WBBSE Class 8 পরবাসী Chapter 3 Bangla Solution |Bengali Medium

Class 8 Chapter 3 Bengali Medium

পরবাসী

Very Short Question Answer

১. নীচের প্রশ্নগুলির একটি বাক্যে উত্তর দাও :

১.১ কবি বিষ্ণু দে-র প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম কী?

উত্তর: ১৯৩২ সালে প্রকাশিত ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’ কবি বিষু দে-র প্রথম কাব্যগ্রন্থ।

১.২ তাঁর লেখা দুটি প্রবন্ধের বইয়ের নাম লেখো।

উত্তর: রবীন্দ্রোত্তর কবি বিষ্ণু দে প্রণীত দুটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থ হল-

১. রুচি ও প্রগতি : ১৯৪৬, ২. সাহিত্যের দেশ বিদেশ : ১৯৬২

২. নিম্নরেখ শব্দগুলির বদলে অন্য শব্দ বসিয়ে অর্থপূর্ণ বাক্য তৈরি করো। প্রথমটি করে দেওয়া হল:

২.১ দুই দিকে বন, মাঝে ঝিকিমিকি পথ

উত্তর: দুই দিকে বন, মাঝে আলোছায়া পথ।

২.২ এঁকে বেঁকে চলে প্রকৃতির তালে তালে।

উত্তর: এঁকে বেঁকে চলে প্রকৃতির ছন্দে।

২.৩ তাঁবুর ছায়ায় নদীর সোনালি সেতারে।

উত্তর: তাঁবুর ছায়ায় নদীর কুলুকুলু ধ্বনিতে।

২.৪ হঠাৎ পুলকে বনময়ূরের কথক।

উত্তর: হঠাৎ পুলকে বনময়ূরের ভারতনাট্যম্।

২.৫ বন্যপ্রাণের কথাকলি বেগ জাগিয়ে।

উত্তর: বন্যপ্রাণের নৃত্যের বেগ জাগিয়ে।

Short Question Answer

৩.১ পথ কীসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে?

উত্তর: রবীন্দ্র পরবর্তী কবি বিষ্ণু দে প্রণীত ‘পরবাসী’ নামাঙ্কিত কবিতায় পথ বনের মধ্যে এঁকেবেঁকে ‘প্রকৃতির তালে-তালে’ মিলিয়ে চলে।

৩.২ চিতার চলে যাওয়ার ছন্দটি কেমন?

উত্তর : রবীন্দ্র পরবর্তী অত্যন্ত খ্যাতিমান কবি বিষ্ণু দে প্রণীত ‘পরবাসী’ নামাঙ্কিত কবিতায় বন্য-হিংস্র চিতার চলে যাওয়ার ছন্দে তার লুব্ধতা ও ভয়ংকর হিংস্রতা ধরা পড়ে।

৩.৩ ময়ূর কীভাবে মারা গেছে?

উত্তর: রবীন্দ্র পরবর্তী অত্যন্ত খ্যাতিমান কবি বিষ্ণু দে প্রণীত ‘পরবাসী’ নামাঙ্কিত কবিতায় ময়ূরের মৃত্যুর নেপথ্য কারণ অন্বেষণে মানুষের অপরিমেয় লোভ-লালসা এবং অর্থ আদায়ের সংকল্পকে চিহ্নিত করা হয়েছে।

৩.৪ প্রান্তরে কার হাহাকার শোনা যাচ্ছে?

উত্তর: রবীন্দ্র পরবর্তী অত্যন্ত খ্যাতিমান কবি বিষ্ণু দে প্রণীত ‘পরবাসী’ নামাঙ্কিত কবিতায় ধূসর, ঊষর, নির্জন প্রান্তরে ‘শুকনো হাওয়ার হাহাকার’ শোনা যায়।

৩.৫ পলাশের ঝোপে কবি কী দেখেছেন?

উত্তর: রবীন্দ্র পরবর্তী অত্যন্ত খ্যাতিমান কবি বিষ্ণু দে প্রণীত ‘পরবাসী’ নামাঙ্কিত কবিতায় কবি নিটোল টিলার পাশে লাল পলাশের ঝোপে বন্য ময়ূরকে অপূর্ব ছন্দে নৃত্য করতে দেখেছেন।

৪. নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর কয়েকটি বাক্যে লেখো:

৪.১ জঙ্গলের কোন্ কোন্ প্রাণীর কথা কবি এই কবিতায় বলেছেন?

উত্তর: বিশ শতকের অন্যতম সংবেদনশীল কবি বিষ্ণু দে প্রণীত ‘পরবাসী’ নামাঙ্কিত কবিতায় কচি খরগোশ, বন ময়ূর, হরিণ ও হিংস্র চিতার কথা উল্লিখিত হয়েছে। এই প্রাণীরা একসময় আরণ্যক প্রান্তরে স্বাধীনভাবে বিচরণ করত।

৪.২ সেতারের বিশেষণ হিসেবে কবি ‘সোনালি’ শব্দের ব্যবহার করেছেন কেন?

উত্তর: বিশ শতকের অন্যতম সংবেদনশীল কবি বিষ্ণু দে প্রণীত ‘পরবাসী’ নামাঙ্কিত কবিতায় কবি নদীর প্রবাহিত কুলকুল ধ্বনির সঙ্গে সেতারের মূর্ছনার তুলনা করেছেন। সূর্যের নরম আলোয় নদীর বহমান জল সোনালি আভায় ভরে উঠেছে। ময়ূর আনন্দে কথকের মতো নৃত্য করে চলেছে। ময়ূরের সেই নৃত্যের সঙ্গে নদীর প্রবাহিত ধ্বনি মিলেমিশে অপূর্ব যে সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়েছে তাকে চিহ্নিত করতে কবি বিষ্ণু দে ‘সোনালি’ শব্দটিকে সঠিক প্রয়োগ করেছেন।

৪.৩ ‘কথক’ ও ‘কথাকলি’-র কথা কবিতার মধ্যে কোন্ প্রসঙ্গে এসেছে?

উত্তর: বিশ শতকের অন্যতম সংবেদনশীল কবি বিষু দে প্রণীত ‘পরবাসী’ নামাঙ্কিত কবিতায় ‘কথক’ ও ‘কথাকলি’-এই দুটি ধ্রুপদী নৃত্যকলার উল্লেখ রয়েছে। কথক হল উত্তর ভারতের প্রসিদ্ধ ধ্রুপদী নৃত্যকলা। অষ্টাদশ শতকে এই নৃত্যশৈলীর উদ্ভব হয়। হঠাৎ পুলকিত বনময়ূরীর নৃত্য চাপল্যের পরিচয় প্রসঙ্গে কবি বিষ্ণু দে ‘কথক’-এর প্রসঙ্গ এনেছেন।

‘কথাকলি’ হল দক্ষিণ ভারতের কেরলের নৃত্যশৈলী। পুরাণের আখ্যানকে মনে রেখে এই নৃত্যের বিষয় নির্বাচন করা হয়। লুব্ধক চিতাবাঘের গমনের সঙ্গে তুলনা করতে ‘কথাকলি’-এর প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন কবি।

৪.৪ ‘সিন্ধুমুণির হরিণ-আহ্বান’ কবি কীভাবে শুনেছেন?

উত্তর: বিশ শতকের অন্যতম সংবেদনশীল কবি বিষ্ণু দে প্রণীত ‘পরবাসী’ নামাঙ্কিত কবিতায় রামায়ণের মিথলজিকে তুলে ধরা হয়েছে। রাজা দশরথ হরিণ ভেবে অন্ধমুনির পুত্র সিন্ধুকে শরাঘাত করেছিলেন। এর ফলে সিন্ধুমুনির মৃত্যু হয় এবং দশরথও অধমুনির অভিশাপে পরবর্তীকালে তাঁর প্রিয় পুত্র শ্রীরামচন্দ্রকে হারিয়ে অকালে প্রাণত্যাগ করেন।

সিন্ধুমুনি না জেনেই মৃত্যুকে আহ্বান করেছিলেন। কবি বিষ্ণু দে-র মনে হয়েছে সিন্ধুমুনির মতো জলপানের শব্দে হিংস্র চিতাবাঘকে আহ্বান করেছে সরল, নিষ্পাপ হরিণ। এর ফলে অজান্তেই সে নিজের মৃত্যুকে ডেকে এনেছে। 

৪.৫ ‘ময়ূর মরেছে পণ্যে’ এই কথার অন্তর্নিহিত অর্থ কী?

উত্তর: বিশ শতকের অন্যতম সংবেদনশীল কবি বিষ্ণু দে প্রণীত ‘পরবাসী’ নামাঙ্কিত কবিতায় কবি মানুষের অফুরান লোভ-লালসা-জিঘাংসার পরিচয় দিয়েছেন। ময়ূরের সৌন্দর্য অপূর্ব। তাকে দেখলে মায়া হয়, ভালো লাগার এক অনুভূতি মনের মধ্যে জন্ম নেয়। অথচ সেই সৌন্দর্যের প্রতীক ময়ূরকে মানুষ অবলীলায় হত্যা করে, পণ্যের মতো বিক্রি করা হচ্ছে। এখানে ময়ূরকে ব্যবসায়িক পণ্যে পরিণত করায় ব্যথিত কবি এই মন্তব্য করেছেন।A৩.১ পথ কীসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে?

উত্তর: রবীন্দ্র পরবর্তী কবি বিষ্ণু দে প্রণীত ‘পরবাসী’ নামাঙ্কিত কবিতায় পথ বনের মধ্যে এঁকেবেঁকে ‘প্রকৃতির তালে-তালে’ মিলিয়ে চলে।

৩.২ চিতার চলে যাওয়ার ছন্দটি কেমন?

উত্তর : রবীন্দ্র পরবর্তী অত্যন্ত খ্যাতিমান কবি বিষ্ণু দে প্রণীত ‘পরবাসী’ নামাঙ্কিত কবিতায় বন্য-হিংস্র চিতার চলে যাওয়ার ছন্দে তার লুব্ধতা ও ভয়ংকর হিংস্রতা ধরা পড়ে।

৩.৩ ময়ূর কীভাবে মারা গেছে?

উত্তর: রবীন্দ্র পরবর্তী অত্যন্ত খ্যাতিমান কবি বিষ্ণু দে প্রণীত ‘পরবাসী’ নামাঙ্কিত কবিতায় ময়ূরের মৃত্যুর নেপথ্য কারণ অন্বেষণে মানুষের অপরিমেয় লোভ-লালসা এবং অর্থ আদায়ের সংকল্পকে চিহ্নিত করা হয়েছে।

৩.৪ প্রান্তরে কার হাহাকার শোনা যাচ্ছে?

উত্তর: রবীন্দ্র পরবর্তী অত্যন্ত খ্যাতিমান কবি বিষ্ণু দে প্রণীত ‘পরবাসী’ নামাঙ্কিত কবিতায় ধূসর, ঊষর, নির্জন প্রান্তরে ‘শুকনো হাওয়ার হাহাকার’ শোনা যায়।

৩.৫ পলাশের ঝোপে কবি কী দেখেছেন?

উত্তর: রবীন্দ্র পরবর্তী অত্যন্ত খ্যাতিমান কবি বিষ্ণু দে প্রণীত ‘পরবাসী’ নামাঙ্কিত কবিতায় কবি নিটোল টিলার পাশে লাল পলাশের ঝোপে বন্য ময়ূরকে অপূর্ব ছন্দে নৃত্য করতে দেখেছেন।

৪. নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর কয়েকটি বাক্যে লেখো:

৪.১ জঙ্গলের কোন্ কোন্ প্রাণীর কথা কবি এই কবিতায় বলেছেন?

উত্তর: বিশ শতকের অন্যতম সংবেদনশীল কবি বিষ্ণু দে প্রণীত ‘পরবাসী’ নামাঙ্কিত কবিতায় কচি খরগোশ, বন ময়ূর, হরিণ ও হিংস্র চিতার কথা উল্লিখিত হয়েছে। এই প্রাণীরা একসময় আরণ্যক প্রান্তরে স্বাধীনভাবে বিচরণ করত।

৪.২ সেতারের বিশেষণ হিসেবে কবি ‘সোনালি’ শব্দের ব্যবহার করেছেন কেন?

উত্তর: বিশ শতকের অন্যতম সংবেদনশীল কবি বিষ্ণু দে প্রণীত ‘পরবাসী’ নামাঙ্কিত কবিতায় কবি নদীর প্রবাহিত কুলকুল ধ্বনির সঙ্গে সেতারের মূর্ছনার তুলনা করেছেন। সূর্যের নরম আলোয় নদীর বহমান জল সোনালি আভায় ভরে উঠেছে। ময়ূর আনন্দে কথকের মতো নৃত্য করে চলেছে। ময়ূরের সেই নৃত্যের সঙ্গে নদীর প্রবাহিত ধ্বনি মিলেমিশে অপূর্ব যে সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়েছে তাকে চিহ্নিত করতে কবি বিষ্ণু দে ‘সোনালি’ শব্দটিকে সঠিক প্রয়োগ করেছেন।

৪.৩ ‘কথক’ ও ‘কথাকলি’-র কথা কবিতার মধ্যে কোন্ প্রসঙ্গে এসেছে?

উত্তর: বিশ শতকের অন্যতম সংবেদনশীল কবি বিষু দে প্রণীত ‘পরবাসী’ নামাঙ্কিত কবিতায় ‘কথক’ ও ‘কথাকলি’-এই দুটি ধ্রুপদী নৃত্যকলার উল্লেখ রয়েছে। কথক হল উত্তর ভারতের প্রসিদ্ধ ধ্রুপদী নৃত্যকলা। অষ্টাদশ শতকে এই নৃত্যশৈলীর উদ্ভব হয়। হঠাৎ পুলকিত বনময়ূরীর নৃত্য চাপল্যের পরিচয় প্রসঙ্গে কবি বিষ্ণু দে ‘কথক’-এর প্রসঙ্গ এনেছেন।

‘কথাকলি’ হল দক্ষিণ ভারতের কেরলের নৃত্যশৈলী। পুরাণের আখ্যানকে মনে রেখে এই নৃত্যের বিষয় নির্বাচন করা হয়। লুব্ধক চিতাবাঘের গমনের সঙ্গে তুলনা করতে ‘কথাকলি’-এর প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন কবি।

৪.৪ ‘সিন্ধুমুণির হরিণ-আহ্বান’ কবি কীভাবে শুনেছেন?

উত্তর: বিশ শতকের অন্যতম সংবেদনশীল কবি বিষ্ণু দে প্রণীত ‘পরবাসী’ নামাঙ্কিত কবিতায় রামায়ণের মিথলজিকে তুলে ধরা হয়েছে। রাজা দশরথ হরিণ ভেবে অন্ধমুনির পুত্র সিন্ধুকে শরাঘাত করেছিলেন। এর ফলে সিন্ধুমুনির মৃত্যু হয় এবং দশরথও অধমুনির অভিশাপে পরবর্তীকালে তাঁর প্রিয় পুত্র শ্রীরামচন্দ্রকে হারিয়ে অকালে প্রাণত্যাগ করেন।

সিন্ধুমুনি না জেনেই মৃত্যুকে আহ্বান করেছিলেন। কবি বিষ্ণু দে-র মনে হয়েছে সিন্ধুমুনির মতো জলপানের শব্দে হিংস্র চিতাবাঘকে আহ্বান করেছে সরল, নিষ্পাপ হরিণ। এর ফলে অজান্তেই সে নিজের মৃত্যুকে ডেকে এনেছে। 

৪.৫ ‘ময়ূর মরেছে পণ্যে’ এই কথার অন্তর্নিহিত অর্থ কী?

উত্তর: বিশ শতকের অন্যতম সংবেদনশীল কবি বিষ্ণু দে প্রণীত ‘পরবাসী’ নামাঙ্কিত কবিতায় কবি মানুষের অফুরান লোভ-লালসা-জিঘাংসার পরিচয় দিয়েছেন। ময়ূরের সৌন্দর্য অপূর্ব। তাকে দেখলে মায়া হয়, ভালো লাগার এক অনুভূতি মনের মধ্যে জন্ম নেয়। অথচ সেই সৌন্দর্যের প্রতীক ময়ূরকে মানুষ অবলীলায় হত্যা করে, পণ্যের মতো বিক্রি করা হচ্ছে। এখানে ময়ূরকে ব্যবসায়িক পণ্যে পরিণত করায় ব্যথিত কবি এই মন্তব্য করেছেন।

Long Question Answer

৫.১ বিরামচিহ্ন ব্যবহারের দিক থেকে কবিতাটির শেষ স্তবকের বিশিষ্টতা কোথায়? এর থেকে কবি-মানসিকতার কী পরিচয় পাওয়া যায়?

উত্তরের প্রথমাংশ: ইতিহাস ও সময়-সচেতন কবি বিষ্ণু দে প্রণীত ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘পরবাসী’ নামাঙ্কিত কবিতায় পাঁচটি স্তবকে কুড়িটি পঙক্তি রয়েছে। কবিতার শেষ স্তবকে কবি প্রত্যেকটি বাক্যের শেষে একটি করে জিজ্ঞাসা চিহ্ন রেখেছেন। ফলে চারটি প্রশ্নবোধক বাক্য তৈরি করে কবি পাঠকের সামনে সমস্যাগুলি তুলে ধরেছেন। অর্থাৎ পাঠককে তিনি ভাবাতে চেয়েছেন-কেন এদেশে পশু-পাখি-ময়ূর- খরগোশের মতো প্রাণীরা বেঁচে থাকার স্বস্তিটুকু পায় না? কেন জঙ্গল পরিষ্কার করে রাতারাতি নগরায়ণের প্রক্রিয়া শুরু হয়? কেন নিজ দেশে মানুষ পরবাসী থেকে যায়? এই স্পর্শকাতর প্রশ্নগুলি পাঠকের মনের মধ্যে জাগিয়ে রাখতে কবিতার শেষ স্তবকে বিরাম চিহ্ন ব্যবহার করেছেন।

উত্তরের দ্বিতীয়াংশ: কবি বিষ্ণু দে চেয়েছেন প্রকৃতিকে যেন লুঠেরার ভান্ডার হিসাবে আমরা না দেখি। বন্য পথ, কচি কচি খরগোশের খেলা, ময়ূরের আপন মনে নৃত্য করা, নদীর কলকল ধ্বনিতে প্রবাহিত হওয়া, হরিণের জল পান করা, লুব্ধ হিংস্র ছন্দে চিতার এগিয়ে চলা-এইসব প্রকৃতির বাস্তুতন্ত্র বা ইকো সিস্টেমকে বাঁচিয়ে রাখে। কিন্তু নিসর্গ প্রকৃতির বুকে একসময় নেমে আসে শূন্যতা ও হাহাকার। জঙ্গল সাফ হয়ে যায়। গ্রাম মরে যায়। ময়ূরের মতো প্রাণীরা পণ্যে পরিণত হয়। মানুষ কোনো প্রতিবাদ করে না। এরই প্রতিবাদে কবি লেখেন ‘পরবাসী’ কবিতাটি। প্রশ্ন রাখেন মানুষ আর কতদিন নিজ বাসভূমিতে পরবাসী হয়ে থাকবে।

৫.২ কবি নিজেকে পরবাসী বলেছেন কেন?

উত্তর: ইতিহাস ও সময়-সচেতন কবি বিষ্ণু দে প্রণীত ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘পরবাসী’ নামাঙ্কিত কবিতায় কবি দেখেছেন আরণ্যক প্রকৃতি দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। একসময় আরণ্যক প্রাণীরা স্বাধীন, স্বচ্ছন্দে জীবনযাপন করতে পারত। তখন বনের আলো-অন্ধকারের পথ ঝিকিমিকি করত। রাতের বেলা জ্বলে উঠত বন্যপ্রাণীর চোখ। ছোট্ট খরগোশের দল আপনমনে খেলে বেড়াত। কথকের ছন্দে বনময়ূর নৃত্য করে যেত। কবি লিখেছেন- 

নিটোল টিলার পলাশের ঝোপে দেখেছি

হঠাৎ পুলকে বনময়ূরের কথক

ময়ূরের নৃত্যের ছন্দে মিশে যেত নদীর চলমানতার ধ্বনি। হরিণ আসত জল খেতে। আপন মনে হেটে বেড়াত লুব্ধ হিংস্র চিতা। নাগরিক সভ্যতার যত অগ্রসর ঘটেছে ততই সবুজায়ন নষ্ট হয়েছে। বিপরীতে মরুভূমির মতো শূন্যতা, রুক্ষতা আবৃত করে রেখেছে। ফলে মানুষ এখন আর তাঁর বাসভূমিকে চিনতে পারে না। কেননা, কোথাও জঙ্গল নেই, সবুজ প্রাণের স্পন্দন নেই। গ্রাম মরে গিয়েছে। ফলে কবির চেনা স্বদেশ একেবারেই অপরিচিত হয়ে গিয়েছে।

৫.৩ ‘জঙ্গলে সাফ, গ্রাম মরে গেছে, শহরের/পত্তন নেই…’

-প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে এই পঙ্ক্তিটির প্রাসঙ্গিকতা বিচার করো।

উত্তর: ইতিহাস ও সময়-সচেতন কবি বিষ্ণু দে প্রণীত ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘পরবাসী’ নামাঙ্কিত কবিতায় কবি দেখিয়েছেন মানুষের ক্রমাগত লোভ-লালসার কারণে সবুজ ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে পশু-পাখি-কীট-পতঙ্গ সমেত যে প্রকৃতি সুন্দর, সুশৃঙ্খল একটি পরিবেশ গড়ে তুলেছিল তা মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। নগরায়ণের যত দ্রুত প্রসার হবে আরণ্যক ভূখণ্ড ততটাই বিনষ্ট হবে। মানুষ তার নিজের সুখ-সুবিধা, ভোগ-আকাঙ্ক্ষা থেকে আদিম আরণ্যক জীবনকে ধ্বংস করে চলেছে। শহর গ্রাস করে নিচ্ছে গ্রামকে। কবির মনে হয়েছে একসময় রুক্ষ প্রান্তর এসে আমাদের প্রাণের সজীবতাকে গ্রাস করবে। সুতরাং কবি বিষ্ণু দে মনে করেন এভাবে চলতে থাকলে প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্কে অবনমন ঘটবে।

৫.৪ ‘পরবাসী’ কবিতার প্রথম তিনটি স্তবক ও শেষ দুটি স্তবকের মধ্যে বক্তব্য বিষয়ের কোনো পার্থক্য থাকলে তা নিজের ভাষায় লেখো।

উত্তর: ইতিহাস ও সময়-সচেতন কবি বিষ্ণু দে প্রণীত ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘পরবাসী’ নামাঙ্কিত কবিতায় মোট পাঁচটি স্তবক রয়েছে। কিন্তু প্রথম তিনটি স্তবকে কবি আরণ্যক প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্য-মাধুর্যের পরিচয় দিয়েছেন। পরবর্তী দুটি স্তবকে কীভাবে এই আরণ্যক প্রকৃতি বিনষ্ট হতে চলেছে তার আশঙ্কা থেকে তিনি ক্রমাগত একটির পর একটি সূত্র ধরিয়ে দিয়েছেন।

কবিতার প্রথম স্তবকে দুটি বনের মাঝখান দিয়ে আরণ্যক পথের সৌন্দর্য, রাতের আলোয় জ্বলতে থাকা বন্যপ্রাণীর চোখ, ছোট্ট খরগোশের আপন মনে লাফিয়ে চলার কথা বলেছেন।

দ্বিতীয় স্তবকে এসে নিটোল টিলার পলাশের ঝোপে বনময়ূরের অপূর্ব নৃত্য দেখেছেন। দেখেছেন নদীর আপনমনে কলকল শব্দে বয়ে চলা।

তৃতীয় স্তবকে নদীর কিনারায় দাঁড়িয়ে চুপিচুপি জলপান করতে দেখেছেন হরিণকে। দূরে আপন ছন্দে চলে যায় লুব্ধ হিংস্র চিতা।

চতুর্থ স্তবকে এসে প্রকৃতির ধ্বংস হওয়ার ট্রাজেডিকে পাঠকের সামনে তুলে ধরেন। তিনি দেখেন সেই বন নেই; সেই বসতিও নেই। চারিদিকে শুধু ধূ ধূ প্রান্তর এবং শুকনো হাওয়ার হাহাকার। কবি লিখেছেন-

জঙ্গল সাফ, গ্রাম মরে গেছে, শহরের

পত্তন নেই, ময়ূর মরেছে পণ্যে

পঞ্চম স্তবকে এসে চারটি পত্তিতে পরপর প্রশ্ন চিহ্ন বসিয়ে কবি প্রথমেই জানতে চান ‘কেন এই দেশে মানুষ মৌন অসহায়?’ 

কবির মনে হয়েছে আমরা নিজবাসভূমে পরবাসী হয়ে গিয়েছি। 

৫.৫ ‘পরবাসী’ কবিতাতে কবির ভাবনা কেমন করে এগিয়েছে তা কবিতার গঠন আলোচনা করে বোঝাও।

উত্তর: ইতিহাস ও সময়-সচেতন কবি বিষ্ণু দে প্রণীত ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘পরবাসী’ নামাঙ্কিত কবিতায় পাঁচটি স্তবকে কবি তাঁর প্রকৃতি প্রেম এবং প্রকৃতি ধ্বংসের যন্ত্রণাকে ব্যক্ত করেছেন।

কবিতার প্রথম তিনটি স্তবকে কবির ভাবনা মূলত প্রকৃতির নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ থাকার আনন্দ থেকে অপূর্ব ভাষারূপ পেয়েছে। সেখানে বনের মধ্যে দিয়ে চলা পথ, রাতের অন্ধকারে বন্যপ্রাণীর ‘জ্বলে চোখ’, লাফিয়ে খেলতে থাকে ‘কচি-কচি খরগোশ’। পলাশের ঝোপের পাশে কবি দেখেন পুলকে নৃত্য করে চলেছে বনময়ূর। নদী চলেছে আপন ছন্দে। নদীর কিনারায় এসে দাঁড়ায় তৃয়ার্ত হরিণ। দূর থেকে দেখা যায় ‘লুব্ধ হিংস্র ছন্দে’ চলে যায় চিতা।

এই পর্যন্ত কবি প্রকৃতির অপূর্ব ছবি এঁকেছেন। কিন্তু চতুর্থ স্তবকে এসে কবি জানান, প্রকৃতি ধ্বংস হয়ে চলেছে। কবি দেখেন-

কোথায় সে বন, বসতিও কৈ বসেন,

শুধু প্রান্তর শুকনো হাওয়ার হাহাকার।

অর্থাৎ কবির চোখে ধরা পড়ে জঙ্গল সাফ হওয়ার দৃশ্য। কবি দেখেন ‘গ্রাম মরে গেছে’। চারিদিকে শূন্যতা। ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে ‘নদী গাছ পাহাড়’। কবির মনে হয় নিজবাসভূমিতে আমরা পরবাসী।

৫.৬ কবিতাটির নাম ‘পরবাসী’ দেওয়ার ক্ষেত্রে কবির কী কী চিন্তা কাজ করেছে বলে তোমার মনে হয়? তুমি কবিতাটির বিকল্প নাম দাও এবং সে নামকরণের ক্ষেত্রে তোমার যুক্তি সাজাও।

উত্তরের প্রথমাংশ: ইতিহাস ও সময়-সচেতন কবি বিষ্ণু দে প্রণীত ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘পরবাসী’ নামাঙ্কিত কবিতায় কবি নিজবাসভূমে আমরা কীভাবে পরবাসী হয়ে চলেছি সেই বিষয়টি মনে রেখে এই কবিতার এমন তাৎপর্যপূর্ণ নামকরণটি করেছেন।

সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি হারিয়েছে তার সৌন্দর্য, তার স্বাধীনতা। অথচ একসময় চারিদিকে বিস্তীর্ণ ছিল তপোবনের মতো আরণ্যক জীবন-সংস্কৃতি। তখন প্রকৃতির বুকে অসংখ্য গাছপালা, বন্যপ্রাণী, পাখ-পাখালি ছিল। আনন্দে খেলে বেড়াত খরগোশ। নৃত্য করত পুলকিত বনময়ূর। নদীর জল কলকল শব্দে এগিয়ে চলত। নদীর ধারে দেখা যেত তৃষ্ণার্ত হরিণের জল খাওয়া। দূরে ‘লুব্ধ হিংস্র ছন্দে’ যেতে দেখা যেত চিতাকে। কিন্তু প্রকৃতির সেই আনন্দময় দিনগুলি এখন হাহাকারে পরিণত হয়েছে। নির্বিচারে বৃক্ষছেদন, ময়ূরের মতো নিরীহ প্রাণীদের পণ্যে পরিণত করা ইত্যাদি প্রক্রিয়াগুলি অব্যাহত রয়েছে। মানুষ যেন ‘নিজবাসভূমে পরবাসী’। এই বিষয়কে মাথায় রেখে কবিতার নাম ‘পরবাসী’ যুক্তিসংগত বলেই মনে হয়।

উত্তরের দ্বিতীয়াংশ: কবিতাটির বিকল্প নাম যদি দিতেই হয়, তবে আমি নাম রাখব ‘সভ্যতার সংকট’। কবি যে সময়কে হারিয়ে ফেলেছেন সেই সময়ের আরণ্যক জীবন ও সংস্কৃতি তপোবনের মতো সুন্দর ও প্রাণময় ছিল। কিন্তু নগর সভ্যতা যত এগিয়েছে ততই অরণ্য মরুপ্রান্তর হওয়ার পথে এগিয়ে চলেছে। ফলে আমরা এমন এক সভ্যতার সংকটে দাঁড়িয়ে আছি যেখান থেকে আমাদের মুক্তির পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই আমি এই কবিতার বিকল্প নাম হিসাবে ‘সভ্যতার সংকট’কেই গ্রহণ করব।

৬. টীকা লেখো:

কথক, সেতার, কথাকলি, সিন্ধুমুনি, পণ্য

উত্তর :

কথক- ঐতিহ্যসচেতন কবি বিষ্ণু দে প্রণীত ‘পরবাসী’ কবিতার দ্বিতীয় স্তবকের দ্বিতীয় চরণে কথকের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে। এই নৃত্য একধরনের উচ্চাঙ্গ শাস্ত্রীয় নৃত্য। উচ্চারিত শ্লোক বা বোলের সঙ্গে এই নৃত্যশৈলীর গভীর সম্পর্ক। ভারতনাট্যমের মতো। এই নৃত্যের তিনটি অঙ্গ রয়েছে। যথা-

ক। বিশুদ্ধ ছন্দভিত্তিক নৃত্য

খ। রসপ্রকাশের উপযোগী নৃত্য

গ। অভিনয় সমৃদ্ধ নৃত্য

কখনও বিশেষ আয়োজিত জলসায়; কখনও বা থিয়েটারে, কখনোও বা সিনেমায় বিশেষ কোনো নৃত্যের প্রয়োজনে কথকের প্রচলন দেখা যায়। উচ্চারিত বোলের সঙ্গে এই নৃত্য পরিবেশিত হয় বলে এই নৃত্যশৈলীর নাম হয়েছে কথক। অসাধারণ পায়ের কাজ বাঁচিয়ে রাখে এই নৃত্যের প্রাণময়তাকে। ‘পরবাসী’ কবিতায় ময়ূরের নৃত্য প্রসঙ্গে ‘কথক’ নৃত্যের উপমাটি যথার্থেই গ্রহণ করেছেন বিষ্ণু দে।

সেতার- তিনটি প্রধান তারের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ‘সেতার’ শব্দের নামকরণটি অসাধারণ। সেতার যন্ত্রটি গোড়ার দিক গোলাকার ও ফাঁপা থাকে। বীণা যন্ত্রের মতো এর গঠন। ওস্তাদ বিলায়েত খাঁ, পণ্ডিত রবিশংকর প্রমুখ হলেন ভুবনবিজয়ী সেতার শিল্পী। উত্তর এশিয়া থেকে উত্তর ভারতে প্রথম সেতারের প্রচলন হয়েছিল। ‘পরবাসী’ কবিতায় কবি বিষ্ণু দে নদীর কলধ্বনি প্রসঙ্গে ‘সেতার’ শব্দটি গ্রহণ করেছেন।

কথাকলি- ভারতীর ক্লাসিক নৃত্যগুলির মধ্যে দক্ষিণ ভারতের কেরলের শাস্ত্রীয় নৃত্য হল কথাকলি। কথা অর্থাৎ কাহিনি যখন একটি নৃত্যের মাধ্যম হয়ে ওঠে তখনই তা বিশেষ আঙ্গিক লাভ করে। এই নৃত্যের বিষয়বস্তু গ্রহণ করা হয় রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণের আখ্যানকে অবলম্বন করে। এই নৃত্যের সঙ্গে মাদল, করতাল, চান্ডা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হয়। এটি পুরুষ-প্রধান নৃত্য। এই নৃত্যের প্রসাধন অত্যন্ত জটিল। যারা নৃত্য পরিবেশন করেন তারা মুখোশ ব্যবহার করেন। চোখ, ভ্রু, ওষ্ঠ ও অধর সবই গাঢ় রং দিয়ে আঁকা হয়। কথাকলি নৃত্যশিল্পীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন-শঙ্করণ নাম্বুদ্রী, মাম্পুঝা মাধবপানিক্কর, কলামণ্ডল গোপী, রামান কুট্টি, নায়ার, রাবণি মেনন প্রমুখ। ‘পরবাসী’ কবিতায় লুব্ধ, হিংস্র চিতাবাঘের সঙ্গে ‘কথাকলি’ উপমাটি গ্রহণ করেছেন কবি।

সিন্ধুমুনি- ‘সিন্ধুমুনি’ নামাঙ্কিত অংশটি গৃহীত হয়েছে পুরাণ সচেতন কবি বিষ্ণু দে প্রণীত ‘পরবাসী’ কবিতা থেকে। আদি কবি বাল্মীকির ‘রামায়ণ’ গ্রন্থে সিন্ধুমুনির উল্লেখ পাওয়া যায়। অন্ধমুনির ঔরসে শূদ্রা জননীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন সিন্ধুমুনি। সরযূ নদীর তীরে এঁরা বাস করতেন। পিতৃ-মাতৃভক্ত সিন্ধু বাবা-মায়ের সেবা-যত্নে সর্বদা ব্যস্ত থাকতেন। শিকারে গিয়ে অযোধ্যার রাজা দশরথ মৃগের জল পান করার শব্দ ভেবে ‘শব্দভেদী বাণ’ নিক্ষেপ করেন।

ওই বাণে সিন্ধুমুনি মারা যান। পুত্রশোকে আচ্ছন্ন হয়ে সিন্ধুমুনির পিতা মৃত্যুর পূর্বে দশরথকে এই বলে শাপ দেন যে, দশরথেরও মৃত্যু হবে পুত্রশোকে। রামায়ণের অযোধ্যা কান্ডের এই আখ্যানকে মনে রেখে  হরিণের জল পানের প্রসঙ্গে ‘সিন্ধুমুনি’র বিষয়কে তুলে ধরেছেন কবি।

পণ্য- শব্দ সচেতন কবি বিষ্ণু দে প্রণীত ‘পরবাসী’ নামাঙ্কিত কবিতা থেকে উদ্ধৃত শব্দটি গৃহীত হয়েছে। ‘পণ্য’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল ‘বিক্রি করা’। আবার ‘পণ্য’ শব্দের অর্থে ‘ব্যবহার্য বস্তু’কেও বোঝায়। আধুনিক সভ্যতায় দ্রুত নগরায়ণ ঘটে। ফলে দেখা যায় বাজারে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। অত্যন্ত শৌখিন জিনিসপত্র যেমন বিক্রয় হয় তেমন সুলভে বিকিয়ে দেওয়া হয় সৌন্দর্যের প্রতীক ময়ূরকে। অর্থাৎ মানুষের লোভ-লালসা-আকাঙ্ক্ষা এতটাই সীমাতীত বিস্তার পায় যে, ময়ূরও বিকিয়ে যায়। ‘পরবাসী’ কবিতায় ময়ূরের বিক্রয় প্রসঙ্গে ‘পণ্য’ শব্দটি গ্রহণ করা হয়েছে।

পথচলিত

Very Short Question Answer

১.১ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের আত্মজীবনীর নাম কী?
উত্তর: প্রসিদ্ধ ভাষাতাত্ত্বিক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের আত্মজীবনীর নাম ‘জীবনকথা’।

Short Question Answer

১.২ ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে কোন্ গ্রন্থ রচনার জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন?

উত্তর: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুখ্যাত অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘The Origin and Development of the Bengali Language’ নামের ভাষাতত্ত্ব বিষয়ক গ্রন্থ রচনার জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।

২.১ লেখকের কোন্ ট্রেন ধরার কথা ছিল?

উত্তর: লেখক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেহরা-দুন এক্সপ্রেস’ ট্রেন ধরার কথা ছিল।

২.২ একটা তৃতীয় শ্রেণির বগির কাছে একেবারেই লোকের ভিড় নেই কেন?

উত্তর: ‘পথচল্লি’ নামাঙ্কিত গল্পে একটা তৃতীয় শ্রেণির বগির কাছে একেবারেই লোকের ভিড় না থাকার কারণ হল, ট্রেনের সেই অংশটি ছিল কাবুলিওয়ালাদের দখলে।

২.৩ পাঠানদের মাতৃভাষা কী?

উত্তর: পাঠানদের মাতৃভাষা হল ‘পশতু’।

২.৪ বৃদ্ধ পাঠানের ডেরা বাংলাদেশের কোথায় ছিল?

উত্তর: বৃদ্ধ পাঠানের ডেরা ছিল বাংলাদেশের বরিশাল অঞ্চলের পটুয়াখালি বন্দরে।

২.৫ খুশ-হাল খাঁ খট্টক কে ছিলেন?

উত্তর: সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রণীত ‘পথচল্লি’ গল্পে খুশ-হাল খাঁ খট্টক ছিলেন ঔরঙ্গজেবের সমসাময়িক এবং পাঠানদের পশতু ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি।

২.৬ আদম খাঁ ও দুরথানির কিসসার কাহিনি কেমন?

উত্তর: আদম খাঁ ও দুরখানির মহব্বতের কিসসার কাহিনি হল করুণ-রসাত্মক।

২.৭ এই পাঠ্যে কোন্ বাংলা মাসিকপত্রের উল্লেখ আছে?

উত্তর: এই পাঠ্যে ‘প্রবর্তক’ নামের বাংলা মাসিকপত্রের উল্লেখ আছে। 

২.৮ রোজার উপোসের আগে কাবুলিওয়ালারা ভরপেট কী খেয়েছিলেন?

উত্তর: সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রণীত ‘পথচল্লি’ গল্পে রোজার উপোসের আগে কাবুলিওয়ালারা বড়ো বড়ো পাঠান ‘রোটা’ আর কাবাব ভরপেট খেয়েছিলেন।

২.৯ ‘তসবিহ’ শব্দের অর্থ কী?

উত্তর: ‘তসবিহ’ শব্দের অর্থ ‘জপমালা’ (মুসলমানদের ক্ষেত্রে)।

২.১০ আরবি ভাষায় ঈশ্বরের নিরানব্বইটি পবিত্র ও সুন্দর নামকে কী বলা হয়?

উত্তর: আরবি ভাষায় ঈশ্বরের নিরানব্বইটি পবিত্র ও সুন্দর নামকে ‘নব্বদ-ও-নও অসমা-ই-হাসানা’ বলা হয়।

৩. নিম্নলিখিত শব্দগুলির সন্ধি বিচ্ছেদ করো : হুংকার, স্বস্তি, বিষয়ান্তর।

উত্তর: হুংকার: হুম্ + কার, স্বস্তি: সু+ অস্তি, বিষয়ান্তর: বিষয় + অন্তর।

৪. নিম্নলিখিত শব্দগুলির প্রকৃতি-প্রত্যয় নির্ণয় করো: ফিরতি, আভিজাত্য, জবরদস্ত, নিবিষ্ট, উৎসাহিত।

উত্তর: ফিরতি: ফির্ + তি, আভিজাত্য অভিজাত + য, জবরদস্ত: জবর + দস্ত, নিবিষ্ট: নি-বিশ্ + ত, উৎসাহিত : উৎসাহ + হিন্ + ত।

Long Question Answer

  1. কাবুলিওয়ালা, পশতু, ফারসি, আফগানিস্তান, বরিশাল, গজল, উর্দু, নমাজ।

উত্তর: কাবুলিওয়ালা- সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রণীত ‘পথচল্লি’ গল্প থেকে কাবুলিওয়ালা প্রসঙ্গটি সংকলিত হয়েছে। পাঠ্যাংশে দেহরা-দুন এক্সপ্রেসের একটি কামরায় ষোলোজন কাবুলিওয়ালার প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে।

আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের অধিবাসী পুরুষদের কাবুলিওয়ালা বলা হয়। এদের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন-

(ক) এরা প্রচণ্ড পরিশ্রমী। (খ) জাতিতে এরা পাঠান। (গ) রুক্ষ ও পার্বত্য অঞ্চলের, কখনও মরু অঞ্চলের অধিবাসী হওয়ায় এরা অত্যন্ত কষ্টসহিষ্ণু। (ঘ) সাধারণত আফগানিস্তানের রপ্তানিযোগ্য দ্রব্য, বিশেষ করে কিশমিশ, আখরোট, কাজুবাদাম, পেস্তা বিক্রি করে। কাবুলিওয়ালাদের মাতৃভাষা ‘পশতু’। আফগানিস্তানের সরকারি ভাষা ফারসি এরা বোঝে না। দেশ-বিদেশে ব্যাবসাবাণিজ্য করে বেড়ানোই এদের কাজ।

 পশতুঃ ভাষাতাত্ত্বিক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রণীত ‘পথচল্লি’ নামাঙ্কিত গল্পে ‘পশতু’ হল কাবুলিওয়ালা পাঠানদের মাতৃভাষা। তাদের সঙ্গে লেখকের বাবিনিময় প্রসঙ্গে ‘পশতু’র প্রসঙ্গ এসেছে। গয়া থেকে প্রত্যাবর্তনের পথে প্রচণ্ড ভিড় থেকে বাঁচার জন্যে লেখক সুনীতিকুমার কোনোরকমের কাবুলিওয়ালাদের দখলে থাকা একটি কামরায় উঠে পড়েন। এই কাবুলিওয়ালারা স্বভাবতই অন্যভাষিকে তাদের কাছে আসতে দিতে চায়নি। তারা ‘পশতু’ ভাষায় কথা বলায় লেখক তা বুঝে উঠতে পারেনি। উর্দু, আরবি ও ফারসি ভাষায় যথেষ্ট দখল ছিলেন। ফারসির মতো শিক্ষিতজনের ভাষা জানার ফলে কাবুলিওয়ালারা লেখককে যথেষ্ট সম্মান দিয়েছিলেন।

বলাবাহুল্য আফগানিস্তানের দক্ষিণ-পূর্ব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ছাড়াও বেলুচিস্তানের কিছু মানুষজন ‘পশতু’ ভাষায় কথা বলেন। সবমিলিয়ে প্রায় চল্লিশ লক্ষ মানুষ এ ভাষা জানেন। ইন্দো-ইরানীয় শাখার একটি অংশ থেকে উদ্ভুত হল এই ‘পশতু’ উপভাষা। পশতু ভাষার বিখ্যাত কবি হলেন খুশ-হাল খাঁ খট্টক। পশতু ভাষাতে বহু লৌকিক কাহিনি প্রচলিত রয়েছে। এমন একটি কাহিনি হল ‘আদম খাঁ ও দুরথানির কিসসা’।

ফারসি- সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রণীত ‘পথচল্লি’ গল্পে ফারসি ভাষার প্রসঙ্গ এসেছে। ট্রেনের কামরা জুড়ে থাকা কাবুলিওয়ালাদের সঙ্গে আলাপ জমানোর অভিপ্রায় সুনীতিকুমার ফারসি ভাষা ব্যবহার করেন। 

ফারসি মূলত পারস্য উপসাগরীয় পাঠানজাতির ভাষা। আফগানিস্তানের শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত ও শিষ্ট সমাজের মানুষজন এই ভাষায় বাবিনিময় করেন। এই ভাষা আফগানিস্তানের সরকারি ভাষাও বটে।

ফারসি ভাষার তিনটি বিবর্তন দেখা যায়। যথা-

(১) প্রাচীন ফারসি। (২) মধ্য ফারসি। (৩) আধুনিক ফারসি। আধুনিক ফারসি ভাষায় প্রচুর রুশ ও ফরাসি শব্দের উপস্থিতি দেখা যায়। সাহিত্যের ভাষা হিসাবে ফারসি ভাষার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।

আফগানিস্তান- সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রণীত ‘পথচলি’ গল্পে ফারসি ভাষা ও কাবুলিওয়ালাদের ভাষা ‘পশতু’র প্রসঙ্গে আফগানিস্তানের উল্লেখ রয়েছে।

আফগানিস্তান সম্পর্কে যে তথ্যগুলি জানা যায় তা হল এমন-

(ক) মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটির আয়তন ৬৮৭৫০০ বর্গ কিমি.। (খ) এর লোকসংখ্যা প্রায় ২ কোটি ১০ লক্ষ। (গ) এর রাজধানী কাবুল। (ঘ) অধিবাসীদের মধ্যে পাঠান, তাজিক, হাজরা, উজবেক প্রমুখ রয়েছে। (ঙ) আফগানিস্তানের অধিকাংশ ভূমি পর্বতসংকুল, অনুর্বর ও কৃষিকাজের অনুপযোগী।

প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা, লবণ, তামা ইত্যাদি হল আফগানিস্তানের আয়ের উৎস। পেস্তা, কাজুবাদাম, কিশমিশ, আখরোটের মতো শুকনো ফল রপ্তানিতে আফগানিস্তান বিখ্যাত।

বরিশাল- সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রণীত ‘পথচল্লি’ গল্পে ‘বরিশাল’ কথাটি জনৈক কাবুলিওয়ালার ব্যাবসাকেন্দ্র ও বাসস্থান প্রসঙ্গে এসেছে।

বরিশাল সম্পর্কে যা জানা যায় তা হল এমন-

(ক) বর্তমান বাংলাদেশের নদীবহুল অঞ্চল বরিশালের আয়তন ৯৭৯৮ বর্গ কিমি.। (খ) এই জেলার উল্লেখযোগ্য নদী হল-মেঘনাদ, বালেশ্বর, হরিণঘাটা। (গ) প্রচুর পরিমাণে শস্য উৎপাদন হওয়ার কারণে এই জেলাকে বলা হয় ‘পূর্ববঙ্গের শস্যাগার’। (ঘ) সুপারি, নারকেল, ঝিনুক প্রভৃতি হল এই জেলার প্রধান রপ্তানি দ্রব্য।

বরিশালের বিখ্যাত দু’জন কবি হলেন-‘পদ্মাপুরাণ’-এর রচয়িতা বিজয় গুপ্ত ও ‘রূপসী বাংলা’র রচয়িতা জীবনানন্দ দাশ।

 গজল- সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রণীত ‘পথচল্লি’ গল্পে পাঠানদের ‘পশতু’ ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি খুশ-হাল খাঁ খট্টকের কথাপ্রসঙ্গে ‘গজল’-এর উল্লেখ হয়েছে।

‘গজল’ হল আরবি শব্দ। এর অর্থ হল ‘প্রেমসংগীত’। পারস্য দেশে এই প্রেমসংগীতের উদ্ভব হয়েছিল। গজলের মধ্যে দুটি ভাব দেখা যায়। একটি আধ্যাত্মিক ভাব, অন্যটি নরনারীর প্রেমের গভীর ব্যঞ্জনা। গজল মূলত উর্দু ভাষায় রচিত হয়। বহুরাগের আভাষ পাওয়া গেলেও গজল কখনই শাস্ত্রীয় সংগীত নয়।

গজল আসলে কয়েকটি ‘শের’-এর সমন্বয়ে গঠিত। প্রতিটি শের গভীর ব্যঞ্জনাকে উপস্থাপন করে। সাধারণত এই শেরগুলি বিজোড় সংখ্যায় হয়ে থাকে। অত্যন্ত ছোটো অবয়বে তৈরি হলেও গজল যে কোনো মানুষের মনকে মুগ্ধ করার পক্ষে যথেষ্ট।

উর্দু- সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রণীত ‘পথচল্লি’ গল্পে লেখকের থার্ড ক্লাসে চলার প্রসঙ্গে ‘উর্দু’-এর প্রসঙ্গটি উত্থাপিত হয়েছে।

উর্দু হল আফগানিস্তানের একটি ভাষা। তুর্কি শব্দ ‘ওদু’ থেকে এসেছে উর্দু কথাটি। ‘উর্দু’ শব্দটির অর্থ অবশ্য অদ্ভুত-শিবির বা ক্যাম্প। এই ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাপরিবারের অন্তর্ভুক্ত ইন্দো-ইরানীয় আর্যশাখার একটি ভাষা। সারা পৃথিবীতে প্রায় ৬ কোটি মানুষের মাতৃভাষা হল উর্দু।

দেহরা-দুন এক্সপ্রেসে কাবুলিওয়ালাদের সঙ্গে গয়া থেকে কলকাতায় ফিরছিলেন লেখক। সেইসময় সামনের দুই সহযাত্রী পশতু ভাষায় নিজেদের মধ্যে ভাববিনিময় করছিলেন। সুনীতিকুমারের পশতু ভাষা জানা ছিল না। কিন্তু পশতুর মধ্যে প্রচুর আরবি ও ফারসি শব্দ ছিল। তিনি উর্দু ভাষা জানতেন বলে তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। সহযাত্রী অনুভব করেছিলেন, লেখক বেশ বিদ্বান ও বহুভাষা জ্ঞানী বিচক্ষণ ব্যক্তি।

নমাজ- সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রণীত ‘পথচলি’ নামাঙ্কিত গল্পে ভোরবেলায় ফজরের নমাজ পড়ার প্রসঙ্গ এসেছে। 

নমাজ হল ইসলাম ধর্মের কোরান নির্দেশিত উপাসনা পদ্ধতি। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত মোট পাঁচবার নমাজ পড়েন। পাঁচবার নমাজ পড়বার যে রীতি তার ভিন্ন ভিন্ন নামও প্রচলিত রয়েছে। যথা-

(১) ফজর, (২) জোহর, (৩) আশর, (৪) মাগরির, (৫) এষা

নমাজের এই বিভাগকে বলা হয় ‘রাকাত’। ভোরবেলায় যে নমাজ পড়া হয় তাকে বলা ফজরের নমাজ। এই নমাজ পড়ার মাধ্যমে আল্লার নৈকট্য লাভ করা যায় বলে মুসলিম সমাজ বিশ্বাস করেন।

৮. নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর কয়েকটি বাক্যে লেখো:

৮.১ স্টেশনে পৌঁছে লেখক কী দেখেছিলেন?

উত্তর: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রণীত ‘পথচল্লি’ গল্পে লেখকের গয়াস্থিত শ্বশুরবাড়ি থেকে কলকাতায় প্রত্যাবর্তনের এক অসাধারণ বর্ণনা রয়েছে। 

দেহরা-দুন এক্সপ্রেস ধরার জন্যে স্টেশনে পৌঁছে লেখক দেখেন গাড়িতে সেদিন অসম্ভব ভিড়। মধ্যমশ্রেণির কোনো কামরায় তিল ধারণের জায়গা পর্যন্ত নেই। দ্বিতীয় শ্রেণির গাড়িগুলিতেই লোকে মেঝেতে বিছানা নিয়ে, কোথাও বা বসে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। অথচ তৃতীয় শ্রেণির একটা বড়ো ‘বগি’র কাছে একেবারেই লোকের ভিড় নেই। লেখক এগিয়ে গিয়ে দেখেন ‘এই বিরাট গাড়িখানি গুটিকতক কাবুলিওয়ালার দখলে।’ কেউ সেদিকে গেলে বা জানলা দিয়ে উঁকি দিলে তারা হুংকার ছেড়ে জানান, ‘ইয়ে গাড়ে তোমারা ওয়াস্তে নেহি-জো তুম উদর।’ জবরদস্ত চেহারার সেই কাবুলিওয়ালাদের ভয়ে রেলের কর্মচারি, এমনকি পুলিশ পর্যন্ত তাদের ত্রি-সীমানাতে যাচ্ছে না।

৮.২ দু-চারটি ফারসি কথা বলতে পারার ক্ষমতা লেখককে কী রকম সাহস দিয়েছিল?

উত্তর: প্রখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রণীত ‘পথচল্লি’ গল্পে লেখক জানিয়েছেন ‘আমি দু-চারটি ফারসি কথা বলতে পারি।’ লেখকের ফারসি ভাষায় যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি থাকায় সেই কাবুলিওয়ালাদের ভিড়ে ঠাসা কামরায় ওঠা এবং তাঁর নিজের জায়গাটি করে নেওয়া সহজ হয়েছিল।

লেখক বুঝতে পেরেছিলেন কাবুলিওয়ালা পাঠান হলেও শিক্ষিতজনের ভাষা, উচ্চ ও ভদ্রসমাজের ভাষা, সরকারি ভাষা-ফারসি জানে না। তাদের মাতৃভাষা হল পশতু। যদিও কাবুলিওয়ালা পাঠানদের এই মাতৃভাষার সম্মান তখনও ছিল না। লেখকের মনে হয়েছিল এদের মধ্যে ফারসি বলাটা একটা শিক্ষা ও আভিজাত্যের প্রকাশ তাই। তিনি ফারসি দু-একটি কথা বলবেন। বাঙালি হয়ে চমৎকার ফারসি ভাষায় কথা বলবার ফলে লেখককে দেখে কাবুলিওয়ালারা অবাক হয়েছিল। তারা যথাযোগ্য সম্মানের সঙ্গে লেখককে বসবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ফারসি ভাষা জানার ফলে এবং পাঠানদের সাহিত্য সংস্কৃতির অজানা বহু তথ্য প্রকাশ করবার ফলে কাবুলিওয়ালাদের সঙ্গে একই কামরায় উঠে সানন্দে বাড়ি ফিরতে পেরেছিলেন।

৮.৩ ‘আলেম’ শব্দের মানে কী? লেখককে কারা, কেন ‘এক মস্ত আলেম’ ভেবেছিলেন?

উত্তরের প্রথমাংশ: বহুভাষাবিদ মনীষী অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রণীত ‘পথচল্লি’ গল্পে ‘আলেম’ শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়। এর অর্থ হল ‘সর্বজ্ঞ পণ্ডিত ব্যক্তি’।

উত্তরের দ্বিতীয়াংশঃ লেখককে ‘আলেম’ শব্দে চিহ্নিত করেছিলেন দেহরা-দুন এক্সপ্রেসের তৃতীয় শ্রেণির কামরায় থাকা কাবুলিওয়ালারা। বাঙালি হয়েও লেখক রীতিমতো ফারসি ভাষায় বাক্যালাপ করতে পারতেন। একজন বাঙালির পক্ষে এই পান্ডিত্য অর্জন করা কী করে সম্ভব তা ভেবে অভিভূত হয়েছিল কাবুলিওয়ালারা। তারা ভেবেছিল কলকাতার এই বাঙালিবাবু দিব্যি তাদের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞানের অধিকারী। ফলে লেখককে তারা নিজেদের কাছে বসার ব্যবস্থা করে দেয়। এমনকি দিব্যি লেখকের সঙ্গে কথা বলেন। লেখকের ফরাসি ভাষা জানার কারণেই লেখককে তারা ‘এক মস্ত আলেম’ ভেবে নিয়েছিল।

৮.৪ আগা-সাহেব সম্বন্ধে যা জানা গেল, সংক্ষেপে লেখো।

উত্তর: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রণীত ‘পথচল্লি’ গল্পে ‘আগা-সাহেব’-এর প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে।

সুনীতিকুমার শ্বশুরবাড়ি থেকে কলকাতায় ফেরার পথে দেহরা-দুন এক্সপ্রেসের তৃতীয় শ্রেণির একটি কামরায় ওঠেন। সেখানে বৃদ্ধ আগা সাহেবের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। আগা সাহেব জাতিতে ছিলেন পাঠান। কিন্তু বাঙালির আদব-কায়দা এমনকি ভাষা ও সংস্কৃতিও তিনি ভালোভাবে রপ্ত করেছিলেন। আসলে বাংলাদেশের বরিশাল অঞ্চলের পাটুয়াখালিতে তার নিজস্ব একটি আস্তানা আছে। সেখানে তিনি শীতের জামাকাপড় ও হিংয়ের ব্যাবসা করেন। প্রয়োজনে কৃষকদের টাকা ধারও দেন। এর ফলে দীর্ঘদিন বরিশালে থাকায় বাঙাল ভাষা ও বাঙ্গালি উপভাষা তাঁর রপ্ত হয়েছে। অবশ্য তিনি কলকাতার রাঢ়ি ভাষায় ততখানি অভ্যস্ত নন। ধর্মপ্রাণ আগা সাহেব ভোরে উঠেই ‘তসবিহ’ বা ‘মালা জপ’ করেন।

৮.৫ লেখকের সামনের বেঞ্চির দুই পাঠান সহযাত্রী নিজেদের মধ্যে যে আলোচনা করছিলেন তা নিজের ভাষায় লেখো। লেখক কীভাবে সেই কথার অর্থ বুঝতে পারলেন?

উত্তরের প্রথমাংশ: প্রখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রণীত ‘পথচন্তি’ গল্পে দেখা যায় গয়া থেকে কলকাতায় ফেরার পথে তিনি কাবুলিওয়ালাদের কামরায় উঠেছিলেন। যোলোজন পাঠান কাবুলিওয়ালার দখলে থাকা সেই কামরায় উঠে তিনি তাঁর পাণ্ডিত্য, বুদ্ধিমত্তা ও বহুভাষা জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছিলেন। লেখক তাঁর সামনের বেঞ্চে বসে থাকা দুই পাঠান সহযাত্রীর কথা থেকে বুঝেছিলেন লেখক সম্পর্কেই তারা নিজেদের মধ্যে কিছু বলছেন। যেমন-

(ক) তারা বলছিলেন লেখক অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও বিদ্বান। (খ) ইংরেজদের লেখা সব বই তিনি পড়েছেন। (গ) তিনি চমৎকার ফারসি ভাষা জানেন। (ঘ) পাঠানদের সম্পর্কেও তাঁর শ্রদ্ধা যথেষ্ট। (ঙ) তাদের অনেক গ্রাম্য দেহাতি ভাষাও তাঁর জানা আছে।

উত্তরের দ্বিতীয়াংশ: লেখক আঞ্চলিক ভাষা ‘পশতু’ না জানলেও দুই পাঠান সহযাত্রীর মুখের ভাষায় পেয়েছিলেন প্রচুর পরিমাণে ফারসি ও আরবি শব্দ। তিনি আরবি, ফারসি ও উর্দু-তিনটি ভাষাতেই গভীর ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। ফলে সেই জ্ঞান থেকে পাঠান সহযাত্রীদের আলাপচারিতা অনুধাবন করা তাঁর পক্ষে সহজ হয়েছিল।

৯. নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর নিজের ভাষায় লেখো:

৯.১ পাঠ্য গদ্যটির ভাবের সঙ্গে ‘পথচল্লি’- নামটি কতখানি সংগতিপূর্ণ হয়েছে, বিচার করো।

উত্তর: ‘What’s need a name?’ বলেছিলেন শেক্সপিয়ার। তবু নামের মধ্যেই রয়ে যায় বিষয়ের সংকেত।

গয়া থেকে কলকাতায় প্রত্যাবর্তনের পথে লেখক অপেক্ষাকৃত একটি ফাঁকা কামরা দেখে সেখানে উঠে পড়েন। ষোলোজন পাঠান কাবুলিওয়ালার দখলে থাকা সেই কামরায় ওঠার মুহূর্তে পাঁচ-ছয়জন গম্ভীর স্বরে হুংকার দিয়ে জানিয়েছিল- ‘কিদর আতে হোত? ইয়ে গাড়ে তুম লোগ কে ওয়াস্তে নেহি’। কিন্তু পথচল্লি জীবনে প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের বোঝাপড়া থাকা উচিত। তাই লেখক ফরাসি ভাষায় কথা বলেন এবং অনুভব করেন এদের কেউ সে ভাষার সঙ্গে পরিচিত নয়। লেখক ফারসি ভাষায় খুব সুন্দর বাবিনিময় করলে ফারসি-বলিয়ে ছোকরা জানায়, ‘ভিতরে এসো’। লেখক জানান, ‘গুরুবলে রক্ষা পেলুম’।

একটি কামরায় ষোলোজন পাঠান এবং তার মধ্যে লেখক বসে আছেন। এরা ‘পশতু’ ভাষায় কথা বলে চলেছিল। তাদের সঙ্গে অবশ্য বাংলার পল্লি অঞ্চলে, বরিশালের পাটুলিখালিতে ব্যাবসা করা এক বৃদ্ধ পাঠানের সঙ্গে লেখকের ভাববিনিময় হয়েছিল। সেই বৃদ্ধ আগা-সাহেব বরিশালের ভাষা একেবারে মাতৃভাষার মতোনই বলতে পারেন। যদিও কলকাতার ভাষা তার আয়ত্ত হয়নি। লেখক কথাপ্রসঙ্গে ‘পশতু’ ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে কথা বললে কাবুলিওয়ালারা খুব খুশি হয়। তারা লেখককে ‘এক মস্ত আলেম’ বলে চিহ্নিত করেন।

বন্ধুত্ব, পারস্পরিক বোঝাপড়া, একের সঙ্গে অন্যের ভাববিনিময়ে কতখানি মানুষকে আপন করে নেওয়া যায় তারই অসাধারণ আখ্যান হল ‘পথচল্লি’। পথ চলার নানা মুহূর্তগুলি কীভাবে লেখকের জীবনে বিশেষ অভিজ্ঞতার সঞ্চার করেছিল তারই যথাযথ বর্ণনায় এই গল্পের নামকরণ হয়েছে সংগতিপূর্ণ।

৯.২। পাঠ্য গদ্যাংশটি থেকে কথকের চরিত্রের কোন্ বৈশিষ্টগুলি তোমার চোখে ধরা পড়েছে, বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ করে লেখো। 

উত্তর: বহুভাষাবিদ মনীষী অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রণীত ‘পথচল্লি’ গল্পে কথক চরিত্রের মধ্যে বিশেষ কতকগুলি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন-

১। অসম সাহসী : ‘পথচল্ল্ভি’ গল্পের শুরুতেই লেখক জানিয়ে দেন ‘শ্বশুরালয় গয়া থেকে ফিরছি।’ কিন্তু সেদিন গাড়িতে অসম্ভব ভিড়। কোনো কামরাতেই ওঠা যাচ্ছিল না। লেখক বাধ্য হয়ে কাবুলিওয়ালাদের দখলে থাকা তৃতীয় শ্রেণির একটি ‘বগি’তে উঠে পড়েন। পাঁচ-ছয় জন গুরুগম্ভীর স্বরে হুংকার দিয়ে জানিয়েছিল-‘ইয়ে গাড়ে তুম লোগ কে ওয়াস্তে নেহি’। একথা শোনার পরেও তিনি কোনো দ্বিধা-দ্বন্দু-সংশয় না রেখে সেই কামরাতেই উঠে পড়েন। তাঁর অসম সাহসিকতার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হল কাবুলিওয়ালাদের কামরায় ওঠা।

২৷ বহুভাষাবিদ : সুনীতিকুমার ছিলেন বহুভাষাবিদ। তিনি কাবুলিওয়ালাদের সামনে নিখুঁতভাবে আফগানিস্তানের জাতীয় ভাষা ফারসিতে কথা বলছিলেন। এমনকি তাদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন-

আফগানিস্তানের কোন অঞ্চল থেকে আসছ যে ফারসিতে কথা বলবার ক্ষমতা তোমাদের নেই?

লেখকের আরবি-ফারসি-উর্দু ভাষায় অসাধারণ দক্ষতা ছিল।

৩। সংগীত প্রেমিকঃ লেখকের সংগীত প্রেমিক মনের যথাযথ পরিচয় উঠে আসে পাঠানের ‘পশতু’ ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি খুশ-হাল খাঁ খট্রকের গজল সম্পর্কিত আলোচনায়।

৪। সাহিত্য প্রেমিক: বিদেশি ভাষায় রচিত ‘আদম খাঁ-দুরথানির কিস্সা’র প্রসঙ্গে লেখকের সাহিত্য প্রেমিক মনটির পরিচয় পাওয়া যায়। 

৫। আন্তরিকতা: অদ্ভুত এক আন্তরিকতায় লেখক পাঠানদের আপন করে নিয়েছিলেন। ক্ষণেকের সহযাত্রী ভিন্নজাতির বন্ধুরা তাঁর সঙ্গ-সুখ লাভ করে ধন্য হয়েছিল।

৯.৩ কথকের সঙ্গে কাবুলিওয়ালাদের প্রারম্ভিক কথোপকথনটি সংক্ষেপে বিবৃত করো।

উত্তর: প্রখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রণীত ‘পথচলতি’ গল্পে গয়া থেকে কলকাতায় প্রত্যাবর্তনের পথে কথকের সঙ্গে কাবুলিওয়ালার প্রারম্ভিক কথোপকথনের অসাধারণ একটি আলাপচারিতা রয়েছে।

সম্ভবত ১৯২৮-এর এক শীতকালে গয়া থেকে কলকাতায় প্রত্যাবর্তনের সময় লেখক দেখেন গাড়িতে অসম্ভব ভীড়ের কারণে কোনো কামরাতে তিল ধারণের জায়গা পর্যন্ত নেই। বাধ্য হয়ে তিনি তৃতীয় শ্রেণির ‘বগি’র কাছে আসেন এবং দেখেন ‘এই বিরাটখানি গুটিকতক কাবুলিওয়ালার দখলে।’

লেখক বাধ্য হয়ে সেই কামরাতেই ওঠেন। তিনি যেহেতু দু-চারটি ফারসি কথা অনায়াসেই বলে ফেলতে পারতেন সেইহেতু তাঁর মধ্যে এই আত্মবিশ্বাস ছিল যে, পাঠানদের তিনি বোঝাতে সক্ষম হবেন। কিন্তু সেই কামরায় উঠতে গেলেই পাঁচ-ছয়জন একসঙ্গে গুরুগম্ভীর স্বরে হুংকার দিয়ে ওঠে-

ইয়ে গাড়ে তুম লোগ কে ওয়াস্তে নেহি, সির্ফ হম পঠান-লোগ ইসমে জাতে হৈঁ।

লেখক অবশ্য তাদেরকে জানান, তাকে জায়গা দেওয়া হোক, শুধু একজন মানুষের জন্য। একথাটুকু তিনি আফগানিস্তানের সরকারি ভাষা ফারসিতে বলায় তারা হতভম্ব হয়ে যায়। কিন্তু তারা ফারসি না জানায় লেখক তখন বেশ গলা চড়িয়ে বলেন-

আফগানিস্তানের কোন্ অঞ্চল থেকে আসছ যে ফারসিতে কথা বলবার ক্ষমতা নেই?

পাঠানদের মধ্যে একজন সামান্য হলেও ফারসি জানে। সে লেখককে প্রশ্ন করে যে লেখক কী চান? তারা জানতে চান ‘কুজা মী-রভী?’-অর্থাৎ লেখক কোথায় যাবেন? তদুত্তরে লেখক জানান-‘দর শহর কলকত্তা বি-রভম’। অর্থাৎ তিনি কলকাতায় যাবেন। দলের ইশারাময় ইঙ্গিত পেয়ে ফারসি-বলিয়ে ছোকরাটি লেখককে ভিতরে আসার অনুমতি দেয়।

লেখক ভিতরে প্রবেশ করেই দেখেন সেই বিরাট ‘বগি’র একটা পুরো বেঞ্চি তারা খালি করে রেখেছেন লেখকের জন্যে। রীতিমতো সমীহের ভাব ছিল লেখক সম্পর্কে। তারা ভেবেছেন, ‘যেন এক মস্ত আলেম এসেছেন।’

৯.৪ কথক কেন বলেছেন- ‘যেন এক পশতু-সাহিত্য-গোষ্ঠী বা সম্মেলন লাগিয়ে দিলুম।’- সেই সাহিত্য সম্মেলনের বর্ণনা দাও।

উত্তর: বহুভাষাবিদ মনীষী অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রণীত ‘পথচলতি’ গল্পে গয়া থেকে কলকাতায় ফেরার পথে কাবুলিওয়ালাদের দখলে থাকা তৃতীয় শ্রেণির একটি কামরায় উঠে পড়েন লেখক। আফগানিস্তানের সরকারি ভাষা ফারসিতে তাঁর দখল থাকায় তিনি কাবুলিওয়ালাদের সঙ্গী হয়ে ওঠেন। কিছুটা দূর যাওয়ার পর তিনি জানতে চান, ‘তোমরা কেউ খুশ-হাল খাঁ খট্টকের গজল জানো?’ খুশ-হাল খাঁ খট্টক হচ্ছেন সম্রাট ঔরঙ্গজেবের সময়ের বিখ্যাত একজন পশতু ভাষার কবি। লেখকের মুখে এই কবির নাম শুনে পাঠানরা ভীষণ উৎসাহিত হয়েছিল। তাদের একজন বলেছিল-

খুশ-হাল খাঁ খট্টকের গজল শুনবে? বাবু, দেখছি তুমি আমাদের সব খবর-ই জানো, আমি তোমাকে শোনাচ্ছি।

সে বেশ চড়া গলায় রীতিমতো খুশিতে গজল শোনাতে লাগল। লেখক অতি সহজ আর সরলভাবে মাঝেমধ্যে ‘বহুত খুব, বাহবা বেশ; ধন্যবাদ’ ইত্যাদি অভিবাদনসূচক প্রশস্তি করলে তারা অত্যন্ত খুশি হয়। লেখক তাদের কাছে বলেন আদম খান আর দুরখানির মহব্বতের কিস্সা কেউ জানে কিনা। তাতে পাঠানদের একজন খুব উৎসাহিত হয়ে জানায়-

এ তো দিল-ভাঙা কাহিনি। আমি তোমাকে শোনাচ্ছি।

এভাবে দেহরা-দুন এক্সপ্রেসের সেই থার্ড ক্লাস গাড়িখানিতে যেন এক পশতু-সাহিত্য-গোষ্ঠী বা সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন লেখক। 

৯.৫ ‘পথচল্লি’ রচনায় ভাষা ও সংস্কৃতির বিভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও যে সহজ বন্ধুত্ব ও উদার সমানুভূতির ছবিটি পাওয়া যায় তার স্বরূপ বিশ্লেষণ করো। বর্তমান সময়ে এই বন্ধুত্ব ও সমানুভূতির প্রাসঙ্গিকতা বুঝিয়ে দাও।

উত্তরের প্রথমাংশ: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রণীত ‘পথচলতি’ গল্পে গয়া থেকে কলকাতায় প্রত্যাবর্তনের পথে আফগানিস্তানের কাবুলিওয়ালাদের সঙ্গে গভীর হৃদ্যতার যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল তা অপূর্ব সংলাপের মধ্যে দিয়ে উপস্থাপিত হয়েছে।

বহুভাষা ও সংস্কৃতি মধ্যে সমন্বয়ের ভাব থেকেই একটি জাতি অন্য জাতির সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধনে যুক্ত হয়। অত্যন্ত ভিড়াক্রান্ত ট্রেনের থার্ড ক্লাসের কামরায় উঠে লেখক কাবুলিওয়ালাদের মন জয় করে নেন। তিনি তাদের জাতীয় ভাষা ফারসিতে ভাব বিনিময় করলে তারা উপলব্ধি করে এই মানুষটি নিঃসন্দেহে উচ্চশিক্ষিত, ভদ্র ও শিষ্ট সমাজের মানুষই হবেন। তাই প্রথমে তাকে কামরায় উঠতে নিষেধ করা হলেও পরে রীতিমতো একটি বেঞ্চ ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। লেখক ফারসি, আরবি, উর্দু-প্রতিটি ভাষায় অসম্ভব দক্ষতার অধিকারী ছিলেন বলেই তিনি খুশ-আল খাঁ খট্টকের গজল এবং আদম খান আর দুরখানির মহব্বতের কিস্সা প্রসঙ্গ অবতারণা করেন। এতে সহযাত্রী পাঠান অভিভূত হয়। তারা মনে করে তাদের মধ্যে ‘যেন এক মস্ত আলেম এসেছে’। এভাবে ‘পথচল্লি’ রচনায় ভাষা ও সংস্কৃতির বিভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও সহজ বন্ধুত্ব ও উদার সমানুভূতির ছবিটি অসাধারণভাবে উঠে এসেছে।

উত্তরের দ্বিতীয়াংশ: বন্ধুত্ব ও সমান অনুভূতি মানুষকে ভৌগোলিক দূরত্ব ভুলিয়ে মানুষকে আপন করে নেয়। আমাদের এই ভারতবর্ষ শুধু নয়, সারা বিশ্বে রয়েছে বহু বিচিত্র মানুষের সমাবেশ। আমাদের ক্ষুদ্র স্বার্থ ও সংকীর্ণ মনোভাব ত্যাগ করে যদি আমরা প্রত্যেকের সঙ্গে মিশে যেতে পারি তাহলে প্রকৃত মনুষ্যত্বের পরিচয় প্রদান করা সম্ভব। ভাষা-ধর্ম-জাতি-সংস্কৃতিগত পার্থক্য থাকলেও শুধুমাত্র আন্তরিকতা, পারস্পরিক নির্ভরতার কারণে আমরা একে অন্যের আপনজন হয়ে উঠতে পারি। রবীন্দ্রনাথের গোরা যেমন শেষপর্যন্ত বিশ্বনাগরিক হয়ে উঠেছিলেন, আমরাও সমমনোভাব ও সহানুভূতির মাধ্যমে প্রত্যেকে বিশ্বনাগরিক হয়ে উঠতে পারি।

১০. রেল ভ্রমণের সময় অচেনা মানুষের সঙ্গে তোমার বন্ধুত্বের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি রম্যরচনা লেখো তোমার লেখাটির সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ছবি আঁকো।

উত্তর: জীবন বড়ো বিচিত্র। মানুষের আচার-ব্যবহার, জীবন-সংস্কৃতিও বিচিত্র। মা-বাবার সঙ্গে শান্তিনিকেতন বসন্ত উৎসবে যাওয়ার সময় আমি ভুল করে অন্য একটি ট্রেনে উঠে বসি। মা-বাবা আমাকে দাঁড়াতে বলে খাবার কিনতে গেলে আমার আর দেরি সহ্য হয়নি। ভেবেছিলাম ট্রেনটি ছাড়তে দেরি আছে। কিন্তু হঠাৎই গাড়ি হর্ন বাজিয়ে দৌড়াতে শুরু করলে আমি বিপদে পড়ে যাই। অতি দ্রুত নামতে গিয়ে দেখি ট্রেন তখন আমার থেকে আরও দ্রুত দৌড়ে চলেছে। আমি নামতে গেলে এক পাঞ্জাবি ভদ্রলোক আমাকে বাধা দেন। আমি কেঁদে ফেলি। দূর থেকে আমার বাবা-মাকে আমি দেখতে পেয়ে চিৎকার করি। তারা আমার চিৎকার শুনে দৌড়ে আসেন। ততক্ষণে ট্রেন স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে যায়।

পাঞ্জাবি ভদ্রলোকের সঙ্গে তাঁর পরিবার-পরিজন ছিল। তাঁরা বাড়ি ফিরছিলেন। পাঞ্জাবি ভদ্রলোকের নাম অমৃক সিং অরোরা। তিনি ভালো বাংলা বলতে পারেন। আমার কাছে সমস্ত বিবরণ শুনে তিনি আমাকে সাহস দিয়ে বললেন, ‘কোনো চিন্তা করো না। আমি তোমাকে পৌঁছে দেব তোমার বাবা-মায়ের কাছে।’ তিনি আমার বাবা-মাকে ফোন করে বললেন তারা যেন কোনো চিন্তা না করেন। তিনি কলকাতাতেই চাকরি করেন। সুতরাং ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। বরং বাবা-মা যেন শান্তিনিকেতনে তাঁদের নির্দিষ্ট হোটেলে গিয়ে ছেলের জন্যে অপেক্ষা করেন।

সেদিন রাতে নিজের সন্তানের মতো আমাকে আদর-যত্ন করেছিলেন। পরের দিন ভোরে আমাকে নিয়ে শান্তিনিকেতনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন। পাঞ্জাবি ভদ্রলোকের পত্নী আমার ব্যাগে দিয়েছিলেন নানারকম খাবার, জলের বোতল এবং একটি কাজুর প্যাকেট। আমার বাবা-মা’র হাতে আমাকে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আপনার ছেলেটি বেশ ভালো। ও চমৎকার গান করে।’ আমার মায়ের চোখে তখন জল। তিনি বললেন, ‘আপনি এত ভালো হলেন কী করে?’ এখনও রেলভ্রমণের সময় সেই অচেনা মানুষটির কথা আমার মনে পড়ে।

একটি চড়ুই পাখি

Very Short Question Answer

১.১ তারাপদ রায় কত খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন?

উত্তর : তারাপদ রায় ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।

১.২ তাঁর রচিত দুটি কাব্যগ্রন্থের নাম লেখো।

উত্তর : তারাপদ রায় রচিত দুটি কাব্যগ্রন্থের নাম হলো- ১. ‘তোমার প্রতিমা’। ২. ‘জলের মতো কবিতা’।

২. নীচের প্রশ্নগুলির একটি বাক্যে উত্তর লেখো।

২.১ কবিতার চড়ুই পাখিটিকে কোথায় বাসা বাঁধতে দেখা যায়?

উত্তর : তারাপদ রায়ের ‘একটি চড়ুই পাখি’ কবিতায় চড়ুই পাখিটিকে চারিদিকে ঘুরে ফিরে অবশেষে কবির ঘরেই বাসা বাঁধতে দেখা যায়।

২.২ চড়ুই পাখি এখান-সেখান থেকে কী সংগ্রহ করে আনে?

উত্তর: তারাপদ রায়ের ‘একটি চড়ুই পাখি’ কবিতায় চড়ুই পাখিটি এ বাড়ির খড় কুটো ও-বাড়ির ধান সংগ্রহ করে আনে।

Short Question Answer

২.৩ কবির ঘরে কোন্ কোন্ জিনিস চড়ুই পাখিটির চোখে পড়ে?

উত্তর: বিশিষ্ট কবি ও শিশুসাহিত্যিক তারাপদ রায়ের ‘একটি চড়ুই পাখি’ কবিতায় চড়ুই পাখিটি কৌতূহলী চোখে কবির ঘর, ঘরের দরজা, ‘ জানলা, টেবিলের উপর ফুলদানি, বইখাতা- এ সবই দেখে।

২.৪ ইচ্ছে হলেই চড়ুই-পাখি কোথায় চলে যেতে পারে?

উত্তর: বিশ শতকের পাঁচের দশকের কবি তারাপদ রায় রচিত ‘একটি চড়ুই পাখি’ কবিতায় চড়ুই পাখিটি ইচ্ছা হলেই এপাড়া, ওপাড়া অতিক্রম করে কখনও পালেদের বাড়ি, কখনও বা বোসেদের বাড়ি চলে যেতে পারে।

৩. নীচের প্রশ্নগুলির কয়েকটি বাক্যে উত্তর লেখো।

৩.১ চতুর চড়ুই এক ঘুরে ফিরে আমার ঘরেই বাসা বাঁধে।’-চড়ুই পাখিকে এখানে ‘চতুর’ বলা হল কেন?

উত্তর: রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলা কাব্য-কবিতার বিশিষ্ট কবি তারাপদ রায়ের ‘একটি চড়ুই পাখি’ কবিতায় দেখা যায়, কবি সংসারহীন একাকী জীবনযাপন করেছেন। তাই পড়ার অন্যান্য ঘরের তুলনায় পরিবার-পরিজনহীন কবির বাড়ি চড়ুই পাখির পক্ষে অপেক্ষাকৃত নিরুপদ্রব, নিরাপদ। চড়ুই পাখিটি বাসস্থান নির্মাণের জন্য সঠিক স্থানটিই নির্বাচন করতে সক্ষম হয়েছে; তাই কবি পাখিটিকে ‘চতুর’ বিশেষণ দ্বারা বিশেষিত করেছেন।

Long Question Answer

৩.২ কবিতায় বিধৃত চিত্রকল্পগুলি দৃষ্টান্তসহ আলোচনা করো।

উত্তর: কবি তারাপদ রায় ‘একটি চড়ুই পাখি’ কবিতায় কতকগুলি ছোটো ছোটো চিত্রকল্প বা ইমেজ রচনা করে চড়ুই পাখিটিকে পাঠকের কাছে জীবন্ত করে তুলেছেন। আর এর ফলে কবিতাটিতে এসেছে সাবলীলতা। কবিতার প্রথম দিকেই কবি চড়ুই পাখিটির আগমনবার্তা দিয়েছেন নিসর্গ প্রকৃতিচেনাকে মিশিয়ে- ‘অন্ধকার ঠোঁটে নিয়ে সন্ধ্যা ফেরে যেই সেও ফেরে’- জাগতিক নিয়মের উপর এখানে প্রাণের আরোপ করা হয়েছে। কেননা, অন্ধকার ঠোঁটে নিয়ে ফেরা সম্ভব নয়। কিন্তু পাখিটি সেই অন্ধকারকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ফেরে। সে ‘কৌতূহলী দুই চোখ মেলে অবাক দৃষ্টিতে দেখে। ‘কার্নিশে বসে চাহনিতে তাচ্ছিল্য মজার’ ভাব পাখিটির চঞ্চল চাহনিতে ধরা পড়ে। বর্ণনার গুণে পাখিটির সঙ্গে পাঠকও যেন কৌতূহলী চোখে অবাক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ঘরের আসবাব পত্রগুলির উপর। পাখির মজার ভাবনায় পাঠকও রসদ খুঁজে পায়। ‘রাত্রির নির্জন ঘরে আমি আর চড়ুই একাকী’ পংক্তিটি কবি ও পাখিটির পরিবার-পরিজনহীন একাকিত্বের বেদনাকে পাঠকহৃদয়ে সঞ্চারিত করে। অন্তরের হাহাকার পাঠক মনে বেদনার ঢেউ তোলে। চিত্রকল্পগুলি সামান্য একটি চড়ুই পাখিকে অসামান্যে পরিণত করেছে; এখানেই কবির কৃতিত্ব।

৩.৩ ‘হয়তো ভাবে…’-চড়ুই পাখি কী ভাবে বলে কবি মনে করেন?

উত্তর: কবি তারাপদ রায়ের ‘একটি চড়ুই পাখি’ কবিতায় কবি চড়ুই পাখিটির কৌতূহল ভরা অবাক দৃষ্টি দেখে মনে করেন-পাখিটি ভাবছে লোকটি অর্থাৎ পরিবার-পরিজনহীন কবি চলে গেলে বিধাতার আশীর্বাদে এই ঘর, জানলা, দরজা, টেবিলের ফুলদানি, বইখাতা সবকিছুরই অধিকারী সে-ই হবে।

৩.৪ ‘আবার কার্নিশে বসে চাহনিতে তাচ্ছিল্য মজার…’

-তাচ্ছিল্যভরা মজার চাহনিতে তাকিয়ে চড়ুই কী ভাবে?

উত্তর: তারাপদ রায়ের ‘একটি চড়ুই পাখি’ কবিতায় চড়ুই পাখিটির তাচ্ছিল্য ভরা মজার চাহনিতে তাকিয়ে ভাবে-তার নিতান্ত মায়ার শরীর বলেই সে পরিবার পরিজনহীন একাকী ছন্নছাড়া এই কবির বাজে ঘরে বাসা বেঁধেছে। ইচ্ছা হলেই এপাড়ায় অথবা ওপাড়ায় পালেদের কিংবা বোসেদের বাড়িতে চলে যেতে পারে। পাখিটির মনের বার্তা জানিয়ে কবি লিখেছেন-

ইচ্ছে হলে আজই যেতে পারি 

এপাড়ায়-ওপাড়ায় পালেদের বোসেদের বাড়ি।

এইভাব থেকে সে কার্নিশে বসে তাচ্ছিল্য-মজার চাহনিতে কবিকে নিরীক্ষণ করে।

৩.৫ ‘চড়ুই পাখিকে কেন্দ্র করে কবির ভাবনা কীভাবে আবর্তিত হয়েছে, তা কবিতা অনুসরণে আলোচনা করো।

উত্তর: কবি তারাপদ রায়ের ‘একটি চড়ুই পাখি’ কবিতায় কবি তাঁর সহবাসী চড়ুই পাখিটির কৌতূহল ভরা অবাক দৃষ্টি দেখে মনে করেছেন-চড়ুই পাখিটি হয়তো ভাবছে কবি চলে গেলে এর ঘর, জানলা, দরজা, ফুলদানি, বই-খাতার মালিক সে-ই হবে।

আবার কখনো কবি চড়ুইটির দৃষ্টিতে তাচ্ছিল্য ভরা মজার ভাবনার খোরাক পেয়েছেন। চড়ুইটি যেন ভাবছে- পরিবার-পরিজনহীন এই মানুষটির শ্রীহীন বাজে ঘরে বাসা বেঁধে সে কবির প্রতি করুণাই করেছে। মায়া কাটিয়ে যেকোনো দিনই সে এপাড়ায় কিংবা ওপাড়ায় পালেদের বা বোসেদের বাড়ি চলে যেতে পারে।

রাতের নির্জন অন্ধকার কবির চেতনায় পরিবর্তন এনেছে। অসহনীয় একাকিত্বের জ্বালা কবি চড়ুই পাখিটির সান্নিধ্যেই ভুলবার চেষ্টা করেছেন। উভয়ের একাকী জীবন যেন পরস্পরকে কিছুটা স্বস্তির রসদ জুগিয়েছে।

৩.৬ ‘তবুও যায় না চলে এতটুকু দয়া করে পাখি’- পঙ্ক্তিটিতে কবিমানসিকতার কীরূপ প্রতিফলন লক্ষ করা যায়?

উত্তর: ‘একটি চড়ুই পাখি’ কবিতায় কবি তারাপদ রায় যে চড়ুই পাখিটির কথা লিখেছেন, সেটির কথা প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় জন কিটস্-এর নাইটিঙ্গেল পাখিটির কথা। কবি এই পাখিটিকে বলেছেন ‘চতুর চড়ুই’। পরিবার-স্বজনহীন অন্ধকার ঘরে কবির একাকী বাস। চড়ুইটিও থাকে তাঁর সঙ্গে, যেন কবির একাকিত্বের সঙ্গী হয়ে। সারাক্ষণ ঘরের মধ্যে সে ‘কিচিমিচি গান’ জুড়ে দেয়। কবির মনে হয়েছে, পখিটি সবসময় ‘কৌতূহলী দুই চোখ মেলে’ কবির দিকে ‘অবাক দৃষ্টিতে দেখে’। হয়তো চড়ুইটি মনে মনে ভাবে একদিন এই ঘর তারই হবে- ‘আমাকেই দেবেন বিধাতা’।

কবি তারাপদ রায় কৌতুকের সঙ্গে বলেছেন-

ক। এই পাখিটি যেন নিতান্তই দয়া করে কবির জীর্ণ-ভগ্ন গৃহে পড়ে রয়েছে।

খ। ইচ্ছে করলেই সে পাল কিংবা বোসদের বাড়িতে স্থায়ী বাসা খুঁজে নিতে পারে।

গ। কবির নিঃসঙ্গ জীবনে সে যেন সঙ্গদানকারী স্বজন।

আসলে কবির নির্জন জীবনে চড়ুই পাখিটি যেন তাঁর একমাত্র সঙ্গী। সুতরাং কবির মনে হয়েছে, পাখিটি মনে মনে হয়তো ভাবে একপ্রকার দয়া করে এখানে সে পড়ে আছে। এখানে ‘তবুও’ শব্দটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

৩.৭ ছোট্ট চড়ুই পাখির জীবনবৃত্ত কীভাবে কবিতার ক্ষুদ্র পরিসরে আঁকা হয়েছে তার পরিচয় দাও।

উত্তর: কবি জীবনানন্দ দাশের ‘হায় চিল’ কিংবা তারও আগে কবি জন কিটস্-এঁর ছোট্ট নাইটিঙ্গেল পাখিটির কথা আমরা জেনেছি। কবি তারাপদ রায় ‘একটি চড়ুই পাখি’ কবিতায় পাখিটির একটি জীবনবৃত্ত বর্ণনা করেছেন।

কবিতার ক্ষুদ্র পরিসরে এই চড়ুই পাখি যেভাবে অবস্থান করেছে, তাতে মনে হয় কবির একাকিত্বের জীবনে সে যেন মরূদ্যানের একটুকরো শান্তির মতো আনন্দদায়ক। এই পাখিটি চারিদিক ঘুরে ফিরে কবির ঘরেই বাসা বেঁধেছে। সন্ধ্যার অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গে সে কবির এই গৃহেই ফিরে আসে। কবি লিখেছেন-

এ বাড়ির খড় কুটো, ও বাড়ির ধান

ছড়ায় শব্দের টুকরো, ঘর জুড়ে কিচিমিচি গান। পাখিটি ‘কৌতূহলী দুই চোখ মেলে’ তাকিয়ে থাকে ‘অবাক দৃষ্টিতে’। কবির মনে হয়েছে এই ঘর থেকে তিনি চলে গেলে পুরোপুরি জায়গাটা পাখির হয়ে যাবে। কখনও পাখিটির চাহনিতে ধরা পড়ে ‘তাচ্ছিল্য মজার’ ভাব। কবি লিখেছেন-

ভাবটা যেন- এই বাজে ঘরে আছি নিতান্ত মায়ার শরীর আমার তাই।

কবির মনে হয়েছে, পাখিটি যে তাঁকে পরিত্যাগ করেনি এর কারণ, সে যেন কবিকে দয়া করেছে। এভাবেই কবিতার ক্ষুদ্র পরিসরে ছোট্ট চড়ুই পাখির দৈনন্দিন জীবনবৃত্তের ছবি কবি তারাপদ রায় ফুটিয়ে তুলেছেন ‘একটি চড়ুই পাখি’ নামাঙ্কিত এই কবিতায়।

৩.৮ ‘কৌতূহলী দুই চোখ মেলে অবাক দৃষ্টিতে দেখে’-চড়ুইপাখির চোখ ‘কৌতূহলী’ কেন? তার চোখে কবির সংসারের কোন্ চালচিত্র ধরা পড়ে?

উত্তরের প্রথমাংশ: সুখ্যাত কবি ও গল্পকার তারাপদ রায় প্রণীত ‘একটি চড়ুই পাখি’ নামাঙ্কিত কবিতায় দেখা যায় কবির শান্ত, নিরাপদ ঘরের দখল নেয় একটি চতুর চড়ুই পাখি। সন্ধ্যা যখন কালো রঙের ওড়না গায়ে দিয়ে নেমে আসে তখন চড়ুই বিভিন্ন জায়গা থেকে খড়কুটো সংগ্রহ করে তার সুখের বাসায় ফিরে আসে। কখনও আনন্দে-আহ্লাদে সে কিচিমিচি শব্দে গান ধরে। কবির ঘরের বই-খাতা, ফুলদানি সব কিছুতেই অধিকার আরোপ করে।

পাখিটির কৌতূহলের কারণ, তার মনে হয় এই অনাবশ্যক মানুষটা কেন একাকী এই নির্জন ঘরে বসে থাকে। অর্থাৎ জনমানবশূন্য ঘরটিকে নিজের আশ্রয়স্থল ভেবে নিয়ে কবির কাছাকাছি এসে কৌতূহলী চোখে ভাবে, ‘এসব আমার-ই হবে।’

পাখির দৃষ্টি স্বাভাবিক। আসলে কবির কল্পনায় তা হয়ে উঠেছে কৌতূহলী। এক কারণ পাখিটি কবির কল্পনায় প্রাণবন্ত সত্তা লাভ করেছে।

উত্তরের দ্বিতীয়াংশ: কবি তারাপদ রায় তাঁর কবি কল্পনায় দেখেছেন, ‘চতুর চড়ুই’ পাখিটি কৌতূহলী দুটি চোখে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কবির ঘরের সমস্ত জিনিসপত্রের দিকে। তার চোখে ধরা পড়ে কবির সংসারের নানা চালচিত্র। যেমন-

(ক) কবির ঘর, ঘরের জানালা-দরজা। (খ) কবির টেবিলে থাকা বইপত্র। (গ) কবির টেবিলে শোভিত হওয়া ফুলদানি। এই সব জিনিস সে স্থির প্রত্যয়ে দেখে এবং সেই সঙ্গে সমস্ত কিছুর মালিকানা লাভের স্বপ্ন দেখে- ‘আমাকেই দেবেন বিধাতা’। 

৩.৯ ‘রাত্রির নির্জন ঘরে আমি আর চড়ুই একাকী।’- পঙ্ক্তিটিতে ‘একাকী’ শব্দটি প্রয়োগের সার্থকতা বুঝিয়ে দাও।

উত্তর: তারাপদ রায়ের ‘একটি চড়ুই পাখি’ কবিতায় দেখি, কবি প্রথমেই বলে নিয়েছেন- এই পাখিটি হলো ‘চতুর’। রাত্রির নির্জন ঘরে কবি যখন একাকী জীবন-যাপন করেন, তখন সেই নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্যেই পাখিটি যেন কবিকে অকৃপণ সঙ্গ দান করে। অর্থাৎ এই পাখিটি সেদিক থেকে কবির নিঃসঙ্গ জীবনে বন্ধুর মতো। আবার কবির ঘরটি চড়ুই পাখির কাছে নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের মতো। ‘একাকী’ শব্দটি এখানে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা-

(ক) কবির জীবন একাকিত্বে ভরা। (খ) পাখিটিও একাকী। (গ) রাতের নির্জনতায় তারা দুজনেই একাকিত্বের জীবন-যাপন করে। (ঘ) পাখিটি ইচ্ছা করলেও অন্যত্র যেতে পারে না। (ঙ) কবিও তাকে তাড়িয়ে দিতে পারেন না।

আসলে উভয়ের জীবন যেন একাকিত্বের নিঃসঙ্গ যাপনে কোথায় মিল আছে। ‘একাকী’ শব্দটি প্রয়োগের মাধ্যমে কবি পাঠক হৃদয়ে গভীর মর্মবেদনা ও নিঃসঙ্গতাকে সঞ্চারিত করে দিয়েছেন।

৩.১০ ‘একটি চড়ুই পাখি’ ছাড়া কবিতাটির অন্য কোনো নামকরণ করো। কেন তুমি এমন নাম দিতে চাও, তা বুঝিয়ে লেখো। 

উত্তর: নামকরণ বিষয়টি কোনো সৃষ্টিকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করে। নামকরণের মধ্যে প্রকাশ পায় কতকগুলি বিষয়। যেমন- (ক) কবির মনোভাব। (খ) কবির বিশেষ কোনো উপলব্ধি। (গ) কবির জীবন দর্শন। (ঘ) বিষয়ের সঙ্গে নামকরণের গভীর নিহিত সম্পর্ক।

‘একটি চড়ুই পাখি’ কবিতাটির নামকরণ করা যেতে পারে ‘নিঃসঙ্গের সঙ্গী’।

এমন নামকরণের কারণ কবির পরিবার-পরিজন-স্বজনহীন জীবনে একমাত্র সঙ্গী হয়ে উঠেছে চড়ুই পাখিটি। এই পাখি কবির মনের সমস্ত ভাবনার কেন্দ্রীয় বিষয় হয়েছে। পাখিটির চঞ্চলতা, খাদ্য সংগ্রহ, অর্থহীন কিচিরমিচির গান, কৌতূহলী দৃষ্টি ইত্যাদি বিষয়গুলি কবির মনে বিশেষভাবে জাগয়া করে নিয়েছে। রাতের নির্জনতায় পাখিটি হয়ে উঠেছে কবির একাকী জীবন পথের দোসর। তাই কবিতাটির নামকরণ করা যেতে পারে ‘নিঃসঙ্গের সঙ্গী’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *