে ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে সত্যশোধক সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। এই সমাজের মুখপত্রের নাম ছিল ‘দীনমিত্র’।
প্রশ্ন45. আলিগড় আন্দোলন বলতে কী বোঝায়?
উত্তর- বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে স্যার সৈয়দ আহমদ খান মুসলিম সমাজের মধ্যে শিক্ষার প্রতি করেন। তিনি যে আলিগড় প্রতিষ্ঠা করেন তাকে কেন্দ্র করে মুসলিম সমাজের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চিন্তাধারা বিবর্তিত হয়। মুসলিম সমাজের এই জাগরণ ‘আলিগড় আন্দোলন’ নামে পরিচিত।
প্রশ্ন46. আলিগড় আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বিশিষ্ট কয়েকজন নেতার নাম লেখো।
উত্তর- আলিগড় আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বিশিষ্ট কয়েকজন নেতা ছিলেন চিরাগ আলি, আলতাফ হোসেন আলি, মৌলানা শিবলি নোমানি, নাজির আহম্মদ, কবি হালি, শিক্ষাবিদ খুদাবস্থ প্রমুখ।
প্রশ্ন47. ‘তিন আইন’ কী? এটি কবে পাস হয়? অথবা, তিন আইন কী?
উত্তর- ব্রিটিশ সরকার ভারতে বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করা এবং অসবর্ণ বিবাহের স্বীকৃতি দিয়ে একটি আইন পাস করে। এটি ‘তিন আইন’ নামে পরিচিত। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে তিন আইন পাস হয়।
প্রশ্ন48. কবে, কোথায় অকালি আন্দোলন শুরু হয়? এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য কী ছিল?
উত্তর- ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবে অকালি আন্দোলন শুরু হয়। অকালি আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল শিখদের ধর্মীয় স্থান- গুরুদ্ধারগুলির দুর্নীতি দূর করে সৎ ধর্মীয় পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করা।
প্রশ্ন49. কবে, কাদের উদ্যোগে ‘রেহনুমাই মাজদায়াসন সভা’ বা ধর্মসংস্কার সভা প্রতিষ্ঠিত হয়?
উত্তর- মহারাষ্ট্রের পারসি সমাজসংস্কারক নওরোজি ফার্টুনজি, দাদাভাই নওরোজি, এস. এস. বেঙ্গলি প্রমুখের উদ্যোগে ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে ‘রেহনুমাই মাজদায়াসন সভা’ বা ধর্মসংস্কার সভা প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রশ্ন50. সরকার কবে, কার সহায়তায় বিবাহ সম্মতি আইন পাস করে?
উত্তর- সরকার ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে পারসি সংস্কারক বেহরামজি মেরওয়ানজি মালাবারির সহায়তায় বিবাহ সম্মতি আইন পাস করে।
প্রশ্ন51. প্রাচ্যবাদী বা ওরিয়েন্টালিস্ট নামে কারা পরিচিত? অথবা, প্রাচ্যবাদী কাদের বলা হয়?
উত্তর- ভারতে ব্রিটিশ শাসনকালে এইচ. টি. প্রিন্সেপ, কোলব্রুক, উইলিয়াম প্রমুখ উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মচারীগণ ভারতে প্রাচ্য রীতিতে শিক্ষাদানের পক্ষপাতী ছিলেন। এরা প্রাচ্যবাদী বা ওরিয়েন্টালিস্ট নামে পরিচিত।
প্রশ্ন52. পাশ্চাত্যবাদী বা অ্যাংলিসিস্ট নামে কারা পরিচিত ছিল?
উত্তর- ভারতে ব্রিটিশ শাসনকালে মেকলে, আলেকজান্ডার ডাফ, স্যান্ডার্স, ক্যালভিন প্রমুখ উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মচারীগণ ভারতে পাশ্চাত্য রীতিতে শিক্ষাদানের পক্ষপাতী ছিলেন। এরা পাশ্চাত্যবাদী বা অ্যাংলিসিস্ট নামে পরিচিত।
প্রশ্ন53. মেকলের ‘মিনিট’ কী?
উত্তর- বোর্ড অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশনের সভাপতি মেকলে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে বড়োলাট লর্ড বেন্টিষ্কের কাছে একটি প্রস্তাব পেশ করে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার সমর্থনে সরাসরি মত প্রকাশ করেন। মেকলের এই প্রস্তাব মেকলের ‘মিনিট’ নামে পরিচিত।
প্রশ্ন54. কোন্ গভর্নর জেনারেল ‘অ্যাংলিসিস্ট-ওরিয়েন্টালিস্ট বির্তক’-এর অবসান ঘটান?
উত্তর- গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ইংরেজি শিক্ষার প্রসারকে কেন্দ্র করে অ্যাংলিসিস্ট বা পাশ্চাত্যবাদী এবং ওরিয়েন্টালিস্ট অর্থাৎ প্রাচ্যবাদীদের মধ্যেকার বির্তকের অবসান ঘটান।
প্রশ্ন55. চালর্স উড কে ছিলেন?
উত্তর- ভারতে ব্রিটিশ সরকারের বোর্ড অব কন্ট্রোলের সভাপতি ছিলেন চালর্স উড। তিনি এদেশের সরকারি শিক্ষা নীতির ওপর ‘উডের ডেসপ্যাচ’ নামক এক পরিকল্পনা পেশ করেছিলেন।
প্রশ্ন56. সৈয়দ আহমেদ ছাড়া আলিগড় আন্দোলনের কয়েকজন নেতার নাম লেখো।
উত্তর- সৈয়দ আহমেদ ছাড়া আলিগড় আন্দোলনের কয়েকজন নেতা হলেন-আলি মৌলানা শিবলি নোমানি, কবি হালি, আলতাফ হোসেন, শিক্ষাবিদ খুদাবক্স, চিরাগ আলি, নাজির আহমেদ প্রমুখ।
প্রশ্ন57. একেশ্বরবাদকে সমর্থন জানিয়ে রামমোহন যে পুস্তিকাটি লেখেন তার নাম কী?
উত্তর- একেশ্বরবাদকে সমর্থন জানিয়ে রামমোহন যে পুস্তিকাটি লেখেন তার নাম হল ‘তুহুফৎ উল-মুয়াহিদ্দিন’।
প্রশ্ন58. ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জনক, আধুনিক ভারতের জনক, ভারত পথিক, ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ ইত্যাদি অভিধায় কোন্ ভারতীয়কে ভূষিত করা হয়েছে?
উত্তর- ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জনক, আধুনিক ভারতের জনক, ভারত পথিক, ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ ইত্যাদি অভিধায় রাজা রামমোহন রায়কে ভূষিত করা হয়েছে।
প্রশ্ন59. কারা, কোথায় প্রথম থিওসফিক্যাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর- ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের বাসিন্দা বুশ মহিলা মাদাম ব্লাডাটদ্ধি ও ব্রিটিশ সামরিক অফিসার কর্নেল ওলকট নিউইয়র্কে থিওসফিক্যাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রশ্ন60. কারা ভারতে থিওসফিক্যাল সোসাইটির শাখা প্রতিষ্ঠা করেন।
উত্তর- মাদাম ব্রাভাটস্কি ও কর্নেল ওলকট ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজের আদিয়ার-এ থিওসফিক্যাল সোসাইটির শাখা প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রশ্ন61, কে, কোথায় ‘বেনারস সেন্ট্রাল হিন্দু স্কুল’ স্থাপন করেন?
উত্তর- অ্যানি বেসান্ত নিজে বারাণসীতে ‘বেনারস সেন্ট্রাল হিন্দু স্কুল’ (পরবর্তীকালের বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি) স্থাপন করেন।
প্রশ্ন62 ব্রিটিশ আমলে ভারতীয় সমাজে কৃষিপ্রধান যে নতুন সামাজিক শ্রেণিগুলির উদ্ভব ঘটে তাদের পরিচয় দাও।
উত্তর- নতুন সামাজিক শ্রেণিগুলির মধ্যে ছিল-[i] গ্রামে জমিদার, বণিক, মহাজন শ্রেণি আর (ii) শহরে পুঁজিপতি (শিল্প কলকারখানার মালিক, ব্যবসায়ী), রেলপরিবহণ ব্যবস্থা ও খনিতে নিযুক্ত কর্মচারী এবং চিকিৎসক, শিক্ষক, আইনজীবী, প্রযুক্তিবিদ, কেরানি প্রভৃতি।
প্রশ্ন63. দেবদাসী প্রথা কী?
উত্তর- ছোটোবেলা থেকে অবিবাহিত নারীদের মন্দিরে দেবতাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হত এবং এরা নাচগানের মধ্য দিয়ে দেবতাদের তুষ্ট করত। মন্দিরে এভাবে নারীদের নিয়োজিত করার প্রথার নাম ছিল দেবদাসী প্রথা।
প্রশ্ন64. প্রার্থনা সমাজের কর্মসূচি কী ছিল?
উত্তর- প্রার্থনা সমাজের মূলকর্মসূচিগুলি ছিল অস্পৃশ্যতা বর্জন, পর্দাপ্রথা বর্জন, বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ রদ, মদ্যপান নিবারণ, সমাজের দুস্থদের উন্নয়ন, স্ত্রীশিক্ষার প্রসার, নারীমুক্তির আদর্শ প্রচার এবং শিশু সদন, অনাথ আশ্রম, বিধবা আশ্রম, চিকিৎসালয় স্থাপন প্রভৃতি।
প্রশ্ন65. কাকে ‘বাংলা গদ্যসাহিত্যের জনক’ বলা হয়?
উত্তর- রাজা রামমোহন রায়কে ‘বাংলা গদ্যসাহিত্যের জনক’ বলা হয় কারণ তিনি একেশ্বরবাদের প্রস্তাবের জন্য বাংলা পুস্তিকা রচনা, উপনিবেশের বাংলা অনুবাদ প্রভৃতির মাধ্যমে বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশ ঘটান।
প্রশ্ন66. মহাজনরা গ্রামীণ জীবনে কী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে?
উত্তর- ঊনবিংশ শতকে ক্রমশ ভারতীয় সমাজজীবনে মহাজনদের প্রভাব বাড়তে থাকে। ফলে তারা গ্রামজীবনে উচ্চশ্রেণি বা এলিট শ্রেণি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। মহাজন শ্রেণির ব্যাপক উত্থানের ফলে গ্রামীণ অর্থনৈতিক কাঠামোয় যে পরিবর্তন ঘটে তা গ্রাম-সমাজের প্রচলিত কাঠামোয় ফাটল সৃষ্টি করে।
প্রশ্ন67. পতিদার কাদের বলা হত?
অথবা, পতিদার কাদের বলা হয়?
উত্তর- গুজরাটের একটি স্থানীয় মোড়ল বা আধিপত্যকারী সম্প্রদায় ছিল পতিদার। এখানে গ্রামের যৌথ ভূমি ‘পতি’ নামে পরিচিত ছিল। আর ভূমিরাজস্ব আদায়কারীরা পরিচিত হত ‘পতিদার’ নামে। গুজরাটে কুনবিরা সাধারণত পতিদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করত।
প্রশ্ন68. জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার ফলে পতিদার-বিরোধী আন্দোলনের কী অবস্থা হয়েছিল?
উত্তর- ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পরবর্তীকালে গুজরাটের পতিদার-বিরোধী সম্প্রদায়গুলি উপলব্ধি করেছিল যে, পতিদাররাই হল সেখানকার কংগ্রেসের ভিত্তি। পতিদারদের কংগ্রেস-ঘনিষ্ঠতার ফলে পতিদার-বিরোধী সম্প্রদায় ‘স্বতন্ত্র পার্টি’র সমর্থকে পরিণত হয়েছিল।
প্রশ্ন69. কয়েকটি মহাজনি সম্প্রদায়ের উল্লেখ করো।
উত্তর- ভারতবর্ষের নানা অঞ্চলে মহাজনি সম্প্রদায় বাস করত। উত্তরপ্রদেশ ও পাঞ্জাবে ক্ষত্রী, গুজরাটে বানিয়া, রাজস্থানে মাড়োয়ারি, তামিলনাডুতে চেট্টিয়ার, বাংলায় সাহা ও বণিক প্রভৃতি সম্প্রদায় মহাজনি সম্প্রদায় নামে পরিচিত।
প্রশ্ন70. কারা ভাগচাষি নামে পরিচিত?
উত্তর- কৃষক সমাজের দ্বিতীয় স্তরে অবস্থান করত বর্গাদার বা ভাগচাষিরা। ধনী কৃষকরা সরাসরি জমি চাষ না করে এদের চাষের দায়িত্ব দিতেন। আসলে, এরা ছিল দরিদ্র কৃষক। মহাজনের ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে মহাজনরা তাদের জমিজমা কেড়ে নেয়। ফলে তারা ভাগচাষিতে পরিণত হয়।
প্রশ্ন71. ব্রিটিশ আমলে শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন বামপন্থী নেতার নাম লেখো।
উত্তর- ব্রিটিশ আমলে শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন বামপন্থী নেতা ছিলেন মুজাফ্ফর আহমেদ, শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে, পি. সি. যোশি, হেমন্তকুমার সরকার, কবি নজরুল ইসলাম প্রমুখ।
প্রশ্ন72. কবে, কাদের মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসানো হয়?
উত্তর- সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে (২০ মার্চ) ৩৩ জন শ্রমিক নেতাকে গ্রেপ্তার করে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসানো হয়। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মুজাফ্ফর আহমেদ, এস. এ. ডাঙ্গে, পি. সি. যোশি, মীরাজকর, গঙ্গাধর অধিকারী, শিবনাথ ব্যানার্জি, ধরণী গোস্বামী, বেঞ্জামিন ব্রাডলি, ফিলিপ স্প্যাট প্রমুখ।
প্রশ্ন73. ভারতে কীভাবে আধুনিক শিল্পের সূচনা ঘটে?
উত্তর- ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে বিভিন্ন উদ্যোগে ভারতে আধুনিক শিল্পের সূচনা ঘটে। প্রথমদিকে ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের উদ্যোগে এবং পরে ভারতীয় পুঁজিপতিদের উদ্যোগে ভারতে লৌহ-ইস্পাত, কাগজ, চা, পাট, কয়লা, সুতিবস্ত্র, সিমেন্ট, কাচ, দেশলাই, রাসায়নিক শিল্পের বিকাশ ঘটে।
প্রশ্ন74. শ্রমিকদের অর্থনৈতিক দুরবস্থার ফল কী হয়েছিল?
উত্তর- শ্রমিকদের কম মজুরি, তাদের ওপর বিপুল করের বোঝা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রভৃতি তাদের অর্থনৈতিক সংকটের পথে ঠেলে দেয়। ফলে শ্রমিকরা ক্ষুদ্ধ হয়। শ্রমিক অসন্তোষের ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে ভারতের শ্রমিকরা আন্দোলনের পথে পা বাড়ায়।
4. Long Question Answer
প্রশ্ন1. ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভবের প্রেক্ষাপট আলোচনা করো।
অথবা, ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থানের কারণগুলি লেখো।
সূচনা: ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধে ব্রিটিশ শক্তির জয়লাভের পরবর্তীকালে ভারতের সমাজ ও অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব। এই সময় মোটামুটি সচ্ছল আর্থিক অবস্থাসম্পন্ন ও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত যে শ্রেণির উদ্ভব ঘটে তাকে সাধারণভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বলা হয়।
ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভবের প্রেক্ষাপট
1 সরকারি চাকরি: ভারতে প্রায় ১০০ বছর ধরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ধারাবাহিক প্রসারের সূত্রে এদেশে প্রশাসনের কাজকর্ম পরিচালনার জন্য এত বিপুল সংখ্যক কর্মচারীর প্রয়োজন ছিল যে, বিলেত থেকে তা আনা সম্ভব ছিল না। তাই প্রশাসনের নিম্নস্তরের বিপুল সংখ্যক চাকরির পদে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতীয়রা নিযুক্ত হওয়ার সুযোগ পায়। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত এবং আর্থিকভাবে সচ্ছল এই ভারতীয় কর্মচারীরা মধ্যবিত্ত শ্রেণি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
2 আইনজীবী: সাম্রাজ্যের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজরা এদেশে পাশ্চাত্য ধাঁচের আইন ও বিচারব্যবস্থার প্রবর্তন করে। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বহু ভারতীয় অত্যন্ত লাভজনক আইনের পেশা গ্রহণ করে। ব্রিটিশ- ভারতের আদালতগুলিতে আমলা, উকিল, মোক্তার, কেরানি, মুহুরি ও অন্যান্য বিভিন্ন কাজে শিক্ষিত ভারতীয়রা নিযুক্ত হতে থাকে। এই পেশায় প্রবেশ করে তাদের আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটে। শিক্ষিত ও সচ্ছল এই ভারতীয় সম্প্রদায় মধ্যবিত্ত শ্রেণি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
3 করণিকের কাজ: ইংরেজরা ভারতে তাদের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করার পর এদেশে প্রচুর স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত, হাসপাতাল প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করে। এসব প্রতিষ্ঠানে করণিক পদে প্রচুর সংখ্যক ইংরেজি শিক্ষিত ভারতীয় কর্মচারীর প্রয়োজন হয়। সরকারি বেতনভুক্ত এই নিম্নবর্গের করণিকগণ মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল।
4 সামরিক বিভাগের কর্মী: ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সামরিক বিভাগের উচ্চপদগুলি ইংরেজদের জন্য নির্ধারিত হলেও নিম্ন পদগুলিতে বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত ভারতীয় নিযুক্ত হয়। সরকারি বেতনভুক্ত সচ্ছল এই কর্মচারীরা মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হয়।
5 ব্যবসায়ী: বাণিজ্যের প্রসার ঘটানোর উদ্দেশ্যে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী ও ব্যক্তিগত ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা ভারতের দূরদূরান্তের গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে। এই বিশালাকার বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার জন্য প্রচুর কর্মচারীর প্রয়োজন ছিল। ব্রিটিশ বণিক ও পুঁজিপতিরা তাদের বাণিজ্যিক কাজকর্ম সচল রাখতে বহু শিক্ষিত ভারতীয়কে বিভিন্ন পদে নিয়োগ করে। বাণিজ্যের কাজে নিযুক্ত এসব ভারতীয়রা মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হয়।
6 শিল্পের কাজ: ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে শিল্পের যথেষ্ট বিকাশ ঘটে। শিল্প ও শিল্পকারখানাগুলির কাজকর্ম পরিচালনার জন্য প্রচুর শিক্ষিত ভারতীয় কর্মচারী নিযুক্ত হয়। শিল্পের কাজে নিযুক্ত এসব শিক্ষিত ভারতীয়রা মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্যতম অংশ ছিল।
7 ভূস্বামী ও মধ্যস্বত্বভোগী: ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে কিছু জমিদার বা ভূস্বামী শ্রেণির অস্তিত্ব ছিল। তারা প্রধানত প্রজাদের কাছ থেকে কর আদায় করত। ভূস্বামীর পক্ষ থেকে প্রজার কাছ থেকে কর আদায়ের কাজটি করত মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির বহু মানুষ। বিপুল অর্থের অধিকারী এই জমিদার, ভূস্বামী ও মধ্যস্বত্বভোগীরা ইংরেজদের অনুগত শ্রেণি হিসেবে নিজেদের পেশা ও উপার্জনকে সুনিশ্চিত করেছিল এবং পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণেও এগিয়ে এসেছিল।
৪ মহাজন: ব্রিটিশ সরকার এদেশে চিরস্থায়ী, রায়তওয়ারি, মহলওয়ারি প্রভৃতি ভূমি বন্দোবস্ত চালু করলে ভূস্বামী ও মধ্যস্বত্বভোগীদের রাজস্বের চাপে দরিদ্র কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। নগদ কর আদায়ের উদ্দেশ্যে কৃষকরা মহাজনদের কাছ থেকে অর্থ ঋণ নিতে বাধ্য হয়। ব্রিটিশ শাসনের অনুগামী এই মহাজন শ্রেণি ভারতীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণির অংশ ছিল।
উপসংহার: ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে তারা সংখ্যায় খুবই অল্প হলেও দেশের সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে এই শ্রেণি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ও জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ এই শ্রেণিই মূলত ভারতের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করেছিল। আবার উনিশ শতকে বাংলায় যে, ‘নবজাগরণ’ ঘটেছিল তার অগ্রভাগে ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভূমিকা।
প্রশ্ন2. উনিশ শতকে ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভবের কারণ কী? ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বিকাশে এই শ্রেণির অবদান আলোচনা করো।
উনিশ শতকে ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভবের কারণ
TOPIC [A] -এর 1 নং রচনাধর্মী প্রশ্নের উত্তরের 1-6 নং পয়েন্ট দ্যাখো।
জাতীয়তাবাদ বিকাশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অবদান
1 মূল অবদান: পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণি সংখ্যার বিচারে খুব সামান্য হলেও তারাই পরবর্তীকালে ভারতে ব্রিটিশবিরোধী জাতীয় আন্দোলনের মেরুদণ্ড হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য এ আর দেশাই ভারতের মধ্যবিত্তদের ‘আধুনিক ভারতের স্রষ্টা’ বলে অভিহিত করেছেন। আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণের ফলে তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকশিত হয় এবং ব্রিটিশদের অপশাসনের বিরুদ্ধে তাদের জ্ঞানের চোখ খুলে যায়। মূলত এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিই সর্বপ্রথম ব্রিটিশ শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় এবং নিজেদের গণতান্ত্রিক দাবিদাওয়া আদায়ের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সভাসমিতি গড়ে তোলে। ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে তারা প্রথম পর্বে পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করে ভারতের ব্রিটিশ শাসন ও সভ্যতার একনিষ্ঠ অনুরাগীতে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিই ভারতে সর্বপ্রথম ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সরব হয়ে প্রতিরোধের ডাক দেয় এবং গণ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসে। এইভাবেই মধ্যবিত্ত শ্রেণির হাত ধরে জাতীয়তাবাদের বিকাশ শুরু হয়।
2 অন্য়ান্য়
i. জাতীয় ঐক্য: মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে পাশ্চাত্য ও ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের ফলে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের জাতীয় স্তরের নেতৃবৃন্দের মধ্যে যোগাযোগ ও ঐক্য স্থাপিত হয়। ইংরেজি ভাষা এই ঐক্যের বন্ধন হিসেবে কাজ করে। এর ফলে ইন্ডিয়ান লিগ এবং ইন্ডিয়ান বন্ধন হিসেবেনের মতো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উ
ii. প্রগতিশীলতা: মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় প্রভৃতি বিষয়ে প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা গড়ে ওঠে। এর ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মুক্তিবাদী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার পটভূমি তৈরি হয়।
iii. নবজাগরণ: মধ্যবিত্ত শ্রেণির মাধ্যমে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ভাবধারা ছড়িয়ে পড়লে ভারতের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনে বৈপ্লবিক অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়। এই ঘটনাকে অনেকে উনিশ শতকের ভারতীয় নবজাগরণ বলে অভিহিত করেছেন। বাংলায় এই নবজাগরণের সর্বাধিক প্রভাব পড়ে।
iv. জাতীয় আন্দোলন: মধ্যবিত্ত শ্রেণি ভারতে ব্রিটিশবিরোধী জাতীয় আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসে। মূলত তাদের নেতৃত্বেই ভারতে জাতীয়তাবাদী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এবং ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়।
প্রশ্ন3 ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার সম্পর্কে আলোচনা করো।
সূচনা: ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার আগে ভারতে পাঠশালা, টোল, মক্তব, মাদ্রাসা প্রভৃতি প্রাচীন ধাঁচের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আরবি, ফারসি ও সংস্কৃত ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান চলত। কিছু সাধারণ বিষয়ের প্রাথমিক জ্ঞান ও ধর্মীয় কাহিনি পাঠের মধ্যেই এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাদান সীমাবদ্ধ ছিল।
ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার
1 সরকারি অনিচ্ছা: ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার প্রথম পর্বে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মনে করত যে, পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে ভারতীয়দের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠবে এবং এদেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটবে। এজন্য কোম্পানি এদেশে সংস্কৃত ও আরবি-ফারসি শিক্ষাকেই উৎসাহ দেয়। এই উদ্দেশ্যে কলকাতা মাদ্রাসা (১৭৮১ খ্রি.), এশিয়াটিক ৭ সোসাইটি (১৭৮৪ খ্রি.), বারাণসী সংস্কৃত কলেজ (১৭৯১ খ্রি.), ফোর্ট – উইলিয়াম কলেজ (১৮০০ খ্রি.) প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়।
2 বিদেশিদের ব্যক্তিগত উদ্যোগ: ভারতে সর্বপ্রথম একটি সুসংবদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি জানান কোম্পানির অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী চালর্স গ্রান্ট। ক্রমে এদেশে ব্রিটিশ শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হলে সরকারি অফিস, আদালত, বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি স্থাপিত হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ভারতীয়দের ইংরেজি জ্ঞানের প্রয়োজন ছিল। সরকারি চাকরি লাভের জন্য মধ্যবিত্ত বাঙালি ইংরেজি শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হয়। এই চাহিদা মেটানোর জন্য কলকাতায় কিছু বিদেশি ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপন করে। এসব বিদ্যালয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল শোরবোর্ন, মার্টিন, বাউল, আরটুন পিট্রাস, ডেভিড ড্রামন্ড প্রমুখের প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়।
3 শ্রীরামপুর মিশনারিদের উদ্যোগ: ভারতে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে শ্রীরামপুরের খ্রিস্টান মিশনারি বা ধর্মপ্রচারকগণ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইংরেজি ও পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। মার্শম্যান, ওয়ার্ড ও উইলিয়াম কেরি ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুরে ব্যাপটিস্ট মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁদের উদ্যোগে বাংলা-সহ মোট ২৭টি ভারতীয় ভাষায় বাইবেল অনুদিত হয়। তাঁদের উদ্যোগে কলকাতা, পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন স্থান, এমনকি চুঁচুড়া, বর্ধমান, কালনা, বহরমপুর, মালদা এবং দক্ষিণ ভারতেও বহু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁদের উদ্যোগে শ্রীরামপুর কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় (১৮১৮ খ্রি.)।
4 অন্যান্য মিশনারিদের উদ্যোগ: লন্ডন মিশনারি সোসাইটি ও চার্চ মিশনারি সোসাইটির। তাদের উদ্যোগে বাংলার বিভিন্ন স্থান-সহ দক্ষিণ ভারতে বহু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। স্কটিশ মিশনারি আলেকজান্ডার ডাফ বেশ কয়েকটি ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এগুলির মধ্যে অন্যতম হল ‘জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশন’ (১৮৩০ খ্রি.)। এ ছাড়া মিশনারিদের উদ্যোগে শিবপুরে ‘বিশপ কলেজ’ (১৮২০ খ্রি.), ‘মাদ্রাজ খ্রিস্টান কলেজ’ (১৮৩৭ খ্রি.), বোম্বাই-এ ‘উইলসন কলেজ’ (১৮৩২ খ্রি.) প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়।
5 অন্যান্যদের উদ্যোগ: কলকাতায় রামমোহন রায় ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে ‘অ্যাংলো-হিন্দু স্কুল’ এবং ডেভিড হেয়ার ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে একটি ইংরেজি বিদ্যালয় (হেয়ার স্কুল) প্রতিষ্ঠা করেন। ডেভিড হেয়ার, রাধাকান্ত দেব, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখের উদ্যোগে কলকাতায় ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ডেভিড হেয়ারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ‘ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি’ (১৮১৭ খ্রি.) এবং ‘ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি’ (১৮১৮ খ্রি.) বিভিন্ন স্থানে ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও ইংরেজি পাঠ্যপুস্তক রচনায় সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে গঠিত ‘কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন’ বা ‘জনশিক্ষা কমিটি’র সদস্যরা কলকাতায় একটি সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে রামমোহন রায় তৎকালীন গর্ভনর জেনারেল লর্ড আমহার্স্টকে একটি চিঠি লিখে (১৮২৩ খ্রি.) সংস্কৃত শিক্ষার পরিবর্তে ভারতে আধুনিক বিজ্ঞান ও ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের দাবি জানান।
6 সরকারি ঘোষণা: ব্রিটিশ সরকারের কয়েকটি ঘোষণা ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে সহায়তা করে, যেমন- [i] ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের চার্টার আইনের দ্বারা ঘোষণা করে যে, ভারতীয় জনশিক্ষার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতি বছর ১ লক্ষ টাকা ব্যয় করবে। [ii] জনশিক্ষা কমিটি’র সভাপতি মেকলে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারকে সরকারি নীতি হিসেবে ঘোষণা করেন। [iii] উডের ডেসপ্যাচ (১৮৫৪ খ্রি.) অনুসারে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠে।
উপসংহার: ব্রিটিশ সরকার ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে, ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে লাহোরে, ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে এলাহাবাদে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলে এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষার আরও প্রসার ঘটে। ব্রিটিশ সরকার ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে হান্টার কমিশনের অনুসারে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারি অনুদান কমিয়ে দেয়। কিন্তু মধ্যবিত্তদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার বিপুল চাহিদা থাকায় বেসরকারি উদ্যোগে সারা ভারতে একাধিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে।
প্রশ্ন4. পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণে ঔপনিবেশিক ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্যোগ সম্পর্কে উল্লেখ করো। মধ্যবিত্ত শ্রেণির পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণের তাৎপর্য উল্লেখ করো।
পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণে ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্যোগ
ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার প্রথম পর্বে পাঠশালা, টোল, মক্তব, মাদ্রাসা প্রভৃতি শিক্ষাকেন্দ্রে প্রাচীন শিক্ষাদান প্রথা চালু ছিল। পরে খ্রিস্টান মিশনারি, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও বিভিন্ন প্রগতিশীল ব্যক্তির চেষ্টায় ভারতে প্রচুর শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে ওঠে। এসব প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি ও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা দান করা হত। ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণি পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণে সর্বপ্রথম উদ্যোগ নেয়।
1 অফিস-আদালতের প্রতিষ্ঠা: ভারতে ব্রিটিশ শাসনে সরকার এদেশে বহু অফিস-আদালত স্থাপন করে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ এসব অফিস-আদালতে সরকারি চাকরি লাভের আশায় আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণে তৎপর হয়ে ওঠে। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে তারা পাশ্চাত্যের সভ্যতা ও সংস্কৃতির অনুরাগী হয়ে ওঠে।
2 চাকরিতে অগ্রাধিকার: সরকারি চাকরিই ছিল ঔপনিবেশিক আমলে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত ভারতীয়দের প্রধান পেশা। ব্রিটিশ সরকার ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে ঘোষণা করে যে, চাকরির ক্ষেত্রে ইংরেজি জানা প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণি আরও বেশি করে ইংরেজি ও পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতি ঝুঁকে পড়ে।
3 ব্রিটিশ অনুরাগী: ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণকারী মধ্যবিত্ত শ্রেণির শিক্ষিত সম্প্রদায় ইংরেজ সরকারের সহযোগী ও সমর্থকে পরিণত হয়। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও ভূদেব মুখোপাধ্যায় ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেন। ডিরোজিও-র অনুগামী রামগোপাল ঘোষ ব্রিটিশ সরকারের চাকরি প্রত্যাখ্যান করলেও ভারতে ব্রিটিশ শাসনের স্থায়িত্বকে তিনি সমর্থন করতেন।
4 মধ্যবিত্তদের উদ্যোগ: পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বেশ কয়েকজন প্রগতিশীল ব্যক্তি ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন রামমোহন রায়, রাধাকান্ত দেব, রামকমল সেন, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ। রামমোহন ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট ভূমিকা নিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। তিনি ভারতে আধুনিক বিজ্ঞান ও ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের দাবি জানিয়ে ব্রিটিশ সরকারকে ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে একটি চিঠি দেন। তাঁর এই চিঠি ভারতের নবজাগরণের ইতিহাসে একটি মূল্যবান দলিল।
মধ্যবিত্ত শ্রেণির পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণের তাৎপর্য
1 পাশ্চাত্য ভাবধারার প্রভাব: ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণি পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার ফলে সমাজজীবনে সর্বাপেক্ষা প্রগতিশীল শ্রেণি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তারা পাশ্চাত্য শিক্ষার মাধ্যমে পাশ্চাত্যের সভ্যতা, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, জাতীয়তাবাদ, মানবতাবাদ, জ্ঞানবিজ্ঞান প্রভৃতি মতাদর্শের সঙ্গে পরিচিত হয়। মধ্যবিত্ত শিক্ষিতরাই ভারতীয় সমাজে এসব ভাবধারা ছড়িয়ে দেয়।
2 জাতীয় ঐক্য: মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে পাশ্চাত্য ও ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের ফলে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের জাতীয় স্তরের নেতৃবৃন্দের মধ্যে যোগাযোগ ও ঐক্য স্থাপিত হয়। ইংরেজি ভাষা এই ঐক্যের বন্ধন হিসেবে কাজ করে। এর ফলে ইন্ডিয়ান লিগ এবং ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন-এর মতো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে।
3 প্রগতিশীলতা: মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় প্রভৃতি বিষয়ে প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা গড়ে ওঠে। এর ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যুক্তিবাদী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার পটভূমি তৈরি হয়।
4 জাতীয়তাবাদী সাহিত্য: পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি পাশ্চাত্য সাহিত্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সাহিত্য রচনায় উদ্যোগী হলে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে আঞ্চলিক সাহিত্যের অগ্রগতি ঘটে। তা ছাড়া
জাতীয়তাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী শোষণের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন ভাষায় বহু সাহিত্য রচিত হতে থাকে।
5 নবজাগরণ: মধ্যবিত্ত শ্রেণির মাধ্যমে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ভাবধারা ছড়িয়ে পড়লে ভারতের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনে বৈপ্লবিক অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়। এই ঘটনাকে অনেকে উনিশ শতকের ভারতীয় নবজাগরণ বলে অভিহিত করেছেন। বাংলায় এই নবজাগরণের সর্বাধিক প্রভাব পড়ে।
6 জাতীয় আন্দোলন: মধ্যবিত্ত শ্রেণি ভারতে ব্রিটিশবিরোধী জাতীয় আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসে। মূলত তাদের নেতৃত্বেই ভারতে জাতীয়তাবাদী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এবং ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়।
উপসংহার: উনিশ শতকের মধ্যবিত্ত শ্রেণি ভারতীয় সমাজজীবনে মধ্যমণি হিসেবে সমাজকে আলোকিত করেছিল। এ. আর. দেশাই এই শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণিকে আধুনিক ভারতের স্রষ্টা বলে অভিহিত করেছেন।
প্রশ্ন5. মধ্যবিত্ত শ্রেণি বলতে কী বোঝ? উনিশ শতকে ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ও স্বরূপ সম্পর্কে আলোচনা করো।
মধ্যবিত্ত শ্রেণি
পলাশির যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে মোটামুটি সচ্ছল আর্থিক অবস্থাসম্পন্ন ও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত যে শ্রেণির উদ্ভব ঘটে তাকে সাধারণভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বলা হয়। অর্থাৎ উচ্চবিত্ত ও কায়িক শ্রমজীবী মানুষের মধ্যবিত্ত স্তরে অবস্থিত সামাজিক গোষ্ঠীকে মধ্যবিত্ত বলা হয়। অধ্যাপক নরেন্দ্রকৃয় সিংহ ‘মধ্যবিত্ত’ প্রবন্ধে লিখেছেন-বাংলায় নবাবি আমলে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ঘটেছিল। ইকতিদার আমল খাঁ তাঁর ‘দ্য মিডল ক্লাসেস ইন দ্য মোগল এম্পায়ার’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে, মোগল আমলে সরকারি কর্মচারী, উকিল, শিক্ষক, হাকিম, বৈদ্য এদের নিয়েই মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছিল। বি বি মিশ্র ব্রিটিশশাসিত ভারতে সরকারি চাকুরিজীবী, বণিক, এজেন্ট, আইনজীবী, চিকিৎসক, শিক্ষক, সাংবাদিক প্রভৃতি পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
উনিশ শতকে ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণি
1 উদ্ভব: TOPIC [A] -এর 1 নং রচনাধর্মী প্রশ্নের উত্তরটি দ্যাখো।
2 স্বরূপ: TOPIC [A]-এর 4 নং রচনাধর্মী প্রশ্নের উত্তরের ‘মধ্যবিত্ত শ্রেণির পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণের তাৎপর্য’ শীর্ষক অংশের 1, 2, 3 ও 6 নং পয়েন্ট দ্যাখো।
প্রশ্ন6 ব্রিটিশ ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির সাধারণ বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।
সূচনা: ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ও ব্রিটিশ সভ্যতা-সংস্কৃতির অনুরাগী একটি ভারতীয় জনগোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে। এঁরা মধ্যবিত্ত শ্রেণি হিসেবে চিহ্নিত হয়।
ব্রিটিশ শাসনকালে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য
1 পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত: ব্রিটিশ শাসনকালে বিভিন্ন উদ্যোগে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিকাশ ঘটে। নবোত্থিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি এই পাশ্চাত্য শিক্ষাকে সাদরে গ্রহণ করে। পাশ্চত্য শিক্ষায় শিক্ষিত এই শ্রেণি আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির অনুরাগী ছিল। ইংরেজি ও পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণের ফলে তারা ভারতীয় সমাজে সর্বাধিক প্রগতিশীল শ্রেণি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তারা মনে করত যে, ভারতে ব্রিটিশ শাসন ভারতীয়দের অক্ষে আশীর্বাদস্বরূপ কারণ ব্রিটিশদের ভারতে আগমনের ফলেই এদেশে আধুনিকতার জোয়ার আসে।
2 উচ্চবর্ণের হিন্দুদের প্রাধান্য: ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ছত্রছায়ায় যে উচ্চশিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ঘটেছিল তাতে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের অত্যধিক প্রাধান্য ছিল। সরকারি চাকরির বেশিরভাগটাই তাদের করায়ত্ত ছিল। উচ্চশিক্ষা লাভ ও সরকারি চাকরিতে নিম্নবর্ণের হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ ছিল সামান্য।
3 সংখ্যাল্পতা: ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ছিল দরিদ্র এবং আধুনিক শিক্ষাবিমুখ। ফলে স্বাভাবিকভাবেই আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং আর্থিকভাবে সচ্ছল মধ্যবিত্তদের সংখ্যা ছিল দেশের সমগ্র জনসংখ্যার অনুপাতে খুবই কম। বিংশ শতকের প্রথম দশকে ইংরেজি জানা ভারতীয়দের সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ১ শতাংশ।
4 অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি: ব্রিটিশ শাসনকালে আবির্ভূত মধ্যবিত্ত শ্রেণির অর্থনৈতিক অবস্থা যথেষ্ট ভালো ছিল। আর্থিক সচ্ছলতার ফলে সাধারণ ভারতীয়দের সঙ্গে তাদের ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছিল। মধ্যবিত্তদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন ভূস্বামী, জমিদার, মহাজন, প্রচুর সম্পত্তির মালিক, পুঁজিপতি, ব্যবসায়ী প্রমুখ। মধ্যবিত্তদের মধ্যে সংখ্যায় সর্বাধিক ছিলেন মাঝারি আর্থিক সংগতিসম্পন্ন। তারা বিভিন্ন সরকারি অফিস-আদালতে চাকরি করতেন। অবস্থাসম্পন্নরা নিম্ন মধ্যবিত্ত হিসেবে বিবেচিত হত। মধ্যবিত্তদের মধ্যে যাদের আয় কম ছিল তারাও দরিদ্র ভারতীয়দের চেয়ে যথেষ্ট স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনধারণ করতেন।
5 বেকারত্ব: মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ব্রিটিশ সরকারের অধীনে চাকরি করতেন। পরবর্তীকালে ভারতের উচ্চশিক্ষার প্রসার ঘটলে ইংরেজি ও পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতীয়দের সংখ্যাও যথেষ্ট বেড়ে যায়। কিন্তু সেই তুলনায় সরকারি অফিস-আদালতে চাকরির পদ বাড়েনি। – ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বহু মানুষ পরবর্তীকালে সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়ে বেকার হয়ে পড়ে। তা ছাড়া সরকারি উচ্চপদগুলি ব্রিটিশদের জন্য সুরক্ষিত থাকায় উচ্চশিক্ষিত ও উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন ভারতীয়রা তাদের যোগ্যতার চেয়ে অনেক নীচু পদে নিযুক্ত হতে বাধ্য হয়।
6 শহরকেন্দ্রিকতা: ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা- প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন সরকারি অফিস-আদালতগুলি প্রধানত বিভিন্ন শহরে গড়ে উঠেছিল। ফলে প্রধানত শহরগুলিতেই মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান ঘটেছিল। শহরগুলিকে কেন্দ্র করেই তাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালিত হত। বহু ক্ষেত্রেই তারা গ্রাম ও গ্রামের সাধারণ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল।
7 সাম্প্রদায়িক পক্ষপাতিত্ব: ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণি নিজেদের সাম্প্রদায়িক চেতনা সম্পর্কে সর্বদা সজাগ থাকতেন। তারা সর্বদা নিজ সম্প্রদায় ও তাদের মানুষজনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা চালাতেন।
8 জাতীয় আন্দোলনে নেতৃত্ব: পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণি সংখ্যার বিচারে খুব সামান্য হলেও তারাই পরবর্তীকালে ভারতে ব্রিটিশবিরোধী জাতীয় আন্দোলনের মেরুদণ্ড হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য এ. আর, দেশাই ভারতের মধ্যবিত্তদের ‘আধুনিক ভারতের স্রষ্টা’ বলে অভিহিত করেছেন। আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণের ফলে তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকশিত হয় এবং ব্রিটিশদের অপশাসনের বিরুদ্ধ তাদের জ্ঞানের চোখ খুলে যায়। মূলত এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিই সর্বপ্রথম ব্রিটিশ শাসন ও
শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় এবং নিজেদের গণতান্ত্রিক দাবিদাওয়া আদায়ের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সভাসমিতি গড়ে তোলে।
উপসংহার: ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে, তারা প্রথম পর্বে পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করে ভারতে ব্রিটিশ শাসন ও সভ্যতার একনিষ্ঠ অনুরাগীতে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিই ভারতে সর্বপ্রথম ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সরব হয়ে প্রতিরোধের ডাক দেয় এবং গণ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসে।
প্রশ্ন7. ‘ইয়ং বেঙ্গল’ বা ‘নব্যবঙ্গ’ নামে কারা পরিচিত? ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতাগুলি উল্লেখ করো।
অথবা, সমাজসংস্কার আন্দোলনে নব্যবঙ্গ নামে কারা পরিচিত ছিলেন? নব্যবঙ্গ আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতা পর্যালোচনা করো।
‘ইয়ং বেঙ্গল’ বা ‘নব্যবঙ্গ’
ঊনবিংশ শতকে কলকাতার হিন্দু কলেজের অধ্যাপক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর (১৮০৯-৩১ খ্রি.) নেতৃত্বে বাংলায় এক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে ওঠে। ডিরোজিওর নেতৃত্বাধীন তরুণ গোষ্ঠী ‘ইয়ং বেঙ্গল’ বা ‘নব্যবঙ্গ’ নামে পরিচিত। ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর ডিরোজিওর অনুগামী সদস্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন কৃয়মোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, প্যারীচাঁদ মিত্র, রামতনু লাহিড়ী, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রসিককৃয় মল্লিক, তারাচাঁদ চক্রবর্তী, শিবচন্দ্র দেব প্রমুখ। তাঁদের নেতৃত্বে বাংলায় যে উগ্র সংস্কার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে তা ‘ইয়ং বেঙ্গল মুভমেন্ট’ বা ‘নব্যবঙ্গ আন্দোলন’ নামে পরিচিত। আর এই আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন ডিরোজিও।
ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতা
ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর সদস্যরা যে সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন শুরু করেছিল তা ডিরোজিওর মৃত্যুর পরও সক্রিয় ছিল। কিন্তু ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের সাফল্য ছিল খুবই সামান্য। ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলন শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়। বিভিন্ন পণ্ডিত ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি, সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতার কারণ উল্লেখ করেছেন।
1 নেতিবাচক ভাবাদর্শ: ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর সমস্ত কর্মসূচিই ছিল নেতিবাচক। তাঁদের কোনো গঠনমূলক কর্মসূচি ছিল না। হিন্দুধর্ম সম্পর্কে সবকিছু না জেনেই তাঁরা এই ধর্মের বিরোধিতায় উগ্রভাবে সোচ্চার হন। অথচ পাশ্চাত্য সভ্যতা সম্পর্কেও তাঁদের কোনো স্বচ্ছ ধারণা ছিল না। তাঁদের এই কালাপাহাড়ি মনোভাবের জন্য হিন্দুসমাজ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।
2 জনসমর্থনের অভাব: ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর সদস্যরা তাদের আন্দোলনকে সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে পারেননি। ড. সুমিত সরকার বলেছেন যে, “মুষ্টিমেয় বুদ্ধিজীবী অংশ ছাড়া বাঙালি সমাজের বৃহত্তর অংশের ওপর ইয়ং বেঙ্গল মতাদর্শের কোনো প্রভাব পড়েনি।”অভিজাত পরিবারের শহরের কিছু তরুণ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এই আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিল।
3 সামাজিক বিচ্ছিন্নতা: ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর অনেকেই ইংরেজ কোম্পানির সহযোগী হিসেবে বিলাসবহুল জীবনযাত্রা অতিবাহিত করেন। সমাজের সাধারণ খেটে খাওয়া কৃষক-শ্রমিকের সঙ্গে তাঁদের কোনো যোগাযোগ ছিল না।
4 উগ্রতা: ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর সদস্যদের উগ্র ও অতি বিপ্লবী কার্যকলাপ সমাজে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল। তাই কলকাতার ‘এলিটিস্ট’ সমাজে এবং পত্রপত্রিকার মধ্যেই তাঁদের কার্যকলাপ সীমাবদ্ধ ছিল। ঐতিহাসিক ডেভিড কফ তাঁদের ‘ভ্রান্ত পুঁথি-পড়া বুদ্ধিজীবী’ বলে অভিহিত করেছেন।
5 দরিদ্রদের প্রতি উদাসীনতা: ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠী দেশের দরিদ্র কৃষক ও শ্রমিকদের দুরবস্থা ও সমস্যা সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন ছিলেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সৃষ্ট কৃষকদের দুর্দশা এবং কুটিরশিল্প ধ্বংসের ফলে দরিদ্র সাধারণ মানুষের আর্থিক দুর্দশা থেকে মুক্ত করার কোনো উদ্যোগ তারা গ্রহণ করেননি।
6 মুসলিম-বিচ্ছিন্নতা: ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলন শুধু হিন্দু-সমাজের সংস্কার নিয়ে চিন্তাভাবনায় ব্যস্ত ছিল। মুসলিমসমাজের সংস্কার নিয়ে গোষ্ঠীর সদস্যরা কোনো চিন্তাভাবনা করেননি।
7 সংস্কারবিমুখতা: ডিরোজিওর মৃত্যুর পরবর্তীকালে তাঁর অনুগামীদের অনেকেই সংস্কারবিমুখ হয়ে সংস্কার-কর্মসূচি থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়। অনেকে সরকারি চাকরি বা ব্যাবসায় মনোযোগ দিয়ে নিজেদের সংসার জীবনে উন্নতির চেষ্টা করেন। রসিককৃষ্ণ মল্লিক, মাধবচন্দ্র মল্লিক, গোবিন্দচন্দ্র বসাক প্রমুখ ডেপুটি কালেক্টর এবং কিশোরীচাঁদ মিত্র ও শিবচন্দ্র দেব ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হন।
উপসংহার: সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কারের ক্ষেত্রে ডিরোজিও ও তাঁর অনুগামীদের উগ্র মনোভাব দেশবাসী সাদরে গ্রহণ করেনি। অনেকে তাঁদের ‘উচ্ছৃঙ্খল’, ‘কালাপাহাড়’ প্রভৃতি আখ্যা দিয়েছেন। বিভিন্ন ত্রুটিবিচ্যুতি এবং সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সমাজ ও ধর্মসংস্কারের ক্ষেত্রে তাঁদের আন্তরিক ও নিঃস্বার্থ উদ্যোগকে অস্বীকার করা যায় না। ড. সুমিত সরকার বলেছেন, “তাঁরা ছিল পিতা ও সন্তানহীন একটি প্রজন্ম।”
প্রশ্ন8. ধর্মীয় সংস্কারের ক্ষেত্রে শ্রীরামকৃয়ের অবদান কী ছিল?
সূচনা: ঊনবিংশ শতকে বাংলা তথা ভারতের সামাজিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধারায় যে সংস্কার আন্দোলন এগিয়ে চলে তাতে নতুন মাত্রা যোগ করেন ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব (১৮৩৬-১৮৮৬ খ্রি.)। দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারিণীর মন্দিরের পূজারি শ্রীরামকৃয় মধ্যযুগীয় কুসংস্কারের পাঁকে আবদ্ধ ভারতীয় সমাজ ও ধর্মের ত্রুটিবিচ্যুতিগুলি দিব্যদৃষ্টিতে লক্ষ করে সেগুলি দূর করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
শ্রীরামকৃষ্ণের ধর্মীয় সংস্কার
1 যত মত তত পথ: শ্রীরামকৃয় জাতিকে ‘যত মত তত পথ’-এর সন্ধান দেন। তিনি তাঁর সাধনার মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করেন যে, শৈব, বৈয়ব, হিন্দু, বৌদ্ধ, ইসলাম, খ্রিস্টান, সাকার, নিরাকার, দ্বৈত, অদ্বৈত প্রভৃতি সব সাধনার পথ ধরেই ঈশ্বরের কাছে পৌঁছোনো যায়-সাধনমার্গের সব পথই সত্য ও অভ্রান্ত।
2 কর্মই ধর্ম: শ্রীরামকৃয় বলেন যে, ঈশ্বর লাভের জন্য আচার-অনুষ্ঠান, জপতপ, মন্ত্রতন্ত্র, যাগযজ্ঞ, কৃষ্ণসাধন, শুচিতা, সংসার ত্যাগ প্রভৃতির কোনো প্রয়োজন নেই। শুধু আন্তরিকতার দ্বারাই কোনো মানুষ প্রকৃত সত্যকে উপলব্ধি করতে পারে। ঈশ্বর সাধনার জন্য তিনি বলেছেন সংসারের আসক্তি ত্যাগ করতে, কর্মত্যাগের কথা বলেননি-নিষ্কাম কর্মের কথা বলেছেন। তিনি ঈশ্বর সাধনার নামে কর্মে অবহেলা ও পলায়নি মনোবৃত্তিকে ঘৃণা করতেন।
3 শিবজ্ঞানে জীবসেবা: শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে ধর্মের অর্থ হল জীবের কল্যাণ এবং জীবসেবা। জীবে দয়া নয়, ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’ই হল ধর্মের মূল আদর্শ। আচার-অনুষ্ঠানসর্বস্ব উপাসনা নয়, শ্রীরামকৃয়ের কাছে জীবের সেবাই পরম ধর্ম। তাঁর প্রচারের ফলে আচার-অনুষ্ঠানসর্বস্ব হিন্দুধর্ম জটিলতামুক্ত হয়ে আবার প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
4 ধর্মীয় আদর্শ: শ্রীরামকৃয় বলেন যে, ঈশ্বর লাভই উপাসনার মূল উদ্দেশ্য এবং চৈতন্যের পথে অগ্রসর হওয়াই মানুষের ধর্ম। সাধনামার্গের সব পথই সত্য। তাঁর মতে, আত্মা নিষ্পাপ ও অবিনশ্বর। তাই মানুষকে পাপী বলা অন্যায়। তিনি তাঁর জীবন ও সাধনা দিয়ে প্রমাণ করেন যে, হিন্দুরা পৌত্তলিক নয়, তারা মৃন্ময়ীতে চিন্ময়ীর উপাসনা করেন।
5 নারীমুক্তি: শ্রীরামকৃয় মনে করতেন যে, নারী হল স্বয়ং জগন্মাতার প্রতিমূর্তি। নারী জাতির দুর্দশামোচন ও নারীর নেতৃত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে তিনি নারীর সুউচ্চ মহিমা ঘোষণা করেন।
6 মানবতাবাদ: শ্রীরামকৃয় মনে করতেন যে, প্রতিটি মানুষই অনন্ত শক্তির অধিকারী। তাঁর মানবতাবাদী আদর্শের প্রচারের ফলে সমাজে জাতপাতের বেড়াজাল ভেঙে যায়। তাঁর গ্রাম্য আচার-ব্যবহার, অর্ধনগ্ন বেশ, আভিজাত্যের প্রতি অনীহা তৎকালীন উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংস্কৃতির বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ।
7 সরল আদর্শ: শ্রীরামকৃয় তাঁর আদর্শ খুব সরল ভাষায়, বিভিন্ন গল্পের উপমা দিয়ে মানুষের কাছে তুলে ধরতেন। সমাজের নীচুতলা বা ওপর তলার সব ধরনের মানুষই তাঁর মুখ থেকে ধর্মের আদর্শ শোনার জন্য তাঁর কাছে ছুটে আসতেন। স্বামী বিবেকানন্দ, কেশবচন্দ্র সেন, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বিনোদিনীদাসী প্রমুখ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ ঠাকুরের সান্নিধ্য লাভ করেন।
মূল্যায়ন: শ্রীরামকৃয়ের বাণী ও আদর্শ যন্ত্রণায় দগ্ধ ও কাতর মানুষের বুকে শান্তির বারিবিন্দুর মতো ঝড়ে পড়ে। ভারতীয় সমাজের আধ্যাত্মিক চেতনার বিকাশে তাঁর অবদান অসামান্য। তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর অন্যতম শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ পরবর্তীকালে ভারত তথা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সমাজসেবা ও মানবকল্যাণের সুমহান আদর্শ প্রচার করেন। অগ্নিযুগের বিপ্লবী শ্রীঅরবিন্দ ঘোষ বলেছেন, “বাংলার পুনর্জাগরণে তাঁর অবদানই সর্বশ্রেষ্ঠ। তাঁর দ্বারাই ভারতের মুক্তি ও পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু হয়েছে।”
প্রশ্ন9. সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান কী ছিল?
বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কার
1 কৌলীন্য প্রথার বিরোধিতা: তৎকালীন হিন্দুসমাজে প্রচলিত কৌলীন্য প্রথার ফলে কুল রক্ষার উদ্দেশ্যে বহু পিতামাতা তাদের বালিকা কন্যাকে খুব হিন্দু নারীর জীবনে সীমাহীন দুর্দশা নেমে আসত। তিনি এই কৌলীন্য প্রথার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান। কৌলীন্য প্রথার সুযোগ নিয়ে কলীন ব্রাহ্মণরা কীভাবে নারীদের সর্বনাশ করছে তা তিনি হগলি জেলার ১৩৩ জন ব্রাহ্মণের বৈবাহিক সম্পর্কের তালিকা তৈরি করে প্রমাণ দেন।
2 বৈবাবিধবাবিবাহ প্রবর্তনে উদ্যোগ: বিধবা নারীদের জীবনের করুণ দশা বিদ্যাসাগরকে খুবই ব্যথিত করে। তিনি হিন্দুশাস্ত্র বিশেষত ‘পরাশর সংহিতা’ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত। তিনি বিধবাবিবাহের সমর্থনে ব্যাপক প্রচার শুরু করেন এবং আন্দোলন গড়ে তোলেন। তা ছাড়া দরিদ্র বিধবাদের সহায়তার উদ্দেশ্যে তিনি ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ‘হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুইটি ফান্ড’ গঠন করেন।
3 বিধবাবিবাহ আইন পাস: বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না এ বিষয়ে বিদ্যাসাগর ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে দুটি পুস্তিকা রচনা করেন। এক বছরের মধ্যেই পুস্তিকা দুটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। তাঁর উদ্যোগে বিধবাবিবাহের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৪ অক্টোবর ১ হাজার ব্যক্তির স্বাক্ষরিত একটি আবেদনপত্র সরকারের কাছে পাঠানো হয়। শেষপর্যন্ত বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় বড়োলাট লর্ড ডালহৌসি ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে (২৬ জুলাই) ১৪০ নং রেগুলেশন দ্বারা বিধবাবিবাহ আইন পাস করেন।
4 বিধবাবিবাহের আয়োজন: বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে (৭ ডিসেম্বর) বর্ধমান জেলার পলাশডাঙার ব্রহ্মানন্দ মুখোপাধ্যায়ের ১০ বছরের বিধবা কন্যা কালীমতী দেবীকে বিবাহ করেন। বিদ্যাসাগর নিজ পুত্র নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গে অষ্টাদশী বিধবা ভবসুন্দরীর বিবাহ দেন। বিদ্যাসাগর ১৮৫৬-৬৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নিজের উদ্যোগে ৮২ টাকা ব্যয় করে ৬০ জন বিধবার বিবাহ দেন।
5 বাল্যবিবাহের বিরোধিতা: উনবিংশ শতকে ভারতের হিন্দু- সমাজে বাল্যবিবাহের প্রকোপ ছিল। বাল্যবিবাহের অভিশাপ থেকে সমাজকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে বিদ্যাসাগর সর্বশুভকরী সভার মুখপাত্র ‘সর্বশুভকরী পত্রিকা’-র প্রথম সংখ্যাতেই ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকায় লেখা হয়-বাল্যবিধবাদের দুঃখ মোচনের জন্যই বিধবাবিবাহের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিদ্যাসাগর বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে জোরালো প্রচার ও সোচ্চার প্রতিবাদ শুরু করেন। এর ফলে ব্রিটিশ সরকার আইন প্রণয়ন করে মেয়েদের বিবাহের সর্বনিম্ন বয়স ১০ বছর ধার্য করে দেয়।
6 বহুবিবাহের বিরোধিতা: বিদ্যাসাগর বহুবিবাহ প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিনি বর্ধমানের মহারাজার সহায়তায় বহুবিবাহ প্রথার বিরুদ্ধে ৫০ হাজার ব্যক্তির স্বাক্ষর সংবলিত একটি
প্রতিবাদপত্র ব্রিটিশ সরকারের কাছে পাঠান (১৮৫৫ খ্রি.)। বহুবিবাহ বন্ধের উদ্দেশ্যে আইন প্রণয়ন করার জন্য ব্রিটিশ সরকার বিদ্যাসাগর-সহ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন। কিন্তু ইতিমধ্যে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে মহাবিদ্রোহ সংঘটিত হওয়ার পর সরকার হিন্দুদের সামাজিক প্রথায় হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে বহুবিবাহ বন্ধের বিষয়টি আর বেশি দূর এগোয়নি। বিদ্যাসাগর পরবর্তীকালে বহুবিবাহের বিরুদ্ধে দুটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন (১৮৭১ খ্রি.) এবং প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, বহুবিবাহ অশাস্ত্রীয়। তাঁর প্রচার ও শিক্ষাবিস্তারের ফলে বহুবিবাহের প্রকোপ বহুলাংশে হ্রাস পায়।
7 অন্যান্য সংস্কার: বিদ্যাসাগর তৎকালীন বিভিন্ন সামাজিক কুসংস্কার ও কুপ্রথার বিরুদ্ধে সরব হন। তিনি গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন, কুষ্ঠরোগী হত্যা, অস্পৃশ্যতা, জাতিভেদপ্রথা প্রভৃতি কুপ্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ করেন।
মূল্যায়ন: উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণে যাঁদের অসামান্য অবদান রয়েছে তাঁদের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮২০-১৮৯১ খ্রি.)।
প্রশ্ন10. উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলার সংস্কার আন্দোলনের বিবরণ দাও।
সূচনা: ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলায় সংস্কার আন্দোলনের জোয়ার এসেছিল। এই সময় বাংলা সমগ্র ভারতবর্ষকে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের পথ দেখিয়েছিল।
উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলার সংস্কার আন্দোলন
ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে সমাজ, ধর্ম ও শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়।
1 সমাজসংস্কার:
i. ব্রাহ্মসমাজ ও বিদ্যাসাগরের ভূমিকা: কেশবচন্দ্রের নেতৃত্বে ব্রাহ্মসমাজ বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, অস্পৃশ্যতা ও জাতিভেদপ্রথার বিরুদ্ধে সরব হয়। পাশাপাশি নারী স্বাধীনতা, অসবর্ণ বিবাহ, বিধবাবিবাহ প্রভৃতির পক্ষে ব্রাহ্মসমাজ সারা দেশে এক আন্দোলন গড়ে তোলে। কেশবচন্দ্রের পরবর্তী সময়ে তরুণ ব্রাহ্ম নেতা শিবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, দুর্গামোহন দাস প্রমুখের প্রচেষ্টায় সমাজসংখ্যারমূলক কাজের অগ্রগতি ঘটে। বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহের অনুকূলে আইন রচনার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলেন ও সরকারের কাছে আবেদন জানান। তাঁর আবেদনে সাড়া দিয়ে সরকার বিধবাবিবাহ বৈধ বলে ঘোষণা করে (১৮৫৬ খ্রি. ২৬ জুলাই, ১৫ নং রেগুলেশন)।
ii. রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের প্রচেষ্টা: শ্রীশ্রী রামকৃয়দেব ও তাঁর শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ ‘শিবজ্ঞানে জীব সেবা’র কথা বলে এক উন্নত সমাজ গঠনের পথ দেখান। বিবেকানন্দ তীব্র ভাষায় জাতিভেদপ্রথার বিরোধিতা করেন। তিনি সমস্ত জাতিকে এক হয়ে সমাজের উন্নতিতে নিয়োজিত হওয়ার কথা বলেন। তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শ্রেষ্ঠ ভাবধারার মিলন ঘটিয়ে এক নতুন জাতি গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
iii . সৈয়দ আহমেদ ও আলিগড় আন্দোলনের ভূমিকা: সৈয়দআহমেদ মুসলমানদের মধ্যযুগীয় আচার-আচরণ ও চিন্তাধারা ত্যাগ করার পরামর্শ দেন। তিনি মুসলমান সমাজের কুপ্রথাগুলির নিন্দা করেন ও সমাজে দাসপ্রথাকে সমাজ বিরোধী বলে আখ্যা দেন। তিনি নারীমুক্তির স্বপক্ষে প্রচার চালান। নারীদের পর্দাপ্রথার বিরুদ্ধেও তিনি প্রতিবাদ জানান। পরবর্তীকালে মৌলবি চিরাগ আলি মুসলিম সমাজের পুরুষদের একটিমাত্র বিবাহের স্বপক্ষে মত দেন।
2 ধর্মসংস্কার:
i. ব্রাহ্মসমাজের প্রচেষ্টা: দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর উপনিষদ থেকে বিধি সংকলিত করে ব্রাহ্মমতকে আস্তিক্যবাদের রূপ দেন। কেশবচন্দ্রের নিরলস প্রচেষ্টার ফলে ব্রাহ্মধর্ম বিশ্বজনীন সর্বধর্ম-সমন্বয়ের রূপ নেয়।
ii. রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের বেদান্তবাদ: শ্রীশ্রী রামকৃয়দেব বেদান্তের মূল কথাগুলিকে খুবই সহজ ও সরলভাবে ব্যাখ্যা করেন। তাঁর বেদান্তের এই মানবিক ব্যাখ্যা নববেদান্তবাদ নামে পরিচিতি পায়। এতে বলা হয়, মানব সেবাই ঈশ্বর সেবা। গুরুর এই বাণীকে শিষ্য বিবেকানন্দ গ্রহণ করেন ও বলেন- “জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর”।
iii. সৈয়দ আহমেদ ও আলিগড় আন্দোলন: সৈয়দ আহমেদ গোঁড়া ও রক্ষণশীল মনোভাব ছেড়ে মুসলিমদের উদার হওয়ার কথা বলেন। তিনি মুক্তির আলোকে পবিত্র কোরানশরিফ গ্রহণ করার কথা বলেন। পীরের পুজো ও মুরিদি প্রথাকে তিনি নিন্দা করেন। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে দেওবন্দে স্থাপিত হয় দার-উল-উলুম। এখানে বিশুদ্ধ কোরানীয় ইসলাম ধর্মের চর্চা শুরু হয়।
3 শিক্ষাসংস্কার:
i. ব্রাহ্মসমাজের প্রচেষ্টা: কেশবচন্দ্র বয়স্কদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটানোর লক্ষ্যে কলকাতার কলুটোলায় এক নৈশ্যবিদ্যালয় গড়ে তোলেন। পাশাপাশি শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ব্রাহ্মবন্ধু সভা, সংগত সভা প্রভৃতি। স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে তিনি গড়ে তোলেন বামাবোধিনী সভা, ব্রাত্মিকা সমাজ, নেটিভ লেডিজ নর্মাল স্কুল প্রভৃতি। বৃত্তিমূলক শিক্ষাদানের লক্ষ্যে তিনি গড়ে তোলেন একটি শিল্প বিদ্যালয়।
ii. বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টা: বাংলা গদ্যসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি বিদ্যাসাগর শিক্ষাবিস্তারে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। হার্ডিঞ্জের সাহায্যে তিনি বহু বাংলা স্কুল স্থাপন করেছিলেন। নিজের শিক্ষা রূপায়ণের জন্য তিনি ২০টি মডেল স্কুল গড়ে তোলেন। তিনি কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশন (বিদ্যাসাগর কলেজ)। ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন একটি মেয়েদের স্কুল গড়ে তুললে বিদ্যাসাগর এই স্কুলে বহু ছাত্রীর পাঠদানের ব্যবস্থা করে দেন। নারীশিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে বিদ্যাসাগর গ্রামাঞ্চলে নিজ খরচে ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় গড়ে তোলেন।
iii. সৈয়দ আহমেদ ও আলিগড় আন্দোলনের ভূমিকা: সৈয়দ আহমেদ গাজীপুরে একটি ইংরেজি বিদ্যালয় গড়ে তোলেন। ইংরেজি শিক্ষা প্রসারের জন্য তিনি গঠন করেন ট্রানস্লেশান সোসাইটি নামে একটি সমিতি (বর্তমান সায়েন্টিফিক সোসাইটি অব আলিগড়)। মুসলিমদের উচ্চশিক্ষা দানের লক্ষ্যে তিনি অক্সফোর্ড বা কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শে গঠন করেন আবাসিক, আলিগড় অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ (বর্তমান আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়)।
প্রশ্ন11. দক্ষিণ ভারতে সমাজসংস্কার ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে নারায়ণ গুরুর ভূমিকা আলোচনা করো।
সূচনা: ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে কেরালা তথা দক্ষিণ ভারতে যে সমাজসংস্কার ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে তাতে নেতৃত্বের অগ্রভাগে ছিলেন বিশিষ্ট সাধক ও চিন্তাবিদ শ্রীনারায়ণ গুরু (১৮৫৬- ১৯২৮খ্রি.)। তিনি কেরালার এজহাবা নামক এক দলিত অস্পৃশ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কেরালার পিছিয়ে-পড়া মানুষের উন্নতি ও সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে যে আন্দোলন গড়ে তোলেন তা হিন্দু সংস্কার আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা যোগ করে।
সমাজসংস্কার ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতিতে নারায়ণ গুরু
1 ভাবাদর্শ: সংস্কারক শ্রীনারায়ণ গুরুর সংস্কার আন্দোলনের প্রচারিত ভাবাদর্শের প্রধান দিকগুলি ছিল- [i] শিক্ষাগ্রহণের মাধ্যমে নিজেকে কুসংস্কারমুক্ত করা, [ii] শক্তিশালী হওয়ার জন্য একতা গড়ে তোলা, [iii] শিল্পের বিকাশের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটানো।
2 অবদান: নারায়ণ গুরু তাঁর সংস্কার কর্মসূচি দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দেন। সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান সম্পর্কে নীচে আলোচনা করা হল-
i. অস্পৃশ্যতার বিরোধিতা: কেরালার মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই ছিল এজহাবা নামে নিম্ন সম্প্রদায়ের মানুষ। হিন্দু দেবদেবীর মন্দির বা উচ্চবর্ণের মানুষের গৃহে প্রবেশের কোনো অধিকার এই দলিত শ্রেণির মানুষের ছিল না। এমনকি এজহাবাদের নিজস্ব মন্দিরেও হিন্দু দেবদেবীর ছবি বা বিগ্রহ রাখা যেত না। নারায়ণ গুরু সামাজিক অস্পৃশ্যতার তীব্র বিরোধিতা করেন। সমাজের অস্পৃশ্য জাতির মানুষকে মন্দিরে অবাধ প্রবেশের সুযোগ দেওয়ার দাবিতে তিনি তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন।
ii. প্রচারকার্য: নারায়ণ গুরু কেরালার সর্বত্র ভ্রমণ করে প্রচলিত জাতিভেদ, বর্ণবৈষম্য, সামাজিক অবিচার ও অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে প্রচার চালান এবং এসবের বিরুদ্ধে তীব্র জনমত গড়ে তোলেন। তিনি মদ তৈরি ও মদ্যপানের বিরুদ্ধে এবং অসবর্ণ বিবাহের সপক্ষে প্রচার চালান। এজহারা সম্প্রদায়ের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য তিনি তাদের ব্যাবসা করার পরামর্শ দেন। সমাজসংস্কারের বিষয়ে তাঁর আদর্শ প্রচার এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত মন্দির, মঠ ও বিদ্যালয়গুলির মধ্যে সমন্বয় সাধনের উদ্দেশ্যে তিনি ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে শ্রীনারায়ণ ধর্ম পরিপালন যোগম নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এজহাবা সম্প্রদায়ের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক উন্নতি, তাদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার এবং দক্ষিণ ভারতে অসবর্ণ বিবাহ প্রচলনে এই প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
iii. ভাইকম সত্যাগ্রহ: দক্ষিণ ভারতের ভাইকমে বর্ণহিন্দুদের একটি মন্দিরের পার্শ্ববর্তী রাস্তা ব্যবহারের অধিকার সেখানকার নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ছিল না। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে নারায়ণ গুরু প্রবল জনমত ও তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাঁর নেতৃত্বে এই আন্দোলন ‘ভাইকম সত্যাগ্রহ’ (১৯২৪ খ্রি.) নামে পরিচিত। তাঁর নেতৃত্বে মন্দিরে পুজোর জন্য ‘এজহারা পুরোহিত’ সম্প্রদায় গড়ে ওঠে এবং সেখানকার রন্ধনশালার কাজে তথাকথিত অস্পৃশ্যদের নিয়োগ করা হয়। ভাইকম সত্যাগ্রহের ব্যাপকতায় মুগ্ধ গান্ধিজি দক্ষিণ ভারতে এসে এই আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানান। শেষপর্যন্ত ভাইকম সত্যাগ্রহ জয়যুক্ত হয়।
iv. শিক্ষার প্রসার: নারায়ণ গুরু উপলব্ধি করেছিলেন যে, দলিত অনগ্রসর জাতির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতির জন্য তাদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার অত্যন্ত জরুরি। এজন্য তিনি শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে একটি অর্থভান্ডার খোলেন। তাঁর উদ্যোগে কেরালায় বেশ কয়েকটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।
মূল্যায়ন: শ্রীনারায়ণ গুরুর নেতৃত্বে সংস্কার আন্দোলন প্রথমদিকে মূলত দলিতদের উন্নতির লক্ষ্যে পরিচালিত হলেও তা শীঘ্রই দক্ষিণ ভারতের জাতিভেদপ্রথা ও সামাজিক কুসংস্কারের বিরোধী হয়ে ওঠে। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ শ্রীনারায়ণ গুরুর আন্দোলনে শামিল হলে তা দক্ষিণ ভারতে ব্যাপক আকার ধারণ করে।
প্রশ্ন12. উনবিংশ শতকে শিখ সম্প্রদায়ে সংঘটিত বিভিন্ন সমাজসংস্কার আন্দোলনগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
সূচনা: উনবিংশ শতকের শেষদিকে পাঞ্জাবের শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যে সমাজসংস্কার আন্দোলন যথেষ্ট তীব্র হয়ে ওঠে। এই সময় শিখ সম্প্রদায়ের বিভিন্ন শাখার মধ্যে সমাজসংস্কার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
শিখ সম্প্রদায়ের সমাজসংস্কার আন্দোলন
1 সিংহসভা আন্দোলন
1. আন্দোলনের প্রতিষ্ঠা: সর্দার ঠাকুর সিংহ, বাবা শ্রীখেম সিংহ বেদি ও বিক্রম সিংহ ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবের অমৃতসরে ‘শ্রীপুর সিংহসভা’ নামে একটি সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। অধ্যাপক গুরুমুখ সিংহের উদ্যোগে ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে লাহোর সিংহসভা স্থাপিত হয়। বহু শিখ পূজারি ও জ্ঞানী ব্যক্তি এই আন্দোলনে শামিল হয়।
ⅱ. কার্যকলাপ: সিংহসভার উদ্যোগেই সর্বপ্রানে শামিল হয়ধ্যে ধর্ম ও সমাজসংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। শিখ সমাজ ও ধর্মে দুর্নীতির অবসান এবং শিখদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে এই সংঘ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। বিভিন্ন গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে এই সভা পাঞ্জাবি ও গুরুমুখি ভাষাকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করে। লাহোর সিংহসভা অস্পৃশ্যতা ও গুরুবাদের প্রভাব থেকে তাঁদের সমাজ ও ধর্মকে মুক্ত করার চেষ্টা চালান।
2 নিরঙ্কারী আন্দোলন
i. দয়াল সিং-এর নেতৃত্ব: পাঞ্জাবের নিরঙ্কারী আন্দোলনের প্রবর্তক ছিলেন বাবা দয়াল সিং (১৭৮৩-১৮৫৫ খ্রি.)। তিনি বলতেন, মানুষ ও ঈশ্বরের মধ্যে যোগসূত্র রক্ষা করার জন্য পুরোহিতের কোনো প্রয়োজন নেই। তিনি শিখধর্মকে কলুষতা মুক্ত করে পবিত্র ধর্মে পরিণত করার উদ্যোগ নেন। তাঁর মৃত্যুর পরবর্তীকালে তাঁর পুত্র বাবা দরবারা সিংহ (১৮১৪-১৮৭০ খ্রি.) নিরঙ্কারী সংস্কার আন্দোলন চালিয়ে যান।
ii. গুরুত্ব: [a] খালসা বাহিনীর সামরিক আদর্শ ত্যাগ করে তারা সমাজে শান্তিপ্রতিষ্ঠায় জোর দিয়েছিলেন। [b] ঈশ্বরের নিরাকার রূপের প্রতি বিশ্বাসী নিরঙ্কারীরা নিজ ধর্মের পুরোহিতদের দিয়ে তাদের উপাসনা ও পূজাকেন্দ্রগুলি পরিচালনার প্রথা চালু করেন। [c] রাওয়ালপিন্ডিতে নিরাকারী দরবার স্থাপন করে এই সভার অনুগামীরা মাংসভক্ষণ, মদ্যপান, প্রতারণা, মিথ্যাচার প্রভৃতি দূর করার উদ্দেশ্যে প্রচার চালান। [d] এই আন্দোলন উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে পাঞ্জাবে খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে। অ-জাঠ শিখদের মধ্যে এই আন্দোলনের সর্বাধিক প্রভাব লক্ষ করা গিয়েছিল।
3 নামধারী আন্দোলন
i . আন্দোলনের নেতৃত্ব: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে নামধারী আন্দোলনের প্রবর্তন করেন বাবা বালক সিং। এই আন্দোলনটি ‘কুকা আন্দোলন’ (Kuka Movement) নামেও পরিচিত। পরবর্তীকালে বাবা রাম সিং (১৮১৬-৮৫ খ্রি.)-এর নেতৃত্বে এই আন্দোলন খুবই শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
ii. বৈশিষ্ট্য: [a] নামধারী অনুগামীরা ‘গ্রন্থসাহেব’-কে প্রকৃত সত্য বলে মানতেন। [b] তারা নারী-পুরুষের সমান অধিকার দাবি করে। [c] তারা জাতিগত অসাম্যের বিরোধিতা করেন। [d] তারা বাল্যবিবাহের বিরোধিতা এবং অসবর্ণ বিবাহ, বিধবাবিবাহ ও নারীকল্যাণকে সমর্থন করেন। [e] সব ধরনের আচার-অনুষ্ঠান থেকে বিরত হয়ে সহজসরল জীবনযাপন এবং ঈশ্বরের নামকীর্তন করা ছিল এই আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য।
4. অকালি আন্দোলনের গুরুত্ব: অকালি আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গুরুত্ব ছিল-
i. আদর্শ বিচ্যুতি: অকালি আন্দোলনের অংশরূপে পরিচালিত নিরস্কারীরা নামধারী আন্দোলনের মূল আদর্শ থেকে অনেকটাই সরে এসেছিল।
ii. গুরুদ্বারগুলির সমৃদ্ধি: বহু বিত্তবান শিখ অর্থ ও জমি দান করে গুরুদ্বারগুলিকে সমৃদ্ধ করে তুলেছিল।
iii. সমান্তরাল সরকার গঠন: পাঞ্জাবের বিভিন্ন জায়গায় নামধারীরা সংগঠন গড়ে তুলে এক সমান্তরাল সরকার গঠন করে যা ব্রিটিশকে উদ্বিগ্ন করে তোলে।
iv. গুরুদ্ধার আইন প্রবর্তন: অকালি আন্দোলনের তীব্রতায় অবশেষে, ব্রিটিশ এক নতুন শিখ গুরুদ্বার আইন প্রবর্তনে (১৯২৫ খ্রি.) বাধ্য হয়।
প্রশ্ন13.ঔপনিবেশিক শাসনকালে সমাজসংস্কার আন্দোলন ভারতীয় সমাজে কীরূপ প্রভাব ফেলেছিল?
সূচনা: অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে সমাজসংস্কার আন্দোলনের যে ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে তা ভারতের সমাজজীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। আন্দোলনের প্রভাবে ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী সমাজে বহু মৌলিক পরিবর্তন ঘটে।
ভারতীয় সমাজে সমাজসংস্কার আন্দোলনের প্রভাব
1 সামাজিক কুসংস্কার হ্রাস: ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতে সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের প্রভাবে বহু সামাজিক কুসংস্কার দুর্বল হতে শুরু করে। আন্দোলনের চাপে কুসংস্কার আঁকড়ে থাকা রাধাকান্ত দেব, রামকমল সেন প্রমুখ রক্ষণশীলদের সামাজিক প্রভাব যথেষ্ট খর্ব হয়। ফলে সামাজিক অন্ধবিশ্বাস, অনুষ্ঠানসর্বস্বতা, কুসংস্কারের বাধন ক্রমশ শিথিল হতে থাকে। ভারতীয় সমাজ হীনম্মন্যতা কাটিয়ে নতুন আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে ওঠে।
2 পাশ্চাত্য শিক্ষার বিকাশ: বিভিন্ন সংস্কারকের উদ্যোগ ও প্রচারের ফলে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিষয়ে ভারতীয়দের গোঁড়ামি অনেকটাই দূর হয়। ফলে ভারতীয়দের মধ্যে ইংরেজি ও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের পথ সুগম হয়। আলিগড় আন্দোলনের প্রভাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যেও পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়। সরকারও প্রয়োজনের তাগিদে পাশ্চাত্য শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে থাকে।
3 সাংস্কৃতিক অগ্রগতি: সমাজসংস্কার আন্দোলন ভারতীয় সমাজে সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক বিকাশ ঘটায়। বিভিন্ন সংস্কার আন্দোলন ভারতীয় সমাজে পাশ্চাত্যের ভাবধারার অবাধ প্রবেশের সুযোগ করে দেয়। ফলে ভারতীয়দের মধ্যে পাশ্চাত্য দর্শন আধুনিকতা, যুক্তিবাদ, গণতন্ত্র, মানবতাবাদ, বিজ্ঞানচেতনা প্রভৃতির প্রসার ঘটে। ধর্মীয় কুসংস্কার দুর্বল হয়ে প্রগতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক চেতনার প্রভাবে ভারতের শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য অগ্রগতি ঘটে।
4 জাতীয়তাবাদের বিকাশ: সংস্কার আন্দোলনের ফলে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ভাবধারা ছড়িয়ে পড়লে ভারতে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ভাবধারায় দীক্ষিত এই প্রগতিশীল শ্রেণির চিন্তা-চেতনা থেকে ভারতে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ দেশপ্রেমিক মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিভিন্ন রাজনৈতিক সভাসমিতি প্রতিষ্ঠা করে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা করতে শুরু করে। তারা সরকারের কাছে ভারতীয়দের বিভিন্ন অধিকারের দাবি তুলে ধরে। জাতীয় চেতনার বিকাশের ফলে ভারতে বিভিন্ন ভাষায় জাতীয়তাবাদী সাহিত্যের বিকাশ ঘটে।
5 নারীকল্যাণ: সমাজসংস্কার আন্দোলনের প্রভাবে ভারতের চির- নির্যাতিত নারী জাতির প্রতি সহানুভূতির বাতাবরণ তৈরি হয়। পুরুষের বহুবিবাহ, কন্যা সন্তান হত্যা, নারীদের বাল্যবিবাহ, সতীদাহপ্রথা, পর্দাপ্রথা, পণপ্রথা প্রভৃতির বিরুদ্ধে সমাজের মানুষ ক্রমে সচেতন হয়ে ওঠে। নারীদের সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে তাদের মধ্যে আধুনিক শিক্ষার প্রসার ঘটানো হয়। নারীশিক্ষার প্রসার ঘটলে সমাজের সার্বিক উন্নতি ঘটে।
উপসংহার: আচার্য যদুনাথ সরকার মনে করেন যে, ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীকালে ভারতে নবজাগরণ সংঘটিত হয়। এই নবজাগরণ সংঘটনের ক্ষেত্রে সমাজসংস্কার আন্দোলনের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। বস্তুতপক্ষে, ইটালির নবজাগরণে জ্ঞানীগুণী পণ্ডিতরা যতটা ভূমিকা নিয়েছিলেন ভারতীয় নবজাগরণের ক্ষেত্রে ততটা ভূমিকা নিয়েছিলেন সমাজসংস্কারকগণ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সমাজসংস্কারের প্রভাবে ভারতীয় সমাজে যে অগ্রগতি ঘটেছিল তার প্রথম সূচনা হয়েছিল বাংলায়।
প্রশ্ন14. ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতের সমাজসংস্কার আন্দোলন ব্রিটিশ সরকারের নীতিকে কতটা প্রভাবিত করেছিল?
সূচনা: ভারতীয় সংস্কারকদের উদ্যোগে ছড়িয়ে-পড়া সমাজসংস্কার আন্দোলনের প্রভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ভাবধারার মুক্ত বাতাস ভারতীয় সমাজে প্রবেশ করে এই সমাজের সার্বিক অগ্রগতি ঘটিয়েছিল। এই সংস্কার আন্দোলনের প্রভাবে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন কুসংস্কার দূর করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
সমাজসংস্কার আন্দোলনের প্রভাবে ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগ
1 শিশুহত্যা রদ: ভারতীয় হিন্দুসমাজে বহু সন্তানহীনা নারী ঈশ্বরের কাছে সন্তান কামনা করে বলত যে, তার একাধিক সন্তান জন্মগ্রহণ করলে একটি সন্তানকে সে গঙ্গাসাগরে উৎসর্গ করবে। রাজপুতানা, মধ্য ও পশ্চিম ভারতের দরিদ্র রাজপুত, জাঠ ও মেওয়াট জাতির মধ্যেও শিশুকন্যাকে হত্যার কুপ্রথা প্রচলিত ছিল। সরকার ১৭৯৫ ও ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে দুটি পৃথক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে শিশুহত্যা নিষিদ্ধ করে। ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে আইন প্রণয়ন করে নববিজিত অঞ্চলগুলিতে শিশুহত্যা নিষিদ্ধ করা হয়।
2 সতীদাহপ্রথা রদ: ভারতীয় সমাজে দীর্ঘকাল ধরে ‘সতীদাহপ্রথা’ নামে এক অমানবিক প্রথা প্রচলিত ছিল। এই প্রথা অনুসারে মৃত স্বামীর চিতায় তার জীবন্ত বিধবা স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারা হত। সরকার ১৮১২, ১৮১৫ ও ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে কয়েকটি বিধিনিষেধ ঘোষণা করে সতীদাহপ্রথা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। রাজা রামমোহন রায় সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন ও শক্তিশালী জনমত গড়ে তোলেন। শেষপর্যন্ত বড়োলাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর এক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সতীদাহপ্রথা নিষিদ্ধ করেন।
3 বিধবাবিবাহ আইন: হিন্দুসমাজে দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের বিরুদ্ধে এবং বিধবাবিবাহের সপক্ষে পণ্ডিত তোলেন। রক্ষণশীল হিন্দু ঈশ্বরচন্দ্র বিদরা সপক্ষে প্রচার করলেও বিধবাবিবাহ হিন্দুশাস্ত্রসম্মত বলে বিদ্যাসাগর বিভিন্ন শাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেন। শেষপর্যন্ত বড়োলাট লর্ড ডালহৌসি ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই বিধবাবিবাহকে আইনসম্মত বলে ঘোষণা করেন।
4 নরবলি প্রথা রদ: উড়িষ্যার খোন্দ উপজাতি তাদের চাষের জমির উর্বরতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নরবলি দিত। বড়োলাট লর্ড হার্ডিঞ্জ এই নরবলি প্রথার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও তা বিশেষ সফল হয়নি। পরবর্তীকালে ১৮৪৭ ও ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে সরকারি কর্মচারীদের বিশেষ উদ্যোগে এই অমানবিক প্রথার অবসান ঘটে।
5 সহবাস সম্মতি আইন: সহবাসের (১৮৯১ খ্রি.) ফলে দশ-এগারো বছরের বালিকাবধূ ফুলমণির মৃত্যুর ঘটনা সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এই ঘটনায় অত্যন্ত বিচলিত তৎকালীন বড়োলাট লর্ড ল্যান্সডাউনের উদ্যোগে স্যার অ্যান্ড্র স্কোবল ‘সহবাস সম্মতি বিল’ উত্থাপন করেন। এই আইনে বিবাহের সর্বনিম্ন বয়স দশ থেকে বাড়িয়ে বারো বছর করার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
6 দাসত্বপ্রথা রদ: ভারতীয় সমাজে প্রাচীন কাল থেকেই দাসত্বপ্রথা প্রচলিত ছিল। বড়োলাট লর্ড অকল্যান্ড ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে এক আইনের মাধ্যমে ভারতে দাসত্বপ্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।
উপসংহার: ব্রিটিশ সরকার প্রথমদিকে ভারতের সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন মনোভাব গ্রহণ করলেও শেষপর্যন্ত ভারতীয় সংস্কারকদের চাপে সেই উদাসীনতা ভঙ্গ হয়।
প্রশ্ন15. ভারতের সমাজসংস্কারক হিসেবে রামমোহনের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করো।
অথবা, ভারতের সমাজসংস্কারক হিসেবে রামমোহন রায়ের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করো।
অথবা, ভারতের সমাজসংস্কারক হিসেবে রামমোহনের অবদান আলোচনা করো।
অথবা, ভারতের সমাজসংস্কারক হিসেবে রামমোহন রায়ের অবদান ব্যাখ্যা করো।
অথবা, ভারতের সমাজসংস্কারক হিসেবে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান লেখো।
ভূমিকা: রাজা রামমোহন রায় হলেন ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমাজসংস্কারক। তিনি তৎকালীন হিন্দু সমাজের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও সমাজসংস্কারে উদ্যোগী ছিলেন ও একাই লড়াই করে গিয়েছিলেন।
সমাজসংস্কারক রামমোহন
1 সতীদাহপ্রথা:
1. রামমোহনের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি: হিন্দু নারীর জীবনে এক নিষ্ঠুর অভিশাপ ছিল সতীদাহপ্রথা। তখনকার সমাজে রক্ষণশীল হিন্দুরা মৃত স্বামীর বিধবা স্ত্রীকে বোঝাতেন যে, স্বামীর সঙ্গে সহমরণে গেলে পুণ্য অর্জন হবে এবং পরলোকে সে তার মৃত স্বামীর সাহচর্য পারে। রামমোহন রায়ের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি এই নিষ্ঠুর সতীদাহপ্রথা রদ। তিনি বিভিন্ন গুণীজনের স্বাক্ষরিত এক আবেদনপত্রের মাধ্যমে সরকারকে জানান, মানবতাবোধ ও শাস্ত্র-সকল দিক থেকেই সতীদাহ নিন্দনীয়। এই কাজ নরহত্যা ছাড়া আর কিছুই নয়।
ii. সতীদাহপ্রথার উদ্দেশ্য: সতীদাহপ্রথা চালু রাখার পিছনে সে সময়কার গোঁড়া ব্রাহ্মণদের কিছু অসৎ উদ্দেশ্য ছিল। এ ছাড়া তৎকালীন হিন্দুসমাজের কিছু ভ্রান্ত বিশ্বাস এই প্রথা প্রচলিত থাকার পেছনে দায়ী ছিল। মৃত কুলীন পতির বহু বিধবার দায় এড়ানোর জন্য অর্থাৎ বিধবা নারীকে ভরণপোষণ করার যে ঝঞ্ঝাট বা দায়িত্ব থাকে তা থেকে উচ্চবর্ণের পরিবারগুলিকে রেহাই দিতে চাওয়া হয়েছিল। সে সময়ের সমাজের নিয়ন্ত্রকগণ বিধবার সম্পত্তি গ্রাস করতে চেয়েছিল। হিন্দুধর্মের সে সময়ে ভ্রান্ত বিশ্বাস ছিল যে মৃত স্বামীর সঙ্গে বিধবা পত্নীকে একই চিতায় দাহ করতে পারলে পরলোক গিয়ে পত্নীটি তার স্বামীর সাহচর্য পাবে। সতীদাহপ্রথায় নিজের প্রাণ উৎসর্গ করলে বিধবা নারীটি সতীরূপে সারা গ্রামে পূজিতা হবেন এবং তার নামে কোনো মনস্কামনা করলে তা পূরণ হবে-এই ভ্রান্ত বিশ্বাস মানুষের মধ্যে প্রচলিত ছিল।
iii. সতীদাহপ্রথার বিবরণ: বাংলার সমাজে সতীদাহ নামে যে নিষ্ঠুর ও অমানবিক প্রথাটি প্রচলিত ছিল, সেটি ছিল এরকম- উচ্চবর্ণের পরিবারে কোনো বধূ স্বামীহারা হলে মৃত স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় সেই বিধবা নারীটিকে নববধূর সাজে সাজিয়ে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে পুড়িয়ে মারা হত। জ্বলন্ত চিতায় অগ্নিদগ্ধ হওয়ার সময় বিধবাটির চিৎকার যাতে অন্য কারোর কানে না পৌঁছোয় তার জন্য শ্মশানে ঢাক, ঢোল, কাঁসর-ঘণ্টা বাজিয়ে একদল মানুষ পৈশাচিক উল্লাসে মেতে উঠত।
iv. সতীদাহপ্রথা রদে রামমোহনের প্রচেষ্টা: রামমোহন সতীদাহপ্রথা বন্ধ করার লক্ষ্যে বিভিন্ন হিন্দুশাস্ত্র ও ধর্মগ্রন্থ থেকে উক্তি তুলে ধরে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, সতীদাহ একটি ধর্মবিরুদ্ধ ও অশাস্ত্রীয় কুপ্রথা। এই প্রথা বন্ধের লক্ষ্যে তিনি ৩০০ জন বিশিষ্ট নাগরিকের স্বাক্ষর নিয়ে বড়োলাট বেন্টিষ্কের কাছে জমা দেন। রামমোহনকে এসময় সমর্থন জানিয়ে সমাচার দর্পণ, সংবাদ কৌমুদী, বেঙ্গল হরকরা, ইন্ডিয়ান গেজেট, ক্যালকাটা জার্নাল, ফ্রেন্ডস অব ইন্ডিয়া প্রভৃতি পত্রপত্রিকাতেও সতীদাহ-বিরোধী লেখা প্রকাশিত হয়। রামমোহন নিজে সতীদাহ-বিরোধী এক পুস্তিকা প্রকাশ করেন (১৮১৮ খ্রি.)।
v. সতীদাহপ্রথা রদ: রামমোহনের চেষ্টায় সতীদাহপ্রথা-বিরোধী যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তার রেশ বেন্টিঙ্ককেও স্পর্শ করে। বেন্টিঙ্ক ১৭ নং রেগুলেশন জারি করে সতীদাহপ্রথা রদ করেন (১৮২৯ খ্রি. ৪ ডিসেম্বর)। ঘোষণা করা হয় সতীদাহপ্রথা হল বেআইনি এবং তা ফৌজদারি আদালতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মাদ্রাজ-সহ ভারতের বিভিন্ন শহরে এই আইন কার্যকারী হয়। যোগেশচন্দ্র বাগল ‘মুক্তির সন্ধানে ভারত’ গ্রন্থে লিখেছেন, “রামমোহন জনসাধারণের চক্ষে সতীদাহ দমনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। টাউন হলের এক জনসভায় তাঁকে এজন্য কলিকাতার বিশিষ্ট নাগরিকরা সম্বর্ধনা দেন।”
2 জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা: রামমোহন হিন্দুসমাজের জাতিভেদ প্রথার প্রবল বিরোধী ছিলেন। তিনি জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রমাণ তুলে ধরার জন্য ‘বজ্রসূচী’ গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেন। তিনি অসবর্ণ বিবাহের সমর্থনেও কলম ধরেন।
3 নারীকল্যাণ প্রচেষ্টা: রামমোহন প্রথম অনুভব করেছিলেন যে, সমাজে নারীদের অবস্থানের উন্নয়ন ঘটানো এবং তাদের মর্যাদা বাড়ানো দরকার। তিনি মূলত যেসব নারী সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছিলেন সেগুলি হল-[i] স্বামী বা পিতার সম্পত্তিতে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা। তিনি যাজ্ঞবল্ক্য, কাত্যায়ন, ব্যাস প্রমুখ শাস্ত্রকারদের শাস্ত্রবিধান তুলে ধরে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, পিতার সম্পত্তিতে নারীদের অধিকার রয়েছে। [ii] স্ত্রীশিক্ষার সার্বিক প্রসার। কারণ তিনি মনে করতেন নারীসমাজকে শিক্ষার আলোয় নিয়ে আসতে না পারলে সমাজের প্রগতি ও সভ্যতার উন্নতি রুদ্ধ হয়ে যাবে। [iii] কৌলীন্য প্রথার শিকার নারীসমাজকে রক্ষা করা। [iv] বিবাহবিষয়ক এক নির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করা।
মূল্যায়ন: রামমোহনই হলেন ভারতের প্রথম ব্যক্তিত্ব যিনি সমাজ-সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন এবং সেই কাজে ব্রতী হন।
প্রশ্ন16. শিক্ষা ও ধর্মসংস্কারে রাজা রামমোহনের অবদান লেখো।
ভূমিকা: রাজা রামমোহন রায় বিশ্বাস করতেন যে জাতিকে অজ্ঞতা ও জড়তা থেকে মুক্ত করতে পারে একমাত্র পাশ্চাত্য শিক্ষা ও যুক্তিবাদ। তাই তিনি প্রাচ্যের শ্রেষ্ঠ ও শাশ্বত চিন্তাধারার সঙ্গে পাশ্চাত্যের শ্রেষ্ঠ ভাবধারায় সমন্বয় ঘটিয়ে নবভারত গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন।
শিক্ষাসংস্কার
1 শিক্ষাবিষয়ক চিন্তাধারা: রামমোহনের শিক্ষা বিষয়ক চিন্তায় ভারতের অতীত ঐতিহ্য ও গৌরবের সঙ্গে আধুনিক পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞানের মিলন ঘটানোর প্রয়াস ছিল। তাই তিনি সারাজীবন ধরেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যকে কাছাকাছি নিয়ে আসার চেষ্টা করে গেছেন। রামমোহনের শিক্ষাবিস্তারের মূল লক্ষ্য ছিল দেশবাসীকে বাস্তব জগতের উপযুক্তরূপে গড়ে তোলা ও তাদেরকে সমাজকল্যাণে নিয়োগ করে দেশ ও জাতিকে প্রগতি ও উন্নতির পথে চালিত করা।
2 পাশ্চাত্য শিক্ষা সমর্থক: রামমোহন তৎকালীন গভর্নর জেনারেল আমহার্স্টকে এক পত্র মারফত (১৮২৩ খ্রি.) ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার জন্য সরকারি অর্থ ব্যয়ের অনুরোধ জানান। এর পাশাপাশি তিনি চেয়েছিলেন শিক্ষার্থীদের গণিত, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা ও প্রাকৃতিকবিদ্যা পড়ানো হোক। তিনি ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে আলেকজান্ডার ডাফকে জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশন প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেন। তিনি ক্যালকাটা বুক সোসাইটির একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন।
3 স্কুল কলেজের প্রতিষ্ঠা: দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে তিনি স্কুল, কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও যত্নবান হন। তিনি নিজের প্রচেষ্টায় অ্যাংলো হিন্দু স্কুল (১৮১৭ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন। বেদান্ত শিক্ষার লক্ষ্যে কলকাতায় গড়ে তোলেন বেদান্ত কলেজ (১৮২৬ খ্রি.)।
4 বাংলা গদ্যসাহিত্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা: রামমোহন রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি ছিল-[i] বেদান্ত গ্রন্থ (১৮১৫ খ্রি.) [ii] বেদান্ত সার (১৮১৫ খ্রি.) [iii] ভট্টাচার্য্যের সহিত বিচার (১৮১৭ খ্রি.) [iv] মাণ্ডুক্যোপনিষৎ (১৮১৭ খ্রি.) [v] মুণ্ডুকোপনিষৎ (১৮১৯ খ্রি.) [vi] সহমরণ বিষয়ক প্রবর্তক ও নিবর্তকের দ্বিতীয় সম্বাদ (১৮১৯ খ্রি.) [vii] সুব্রহ্মণ্য শাস্ত্রীর সহিত বিচার (১৮২০ খ্রি.) [viii] ব্রাহ্মণ সেবধিঃ (১৮২১ খ্রি.) প্রভৃতি।
5 বিবিধ সংবাদপত্র প্রকাশনা: রামমোহন সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রের পরিবেশনের ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের দিশারি ছিলেন। তিনি বাংলা, হিন্দি, ইংরাজি ও ফরাসি ভাষায় বিভিন্ন সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। বাংলা ভাষায় ‘সম্বাদ কৌমুদী’ (১৮২১ খ্রি.) এবং ফারসিতে প্রকাশিত ‘মিরাৎ-উল-আখবর’ (১৮২২ খ্রি.) ইত্যাদি ছিল তাঁর প্রকাশিত সংবাদপত্রের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন।
ধর্মসংস্কার
1 একেশ্বরবাদী প্রচার: রামমোহন সর্বপ্রথম ফারসি ভাষায় ‘তুহফাৎ-উল-মুয়াহিদ্দিন’ শীর্ষক রচনায় পৌত্তলিকতাবাদ, অলৌকিক তত্ত্ব, বহু ঈশ্বরবাদ, অবতারবাদ ইত্যাদির বিরোধিতা করেন। বেদ, বেদান্ত, উপনিষদ, ইসলামীয় ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করে তিনি ঘোষণা করেন সব ধর্মই মূলত একেশ্বরবাদী। তিনি বলেন পৌত্তলিকতাই হিন্দুধর্মের শেষ কথা নয়। একেশ্বরবাদী ভাবধারায় ভারতের বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়কে একত্রিত করার লক্ষ্যে তিনি দ্বারকানাথ ঠাকুর, পাদরি অ্যাডাম্স প্রমুখের সাহায্যে ‘কলিকাতা ইউনিটেরিয়াম কমিটি’ গঠন করেন (১৮২১ খ্রি.)।
2 আত্মীয়সভা প্রতিষ্ঠা: রামমোহন হিন্দুধর্মের গোঁড়ামি ও পৌত্তলিকতাবাদের বিরোধিতার উদ্দেশ্যে ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ‘আত্মীয়সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন। আত্মীয়সভার বিভিন্ন অধিবেশনে হিন্দুধর্মের মূর্তিপূজার অসারতা, সতীদাহপ্রথা ও জাতিভেদ প্রথা বিষয়ে আলোচনা হত। আত্মীয়সভার সদস্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর, নন্দকিশোর বসু, প্রসন্নকুমার ঠাকুর প্রমুখ।
3 ব্রাত্মসভা গঠন: একেশ্বরবাদের প্রচার ও ধর্মীয় চেতনার বিকাশের লক্ষ্যে রামমোহন ব্রাহ্মসভা গঠন (১৮২৮ খ্রি.) করেন। রামমোহন ব্রাহ্মসভার মাধ্যমে তৎকালীন হিন্দুধর্মের রক্ষকদের গোঁড়ামিতে আঘাত করতে চেয়েছিলেন। প্রত্যেক শনিবার (পরে বুধবার) সন্ধ্যায় এই সভার প্রার্থনা অনুষ্ঠানের পাশাপাশি ব্রহ্মসংগীত পরিবেশন, বৈদিক শ্লোকের ব্যাখ্যা, বেদ- উপনিষদ পাঠ করা হত।
4 বেদান্তের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার: রামমোহন মনে করতেন নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনাই প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্রের শ্রেষ্ঠ দান। তাই তিনি বাংলা ভাষাতে বেদান্তের ভাষ্য রচনা করেছিলেন। এমনকি অদ্বৈতবাদ প্রচারের জন্য তিনি বেদান্ত কলেজও প্রতিষ্ঠা করেন (১৮২৫ খ্রি.)। তিনি ঈশ, কঠ, কেন, মণ্ডুক, মাণ্ডুক্য এই পাঁচটি উপনিষদের ভাবানুবাদ করেছিলেন।
মূল্যায়ন: উনিশ শতকে রামমোহন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষার মিলন, এবং জনশিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে একদিকে যেমন একজন শিক্ষা সংস্কারক হয়ে উঠেছিলেন, অপরদিকে তেমনই উদার মানসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি যুক্তিবাদী মননশীলতায় নিজেকে একজন শ্রেষ্ঠ ধর্মসংস্কারকরূপে প্রমাণ করেছিলেন।
প্রশ্ন17. শিক্ষা ও সমাজসংস্কারে রামমোহন রায়ের অবদান লেখো।
সূচনা: আধুনিক ভারতে যেসব সংস্কারক জন্মগ্রহণ করেছেন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগণ্য ছিলেন রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩ খ্রি.)।
রামমোহন ভারতীয় সমাজের অন্ধকার ও কুসংস্কার দূর করে জাতিকে আলোর পথ দেখান। তাঁকে ‘ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ’, ‘আধুনিক ভারতের জনক’, ‘আধুনিক ভারতের ইরাসমাস’ প্রভৃতি অভিধায় ভূষিত করা হয়। তিনি ছিলেন ‘ভারতীয় নবজাগরণের অগ্রদূত’। মোগল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর তাঁকে ‘রাজা’ উপাধি দেন।
রাজা রামমোহন রায়ের শিক্ষাসংস্কার
TOPIC [A] -এর 16 নং রচনাধর্মী প্রশ্নের উত্তরের ‘শিক্ষাসংস্কার’ শীর্ষক অংশটি দ্যাখো।
রাজা রামমোহন রায়ের সমাজসংস্কার
1 জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা: রামমোহন হিন্দু সমাজে জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতা প্রথার তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি ‘বজ্রসূচি’ গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদ করে প্রচার করেন যে, জাতিভেদ প্রথা শাস্ত্রসম্মত নয়। তিনি অসবর্ণ বিবাহের সমর্থনে বিভিন্ন পুস্তিকা রচনা করেন।
2 সতীদাহপ্রথা নিবারণ: তৎকালীন হিন্দু সমাজে উচ্চবর্ণের মধ্যে। মৃত স্বামীর চিতায় তার জীবিত স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারা হত। এই অমানবিক কুপ্রথা ‘সতীদাহ প্রথা’ নামে পরিচিত। এই কুপ্রথার বিরোধিতা করে রামমোহন জনমত গড়ার উদ্দেশ্যে প্রচারকার্য চালান। তিনি বড়োলাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিষ্কের কাছে ৩০০জন বিশিষ্ট নাগরিকের স্বাক্ষর সংবলিত একটি আবেদনপত্র জমা দিয়ে এই প্রথা বন্ধের দাবি জানান। তাঁর আবেদনে সাড়া দিয়ে বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে (৪ ডিসেম্বর) ১৭নং রেগুলেশন (Regulation-XVII) জারি করে সতীদাহপ্রথাকে বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা করেন।
3 নারীকল্যাণ: রামমোহন নারীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন উদ্যোগ নেন। [i] তিনি বিভিন্ন শাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেন যে, পিতা বা স্বামীর সম্পত্তিতে নারীর অধিকার আছে। [ii] তিনি স্ত্রীশিক্ষার প্রসারে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। [iii] কৌলীন্যপ্রথার অভিশাপ থেকে নারীসমাজকে রক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি প্রয়াস চালান। [iv] নারীর বিবাহ বিষয়ক সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যে তিনি প্রয়াস চালান।
4 অন্যান্য সামাজিক সংস্কার: রামমোহন বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, কন্যাপণ, কৌলীন্যপ্রথা, গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন প্রভৃতি কুপ্রথাগুলির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান। রামমোহন নারীপুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা, বিধবাবিবাহের প্রচলন প্রভৃতি বিষয়ে যথেষ্ট তৎপর হন।
উপসংহার: রামমোহন রায়ের চরিত্রে কিছু সীমাবদ্ধতাও লক্ষ করা যায়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় যে, তিনি জাতিভেদপ্রথা বা বহুবিবাহের বিরুদ্ধে তীব্রভাবে রুখে দাঁড়াননি। ব্রিটিশ সংস্কৃতির প্রতি অত্যন্ত অনুরাগের বশে তিনি দেশীয় শিক্ষার প্রতি অবহেলা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এসব সমালোচনা সত্ত্বেও আধুনিক ভারত গঠনে তাঁর অবদান অসীম।
প্রশ্ন18. উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণের রাজা রামমোহনের অবদান কী ছিল?
ভূমিকা: আধুনিক ভারতের নিমার্তারূপে ‘ভারতপথিক’ রাজা রামমোহন রায় যে সংস্কারমুখী কাজগুলি করে গেছেন, তার ওপর ভিত্তি করেই ভারতবর্ষ আধুনিক রূপ পেয়েছে। তাই তাঁকে ‘ভারতীয় নবজাগরণের অগ্রদূত’ বলা হয়।
সমাজসংস্কারে ভূমিকা
1 সতীদাহপ্রথার অবসান: তৎকালীন হিন্দুসমাজে মৃত স্বামীর চিতায় তার স্ত্রীকে নববধূর সাজে সাজিয়ে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে পুড়িয়ে মারা হত। আসলে মৃত কুলীন ব্যক্তিকে বহু বিধবার দায় থেকে মুক্তি, মৃতার সম্পত্তি গ্রাসের ইচ্ছা ও অন্যান্য সামাজিক জটিলতা এড়ানোর লক্ষ্যে রক্ষণশীল হিন্দুসমাজে এই জঘন্য সতীদাহপ্রথার প্রচলন ছিল। এই প্রথাটি বন্ধ করবার জন্য রামমোহন সেসময়কার বাংলার ৩০০ জন বিশিষ্ট নাগরিকের স্বাক্ষর সম্মিলিত এক আবেদনপত্রে তৎকালীন বড়োলাট লর্ড ি উইলিয়াম বেন্টিষ্কের কাছে পাঠান। বেন্টিঙ্ক রামমোহনের আবেদনে সাড়া দিয়ে ১৭ নং রেগুলেশন জারি করে সতীদাহপ্রথাকে বেআইনি বলে ঘোষিত করেন।
2 জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা: রামমোহন জাতিভেদ প্রথার প্রবল বিরোধী ছিলেন। তিনি জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে তিনি অসবর্ণ বিবাহের সমর্থনেও কলম ধরেন। তবে সমালোচকদের মতে, জাতিভেদ প্রথার বিরোধী হয়েও তিনি উপবীত ধারণ করতেন।
3 নারীকল্যাণ প্রচেষ্টা: [i] স্বামী বা পিতার সম্পত্তিতে নারীর অধিকার নিয়ে রামমোহন লড়াই করেছিলেন। তিনি যাজ্ঞবল্ক্য, ক্যাত্যায়ন, ব্যাস প্রমুখ শাস্ত্রকারদের শাস্ত্রবিধান তুলে ধরে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, পিতার সম্পত্তিতে নারীদের অধিকার রয়েছে। [ii] স্ত্রীশিক্ষার সার্বিক প্রসার চেয়েছিলেন রামমোহন। কারণ তিনি মনে করতেন নারীসমাজে শিক্ষার আলো নিয়ে আসতে না পারলে সমাজের প্রগতি ও সভ্যতার উন্নতি রুদ্ধ হয়ে যাবে। [iii] কৌলীন্য প্রথা থেকে নারীসমাজকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন তিনি। [iv] বিবাহ বিষয়ক এক নির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করার ওপর জোর দেন তিনি।
ধর্মসংস্কারে ভূমিকা
1 একেশ্বরবাদের প্রচার: মূর্তিপূজার ঘোর বিরোধী ছিলেন বলেই তিনি একেশ্বরবাদী ধর্মের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। এই কারণে হিন্দু ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ ও ঐতিহ্য বিশ্লেষণ করে তার বিশুদ্ধ রূপটি তিনি সকলের সামনে তুলে ধরেন।
2 কুসংস্কারের বিরোধিতা: ধর্মীয় ক্ষেত্রে রামমোহন এক যুক্তিবাদী মন নিয়ে চিন্তার স্বচ্ছতা ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা ধর্মীয় কুসংস্কারগুলি দূর করার উদ্যোগ নেন। ইংল্যান্ডে অতিবাহিত জীবনের শেষ দিনগুলিতে তিনি ইউনিটেরিয়ান খ্রিস্টধর্মের অনুরাগী হয়ে ওঠেন।
শিক্ষাসংস্কারে ভূমিকা
1 পাশ্চাত্য শিক্ষার সমর্থক: প্রাচ্য দর্শনকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তিবাদী পাশ্চাত্য শিক্ষাকে ভারতের পুনর্জাগরণের উপায় বলে রামমোহন মনে করতেন। তাই তিনি নিজে সংস্কৃত সাহিত্য, জৈনধর্ম, হিন্দু দর্শন, আরবি, ফারসি ও কোরানের মূল শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি ইংরেজি, ফরাসি, লাতিন, হিব্রু ও গ্রিক ভাষায় পান্ডিত্য অর্জন করেন। তাঁর দৃঢ় ধারণা ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষা ভারতবাসীকে যুক্তিবাদী ও বৈজ্ঞানিক মনের অধিকারী করে তুলবে।
2 স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা: রামমোহন শিক্ষার সার্বিক প্রসারের লক্ষ্যে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এই লক্ষ্যে তিনি হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং আলেকজান্ডার ডাফের সহযোগিতায় জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশন প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ নেন। তিনি নিজের প্রচেষ্টায় অ্যাংলো হিন্দু স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।
3 সংবাদপত্র প্রকাশনা: রামমোহন সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের দিশারি ছিলেন। তিনি বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি ও ফারসি ভাষার বিভিন্ন সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। বাংলা ভাষায় ‘সম্বাদ কৌমুদী’ (১৮২১ খ্রি.) এবং ফারসিতে প্রকাশিত ‘মিরাৎ-উল-আখবর’ (১৮২২ খ্রি.) ইত্যাদি ছিল তাঁর প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য সংবাদপত্রের নিদর্শন।
অর্থনৈতিক চিন্তা
রামমোহনের অর্থনৈতিক চিন্তাধারার পরিচয় মেলে সিলেক্ট কমিটির নির্ধারিত আর্থিক সমস্যার সমাধানকল্পে তাঁর অভিমত থেকে। ব্রিটিশ প্রশাসনের ব্যয়সংকোচের প্রশ্নে রামমোহনের অভিমত ছিল অধিক বেতনের ইউরোপীয় কর্মচারীর পরিবর্তে ভারতীয় কালেক্টর নিয়োগ অধিক উপযোগী। রামমোহনের যুক্তি ছিল-অবাধ বাণিজ্যনীতির সূত্রে ভারতে ব্যাপকভাবে বিদেশি পুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটবে, তার সুফল হিসেবে ভারতবাসীর আর্থিক উন্নয়ন ঘটবে। রামমোহন সম্পদের নির্গমনের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করলেও অবশিল্পায়নের প্রশ্নে নীরব ছিলেন।
রাজনৈতিক সংস্কারে ভূমিকা
রামমোহনের রাজনৈতিক ভাবনা মন্তেস্কু, বুশো, ভলতেয়ার, টম-পেইন, বেত্থাম প্রমুখের চিন্তভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। [1] তিনি মনে করতেন ভারতীয়দের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটানোর জন্য ভারতবর্ষের শাসনভার কোম্পানির হাত থেকে নিয়ে ব্রিটিশ পালার্মেন্টের হাতে তুলে দেওয়াই শ্রেয়। রামমোহন সাংবিধানিক নিয়ম মেনে শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে শাসনতান্ত্রিক অধিকার অর্জনে বিশ্বাসী ছিলেন। [2] সমকালীন ইউরোপের বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনায় রামমোহনের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়। যেমন-ইতালির রাজতন্ত্র বিরোধী অভ্যুত্থানের (১৮২১ খ্রি.) ব্যর্থতায় তিনি হতাশ হন। অন্যদিকে লাতিন আমেরিকায় স্পেন বিরোধী বিদ্রোহের (১৮২৩ খ্রি.) সফলতা এবং ফ্রান্সে ১৮৩০ খ্রি. জুলাই বিপ্লবের সাফল্যে তিনি উৎফুল্ল হন।
মূল্যায়ন: উনিশ শতকের সংস্কারাচ্ছন্ন হিন্দুসমাজে সাংস্কৃতিক নবজাগরণ, সামাজিক উন্নয়ন ও শিক্ষার উদারীকরণের ক্ষেত্রে রামমোহন ছিলেন পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অগ্রদূত স্বরূপ।
প্রশ্ন19. ভারতীয় নারীর কল্যাণে রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের প্রয়াস আলোচনা করো।
ভূমিকা: পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদী ও উদারনৈতিক চিন্তাধারা উনিশ শতকে। ভারতীয় সংস্কৃতিতে যে প্লাবন এনেছিল রামমোহন ও ঈশ্বরচন্দ্র ছিলেন তার দুই স্মরণীয় বাহক।
নারীকল্যাণে রামমোহনের প্রয়াস
1 নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা: রামমোহন স্ত্রী পুরুষের সমান অধিকারে একান্তভাবে বিশ্বাসী ছিলেন। নারীজাতিকে পুরুষের সঙ্গে একাসনে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে ভারতীয় সমাজের প্রকৃত উন্নতি অসম্ভব বলেই তিনি মনে করতেন। তাই সম্পত্তিতে মহিলাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি সোচ্চার হয়েছিলেন।
2 সতীদাহপ্রথা নিবারণ: নারীজাতির কল্যাণসাধনে রামমোহনের সর্বাপেক্ষা সফল প্রচেষ্টা হল সতীদাহপ্রথা নিবারণ আন্দোলন। এর সাহায্যে সমাজে নারীজাতির অমর্যাদা ও তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের তিনি তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। ১৮০০-১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতে ২ হাজার ৩৬৫ জন বিধবাকে সতীরূপে দাহ করা হয়। শেষ পর্যন্ত প্রগতিশীল জনমতের সমর্থনে এবং রামমোহনের প্রচেষ্টায় বড়োলাট উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর আইন জারি করে সতীদাহপ্রথা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেন।
3 স্ত্রীশিক্ষা প্রসার: স্ত্রীশিক্ষার প্রসারেও রামমোহন বেশ কতকগুলি প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষার সংস্পর্শে নারীদের আধুনিকরূপে গড়ে তোলার সমর্থক ছিলেন। কিন্তু গোঁড়া ব্রাহ্মণদের বিরোধিতার জন্য তিনি স্ত্রীশিক্ষার সফল প্রসার ঘটাতে পারেননি।
নারীকল্যাণে বিদ্যাসাগরের প্রয়াস
1 স্ত্রীশিক্ষা বিস্তার: স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারে তাঁর আগ্রহ ছিল গভীর। হিন্দু সমাজের সেই যুগে যখন মানুষের বিশ্বাস ছিল লেখাপড়া শিখলে স্ত্রীলোকের আশু বৈধব্য অনিবার্য, তখন সমস্ত কুসংস্কারকে ‘অজেয় পৌরুষ’-এ উপেক্ষা করে স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারে তাঁর উৎসাহ ও প্রচেষ্টা ছিল অক্লান্ত। স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারের জন্য তিনি হুগলি, মেদিনীপুর, বর্ধমান জেলায় স্ত্রীশিক্ষা সম্মিলনী গঠন করেন। তিনি ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত থেকে নারীদের সার্বিক উন্নয়নে সচেষ্ট ছিলেন।
2 বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা: বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে বড়োলাটের কাউন্সিলের সদস্য ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল স্থাপন করেন (যা বর্তমানে বেথুন স্কুল নামে পরিচিত)। তিনি মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশন নামক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন যা পরে মেট্রোপলিটন কলেজ (আজকের বিদ্যাসাগর কলেজ) নামে পরিচিতি পায়। সরকারি বিদ্যালয় পরিদর্শকরূপে বিদ্যাসাগর ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিলেন; এগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটি তাঁর নিজ ব্যয়ে পরিচালিত হত। বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়গুলিতে প্রায় ১ হাজার ৩০০ জন ছাত্রী পড়াশোনা করত। ইংরেজি শিক্ষার পাশাপাশি, ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে ছোটোলাট হ্যালিডের আনুকূল্যে ঈশ্বরচন্দ্র হুগলি, বর্ধমান, নদিয়া ও মেদিনীপুর জেলায় ২০টি আদর্শ বাংলা বিদ্যালয় স্থাপন করেন।
3 বাল্যবিবাহের বিরোধিতা: বাল্যবিবাহ প্রথা বন্ধের পক্ষে মত প্রকাশ করে তিনি ‘সর্বশুভকরী পত্রিকার’ প্রথম সংখ্যায় ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ নামক একটি প্রবন্ধ লেখেন। তিনি বাল্যবিধবাদের দুঃখমোচনের জন্য আজীবন চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।
4 বিধবাবিবাহ প্রবর্তন: বিদ্যাসাগরের আর এক অনবদ্য কৃতিত্ব হল হিন্দু বিধবার পুনর্বিবাহ আইন প্রবর্তনে সরকারের স্বীকৃতি আদায় করা। এই আইন যাতে বিধিবদ্ধ হয় তার জন্য তিনি ‘সর্বশুভকরী’ পত্রিকা ও ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় বিধবাদের পুনর্বিবাহের প্রয়োজন ও স্বাধীনতা সম্বন্ধে প্রবন্ধ লেখেন। সেই সঙ্গে বিধবাবিবাহ যে শাস্ত্র অনুমোদিত তা ‘পরাশর সংহিতা’ থেকে নানা উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি প্রমাণ করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বড়োলাট ডালহৌসি শেষপর্যন্ত হিন্দু বিধবাবিবাহ আইন প্রণয়ন করেন। আর ওই আইনে স্বাক্ষর করে তা বিধিবদ্ধ করেন পরবর্তী বড়োলাট ক্যানিং (২৬ জুলাই, ১৮৫৬ খ্রি.)। বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় বাংলায় প্রথম যে বিধবাবিবাহটি অনুষ্ঠিত হয় (১৮৫৬ খ্রি., ৭ ডিসেম্বর) তাতে পাত্র ছিলেন ২৪ পরগনা ১৮৬৪ খ্রি.), ‘শ্লোক মঞ্জুরী’ (১৮৯০ খ্রি.) সংকলন করেন। তাঁর অন্যান্য রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘আবার অতি অল্প হইল’ (১৮৭৩ খ্রি.), ‘ব্রজবিলাস’ (১৮৮৪ খ্রি.), ‘রত্নপরীক্ষা’ (১৮৮৬ খ্রি.) প্রভৃতি।
7 অনুবাদ: অনুবাদকরূপে বিদ্যাসাগর অসাধারণ মুনশিয়ানার পরিচয় দেন। বিদ্যাসাগর সংস্কৃত, হিন্দি, ইংরেজি বিভিন্ন ভাষার গ্রন্থ অনুবাদ করেন। হিন্দি ‘বেতাল পচ্চিশির’ বঙ্গানুবাদ ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ (১৮৪৭ খ্রি.), কালিদাস রচিত ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্’ অনুসরণে ‘শকুন্তলা’ (১৮৫৪ খ্রি.) ভবভূতির ‘উত্তর রামচরিত’ অবলম্বনে ‘সীতার বনবাস’ (১৮৬০ খ্রি.), শেকসপিয়র রচিত ‘কমেডি অব এররস’-এর ভাবানুবাদ ‘ভ্রান্তিবিলাস’, মার্শম্যানের ‘History of Bengal’ গ্রন্থটির অনুবাদ ‘বাংলার ইতিহাস’ ছিল তাঁর উল্লেখযোগ্য অনুবাদ সাহিত্য। ঈশপের ‘ফেবলস’-এর অবলম্বনে তিনি রচনা করেন ‘কথামালা’।
উপসংহার: বিদ্যাসাগর শিক্ষাকে জীবিকা অর্জনের মাধ্যম বলে মানতেন না। তাঁর কাছে শিক্ষা ছিল মনুষ্যত্বে উত্তরণের সিঁড়ি।
প্রশ্ন22. উনিশ শতকে বাংলার সমাজজীবনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান পর্যালোচনা করো।
অথবা, সমাজসংস্কারক রূপে বিদ্যাসাগরের মূল্যায়ন করো।
সূচনা: বিদ্যাসাগর সারাজীবন ধরেই সমাজের বহুমুখী সংস্কারে ব্রতী ছিলেন। কুসংস্কার ও বিভিন্ন নিয়মকানুনের বেড়াজালে আবদ্ধ হিন্দুসমাজের নারীদের সার্বিক উন্নয়নের জন্য তাঁর প্রচেষ্টা ছিল অবিস্মরণীয়। বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহের বিরোধিতা, বিধবাবিবাহের পক্ষে। আন্দোলন, নারীশিক্ষার বিস্তার, উচ্চশিক্ষার প্রসার, সর্বোপরি জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতা-সহ বিভিন্ন সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গেছেন।
বিধবাবিবাহ প্রবর্তন
1 বিধবাবিবাহ প্রবর্তন: সমাজসংস্কারক বিদ্যাসাগরের জীবনে সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হল বিধবাবিবাহ প্রবর্তন। সে সময়কার হিন্দুসমাজে অত্যন্ত অল্পবয়সি মেয়েদের সঙ্গে বয়স্ক এমনকি বৃদ্ধদেরও বিবাহ হত। ফলস্বরূপ অনেক সময় অল্প বয়সেই মেয়েরা বিধবা হত। বিদ্যাসাগর সর্বপ্রথম হিন্দু বাল্যবিধবাদের বৈধব্যকালীন জীবনযন্ত্রণা অনুভব করেন। তিনি ‘পরাশর সংহিতা’ থেকে উদ্ধৃতি তুলে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত। উনিশ শতকের সমাজসংস্কার আন্দোলনের ইতিহাসে বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ আন্দোলনই প্রথম সর্বভারতীয় আন্দোলন।
2 বিধবাবিবাহের সপক্ষে আইন পাস: বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে বিধবাবিবাহকে সমর্থন জানিয়ে ৯৮৭ জন ব্যক্তির স্বাক্ষর সম্বলিত এক আবেদনপত্র ভারতীয় আইনসভার সদস্যদের কাছে পাঠানো হয় (১৮৫৫ খ্রি. ৪ অক্টোবর)। বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় লর্ড ডালহৌসির সরকার অবশেষে ১৪নং রেগুলেশন দ্বারা বিধবাবিবাহ আইন পাস করায় (১৮৫৬ খ্রি. ২৬ জুলাই) এবং এক ঘোষণায় বলে-বিধবাবিবাহজাত সন্তান পিতার সম্পত্তির বৈধ উত্তরাধিকার পাবে।
3 বিধবাবিবাহ আয়োজন: বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন এবং বর্ধমান জেলার পলাশডাঙার ব্রহ্মানন্দ মুখার্জির দশ বছরের বিধবা কন্যা কালীমতি দেবীর মধ্যে প্রথম বিধবাবিবাহ অনুষ্ঠিত হয় (১৮৫৬ খ্রি. ৭ ডিসেম্বর)। এরপরে নিজের পুত্র নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গে বিদ্যাসাগর ১৮ বছরের ভবসুন্দরী নামক বিধবার বিবাহ দেন। ১৮৫৬-৬৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে তিনি নিজের ৮২ হাজার টাকা খরচ করে মোট ৬০ জন বিধবার বিবাহ দিয়েছিলেন। দরিদ্র বিধবাদের সাহায্য করার জন্য বিদ্যাসাগর ‘হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুইটি ফান্ড’ (১৮৭২ খ্রি.) গঠন করেন ও নিজে তার কোষাধ্যক্ষ হন। নিজ পুত্রের বিধবাবিবাহ প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগর ভাই শম্ভুচন্দ্রকে লিখেছিলেন-“নারায়ণ স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া এই বিবাহ করিয়া আমার মুখ উজ্জ্বল করিয়াছে।”
বহুবিবাহের বিরোধিতা
সে সময়কার হিন্দু সমাজে বহুবিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। জনসাধারণকে বহুবিবাহের ক্ষতিকর দিকগুলির সম্বন্ধে ধারণা দেওয়ার জন্য বিদ্যাসাগর দু- খণ্ডের ‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ নামক এক গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি এই প্রথাটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বর্ধমানের মহারাজা (মহাতাব চাঁদ)-র সহায়তায় ৫০ হাজার মানুষের স্বাক্ষরিত এক প্রতিবাদপত্র ব্রিটিশ সরকারের কাছে পাঠান (১৮৫৫ খ্রি.)। ব্রিটিশ সরকার বিদ্যাসাগর-সহ কয়েকজনকে নিয়ে বহুবিবাহ বন্ধের লক্ষ্যে আইন প্রনয়ণের জন্য এক কমিটি নিয়োগ করে। কিন্তু মহাবিদ্রোহের পর সরকারি তরফে হিন্দু সামাজিক প্রথায় হস্তক্ষেপে দ্বিধা থাকায় এই ব্যাপারটি খুব বেশি দূর এগোয়নি।
বাল্যবিবাহের বিরোধিতা
তৎকালীন হিন্দুসমাজে বাল্যবিবাহ ছিল এক অভিশাপের মতো। এই অভিশাপ মোচনের জন্য তিনি আজীবন সচেষ্ট ছিলেন। বাল্যবিবাহের বিরোধিতা করে বিদ্যাসাগর ‘সর্বশুভকারী’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ নামক প্রবন্ধ লেখেন। বাল্যবিবাহের ফলে মেয়েরা খুব কম বয়সেই বিধবা হত। ফলে বাকি জীবনটা তাদের বৈধব্যের গ্লানি ও বিভিন্ন কঠোর সামাজিক অনুশাসনের মধ্যে কাটাতে হত। এই অল্পবয়সি মেয়েদের জীবনের দুঃখ মোচনের জন্যই বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহের প্রচলন করতে চেয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে যেভাবে সোচ্চার হয়েছিলেন তার ফলশ্রুতিরূপে ব্রিটিশ সরকার এক আইন পাস (১৮৬০ খ্রি.) করে মেয়েদের বিয়ের নূন্যতম বয়স ১০ বছর ধার্য করে।
অন্যান্য সামাজিক সংস্কার
বিদ্যাসাগর সে সময়কার সমাজের অন্যান্য বেশকিছু সংস্কারকে দূর করতে চেয়েছিলেন। গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন প্রথা, কুষ্ঠরোগী হত্যার নিয়ম, জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে তিনি সরব হন। কৌলীন্য প্রথার বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। এই কুপ্রথাটির ইতিহাস পর্যালোচনা করে তিনি দেখিয়েছিলেন যে শুধুমাত্র অর্থলোলুপতার জন্য এই প্রথা কতদূর হীন হতে পারে। কৌলীন্য প্রথার বলি হয়ে নারীরা সমাজে কতটা অসহায় হয়ে বেঁচে থাকে তা তিনি অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে অনুভব করেন। তিনি হুগলি আবেদনপত্র ভারতীয় আইনসভার সদস্যদের কাছে পাঠানো হয় (১৮৫৫ খ্রি. ৪ অক্টোবর)। বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় লর্ড ডালহৌসির সরকার অবশেষে ১৪নং রেগুলেশন দ্বারা বিধবাবিবাহ আইন পাস করায় (১৮৫৬ খ্রি. ২৬ জুলাই) এবং এক ঘোষণায় বলে-বিধবাবিবাহজাত সন্তান পিতার সম্পত্তির বৈধ উত্তরাধিকার পাবে।
3 বিধবাবিবাহ আয়োজন: বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন এবং বর্ধমান জেলার পলাশডাঙার ব্রহ্মানন্দ মুখার্জির দশ বছরের বিধবা কন্যা কালীমতি দেবীর মধ্যে প্রথম বিধবাবিবাহ অনুষ্ঠিত হয় (১৮৫৬ খ্রি. ৭ ডিসেম্বর)। এরপরে নিজের পুত্র নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গে বিদ্যাসাগর ১৮ বছরের ভবসুন্দরী নামক বিধবার বিবাহ দেন। ১৮৫৬-৬৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে তিনি নিজের ৮২ হাজার টাকা খরচ করে মোট ৬০ জন বিধবার বিবাহ দিয়েছিলেন। দরিদ্র বিধবাদের সাহায্য করার জন্য বিদ্যাসাগর ‘হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুইটি ফান্ড’ (১৮৭২ খ্রি.) গঠন করেন ও নিজে তার কোষাধ্যক্ষ হন। নিজ পুত্রের বিধবাবিবাহ প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগর ভাই শম্ভুচন্দ্রকে লিখেছিলেন-“নারায়ণ স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া এই বিবাহ করিয়া আমার মুখ উজ্জ্বল করিয়াছে।”
বহুবিবাহের বিরোধিতা
সে সময়কার হিন্দু সমাজে বহুবিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। জনসাধারণকে বহুবিবাহের ক্ষতিকর দিকগুলির সম্বন্ধে ধারণা দেওয়ার জন্য বিদ্যাসাগর দু- খণ্ডের ‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ নামক এক গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি এই প্রথাটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বর্ধমানের মহারাজা (মহাতাব চাঁদ)-র সহায়তায় ৫০ হাজার মানুষের স্বাক্ষরিত এক প্রতিবাদপত্র ব্রিটিশ সরকারের কাছে পাঠান (১৮৫৫ খ্রি.)। ব্রিটিশ সরকার বিদ্যাসাগর-সহ কয়েকজনকে নিয়ে বহুবিবাহ বন্ধের লক্ষ্যে আইন প্রনয়ণের জন্য এক কমিটি নিয়োগ করে। কিন্তু মহাবিদ্রোহের পর সরকারি তরফে হিন্দু সামাজিক প্রথায় হস্তক্ষেপে দ্বিধা থাকায় এই ব্যাপারটি খুব বেশি দূর এগোয়নি।
বাল্যবিবাহের বিরোধিতা
তৎকালীন হিন্দুসমাজে বাল্যবিবাহ ছিল এক অভিশাপের মতো। এই অভিশাপ মোচনের জন্য তিনি আজীবন সচেষ্ট ছিলেন। বাল্যবিবাহের বিরোধিতা করে বিদ্যাসাগর ‘সর্বশুভকারী’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ নামক প্রবন্ধ লেখেন। বাল্যবিবাহের ফলে মেয়েরা খুব কম বয়সেই বিধবা হত। ফলে বাকি জীবনটা তাদের বৈধব্যের গ্লানি ও বিভিন্ন কঠোর সামাজিক অনুশাসনের মধ্যে কাটাতে হত। এই অল্পবয়সি মেয়েদের জীবনের দুঃখ মোচনের জন্যই বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহের প্রচলন করতে চেয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে যেভাবে সোচ্চার হয়েছিলেন তার ফলশ্রুতিরূপে ব্রিটিশ সরকার এক আইন পাস (১৮৬০ খ্রি.) করে মেয়েদের বিয়ের নূন্যতম বয়স ১০ বছর ধার্য করে।
অন্যান্য সামাজিক সংস্কার
বিদ্যাসাগর সে সময়কার সমাজের অন্যান্য বেশকিছু সংস্কারকে দূর করতে চেয়েছিলেন। গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন প্রথা, কুষ্ঠরোগী হত্যার নিয়ম, জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে তিনি সরব হন। কৌলীন্য প্রথার বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। এই কুপ্রথাটির ইতিহাস পর্যালোচনা করে তিনি দেখিয়েছিলেন যে শুধুমাত্র অর্থলোলুপতার জন্য এই প্রথা কতদূর হীন হতে পারে। কৌলীন্য প্রথার বলি হয়ে নারীরা সমাজে কতটা অসহায় হয়ে বেঁচে থাকে তা তিনি অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে অনুভব করেন। তিনি হুগলি জেলার ১৩৩ জন ব্রাহ্মণের বৈবাহিক সম্পর্কের তালিকা তৈরি করে দেখান যে সমাজে কৌলীন্য প্রথার সুযোগ নিয়ে কুলীন ব্রাহ্মণেরা কীভাবে নারীদের সর্বনাশ করছে।
মূল্যায়ন: সমাজসংস্কারকরূপে বিদ্যাসাগর যে সমস্ত ক্ষেত্রেই সফলতা পেয়েছিলেন তা নয়। তবে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি সমাজসংস্কারে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন।
প্রশ্ন23. উনিশ শতকে বাংলার ইতিহাসে ইয়ংবেঙ্গল আন্দোলনের ভূমিকা লেখো।
অথবা, ডিরোজিও ও নব্যবঙ্গ আন্দোলনের বিবরণ দাও।
ভূমিকা: ফরাসি বিপ্লবের মানবিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে এবং রুশো, ভলতেয়ার, হিউম, লক, বেকান, টমপেইন, বেত্থাম, রিড প্রমুখ পাশ্চাত্য দার্শনিকের যুক্তিবাদী দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত এক যুব সম্প্রদায়ের আত্মপ্রকাশ ঘটে। হিন্দু কলেজের অধ্যাপক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও-র নেতৃত্বে তারা হিন্দুসমাজে প্রচলিত ধর্মীয় ও সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে তীব্র জেহাদ ঘোষণা করেন, যা নব্যবঙ্গ বা ইয়ংবেঙ্গল আন্দোলন নামে পরিচিত। ঐতিহাসিক তারাচাঁদের মতে- “রক্ষণশীল হিন্দুসমাজে তাঁরা যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিলেন তার ফলে চিন্তাজগতেও বিপ্লব ঘটেছিল।”
1 মতাদর্শ: দীর্ঘদিন ধরে হিন্দুসমাজে ধর্মকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত কুসংস্কার প্রচলিত ছিল সেগুলির বিরুদ্ধে নব্যবঙ্গীয়রা সোচ্চার হয়েছিলেন। তাঁরা চেয়েছিলেন আর্থসামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে যে সমস্ত ভণ্ডামি বা – লোক দেখানো নিয়মকানুন ছিল সেগুলির অবসান ঘটাতে তাঁরা জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতা, সতীদাহপ্রথা-সহ বেশ কিছু কুপ্রথাকে সমূলে বিনাশ করার – আদর্শ গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর ছাত্রদের প্রতি ডিরোজিওর শিক্ষার মূল বক্তব্য ছিল-“স্বাধীন চিন্তার দ্বারা মত ও পথ স্থির করবে, কোনো প্রচলিত সংস্কার অন্ধভাবে অনুশীলন করবে না, জীবনে ও মরণে একমাত্র সত্যকেই অবলম্বন করবে, সৎগুণ অনুশীলন করবে, আর যা কিছু অন্যায় ও অসৎ তা পরিহার করবে।”
2 গোষ্ঠীর সদস্যগণ: ইয়ংবেঙ্গল বা নব্যবঙ্গীয় গোষ্ঠীর সদস্যগণ হলেন রামতনু লাহিড়ী, রসিককৃয় মল্লিক, কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, প্যারীচাঁদ মিত্র, লালবিহারী দে, মাধবচন্দ্র মল্লিক, তারাচাঁদ চক্রবর্তী, শিবচন্দ্র দেব, কিশোরীচাঁদ মিত্র, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রাধানাথ শিকদার, কাশীপ্রসাদ ঘোষ, মহেশচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ। অধ্যাপক সুশোভন সরকারের মতে- “ডিরোজিয়ানরা তাঁদের শিক্ষকের স্মৃতির প্রতি শেষ পর্যন্ত অনুগত ছিলেন এবং নিজেরা পারস্পরিক সহানুভূতি ও বন্ধুত্বের বাঁধনে আবদ্ধ ছিলেন।”
3 কার্যাবলি: ইয়ংবেঙ্গল বা নব্যবঙ্গীয়রা সে সময়কার সমাজের জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা, সতীদাহপ্রথা-সহ বিভিন্ন কুসংস্কার ও নানা আর্থসামাজিক কুপ্রথাগুলির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন। ডিরোজিয়ানরা হিন্দু সমাজের নিয়ন্ত্রক ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের রক্ষণশীলতা বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ করে বলতেন-‘আমরা গোরু খাই গো।’ কালীঘাটের মা ফালীকে সম্বোধন করেন, ‘গুড মর্নিং ম্যাডাম’ বলে। ডিরোজিয়ানরা ফ্রান্সের ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই বিপ্লবের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে কলকাতার টাউন হলে এক বিজয় উৎসব পালন করে ও ফরাসি বিপ্লবের ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা মনুমেন্টে (এখনকার শহিদ মিনার) টাঙিয়ে দেয় (২৫ ডিসেম্বর)। নব্যবঙ্গীয়রা সনাতন হিন্দুধর্মের পৌত্তলিকতার তীব্র সমালোচনা করেন। আসলে নব্যবঙ্গীয়রা সমকালীন হিন্দু সমাজব্যবস্থা ও হিন্দুধর্মের গোঁড়ামিগুলিকে সহ্য করতে পারত না।
4 অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন গঠন: ডিরোজিও তাঁর অনুগামীদের নিয়ে মানিকতলায় শ্রীকৃয় সিংহের বাগানবাড়িতে গঠন করেন অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন নামক এক বিতর্কসভা (১৮২৮ খ্রি.)। ডিরোজিও নিজে ছিলেন এর সভাপতি এবং ডিরোজিওর ছাত্র উমেশচন্দ্র বসু ছিলেন এর সম্পাদক। এই প্রতিষ্ঠানটি ছিল ভারতের প্রথম ছাত্র সংগঠন। অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনের বিভিন্ন অধিবেশনে সনাতন হিন্দুসমাজের জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা, পৌত্তলিকতার ওপর আলোচনা ও বিতর্ক চলত।
5 বিভিন্ন পত্রপত্রিকা প্রকাশ: ডিরোজিওর অনুগামী ছাত্ররা ‘পার্থেনন’ নামক একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন (১৮৩০ খ্রি.)। এই পত্রিকায় তাঁরা হিন্দুসমাজের বিভিন্ন কুপ্রথাগুলির বিরুদ্ধে লেখা প্রকাশ করেন। হিন্দু কলেজের সহসভাপতি প্রাচ্যবাদী হোরেস হেম্যান উইলসন এই পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশের আগেই এটি বন্ধ করে দেন। কৃয়মোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পার্সিকিউটেড’ পত্রিকায়, মাধবচন্দ্র মল্লিক ‘বেঙ্গল হরকরা’ পত্রিকায় হিন্দুসমাজের কুসংস্কার ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লেখেন। নব্যবঙ্গীয়দের প্রচেষ্টায় ‘সোসাইটি ফর অ্যাকুইজিশন অব জেনারেল নলেজ’ নামক এক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে (১৮৩৮ খ্রি.)। ডিরোজিও নিজেও একই লক্ষ্য নিয়ে ‘হেসপেরাস’, ‘ক্যালকাটা লিটারারি গেজেট’, ‘ক্যালাইডোস্কোপ’ ইত্যাদি পত্রিকার সম্পাদনা করতেন। ডিরোজিওর অনুগামীরা ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ভাষায় ‘জ্ঞানান্বেষণ’ ইংরেজি ভাষার ‘দি এনকুয়েরার’, ‘বেঙ্গল স্পেকটেটর’, ‘হিন্দু পাইওনিয়ার’ নামক পত্রিকা প্রকাশ ও সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা (১৮৩৮ খ্রি.) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নব্যবঙ্গীয় আন্দোলনের ধারা বজায় রাখেন। ডিরোজিও রচিত ‘ফকির অব জাংঘিরা’, ‘টু ইন্ডিয়া মাই নেটিভ ল্যান্ড’- কবিতাগুলিতে তাঁর ভারতপ্রেমের পরিচয় মেলে।
6 আন্দোলনের অবসান: ডিরোজিওর মৃত্যুর পর থেকেই ক্রমশ নব্যবঙ্গ বা ইয়ংবেঙ্গল আন্দোলন উপযুক্ত নেতার অভাবে শ্লথ হয়ে পড়ে। ডিরোজিওর অনুগামীদের অনেকেই সমাজসংস্কারের পথ থেকে সরে গিয়ে ব্যক্তিগত জীবনে প্রতিষ্ঠিত হন এবং প্রাচীন হিন্দুত্ববাদী ধর্মের সঙ্গে নিজেদেরকে অঙ্গীভূত করে নেন।
উপসংহার: ডিরোজিওর নেতৃত্বে নব্যবঙ্গীয় আন্দোলনকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা চলে না। নব্যবঙ্গীয়দের মধ্যে প্রথম পাশ্চাত্য সভ্যতা ও পাশ্চাত্য আদর্শের সূর্যালোক প্রতিফলিত হয়েছিল। সাময়িকভাবে হলেও নব্যবঙ্গীয়রা ভারতবর্ষের সমকালীন সমাজব্যবস্থা, ধর্মনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে আলোড়ন সৃষ্টি করতে পেরেছিল।
প্রশ্ন24. ‘নব্যবঙ্গ’ আন্দালনে ডিরোজিওর ভূমিকা লেখো। নব্যবঙ্গীয় আন্দোলন ব্যর্থ হয় কী কারণে?
নব্যবঙ্গ আন্দোলন ও ডিরোজিও
1 মতাদর্শ: জিরোজিও ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ, হিউম, লক, ভলতেয়ার, টম পেইন প্রমুখের দর্শন এবং শিক্ষক ডেভিড ড্রামন্ডের মুক্ত চিন্তা, মুক্তিবাদিতা, আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত হন। পরবর্তী সময়ে শিক্ষকরূপে তিনি তাঁর ছাত্রদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করার এবং যুক্তি ও বিচারের দ্বারা সবকিছু গ্রহণ করার কথা বলেন। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন অতীত গৌরবের অধিকারী ভারতবর্ষের বর্তমান অধঃপতন আটকাতে পারে একমাত্র পাশ্চাত্য ছোঁয়া। তিনি তাঁর ছাত্রদের বলতেন- “সত্যের জন্য বাঁচো, । অসত্য থেকে মুক্ত হও।”
2 ডিরোজিয়ানস: ডিরোজিওর ছাত্রমণ্ডলী তথা অনুগামী নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর সদস্যরা ডিরোজিয়ানস্ নামে পরিচিত। এদের মধ্যে অন্যতম কয়েকজন ছিলেন তারাচাঁদ চক্রবর্তী (১৮০৬-৫৫ খ্রি.), রামগোপাল ঘোষ (১৮১৫-৬৮ খ্রি.), প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮১৪-৮৩ খ্রি.), রেভারেন্ড কৃয়মোহন বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮১৩-৮৫ খ্রি.), রসিককৃয় মল্লিক (১৮১০-৫৮ খ্রি.), রামতনু লাহিড়ী (১৮১২-৮৭ খ্রি.), রাধানাথ শিকদার (১৮১৩-৭০ খ্রি.) প্রমুখ।
3 আদর্শ শিক্ষক: ডিরোজিও মাত্র ১৭ বছর বয়সে (১৮২৬ খ্রি.) হিন্দু। কলেজে ইংরেজি ও ইতিহাসের অধ্যাপক পদ গ্রহণ করেন। শিক্ষক হিসেবে ন’ তিনি তাঁর ছাত্রদের মনে স্বাধীন চিন্তা ও যুক্তিবাদের বীজ বপন করেন। – শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে এ লিখেছেন-“চুম্বক যেমন লৌহকে আকর্ষণ করে, তেমনই তিনিও ■ বালকগিদকে আকর্ষণ করিতেন। এরূপ অদ্ভুত আকর্ষণ, শিক্ষক-ছাত্রে এরূপ ন সম্বন্ধ কেউ কখনও দেখে নাই।”
4 অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন গঠন: ডিরোজিও তাঁর । অনুগামীদের নিয়ে কলকাতার মানিকতলায় শ্রীকৃয় সিংহের বাগানবাড়িতে প অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি পাঠচক্র গঠন করেন (১৮২৮ ৪ খ্রি.)। এই সংগঠনের মাধ্যমে তিনি তাঁর ছাত্রদের মধ্যে স্বাধীন চিন্তা ও – যুক্তিবাদের বিকাশ ঘটাতে চেয়েছিলেন। এই সংগঠনটির বিভিন্ন অধিবেশনে ■ সনাতন হিন্দুধর্মের জাতিভেদ প্রথা ও অস্পৃশ্যতা, অদৃষ্টবাদ, পৌত্তলিকতা ■ ইত্যাদির বিরুদ্ধে সমালোচনা ও বিতর্ক হত। ‘এথেনিয়াম’ ছিল এই সংঘের ■ মুখপত্র। অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনকে অনেকেই ভারতের প্রথম ছাত্র ■ সংগঠন বলে উল্লেখ করেছেন। এই প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা প্রসঙ্গে ‘হিন্দু ■ পেট্রিয়ট’ পত্রিকায় লেখা হয়- “অক্সফোর্ড, ক্রেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাবগুলি যে ভূমিকা পালন করে, হিন্দু কলেজের ছাত্রদের নিয়ে গঠিত অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনও সেই ভূমিকা পালন করে।”
5 পত্রিকা প্রকাশন: ডিরোজিও নিজে ‘হেসপেরাস’ ও ‘ক্যালকাটা লিটারারি গেজেট’ নামে দুটি পত্রিকা সম্পাদনার মাধ্যমে হিন্দুধর্মের কুসংস্কার ও গোঁড়ামির বিরোধিতা করেন। ডিরোজিওর অনুগামীরা একই লক্ষ্যে ‘পার্থেনন’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। এ ছাড়াও ডিরোজিও ব্যক্তিগত উদ্যোগে ‘ক্যালেইডোস্কোপ’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লেখালেখি শুরু করেন।
নব্যবঙ্গীয় আন্দোলনের ব্যর্থত্যর কারণ
1 উপযুক্ত কর্মসূচীর অভাব: বৃহত্তর সমাজকে নিজেদের চিন্তায় প্রভাবিত করার মতো কর্মসূচি ডিরোজিয়ানদের ছিল না। এঁদের অতি উচ্ছ্বাস হিন্দু সম্প্রদায়ের মনে ক্ষোভ ও আতঙ্কের সঞ্চার করে। তাই সমাজের প্রগতিশীল বা রক্ষণশীল কোনো অংশই এঁদের আচরণ মেনে নেয়নি। ডিরোজিয়ানদের তাই অনেকেই উচ্ছৃঙ্খল, কালাপাহাড়, সমাজবিচ্ছিন্ন উগ্র গোষ্ঠী হিসেবে আখ্যা দেয়।
2 অধিক উচ্ছ্বাস ও ভাবাবেগ: ডিরোজিয়ানদের মধ্যে উচ্ছ্বাস ও ভাবাবেগ অত্যন্ত বেশি ছিল। তাঁদের মধ্যে ভারসাম্যের অভাব ছিল। সমাজে দ্রুত প্রতিষ্ঠালাভের তাগিদে এবং রক্ষণশীল গোষ্ঠীর বিরোধিতায় তাঁরা কিছুটা বাড়াবাড়ি করে ফেলেন। অপরিণত বয়সি ডিরোজিয়ানরা তারুণ্যে ও ভাবাবেগে বাংলার সমাজজীবনে আলোড়ন তুললেও স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারেননি।
3 নগরকেন্দ্রিকতা: নব্যবঙ্গ দলের ক্রিয়াকলাপ কয়েকজন ইংরেজি-শিক্ষিত শহুরে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত ঘরের ছাত্রদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে এঁদের সম্পর্ক গড়ে না ওঠায় এই আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে।
4 শ্রমিক ও কৃষকদের প্রতি উদাসীনতা: দেশের জনসংখ্যার মূল অংশ অর্থাৎ কৃষকশ্রেণির সমস্যা ও তার সমাধানে এঁরা অনাগ্রহী ছিলেন। ফলে কৃষকশ্রেণিও এই আন্দোলন সম্পর্কে উদাসীন ছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে দেশীয় কুটিরশিল্পের ধ্বংসসাধন ঘটলে শ্রমিকদের দুরবস্থার প্রতিকার সম্পর্কে তারা উদাসীন ছিল।
5 সমাজের অভিজাতদের বিরোধিতা: হিন্দু সমাজের মধ্যে শুভবুদ্ধি জাগ্রত করার কোনো চেষ্টা না করে, সবকিছু না জেনেই তার বিরোধিতা করার ফলে সমগ্র হিন্দু সম্প্রদায়ই নব্যবঙ্গীয়দের বিরুদ্ধে চলে যায়। বিশেষত, সমাজের অভিজাত ও রক্ষণশীল গোষ্ঠী জিরোজিয়ানদের তীব্র বিরোধিতা করেন। আসলে সমাজে নানা কুসংস্কার ও সমস্যা নিয়ে তাঁরা যতটা সরব হয়েছিলেন সেগুলি সমাধানের ব্যাপারে ততটাই নীরব ছিলেন।
6 মুসলিমদের অনাগ্রহ: মুসলিম সমাজের সংস্কার নিয়ে ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠীর কোনো চিন্তাভাবনা ছিল না। তাই মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে এই আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক ছিল না। ফলে সমাজের একটা বৃহৎ অংশই এই আন্দোলন থেকে মুখ ফিরিয়ে ছিল।
7 ধারাবাহিক নেতৃত্বের অভাব: ডিরোজিওর পর উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ে। ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠীর অনেকেই আন্দোলন থেকে সরে আসেন। অনেকে সরকারি চাকরি বা ব্যবসায় মনোযোগ দিয়ে নিজেদের সংসার জীবনে উন্নতির চেষ্টা করেন। রসিককৃয় মল্লিক, মাধবচন্দ্র মল্লিক, গোবিন্দচন্দ্র বসাক প্রমুখ ডেপুটি কালেক্টার এবং কিশোরীচাঁদ মিত্র ও শিবচন্দ্র দেব ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হন।
প্রশ্ন 25 সমাজসংস্কারে ইয়ংবেঙ্গল আন্দোলনের ভূমিকা ও তার ব্যর্থতার কারণগুলি আলোচনা করো।
সমাজসংস্কারে ইয়ংবেঙ্গল আন্দোলনের ভূমিকা
হিন্দু কলেজের অধ্যাপক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও-র নেতৃত্বে তাঁর অনুগামী (ডিরোজিয়ানস্) -রা অর্থাৎ নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী বা ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠীর সদস্যরা সমাজসংস্কারে উদ্যোগী হয়।
1 সমাজের রক্ষণশীলতার বিরোধিতা: ডিরোজিও-র নেতৃত্বে ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠীর সদস্যরা সমাজের রক্ষণশীলতার বিরোধিতা করেন। আবেগপ্রবণ হয়ে তাঁরা প্রথাগত ধর্মবিশ্বাস বা খাদ্যাভাসের বিরোধিতা করেন। তাই ‘ওরিয়েন্টাল ম্যাগাজিনে’ তাঁদের সম্পর্কে লেখা হয় তাঁরা শূকর ও গোরুর মাংসের মধ্য দিয়ে নিজেদের পথ করে নেয় এবং তাদের উদারনীতিবাদ পৌঁছায় বিয়ারের পাত্রে। কলেজ স্ট্রিটের রাস্তায় কোনো ব্রাহ্মণ দেখতে পেলেই এই গোষ্ঠীর সদস্যরা চেঁচিয়ে বলতেন তাঁরা গো-মাংস খান। কালীঘাটে দেবীর মূর্তির উদ্দেশ্য তাঁরা বলতেন ‘গুড মর্নিং ম্যাডাম’। তাই সে সময়কার কলকাতার রক্ষণশীল সমাজ তাদেরকে নাস্তিক আখ্যা দেয় এবং ডিরোজিওকে ‘ভবঘুরে ফিরিঙ্গি’ বলে সমালোচনা করে। ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠির সদস্য রসিককৃয় মল্লিক প্রকাশ্য আদালতে চেঁচিয়ে বলেন যে, তিনি গঙ্গা নদীর পবিত্রতায় বিশ্বাস করেন না।
2 কুসংস্কারের বিরোধিতা: ডিরোজিও ও তার অনুগামীরা সমাজের ও তে বিধবাবিবাহ প্রবর্তন বিভিন্ন কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সরব হন। সতীদাহপ্রথা রদ, ও স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে তাঁরা আধুনিক মনের পরিচয় দেন। জি- বিদ্যাসাগরের আগেই তাঁরা বিধবাবিবাহের প্রতি সমর্থন জানিয়ে প্রচার চালাতেন। বাল্যবিবাহ, কুলীন প্রথা, বহুবিবাহ প্রভৃতি সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে তাঁরা জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা চালান। ডিরোজিয়ানরা ভলতেয়ার হিউম, লক, টম পেইনের রচনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে হিন্দু সমাজের কুপ্রথাগুলির সমালোচনা শুরু করেন। ‘পার্থেনান’ পত্রিকায় এই গোষ্ঠীর সদস্যরা সামাজিক কুসংস্কারগুলির তীব্র সমালোচনা করে লেখালেখি শুরু করেন। ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠীর সদস্য কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায় ‘দি এনকুয়েরার’ পত্রিকাতে হিন্দু সমাজের কুসংস্কার ও গোঁড়ামির বিরোধিতা করে লেখা প্রকাশ করেন। দি এনকুয়েরার’ পত্রিকায় নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর তরফ থেকে লেখা হয়। “হৈ চৈ এবং বিভ্রান্তি ছাড়া কোনো মানুষের সংস্কার সাধন সম্ভব নয়। … আমরা সেই দায়িত্বই গ্রহণ করেছি।”
3 সমাজে যুক্তিবাদের বীজ বপন: ভারতীয় সমাজকে যুক্তিবাদের পথে পরিচালনার প্রথম কৃতিত্ব প্রাপ্য ডিরোজিও ও তাঁর অনুগামীদের। টম পেইনের ‘এজ অব রিজন’ গ্রন্থ পাঠে অনুপ্রাণিত হয়ে ডিরোজিয়ানরা হিন্দু সমাজে যুক্তিবাদের বীজ বপন শুরু করেন। এঁদের উদ্যোগে প্রকাশিত ‘জ্ঞানান্বেষণ’, ‘দি এনকুয়েরার’, ‘দ্য বেঙ্গল স্পেকটেটর’ প্রভৃতি পত্রপত্রিকা দেশবাসীর মনে যুক্তিবাদ বিস্তারে ও কুসংস্কারমুক্ত মানসিকতা গঠনে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছিল। তা ছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের জন্য নব্যবঙ্গীয়রা জ্ঞানার্জনী সমিতি নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এককথায়, বাংলা তথা ভারতের ভাবজগতের পরিবর্তনের অগ্রদূত হিসেবে এঁদের অবদান নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য। নব্যবঙ্গীয় সদস্য রামগোপাল ঘোষ বলেন-“যে যুক্তির দ্বারা পরিচালিত হবে না সে একজন গোঁড়া, যে যুক্তির দ্বারা পরিচালিত হতে পারে না সে একজন নির্বোধ, এবং যে যুক্তির দ্বারা পরিচালিত হয় না সে একজন ক্রীতদাস।”
4 বিভিন্ন বৈষম্যের বিরোধিতা: তৎকালীন সমাজের বিভিন্ন বৈষম্যের অবসানে ডিরোজিয়ান বা নব্যবঙ্গীয়রা সরব হয়েছিলেন। নারী-পুরুষের বৈষম্য, বিচারব্যবস্থায় ভারতীয় ও ইউরোপীয়দের বিচার বৈষম্য, জাতিগত বৈষম্য, চিরস্থায়ী ভূমি বন্দোবস্ত এমনকি পুলিশি ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ব্রিটিশের বৈষম্যমূলক আচরণের তীব্র প্রতিবাদ জানায় ইয়ংবেঙ্গল সদস্যগণ।
ইয়ংবেঙ্গল আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণসমূহ
TOPIC [A]-এর 24 নং রচনাধর্মী প্রশ্নের উত্তরের ‘নব্যবঙ্গীয় আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ’ শীর্ষক অংশটি দ্যাখো।
প্রশ্ন25. উনবিংশ শতাব্দীর ধর্মসংস্কার আন্দোলনে ব্রাত্মসমাজের ভূমিকা কী ছিল?
ভূমিকা: উনবিংশ শতকের ধর্মসংস্কার আন্দোলনের পুরোধা তথা পথিকৃৎ ছিল ব্রাহ্মসমাজ।
ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠা
রামমোহন উপনিষদকে ভিত্তি করে ব্রাহ্মসভা নামক যে একেশ্বরবাদী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গঠন করেন, তা ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মসমাজ নামে পরিচিতি পায়। এই ধর্মসংঘটি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল এক ও অদ্বিতীয় ব্রাহ্মের উপাসনা করা। ব্রাহ্মসমাজের সদস্যরা পৌত্তলিকতাবাদের বিরোধী ও একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী ছিলেন এবং তারা বেদ, উপনিষদ, পুরাণ অনুসারে হিন্দু আচার অনুষ্ঠানের | ওপর বেশি জোর দিয়েছিলেন।
ব্রাহ্মসমাজের বিবর্তন ও কার্যকলাপ
1 আদি ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্বে: ১৮৩৩ খ্রি. রামমোহন রায় মারা যাবার পর ব্রাহ্মসমাজ দুর্বল হয়ে পড়ে। দ্বারকানাথ ঠাকুর ও রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের প্রচেষ্টায় কোনোরকমে ব্রাহ্মসমাজের অস্তিত্ব টিকে থাকে। রামমোহনের মৃত্যুর প্রায় ৭ বছর পর দ্বারকানাথ ঠাকুরের পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্ব গ্রহণ করলে ব্রাহ্ম আন্দোলন পুনরায় গতিশীল হয়ে ওঠে। দেবেন্দ্রনাথের প্রচেষ্টায় ব্রাহ্মসমাজ এক বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসেবে গড়ে ওঠে। তিনি ভিন্ন ধর্মীয় নিয়মকানুন, আচার-আচরণ ও দীক্ষা দান রীতির প্রবর্তন ঘটিয়ে ব্রাত্ম আন্দোলনকে এক সুগঠিত ধর্মীয় রূপ দান করেন। তিনি ব্রাহ্মধর্মের অনুষ্ঠান পদ্ধতি নামে এক গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে ব্রাহ্ম অনুরাগীদের সুশৃঙ্খলরূপে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা নেন। তিনি এক সভার আয়োজন করে রামমোহন নির্দেশিত বেদান্ত প্রতিপাদ্য ‘সত্যধর্ম’ নামের পরিবর্তে ‘ব্রাহ্মধর্ম’ নামের উদ্যোগ নেন।
2 ভারতীয় ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্বে: ১৮৫৭ খ্রি. কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্মসমাজে যোগদান করলে ব্রাহ্মধর্মীয় আন্দোলন আরও গতিশীল হয়ে ওঠে। কেশবচন্দ্র ব্রহ্ম উপাসনা পদ্ধতিকে ও ব্রাহ্মধর্মের মূল তত্ত্বগুলিকে আরও সহজ সরলভাবে উত্থাপিত করে সেগুলিকে যুগ ও সমাজের উপযোগী করে তোলেন। কিন্তু কেবশচন্দ্রের প্রগতিশীল মনোভাবে দেবেন্দ্রনাথের সায় না থাকায় তাঁর অনুগামীদের নিয়ে ব্রাহ্মসমাজ থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন (১৮৬৬ খ্রি. ১১ নভেম্বর)। ফলে দেবেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে ব্রাহ্মসমাজ ‘আদি ব্রাহ্মসমাজ’ নামে পরিচিতি পায়। কেশবচন্দ্রের নব প্রতিষ্ঠিত ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ উপাসনা হিসেবে বৈয়ব সংকীর্তন নীতিকে গ্রহণ করে। কেশবচন্দ্রের নেতৃত্বে ব্রাহ্মধর্ম ‘সর্বধর্ম সমন্বয়কারী নববিধান’ হিসেবে ঘোষিত হয় (১৮৮০ খ্রি.)। কেশবচন্দ্র বৈয়বদের ভক্তিবাদের সঙ্গে খ্রিস্টানদের ঈশ্বরপ্রেমের সমন্বয় ঘটান। তাঁর নেতৃত্বে উপবীত বর্জন প্রথা চালু হয়।
3 সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্বে: অচিরেই ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে অন্তর্বিরোধের সূচনা ঘটে। তরুণ যুক্তিবাদী প্রগতিশীল সদস্যরা সমাজ ও ব্রাহ্মমন্দিরগুলির পরিচালনার জন্য সংবিধান রচনার দাবি জানালে এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংঘের নেতা নির্বাচনের দাবি তুললে কেশবচন্দ্রের সঙ্গে মতবিরোধ ঘটে। অবশেষে নেটিভ ম্যারেজ অ্যাক্ট-এর বিধি ভেঙে কেশবচন্দ্র কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের সঙ্গে নিজের ১৪ বছর বয়সি কন্যা সুনীতির হিন্দুমতে বিবাহ দিতে প্রগতিশীল তরুণ নেতারা ব্রাহ্মসমাজ ছেড়ে বেরিয়ে যান। শিবনাথ শাস্ত্রী ও আনন্দমোহন বসুর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে “সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ” (১৮৮১ খ্রি., জানুয়ারি)। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের প্রচেষ্টার ফলে ব্রাহ্মধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন অনেকটাই প্রগতিশীল ও উদার হয়ে ওঠে।
অবদান
1 ধর্মীয় অনাচারের অবসান: সে সময়কার ভারতবর্ষের ধর্মীয় ক্ষেত্রে মূর্তিপূজাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের আচার অনুষ্ঠানগুলি অনাচারের রূপ নেয়। প্রথমে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, পরে কেশবচন্দ্রের প্রচেষ্টায় ধর্মীয় ক্ষেত্রে বিভিন্ন অনাচারের অনেকটাই অবসান ঘটে।
2 মূর্তিপূজার বিরোধিতা: রামমোহনের হাত ধরে যে পৌত্তলিকতাবাদ বিরোধী ধর্মসংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছিল তা অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন, শিবনাথ শাস্ত্রী ও আনন্দমোহন বসু প্রমুখ।
3 সর্বধর্মসমন্বয়ের আদর্শ স্থাপন: ব্রাহ্মধর্মে সর্বধর্মসমন্বয়বাদের আদর্শ প্রতিফলিত হয়েছিল। রামমোহনের একেশ্বরবাদী ধর্মচেতনার সঙ্গে ইসলামীয় ও খ্রিস্টীয় ধ্যানধারণার সংমিশ্রণ ঘটেছিল। দেবেন্দ্রনাথের ব্রাহ্মধর্ম থেকে কোনো আলাদা ধর্ম ছিল না। আর কেশবচন্দ্র মনে করতেন, ব্রাহ্মধর্ম হল একটি সর্বজনীন ধর্ম। যেখানে সকল জাতির ও সকল ধর্মের মানুষের অবাধ প্রবেশাধিকার থাকবে।
মূল্যায়ন: ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলন ধর্মীয় ক্ষেত্রে পাশাপশি সামগ্রিক রূপে জাতীয় জাগরণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
প্রশ্ন26. উনবিংশ শতাব্দীর সামাজিক উন্মেষে স্বামী বিবেকানন্দের অবদান বিশ্লেষণ করো।
ভূমিকা: ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতের সমাজব্যবস্থা ছিল জাতপাত, বর্ণ, ধর্মের বেড়াজালে আবদ্ধ ছিল যে গুটিকয়েক সমাজসংস্কারকের প্রচেষ্টায় ভারতীয় সমাজ ধীরে ধীরে আধুনিক হয়ে উঠেছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন স্বামী বিবেকানন্দ।
সামাজিক উন্মেষে বিবেকানন্দের অবদান
1 সমাজভাবনা: স্বামীজি অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার ত্যাগ করে সকলকে যুক্তিবাদী হয়ে ওঠার কথা বলেন। স্বামীজির স্বপ্ন ছিল সমাজে সকল শ্রেণিই একদিন একসূত্রে আবদ্ধ হবে। সমাজের দরিদ্র, অনুন্নত বা পিছিয়ে পড়া মানুষদের সামনের সারিতে নিয়ে আসার প্রয়োজন রয়েছে বলে তিনি মনে করতেন।
2 জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা: স্বামীজি জাতিভেদ প্রথার তীব্র নিন্দা করেন। তিনি ভারতবাসীকে জাতিভেদ প্রথা ত্যাগ করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে উন্নতির জন্য উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেন। তিনি বলেন ভারতে ভবিষ্যতে আসবে শূদ্রের যুগ। শুদ্র বিপ্লবের মধ্য দিয়ে এক নতুন ভারত জন্ম নেবে, স্বামীজি বলেন-“নতুন ভারত বেরুক লাঙ্গল ধরে, চাষার কুটির ভেদ করে, জেলে মাল্লা-মুচি-মেথরের ঝুপড়ির মধ্যে হতে, বেরুক মুদির দোকান থেকে, ভুনাওয়ালার উনুনের পাশ থেকে, বেরুক কারখানা থেকে, হাট থেকে, বাজার থেকে, বেরুক ঝোপ জঙ্গল পাহাড়-পর্বত থেকে।
3 দরিদ্র ভারতবাসীর সেবা: বিবেকানন্দ বলেছেন যথার্থ দেশসেবক হতে হলে দেশবাসীকে মনে প্রাণে ভালোবাসতে হবে। আর এক্ষেত্রে সবার – আগে দরিদ্র ভারতবাসীর সেবা করতে হবে। কারণ ধূলিধূসরিত, ক্ষুধার্ত ■ দেশবাসীর মুক্তি ছাড়া ভারতের উন্নতির সম্ভবনা নেই। তাই দেশবাসীর প্রতি তিনি আহ্বান জানিয়ে বলেন- “সদর্পে বল-আমি ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই, বল-মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই।”
4. নারীমুক্তির সমর্থক: বিবেকানন্দ সমাজে নারীদের মর্যাদাবৃদ্ধির জন্য নারীমুক্তির গুরুত্ব অনুভব করেছিলেন। তিনি স্ত্রীশিক্ষার প্রসারকে সমর্থন করেন, কারণ তিনি মনে করেন মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়লে তারা ভালো মন্দ বুঝতে শিখবে। তিনি বাল্য বিবাহেরও বিরোধী ছিলেন। তিনি কখনোই মনে করতেন না যে পাশ্চাত্য নারীরাই হল ভারতীয় নারীদের কাছে আদর্শস্বরূপ। আমেরিকায় থাকাকালীন এক ভাষণে তিনি বলেছিলেন- “ভারতীয় বিধবারা যথেষ্ট কর্তৃত্বশালী ও মর্যাদার অধিকারী।”
5 সামাজিক সাম্যের প্রচারক: স্বামীজি বলেন একচেটিয়া অধিকারের দিন শেষ হয়েছে। সকলের জন্য সমান ভোগ ও সমান অধিকারের ব্যবস্থা করতে হবে। অনুন্নতদের উন্নত করে সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তিনি আরও বলেন শিক্ষিত ব্যক্তিরা শিক্ষা দিয়েও ধনী ব্যক্তিরা ধন দিয়ে সেবা করলে সমাজের মঙ্গল হবে। স্বামীজি অনুন্নত শ্রেণির প্রতি বলেন কেবল উচ্চ শ্রেণির লোকেদের দোষ দিলে চলবে না। উন্নতির জন্য নিজেদেরও চেষ্টা করে যেতে হবে।
6 সাধারণের সুখদুঃখের শরিক: স্বামীজি আসমুদ্রহিমাচল পরিভ্রমণ করে সাধারণ ভারতবাসীর সুখ দুঃখের শরিক হয়েছিলেন। ভারত পরিভ্রমণকালে তিনি ভারতীয় সমাজের দোষ, ত্রুটি, অন্যায়, অবিচারগুলি প্রত্যক্ষ করেন। পরিভ্রমণকালে ভারতীয় সমাজে রক্ষণশীলতা, জাতিভেদের সংকীর্ণতা, দারিদ্র্য, শোষণ সবকিছুই তার চোখে পড়ে। সাধারণ দরিদ্র ভারতবাসীর দুঃখমোচনের জন্য তিনি স্বাবলম্বী হওয়ার কথা বলেন।
7 যুবসমাজের অনুপ্রেরণা: স্বামীজি ছিলেন যুবসমাজের কাছে আদর্শ। তিনি যুবকদের লৌহকঠিন পেশি, ইস্পাতকঠিন চরিত্র ও বজ্রদীপ্ত মনের অধিকারী হয়ে ওঠার কথা বলেন। সকল সামাজিক সংকীর্ণতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার আহ্বান জানান যুবসমাজের প্রতি। তিনি যুবসমাজের উদ্দেশ্যে বলেন- “গীতা পাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলা ভালো।” যুবকদের উদ্দেশ্যে স্বামীজি আরও বলেন-“ওঠো, জাগো নিজের প্রাপ্য বুঝে নাও।”
8 রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজসেবা: সমাজকল্যাণের আদর্শকে বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্য স্বামীজি প্রতিষ্ঠা করেন রামকৃয় মিশন (১৮৯৭ খ্রি. ১ মে)। এই মিশনের বহু উদ্দেশ্যের মধ্যে অন্যতম হল জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে দুঃস্থ মানুষদের সেবা করা। আজও নির্যাতিত, অবহেলিত, শোষিত মানুষের পাশে দাঁড়নো ও তাদের দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করার ব্রত পালন করে চলেছে রামকৃয় মিশন।
মূল্যায়ন: স্বামীজি মনে প্রাণে চেয়েছিলেন এক গোঁড়ামিমুক্ত, কুসংস্কারমুক্ত জাতপাতহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠুক। এই সমাজের পরিচালিকা শক্তি হোক, শূদ্রগণ। সমাজসংস্কারকদের প্রতি তাঁর সাবধান-বাণী ছিল- “সামাজিক ব্যধির প্রতিকার বাহিরের চেষ্টা দ্বারা হইবে না, মনের উপর কার্য করিবার চেষ্টা করিতে হইবে।”
প্রশ্ন27. জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও নবভারত গঠনে স্বামী বিবেকানন্দের অবদান নির্ণয় করো।
ভূমিকা: পরাধীন ভারতবর্ষে স্বদেশবাসীকে সর্বপ্রথম আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলর কাজে সমীল হয়েছিলেন যিনি, মৃতপ্রায় একটি জাতির দেহে প্রাণ সঞ্চার করেছিলেন যিনি, তিনি হলে শ্রী শ্রী রামকৃয়দেবের প্রিয়তম শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ। স্বামীজির জাতীয়তাবাদী আদর্শ, স্বদেশচেতনা ও দেশপ্রেমে উদবুদ্ধ হয়েছিল পরবর্তী প্রজন্ম।
জাতীয়তাবাদের বিকাশে বিবেকানন্দ
1 জাতীয়তাবাদী আদর্শ: দেশবাসীর উদ্দেশ্যে স্বামীজির মহাজাগরণের বানীগুলি জাতীয়তাবাদের বোধন ঘটিয়েছিল। পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করার জন্য স্বামীজি যুব সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান
জানান। পন্যভূমি ভারতকে তিনি জীবনের একমাত্র সত্য বলে মনে করতেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন-“ভারতের মৃত্যু হলে সত্যের মৃত্যু ঘটবে।” তিনি বলেন-আমামী ৫০ বছরের জন্য ভারতমাতাই আমাদের আরাধ্য দেবতা। অন্যান্য অকেজো দেবতাদের ভুলে গেলে ক্ষতি নেই।
2 জাতীয়তাবাদের অগ্রদূত: স্বামীজি কোনোদিনই প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক আন্দোলনগুলির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু তাঁর অন্তরে স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের ঘাটতি ছিল না। স্বামীজির জ্ঞানযোগ, রাজযোগ, বর্তমান ভারত, পরিব্রাজক প্রভৃতি গ্রন্থ ও পত্রাবলিগুলি বিপ্লবীদের প্রেরণার উৎস ছিল। নেতাজি তাঁর অসম্পূর্ণ আত্মজীবনী ‘ভারত-পথিক-এ স্বীকারোক্তি জানান-“স্বামীজির বানী ও রচনাবলি আমার চিন্তাধারার স্বীকারোক্তি ঘাটিয়েছিল।” গান্ধিজি বলেন-তাঁর রচনাবলি পাঠ করে মাতৃভূমির প্রতি আমার ভালোবাসা সহস্রগুণ বুদ্ধি পেয়েছে।
3 স্বাধীনতা আন্দোলনের স্থাপতি: স্বামীজির বাণীগুলিতে উদ্দীপ্ত হয়েও উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে যুবসম্প্রদায় স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। স্বাধীনতার দাবিতে উত্তাল রক্তে রাঙা দিনগুলিতে স্বামীজি ছিলেন বিপ্লবীদের আদর্শ। গোপাল হালদারের মতে-বাংলাদেশকে যদি কেউ বিপ্লবী মন্ত্রে জাগিয়ে থাকনে, তিনি বিবেকানন্দ। বিবেকানন্দ বলেন কেবল সাহসী শক্তিমানরাই স্বাধীনতা অর্জন করতে পারবে।
4 জাতীয়তাবাদী স্বরূপ: স্বামীজির জাতীয়তাবাদে মাতৃভূমির শৃঙ্কলমোচনের পাশাপাশি মানবমুক্তির কথা বলা হয়। স্বামীজি বলেছিলেন-“জগতের ইতিহাস পর্যালোচনা কর, যেখানেই কোনো সুমহান আদর্শের সন্ধান মিলবে দেখিতে পাইবে উহার জন্ম ভারতবর্ষে।”
নবভারত গঠনে বিবেকানন্দ
1 স্বামীজির স্বপ্নের ভারত: স্বামীজি এমন এক ভারতের স্বপ্ন দেখতেন যেখানে থাকবে না ক্ষুধার জন্য আর্তনাদ, স্বার্থের জন্য শোষণ, লোভের জন্য নিপীড়ন, গরিমার জন্য অবহেলা। নবভারতের রূপকার স্বামীজি চেয়েছিলেন নতুন ভারত গড়ে উঠবে প্রকৃত মানুষদের নিয়ে। তিনি বলেন-“নতুন ভারত বেরুক, বেরুক লাঙল ধরে, চাষার কুটির ভেদ করে, জেলে-মাল্লা-মুচি-মেথরের ঝুপড়ির মধ্যে হতে, বেরুক মুদির দোকান থেকে, ভুনাওয়ালার উনুনের পাশ থেকে, বেরুক কারখানা থেকে, হাট থেকে, বাজার থেকে, বেরুক জঙ্গল পাহাড় পর্বত থেকে।”
2 স্বদেশ ও দেশবাসীর মুক্তির সাধনা: ভারতবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে স্বামীজি বলেন- “সদর্পে বল আমি ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই।” তিনি বলতেন-“ভারতবাসী আমার ভাই, ভারতবাসী আমার প্রাণ, ভারতের দেবদেবী আমার ঈশ্বর, ভারতের সমাজ আমাদের শিশুশয্যা, আমার যৌবনের উপবন, আমার বাধ্যক্যের বারাণসী। বলো ভাই-ভারতের মৃত্তিকা আমার স্বর্গ, ভারতের কল্যাণ আমার কল্যাণ।”
3 আদর্শ যুবসমাজ গঠনে অনুপ্রেরণা: স্বামীজি ছিলেন যুবসমাজের আদর্শ। তিনি ভারতের স্বাধীনতা এবং নতুন ভারত গঠনের ক্ষেত্রে যুবশক্তির ওপরই ভরসা করতেন। তিনি যুবসমাজকে লৌহ কঠিন পেশি, ইস্পাত কঠিন চরিত্র ও বজ্রদীপ্ত মনের অধিকারী হওয়ার আহ্বান জানান। তাঁর বিশ্বাস ছিল একশত খাঁটি আদর্শবাদী যুবক মিলিত হলে ভারতের স্বাধীনতা অবশ্যম্ভাবী। তিনি চেয়েছিলেন, যুবসমাজ আগুন ছড়িয়ে দেবে হিমালয় থেকে কন্যাকুমারীকা পর্যন্ত, উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত।
4 রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা: স্বামী বিবেকানন্দ প্রকৃত মানুষ তৈরির লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করেন রামকৃষ্ণ মিশন (১৮৯৭ খ্রি. ১ মে)। এই মিশনের উদ্দেশ্য ধর্মীয় ঐক্য ও বৈদান্তিক আদর্শের বিশ্বব্যাপী প্রচার হলেও রামকৃষ্ণ মিশনের আসল লক্ষ্য হল মানবরূপী দেবতাদের সেবা করা। অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী অবহেলিত, শোষিত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত, অত্যাচারিত, অসহায় ও নিঃস্ব মানুষগুলির পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্ত করা। রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠার দ্বারা স্বামীজি জীবসোবাকেই জীবনের পরম ব্রতরূপে গ্রহণ করেছিলেন। “জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর”-এই ছিল তাঁর মন্ত্র।
মূল্যায়ন: স্বামীজির আদর্শ ও যাবতীয় ধ্যানধারণা ঘিরে ছিল স্বদেশ ও স্বাদেশবাসীর মুক্তি ও তার সঙ্গে বিশ্ব মানবতার মোক্ষ লাভ। স্বামীজিকে স্মরণ করে আজও প্রতি বছর ১২ জানুয়ারি তাঁর জন্মদিনটি যুবদিবসরূপে পালিত হয়।
প্রশ্ন28. মুসলিম সমাজের অগ্রগতির ক্ষেত্রে স্যার সৈয়দ আহমেদ খানের অবদান উল্লেখ করো।
অথবা, আলিগড় আন্দোলনের প্রসারে স্যার সৈয়দ আহমেদ খানের কৃতিত্বের পরিচয় দাও।
অথবা, মুসলিমদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে আলিগড় আন্দোলনের অবদান কী ছিল?
অথবা, স্যার সৈয়দ আহমেদ খান ও আলিগড় আন্দোলন সম্পর্কে কী জান লেখো।
অথবা, ভারতের মুসলমানদের নবজাগরণে স্যার সৈয়দ
আহমেদ খানের ভূমিকা আলোচনা করো।
অথবা, আলিগড় আন্দোলনের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।
সূচনা: সৈয়দ আহমেদ সমাজে পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের সার্বিক উন্নয়ন। ঘটানোর জন্য যে সংস্কার আন্দোলন পরিচালনা করেন তা ইতিহাসে আলিগড় আন্দোলন নামে পরিচিত।
আন্দোলনের পটভূমি
ব্রিটিশ রাজত্বের প্রথমদিকে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক মোটেই ভালো ছিল না। ব্রিটিশ সরকার মহাবিদ্রোহের জন্য মুসলিমদের বেশি দায়ী করেছিল। অপরদিকে, মুসলমানরা ভারতে ব্রিটিশ শাসনকালে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তনকে সন্দেহের চোখে দেখত। আলিগড় কলেজের অধ্যক্ষ থিয়োডোর বেকের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে সৈয়দ আহমেদ খান পিছিয়ে পড়া মুসলিমদের নিয়ে আলিগড় কলেজকে কেন্দ্র করে এক আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন।
আন্দোলনের প্রসার
1 আলিগড় কলেজের ভূমিকা: আলিগড় কলেজের প্রথম তিন অধ্যক্ষ-থিয়োডোর বেক, টি. মরিসন, ডব্লিউ.এ.জে. আর্চিবল্ড প্রমুখ আলিগড় কলেজকে আন্দোলনের মূলকেন্দ্রে পরিণত করেন। অধ্যক্ষ থিয়োডোর বেক সম্পাদক ‘ইন্সটিটিউট গেজেট’ নামক কলেজ পত্রিকাটির দ্বারা বাঙালি, হিন্দু ও কংগ্রেস দলের বিরুদ্ধে প্রচার চালানো হয়।
2 বিভিন্ন সংগঠন প্রতিষ্ঠা: জাতীয় কংগ্রেসের বিকল্প রূপে আলিগড়ে বেকের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ইউনাইটেড ইন্ডিয়ান প্যাট্রিয়টিক অ্যাসোসিয়েশন (১৮৮৮ খ্রি.)। থিয়োডোর বেক পরবর্তী সময়ে মুসলিমদের স্বার্থরক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন মহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল ডিফেন্স অ্যাসোসিয়েশন অব আপার ইন্ডিয়া (১৮৯৩ খ্রি.)।
3 সৈয়দ আহমেদ ও শিক্ষাসংস্কার: মুসলিমদের উচ্চ শিক্ষিত করার জন্য উর্দু পত্রিকা ‘তাহজিব-উল-আকলার্ক’ ও ‘পাইওনিয়ার’ পত্রিকার মাধ্যমে মুসলিমদের প্রতি পাশ্চাত্য শিক্ষার ভাবধারা প্রচারিত হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় বিজ্ঞান সমিতি (১৮৬৫ খ্রি.) ও অনুবাদ সমিতি (১৮৬৬ খ্রি.)। স্যার সৈয়দ আহমেদ গাজীপুরে প্রতিষ্ঠা করেন একটি ইংরেজি বিদ্যালয় (১৮৬৪ খ্রি.), সায়েন্টিফিক সোসাইটি (১৮৬৫ খ্রি.), কমিটি ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অব লার্নিং অ্যামং দ্য মহামেডান অব ইন্ডিয়া (১৮৭০ খ্রি.), অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ (১৮৭০ খ্রি.), যা পরবর্তীকালে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ পায় (১৯২০ খ্রি.)।
4 সৈয়দ আহমেদ ও সমাজসংস্কার: সৈয়দ আহমেদ সে সময়কার মুসলিম সমাজে প্রচলিত তালাক প্রথা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, বিভিন্ন কুপ্রথার বিরুদ্ধে মুসলিমদের সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করেন। তিনি বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা ও যুক্তিবাদের আলোকে মুসলিম সমাজের আধুনিকীকরণের চেষ্টা চালান। এমনকি তিনি আধুনিক চিন্তা ও যুক্তিবাদের আলোকে কোরানের ব্যাখ্যা দেন। মুসলমান সমাজের রক্ষনশীলতার বিরুদ্ধে তিনি জেহাদ ঘোষনা করেন।
আলিগড় আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য
[1] মুসলিম সমাজের সার্বিক উন্নয়ন ঘটানো। [2] এই আন্দোলনের প্রতি মুসলিম সমাজের গরিষ্ঠ সংখ্যক দরিদ্র শ্রেণির অংশগ্রহণ ঘটেনি। [3] উত্তরপ্রদেশের গুটিকয়েক জমিদার শ্রেণি ও শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলিম সম্প্রদায়কেন্দ্রিক ছিল এই আন্দোলন। [4] এই আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের অবতারণা। অর্থাৎ এই আন্দোলনের সূত্রেই ভারতীয় রাজনীতিতে হিন্দু-মুসলিম দুটি আলাদা জাতি-এই ধারণার উদ্ভব ঘটে।
সীমাবদ্ধতা
1 ব্রিটিশের প্রতি আনুগত্য: আলিগড় আন্দোলনের নেতৃবর্গ সমগ্র মুসলিম সমাজকে ব্রিটিশের অনুগত থাকার পরামর্শ দেওয়ায় মুসলমান সমাজের এক গরিষ্ঠ অংশ ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেয়নি। ফলে পরবর্তীকালের জাতীয় আন্দোলনগুলি যতটা শক্তিশালী ও গতিশীল হওয়ার কথা তা হয়নি।
2 জাতীয় স্বার্থে আঘাত: আলিগড় আন্দোলন সংকীর্ণ মুসলমান স্বার্থকেন্দ্রিক হওয়ায় জাতীয় আদর্শ ও ভারতীয় ঐক্য বিনষ্ট হয়। আলিগড় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ তাদের আন্দোলনকে কংগ্রেসের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনগুলির বিকল্প রূপে গড়ে তুলতে চাইলেও তা ব্যর্থ হয়।
3 বিচ্ছিন্নতাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার জন্মদাতা: আলিগড় আন্দোলন ভারতের জাতীয় ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বীজ রোপণ করে। যার পরিণতিরূপে আগামী দিনে ভারত বিভাজন হয়ে আলাদা পাকিস্তান রাষ্ট্র জন্ম নেয়।
4 উদ্দেশ্যপূরণে ব্যর্থ: গোঁড়া মৌলবি ও মোল্লাদের বিরোধিতার জন্য আলিগড় আন্দোলন শেষপর্যন্ত তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যপূরণে অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছিল।
উপসংহার: হতাশার অন্ধকারে ডুবে থাকা মুসলিম সমাজের উন্নতির জন্য আলিগড় আন্দোলনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য। এই আন্দোলনের সুফল হিসেবে মুসলিম সমাজ আগের থেকে অনেকটাই কুসংস্কার ও গোঁড়ামি মুক্ত হয়ে আধুনিক রূপ লাভ করে।
প্রশ্ন29. উনিশ শতকে মহারাষ্ট্রের সমাজসংস্কার আন্দোলনে প্রার্থনা সমাজের ভূমিকা লেখো। মহারাষ্ট্রে সমাজসংস্কার আন্দোলনে মহাদেব গোবিন্দ রানাডের ভূমিকা লেখো।
সমাজসংস্কারে প্রার্থনা সমাজের ভূমিকা
1 প্রতিষ্ঠা ও লক্ষ্য: ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনের পৃষ্ঠপোষকতায় আত্মারাম পান্ডুরঙ্গ ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে মহারাষ্ট্রে প্রার্থনা সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তবে বিখ্যাত সংস্কৃত পণ্ডিত ও ঐতিহাসিক রামকৃয় গোপাল ভান্ডারকর ও বোম্বাই হাইকোর্টের বিচারপতি মহাদেব গোবিন্দ রানাডে ছিলেন এর দুই প্রাণপুরুষ। প্রার্থনা সমাজের লক্ষ্য ছিল-সমাজ থেকে জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা, বাল্যবিবাহ প্রভৃতি কুসংস্কার দূর করা।
2 কার্যাবলি
i. সমাজসংস্কার: প্রার্থনা সমাজের অনুগামীরা পৌত্তলিকতার বিরোধী ও একেশ্বরবাদের সমর্থক হলেও তাঁরা কখনোই ব্রাহ্মসমাজের মতো হিন্দুধর্ম বা হিন্দু সমাজ বিরোধী ছিলেন না। এ ছাড়াও প্রার্থনা সমাজের সদস্যরা বিধবাবিবাহ, অসবর্ণ বিবাহ, নারীশিক্ষার বিস্তার, পঙ্ক্তিভোজনে উৎসাহ, দলিত সম্প্রদায়ের কল্যাণসাধন ইত্যাদি কাজে নিজেদেরকে নিয়োজিত করেছিল। রানাডের উদ্যোগে বিধবা সমিতি (১৮৬১ খ্রি.) ও সারদা সদন সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রার্থনা সমাজের উদ্যোগে অনেকগুলি শিশুসদন, অনাথ আশ্রম, বিধবা আশ্রম ও চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।
ii. শিক্ষাবিস্তার: পুনা শহরে রানাডে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন এবং উচ্চশিক্ষার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করেন দাক্ষিণাত্য শিক্ষাসমাজ (১৮৮৪ খ্রি.)। শিক্ষা সমাজের উদ্যোগে কোনোপ্রকার সরকারি সাহায্য ছাড়াই পুনায় তৈরি হয় ফারগুসন কলেজ ও সাংলিতে উইলিংডন কলেজ এবং অনেকগুলি ছোটোখাটো স্কুল। শীঘ্রই দাকিষণাত্য শিক্ষাসমাজ সমগ্র মহারাষ্ট্র, মাদ্রাজ ও অন্ধ্রের তেলুগু ভাষাভাষী অঞ্চলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
iii. সার্বজনিক সভা গঠন: ভারতীয়দের স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে রানাডে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে পুনা সার্বজনিক সভা গঠন করেন। প্রসঙ্গত, ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পিছনেও তাঁর প্রেরণা কাজ করেছিল।
মূল্যায়ন: প্রার্থনা সমাজের অনুগামীরা নিজেদেরকে হিন্দুধর্মের থেকে আলাদা কোনো ধর্মমতের সমর্থক বলে দাবি করতেন না। এর সদস্যরা হিন্দুধর্মের মধ্যে থেকেই, হিন্দুধর্মের অংশরূপেই ধর্ম, সমাজসংস্কার আন্দোলন অবতীর্ণ হয়েছিলেন। এইভাবে বাস্তাব ও গঠনাত্মক কর্মপ্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে প্রার্থনাসমাজ উনিশ শতকের মহারাষ্ট্রর সমাজ-সংস্কারের ক্ষেত্রে স্মরণীয় হয়ে আছে। বাস্তবকে অস্বীকার করে যুক্তির আশ্রয়ে সংস্কারমূলক কাজ অর্থহীন।
সমাজসংস্কার আন্দোলনে রানাডের অবদান
1 পরিচয়: উনিশ শতকে সারার ভারত জুড়ে সংস্কারবাদী যে আন্দোলন শুর হয় তার অংশীদার হয়েছিল প্রার্থনাসমাজ। প্রার্থনা সমাজের এর অন্যতম প্রাণপুরুষ ছিলেন প্রতিষ্ঠবিচারালয়ের বিচারপতি মহাদেব গোবিন্দ রানাডে। প্রার্থনা সমাজ আন্দোলনের উদ্দেশ্যগুলিকে সফল করার জন্য রানাডে তাঁর শেষ জীবন পর্যন্ত চেষ্টা করে গেছেন।
2 আদর্শ: [i] প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী রানাডে চেয়েছিলেন পাশ্চাত্যের আধুনিক ভাবধারার সাহায্যে এদেশীয় সমাজসভ্যতার অবস্থানের উন্নতি ঘটাতে। [ii] তিনি সমাজে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা, বাল্যবিবাহ, জাতিকে প্রথা, অস্পৃশ্যতার বিরোধিতা সর্বোপরি প্রগতিশীল সংস্কারের দ্বারা ধর্ম ও সমাজকে উন্নতির চেষ্টায় বিশ্বাসী ছিলেন। [iii] রানাডে বিস্বাস করতেন রাজনৈতিক ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করেই সমাজের উন্নতি ঘটানো সম্ভব।
3 কার্যাবলি
i. বিধবাবিবাহ সমিতি গঠন: রানাডে গঠন করেন বিধবাবিবাহ সমিতি (১৮৬১ খ্রি.)। এই সমিতির দ্বারা তিনি বাল্যবিধবাদের স্বার্থরক্ষা ও তাদের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার ঘটানোর চেষ্টা করেন।
ii. সার্বজনিক সভা প্রতিষ্ঠা: ভারতবাসীর রাজনৈতিক সুযোগসুবিধা ও বিভিন্ন দাবিদাওয়াগুলি আদায় করার উদ্দেশ্য তিনি পুনাতে সার্বজনিক সভা প্রতিষ্ঠা করেন (১৮৭০ খ্রি.)। তিনি এই সভা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজের সব শ্রেণির মানুষের কল্যাণসাধন করতে চেয়েছিলেন।
iii. দাক্ষিণাত্যে শিক্ষাসমাজ গঠন: শিক্ষার সার্বিক প্রসারের লক্ষ্যে তিনি দাক্ষিণাত্য শিক্ষাসমাজ (Deccan Education Society) প্রতিষ্ঠা করেন (১৮৮৪ খ্রি.)। এই সংস্থাটির প্রচেষ্টা পুনাতে ফারগুসন কলেজ, সাংলিতে উইলিংডন কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী সময়ের কংগ্রেস নেতা তথা গান্ধিজির রাজনৈতিক গুরু গোপালকৃষ্ণ গোখলে এই সভার সেবক ছিলেন। রানাডে তাঁর সংস্কারমূলক কাজগুলি করতে গিয়ে কখনোই জাতির ঐতিহ্য ও গৌরবকে খাটো করেননি।
প্রশ্ন30. টীকা লেখো: ভারতে সমাজসংস্কার আন্দোলনে থিওসফিক্যাল সোসাইটির ভূমিকা লেখো।
সমাজসংস্কার আন্দোলনে থিওসফিক্যাল সোসাইটি
1 প্রতিষ্ঠা: উনিশ শতকের শেষার্ধে ভারতে সমাজসংস্কার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল ‘থিওসফিক্যাল সোসাইটি’। হেলেনা পেট্রোভনা মাদাম লাভাটস্কি নামে এক রুশ মহিলা ও কর্নেল হেনরি স্টিল ওলকট নামে এক ব্রিটিশ সামরিক অফিসার ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ‘থিওসফিক্যাল সোসাইটি’ স্থাপন করেন। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁরা আর্যসমাজের আমন্ত্রণে ভারতে আসেন ও মাদ্রাজের
উপকণ্ঠে আডিয়ারে ‘থিওসফিক্যাল সোসাইটি’র ভারতীয় শাখাটি (১৮৮৬ খ্রি.) স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে এটিই সোসাইটির প্রধান কার্যালয়ে পরিণত হয়।
2 লক্ষ্য: ইংরেজি শব্দ ‘থিওসফি’র অর্থ হল ‘ঈশ্বর সম্পর্কে জ্ঞান’। বাংলা বা সংস্কৃতে যা ‘ব্রহ্মজ্ঞান’ হিসেবে পরিচিত। খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে গ্রিক পণ্ডিত আয়ামবেচস সর্বপ্রথম ‘থিওসফি’ শব্দটি উল্লেখ করেন। ‘থিওসফিক্যাল সোসাইটি’র মূল কয়েকটি লক্ষ্য ছিল-[i] জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সৌভ্রাতৃত্ব স্থাপন। [ii] প্রাচীন হিন্দুধর্মের হৃত মর্যাদা ফিরিয়ে আনা। [iii] দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার আদর্শে সকলকে অনুপ্রাণিত করা। [iv] হিন্দুদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি গড়ে তোলা। [v] ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞানের পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন ও চর্চায় উৎসাহদান ইত্যাদি।
3 অ্যানি বেসান্তের ভূমিকা: আইরিশ মহিলা অ্যানি বেসান্ত সোসাইটিতে যোগদান করলে (১৮৮৯ খ্রি.) এটি জনপ্রিয় ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তাঁর চেষ্টায় ভারতের নানা স্থানে এর শাখাপ্রশাখা গড়ে ওঠে। বেসান্তের চেষ্টায় কাশীতে স্থাপিত হয় কেন্দ্রীয় হিন্দু বিদ্যালয়। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে এই বিদ্যালয়টি মদনমোহন মালব্যের উদ্যোগে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। বেসান্তের মতে-ভারতে ‘থিওসফিক্যাল সোসাইটি’র প্রধান কাজ হল হিন্দু, জরথুস্ট্রীয় ও প্রাচীন বৌদ্ধধর্মের পুনর্জাগরণ ঘটানো। বেসান্ত বলতেন- “হিন্দু আদর্শের পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই পরাধীন ভারতবাসী ফিরে পাবে তার আত্মসম্মান, দেশাত্মবোধ ও স্বাধীনতা।”
4 অবদান: এই সোসাইটির কিছু উল্লেখযোগ্য অবদান হল-
i. হিন্দু ধর্মের পুনরুত্থান: ‘থিসফিক্যাল সোসাইটি’র উদ্যোগে গড়ে i ওঠা আন্দোলন হিন্দুধর্মের নব উত্থানে সাহায্য করেছিল।
ii. ধর্মীয় বিশ্বাস: থিওসফিক্যাল আন্দোলন স্বদেশবাসীকে নিজধর্মের প্রতি বিশ্বাস অটুট রাখতে সাহায্য করেছিল।
iii. বিদেশি বিদ্বেষ হ্রাস: বেসান্ত বিদেশি সংস্কার (বন্দিশালার সংস্কার, হাসপাতালের রুগিদের সঙ্গদান)-এর আদর্শ এদেশে প্রচলন করলে বিদেশিদের প্রতি ভারতীয়দের বিদ্বেষের ধারণা অনেকটাই পরিবর্তিত হয়।
5 সোসাইটির ব্যর্থতা: ‘থিওসফিক্যাল সোসাইটি’র কিছু ব্যর্থতাও ছিল-
i. জনপ্রিয়তা হ্রাস: হিন্দুধর্মের মূর্তিপূজা আচার-অনুষ্ঠানকে সমর্থন করে ‘থিওসফিক্যাল সোসাইটি’ প্রথমদিকে জনপ্রিয়তা পেলেও শেষ পর্যন্ত তা ধরে রাখতে পারেনি।
ii. নগরকেন্দ্রিক: থিওসফিক্যাল আন্দোলন মূলত পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মুষ্টিমেয় শহুরে ভারতীয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। গ্রামীণ সাধারণ দরিদ্র ভারতীয়দের সঙ্গে এই আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি।
iii. হিন্দুধর্মকেন্দ্রিক: থিওসফিক্যাল আন্দোলন হিন্দু জাতীয়তাবাদকেন্দ্রিক হওয়ায় ভারতের অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়, বিশেষত মুসলিম সম্প্রদায় এই আন্দোলন থেকে দূরে সরে থাকে।
মূল্যায়ন: থিওসফিস্টরা হিন্দুধর্ম ও ঐতিহ্যের পক্ষে প্রচারে নামলে ভারতীয়দের আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে। জওহরলাল নেহরু এই সংস্থাটির প্রশংসা করে তাঁর ‘দ্য ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে লিখেছেন- “থিওসফিক্যাল সোসাইটি ভারতীয় মধ্যবিত্ত হিন্দুদের মনে প্রবল আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলে।”
প্রশ্ন31. ভারতে সংস্কার আন্দোলনে আর্যসমাজের ভূমিকা কী?
অথবা, সমাজসংস্কার আন্দোলনে আর্যসমাজ ও দয়ানন্দ সরস্বতীর ভূমিকা লেখো।
ভূমিকা: হিন্দুধর্মের পুনর্জাগরণের ক্ষেত্রে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর (১৮২৪- ৮৩ খ্রি.) নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত পাঞ্জাবের ‘আর্যসমাজ’ (১৮৭৫ খ্রি., ১০ এপ্রিল) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। আর্যসমাজের ধর্মীয় প্রচারের জোরেই হিন্দুরাজ প্রতিষ্ঠার চিন্তা আরও তীব্র হয়ে ওঠে।
1 আর্যসমাজের আদর্শ: ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে লাহোরে আর্যসমাজের গঠনতন্ত্র ও আদর্শ রচিত হয়। একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী দয়ানন্দ ছিলেন ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার, অস্পৃশ্যতা, পৌত্তলিকতাবাদ প্রভৃতির ঘোরতর বিরোধী। তিনি মনে করতেন পৃথিবীর সকল ধর্ম, বৈজ্ঞানিক সত্য ও তত্ত্বের সারমর্ম বেদের মধ্যেই নিহিত আছে। কিন্তু সামাজের কিছু স্বার্থপর ব্যক্তি বেদের ভুল ব্যাখ্যা করে সনাতন হিন্দুধর্মকে কলুষিত করতে চাইছে। ইংরেজি ভাষায় অজ্ঞ, অথচ সংস্কৃতে পণ্ডিত দয়ানন্দ ‘বেদভাষ্য’ ও ‘সত্যার্থ প্রকাশ’ নামক দুটি গ্রন্থ রচনা করেন এবং গোরক্ষিণী সভা প্রতিষ্ঠা করেন (১৮৮২ খ্রি.)।
2 কর্মসূচি
i. শুদ্ধি আন্দোলন: আর্যসমাজের অন্যতম কর্মসূচি ছিল শুদ্ধি আন্দোলন। শুদ্ধির প্রধান লক্ষ্য ছিল অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিত হিন্দুদের পুনরায় হিন্দুধর্মে ফিরিয়ে এনে এবং বিধর্মী প্রভাব রোধ করে ভারতকে এক জাতি, এক ধর্ম ও এক সমাজরূপে প্রতিষ্ঠা করা।
ii. নারীদের উন্নতি: স্বামী দয়ানন্দ সমাজে নারীদের সকল প্রকার সুযোগসুবিধা, ও স্বাধীনতা দেওয়া এবং স্ত্রীশিক্ষার সার্বিক উন্নতি ঘটানোর কর্মসূচি গ্রহণ করেন।
iii. হিন্দুধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা: দয়ানন্দ বেদের ওপর নির্ভর করে সকল চিন্তাধারা ও আদর্শ নির্ধারণ করতে চেয়েছিলেন, যাতে বৈদিক যুগের গৌরব ও পবিত্রতা হিন্দুধর্মে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। তাই তিনি বলতেন-বৈদিক শাস্ত্রে ফিরে যাও (‘Go back to the Vedos’)।
iv. সংস্কৃত ভাষার গুরুত্ব: সংস্কৃত ভাষার ওপর আরও গুরুত্ব আরোপ করে তার মর্যাদা বৃদ্ধি করাও ছিল আর্যসমাজের একাধিক কর্মসূচির একটি।
v.প্রসার: দয়ানন্দ সরস্বতীর মৃত্যুর পর আর্যসমাজের পরিচালনার ভার নেন লালা হংসরাজ, পণ্ডিত গুরু দত্ত, লালা লাজপত রায়, স্বামী শ্রদ্ধানন্দ (লালা মুনশী রাম) প্রমুখ। লাহোরে লালা হংসরাজ প্রতিষ্ঠা করেন দয়ানন্দ অ্যাংলো বৈদিক কলেজ (১৮৮৬ খ্রি.), আর হরিদ্বারে স্বামী শ্রদ্ধানন্দ প্রতিষ্ঠা – করেন গুরুকুল আশ্রম (১৯০২ খ্রি.)। অল্প সময়ের মধ্যেই আর্যসমাজ পাঞ্জাব, গুজরাট, রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তার সংস্কার আন্দোলনকে গণমুখী করে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল।
4 অবদান: আর্যসমাজে সংস্কার আন্দোলনের ফলে-[i] হিন্দুদের হীনম্মন্যতা দূর হয়, [ii] বৈদিক হিন্দুধর্ম তার হৃতগৌরব ফিরে পায়, [iii] হিন্দু জনসাধারণ নিজেদের গৌরবময় ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে – ওঠে, [iv] হিন্দুসমাজে জাতপাতের বিভিন্নতা দূর হয় ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠে, – [v] প্রাচীন রীতিনীতিকে অমান্য না করে পশ্চিমি ধাঁচে আধুনিক বিদ্যালয় গড়ে ওঠে।
উপসংহার: স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী প্রতিষ্ঠিত আর্যসমাজ পাশ্চাত্য শিক্ষাকে দূরে সরিয়ে শুধুমাত্র বেদের ওপর নির্ভর করে হিন্দুসমাজ ও ধর্মের যে উত্থান
ঘটিয়েছিলেন, তা সত্যই অসামান্য। শেষের দিকে আর্যসমাজের এই আন্দোলন রাজনৈতিক রূপ ধারণ করেছিল।
প্রশ্ন32. উনিশ শতকে মহারাষ্ট্রে সংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রে জ্যোতিবা ফুলের অবদান উল্লেখ করো।
ভূমিকা: উনিশ শতকে মহরাষ্ট্রের সমাজসংস্কার আন্দোলনের ইতিহাসে জ্যোতিবা গোবিন্দ ফুলে (১৮২৭-১৮৯০ খ্রি.) এক শ্রদ্ধেয় নাম। শূদ্র-সহ নিম্নশ্রেণির মানুষের সর্বিক উন্নয়নে জ্যোতিবা ফুলে ছিলেন বদ্ধপরিকর। জ্যোতিবার জীবনীকার অধ্যাপক পাওয়ারের মতে- “ভারতে সমাজ ও শিক্ষাসংস্কারের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত বিপ্লবী” (He was a true revolutionaries of India in social reforms and education)।
জ্যোতিবা ফুলের অবদান
যুক্তিবাদী সংস্কার: প্রথম জীবনে জ্যোতিবা ফুলে খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মের প্রতি অনুরক্ত ও হিন্দুধর্ম-বিরোধী ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন যুক্তিবাদ ও সাম্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যাবলির সমাধান ও ধর্মীয়- সামাজিক কুসংস্কারগুলির অবসান ঘটুক। তিনি আদর্শের সঙ্গে বাস্তবের মিলন ঘটাতে চেয়েছিলেন।
2 সমাজসংস্কার: মহারাষ্ট্রের জনজীবনে ব্রাহ্মণদের একচেটিয়া আধিপত্য, জাতিভেদ প্রথা এবং শূদ্র ও নারীদের সীমাহীন দুর্দশার বিরুদ্ধে জ্যোতিবা গোবিন্দরাও সস্ত্রীক জেহাদ ঘোষণা করেন। শিশুহত্যা নিবারণের লক্ষ্যে তিনি গড়ে তোলেন ‘হোম ফর প্রিভেনশান অব ইনফ্যানটিসাইড’। যেখানে সমাজের তথাকথিত অবৈধ ছেলেমেয়েরা (পিতৃমাতৃ পরিচয়হীন) আশ্রয় পেত। দলিত ও পিছিয়ে পড়া শ্রেণির জন্য সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জ্যোতিবা ফুলে ‘সত্যশোধক সমাজ’ (১৮৭৩ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন।
3 ব্রাহ্মণ্য বিরোধিতা: জ্যোতিবা ফুলে মনে করতেন-সমাজে দরিদ্র, অস্পৃশ্য ও নীচু জাতের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় ব্রাহ্মণগণ। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর লেখা ‘গুলামগিরি’ গ্রন্থে তিনি ব্রাহ্মণ্যবাদকে চ্যালেঞ্জ জানান। পাশাপাশি কুনরি, মালি, মাভ, মাহার প্রভৃতি নিম্নবর্ণের মানুষের মধ্যে ব্রাহ্মণ্য-বিরোধী প্রচার শুরুর মধ্য দিয়ে অব্রাহ্মণ আন্দোলনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন।
4 নারীকল্যাণ: তিনি বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সরব হন এবং শিশুকন্যা হত্যা নিবারণের প্রচেষ্টা চালান। নিম্নবর্ণের নারীদের জন্য মহাত্মা ফুলে যেমন একাধিক বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, তেমনই বিদ্যাসাগরের মতো বিধবাবিবাহের সমর্থনে মহারাষ্ট্রে প্রবল আন্দোলনও গড়ে তোলেন।
5 শিক্ষাসংস্কার: জ্যোতিবা মনে করতেন শূদ্রসহ বিভিন্ন নিম্নবর্ণের মানুষকে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার আলোয় নিয়ে আসা প্রয়োজন। তাই তিনি ও তাঁর স্ত্রী সাবিত্রীবাঈ পুনাতে পশ্চিম ভারতের প্রথম বালিকা বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন (১৮৫১ খ্রি.)। শিক্ষা সংস্কারক জ্যোতিবার শিক্ষামূলক কাজগুলিতে সাহায্য করেন সদাশিব, বল্লাল পরাঞ্জপে প্রমুখ মারাঠা সংস্কারকগণ।
মূল্যায়ন: যুক্তিবাদ ও আধুনিক মনের অধিকারী জ্যোতিবা ফুলে মহারাষ্ট্রীয় নিম্নবর্ণের মানুষদের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে আজীবন কাজ করে গেছেন। এমনকি ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের কাঠামো থেকে নিম্নবর্ণের মানুষদের রক্ষার জন্য তিনি ব্রিটিশ শাসনের সাহায্য নিতেও দ্বিধা করেননি। এম আর লেভারলের মতে- “সাম্য ও যুক্তিবাদীতার ভিত্তিতে এক নতুন সমাজ কাঠামো তৈরির লক্ষ্যে ফুলে কাজ করে গেছেন” (Phule worked for a new social structure built on quality and nationality)।
প্রশ্ন33. আধুনিক অস্ত্রের প্রতিষ্ঠায় বীরসালিঙ্গম পান্ডুলুর অবদান কতখানি?
ভমিকা: অন্ধ্রপ্রদেশের নবজাগণের জনক কান্দকরি বীরসালিঙ্গম পান্ডুল ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৬ এপ্রিল পূর্ব গোদাবরী জেলার ঐতিহাসিক শহর রাজামুন্দ্রির এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মানুষের নৈতিক উন্নতি রাজামশামাজিক উন্নতির পথ প্রশস্ত করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। জানিয়ে ভারতের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি সর্বপল্লী রাধাকৃয়াণ ‘Swatantra জানিয়ে ভাy Tributes’ এ বলেছেন- “আমাদের সমাজের আমূল পরিবর্তন ঘটানোর জন্য দক্ষিণ ভারতের যাঁরা পথিকৃৎ তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন শ্রী বীরসালিঙ্গম পান্ডুলু (১৮৪৮-১৯১৯ খ্রি.)।
বীরসালিঙ্গমের অবদান
আধুনিক অন্ধ্রের প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদানগুলি হল-
1 সমাজের উন্নতিবিধানে: জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতা ও দলিত শ্রেণির ওপর উচ্চবর্ণের শোষণ-পীড়নের তিনি তীব্র নিন্দা করেন। মানুষের নৈতিক উন্নতি ঘটিয়ে সামাজিক উন্নতির পথ প্রশস্ত করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। ব্রিটিশ সরকারের পদস্থ আমলা, বিচারকদের দুর্নীতি ও অত্যাচারের কাহিনি জনসমক্ষে তুলে ধরে তিনি এর বিরোধিতা করেন। তিনি কয়েকটি সমাজসেবামূলক সংস্থা গড়ে তোলেন। যেমন-‘সংঘ সংস্কার সমাজম (১৮৭৬ খ্রি.), ‘প্রার্থনা সমাজম (১৮৭৮ খ্রি.) এবং ‘স্ত্রী পুনর্বিবাহ সমাজম’ (১৮৮০ খ্রি.)।
2 তেলুগু সাহিত্যে: বীরসালিঙ্গম তেলুগু সাহিত্য ও সাংবাদিকতার জনক। তাঁর সম্পাদিত কয়েকটি তেলুগু পত্রিকা হল-বিবেকাবর্ধনী (১৮৭৪ খ্রি.), হাস্য সঞ্জীবনী (১৮৭৬ খ্রি.), সতীহিত বোধিনী (১৮৮৩ খ্রি.), সত্য সম্বর্ধনী (১৮৯১ খ্রি.) এবং সত্যবোধিনী (১৯০৫ খ্রি.)। তিনিই প্রথম তেলুগু উপন্যাস, নাটক, প্রকৃতি-বিজ্ঞান ও ইতিহাস গ্রন্থের রচয়িতা। জোনাথন সুইফট-এর ‘গালিভার ট্রাভেলস’ ও গোল্ডস্মিথের ‘ভিকার অব ওয়েকফিল্ড’-এর অনুসরণে তিনি রচনা করেন ‘সত্যরাজা পূর্বদেশ যাত্রালু’ ও ‘রাজশেখর চরিত্র’। তেলুগু সাহিত্যের বিবর্তন ও গতিপ্রকৃতির ওপর লেখা তার প্রামাণিক গ্রন্থটি হল-‘দ্য লাইভস অব তেলুগু পোয়েটস’।
3 নারীকল্যাণ: বীরসালিঙ্গম নারীকল্যাণের লক্ষ্যে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, দেবদাসী প্রথা, বাইজি নাচ প্রথা, ধনীদের উপপত্নী রাখার রেওয়াজ ইত্যাদির বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। তিনি নারীসমাজের সার্বিক কল্যাণে রাজামুন্দ্রি সমাজসংস্কার সমিতি (১৮৭৮ খ্রি.) এবং বিধবাবিবাহ সমিতি (১৮৭১ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁরই উদ্যোগে অন্ধ্রপ্রদেশে প্রথম বিধবাবিবাহ অনুষ্ঠিত হয় (১৮৮১ খ্রি. ১১ ডিসেম্বর)। এ ছাড়া মহীশূর (১৯০৭ খ্রি.) এবং ব্যাঙ্গালোরে (১৯১০ খ্রি.) তিনি একটি করে বিধবা আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর সকল কাজের ছায়াসঙ্গী ছিলেন পত্নী রাজলক্ষ্মী।
4 জনশিক্ষা বিস্তার: জনশিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে তিনি দোয়ালেশ্বরম (১৮৭৮ খ্রি.) ও রাজামুন্দ্রিতে (১৮৮৪ খ্রি.) একটি করে বালিকা বিদ্যালয় ছাড়াও বয়স্ক মহিলা, হরিজন ও শ্রমিকদের জন্যও বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বৃত্তিমূলক শিক্ষায় শিক্ষিত নিম্নবর্ণের মহিলাদের তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়গুলিতে তিনি নিয়োগ করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি বিদ্যালয় ছিল-বালভারতী সমিতি ন্যাশন্যাল হাই স্কুল, বন্দেমাতরম হাই স্কুল ইত্যাদি।
মূল্যায়ন: আধুনিক অন্ধ্রের রূপায়ণে সমাজসংস্কারকরূপে বীরসালিঙ্গম ভারতের যে-কোনো স্বনামধন্য সমাজসংস্কারকের সঙ্গে একনিশ্বাসে উচ্চারিত একটি নাম। ভি আর নায়ালা তাঁর ‘বীরসালিঙ্গ’ গ্রন্থে বলেছেন- “তিনি অস্ত্রের মানুষের জীবন ও চিন্তাধারাকে আধুনিক, প্রগতিশীল ও মানবিকতার পথে চালিত করেছিলেন” (“He gave an altogether mod- ern, progressive and humanistic turn to their life and thought”)।
প্রশ্ন34. উনিশ শতকে ভারতে পারসি সমাজে সংস্কার আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও?
সূচনা: উনিশ শতকে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় মানবতাবাদ ও যুক্তিবাদকে ভিত্তি করে যে ধর্মীয় ও সমাজসংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছিল তার অংশীদার ছিল মহারাষ্ট্রে পারসি সমাজও। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে পারসিরা যে সংস্কার আন্দোলন গড়ে তুলেছিল তাতে প্রকৃতপক্ষে লাভবান হয়েছিল দেশীয় সংস্কৃতিই।
পারসি সমাজে সংস্কার আন্দোলন
1 সংগঠন তৈরি ও পত্রিকা প্রকাশ: প্রচলিত রয়েছে যে ৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ জরথুষ্ট্র ধর্মাবলম্বীরা ইরান ছেড়ে ভারতের পশ্চিম উপকূলে এসে বসবাস শুরু করে ও পারসি নামে পরিচিত হয়। ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে কিছু শিক্ষিত পারসি যুবককে নিয়ে নওরোজি ফার্টুনজি, দাদাভাই নওরোজি প্রমুখ ‘রেহনুমাই মাজদায়াসনেন সভা’ বা Persi’s Reform Society গঠন করেন। এই সোসাইটির সভাপতি ছিলেন ফার্টুনজি নিজে এবং সম্পাদক হন সাপুরজি বেঙ্গলি। এই সংগঠনটির মুখপত্র ছিল ‘রাস্তগোফতার’ যা পারসিদের মনে বিজ্ঞানমনস্ক ভাবনা ও উদার সাংস্কৃতিক চেতনা জাগানোর চেষ্টা করে। এ ছাড়াও এই সংগঠনটির সম্পাদক সাপুরজি নিজের চেষ্টায় ‘জগৎ মিত্র’ মাসিক পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে পারসিদের পাশ্চাত্য শিক্ষার ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করে আধুনিক করে তোলার চেষ্টা করেন।
উদ্দেশ্য: পারসি সংস্কার সোসাইটি পারসি সংস্কার আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্যগুলিকে পূরণ করার চেষ্টা করেছিল। যেমন-
i. আঘাত প্রতিহত করা: পারসি সম্প্রদায়ের ওপর অন্যান্য সম্প্রদায়ের আঘাতকে প্রতিহত করা।
ii. আধুনিক সম্প্রসারণ: পারসি সম্প্রদায়ের সামাজিক জীবনকে পাশ্চাত্য সভ্যতা, সংস্কৃতির ভাবধারায় নতুন রূপে গড়ে তোলা।
iii. ধর্মীয় গৌরবের পুনঃপ্রতিষ্ঠা: জরথুস্ট্রীয় ধর্মের সারাংশকে অনুসরণ করে এই ধর্মের হারানো গৌরবকে নতুনরূপ প্রতিষ্ঠা করা।
3 বিভিন্ন সংস্কার: পারসি সমাজসংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে পারসি মহিলাদের শিক্ষার আলোয় নিয়ে আসার চেষ্টা শুরু হয়েছিল। সমাজ থেকে পর্দা প্রথার অবসান ঘটানো ও বিবাহবিধির সংস্কারসাধনও তারা করতে চেয়েছিল। পারসি মহিলাদের অল্প বয়সে বিবাহ দেওয়ার রীতি প্রচলিত ছিল। যার বিরোধিতা করেন ফার্টুনজি, সাপুরজি বেঙ্গলি, দাদাভাই নওরোজি প্রমুখ। শিক্ষিত পারসি যুবকগণ ও পারসি সংস্কারক বেহরামজি মেরওয়ানজি মালাবারির উদ্যোগে ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয় ‘বিবাহ সম্মতি আইন’ (১৮৯১ খ্রি.) প্রণয়নে, যার সুফলরূপে পারসি কন্যাদের ১২ বছরের কম বয়সে বিবাহ দেওয়া নিষিদ্ধ হয়।
4 গুরুত্ব: পারসি সংস্কার আন্দোলন উনিশ শতকের সমাজসংস্কার আন্দোলনে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না।
প্রথমত: রেহনুমাই সভা পারসিদের প্রয়োজন মেনে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে পারসি সংস্কৃতির বিন্যাস ঘটিয়েছিল।
দ্বিতীয়ত: পারসি সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল শিক্ষিত ও ধনী পারসি ব্যক্তিবর্গ। যার প্রভাবে শহরে পারসি সংস্কৃতির দ্রুত বিন্যাস ঘটেছিল।
উপসংহার: পারসি সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে একদিকে যেমন একদেশীয় সমাজে পারসিদের সামাজিক অবস্থানের উন্নতি ঘটেছিল, অপরদিকে তেমনই ভবিষ্যতের ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনে দাদাভাই নওরোজি, আগারকার-এর মতো কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নেতাকে পেয়েছিল।
প্রশ্ন35. উপযোগবাদ হিসেবে জন স্টুয়ার্ট মিলের বক্তব্যসমূহ ব্যাখ্যা করো। মেকলের নীচে চুঁইয়ে পড়ার তত্ত্বটি ব্যাখ্যা করো।
মিলের উপযোগবাদ
1 পরিচিতি: উনিশ শতকের উপযোগবাদী দার্শনিকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জন স্টুয়ার্ট মিল (১৮০৬-১৮৭৩ খ্রি.)। জন স্টুয়ার্ট মিল তাঁর ইউটিলিটেরিয়ানিজম গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ে উপযোগবাদের মূল সূত্রগুলি ব্যাখ্যা করেন। মিল তাঁর প্রধান সূত্রে বলেছেন কাজগুলি যে অনুপাতে আনন্দ তৈরি করতে পারে সে অনুপাতে সেগুলি যথোচিত। আর যে অনুপাতে কাজগুলি আনন্দের বিপরীত অনুভূতি তৈরি করতে পারে সেগুলি অনুচিত। এখানে আনন্দের অর্থ হল সুখের উপস্থিতি থাকলেও দুঃখ থাকবে না। আবার আনন্দহীনতার অর্থ হল দুঃখের উপস্থিতি থাকলেও সুখ থাকবে না। মিল উপযোগিতা শব্দটির ব্যবহার করেননি। তাঁর ধারণায় উপযোগিতার অর্থ সুখ। উপযোগিতা আনন্দ একই অর্থ বোঝায়। আনন্দের অর্থ হল সুখের উপস্থিতি কিন্তু দুঃখের অভাব।
2 ব্যাখ্যা: উপযোগবাদের অন্যতম ভাষ্যকার ছিলেন জন স্টুয়ার্ট মিল। তিন তাঁর পিতা জেমস্ মিলের মতো রক্ষণশীল উপযোগবাদীর প্রবক্তা ছিলেন না। তিনি নিজের মতো করে উপযোগবাদের ভিত্তিতে এক নতুন রাষ্ট্রতত্ত্বের অবতারণা করেন। তাঁর লেখা ‘অন লিবার্টি’, ‘রিপ্রেজেনটেটিভ গভর্নমেন্টে’, ‘পলিটিক্যাল ইকোনমি’ তাকে উপযোগবাদী দার্শনিক হিসেবে স্বীকৃতি এনে দেয়। জন স্টুয়ার্ট মিল তাঁর লেখাতে ইচ্ছাকৃতভাবে রাষ্ট্র শব্দের বদলে সমাজ শব্দের ব্যবহার করেছেন। আসলে তিনি মনে করতেন সমাজে মানুষ নিজের সুখের জন্যই সরকার গড়ে তোলেন। তাই বলা যায় রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার প্রাথমিক শর্তটি হল মানুষের ইচ্ছা। অপরদিকে রাষ্ট্রের আসল উদ্দেশ্য হল সমাজের সার্বিক উন্নতি ঘটানো। জন স্টুয়ার্ট মিলের ধারণায় সৎ এবং বুদ্ধিমানের পক্ষে ভালোভাবে সরকার চালনা করা সম্ভব। মিল মুক্ত অর্থনীতি ও মুক্তচিন্তার প্রতি সমর্থ জানান। তিনি বলেন শাসক কখনোই স্বাধীন চিন্তার কণ্ঠরোধ করতে পারেন না। তাঁর ধারণায় প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক সরকারই হল সর্বশ্রেষ্ঠ সরকার। কারণ প্রথমত, এই ধরনের সরকার পরিচালনকারীরা নিজেদের অধিকার ও স্বার্থের দিকে খেয়াল রাখে। দ্বিতীয়ত, এতে সমাজে মানুষের নৈতিক, বৌদ্ধিক ও ব্যবহারিক উন্নতি ঘটে থাকে।
চুইয়ে পড়া তত্ত্ব
1 প্রবক্তা: বেন্টিঙ্ক তাঁর আইন সচিব টমাস ব্যাবিংটন মেকলেকে ‘পাবলিক ইনস্ট্রাকশন কমিটি’র সভাপতির পদে নিয়োগ করেন। মেকলে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাপ্রসারের সপক্ষে বেন্টিষ্কের কাছে একটি প্রস্তাব পেশ করেন (১৮৩৫ খ্রি.)। এই প্রতিবেদন মেকলে মিনিটস (Macaulay Minutes) নামে খ্যাত।
2 মূল বক্তব্য: মেকলে বলেন, ভারতীয়দের ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্য শিক্ষা দিলে, তাদের মাধ্যমে আরও বহু ভারতীয় পাশ্চাত্য-শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠবে। অর্থাৎ সীমিত সংখ্যক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তির মধ্য দিয়ে ইংরেজি শিক্ষা পরিস্তুত হয়ে জনগণের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে যাবে- এই নীতি ইনফিলট্রেশন থিয়োরি (Infiltration theory) নামে পরিচিত।
3 ফলশ্রুতি: [i] মেকলে মিনিটস্-এর প্রস্তাব মেনে কলকাতায় মেডিকেল কলেজ, মাদ্রাজে ইউনিভারসিটি হাই স্কুল এবং বোম্বাইতে এলফিনস্টোন ইন্সটিটিউট গড়ে তোলা হয়। [ii] কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন পুনর্গঠিত করে কাউনসিল অব এডুকেশন গঠন করা হয় (১৮৪২ খ্রি.)।
4 পরিণতি: মেকলের প্রতিবেদনের ফলেই ভারতে ইংরেজি শিক্ষার দ্বার খুলে যায়। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ মার্চ এই প্রস্তাব সরকারের অনুমোদন পায়।
প্রশ্ন36. গ্রামীণ এলিট সম্প্রদায় হিসেবে পতিদার ও সাউকার শ্রেণির পরিচয় দাও।
পতিদার
ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শক্তি ভারতে বিভিন্ন স্থানীয় মোড়ল বা আধিপত্যকারী সম্প্রদায়ের যোগসূত্র গড়ে তুলে রাজস্ব আদায় করতে থাকে। এরূপ একটি উল্লেখযোগ্য স্থানীয় মোড়ল বা আধিপত্যকারী সম্প্রদায় ছিল গুজরাটের পতিদাররা। গুজরাটের গ্রামের যৌথ ভূমি ‘পতি’ নামে পরিচিত ছিল। এই ভূমির রাজস্ব আদায়কারীগণ ‘পতিদার’ নামে পরিচিত ছিল। সাধারণত গুজরাটের কুনবি সম্প্রদায় পতিদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করত। তাদের উপাধি হত ‘প্যাটেল’ অর্থাৎ ‘গ্রামের প্রধান’।
1 কৃষিকাজ: গুজরাটের পতিদাররা আগে কোলি নামে একটি যোদ্ধা সম্প্রদায়ের সমগোত্রীয় ছিল। পরবর্তীকালে ব্রিটিশরা ভারতে ভূমি বন্দোবস্তের প্রবর্তন করলে পতিদাররা কৃষির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যথেষ্ট উন্নতি ঘটায়। কৃষিকাজের মাধ্যমে ১৮৬০-এর দশকের পর থেকে সঠিক ফসলের উৎপাদন, উন্নত কৃষি-কৌশল ও শস্য রপ্তানি ব্যবস্থার উন্নতির মাধ্যমে পতিদার সম্প্রদায় যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটায়। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে ভারতের আদমশুমারিতে পতিদার সম্প্রদায় একটি পৃথক সত্তা হিসেবে চিহ্নিত হয়।
2 রাজস্ব আদায়: দাক্ষিণাত্যের বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে ব্রিটিশ সরকার প্রবর্তিত রায়তওয়ারি ভূমিব্যবস্থায় প্রত্যেক কৃষকদের ওপর পৃথকভাবে রাজস্ব ধার্য করা হত। পতিদাররা রাজস্ব আদায় করে তা সরকারের কোশাগারে জমা দিত। গুজরাটের বাইরে প্রতিবেশী মহারাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রদেশের কিছু কিছু অঞ্চলেও পতিদাররা রাজস্ব আদায় করত।
3 শোষণ: ঔপনিবেশিক আমলে ভারতে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় করতে গিয়ে পতিদাররা গুজরাটের দরিদ্র কৃষকদের ওপর তীব্র অত্যাচার চালাত। কৃষকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত বিপুল পরিমাণ সুদের অর্থও তারা ভোগ করত। এভাবে তারা বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদের মালিক হয়ে উঠেছিল। পতিদারদের নানাবিধ শোষণের ফলে গুজরাটের কৃষকদের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে যায়।
4 গ্রামীণ সমাজে ভাঙন: গুজরাটের পতিদাররা শীঘ্রই বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদের মালিক হয়ে উঠলে তারা সাধারণ দরিদ্র কৃষকদের থেকে পৃথক সত্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পতিদাররা কংগ্রেসের একনিষ্ঠ সমর্থকে পরিণত হলে পতিদার-বিরোধিরা ‘স্বতন্ত্র পার্টি’র সমর্থকে পরিণত হয়। অবশ্য পরবর্তীকালে গান্ধিজির নেতৃত্বে উভয় সম্প্রদায়ই জাতীয় আন্দোলনকে শক্তিশালী করেছিল।
সাউকার
দাক্ষিণাত্যের বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে গ্রামের ‘প্যাটেল’ বা মোড়লরা রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব পালন করত। ফলে সরকার ও প্যাটেলদের যৌথ শোষণে জর্জরিত কৃষকরা মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে অর্থ ঋণ নিতে বাধ্য হয়। এই সুদখোর মহাজন শ্রেণি দাক্ষিণাত্যে ‘সাউকার’ নামে পরিচিত।
1 সাউকারদের প্রসার: দাক্ষিণাত্যে কৃষকদের ঋণগ্রহণের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সেখানে সুদখোর সাউকারদের মহাজনি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। ঋণের বিনিময়ে কৃষকদের জমির দলিলপত্র সাউকারদের কাছে বন্ধক থাকত। এভাবে কৃষকদের জীবন- জীবিকার ওপর সাউকারদের আধিপত্য বৃদ্ধি পায়।
2 শোষণ: সাউকাররা কৃষকদের নগদ টাকা, বীজধান, খাদ্যশস্য প্রভৃতি ঋণ দিত। এই ঋণের সুদের হার ছিল ৩৫ থেকে ৬০ শতাংশ এবং তা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ত। এই ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে দরিদ্র কৃষকরা সাউকারদের কাছে চিরদিনের মতো ঋণের জালে আবদ্ধ হয়ে পড়ত। ঋণের জালে আবদ্ধ কৃষকদের জমিজমা সাউকাররা কেড়ে নিলে কৃষকরা জমি থেকে উৎখাত হয়ে সর্বস্বান্ত হত।
3 দাক্ষিণাত্য বিদ্রোহ: ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে দাক্ষিণাতে কৃষিপণ্যের মূল্য হ্রাস, পরবর্তী কয়েক বছর ধরে অজন্মা প্রভৃতির ফলে কৃষকরা খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই অবস্থায় কৃষকরা সরকারের রাজস্ব এবং সাউকারদের ঋণের অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হলে সাউকাররা আদালতের সহায়তায় কৃষকদের জমি ও বাড়ি দখল করে নিতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে কৃষকরা সাউকারদের বিরুদ্ধে ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে পুনা জেলার কারদে গ্রামে বিদ্রোহ শুরু করে। পরের বছর এই বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করে। এই বিদ্রোহ ‘সাউকার বিরোধী দাঙ্গা’ বা ‘দাক্ষিণাত্য বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত। অবশ্য পুলিশ ও সেনাবাহিনীর তীব্র দমননীতির ফলে শেষপর্যন্ত বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়।
প্রশ্ন37. ঔপনিবেশিক শাসনকালে গ্রামীণ কৃষকদের শ্রেণিবিভাজন সম্পর্কে আলোচনা করো।
সূচনা: ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতের গ্রামীণ কৃষক সমাজে বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটে। এক শ্রেণির কৃষক বিপুল পরিমাণ জমিজমা ও অর্থসম্পদের মালিক হয়ে ওঠে। তারা পতিত জমি উদ্ধার, অর্থকরী ফসল উৎপাদন, কৃষি-খামার প্রতিষ্ঠা, সুদের ব্যাবসা প্রভৃতির মাধ্যমে এই সম্পদের মালিক হয়। মহাজনি কারবার ও ধনী কৃষকদের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের ফলে ভারতের গ্রামীণ কৃষক সমাজ তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
ঔপনিবেশিক আমলে গ্রামীণ কৃষক সমাজে শ্রেণিবিভাজন
1 ধনী কৃষক: ব্রিটিশ শাসনকালে একশ্রেণির গ্রামীণ কৃষক বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদের মালিক হয়ে ওঠে। ধনী কৃষকরা তাদের বিপুল পরিমাণ অর্থ মহাজনি কারবারে নিয়োজিত করে দরিদ্র কৃষকদের উচ্চ সুদে ঋণ দেয়। গ্রামীণ মহাজনদের সংখ্যা কম হলেও গ্রামীণ অর্থনীতিতে তারা সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী শ্রেণি হিসেবে উঠে আসে। এই ধনী কৃষক ও মহাজন শ্রেণির সঠিক সংখ্যা জানা যায় না। গ্রামীণ কৃষকদের ঋণের অন্তত ৭৫ শতাংশই মহাজনদের কাছ থেকে আসত বলে ব্যাংকিং এনকোয়ারি কমিটির রিপোর্ট (১৯২৯-৩১ খ্রি.) থেকে জানা যায়। এই সময় বাংলায় অন্তত ৩০ শতাংশ ধনী কৃষক এই কারবারের সঙ্গে যুক্ত ছিল।
2 ভাগচাষি: গ্রামীণ কৃষক সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় শ্রেণি ছিল ভাগচাষি বা বর্গাদার শ্রেণি।
i. ভাগচাষির আবির্ভাব: ধনী কৃষকরা সরাসরি তাদের জমি চাষের কাজে যুক্ত ছিল না। তাদের কৃষিজমি চাষের দায়িত্ব দেওয়া হত ভাগচাষিদের হাতে। বহু দরিদ্র কৃষক মহাজনের ঋণের অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হলে মহাজন তাদের জমিজমা দখল করে নিত। এভাবে জমি হারিয়ে তারা ভাগচাষিতে পরিণত হত।
ii. ফসল প্রাপ্তি: ভাগচাষিরা নিজেদের খরচে মালিকের জমি চাষ করত এবং এর বিনিময়ে তারা উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক ভাগ পেত। তারা ফসলের মাধ্যমে তাদের খাজনা পরিশোধ করত।
3 ভূমিহীন কৃষক-মজুর
i. অবস্থান: ব্রিটিশ শাসনকালে গ্রামীণ কৃষক সম্প্রদায়ের তৃতীয় স্তরে অবস্থান করত ভূমিহীন কৃষক শ্রেণি। তারা ধনী কৃষকের জমিতে শ্রমদানের বিনিময়ে নিজেদের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমাজের নিম্নস্তরের দলিত ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ ভূমিহীন খেতমজুরে পরিণত হয়েছিল। মহাজনের ঋণের অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে বহু কৃষক ভূমিহীন ক্ষেতমজুরে পরিণত হয়।
ii. পরিসংখ্যান: হান্টারের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে চব্বিশ পরগনা জেলায় খেতমজুরের সংখ্যা ছিল খুবই সামান্য। কিন্তু ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে এই সংখ্যা যথেষ্ট বৃদ্ধি পায় এবং পরবর্তীকালেও এই বৃদ্ধির গতি অব্যাহত থাকে। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারি রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, এই সময় বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার অন্তত ১৭.৫ শতাংশ কৃষকই ছিল ভূমিহীন খেতমজুর।
উপসংহার: ব্রিটিশ শাসনাধীন গ্রামীণ সমাজে ধনী কৃষক সম্প্রদায় ও মোড়লরা ব্রিটিশ সরকারের সমর্থক শ্রেণিতে পরিণত হয়। অন্যদিকে তাদের নীচের স্তরে অবস্থানকারী ভাগচাষি ও ভূমিহীন কৃষক-মজুররা সুদখোর মহাজন ও সরকারের শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে শামিল হয়। প্রতিবাদী এই কৃষক শ্রেণির বিভিন্ন বিদ্রোহই ছিল ভারতে ব্রিটিশ সরকারের আর্থিক শোষণের বিরুদ্ধে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বিদ্রোহ।
1 করারোপ: আদিবাসীরা ব্রিটিশ আমলে তথাকথিত সভ্য সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসতে শুরু করলে তাদের সমাজ ও সংস্কৃতিতে পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ব্রিটিশ সরকার উনিশ শতকে আদিবাসী সম্প্রদায় সরকারের আইন, শাসন ও বিচার-ব্যবস্থার আওতায় আনে। ভূমি বন্দোবস্ত করে সরকার না আদিবাসীদের জমির ওপর কর আরোপ করে ও আদিবাসী কৃষকদের কাছ থেকে কর আদায়ে তীব্র নির্যাতন চালায়।
2 ‘দিকু’দের ভূমিকা: সরকার ও আদিবাসী কৃষকদের মধ্যে বহিরাগত জমিদার জোতদার, বণিক, মহাজন, ঠিকাদার, দালাল প্রভৃতি বিভিন্ন স্তরের মধ্যস্বত্বভোগীর আত্মপ্রকাশ ঘটে। তারা ব্রিটিশ সরকারের ছত্রছায়ায় থেকে আদিবাসী এলাকায় ঢুকে পড়ে। আদিবাসীরা এই মধ্যস্বত্বভোগী বহিরাগতদের ‘দিকু’ বলত। ‘দিকু’রা আদিবাসীদের সঙ্গে নানাভাবে প্রতারণা দেও শোষণ চালায়।
3 অরণ্যের অধিকার ব্যাহত: আদিবাসীরা পাহাড় ও মালভূমির অরণ্যাঞ্চলে ঝুম চাষ করে খাদ্য উৎপাদন করত এবং অরণ্য থেকে বিভিন্ন * সম্পদ আহরণ করত। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে সংরক্ষিত অরণ্যাঞ্চলে ঝুম চাষ নিষিদ্ধ করে এবং অরণ্য-সম্পদের ওপর সরকার একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করে।
4 সামাজিক আগ্রাসন: ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায় বিভিন্ন সামাজিক আগ্রাসনের শিকার হয়। খ্রিস্টান মিশনারিরা আদিবাসীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারের পাশাপাশি তাদের খ্রিস্টানধর্মে দীক্ষিত করতে থাকে। নতুন পাশ্চাত্য খ্রিস্টান সংস্কৃতির প্রভাবে আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাদী সংস্কৃতি আক্রান্ত হয়।
5 শোষণ ও বঞ্চনা: উনিশ শতকে ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা চা-কফির বাগিচা চাষ শুরু করে। অসংখ্য আদিবাসী শ্রমিককে সেখানে নিয়ে তাদের চা- কফি চাষে নিয়োগ করা হয়। সেখানকার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এবং সীমাহীন অত্যাচারের শিকার হয়ে বহু শ্রমিকের মৃত্যু হয়। সারা দেশে রেলপথ স্থাপনের কাজ শুরু হলে প্রচুর আদিবাসী শ্রমিককে এই কাজে নিয়োগ করা হয়। কয়লা উৎপাদনের কাজেও প্রচুর সংখ্যক আদিবাসী শ্রমিক নিয়োগ করা হয়। কিন্তু ন্যায্য পারিশ্রমিক না দিয়ে দিনের পর দিন নানাভাবে তাদের বঞ্চিত করা হয়।
6 মুক্তির উদ্যোগ: আদিবাসী সম্প্রদায় ব্রিটিশ সরকার, পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও অন্যান্য শোষকদের হাত থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে প্রয়াস চালায়। তারা নিজেদের সামাজিক সংস্কারের উদ্দেশ্যে শুদ্ধি আন্দোলন শুরু করে। সরকারি রাজস্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে তারা রুখে দাঁড়াতে শুরু করে। শোষণ থেকে মুক্তিলাভের উদ্দেশ্যে আদিবাসী সম্প্রদায়ের অন্যতম শাখা ছোটোনাগপুর অঞ্চলের কোল উপজাতি ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে এবং বিহারের সাঁওতাল উপজাতি ১৮৫৫-৫৬ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহ করে। ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার আশায় গুজরাটের এক আদিবাসী সম্প্রদায় ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে পুলিশ চৌকি আক্রমণ করে। দক্ষিণের রম্পা অঞ্চলে বনের কাঠ সংগ্রহ ও চারণভূমির ওপর অধিকারের দাবিতে বেশ কয়েকবার বিদ্রোহ করে। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে মুন্ডা বিদ্রোহের নেপথ্যেও একই ধরনের পটভূমি কাজ করেছিল।
উপসংহার: ঔপনিবেশিক আমলে আদিবাসী সম্প্রদায় সর্বাধিক সামাজিক অসাম্যের শিকার হয়। ব্রিটিশবিরোধী মহাবিদ্রোহ (১৮৫৭ খ্রি.) বা জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহ শুরু হওয়ার আগে ভারতের শোষিত ও নিপীড়িত আদিবাসী সম্প্রদায়ই প্রথম ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ভিত তৈরি করে। তাদের বিদ্রোহ ব্রিটিশবিরোধী কৃষক বিদ্রোহগুলিকেও শক্তি সরবরাহ করে।
প্রশ্ন38. ঔপনিবেশিক আমলে ভারতে দলিত সম্প্রদায়ের অবস্থার পরিচয় দাও।
সূচনা: খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে বৈদিক সভ্যতার যুগ থেকেই ভারতে শূদ্র নামে অস্পৃশ্য দলিত জাতির আত্মপ্রকাশ ঘটে। পরবর্তীকালে আরও বহু অনগ্রসর ও অস্পৃশ্য জাতির উদ্ভব ঘটে। এই অনগ্রসর, শোষিত ও নির্যাতিত সম্প্রদায় ব্রিটিশ শাসনকালে ‘দলিত’ নামে পরিচিত হয়। এই সময় তারা উচ্চবর্ণের নানা শোষণ ও অত্যাচারের শিকার হয়। তাই দলিতদের কাছে ইংরেজ বিরোধিতার চেয়ে নিজেদের সামাজিক মর্যাদা লাভের বিষয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
দলিত সম্প্রদায়ের অবস্থা
1 অবহেলার শিকার: শিক্ষা-সংস্কৃতিতে পিছিয়ে থাকা গ্রামগঞ্জের দলিত শ্রেণির মানুষ সংস্কৃত বা ইংরেজি ভাষা জানত না বলে তারা নিজেদের কথ্যভাষায় ভাবের আদান-প্রদান করত। উচ্চবর্ণের মানুষ দলিতদের এই কথ্যভাষাকে খুবই অবজ্ঞা করত। ব্রাহ্মণরা দক্ষিণ ভারতে তামিল ভাষাকে – যথেষ্ট ঘৃণার চোখে দেখত।
2 কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গি: জাতীয় কংগ্রেসে উচ্চবর্ণের নেতাদের প্রাধান্য ছিল। তারা অনেকেই জাতিভেদপ্রথার সমর্থক ছিল। কংগ্রেস নেতাদের এরূপ মনোভাবের ফলে দলিতদের সঙ্গে কংগ্রেসের দূরত্ব বাড়তে থাকে এবং তারা ক্রমে কংগ্রেসের বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি চেষ্টার সক্রিয় চেষ্টা ■ চালায়। অবশ্য মহাত্মা গান্ধি হরিজন আন্দোলন শুরু করে কংগ্রেসের প্রতি – দলিতদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেন। কিন্তু গান্ধিজির সাবধানী উদ্যোগ দলিতদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি।
3 বাংলায় দলিত সক্রিয়তা: ঊনবিংশ শতকে বাংলার দলিত নমঃশূদ্র সম্প্রদায় ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য ও শোষণের বিরুদ্ধে সরব হয়। প্রথমদিকে মতুয়া ধর্মের প্রবর্তক হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুর এবং পরবর্তীকালে প্রমথরঞ্জন ঠাকুর, যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল প্রমুখ দলিত নেতা উচ্চবর্ণের হিন্দুদের শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারিতে ■ উত্তরবঙ্গের রাজবংশী ও কোচদের তপশিলি জাতিভুক্ত করলে এর বিরুদ্ধে তারা সামাজিক আন্দোলন শুরু করে।
4 দলিত সংগঠন: দক্ষিণ ভারতে তামিল ভাষা ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে অব্রাহ্মণদের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়। এর ফলে জাস্টিস পার্টি (১৯১৭ খ্রি.) নামে দলিতদের রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে নাগপুরে অনুষ্ঠিত দলিত নেতাদের সম্মেলনে দলিত আন্দোলনের গতি আসে। এখানে সর্বভারতীয় নিপীড়িত সমিতি গঠিত হয়। এস. সি. রাজা এই সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। ড. আম্বেদকর ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে সর্বভারতীয় নিপীড়িত শ্রেণির কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি দলিতদের পৃথক নির্বাচনের অধিকার দাবি করেন।
5 আম্বেদকরের ভূমিকা: গান্ধিজি-সহ অন্যান্য কিছু নেতার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা অস্পৃশ্যতা-বিরোধী দলিত নেতা আম্বেদকরের কাছে বিশেষ মূল্যবান ছিল না। দলিতদের মন্দিরে প্রবেশ বা উচ্চবর্ণের সঙ্গে মেলামেশার অধিকারের চেয়ে তিনি দলিতদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি ঘটানোর বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দেন। তিনি ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে দলিতদের নিয়ে মহারাষ্ট্রে সত্যাগ্রহ আন্দোলন করেন এবং প্রকাশ্যে ‘মনুস্মৃতি’ গ্রন্থটি পুড়িয়ে তিনি ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিরোধিতা করেন। তিনি দলিতদের শিক্ষা, সংগঠন ও বিক্ষোভ আন্দোলনের ওপর বেশি গুরুত্ব দেন।
6 পুনা চুক্তি: ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ম্যাকডোনাল্ড তাঁর ‘সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা’ (১৯৩২ খ্রি.) নীতির মাধ্যমে দলিতদের পৃথক নির্বাচনের অধিকার দিলে গান্ধিজি এর তীব্র প্রতিবাদ করে অনশন শুরু করেন (২০ সেপ্টেম্বর, ১৯৩২খ্রি.)। শেষপর্যন্ত পুনা চুক্তির (২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৩২ খ্রি.) মাধ্যমে আম্বেদকর দলিতদের পৃথক নির্বাচনের অধিকারের দাবি থেকে সরে আসেন এবং গান্ধিজিও দলিতদের আরও বেশি সংখ্যক আসন সংরক্ষণের দাবি মেনে নেন।
উপসংহার: আম্বেদকরের নেতৃত্বে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে সর্বভারতীয় তপশিলি জাতি ফেডারেশন প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে দলিত আন্দোলনকে জাতীয় কংগ্রেসও গুরুত্ব দিতে শুরু করে। স্বাধীনতা লাভের প্রাক্-মুহূর্তে দলিত নেতা আম্বেদকরকে সংবিধানের খসড়া রচনা কমিটির সভাপতি নির্বাচন করা হয়। একজন দলিত নেতার নেতৃত্বাধীন কমিটি স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার অধিকার পায়। তাঁর নেতৃত্বে রচিত নতুন সংবিধানে অস্পৃশ্যতাকে বেআইনি বলে ঘোষণা করা হয়।
প্রশ্ন39. ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতে আদিবাসী ও দলিত সম্প্রদায়ের আন্দোলনের বিবরণ দাও।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতে আদিবাসী আন্দোলন
1 চূয়াড় বিদ্রোহ (১৭৬৮ খ্রি.): ১৭৬৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মেদিনীপুর ও বাঁকুড়া জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে চূয়াড় নামক উপজাতি সম্প্রদায় ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। ঘাটশিলার জমিদার তথা ধলভূমের রাজা জগন্নাথ সিংহের নেতৃত্বে বিদ্রোহ শুরু হয় এবং শীঘ্রই কৃষক ও জমিদাররা বিদ্রোহে যোগ দেয়।
2 কোল বিদ্রোহ (১৮৩২ খ্রি.): বর্তমান বিহারের ছোটনাগপুর অঞ্চলে কোল উপজাতির বাস ছিল। তারা অত্যাচারী মহাজন, জমিদার ও ইংরেজ কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহ শুরু করে। বুদ্ধু ভগত, জোয়া ভগত, বিন্দরাই মানকি, সুই মুন্ডা প্রমুখ নেতা কোল বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। দু-বছর বিদ্রোহ চলার পর আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ব্রিটিশ বাহিনীর কাছে বিদ্রোহীরা পরাজিত হয়
3 সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫ খ্রি.): ছোটনাগপুর, মানভূম, পালামৌ,বীরভূম, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর প্রভৃতি অঞ্চলে বসবাসকারী সাঁওতাল উপজাতি ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে জমিদার, মহাজন ও ব্রিটিশ কর্মচারীদের বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্রোহ শুরু করে। সিধু, কানু, চাঁদ, ভৈরব, বীরসিং, কালো প্রামাণিক, ডোেমন মাঝি প্রমুখ সাঁওতাল নেতার নেতৃত্বে প্রায় ৫০ হাজার সাঁওতাল বিদ্রোহী ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে সাঁওতাল বিদ্রোহে শামিল হয়। কিন্তু ব্রিটিশ সেনাবাহিনী প্রায় ২৩ হাজার বিদ্রোহীকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে এই বিদ্রোহ দমন করে।
4 মুন্ডা বিদ্রোহ (১৯০০ খ্রি.): ছোটনাগপুর ও তার সন্নিহিত অঞ্চলে প্রচুর মুন্ডা বসবাস করত। বিভিন্ন শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বীরসা মুন্ডার নেতৃত্বে মুন্ডারা ১৮৯৯-১৯০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে যা ‘উলগুলান’ বা ‘ভয়ঙ্কর বিশৃঙ্খলা’ নামে পরিচিত। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪ ডিসেম্বর মুন্ডা বিদ্রোহীরা রাঁচী ও সিংভূম জেলায় বিদ্রোহ শুরু করে। জমিদার, মহাজন, পুলিশ ও ইংরেজ কর্মচারীদের ওপর আক্রমণ চলে। তবে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী কিছুদিনের মধ্যেই বিদ্রোহ দমন করে।
5 অন্যান্য আদিবাসী বিদ্রোহ: এ ছাড়া অন্যান্য আদিবাসী বিদ্রোহগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- [i] খাসি বিদ্রোহ (১৭৮০ খ্রি.), [ii] ভীল বিদ্রোহ (১৮০৮ খ্রি.), [iii] জাঠ বিদ্রোহ (১৮০৯ খ্রি.), [iv] কোল বিদ্রোহ (১৮৩১-৩২ খ্রি.), [v] ভূমিজ বিদ্রোহ (১৮৩২ খ্রি.), [vi] নাগা বিদ্রোহ (১৮৩৯ খ্রি.), [vii] খোন্দ বিদ্রোহ (১৮৪৬ খ্রি.) প্রভৃতি।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতে দলিত আন্দোলন
ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের বিভিন্ন অস্পৃশ্য ও নিপীড়িত মানুষ ‘দলিত’ বলে পরিচিতি লাভ করে।
1 জ্যোতিবা ফুলের আন্দোলন: ১৮৭০-এর দশকে জ্যোতিবা ফুলে- র নেতৃত্বে মহারাষ্ট্রে এক দলিত আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। তিনি ‘সত্যশোধক সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করে দলিতদের মর্যাদা আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু করেন। তিনি বলেন যে, ব্রাহ্মণরা হল বিদেশি আর্যজাতির বংশধর। এদের সরিয়ে ভারতে প্রাচীন সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন।
2 শ্রীনারায়ণ গুরুর আন্দোলন: কেরালার এজাভা নামক দলিত সম্প্রদায়ের নেতা শ্রীনারায়ণ গুরু (১৮৫৬-১৯২৮ খ্রি.) দলিত শ্রেণির সামাজিক মর্যাদা আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন গড়ে তোলেন। দলিত হিন্দুরা যাতে অবাধে মন্দিরে প্রবেশ করতে পারে সে উদ্দেশ্যে তিনি বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তাঁর উদ্যোগে ভাইকম মন্দিরে দলিতদের প্রবেশের অধিকার স্বীকৃত হয়। তাঁর অনুগামীরা দলিত শ্রেণির উন্নতির লক্ষ্যে ‘শ্রীনারায়ণ ধর্ম পরিপালন যোগম’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে দলিতদের উন্নয়নের কর্মসূচি চালিয়ে যান।
3 জাস্টিস পার্টির আন্দোলন: টি. এম. নায়ার, পি. চেট্টি প্রমুখের নেতৃত্বে মাদ্রাজে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে জাস্টিস পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই পারি অরাত্মণদের জন্য পৃথক নির্বাচনের দাবি জানায়। তাদের দাবির ভিত্তিতে মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইনে (১৯১৯ খ্রি.) মাদ্রাজ আইন পরিষদে ২৮টি আসন দলিত প্রতিনিধিদের জন্য সংরক্ষিত হয়।
4 রামস্বামী নাইকার-এর আন্দোলন: জাস্টিস পার্টির প্রভাব হ্রাস পাওয়ার পরবর্তীকালে দক্ষিণ ভারতে ই. ভি. রামস্বামী নাইকার-এর নেতৃত্বে দলিত আন্দোলন নতুন পথে পরিচালিত হয়। তাঁর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এই আন্দোলন ‘আত্মসম্মান আন্দোলন’ নামে পরিচিত। এই আন্দোলনের অনুগামীরা তামিল ভাষা ও সাহিত্যের পুনরুদ্ধার শুরু করে।
5 বাংলার দলিত আন্দোলন: বিংশ শতকের শুরুতে উচ্চবর্গীয় হিন্দুদের আর্থিক শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে এবং নিজেদের সামাজিক মর্যাদা আদায়ের লক্ষ্যে নমঃশূদ্ররা সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলে। এ ছাড়া উত্তরবঙ্গের রাজবংশী ও কোচ নামক দলিত সম্প্রদায় আন্দোলন শুরু করে। বাংলায় নমঃশূদ্র নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল ও প্রমথ রঞ্জন ঠাকুর এবং রাজবংশী নেতা ঠাকুর পঞ্চানন দলিত আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
প্রশ্ন40. ব্রিটিশ শাসনকালে আদিবাসী ও দলিত সম্প্রদায়ের বিবরণ দাও?
অথবা, ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে আদিবাসী ও দলিত সম্প্রদায় সম্পর্কে আলোচনা করো।
ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায়
1. পরিচিতি: ভারতের আদিবাসী জনগণ প্রাথমিকভাবে আদিম মানুষ, পাহাড়ি জনগোষ্ঠী, উপজাতি প্রভৃতি নানা নামে পরিচিত। কোনো একটি এলাকায় অনুপ্রবেশকারীরা আসার আগে সেখানকার নিজস্ব সংস্কৃতি রীতিনীতি ও মূল্যবোধসম্পন্ন জনগোষ্ঠী যারা পরবর্তীকালে সমাজের সংখ্যালঘু হিসেবে বসবাস করে তারা আদিবাসী নামে পরিচিত। সাঁওতাল, কোল, ভীল, মুন্ডা, ওঁরাও, হো, ভূমিজ, খন্দ, গোণ্ড, ভারলি, নাগরা প্রভৃতি আদিবাসী সম্প্রদায় প্রকৃতির কোলে বসবাস করত এবং প্রকৃতির সম্পদ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করত।
2 বিবরণ: TOPIC [D]-এর 1 নং রচনাধর্মী প্রশ্নের উত্তরের 1, 2, 3, 435 নং পয়েন্ট দ্যাখো।
দলিত সম্প্রদায়
1 পরিচিতি: জন্ম ও পেশাগত দিক থেকে বৈষম্য ও বঞ্জনার স্বীকার হয় যেসব মানুষেরা, তারা সাধারণভাবে দলিত নামে পরিচিত। দলিত শব্দের বাংলা অর্থ হল দমিত, শাষিত বা মর্দিত, পদদলিত। ময়লা পরিস্কার করা, রাস্তা ঝাড়ু দেওয়া, মৃতদেহ সৎকার করা, মানুষের মলমূত্র পরিস্কারের মতো যে কাজগুলিকে আমরা অশুদ্ধ বলে মনে করি সেই কাজগুলি করে থাকে দলিত শ্রেণি। দলিতদের মধ্যে অন্যতম কয়েকটি গোষ্ঠী হল চর্মকার, মালাকার, কামার, কুমোর, জেলে, কোল, কাহার, ডোম, মুচি, মালো, সবর প্রভৃতি সম্প্রদায়।
2 বিবরণ: TOPIC [D]-এর 2 নং রচনাধর্মী প্রশ্নের উত্তরের 1, 3, 4, 5 ও 6 নং পয়েন্ট দ্যাখো।
প্রশ্ন41 ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে আদিবাসী শ্রেণির আন্দোলন সংক্ষেপে বিবৃত করো।
ভারতের আদিবাসী শ্রেণির আন্দোলন
1 চুয়াড় বিদ্রোহ
i. কারণ
জীবিকা সমস্যা: ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চুয়াড়দের অধিকাংশ ভোগদখল করা জমি কেড়ে নিলে চুয়াড়দের স্বাধীন জীবিকার সমস্যা দেখা দেয়।
খাজনার হার বৃদ্ধি: আবাদি জমিতে খাজনার হার বাড়িয়ে দেওয়ায় চুয়াড়রা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এদের সঙ্গে বিক্ষুদ্ধ কৃষক, পাইক, প্রমুখরাও যোগ দেয়।
ii. প্রসার: ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে এই বিদ্রোহ ব্যাপক হিংসাত্মক হয়ে ওঠে। বিদ্রোহীরা বহু এলাকায় সরকারি সম্পত্তি ও ফসল পুড়িয়ে দেয়। গোবর্ধন দিকপতি, মোহনলাল, লাল সিং প্রমুখের নেতৃত্বে ৩৮টি গ্রামের সর্দার ও পাইক সম্প্রদায় গেরিলা পদ্ধতিতে আক্রমণ চালায়।
iii. বিদ্রোহ দমন: ব্রিটিশের তীব্র দমননীতির কাছে বিদ্রোহীরা আত্ম সমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
iv. তাৎপর্য: বিদ্রোহের শেষে চুয়াড়দের একাংশকে পুলিশের কাজে নেওয়া হয় এবং পাইকদের নিষ্কর জমি ফেরত দেওয়া হয়। নতুন ব্যবস্থায় বলা হয়, পাইকরা খুব কম হারে রাজস্ব দেবে এবং তাদের জমিকে খাসজমি করে নেওয়া হবে না।
2 কোল বিদ্রোহ
i. কারণ
রাজস্ববৃদ্ধি: ইংরেজ কোম্পানি ছোটোনাগপুর অঞ্চলের শাসনভার পাওয়ার পর অঞ্চলটিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে বহিরাগত হিন্দু, মুসলিম, শিখ মহাজনদের ইজারা দেয়। এইসব মহাজন রাজস্বের হার বৃদ্ধি করলে কোলরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
জীবিকায় আঘাত: কোম্পানির আমলে চুয়াড়দের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আফিম চাষ করানো হতে থাকে। এতে কোলদের জীবিকাগত ঐতিহ্যে আঘাত লাগে ও তারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
ii. নেতৃত্ব: বুদ্ধু ভগত, জোয়া ভগত, ঝিন্দরাই মানকি, সুই মুণ্ডা প্রমুখের নেতৃত্বে কোল বিদ্রোহ পরিচালিত হয়।
iii. বিদ্রোহের বিস্তার ও দমন: ১৮৩১-৩২ খ্রিস্টাব্দে কোলরা প্রথম সংঘবদ্ধভাবে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বিদ্রোহী কোলদের সঙ্গে যোগ দেয় সাধারণ চাষি, কামার, কুমোর, গোয়ালা প্রভৃতি নিম্নবর্গীয় ও শোষিত মানুষ। ইংরেজ সরকার সেনাবাহিনীর সাহায্যে এই বিদ্রোহ দমন করে।
iv. গুরুত্ব: কোল বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে সরকার কোল উপজাতিদের জন্য ‘দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত এজেন্সি’ নামে একটি ভূ- খন্ড নির্দিষ্ট করে দেয়। কোলদের বসবাসের জন্য নির্দিষ্ট এইসব অঞ্চলে কয়েকটি স্বতন্ত্র নিয়মকানুন চালু হয়।
3 সাঁওতাল বিদ্রোহ
1. কারণ
খাজনা ও উপশুল্ক আরোপ: আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত সাঁওতালদের আবাদি জমিগুলি জমিদাররা হস্তগত করে। পাশাপাশি কোম্পানি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করে তাদের থেকে বিভিন্ন খাজনা ও উপশুল্ক আদায় করলে সাঁওতালরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
বন্ড প্রথা: অভাবের তারনায় সাঁওতালরা মহাজনদের থেকে কামিয়াতি ও হারহয়াহি নামে দুই ধরনের বন্ডে সই করে ঋণ নিত। খাদ্যশস্য বা অর্থ হিসেবে নেওয়া এই ঋণ যতদিন না তারা শোধ করতে পারত ততদিন তাদেরকে মহাজনদের জমিতে বেগার খাটতে হত।
ব্যবসায়ীদের কারচুপি: সাঁওতাল পরগনাতে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বেচারাম নামক বাটখারা দ্বারা হিসাবে কম ওজনের দ্রব্য বিক্রি করে সাঁওতালদের ঠকাত। আবার সাঁওতালদের কাছ থেকে কোনো শস্য কেনার সময় হিসাবের থেকেও ভারী ওজনের কেনারাম বাটখারা ব্যবহার করে।
ii. গুরুত্ব বা ফলাফল: একজন ডেপুটি কমিশনারের অধীনে সাঁওতালদের জন্য সাঁওতাল পরগনা নামে একটি স্বতন্ত্র সংরক্ষিত এলাকা সৃষ্টি করে। বলা হয়, সাঁওতাল পরগনায় কোম্পানির কোনো আইনবিধি কার্যকর করা হবে না। বিদ্রোহের পর সাঁওতালদের পৃথক উপজাতি হিসেবেও স্বীকৃতি দেয় ব্রিটিশ সরকার।
4 মুণ্ডা বিদ্রোহ
i. কারণ
কৃষিব্যবস্থায় ডাঙন: আদিবাসী মুন্ডাদের কৃষিব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ‘খুঁৎকাঠি’ প্রথা অর্থাৎ ‘জমির যৌথ মালিকানার প্রথা’। কিন্তু ব্রিটিশ শাসন তাদের সেই চিরাচরিত প্রথাকে উপেক্ষা করে। জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠা করে।
জমিদখল: উত্তরের সমভূমি থেকে আগত ঠিকাদার, মহাজন ও জমিদাররা মুন্ডাদের জমিগুলি (ভূঁইহারি জমি)-র থেকে বিতাড়িত। করে সেগুলি নিজেদের খাসজমি (মাঝিহাম)-তে পরিণত করে। ফলে মুন্ডারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
ii. গুরুত্ব বা ফলাফল: মুণ্ডা বিদ্রোহের তীব্রতা হ্রাসের লক্ষ্যে। ছোটোনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন (১৯০৮ খ্রি.) পাস হয়। প্রজাস্বত্ব আইনের মাধ্যমে প্রজাদের খুঁৎকাঠি বা মুণ্ডকটি প্রথা অর্থাৎ জমির যৌথ মালিকানার প্রথা স্বীকার করে নেওয়া হয়।
5 ভিল বিদ্রোহ
i. কারণ
খান্দেশ অধিকার: ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজরা খান্দেশ অধিকার করলে ভিলরা ক্ষুব্ধ হয়। ঔপনিবেশিক আমলে এই অঞ্চলে প্রবর্তিত সরকারি নিয়মকানুন ও কর্তৃত্ব মানতে না পেরে ভিলরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
মাড়োয়ারি সাউকারদের অত্যাচার: মাড়োয়ারি সাউকার ও মহাজনদের কাছ থেকে ভিলরা অভাবের তাড়নায় চড়া সুদে টাকা ধার নিত। কিন্তু তারা সেই ঋণ শোদ দিতে ব্যর্থ হলে তাদের ওপর সাউকাররা নিদারুণ শোষণ ও উৎপীড়ন চালাত।
II. দমন: প্রথমদিকে কর্নেল আউট্রামের নেতৃত্বে ইংরেজ বাহিনী ভিন্ন বিদ্রোহ দমন করলেও ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই বিদ্রোহ চলেছিল।
Iii. গুরুত্ব: ভিল বিদ্রোহের ফলস্বরূপ শোষক মাড়োয়ারি মহাজন শ্রেণি রাজস্থানের গ্রামাঞ্চল থেকে পালিয়ে যায়।
5. Fill in The Blanks
1. ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণির অগ্রভাগে ছিল |
(a) দিল্লির মধ্যবিত্ত শ্রেণি
(b) বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণি ✔
(c) মাদ্রাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণি
(d) বোম্বাইয়ের মধ্যবিত্ত শ্রেণি
2. ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করে।
(a) কৃষকরা
(b) শ্রমিকরা
(c) মধ্যবিত্তরা ✔
(d) চরমপন্থীরা
3. ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ইস্পাত-কাঠামো বলা হত |
(a) সামরিক বিভাগকে
(b) পুলিশ বিভাগকে
(c) অর্থবিভাগকে
(d) আমলাতন্ত্রকে ✔
4. ব্রিটিশ আমলে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত সম্প্রদায় ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ।
(a) উচ্চবর্ণের হিন্দু ✔
(b) নিম্নবর্ণের হিন্দু
(c) মুসলিম
(d) ফারসি জানা শিক্ষিত ভারতীয়
5. উদ্যোগে ভারতে সর্বপ্রথম মুদ্রণযন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
(a) মধ্যবিত্তদের
(b) ইংরেজ সরকারের
(c) ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর
(d) ব্যাপটিস্ট মিশনের মিশনারিদের ✔
6. জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশন প্রতিষ্ঠায় সর্বাধিক উদ্যোগ নেন।
(a) রাজা রামমোহন রায়
(b) আলেকজান্ডার ডাফ ✔
(c) জোনাথান ডানকান
(d) ডেভিড হেয়ার
7. কলকাতায় ‘অ্যাংলো-হিন্দু স্কুল’ (১৮২২ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন |
(a) রামমোহন রায় ✔
(b) রাধাকান্ত দেব
(c) বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়
(d) ডেভিড হেয়ার
8. খ্রিস্টাব্দে কলকাতা সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
(a) ১৮১৭
(b) ১৮২৪ ✔
(c) ১৮৩৬
(d) ১৮৫৬
9. খ্রিস্টাব্দে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
(a) ১৮১৭
(b) ১৮৬০ ✔
(c) ১৮৫৬
(d) ১৮৭০
10. ভারতের পাশ্চাত্য শিক্ষার ‘ম্যাগনাকার্টা’ বা মহাসনদ বলা হয়।
(a) উডের ডেসপ্যাচকে ✔
(b) হান্টার কমিশনকে
(c) চার্টার আইনকে
(d) মেকলে মিনিটকে
11. কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন খ্রিস্টাব্দে গঠিত হয়।
(a) ১৭৯৩
(b) ১৮২৩
(c) ১৮২৮
(d) ১৮৩৩ ✔
12. উডের ডেসপ্যাচ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়।
(a) ১৮১৩
(b) ১৮৩৩
(c) ১৮৩৫
(d) ১৮৫৪ ✔
13. ‘ভারতীয় নবজাগরণের অগ্রদূত’ বলা হয় |
(a) বিদ্যাসাগরকে
(b) রবীন্দ্রনাথকে
(c) রামমোহন রায়কে ✔
(d) স্বামী বিবেকানন্দকে
14. ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ বলা হয়।
(a) রামমোহন রায়কে ✔
(b) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে
(c) শ্রীরামকৃয়কে
(d) স্বামী বিবেকানন্দকে
15. খ্রিস্টাব্দে সতীদাহপ্রথা নিষিদ্ধ হয়।
(a) ১৮১৫
(b) ১৮২৩
(c) ১৮২৯ ✔
(d) ১৮৩৩
16. ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠা করেন।
(a) কেশবচন্দ্র সেন
(b) রাজা রামমোহন রায় ✔
(c) দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
(d) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
17. ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র ছিল |
(a) দিগ্দর্শন
(b) সম্বাদ কৌমুদী
(c) তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা ✔
(d) সমাচার দর্পণ
18. কেশবচন্দ্র সেনের সর্বধর্মসমন্বয়ের আদর্শ নামে পরিচিত।
(a) নববিধান ✔
(b) মিত্রমেলা
(c) ব্রাহ্মধর্ম
(d) ব্রহ্মদর্শন
19.’ইন্ডিয়ান মিরর’ পত্রিকাটি প্রকাশ করেন।
(a) রামমোহন রায়
(b) দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ✔
(c) কেশবচন্দ্র সেন
(d) ডিরোজিও
20. বিদ্যাসাগর কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন।
(a) হিন্দু
(b) সংস্কৃত ✔
(c) বিদ্যাসাগর
(d) সেন্ট লরেন্স
21. বিধবাবিবাহ সমিতি (১৮৬১ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন।
(a) আত্মারাম পান্ডুরঙ্গ
(b) রামকৃয় ভান্ডারকর
(c) মহাদেব গোবিন্দ রানাডে ✔
(d) কেশবচন্দ্র সেন
22. ভারতের থিওসফিক্যাল সোসাইটির প্রধান কার্যালয় স্থাপিত হয়।
(a) কলকাতায়
(b) মাদ্রাজে ✔
(c) বোম্বাইয়ে
(d)দিল্লিতে
23. শ্রীমতী অ্যানি বেসান্ত সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
(a) থিওসফিক্যাল সোসাইটির ✔
(b) অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনের
(c) ব্রাহ্মসমাজের
(d) আত্মীয় সভার
24.মাদ্রাজ মহাজন সভা খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়।
(a) ১৮৭৫
(b) ১৮৮৪ ✔
(c) ১৮৮৭
(d) ১৮৯০
25. সত্যশোধক সমাজের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন |
(a) দয়ানন্দ সরস্বতী
(b) কেশবচন্দ্র সেন
(c) জ্যোতিবা ফুলে ✔
(d) শিবনাথ শাস্ত্রী
26. গোরক্ষা আন্দোলন শুরু করে।
(a) ব্রাহ্মসমাজ
(b) পরমহংস সমাজ
(c) আর্যসমাজ ✔
(d) আত্মীয় সভা
27. পুনা সর্বজনিক সভা প্রতিষ্ঠিত হয় খ্রিস্টাব্দে।
(a) ১৮৭৫
(b) ১৮৮০
(c) ১৮৭০ ✔
(d)১৮৯২
28. শ্রীনারায়ণ গুরু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
(a) হরিজন
(b) ইঝোবা
(c) এজহারা
(d) মাহার ✔
29. তেলুগু সাহিত্য ও সাংবাদিকতার জনক ছিলেন |
(a) নারায়ণ গুরু
(b) মহাদেব গোবিন্দ রানাডে
(c) বীরসালিঙ্গম ✔
(d) দয়ানন্দ সরস্বতী
30 . দক্ষিণ ভারতে প্রথম বিধবাবিবাহ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত হয়।
(a) ১৮৫৬
(b) ১৮৮১ ✔
(c) ১৮৭২
(d) ১৮৮২
31. মহারাষ্ট্রে সমাজসংস্কার আন্দোলনের সূচনা করেন।
(a) বি. আর. আম্বেদকর
(b) জ্যোতিবা ফুলে ✔
(c) মহাদেব গোবিন্দ রানাডে
(d) গোপালহরি দেশমুখ
32. বীরসালিঙ্গম দক্ষিণের নামে পৰিচয়
(a) গান্ধি
(b) রামকৃয়
(c) বিবেকানন্দ
(d) বিদ্যাসাগর ✔
33. অমলেশ ত্রিপাঠী -কে বাংলার নবজাগরণের জনক বলে মনে করেন।
(a) রামমোহন রায় ✔
(b) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
(c) বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
(d) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
34. নব্যবঙ্গ দলের প্রতিষ্ঠাতা।
(a) রামমোহন রায়
(b) ডিরোজিও ✔
(c) দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
(d) কেশবচন্দ্র সেন
35. মহাজনদের প্রধান কাজ ছিল |
(A) সুদের ব্যাবসা ✔
(B) শিল্প প্রতিষ্ঠা
(C) ব্যাবসা
(D) শাসনকার্য পরিচালনা
36. প্যাটেল উপাধি গ্রহণ করত।
(A) সাউকাররা
(B) পতিদাররা ✔
(C) মহাজনরা
(D) বণিকরা
37. চেটিয়াররা সঙ্গে যুক্ত ছিল।
(A) প্রশাসনের
(B) সেনাবিভাগের
(C) মহাজনি কারবারের ✔
(D) রাজনীতির
38. সাটকার বিরোধী দাঙ্গা’ বা ‘দাক্ষিণাত্য বিদ্রোহ’ হয় খ্রিস্টাব্দে।
(A) ১৮৬০
(B) ১৮৬৫
(C) ১৮৭৫ ✔
(D) ১৮৮৫
39. দাক্ষিণাত্যের হাঙ্গামা দের বিরুদ্ধে হয়েছিল।
(A) পতিদার
(B) দেওয়ান
(C) সাউকার ✔
(D) মধ্যবিত্
40. ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতে সুতাকল প্রতিষ্ঠিত হয়।
(A) ৫৫টি
(B)৫৬টি ✔
(C) ৫৭টি
(D) ৫৮টি
41. হোমরুল আন্দোলনের নেত্রী ছিলেন |
(A) শ্রীমতি বেসান্ত ✔
(B) সরোজিনী নাইডু
(C) কল্পনা দত্ত
(D) প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার
42. খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজির নেতৃত্বে আমেদাবাদের বস্ত্রশিল্পের শ্রমিকরা আন্দোলন করে সফল হয়।
(A) ১৯১৬
(B) ১৯১৭
(C) ১৯১৮ ✔
(D) ১৯১৯
43. মাদ্রাজ লেবার ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করেন |
(A) লালা লাজপত রায়
(B) দেওয়ান চমনলাল ✔
(C) বি. পি. ওয়াদিয়া
(D) ভি. ভি. গিরি
44. ‘লেবার-কিষাণ গেজেট’ পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন |
(A) মুজাফ্ফর আহমেদ
(B) সন্তোষকুমারী গুপ্তা
(C) সিঙ্গারাভেল্লু চেট্টিয়ার
(D) এস. এ. ডাঙ্গে ✔
45. ফোর্ট গ্লস্টার চটকল অবস্থিত।
(A) চেঙ্গাইলে ✔
(B) বোম্বাইতে
(C) বাউড়িয়ায়
(D) হাওড়ায়
46. মুজাফ্ফর আহমেদ ছিলেন নেতা।
(A) কংগ্রেস
(B) হোমরুল
(C) বামপন্থী ✔
(D) মুসলিম লিগ
47. অকালি আন্দোলন খ্রিস্টাব্দে শুরু হয়।
(A) ১৮৯১
(B) ১৮৯৯
(C) ১৯১১
(D) ১৯২০ ✔
48. মুন্ডা বিদ্রোহ হয়েছিল |
(A) পুরুলিয়ায়
(B) মধ্যপ্রদেশে
(C) রাঁচি ও সিংভূম জেলায় ✔
(D) বাঁকুড়ায়
49. দলিত আন্দোলন সংগঠিত করেন |
(A) দাদাভাই নওরোজি
(B) ভীমরাও আম্বেদকর ✔
(C) সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
(D) সরোজিনী নাইডু
50. সাঁওতাল বিদ্রোহ হয়েছিল খ্রিস্টাব্দে।
(A) ১৮৫৫-৫৬ ✔
(B) ১৮৫৬-৫৭
(C) ১৮৫৭-৫৮
(D) ১৮৫৮-৫৯
51. হরিজন আন্দোলন শুরু করেন |
(A) ভীমরাও আম্বেদকর
(B) মহাত্মা গান্ধি ✔
(C) বীরসালিঙ্গম পান্ডুলু
(D) জ্যোতিবা ফুলে
52. মতুয়া ধর্মের প্রবর্তক ছিলেন |
(A) টেকচাঁদ ঠাকুর
(B) প্রমথরঞ্জন ঠাকুর
(C) হরিচাঁদ ঠাকুর ✔
(D) প্রসন্নকুমার ঠাকুর