WBCHSE Class 12 History Chapter 6 Solution | Bengali Medium

Class 12 History Solution

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং উপনিবেশসমূহ

1. MCQs Question Answer

1. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে ভারতের বড়োলাট লিনলিথগোর ব্রিটেনের পক্ষ অবলম্বনের প্রস্তাবের ব্যাপারে কংগ্রেস শর্ত 

(A) ২টি  ✓

(B) ৪টি

(C) ৬টি

(D) ৮টি

2. ক্লিপস মিশন ভারতে আসে-

(A) ১৯১৪ খ্রি.

(B) ১৯৪২ খ্রি. ✓

(C) ১৯৪৩ খ্রি.

(D) ১৯৪৪ খ্রি.

3. কোন্ প্রস্তাবটিকে গান্ধিজি একটি ফেলপড়া ব্যাংকের আগাম তারিখের চেকের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন?

(A)  আগস্ট প্রস্তাব 

(B) রাজাজি প্রস্তাব

(C) ক্লিপস প্রস্তাব ✓

(D) লাহোর প্রস্তাব

4. ক্লিপস প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়েছিল কোন্ রাজনৈতিক দল?

(A) হিন্দু মহাসভা

(B) র‍্যাডিক্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ✓

(C) জাতীয় কংগ্রেস

(D) মুসলিম লিগ

5. গান্ধিবুড়ি নামে পরিচিত ছিলেন-

(A) কনকলতা বড়ুয়া

(B) মাতঙ্গিনী হাজরা  ✓

(C) বাসন্তী দেবী

(D) সরোজিনী নাইডু

6.গান্ধিজির নেতৃত্বে সর্ববৃহৎ গণ আন্দোলন হল-

(A) খিলাফৎ আন্দোলন

(B) অসহযোগ আন্দোলন

(C) আইন অমান্য আন্দোলন

(D) ভারত ছাড়ো আন্দোলন ✓

7. গান্ধিজি সম্পাদিত পত্রিকাটি হল-

(A) দীনবন্ধু

(B) সমাচার দর্পন

(C) হরিজন  ✓

(D) কেশরি

৪. ভারতে গান্ধিজির প্রথম রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল-

(A) চম্পারন সত্যাগ্রহ ✓

(B) আমেদাবাদ সত্যাগ্রহ

(C) খেড়া সত্যাগ্রহ

(D) অহিংস অসহযোগ আন্দোলন

9. “করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে। “গান্ধিজির এই উক্তিটি যুক্ত ছিল-

(A) খিলাফৎ আন্দোলনে

(B) অসহযোগ আন্দোলনে

(C) আইন অমান্য আন্দোলনে

(D) ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ✓

10. “ভারতকে ঈশ্বরের হাতে ছেড়ে দাও, না হলে তাকে নৈরাজ্যের হাতে ছেড়ে চলে যাও।”এই উক্তিটি গান্ধিজি যে পত্রিকায় উল্লেখ করেন তা হল- 

(A) যুগান্তর পত্রিকায়

(B) বন্দেমাতরম্ পত্রিকা

(C) হরিজন পত্রিকা ✓

(D) স্টেটসম্যান পত্রিকা

11. ভারত ছাড়ো আন্দোলন চলাকালে মেদিনীপুরের তমলুকে বিক্ষোভ দেখানোর সময় পুলিশের গুলিতে শহিদ হন-

(A) বীণা দাস

(B) মাতঙ্গিনী হাজরা ✓

(C) শ্রীমতী অ্যানি বেসান্ত

(D) কল্পনা চৌধুরি

12. স্বরাজ দলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন-

(A) জওহরলাল নেহরু

(B) সুভাষচন্দ্র বসু

(C) চিত্তরঞ্জন দাশ ✓

(D) মুজাফ্ফর আহমেদ

13.  ত্রিপুরি কংগ্রেসের অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র বসু-র প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন-

(A) গোবিন্দ বল্লভপন্থ

(B) ক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী

(C) পট্টভি সীতারামাইয়া। ✓

 (D) জওহরলাল নেহরু

14. সরকার ও নৌবাহিনীর মধ্যে মধ্যস্থতা করেন কংগ্রেস নেতা-

(A) মহাত্মা গান্ধি

(B) জওহরলাল নেহরু

(C) মৌলানা আবুল কালাম আজাদ

(D) বল্লভভাই প্যাটেল ✓

15. “বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ চারিদিকে” গানটি রচনা করেন-

(A) নজরুল ইসলাম

(B) বিজন ভট্টাচার্য

(C) সুকান্ত ভট্টাচার্য ✓

(D) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

16. র‍্যাডিক্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হলেন-

(A) গান্ধিজি

(B) জওহরলাল নেহরু

 (C) বল্লভভাই প্যাটেল

(D) মানবেন্দ্রনাথ রায় ✓

17. “সুভাষচন্দ্র, বাঙালি কবি আমি, বাংলাদেশের হয়ে তোমাকে দেশনায়কের পদে বরণ করি।” এই উক্তিটি করেছেন-

(A) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ✓

(B) দ্বিজেন্দ্রলাল রায়

(C) অন্নদাশঙ্কর রায়

(D) উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি

18. সুভাষচন্দ্র কলকাতা থেকে পলায়ন করেন-

(A)  ১৯৪০ খ্রি. ১৭ জানুয়ারি

(B) ১৯৪০ খ্রি. ২ জুলাই

(C) ১৯৪১ খ্রি. ১৭ জানুয়ারি ✓

(D) ১৯৪১ খ্রি. ২ জুলাই

19. সুভাষচন্দ্র বার্লিনে ‘ফ্রি ইন্ডিয়া সেন্টার’ গঠন করেন-

(A) ১০ জন ভারতীয়কে নিয়ে

(B) ১৫ জন ভারতীয়কে নিয়ে

(C) ২০ জন ভারতীয়কে নিয়ে ✓

(D) ২৫ জন ভারতীয়কে নিয়ে

20. ব্রিটিশ সরকারের চোখে ধুলো দিয়ে নেতাজি দেশত্যাগ করেন-

(A)  জিয়াউদ্দিনের ছদ্মবেশে ✓

(B) মইনুদ্দিনের ছদ্মবেশে

(C) আলাউদ্দিনের ছদ্মবেশে

(D) সফিউদ্দিনের ছদ্মবেশে

21. সিঙ্গাপুরে আয়োজিত এক জনসভায় রাসবিহারী বসুর হাত থেকে সুভাষচন্দ্র আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন-

(A)  ১৯৪০ খ্রি., ২৫ আগস্ট

(B) ১৯৪১ খ্রি., ২৫ আগস্ট

(C) ১৯৪২ খ্রি., ২৫ আগস্ট

(D) ১৯৪৩ খ্রি., ২৫ আগস্ট ✓

 22. সুভাষ ব্রিগেডের প্রধান ছিলেন-

(A) সুভাষচন্দ্র বসু

(B) শাহনওয়াজ খান ✓

(C) জি. এস. ধীলন

(D) রসিদ আলি

23. নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আজাদ হিন্দ সরকার গঠন করার কথা ঘোষণা করেন-

(A)  ১৯৪১ খ্রি., ২১ অক্টোবর

(B) ১৯৪২ খ্রি., ২১ অক্টোবর

(C) ১৯৪৩ খ্রি., ২১ অক্টোবর ✓

(D) ১৯৪৪ খ্রি., ২১ অক্টোবর

24. শাহনওয়াজ খান ছিলেন-

(A)   কংগ্রেস দলের নেতা

(B) মুসলিম লিগের নেতা

(C) ভারত সরকারের একজন মন্ত্রী

(D)  আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনাপতি ✓

25. সুভাষচন্দ্র আন্দামান দ্বীপের নাম রাখেন-

(A)  স্বদেশ দ্বীপ

(B) স্বাধীনতা দ্বীপ

(C) স্বরাজ দ্বীপ

(D) শহিদ দ্বীপ ✓

26. সুভাষচন্দ্র দ্বিতীয়বারের জন্য জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হন-

(A)  ত্রিপুরি অধিবেশনে

(B) হরিপুরা অধিবেশনে ✓

(C) লাহোর অধিবেশনে

(D) কলকাতা অধিবেশনে

27. ‘রশিদ আলি দিবস’ পালিত হয়-

(A)  ২ জানুয়ারি

(B) ১২ ফ্রেব্রুয়ারি ✓

(C) ১৬ মার্চ

(D) ২২ মে

28. কোন্ স্থানে প্রথম নৌবিদ্রোহ শুরু হয়?

(A)  কলকাতা

(B) বোম্বাই ✓

(C) মাদ্রাজ

(D) লাহোর 

29.নৌবিদ্রোহ প্রথম শুরু হয়-

(A)  কাসেল ব্যারাকে

(B) কোমাগাতামার জাহাজে

(C) তলোয়ার জাহাজে ✓

(D) আমেরিকান জাহাজে

30. আজাদ হিন্দ বাহিনী সর্বপ্রথম ভারতের যে শহরটি দখল করে সেটি হল-

(A)  কোহিমা ✓

(B) ইম্ফল

(C) গৌহাটি

(D) দিসপুর

31. আজাদি সেনানায়কদের বিচার শুরু হয়-

(A)  কলকাতায়

(B) বোম্বাইতে

(C) দিল্লিতে ✓

(D) মাদ্রাজে

32. বড়োলাট ওয়াভেলের পরিকল্পনা মেনে সিমলায় আয়োজিত হয়-

(A)  প্রথম গোলটেবিল বৈঠক

(B) দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক

(C) তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠক

(D) সিমলা বৈঠক ✓

33. ভারতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ছিলেন-

(A)  জওহরলাল নেহরু ✓

(B) আবুল কালাম আজাদ

(C) মহম্মদ আলি জিন্না

(D) বল্লভভাই প্যাটেল

34. বাংলার ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যে নারী শহিদ হন-

(A)  প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার

(B) বীণা দাশ

(C) শান্তি ঘোষ

(D) মাতঙ্গিনী হাজরা ✓

35. স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল ছিলেন-

(A)  ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ

(B) রাজাগোপালাচারী ✓

(C) লর্ড মাউন্টব্যাটেন

(D) স্যার পেথিক লরেন্স

36. গণপরিষদের প্রথম স্থায়ী সভাপতি ছিলেন-

(A)  বি. আর. আম্বেদকর

(B) জওহরলাল নেহরু

(C) গান্ধিজি

(D) ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ ✓

37. গণপরিষদের মোট সদস্য সংখ্যা ছিল-

(A)  ৫৮৯

(B) ৩৮৯ ✓

(C) ১৮৯

(D) ৪৮৯

3৪. গণপরিষদ গঠন করার জন্য এক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়-

(A)  ১৯৪৩ খ্রি., জুলাই

(B) ১৯৪৪ খ্রি., জুলাই

(C) ১৯৪৫ খ্রি., জুলাই

(D) ১৯৪৬ খ্রি., জুলাই ✓

39. ভারতের স্বাধীনতা আইন পাস হয়-

(A)  ১৯৪৬-এর ৪ জুলাই

(B) ১৯৪৬-এর ১৪ আগস্ট

(C) ১৯৪৭-এর ৪ জুলাই

(D) ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট ✓

40. ভারতের বড়োলাট লিনলিখগো এক ঘোষণায় উল্লেখ করেন যে ভারত ব্রিটেনের পক্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিয়েছে, যার প্রতিক্রিয়া হিসেবে-

(A)  মুসলিম লিগ মন্ত্রীসভাগুলি থেকে পদত্যাগ করেন

(B) জাতীয় কংগ্রেস মন্ত্রীসভাগুলি থেকে পদত্যাগ করেন ✓

(C) কমিউনিস্ট দল মন্ত্রীসভায় যোগদান করেন

(D) কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলে

41. বড়োলাট লিনলিথগোর প্রস্তাব সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করা হয়-

(A)  জাতীয় কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশনে

(B) জাতীয় কংগ্রেসের লাহোর অধিবেশনে

(C) জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে

(D) জাতীয় কংগ্রেসের রামগড় অধিবেশনে ✓

42. বড়োলাট লিনলিথগোর ঘোষণার প্রতিবাদ হিসেবে গান্ধিজি-

(A)  ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহের উদ্যোগ নেন ✓

(B) অসহযোগ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেন

(C) আইন অমান্য আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেন

(D) আগস্ট আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেন

43. ক্লিপস মিশনের সদস্য স্ট্যাফোর্ড ক্লিপস ছিলেন-

(A)  ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য ✓

(B) ফরাসি মন্ত্রীসভার সদস্য

(C) জাপানি মন্ত্রীসভার সদস্য

(D) মার্কিন মন্ত্রীসভার সদস্য

44. বড়োলাট লিনলিথগোর পরে ভারতের নতুন বড়োলাট হন-

(A)  আর্চিবল্ড ওয়াভেল ✓

(B) ক্যানিং

(C) মাউন্টব্যাটেন

(D) আরউইন

45. ক্যাবিনেট মিশন বা মন্ত্রী মিশনকে ভারতে পাঠানো হয়-

(A)  ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে

(B) ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে

(C) ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ✓

(D) ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে

46. ভারতের সংবিধান রচনার লক্ষ্যে সংবিধান খসড়া রচনা করে-

(A)  ভারতীয় রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত খসড়া কমিটি ✓

(B) ইংরেজ কর্মচারীদের নিয়ে গঠিত খসড়া কমিটি

(C) ভারতে ব্রিটিশ সরকারে কর্মরত ইউরোপীয় কর্মচারীদের নিয়ে গঠিত খসড়া কমিটি

(D) ইউরোপীয় ও ভারতীয় কর্মচারীদের নিয়ে গঠিত খসড়া কমিটি

47. ভারতের লৌহমানব বলা হয়-

(A)  দাদাভাই নৌরজিকে

(B) মৌলানা আবুল কালাম আজাদকে

(C) জওহরলাল নেহরুকে

(D) সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলকে ✓

48. ভারতীয় সংবিধান কার হাতে স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রদান করেছে?

(A)  রাষ্ট্রপতি ✓

(B) প্রধানমন্ত্রী

(C) রাজ্যপাল

(D) মুখ্যমন্ত্রী

49. ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ২ সেপ্টেম্বর ভারতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়-

(A)  আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে

(B) জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে ✓

(C) সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের নেতৃত্বে

(D) বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদের নেতৃত্বে

50. অন্তর্বর্তী সরকারের মন্ত্রীসভার সদস্য ছিল-

(A)  ৮ জন

(B) ১০ জন

(C) ১২ জন ✓

(D) ১৮ জন

51. “যখনই প্রস্তাবগুলি আমি প্রথম পড়লাম, আমি ভীষণভাবে হতাশ হয়েছিলাম”- ক্লিপস প্রস্তাব প্রসঙ্গে এই বক্তব্যটি কে বলেন?

(A)  জওহরলাল নেহরু ✓

(B) বল্লভভাই প্যাটেল

(C) আবুল কালাম আজাদ

(D) মহম্মদ আলি জিন্না

52. প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের ডাক দেন-

(A)  মৌলানা আবুল কালাম আজাদ

(B) মহম্মদ আলি জিন্না ✓

(C) আগা খাঁ

(D) আবদুল রসুল

53. “দেশভাগ হল এক দৈব দুর্বিপাক।” এই উক্তিটি করেন-

(A)  মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ✓

(B) মহাত্মা গান্ধি

(C) জওহরলাল নেহরু

(D) সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল

54. ব্রিটিশ ভারতের শেষ ভাইসরয় ছিলেন-

(A)  মাউন্টব্যাটেন ✓

(B) এটলি

(C) ক্যানিং

(D) ওয়ারেন হেস্টিংস

55. মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা অনুসারে অখন্ড ভারত বিভক্ত হয় ও ভারত স্বাধীনতা পায়-

(A)  ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্ট

(B) ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট ✓

(C) ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট

(D) ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৭ আগস্ট

56. মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা অনুসারে অখণ্ড ভারত বিভক্ত হয় ও পাকিস্তান স্বাধীনতা পায়-

(A)  ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্ট ✓

(B) ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট

(C) ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট

(D) ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৭ আগস্ট

57. গণপরিষদের প্রথম সভাপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়-

(A)  ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর

(B) ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর

(C) ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর ✓

(D) ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর

58. গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে-

(A)  কলকাতায়

(B) দিল্লিতে ✓

(C) বোম্বাইতে

(D) মাদ্রাজে

59. স্বাধীন ভারতে প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন-

(A)  বল্লভভাই প্যাটেল

(B) ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ ✓

(C) মৌলানা আবুল কালাম আজাদ

(D) সর্বপল্লি রাধাকৃয়ণ

60. স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন-

(A)  জওহরলাল নেহরু ✓

(B) ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ

(C) আবুল কালাম আজাদ

(D) এস. রাধাকৃষুণ

61. ‘Discovery of India’ গ্রন্থের রচয়িতা হলেন-

(A)  জওহরলাল নেহরু ✓

(B) সুভাষচন্দ্র বসু

(C) আবুল কালাম আজাদ

(D) ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ

62. ‘দ্য স্পিরিট অব ইসলাম’ গ্রন্থটির লেখক ছিলেন-

(A)  মন্ডেস্থ

(B) চৌধুরি রহমত আলি

(C) আবুল কালাম আজাদ

(D) সৈয়দ আমির আলি ✓

63 . ‘India Wins Freedom’ নামক গ্রন্থটি রচনা করেন-

(A)  মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ✓

(B) মহাত্মা গান্ধি

(C) নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু

(D)  জওহরলাল নেহরু

64. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতের বড়োলাট ছিলেন-

(A)  লর্ড আরউইন

(B) ওয়াভেল

(C) লিনলিথগো ✓

(D) মাউন্টব্যাটেন

65. ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হয়েছিল-

(A)  ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৯ আগস্ট ✓

(B) ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ মার্চ

(C) ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৬ মে

(D) ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ সেপ্টেম্বর

66. ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে ‘অযৌক্তিক ও দায়িত্বজ্ঞানহীন’ বলে উল্লেখ করেছেন-

(A)  সুভাষচন্দ্র বসু

(B) স্ট্যাফোর্ড ক্লিপস

(C) বি. আর. আম্বেদকর ✓

(D) মাউন্টব্যাটেন

67. ‘জাগরী’ উপন্যাসের রচয়িতা হলেন-

(A)  তারাশংকর বন্দোপাধ্যায়

(B) মানিক বন্দোপাধ্যায়

(C) বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়

(D) সতীনাথ ভাদুড়ি ✓

68. তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার গড়ে ওঠে-

(A)  অসহযোগ আন্দোলনের সময় 

(B) আইন অমান্য আন্দোলনের সময়

(C) ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় ✓

(D) স্বাধীনতার সময়

69 . তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের সর্বাধিনায়ক ছিলেন-

(A)  অজয় মুখোপাধ্যায়

(B) সতীশচন্দ্র সামন্ত ✓

(C) মাতঙ্গিনী হাজরা

(D) চৈতু পাণ্ডে

70. ভারত থেকে সুভাষচন্দ্র বসুর ঐতিহাসিক মহানিষ্ক্রমণ ঘটে-

(A)  ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে

(B) ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে

(C) ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে ✓

(D) ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে

71.সুভাষচন্দ্র বসু ‘ইন্ডিয়ান লিজিয়ন’ প্রতিষ্ঠা করেন-

(A)  কাবুলে

(B) জার্মানিতে ✓

(C) জাপানে

(D) সিঙ্গাপুরে

72. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জার্মানি থেকে সমুদ্রপথে সাবমেরিনে কয়েক হাজার মাইল অতিক্রম করে সুভাষচন্দ্রের জাপানে আসতে সময় লাগে-

(A)  ৩৭ দিন

(B) ৫৭ দিন

(C) ৭৭ দিন

(D) ৯৭ দিন ✓

73. নৌবিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন- 

(A)  সরোজিনী নাইডু

(B) শাহনওয়াজ খান

(C) এম. এস. খান ✓

(D) অরুণা আসফ আলি

74 . মন্ত্রী মিশনের প্রধান নেতা ছিলেন-

(A)  স্ট্যাফোর্ড ক্লিপস

(B) এ. ভি. আলেকজান্ডার ✓

(C) পেথিক লরেন্স

(D) মেকলে

75. যে পরিকল্পনার চূড়ান্ত পরিণাম হল দেশভাগ তা হল-

(A)  সিমলা পরিকল্পনা

(B) আরউইন পরিকল্পনা

(C) ওয়াভেল পরিকল্পনা

(D) মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা ✓

76. ভারত বিভাগের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন বড়োলাট-

(A)  আরউইন

(B) লিনলিথগো

(C) মাউন্টব্যাটেন ✓

(D) ওয়াভেল

77. পাঞ্জাবে কোন্ দলের নেতা ছিলেন সিকান্দর হায়াৎ খাঁ?

(A)   অকালি

(B) কমিউনিস্ট

(C) কংগ্রেস

(D) ইউনিয়নিস্ট ✓

78. ‘আজাদ হিন্দ সরকার’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কোথায়?

(A)  টোকিও-তে

(B) ব্যাংকক-এ

(C) রেঙ্গুন-এ

(D) সিঙ্গাপুর-এ ✓

 79. ক্লিপস মিশন যখন ভারতে এসেছিল তখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কে ছিলেন?

(A)  উইনস্টন চার্চিল ✓

(B) লিনলিথগো

(C) ক্লেমেন্ট এটলি

(D) স্ট্যাফোর্ড ক্লিপস

80. কোন্ জাহাজে প্রথম নৌবিদ্রোহ শুরু হয়? 

(A)  র‍্যাভেন 

 (B) তলোয়ার ✓

(C) সমুদ্র কন্যা

(D) টাইটানিক

81. ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেস লিগের সভাপতি নিযুক্ত হন-

(A)  মোহন সিং ✓

(B) সুভাষচন্দ্র বসু

(C) রাসবিহারী বসু

(D) লক্ষ্মী স্বামীনাথন

82. ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ঘটে- 

(A) ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর হিটলারের পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে ✓

(B) ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জুলাই নাৎসিদের অস্ট্রিয়ায় সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে

(C) ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ২২ জুন হিটলারের রাশিয়া আক্রমণের মধ্য দিয়ে

(D) ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ১০ মে হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানির বেলজিয়াম আক্রমণের মধ্য দিয়ে

83 . দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন রাষ্ট্রপতি ছিলেন-

(A) উড্রো উইলসন

(B) হুভার

(C) বুজভেল্ট ✓

(D) ট্রুম্যান

84. ইংল্যান্ড মিত্রপক্ষের হয়ে যে দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে তা হল-

(A) ইটালি

(B) স্পেন

(C) জাপান

(D) জার্মানি ✓

85. হিদেকি তোজো রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন-

(A) চিনের

(B) ইটালির

(C) জার্মানির

(D) জাপানের ✓

86. চিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল-

(A) লং মার্চ  ✓

(B) দিয়েন বিয়েন ফু-র ঘটনা

(C) মাই-লাই ঘটনা

(D) কথো সংকট

87. চিনের পিকিং শহরের দক্ষিণে যে সেতুর কাছে জাপানি সেনাবাহিনী চিনা সেনাদের আক্রমণ করে তা হল-

(A) লুকোচিয়াও

(B) মার্কোপোলো ✓

(C) সেচুয়ান 

(D) সাংহাই

88. পিকিং শহরের নিকটবর্তী যে গ্রামে চিনা ও জাপানি সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষ (১৯৩৭ খ্রি.) শুরু হয়, তা হল- 

(A) লুকো চিয়াও ✓

(B) উয়াং 

(C) লাচু

(D) ক্যান্টন

89. ‘রিয়েলপলিটিক’ নীতির প্রবক্তা ছিলেন-

(A) কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম

(B) হিটলার

(C) মুসোলিনি

(D) বিসমার্ক ✓

90. আধুনিককালে পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি সবচেয়ে বেশি উপনিবেশ স্থাপন করে- 

(A) এশিয়া ও আফ্রিকায়  ✓

(B) দক্ষিণ আমেরিকায় 

(C) এশিয়া ও আমেরিকায়

(D) আফ্রিকা ও আমেরিকায়

91. ২১ (একুশ) দফা দাবি পেশ করে- 

(A) জাপান ✓

(B) ভিয়েতনাম

(C) চিন

(D) ইন্দোনেশিয়া

92. জাপান পার্ল হারবার আক্রমণ করে-

(A) ১৯৪১ খ্রি. ✓

(B) ১৯৪২ খ্রি.

(C) ১৯৪৪ খ্রি.

(D) ১৯৪৫ খ্রি.

93. বৃহত্তর পূর্ব এশিয়া সম্মেলন (Greater East Asia Conference) অনুষ্ঠিত হয়

(A) ১৯৪১ খ্রি.

(B) ১৯৪২ খ্রি.

(C) ১৯৪৩ খ্রি. ✓

(D) ১৯৪৪ খ্রি.

94. পূর্ব এশিয়ার ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের জনক বলা হয়-

(A) ক্যাপ্টেন মোহন সিংকে

(B) ভগৎ সিংকে

(C) রাসবিহারী বসুকে ✓

(D) সুভাষচন্দ্র বসুকে

95. হিরোশিমায় আণবিক বোমা ফেলে-

(A) রাশিয়া

(B) আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ✓

(C) গ্রেট ব্রিটেন

(D) ভারত

96. স্বাধীন ইন্দোনেশিয়ার জন্ম হয়-

(A) ১৯৪৯ খ্রি. ✓

(B) ১৯৪৮ খ্রি.

(C) ১৯৪৭ খ্রি.

(D) ১৮৪৯ খ্রি.

97. ফরাসি শাসন থেকে মুক্তির পর ইন্দোচিনের নাম হয়-

(A) মাঞ্জুরিয়া

(B) থাইল্যান্ড

(C) ভিয়েতনাম ✓

(D) ইন্দোনেশিয়া

98. ইন্দোনেশিয়া কোন্ ইউরোপীয় শক্তির উপনিবেশ ছিল?

(A) স্পেন

(B) ইংল্যান্ড

(C) ফ্রান্স

(D) হল্যান্ড ✓

99. ওলন্দাজদের হাত থেকে ইন্দোনেশিয়া স্বাধীনতা লাভ করে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সদস্যপদ লাভ করে-

(A) ১৯৭১ খ্রি.

(B) ১৯৫০ খ্রি. ✓

(C) ১৯৫৫ খ্রি.

(D) ১৯৬০ খ্রি.

100. ‘বাফার’ বা নিরপেক্ষ দেশ হিসেবে স্বীকৃত পায় মধ্য এশিয়ার-

(A) কোরিয়া

(B) সিঙ্গাপুর

(C) আফগানিস্তান ✓

(D) সুইটজারল্যান্ড

101. স্বাধীন ইন্দোনেশিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি হলেন-

(A) হাত্তা

(B) ড. সুকর্ণ ✓

(C) সুহার্তো

(D) হাব্বিবি

102. ড. সুকর্ণ কোন্ দেশের নেতা ছিলেন?

(A) চিনের

(B) ইন্দোচিনের

(C) ইন্দোনেশিয়ার ✓

(D) জাপানের

103. ভিয়েতনামের হাইফং অঞ্চলে বোমা নিক্ষেপ করে কয়েক হাজার নিরীহ ভিয়েতনামিকে হত্যা করে-

(A) ইংল্যান্ড

(B) ফ্রান্স ✓

(C) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

(D) জাপান

2. Very Short Question Answer

1. কোন্ সময় লিনলিথগো ভারতের বড়োলাট হয়ে আসেন?

উত্তর-  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনাকালে (১৯৩৬ খ্রি.) ভারতের বড়োলাট হয়ে আসেন লিনলিথগো।

2. মোট কয়টি গোলটেবিল বৈঠক হয়?

উত্তর-  মোট তিনটি গোলটেবিল বৈঠক হয়।

3. লিনলিথগো প্রস্তাব অথবা আগস্ট প্রস্তাব কবে ঘোষিত হয়?

উত্তর-  ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ৮ আগস্ট লিনলিথগো প্রস্তাব অথবা আগস্ট প্রস্তাব ঘোষিত হয়।

4. ক্লিপস প্রস্তাবের ব্যর্থতার মূল কারণ কী?

উত্তর-  ক্লিপস প্রস্তাবে প্রচ্ছন্নভাবে ভারত বিভাজনের ইঙ্গিত থাকায় তা ব্যর্থ হয়।

5. তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের মহিলা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নাম কী ছিল?

উত্তর-  তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের মহিলা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নাম ছিল ভগিনী সেবাসমিতি।

6. সুভাষচন্দ্র বসু কাকে ‘পূর্ব এশিয়ায় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের জনক’ বলে অভিহিত করেন?

উত্তর-  সুভাষচন্দ্র বসু, রাসবিহারী বসুকে ‘পূর্ব এশিয়ায় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের জনক’ বলে অভিহিত করেন।

7. বাংলায় আগস্ট বা ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কয়েকটি মূলকেন্দ্রের নাম লেখো।

উত্তর-  বাংলায় আগস্ট আন্দোলনের মূলকেন্দ্র ছিল কলকাতা, ঢাকা, হুগলি-সহ বিভিন্ন জায়গা।

8. ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে হরিপুরা কংগ্রেসে কে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন?

উত্তর-  শীয় ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে হরিপুরা কংগ্রেসে সুভাষচন্দ্র বসু জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন।

9. হরিপুরা কংগ্রেসে সুভাষচন্দ্র কাকে পরাজিত করে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন?

উত্তর-  সুভাষচন্দ্র গান্ধিজি সমর্থিত প্রার্থী পট্টভি সীতারামাইয়াকে পরাজিত করে জাতীর কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন।

10. কেন সুভাষচন্দ্র জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতির পদ ত্যাগ করেন?

উত্তর-  গান্ধিজির সমর্থিত কংগ্রেসি গোষ্ঠীর অসহযোগিতার কারণে সুভাষচন্দ্র জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতির পদ ত্যাগ করেন।

11. ‘ফ্রি ইন্ডিয়া সেন্টার’-এর মুখপত্রটির নাম কী?

উত্তর-  ‘ফ্রি ইন্ডিয়া সেন্টার’-এর মুখপত্রটির নাম হল ইংরেজি ও হিন্দি দ্বিভাষিক পত্রিকা ‘আজাদ হিন্দ’।

12.কোথায় সুভাষচন্দ্র ‘নেতাজি’ শিরোপায় ভূষিত হন?

উত্তর-  জার্মানির বার্লিনে সুভাষচন্দ্র ‘নেতাজি’ শিরোপায় ভূষিত হন।

13. কাদের নিয়ে সুভাষচন্দ্র জার্মানিতে ‘ইন্ডিয়ান লিজিয়ন’ বা ‘ফ্রি ইন্ডিয়া আর্মি’ নামে এক সেনাদল গঠন করেন?

উত্তর-  জার্মানির হাতে বন্দি ভারতীয় সৈন্যদের নিয়ে সুভাষচন্দ্র ইন্ডিয়ান লিজিয়ন বা ফ্রি ইন্ডিয়া আর্মি নামে এক সেনাদল গঠন করেন।

14. আজাদ হিন্দ বাহিনীর দুজন সেনানায়কের নাম লেখো।

উত্তর-  আজাদ হিন্দ বাহিনীর দুজন সেনানায়ক হলেন রাসবিহারী বসু ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। 

15. কার নেতৃত্বে ঝাঁসি রেজিমেন্ট গঠিত হয়?

উত্তর-  শ্রীমতী লক্ষ্মী স্বামীনাথনের নেতৃত্বে ঝাঁসি রেজিমেন্ট গঠিত হয়।

16. রশিদ আলি কে?

উত্তর-  রশিদ আলি ছিলেন আজাদ হিন্দ বাহিনীর ক্যাপটেন।

17. কোন্ জাহাজে নৌবিদ্রোহ শুরু হয়? অথবা, নৌবিদ্রোহ কবে, কোথায় শুরু হয়?

উত্তর-  ভারতীয় নৌবাহিনীর রয়‍্যাল ইন্ডিয়ান নেভি নামক জাহাজে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে নৌবিদ্রোহ শুরু হয়।

18. কোথায় প্রথম নৌবিদ্রোহের সূচনা ঘটে?

উত্তর-  ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে বোম্বাইয়ের ২২টি জাহাজে এবং করাচির হিন্দুস্তান জাহাজে এই বিদ্রোহের সূচনা ঘটে।

19. ভারতের সংবিধান খসড়া কমিটির সভাপতি কে ছিলেন?

উত্তর-  ভারতের সংবিধান খসড়া কমিটির সভাপতি ছিলেন ড. বি. আর. আম্বেদকর।

20. ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট ভারতের ইতিহাসে কেন গুরুত্বপূর্ণ?

উত্তর-  ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট ভারতবর্ষ ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে।

21. কোন্ পরিকল্পনা মেনে ভারতীয় গণপরিষদ গঠিত হয়?

উত্তর-  মন্ত্রী মিশনের পরিকল্পনা অনুযায়ী চারটি মূলনীতির ভিত্তিতে গণপরিষদ গঠিত হয়।

22. গণপরিষদ গঠনের মধ্য দিয়ে কোন্ কোন্ উদ্দেশ্য পূরণ করতে চাওয়া হয়?

উত্তর-  গণপরিষদ গঠনের মধ্য দিয়ে ভারতে দুঃখদারিদ্র্যের অবসান ঘটানো, যাবতীয় বৈষম্য লোপ ও শোষণের অবসান ঘটাতে চাওয়া হয়।

23. কবে গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে?

উত্তর-  গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর।

24. পরাধীন ভারতের শেষ ভাইসরয় কে ছিলেন?

উত্তর-  পরাধীন ভারতের শেষ ভাইসরয় ছিলেন মাউন্টব্যাটেন।

25. ভারত কবে প্রজাতন্ত্র হল?

উত্তর-  ভারত ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র হল।

26. ভারতের শেষ গভর্নর জেনারেল কে ছিলেন?

উত্তর-  ভারতের শেষ গভর্নর জেনারেল ছিলেন মাউন্টব্যাটেন।

27. ভারত যখন স্বাধীনতা লাভ করে তখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কে ছিলেন?

উত্তর-  ভারত যখন স্বাধীনতা লাভ করে তখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ক্লিমেন্ট এটলি।

28. স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল কে হন?

উত্তর-  গণপরিষদের পঞ্চম অধিবেশনে (১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে) মাউন্টব্যাটেনকে স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল নিয়োগ করা হয়।

29. কবে স্বাধীন ভারতের নতুন সংবিধান কার্যকর হয়?

উত্তর-  ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি গণপরিষদের শেষ অধিবেশনে স্বাধীন ভারতের নতুন সংবিধান কার্যকর হয়।

30. ভারতের গণপরিষদের প্রকৃতি লেখো।

উত্তর-  প্রকৃতিগত বিচারে ভারতের গণপরিষদ জনপ্রতিনিধিত্বহীন একদলীয় আপসমুখী ছিল, যাতে আইনবিদদের প্রাধান্য দেখা যায়।

31.ভারতের লৌহমানব কাকে বলা হয়?

উত্তর-  সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলকে ভারতের লৌহমানব বলা হয়।

32. কারা রোম-বার্লিন-টোকিও চুক্তিতে আবদ্ধ হয়?

উত্তর: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান ইটালি ও জার্মানির সঙ্গে ‘রোম-বার্লিন-টোকিও চুক্তি’-তে আবদ্ধ হয়।

33. রোম-বার্লিন-টোকিও চুক্তি কবে স্বাক্ষরিত হয়?

উত্তর: ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে রোম-বার্লিন-টোকিও চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

34. জাপান কবে মাঞ্জুরিয়া আক্রমণ করেছিল?

উত্তর: ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে জাপান চিনের মাঞ্জুরিয়া আক্রমণ করেছিল।

35. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের প্রধানমন্ত্রী কে ছিলেন?

উত্তর: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন হিদেকি তোজো।

36. জাপানের কোন দুটি শহরে আমেরিকা আণবিক বোমা বর্ষণ করে?

উত্তর: আমেরিকা ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে জাপানের হিরোশিমা (৬ আগস্ট) ও নাগাসাকিতে (৯ আগস্ট) আণুবিক বোমা বর্ষণ করেছিল।

37. ‘বৃহত্তর পূর্ব এশিয়া যুগ্ম বিকাশ’ তত্ত্ব কার?

উত্তর: ‘বৃহত্তর পূর্ব এশিয়া যুদ্ধা বিকাশ তত্ত্ব’ হল জাপানের।

38. স্বাধীন ইন্দোনেশিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী কে ছিলেন?

উত্তর: স্বাধীন ইন্দোনেশিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি হন ড. সুকর্ণ এবং প্রধানমন্ত্রী হন মহম্মদ হাত্তা।

39. সুকর্ণ কে ছিলেন?

উত্তর: PNI দলের প্রতিষ্ঠাতা ও স্বাধীন ইন্দোনেশিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি।

40. কোন্ কোন্ দ্বীপ নিয়ে ইন্দোনেশিয়া গড়ে উঠেছে?

উত্তর: জাভা, সুমাত্রা, বোর্নিয়ো এবং একশোরও বেশি ছোটো বড়ো দ্বীপ নিয়ে ইন্দোনেশিয়া গড়ে উঠেছে।

41. উত্তর ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট বাহিনী কী নামে পরিচিত ছিল?

উত্তর: উত্তর ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট বাহিনী ভিয়েতমিন নামে পরিচিত ছিল।

42. দক্ষিণ ভিয়েতনামের কমিউনিস্টরা কী নামে পরিচিত ছিল?

উত্তর: দক্ষিণ ভিয়েতনামের কমিউনিস্টরা ভিয়েতকং নামে পরিচিত ছিল।

43. কবে ভিয়েতনামে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র স্থাপিত হয়?

উত্তর: ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২ সেপ্টেম্বর ভিয়েতনামে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র স্থাপিত হয়।

44. ঐক্যবদ্ধ ভিয়েতনামের প্রথম রাষ্ট্রপতি কে ছিলেন?

উত্তর: ঐক্যবন্ধ ভিয়েতনামের প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন হো-চি-মিন।

45. হো-চি-মিন কে ছিলেন?

উত্তর: হো-চি-মিন ছিলেন ভিয়েতনাম প্রজাতন্ত্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি।

46. কবে দিয়েন-বিয়েন ফু-এর যুদ্ধ সংঘটিত হয়?

উত্তর: ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ১৩ মার্চ দিয়েন-বিয়েন ফু-এর যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

47. জেনেভা সম্মেলনে কোন্ কোন্ দেশ অংশগ্রহণ করে?

উত্তর: জেনেভা সম্মেলনে আমেরিকা, ব্রিটেন, চিন, ফ্রান্স, ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডি ইত্যাদি দেশ অংশগ্রহণ করে।

48. কাদের মধ্যস্থতায় ডাচ-ইন্দোনেশীয় (লিঙ্গজ্যোতি) স্বাক্ষরিত হয়?

উত্তর: ব্রিটিশের মধ্যস্থতায় ডাচ-ইন্দোনেশীয় চুক্তি (লিঙ্গজ্যোতি) স্বাক্ষরিত হয় (১৯৪ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মার্চ)।

Short Question Answer

প্রশ্ন1. জাপানের তরফে ‘পূর্ব এশিয়ার নতুন বিধান’ ঘোষণায় কী বলা হয়?

উত্তর: ‘পূর্ব এশিয়ার নতুন বিধান’ (New Order of East Asia) ঘোষণায় বলা হয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের অবসান ঘটিয়ে জাপানি সাম্রাজ্যবাদের সূচনা ঘটানো হবে।

প্রশ্ন2. ‘এশিয়া এশিয়াবাসীর জন্য’- এই স্লোগান কোন্ দেশের?

উত্তর: ‘এশিয়া এশিয়াবাসীর জন্য’-এই স্লোগানটি ছিল জাপানের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান এশিয়ার উপনিবেশগুলি থেকে পশ্চিমি শক্তিগুলিকে বিতাড়িত করে নিজের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের প্রসার ঘটানোর জন্য এই স্লোগানটি ছিল। এই স্লোগানটির আড়ালে জাপানের প্রকৃত বক্তব্য ছিল ‘পশ্চিমি শক্তিগুলি নয়, এশিয়ায় কর্তৃত্ব করবে জাপান।’

প্রশ্ন3. ‘এশিয়াবাসীদের জন্য এশিয়া’ জাপানের এই ঘোষণার প্রকৃত উদ্দেশ্য কী ছিল?

উত্তর: ‘এশিয়াবাসীদের জন্য এশিয়া’ এই ঘোষণার দ্বারা জাপান আসলে চেয়েছিল এশিয়াকে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে মুক্ত রাখতে, আর এই সুযোগে নিজের সাম্রাজ্যবাদের বিস্তার ঘটাতে।

প্রশ্ন4. ‘AAA’-বলতে কী বোঝ?

উত্তর: জাপানের উদ্যোগে ১৯৪২ খ্রি. ‘AAA’ নামে এক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূচনা ঘটে। ‘AAA’-এর অর্থ হল জাপান এশিয়ার (A) রক্ষক, এশিয়ার (A) নেতা এবং এশিয়ার (A) আলো।

প্রশ্ন5. জাপানি পার্লামেন্টে কোক্কা সোদোইন আইন পাসের মাধ্যমে কী কর্মসূচি নেওয়া হয়?

উত্তর: জাপানি পার্লামেন্টে কোক্কা সোদোইন আইন পাসের মাধ্যমে একদিকে যেমন শিল্প বিকাশের কর্মসূচি নেওয়া হয় অপরদিকে তেমনই জাপানি আগ্রাসী নীতিকেও সমর্থন করা হয় (১৯৩৮ খ্রি., এপ্রিল)।

প্রশ্ন6. কে, কবে পার্ল হারবারে বোমা বর্ষণ করে?

উত্তর: ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর জাপান হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত মার্কিন নৌঘাঁটি পার্ল হারবারের ওপর বিমান আক্রমণ চালায় এবং বোমা বর্ষণ করে।

7. ভারতের ইতিহাসের প্রেক্ষিতে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট ঘোষণা বলতে কী বোঝ?

উত্তর-  ভারতের বড়োলাট লর্ড লিনলিথগো ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ৮ আগস্ট এক প্রস্তাবে ঘোষণা করেন যে-[i] গভর্নর-জেনারেলের শাসন পরিষদে আরও বেশি ভারতীয় সদস্য নেওয়া হবে, [ii] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ভারতের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি ‘গণপরিষদ’ গঠন করা হবে, [iii] এই পরিষদ ভারতের জন্য সংবিধান রচনা করবে ইত্যাদি। এটি আগস্ট ঘোষণা নামে পরিচিত।

8. লিনলিথগোর প্রস্তাবে ভারতের পক্ষ থেকে কোন্ দুটি শর্তের উল্লেখ করা হয়?

উত্তর-  লিনলিথগোর প্রস্তাবের প্রথম শর্তে বলা হয় যে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে। আর দ্বিতীয় শর্তে বলা হয়, ব্রিটিশকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে, যুদ্ধশেষে তারা ভারতকে স্বাধীনতা প্রদান করবে।

9. মুসলিম লিগ কবে মুক্তি দিবস পালনের ডাক দেয়?

উত্তর-  ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ২২ ডিসেম্বর প্রাদেশিক, কংগ্রেসি মন্ত্রীসভাগুলি পদত্যাগ করে। এই দিনটিকে মুসলিম লিগ মুক্তি দিবস পালনের ডাক দেয়।

10. কে, কবে লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন?

উত্তর-  ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ২৩ মার্চ পাকিস্তানের লাহোরে মুসলিম লিগের অধিবেশনে আবুল কাশেম ফজলুল হক লাহোর প্রস্তাব উপস্থাপন করেন যা পাকিস্তান প্রস্তাব নামেও পরিচিত।

11. লাহোর প্রস্তাব কী?

উত্তর-  লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লিগের অধিবেশনে বাংলার প্রধানমন্ত্রী আবুল কাশেম ফজলুল হক উত্তর-পশ্চিম ও পূর্ব ভারতের মুসলিম প্রধান অঞ্চলগুলিকে নিয়ে একটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবি তোলেন। এটি ‘লাহোর প্রস্তাব’ বা ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ নামে পরিচিত।

12.কোন্ অধিবেশনে পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হয়?

উত্তর-  ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম লিগের লাহোর অধিবেশনে পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হয়। ফলে জাতীয় রাজনীতি এক জটিল আবর্তে নিক্ষিপ্ত হয়।

13. জাতীয় কংগ্রেসের রামগড় অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলির মধ্যে দুটি উল্লেখ করো।

উত্তর-  জাতীয় কংগ্রেসের রামগড় অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলির মধ্যে দুটি হল- [i] ডোমিনিয়নের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করা হবে, [ii] গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রতিনিধি নির্বাচনের মাধ্যমে গণপরিষদ গঠন করতে হবে।

14. লিনলিথগোর আগস্ট প্রস্তাবসমূহের দুটি উল্লেখ করো।

উত্তর-  লিনলিথগোর আগস্ট প্রস্তাবগুলির মধ্যে দুটি হল-[i] ব্রিটিশ সরকার ভারতে ডোমিনিয়ন (স্বশাসনের অধিকারপ্রাপ্ত ব্রিটিশ উপনিবেশ) ধরনের এক দায়িত্বশীল গণতান্ত্রিক সরকার গঠনে ইচ্ছুক, [ii] ভারতে দেশীয় রাজ্যগুলির প্রতিনিধি ও জাতীয় নেতাদের নিয়ে একটি যুদ্ধ উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হবে।

15. লিনলিথগোর প্রস্তাবের দুটি ত্রুটি উল্লেখ করো।

উত্তর-  লিনলিথগোর প্রস্তাবের দুটি ত্রুটি ছিল- [i] এই প্রস্তাবে ভারতকে পূর্ণ স্বাধীনতা দানের ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো উল্লেখ ছিল না। [ii] এই প্রস্তাবে সাংবিধানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

16. ক্লিপস প্রস্তাব কী?

উত্তর-  ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে ক্লিপস মিশন ভারতে আসে (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ) ও ভারতকে স্বায়ত্তশাসন প্রদানের লক্ষ্য নিয়ে ২৯ মার্চ একগুচ্ছ প্রস্তাব পেশ করে যা ক্রিপস প্রস্তাব নামে পরিচিত।

17. ক্লিপস মিশনের উল্লেখযোগ্য দুটি প্রস্তাব উল্লেখ করো।

উত্তর-   ক্লিপস মিশনের উল্লেখযোগ্য দুটি প্রস্তাব ছিল-[i] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার অব্যবহিত পরেই ভারতে একটি যুক্তরাষ্ট্র (union) প্রতিষ্ঠা করা হবে। [ii] ওই যুক্তরাষ্ট্রকে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনাধিকার ‘ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস’-এর মর্যাদা দান করা হবে।

18. ক্লিপস মিশনের প্রস্তাবে গান্ধিজি কী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন?

উত্তর-  গান্ধিজি ক্লিপস মিশনের প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়ায় বলেন যে, “এই প্রস্তাবটি ছিল একটি ভেঙে পড়া ব্যাংকের এক আগাম তারিখের চেক কাটার শামিল”|

19. আগস্ট বা ভারত ছাড়ো আন্দোলন কোন্ কোন্ শহরে ছড়িয়ে পড়ে?

উত্তর-  আগস্ট বা ভারত ছাড়ো আন্দোলন বোম্বাই, আমেদাবাদ, কলকাতা, পুনা, নাগপুর, কানপুর, কেরালা, মহিশূর ইত্যাদি শহরে ছড়িয়ে পড়ে।

20. ভারত ছাড়ো আন্দোলন চলাকালে কোথায় তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার গঠিত হয়?

উত্তর-  ভারত ছাড়ো আন্দোলন চলাকালে মেদিনীপুরের তমলুকে স্বাধীন জাতীয় সরকার গঠিত হয় যা ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর থেকে ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট পর্যন্ত টিকে ছিল।

21. তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার কোথায়, কার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল? অথবা, তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার কী?

উত্তর-  ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ডিসেম্বর তমলুকে অজয় মুখার্জি, সুশীল ধাড়া ও সতীশচন্দ্র সামন্তের নেতৃত্বে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার গড়ে ওঠে।

22. ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কয়েকজন নেতৃবৃন্দের নাম লেখো।

উত্তর-  গান্ধিজির নেতৃত্বে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ক্ষেত্রে জয়প্রকাশ নারায়ণ, অরুণা আসফ আলি, সুচেতা কৃপালনি, রামমনোহর লোহিয়া, অচ্যুৎ পট্টবর্ধন, অজয় মুখার্জি, যোগেন চ্যাটার্জি, সুশীল ধাড়া, সরযূ পান্ডে, নানা পাতিল এবং আসামের ১৩ বছরের স্কুলছাত্রী কনকলতা বড়ুয়া ও মেদিনীপুরের তমলুকের ৭৩ বছরের বৃদ্ধা মাতঙ্গিনী হাজরা ছিলেন উল্লেখযোগ্য।

23. ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ব্যর্থতার কয়েকটি কারণ ভ লেখো।

উত্তর-  ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ব্যর্থতার কয়েকটি কারণ ছিল-[i] নেতৃত্বের অভাব, [ii] ঐক্যের অভাব, [iii] ব্রিটিশের দমননীতি, [iv] অসময়ে সূচনা, [v] কয়েকটি সংগঠনের অসহযোগিতা, [vi] গান্ধিজির অনুপস্থিতি, [vii] প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং [viii] মুসলিম সম্প্রদায়ের ভূমিকা ইত্যাদি।

24. ভারত ছাড়ো আন্দোলনকালে কংগ্রেসকে কোন্ কোন্ রাজনৈতিক দল সমর্থন করেনি?

উত্তর-  ভারত ছাড়ো আন্দোলনকালে মুসলিম লিগ, কমিউনিস্ট পার্টি, হিন্দু মহাসভা, র‍্যাডিক্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, অনুন্নত সম্প্রদায়, লিবারেল গোষ্ঠী কেউই কংগ্রেসকে সমর্থন করেনি।

25. ভারত ছাড়ো আন্দোলনের গুরুত্ব লেখো।

উত্তর- ভারত ছাড়ো আন্দোলন ভারতবাসীর স্বাধীনতা অর্জনের ভিত্তি স্থাপন করে এবং কংগ্রেসের মর্যাদার পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘটায়।

26.কোন্ উদ্দেশ্যে সুভাষচন্দ্র ফরওয়ার্ড ব্লক নামে একটি নতুন দল গঠন করেন?

উত্তর-  জাতীয় আন্দোলনকে গতিশীল ও সংগ্রামমুখী করে তুলতে সুভাষচন্দ্র ফরওয়ার্ড ব্লক নামে একটি নতুন দল গঠন করেন (১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দ, ৩ মে)।

27. সুভাষচন্দ্র কেন হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণের জন্য আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন?

উত্তর-  সিরাজ-উদ্দৌলার অন্ধকূপ হত্যাকে স্মরণ করে ব্রিটিশ সরকার হলওয়েল মনুমেন্ট স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেন। কিন্তু বেশিরভাগ ভারতবাসী মনে করত অন্ধকূপ হত্যা ঘটনাটি অসত্য এবং সিরাজকে কলঙ্কিত করার জন্য ব্রিটিশের সাজানো এক চেষ্টা। এতে সুভাষচন্দ্র বাংলার মুসলিম লিগের সহযোগিতায় হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণের জন্য আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন।

28. সুভাষচন্দ্র কীভাবে ‘ফ্রি ইন্ডিয়া সেন্টার’ গঠন করেন?

উত্তর-  ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের শেষার্ধে সুভাষচন্দ্র বার্লিনে গিরিজা মুখার্জি, এম. আর. ব্যাস, এ. সি. এন. নাম্বিয়ার-সহ ২০ জন ভারতীয়কে নিয়ে গঠন করেন ‘ফ্রি ইন্ডিয়া সেন্টার’।

29. কাদের নিয়ে সুভাষচন্দ্র ‘ইন্ডিয়ন লিজিয়ন’ গড়ে তোলেন?

উত্তর-  জার্মানির হাতে যুদ্ধবন্দিদের নিয়ে সুভাষচন্দ্র গড়ে তোলেন ‘ইন্ডিয়ান লিজিয়ন’। জার্মানিতে যুদ্ধবন্দির সংখ্যা ছিল প্রায় ১৫,০০০ জন। এদের মধ্যে ৪,০০০ যুদ্ধবন্দি পরে ‘ইন্ডিয়ান লিজিয়ন’-এ যোগ দেন।

30. জাপানের কাছ থেকে সুভাষচন্দ্র কী প্রতিশ্রুতি পান?

উত্তর-   জাপানের আইনসভা ডায়েট (Diet)-এ সুভাষচন্দ্রের উপস্থিতিতে জাপানি প্রধানমন্ত্রী তোজো ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য জাপানের তরফে সুভাষকে নিঃশর্ত সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন।

31. কে, কবে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করেন? অথবা, আজাদ হিন্দ ফৌজ কে, কবে, কোথায় গঠন করেন?

উত্তর-  ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে জাপানের হাতে যুদ্ধবন্দি ভারতীয় ন সেনাদের নিয়ে ক্যাপটেন মোহন সিং-এর প্রচেষ্টায় রাসবিহারী বসু সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ ■) ফৌজ বা আই. এন. এ (Indian National Army) গঠন করেন।

32. রাসবিহারী বসু কে ছিলেন?

উত্তর-   রাসবিহারী বসু ছিলেন ভারতের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সশস্ত্র ধারার অন্যতম প্রবক্তা। ভারতের মধ্যে থেকে এবং ভারতের বাইরে গিয়েও তিনি আজীবন দেশের মুক্তির লক্ষ্যে সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর কাছ থেকে সুভাষচন্দ্র বসু আজাদ হিন্দ ফৌজ-এর দায়িত্বভার পান।

33. কীভাবে সুভাষচন্দ্র আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন?

উত্তর-  সিঙ্গাপুরে রাসবিহারী বসু ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে সুভাষচন্দ্রের হাতে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স লিগ বা ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘের দায়িত্বভার অর্পণ করেন। পরে নেতাজি আনুষ্ঠানিকভাবে আজাদ হিন্দ ফৌজ-এর সর্বাধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন।

34. নেতাজি কোন্ কোন্ দ্বীপের নাম দেন ‘শহিদ’ ও ‘স্বরাজ’ দ্বীপ? অথবা, সুভাষচন্দ্র আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কী নামকরণ করেন?

উত্তর-  জাপান নবগঠিত আজাদ হিন্দ সরকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং নেতাজির হাতে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের অধিকার সমর্পণ করলে তিনি ওই দ্বীপ দুটির নামকরণ করেন যথাক্রমে ‘শহিদ’ ও ‘স্বরাজ’।

35. আজাদ হিন্দ ফৌজের পাঁচটি ব্রিগেডের নাম লেখো।

উত্তর-  আজাদ হিন্দ ফৌজের পাঁচটি ব্রিগেডের নাম ছিল-গান্ধি ব্রিগেড, আজাদ ব্রিগেড, সুভাষ ব্রিগেড, ঝাঁসির রানি ব্রিগেড, নেহরু ব্রিগেড।

36. সুভাষচন্দ্র কীভাবে জার্মানি থেকে জাপানে এসে পৌঁছোন?

উত্তর-  সুভাষচন্দ্র দুঃসাহসিক সাবমেরিন অভিযান চালিয়ে কয়েক হাজার মাইল পথ অতিক্রম করে জার্মানির টোকিও-তে এসে পৌঁছোন (১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ১৩ জুন)।

37. আজাদ হিন্দ বাহিনী ভারতের কোথায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে?

উত্তর-  কোহিমা পর্যন্ত এসে আজাদ হিন্দ বাহিনী ভারতের মাটিতে তেরঙা জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে (১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৯ মার্চ)।

38. কেন আজাদ হিন্দ সেনারা অস্ত্র ত্যাগ করতে বাধ্য হন?

উত্তর-  জাপান মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করলে (১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ, আগস্ট) জাপানিদের দ্বারা অস্ত্র ও খাদ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে আজাদ হিন্দ সেনারা অস্ত্র ত্যাগ করতে বাধ্য হন।

39. দিল্লির লালকেল্লায় বন্দি আজাদ হিন্দ সেনাদের পক্ষে ত কংগ্রেসের কোন্ আইন বিশেষজ্ঞরা কৌঁসুলি হিসেবে সওয়াল করেন?

উত্তর-  আজাদ হিন্দ সেনাদের পক্ষে সওয়াল করতে কৌঁসুলি হিসেবে এগিয়ে আসেন ভুলাভাই দেশাই, জওহরলাল নেহরু, অরুণা আসফ আলি, তেজবাহাদুর সপ্ত, কৈলাসনাথ কাটজু প্রমুখের মতো কংগ্রেসের প্রথমসারির আইন বিশেষজ্ঞ।

40. কংগ্রেস ছাড়াও আর কোন্ কোন্ রাজনৈতিক দল আজাদ হিন্দ সেনাদের মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে?

উত্তর-  কংগ্রেসের পাশাপাশি মুসলিম লিগ, হিন্দু মহাসভা, আর. এস. এস., অকালি দল, শিখ লিগ, কমিউনিস্ট পার্টি প্রভৃতি সমস্ত রাজনৈতিক দল মতপার্থক্য ভুলে আজাদ হিন্দ সেনাদের মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে।

41. আজাদ হিন্দ সেনাদের বিচারকে কেন্দ্র করে কলকাতায় কীরূপ ছাত্র আন্দোলন গড়ে ওঠে?

উত্তর-  ২১ নভেম্বর (১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ) প্রাদেশিক ছাত্র কংগ্রেস, ছাত্র ব্লক (ফরওয়ার্ডব্লকের ছাত্র সংগঠন), ছাত্র ফেডারেশন (কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন)-এর সদস্যরা এবং ইসলামিয়া কলেজ (বর্তমান মৌলানা আজাদ কলেজ)-সহ নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা মিছিল বের করে।

42. ‘রশিদ আলি দিবস’ কী? অথবা, রশিদ আলি দিবস কবে এবং কেন পালিত হয়েছিল?

উত্তর-  আজাদ হিন্দ বাহিনীর ক্যাপটেন রশিদ আলিকে বিচারে ৭ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হলে, প্রতিক্রিয়া হিসেবে ১১ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় ব্যাপক ছাত্র ধর্মঘট এবং ১২ তারিখে সাধারণ ধর্মঘট ঘটে, যা ‘রশিদ আলি দিবস’ নামে পরিচিত।

43. যুদ্ধবন্দি আইনে আই. এন. এ.র কোন্ তিন সেনাপতিকে বিচারের জন্য দিল্লির লালকেল্লায় নিয়ে আসা হয়?

উত্তর-  যুদ্ধবন্দি আইনে আই. এন. এ-র তিন সেনাপতি গুরুদয়াল সিং ধিলন, প্রেম সায়গল, শাহনওয়াজ খানকে বিচারের জন্য দিল্লির লালকেল্লায় নিয়ে আসা হয়।

44. আজাদ হিন্দ বাহিনীর সদস্যদের লালকেল্লায় বিচারের সময় কংগ্রেস নেতা ছিলেন এমন দুজন ব্যারিস্টারের নাম লেখো।

উত্তর-  আজাদ হিন্দ বাহিনীর সদস্যদের লালকেল্লায় বিচারের সময় কংগ্রেস নেতা ছিলেন এমন দুজন ব্যারিস্টারের নাম হল ভুলাভাই দেশাই ও জওহরলাল নেহরু।

45. নৌসেনাবাহিনী কোন্ দুই বিভাগে বিভাজিত ছিল?

উত্তর-  নৌসেনাবাহিনী দুই বিভাগে বিভাজিত ছিল, যথা- [i] ইংরেজ শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায় ‘British Other Ranks’ (BOR), [ii] ভারতীয় নৌকর্মচারীর ‘Indian Other Ranks’ (IOR)।

46. কার নির্দেশে নৌবিদ্রোহীরা আত্মসমর্পণ করে?

উত্তর-  সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের নির্দেশে বিদ্রোহীরা আত্মসমর্পণ করে (২৩ ফেব্রুয়ারি)। বিদ্রোহীরা ঘোষণা করে, আমরা আত্মসমর্পণ করছি ব্রিটিশের কাছে নয়, ভারতের কাছে।

47. নৌবিদ্রোহের অন্যতম প্রধান গুরুত্ব কী ছিল?

উত্তর-  নৌবিদ্রোহের জন্যই ব্রিটিশ প্রশাসন ক্ষমতা হস্তান্তরের অর্থাৎ ভারতকে স্বাধীনতা প্রদানের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিল এবং তড়িঘড়ি তার ক্যাবিনেট মিশন বা মন্ত্রী মিশনকে ভারতে পাঠাতে বাধ্য হয়েছিল।

48. ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের সি. আর. ফর্মুলার মূল কথা কী ছিল? অথবা, সি. আর. ফর্মুলা কী?

উত্তর-  মুসলিম লিগের পৃথক পাকিস্তানের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী যে প্রস্তাব (১৯৪৪ খ্রি.) দেন তা ‘সি. আর. ফর্মুলা’ নামে পরিচিত।  -। চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারীর নামে এই ফর্মুলা প্রকাশিত হয়।

49. ‘ওয়াভেল পরিকল্পনা’ কী?

উত্তর-  বড়োলটি ওয়াভেল ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুন কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের কাছে একটি সূত্র উত্থাপন করেন। সেটিই ‘ওয়াভেল পরিকল্পনা’ নামে খ্যাত।

50. ওয়াভেল তাঁর পরিকল্পনায় কী সুপারিশ করেন?

উত্তর-  ওয়াভেল তাঁর পরিকল্পনায় ভারতীয়দের হাতে অধিকতর ক্ষমতা ও দায়িত্ব অর্পণ করে কেন্দ্রীয় শাসন পরিষদ পুনর্গঠনের সুপারিশ করেন।

51. সিমলা বৈঠকের মূল আলোচ্য বিষয় দুটি কী ছিল?

উত্তর-  সিমলা বৈঠকের মূল আলোচ্য বিষয় দুটির মধ্যে প্রথমটি ছিল বড়োলাটের কাউন্সিল বা শাসন পরিষদ যে সমস্ত নীতির ভিত্তিতে কাজ করবে সেগুলি ঠিক করা; দ্বিতীয়টি ছিল কাউন্সিল কীভাবে গঠিত হবে বা এই কাউন্সিলের কারা সদস্য হবেন, তা ঠিক করা।

52. এটলির ঘোষণা কী?

উত্তর-  ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৯ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট এটলি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ঘোষণা করেন যে, ভারতের স্বাধীনতার বিষয়ে আলোচনার জন্য ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার তিনজন সদস্যকে নিয়ে গঠিত একটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন প্রতিনিধি দলকে ভারতে পাঠানো হবে।

53. মন্ত্রী মিশনের (ক্যাবিনেট মিশন) তিনজন সদস্যের নাম করো। অথবা, ক্যাবিনেট মিশনের তিনজন সদস্যের নাম লেখো।

উত্তর-  মন্ত্রী মিশনের তিনজন সদস্য ছিলেন- [i] ভারত-সচিব স্যার পেথিক লরেন্স, [ii] বাণিজ্যসভার সভাপতি স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্লিপস এবং [iii] নৌবাহিনীর প্রধান এ. ভি. আলেকজান্ডার।

54. ক্যাবিনেট মিশন বা মন্ত্রী মিশন কী?

উত্তর-  ভারতবাসীকে স্বাধীনতা দান প্রসঙ্গে ভারত-সচিব পেথিক লরেন্স, বাণিজ্য-সচিব স্ট্যাফোর্ড ক্লিপস এবং নৌ-সচিব এ. ভি. আলেকজান্ডার-এই তিনজনকে নিয়ে গড়া উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ব্রিটিশ প্রতিনিধি দলটি ভারতের ইতিহাসে ক্যাবিনেট মিশন বা মন্ত্রী মিশন (১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ) নামে খ্যাত।

55. ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবে কী বলা হয়?

উত্তর-  ব্রিটিশ শাসিত ভারত ও দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়ে একটি যুক্তরাষ্ট্র গঠন করা হবে। পররাষ্ট্র, যোগাযোগ ও প্রতিরক্ষা বিষয়ক ক্ষমতা থাকবে প্রদেশগুলির হাতে। প্রদেশগুলিকে তিনভাগে ভাগ করা হবে। নতুন সংবিধান যতদিন না প্রবর্তিত হবে ততদিন ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত একটি অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করবে। প্রদেশগুলির নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান রচনার জন্য গণপরিষদ গঠিত হবে।

56. গণপরিষদে নির্বাচিত কয়েকজন সদস্যের নাম লেখো।

উত্তর-  গণপরিষদে নির্বাচিত কয়েকজন সদস্য হলেন বল্লভভাই প্যাটেল, জওহরলাল নেহরু, বি- আর. আম্বেদকর, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী, কৃষ্ণস্বামী আয়ার প্রমুখ।

57. ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ বা কলকাতা হত্যাকাণ্ড কী?

উত্তর-  মুসলিম লিগ পৃথক পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবিতে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের ডাক দিলে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধে। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট থেকে ২০ আগস্ট এই পাঁচদিনে কলকাতায় কয়েক হাজার নিরীহ মানুষ মারা যায় যা ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ বা কলকাতা হত্যাকান্ড নামে পরিচিত।

58. মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা কী?

উত্তর-  মাউন্টব্যাটেনের উপদেষ্টা লর্ড ইম্মে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারত ভাগের পরিকল্পনা পাঠান যা ভারতীয় স্বাধীনতা আইনরূপে পাস হয় এবং মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা নামে পরিচিতি পায়।

59.’মাউন্টব্যাটেন রোয়েদাদ’ কী?

উত্তর-  ব্রিটিশ সরকার ভারত বিভাজনের পরিকল্পনা অনুমোদন করার পর লর্ড মাউন্টব্যাটেন ৩ জুন (১৯৪৭ খ্রি.) তাঁর ভারত বিভাগের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। এই ঘোষণা ‘মাউন্টব্যাটেন প্রস্তাব’ বা ‘মাউন্টব্যাটেন রোয়েদাদ’ নামে পরিচিত।

60. বলকান পরিকল্পনা কী?

উত্তর-  প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে অটোমান সাম্রাজ্যের ভাঙনের পর বলকান অঞ্চলে জাতিভিত্তিক একাধিক ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের উদ্ভব প্রক্রিয়াই বলকান পরিকল্পনা নামে পরিচিত।

61. মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনার বিকল্প হিসেবে বলকান পরিকল্পনায় কী প্রস্তাব রাখা হয়?

উত্তর-  মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনার বিকল্প হিসেবে অটোমান সাম্রাজ্যের বলকান পরিকল্পনার ন্যায় পাঞ্জাব ও বাংলা ভাগের প্রস্তাব রাখা হয় এবং বলা হয়, যে সকল প্রদেশ সাংবিধানিক সভায় যোগ দেবে তাদেরও ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে।

62.সিমলা বৈঠক বলতে কী বোঝ?

উত্তর-  ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে বড়োলাট ওয়াভেল সিমলাতে সর্বদলীয় নেতাদের নিয়ে এক বৈঠক ডাকেন (২৫ জুন, ১৯৪৫) যা সিমলা বৈঠক নামে পরিচিত।

63. ‘বৃহত্তর পূর্ব এশিয়া যৌথ অগ্রগতি বলয়’ কী?

উত্তর: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান, মিত্রশক্তিভুক্ত ব্রিটেন ও ফ্রান্সকে কোণঠাসা করার পর জাপানি বিদেশমন্ত্রী মাৎসুওকা এশিয়ায় বিস্তার নীতি গ্রহণ করেন, যা ‘বৃহত্তর পূর্ব এশিয়া যৌথ অগ্রগতি বলয়’ নামে পরিচিত।

64. ‘টানাকা মেমোরিয়াল’ কী?

উত্তর: জাপানের উগ্র সাম্রাজ্যবাদী প্রধানমন্ত্রী টানাকা জাপানের সম্রাট হিরোহিতোর কাছে প্রদত্ত এক প্রতিবেদনে জানান যে, পূর্ব এশিয়ার সমস্যা সমাধানের জন্য জাপানের উচিত যুদ্ধনীতি গ্রহণ করা। এই প্রতিবেদন টানাকা মেমোরিয়াল (১৯২৭ খ্রি.) নামে পরিচিত।

65. সিয়াটো কেন গঠিত হয়?

উত্তর: ইন্দোচিন-সহ সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে সাম্যবাদ মুক্ত করার লক্ষ্যে মার্কিন উদ্যোগে গঠিত হয় সিয়াটো (SEATO) বা ‘দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা’।

66. ‘নুশানতারা’ (Nusantara) কী?

উত্তর: আজকের স্বাধীন ইন্দোনেশিয়া অঞ্চলটির নাম ছিল নুশানতারা। এটি প্রাচীন জাভাদেশীয় শব্দ, যার আক্ষরিক অর্থ হল ‘দ্বীপপুঞ্জ’।

68. ভোকস্রাদ (Volksraad) কী?

উত্তর: ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে গঠিত ইন্দোনেশিয়ায় বিদেশি ডাচ সরকারের গঠিত উপদেষ্টা সমিতির নাম ছিল ভোকস্রাদ। এই সভাটির আইন প্রণয়নের কোনো ক্ষমতা না থাকলেও এরপ মাধ্যমে রাজনৈতিক মতামত এবং অভাব অভিযোগ জানানো হত।

69. ইন্দোনেশিয়ার কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নাম লেখো।

উত্তর: ইন্দোনেশিয়ার কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নাম হল বুদিউতোমা (বুদ্ধি উত্তম), সারেকত ইসলাম (মুসলিম জাতীয়তাবাদী সংগঠন), কমিউনিস্ট দল বা (PKI বা Partai Komunis Indonesia) প্রভৃতি।

70. ভিয়েতকং কাকে বলে?

উত্তর: দক্ষিণ ভিয়েতনামে কমিউনিস্ট, অকমিউনিস্ট এমনকি বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরাও মার্কিন অনুগ্রহপুষ্ট ন-দিন-দিয়েম সরকারের বিরোধীতার লক্ষ্যে জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট নামে এক সংগঠন গড়ে তোলে (১৯৬০ খ্রি.)। এদের দিয়েম সরকার ভিয়েতনামি কমিউনিস্ট বা ভিয়েতকং আখ্যা দেয়।

71. লিঙ্গজ্যোতি চুক্তি কী?

উত্তর: ডাচদের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ার প্রজাতন্ত্রী নেতাদের যে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তা নাম লিঙ্গজ্যোতি চুক্তি। বাটাভিয়া (জাকার্তা)-র লিঙ্গজ্যোতি শহরে এই চুক্তি স্বাক্ষরি হয়। এই চুক্তিতে ইন্দোনেশিয়ার পূর্ণ স্বাধীনতার স্বীকৃতি না দিয়ে সেখানে এক যুক্তরাষ্ট্রী ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রস্তাব রাখা হয়।

4. Long Question Answer

প্রশ্ন1. লিনলিথগো প্রস্তাব সম্বন্ধে আলোচনা করো।

সূচনা: ব্রিটিশ সরকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয়দের সাহায্য লাভের লক্ষ্যে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। এই লক্ষ্যপূরণের জন্য বড়োেলাট লিনলিথগো সক্রিয় হয়ে ওঠেন এবং কিছু প্রস্তাব পেশ করেন যা লিনলিথগো প্রস্তাব নামে পরিচিত।

উত্তর: লিনলিথগো প্রস্তাব

1 প্রেক্ষাপট: এইসময় ভারতের বড়োেলাট লিনলিথগো একতরফা ঘোষণায় বলেন যে ভারত ব্রিটেনের পক্ষে বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিয়েছে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হল যে লিনলিথগো ভারতীয় নেতৃবর্গ বা কেন্দ্রীয় আইনসভার সঙ্গে কোনোরকম পরামর্শ না করেই এই ঘোষণা করে দেন। তাই লিনলিথগোর এই ঘোষণায় ভারতের জনগণ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন।

2 কংগ্রেসের শর্তাধীন সহযোগিতার সিদ্ধান্ত: লিনলিথগোর ঘোষণার প্রতিবাদে জাতীয় কংগ্রেস মন্ত্রীসভাগুলি থেকে পদত্যাগ করে। তবে কংগ্রেস ব্রিটিশের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পথ খোলা রাখে। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি এক প্রস্তাব গ্রহণ করে। এই প্রস্তাবে ব্রিটেনের পক্ষ অবলম্বনের ব্যাপারে কংগ্রেস দুটি শর্তের উল্লেখ করে। প্রথম শর্তে বলা হয়, কেন্দ্রে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে। আর দ্বিতীয় শর্তে বলা হয়, ব্রিটিশকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে যুদ্ধ শেষে তারা ভারতকে স্বাধীনতা প্রদান করবে। জাতীয় কংগ্রেসের এই ভূমিকার বিরুদ্ধে সরব হয় বামপন্থী গোষ্ঠীগুলি।

3 ব্রিটিশের বিভেদকামী ভূমিকা: বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই ব্রিটিশ ভারতে মুসলিম লিগকে অধিক গুরুত্ব দিতে শুরু করে। বিশেষত কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লিগের বিদ্বেষ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্রিটিশ সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে লিগ ও কংগ্রেসের দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয়ে ওঠে।

4 লিনলিথগোর আগস্ট প্রস্তাব: গভর্নর জেনারেল এক ঘোষণায় বলেন (১৯৪০ খ্রি., ৮ আগস্ট)- [i] ব্রিটিশ সরকার ভারতে ডোমিনিয়ন ধরনের এক দায়িত্বশীল গণতান্ত্রিক সরকার গঠনে ইচ্ছুক। [ii] ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের কোনো পরিবর্তন করার আগে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পরামর্শ নেওয়া হবে। পাশাপাশি ভারতের বিভিন্ন দল, সম্প্রদায় এবং দেশীয় রাজাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা হবে। [iii] ভারতে একটি যুদ্ধ উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হবে।

5 কংগ্রেসের রামগড় অধিবেশন: কংগ্রেসের রামগড় অধিবেশনে (১৯৪০ খ্রি., মার্চ) লিনলিথগোর প্রস্তাব সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করা হয়। তাই রামগড় অধিবেশনে স্থির হয়- [i] সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে জাতীয় কংগ্রেস অংশ নেবে না। [ii] ডোমিনিয়নের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করা হবে। [iii] গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রতিনিধি নির্বাচনের মাধ্যমে গণপরিষদ গঠন করতে হবে। [iv] জাতীয় কংগ্রেস সাংগঠনিকভাবে নিজেদেরকে প্রস্তুত করবে এবং সংকট তৈরি হলে আইন অমান্য করবে।

6 মুসলিম লিগের লাহোর অধিবেশন: মুসলিম লিগ কংগ্রেসের গণপরিষদ গঠনের দাবি প্রত্যাখ্যান করে। লিগ আশঙ্কিত হয় এই ভেবে যে, প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে গণপরিষদ বা সংবিধান সভা গঠিত হলে জাতীয় কংগ্রেসের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব বা প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হবে। এ সময়কালে মুসলিম লিগের লাহোর অধিবেশনে মুসলিমদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র পাকিস্তান গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। ফলে জাতীয় রাজনীতি এক জটিল আবর্তে নিক্ষিপ্ত হয়।

7 সমালোচনা-

প্রথমত, এই প্রস্তাবে ভারতকে পূর্ণ স্বাধীনতাদানের ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো উল্লেখ ছিল না। বলা হয়েছিল যুদ্ধ শেষে ভারতকে ব্রিটিশ কমনওয়েলথের মধ্যে একটি ডোমিনিয়নের মর্যাদা দেওয়া হবে।

ই দ্বিতীয়ত, এই প্রস্তাবে সাংবিধানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এই অহেতুক প্রতিশ্রুতিদান আসলে জিন্নার পাকিস্তান দাবিকেই সমর্থন করেছিল বলা চলে। তাই এই প্রস্তাবকে কংগ্রেস হতাশাজনক বলে সমালোচনা করে।

৪ ফলাফল

• গান্ধিজির ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহ: জাতীয় কংগ্রেস দ্বারা আগস্ট প্রস্তাব। সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। বড়োলাট লিনলিথগোর ঘোষণায় আপত্তি – তুলে গান্ধিজি ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহের উদ্যোগ নেন। কংগ্রেস কার্যকরী সমিতির অনুমোদনের পর প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিগুলি এবং কংগ্রেসের সাধারণ কর্মীগণ ■ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশ নেয়।

উপসংহার: কংগ্রেস ছাড়াও লিগ-সহ অন্যান্য দলগুলিও ব্রিটিশের বিরোধিতা শুরু করে। ফলে জাতীয় রাজনীতিতে এক অচলাবস্থা তৈরি হল। জাতীয় রাজনীতির এই অচলাবস্থা দূর করার জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল এই প্রস্তাবের কিছু অংশ সংশোধন করে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ক্লিপস মিশনকে ভারতে পাঠান।

প্রশ্ন2. ক্লিপস মিশনের প্রস্তাবগুলি আলোচনা করো। ক্লিপস মিশনের ব্যর্থতার কারণগুলি ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: ক্লিপস মিশনের প্রস্তাবসমূহ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে জার্মানির আক্রমণের চাপে মিত্রশক্তির দেশগুলি বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। ভারতেও জাপানের আক্রমণের প্রবল সম্ভাবনা দেখা দেয়। এই জটিল পরিস্থিতিতে ভারতের ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর আর্থিক ও সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করে। যদিও কংগ্রেস এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়, ফলে এক রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে ক্রিপস মিশন ভারতে আসে (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ) ও এক প্রস্তাব পেশ করে যা ক্রিপস প্রস্তাব নামে পরিচিত।

স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্লিপস ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ভারতের বিভিন্ন স্তরের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এক সপ্তাহ ধরে আলোচনার পর ২৯ মার্চ একগুচ্ছ প্রস্তাব রাখেন, যা ‘ক্লিপস প্রস্তাব’ নামে পরিচিত। [1] যুদ্ধ শেষ হওয়ার অব্যবহিত পরেই ভারতে একটি যুক্তরাষ্ট্র (Union) প্রতিষ্ঠা করা হবে। [2] ওই যুক্তরাষ্ট্রকে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনাধিকার ‘ডোমিনিয়ন’-এর মর্যাদা দান করা হবে। [3] যুদ্ধশেষে ভারতীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত গণপরিষদ রচিত সংবিধান প্রবর্তন করা হবে। [4] অবিলম্বে ভারতীয় নেতৃবৃন্দকে বড়োলাটের শাসন পরিষদে অংশগ্রহণ ও আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলিতে প্রতিনিধি হিসেবে যোগদানের সুযোগ দেওয়া হবে। [5] সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার জন্য স্বতন্ত্র সংবিধান চালু হবে। [6] গণপরিষদ রচিত সংবিধান কোনো প্রদেশের পছন্দ না হলে সেই প্রদেশটি ভারতীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে নতুন সংবিধান রচনা করতে পারবে। [7] সংবিধান রচিত না হওয়া পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের নিরাপরার দায়িত্ব নেবে। বিনিময়ে তারা ভারতের সম্পদ যুদ্ধে- এ কাজে ব্যবহার করবে।

ক্লিপস প্রস্তাবের ব্যর্থতার কারণ

২১ মার্চ (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ) এক সাংবাদিক সম্মেলনে ক্লিপস যেমন খসড়া প্রস্তাবগুলি সর্বজন-সম্মুখে পেশ করেছিলেন, ঠিক তেমনি ১১ এপ্রিল আর- এক সাংবাদিক সম্মেলনে সেগুলি সরাসরি প্রত্যাহার করে নিয়ে লন্ডন যাত্রা ২৮ করেন।

1 পূর্ব স্বাধীনতাদানের অনুল্লেখ: এই প্রস্তাবটিতে পূর্ণ স্বাধীনতা- জানের কোনো উল্লেখ ছিল না। ব্রিটিশ সরকার, বিশেষত চার্চিলের অনিচ্ছুক এম মনোভাব এই প্রস্তাবকে ব্যর্থ করেছিল। তিনি কখনোই চাননি ভারত স্বাধীন ইহোক। আসলে এটি ছিল লোক-দেখানো কৌশলমাত্র।

2 সংবিধান সভাকেন্দ্রিক সমস্যা: ক্লিপস প্রস্তাবগুলিতে সংবিধান সভায় ভারতীয় প্রতিনিধিদের সরাসরি নির্বাচনের দ্বারা নিয়োগের কথা কিছু বলা হয়নি। এ ছাড়াও এই প্রস্তাবে সংবিধান সভাকে সার্বভৌম ক্ষমতা না দেওয়ায় হিন্দু মহাসভা, লিবারেল পার্টি প্রভৃতি দলও ক্লিপস প্রস্তাবের কঠোর সমালোচনা করে।

3 ভারত বিভাজনের ইঙ্গিত: ক্লিপস প্রস্তাবে দেশীয় রাজ্যগুলির ৯ কোটি মানুষের ভাগ্য দেশীয় রাজন্যবর্গের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। যা আসলে প্রচ্ছন্নভাবে ভারত বিভাজনেরই ইঙ্গিত দেয়। তাই জাতীয় কংগ্রেস এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে। গান্ধিজি এই প্রস্তাবের সমালোচনা করে বলেন- “এই প্রস্তাবটি ছিল একটি ফেলপড়া ব্যাংকের ওপর একটি আগামী তারিখের চেক কাটার শামিল” (A post dated cheque on a crashing bank)।

4 সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতার অভাব: ভারতের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীগুলির কাছে অর্থাৎ হিন্দু, শিখ, মুসলিম, অনুন্নত সম্প্রদায়- কারও কাছেই এই প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য ছিল না। তাই এই প্রস্তাব ব্যর্থ হয়েছিল।

3. কোন্ পরিস্থিতিতে ক্রিপস ভারতে আসে? ক্রিপসের প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে ভারতীয়দের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া হয়?

উত্তর: ক্লিপস মিশনের প্রেক্ষাপট

1 জাপানি আক্রমণ প্রতিরোধ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন (১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর) জাপান হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্ল হারবারে অবস্থিত মার্কিন যুদ্ধ জাহাজ ধ্বংস করে অক্ষশক্তির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করলে বিশ্বরাজনীতিতে এক গুরুতর পরিবর্তন ঘটে। একে একে ফিলিপিনস, ইন্দোচিন, ইন্দোনেশিয়া, মালয় ও বজ্রদেশ বিধ্বস্ত করে (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ) জাপান ভারতের নিকটে এসে হাজির হয়। এই পরিস্থিতিতে জাপানি আক্রমণের মোকাবিলায় ভারতবাসীর সক্রিয় সাহায্য লাভের আশায় ব্রিটিশ সরকার ব্যগ্র হয়ে ওঠে।

2 প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দের চাপ: মার্কিন রাষ্ট্রপতি বুজভেল্ট, ব্রিটেনের শ্রমিক দলের (Labour Party) নেতা ক্লিমেন্ট এটলি ও অন্যান্য ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ যুদ্ধে ভারতীয়দের সাহায্য নেওয়ার কথা বলেন। ভারতবাসীকে স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতা প্রদানের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি ঘোষণার জন্য তারা ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের চাপ দেন। চিনের রাষ্ট্রপতি চিয়াং কাই শেকও ভারতীয়দের স্বাধীনতার দাবিকে সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনার জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলকে অনুরোধ জানান।

3 ভারতের শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতে ব্রিটিশবিরোধী গণবিদ্রোহ শুরু হলে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা দেখা দেয়। অপরদিকে, মিত্রপক্ষভুক্ত ব্রিটিশ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গনে তার ঔপনিবেশিক শক্তিকে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিলে ভারতের সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এই লক্ষ্য নিয়েই যুদ্ধকালীন ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য, বিশিষ্ট সমাজসেবী ও খ্যাতনামা আইনজ্ঞ স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্লিপস তার একগুচ্ছ প্রস্তাব নিয়ে ভারতে আসেন।

প্রতিক্রিয়া

২৯ মার্চ (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ) এক সাংবাদিক সম্মেলনে ক্লিপস যেমন খসড়া প্রস্তাবগুলি সর্বজন সম্মুখে পেশ করেছিলেন, ঠিক তেমনই ১১ এপ্রিল আর এক সাংবাদিক সম্মেলনে সেগুলি সরাসরি প্রত্যাহার করে নিয়ে লন্ডন যাত্রা করেন।

1 কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়া: দেশবিভাগের সম্ভাবনাকে প্রশয় দেওয়ায় ক্রিপস প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে কংগ্রেস তা প্রত্যাখ্যান করে।

2 মুসলিম লিগের প্রতিক্রিয়া: লিগের প্রতিক্রিয়া ছিল অবশ্য দু- রকমের সন্তোষজনক, আবার হতাশাব্যঞ্জক। প্রদেশগুলিকে ভারত যুক্তরাষ্ট্রে যোগ দেওয়া বা না দেওয়ার স্বাধীনতা দেওয়ায় লিগ খুশি হলেও স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের, অর্থাৎ পাকিস্তান দাবি স্বীকৃত না হওয়ায় লিগ ক্লিপস প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।

3 শিখ সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া: ভারতীয় শিখ সম্প্রদায়ও ক্লিপস প্রস্তাব মেনে নিতে পারেনি। তাদের আশঙ্কা ছিল মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঞ্জাব ভারত থেকে আলাদা হয়ে গেলে শিখদের স্বার্থ বিপন্ন হয়ে পড়বে।

4 হরিজন সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া: হরিজন সম্প্রদায়ের নেতা আম্বেদকর এই ভেবে অসন্তোষ প্রকাশ করেন যে, ক্লিপস প্রস্তাব কার্যকরী হলে বর্ণহিন্দু সম্প্রদায়ের নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে।

5 ইঙ্গ-ভারতীয় ও ভারতীয় খ্রিস্টানদের প্রতিক্রিয়া: ইঙ্গ-ভারতীয় ও ভারতীয় খ্রিস্টান প্রভৃতি সম্প্রদায়ও এই প্রস্তাবের ফলে ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার অভাব বোধ করে। সমকালীন ভারতের রাজনৈতিক দলগুলি ক্রিপস প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করায় এই প্রস্তাব শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়। আসলে ভারতের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীগুলির কাছে অর্থাৎ হিন্দু, শিখ, মুসলিম, অনুন্নত সম্প্রদায়- কারুর কাছেই এই প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য ছিল না। তাই গান্ধিজি এই প্রস্তাবের সমালোচনা: র বলেন-“এই প্রস্তাবটি ছিল একটি ভেঙে পড়া ব্যাংকের ওপর আগামী বিদ্রোহীমে তারিখের চেক কাটার শামিল’ (A post dated cheque on a crashing bank)।

প্রশ্ন4 ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পটভূমি ও অগ্রগতির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।

উত্তর: ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পটভূমি

1 ক্লিপস প্রস্তাবের ব্যর্থতা: ক্লিপসের প্রস্তাবে ভারতবাসী অনুভব করেnযে-ইংরেজ সরকার কখনোই স্বেচ্ছায় তাদেরকে স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেবে না। তাই স্বাধীনতা পেতে হলে সরাসরি ইংরেজদের সঙ্গে সংগ্রামে লিপ্ত হওয়া ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ নেই।

2 ব্রিটিশ দমননীতি: শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের জবাব হিসেবে ব্রিটিশ সরকার তার সামরিকবাহিনী দ্বারা ভারতবাসীর ওপর যে অকথ্য নির্যাতন, অত্যাচার চালিয়ে আসছিল তাতে ভারতীয়রা বিক্ষুব্ধ হয়ে মুক্তির পথ খুঁজতে শুরু করেছিল।

3 দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনের তুলনায় খাদ্যের জোগান কম হওয়ায় মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। চালের খুচরো দাম বেড়ে হয় ৩০-৩৫ টাকা প্রতি মণ; কেরোসিন, কাপড়, ওষুধপত্র প্রভৃতি দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়ে। এই সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা ফায়দা তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার এই অপচেষ্টা আটকাতে তেমন উদ্যোগী হয়নি।

4 স্বাধীনতার তীব্র আকাঙ্ক্ষা: অসহযোগ, আইন অমান্য আন্দোলন ভারতবাসীর স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে তীব্রতর করে তুলেছিল। ভারতবাসী চেয়েছিল শেষবারের মতো এক সর্বভারতীয় গণ আন্দোলন গড়ে তুলে ব্রিটিশের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে।

5 শীর্ষ নেতাদের জঙ্গি মনোভাব: ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে দেশের শীর্ষ নেতাদের জঙ্গি মানসিকতা, বিশেষত গান্ধিজির অনমনীয় মনোভাব আর-একটি গণ আন্দোলনের পটভূমি রচনা করেছিল। গান্ধিজি দেশবাসীর উদ্দেশে ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’ মন্ত্র ঘোষণা করেন। জওহরলাল এ প্রসঙ্গে বলেছেন- “গান্ধিজিকে ইতিপূর্বে আর কখনও এতটা ব্রিটিশবিরোধী হতে দেখা যায়নি।”

 ভারত ছাড়ো আন্দোলনের অগ্রগতি বা প্রসার

জাতীয় নেতাদের গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎগতিতে আন্দোলন ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। “ইংরেজ তুমি ভারত ছাড়ো”

ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস আলোড়িত হতে থাকে।

1 বাংলায়: বাংলায় আগস্ট আন্দোলনের মূলকেন্দ্র ছিল কলকাতা, ঢাকা, মেদিনীপুর, হুগলি-সহ বিভিন্ন জায়গা। মেদিনীপুর জেলার তমলুক ও কাঁথি মহকুমায় এই আন্দোলন সবচেয়ে তীব্ররূপ ধারণ করেছিল। মাতঙ্গিনী হাজরার নাম এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। তমলুকে গঠিত হয় স্বাধীন তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার। এ ছাড়াও দিনাজপুর, বীরভূম, ফরিদপুর, বরিশাল, হাওড়া, হুগলি, বর্ধমান প্রভৃতি জেলাতেও আন্দোলন গণচরিত্র লাভ করে। দিনাজপুরের বালুরঘাটে জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।

2 বিছারে: বিহারের মুঙ্গের, ভাগলপুর, মুজাফফরপুর, পূর্ণিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে এই আন্দোলন তীব্ররূপ ধারণ করেছিল। ওইসব জায়গায় আন্দোলনকারীরা জাতীয় পতাকা তোলেন। উত্তর ভাগলপুরে এক জাতীয় সরকার গড়ে তোলা হয়। বিহারের ১০টি জেলার অন্তত ৮০ শতাংশ থানা জী। বিদ্রোহীদের দখলে চলে যায়। জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে এবং সিয়ারাম ও পরশুরাম নামক দুই বৈপ্লবিক দলের প্রভাবে আন্দোলন চরমে পৌঁছোয়।

3 যুক্তপ্রদেশে: যুক্তপ্রদেশের বালিয়া, আজমগড়, সুলতানপুর, জৌনপুর, গোরক্ষপুর প্রভৃতি জেলায় গান্ধিজির ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’ ধ্বনি জনগণকে স্বাধীনতালাভে ব্যাকুল করে। বালিয়া জেলায় চিতু পাণ্ডের নেতৃত্বে জাতীয় সরকার গড়ে ওঠে।

4 ওড়িশায়: ওড়িশার বালেশ্বর, তালচের, কোরাপুট, কটকে বিক্ষিপ্তভাবে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলনের পুরোভাগে ছিল ছাত্ররা। কোরাপুটে লক্ষ্মণ নায়েকের নেতৃত্বে উপজাতি কৃষকরা সক্রিয় হয়। তালচেরে ‘চাব্বি মল্লা রাজ’ কায়েম হয়।

5 অন্যান্য অঞ্চলে: মধ্যপ্রদেশের নাগপুর, অমরাবতী, বান্দ্রা, বেতুল ছিল এই আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র। মদনলাল বাগড়ি নাগপুর ‘হিন্দুস্থান রেড আর্মি’ গঠন করেন। আসামের গোয়ালপাড়া, তেজপুর, বরপোতা অঞ্চলে, কেরলের কালিকটে, মাদ্রাজের মাদুরায় এই আন্দোলনের রেশ ছড়িয়ে পড়ে।

প্রশ্ন5. ১৯৪২-এর আগস্ট আন্দোলন (ভারত ছাড়ো) সম্পর্কে যা জান লেখো। অথবা, ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন সম্পর্কে একটি নিবন্ধ লেখো।

সূচনা: সর্ববৃহৎ জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ভারত ছাড়ো বা আগস্ট আন্দোলন। এই আন্দোলন নিঃসন্দেহে ভারতবাসীর স্বাধীনতা লাভকে ত্বরান্বিত করে।

উত্তর: ১৯৪২-এর আগস্ট আন্দোলন

1 পটভূমি: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকায় ক্রিপস মিশনের আগমন ও প্রস্থান, ভারতবাসীর তীব্র স্বাধীনতা-আকাঙ্ক্ষা, মূল্যবৃদ্ধি, জাপানি আক্রমণের ভয়, ব্রিটিশ সেনাদের অত্যাচার সবকিছু মিলেমিশে এক ভবিষ্যৎ গণ আন্দোলনের পটভূমি রচনা করে।

2 আন্দোলনের সূচনা: বোম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ আগস্ট) নিখিল ভারত কংগ্রেস সমিতির বিপুল ভোটে গান্ধিজির ভারত ছাড়ো প্রস্তাব পাস হয়। ঘোষণা করা হয় ৯ আগস্ট থেকে ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হবে এবং ইংরেজ ভারত না ছাড়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে। গান্ধিজি জাতির উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেন- “ভারত স্বাধীন করব, অথবা মৃত্যুবরণ করব-‘Do or Die’ (করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে)।” নিখিল ভারত কংগ্রেস সমিতির অধিবেশন শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বোম্বাই রেলস্টেশন থেকে গভীর রাতে গান্ধিজি, জওহরলাল, প্যাটেল, আজাদ ও জে. বি. কৃপালনি-সহ শীর্ষ নেতাদের ব্রিটিশ গ্রেফতার করে। পরের দিন সকালে এই খবর প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভারত ছাড়ো বা আগস্ট আন্দোলন বিদ্যুৎ গতিতে ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।

3 বিস্তার

1. বাংলায়: বাংলায় আগস্ট আন্দোলনের মূলকেন্দ্র ছিল কলকাতা, ঢাকা, মেদিনীপুর, হুগলি-সহ বিভিন্ন জায়গায়। কলকাতা কার্যত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। মেদিনীপুর জেলার তমলুক ও কাঁথি মহকুমায় এই আন্দোলন সবথেকে তীব্র আকার ধারণ করে। তমলুকে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার গড়ে ওঠে।

ii. বিহার ও যুক্তপ্রদেশে: বিহারের মুঙ্গের, ভাগলপুর, মুজাফ্ফরপুর, পূর্ণিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে, যুক্তপ্রদেশের বালিয়া, আজমগড়, সুলতানপুর, জৌনপুর, গোরক্ষপুর প্রভৃতি জেলায় গান্ধিজির ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’ ধ্বনি জনগণকে স্বাধীনতালাভে ব্যাকুল করে।

iii. অন্যান্য অঞ্চলে: বোম্বাই, আমেদাবাদ, পুনা, নাগপুর, কানপুর-সহ বিভিন্ন অঞ্চলে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। বেনারস, পাটনা, কটক প্রভৃতি স্থানে আন্দোলনকারীরা যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। রাজস্থানের যোধপুর, উদয়পুর, জয়পুরে সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। পাঞ্জাব, সিন্ধু ও সীমান্ত প্রদেশে আন্দোলনকারীরা জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে।

4 নেতৃবৃন্দ: গান্ধিজির ডাকে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যাঁরা দক্ষতার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে জয়প্রকাশ নারায়ণ, অরুণা আসফ আলি, সুচেতা কৃপালনি, রামমনোহর লোহিয়া, অচ্যুৎ পট্টবর্ধন, অজয় মুখার্জি, যোগেশ চ্যাটার্জি, সুশীল ধাড়া, সরযূ পান্ডে, নানা পাতিল এবং আসামের ১৩ বছরের স্কুলছাত্রী কনকলতা বড়ুয়া ও মেদিনীপুরের তমলুকের ৭৩ বছরের বৃদ্ধা মাতঙ্গিনী হাজরা ছিলেন উল্লেখযোগ্য।

5 ব্রিটিশের দমননীতি: আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে গুলিচালনা, গ্রেফতার, জরিমানা, লাঠিচালনা, বেতের আঘাত এমনকি বিমান থেকে গোলাবর্ষণও করা হয়। সারা দেশে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর তাণ্ডব শুরু হয়।

6 ব্যর্থতার কারণ

1. শীর্ষ নেতৃত্বের অভাব: গান্ধিজি-সহ শীর্ষ নেতৃবৃন্দ কারারুদ্ধ থাকায় এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো উপযুক্ত নেতা ছিল না।

ii. ঐক্যের অভাব: মুসলিম লিগ, কমিউনিস্ট পার্টি, হিন্দু মহাসভা, কেউই আন্দোলন সফল করার জন্য কংগ্রেসকে সমর্থন করেনি। এই দলগত ঐক্যের অভাব আন্দোলনকে ব্যথ করে।

iii. ব্রিটিশের পীড়ন নীতি: ব্রিটিশের তীব্র দমননীতি আন্দোলনকে সফল হতে দেয়নি। দৈহিক নির্যাতন, গ্রেফতার, ঘর পুড়িয়ে দেওয়া, ধর্ষণ, এমনকি গুলি চালিয়ে ব্রিটিশ সরকার এই আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেয়।

iv. অসময়ে সূচনা: ভুল সময়ে এই আন্দোলন শুরু হওয়ায় আন্দোলন সফল হয়নি বলে মনে করা হয়। সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি থাকাকালীন এই আন্দোলনের সূচনা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু গান্ধি অনুগামীরা তখন তা অনুমোদন করেননি।

i. কংগ্রেসের মর্যাদাবৃদ্ধি: ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পর কংগ্রেসের মর্যাদা ও প্রভাব বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।

ii. সাম্প্রদায়িক ঐক্য: এই আন্দোলন সাম্প্রদায়িক ঐক্যকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করে।

উপসংহার: ১৯৪২-এর আন্দোলন যেভাবে জাতীয় জাগরণ ঘটিয়েছিল ইতিপূর্বে তা আর দেখা যায়নি।

প্রশ্ন6 ভারত ছাড়ো আন্দোলন ব্যর্থ হল কেন? ভারত আন্দোলনের গুরুত্ব আলোচনা করো।

উত্তর: ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ

1 উপযুক্ত শীর্ষ নেতৃত্বের অভাব: ভারত ছাড়ো আন্দোলন সম্পূর্ণরূপে গান্ধিজির নেতৃত্বের ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু আন্দোলন শুরু হওয়ার আগেই গান্ধিজি-সহ কংগ্রেসের সব শীর্ষনেতাকে কারারুদ্ধ করা হয়। গান্ধিজির অবর্তমানে সেই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো শীর্ষ নেতার অনুপস্থিতিতে এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়।

2 কমিউনিস্ট-সহ অন্যান্য দলের বিরোধিতা: ভারতের কমিউনিস্ট দল পরোক্ষভাবে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল। জাতীয় আন্দোলনের মূলস্রোত থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে তারা ব্রিটিশের সহযোগিতা করে। মুসলিম লিগ, অনুন্নত সম্প্রদায়, লিবারেল গোষ্ঠী, হিন্দু মহাসভা, র‍্যাডিক্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি এই আন্দোলনে সহযোগিতা করেনি। ফলস্বরূপ আন্দোলন ব্যর্থ হয়।

3 অসময়ে সূচনা: সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি থাকাকালীন এই আন্দোলনের সূচনা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু গান্ধি অনুগামীরা তখন তা করেননি। সেই আন্দোলন গান্ধিজি শুরু করেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে, যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গনে ইংল্যান্ড- সহ মিত্রপক্ষ সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। ফলে এই বিলম্ব আন্দোলনকে ব্যর্থ করে।

ভারত ছাড়ো বা আগস্ট আন্দোলনের গুরুত্ব

1 স্বাধীনতার অজেয় সংকল্প: ১৯৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলন ছিল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়। ব্রিটিশ শাসনের প্রতি ভারতবাসীর ঘনীভূত ক্ষোভ ও তা থেকে মুক্তির জন্য অজেয় সংকল্প এই বিদ্রোহে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। এই আন্দোলনে সমাজের গরিব শ্রেণির ডি অংশগ্রহণের সুন্দর বিবরণ রয়েছে সতীনাথ ভাদুড়ির ‘জাগরী’ এবং ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’-এই দুই উপন্যাসে।

2 সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা: মুসলিম লিগ এই আন্দোলনেযোগ না দিলেও উত্তরপ্রদেশ, বিহার, চট্টগ্রাম, শিলচর প্রভৃতি স্থানের বহুমু সলিম এই আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশ নেয়। আন্দোলন চলাকালে কোথাও কোনো সাম্প্রদায়িক বিরোধ বাধেনি। তাই সাম্প্রাদায়িক সম্প্রীতি ও হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ছিল এই আন্দোলনের এক বিশাল সম্পদ।

3 জাতীয় বিপ্লব: ৪২-এর আন্দোলনের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন- “নেতা নেই, সংগঠন নেই, উদ্যোগ আয়োজন কিছু নেই, কোনো মন্ত্রবল নেই, অথচ একটা অসহায় জাতি স্বতঃস্ফূর্তভাবে কর্মপ্রচেষ্টার আর কোনো পথ না পেয়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠল-এ দৃশ্য বাস্তবিকই বিস্ময়ের।” এই আন্দোলনকে তিনি ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের সঙ্গে তুলনা করেছেন। বড়োলাট লর্ড লিনলিথগোও এই আন্দোলনকে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের পর সবচেয়ে বড়ো বিদ্রোহ বলে উল্লেখ করেছেন। অরুণ চন্দ্র ভূঁইয়া তাঁর ‘The Quit India Movement’ গ্রন্থে বলেছেন যে, এই আন্দোলনের ফলে একটি অভূতপূর্ব জাতীয় জাগরণ ও জাতীয় ঐক্যবোধ গড়ে ওঠে।

4 স্বাধীনতা অর্জনের ভিত্তিস্থাপন: ৪২-এর আন্দোলনের গভীরতা ও ব্যাপকতা যে ভারতের স্বাধীনতার ভিত্তিভূমি রচনা করেছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। একদিকে যখন সুভাষচন্দ্রের সশস্ত্র বিপ্লবী তৎপরতায় ভারতের ব্রিটিশ সরকার আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল, ঠিক তখনই ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের তীব্রতা সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারের প্রশাসনিক ভিত্তিকে নড়বড়ে করে দিয়েছিল। এর ফলে ইংরেজরা ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত ছাড়তে বাধ্য হয়।

5 কংগ্রেসের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা: এই আন্দোলন থেকে সবচেয়ে লাভবান হয়েছিল জাতীয় কংগ্রেস। আন্দোলনকালে মহাত্মা গান্ধির অনশন জাতির হৃদয়ে কংগ্রেসের মর্যাদাকে পুনরায় অধিষ্ঠিত করে। কংগ্রেস নেতাদের দুঃখবরণ ও আত্মত্যাগ দেখে জাতি আপ্লুত হয়। সমাজবাদী কংগ্রেস নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ “Towards Struggle’ গ্রন্থে লেখেন, “The Congress alone is the country’s salvation.”

6 গণ আন্দোলন হিসেবে: এই আন্দোলনে শ্রমিক ও কৃষক-সহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি স্বতঃস্ফূর্তভাবে শামিল হয়ে একে গণ আন্দোলনের রূপদান করে। নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটিও এই আন্দোলনকে গণযুদ্ধ আখ্যা দিয়েছিল। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের মতে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে এ ধরনের ব্যাপক বিদ্রোহ ইতিপূর্বে আর কখনও সংঘটিত হয়নি। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘মন্ত্র মুখর’ উপন্যাসে আগস্ট বিপ্লব বা ভারত ছাড়ো আন্দোলনের গণজাগরণের চিত্র ধরা পড়ে।

প্রশ্ন7. ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রকৃতি আলোচনা করো। এই আন্দোলনের গুরুত্ব কী ছিল?

উত্তর: ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রকৃতি

1 গণবিদ্রোহ: ভারত ছাড়ো আন্দোলন ভারতের জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ গণবিদ্রোহ। এই বিদ্রোহে শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের নারীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিয়েছিল। বড়োলাট লিনলিথগো এই আন্দোলনের ব্যাপকতা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের পর এত বড়ো গণবিদ্রোহ ভারতে সংগঠিত হয়নি। ইতিহাসবিদ ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন “১৯৪২-এর গণবিদ্রোহ প্রকৃত অর্থেই ছিল সৈনিক যুদ্ধ। সেনাপতি দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন, কিন্তু সৈনিকদের ভূমিকা ছিল এনে গৌরবময় কারণ তাঁরা দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করে শহিদ বহু হয়েছেন।”

2 গণযুদ্ধ: ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে নিখিল ভারত কংগ্রেস এক কমিটি আগস্ট আন্দোলনকে গণযুদ্ধ বলে স্বীকার করে নেয়। এই আন্দোলনকে ভারতের মুক্তিসংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায় বলা যায়। অধ্যাপক শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘পলাশী থেকে পার্টিশান’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন “ফরওয়ার্ড ব্লক, এ. আই. টি. ইউ. সি., সি. এস. পি এবং এ. আই. কে. এস- এর মতো কংগ্রেস অনুমোদিত ও সহযোগী সংগঠনগুলির পরিচালনায় গত দুই দশকের উগ্র আন্দোলনগুলি গণ অভ্যুত্থানের অনুকূল ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।” সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের মতে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে এধরনের ব্যাপক বিদ্রোহ ইতিপূর্বে আর কখনও সংঘটিত হয়নি।

3 অহিংস আন্দোলন থেকে বিচ্যুতি: গান্ধিজির অহিংস আদর্শ নীতি মেনে ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হলেও শেষপর্যন্ত এই আন্দোলন ■ অহিংস আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়। এই পর্বে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস কার্যকরী সমিতির অধিবেশনেও স্বীকার করা হয় যে বহু স্থানেই জনতা কংগ্রেসের গৃহিত অহিংস নীতি থেকে সরে গিয়েছিল। শুধুমাত্র সাধারণ মানুষই নয়, গান্ধিবাদে সমর্থনকারী জাতীয় নেতাদের অনেকেই সহিংস পন্থা মেনে আন্দোলন পরিচালনা করেন। তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারে স্বরাষ্ট্র সমরমন্ত্রী ও জাতীয় সেনাদলের সর্বাধিনায়ক সুশীলকুমার ধাড়া নিজের আত্মজীবনী গ্রন্থ। ‘প্রবাহ’-তে লেখেন “মেদিনীপুর জেলায় ইংরেজ সরকারের সব কিছু মুছে পুছে দেব। তাতে যে জাতীয় হিংসা হবে বা অহিংসা থেকে বিচ্যুতি হবে তাকে গ্রাহ্য করা হবে না। যেমন-থানা পুড়িয়ে দেওয়া, রাস্তা কেটে বা পুল উড়িয়ে বা ট্রেনলাইন উঠিয়ে পথ অবরোধ করা। থানা বা সরকারি ঘাঁটিতে আগুন দিলে যদি কেউ বা পুড়ে মরে তাকে হিংসা বলে ধরার দরকার নেই।’

4 জাতীয়তাবাদী আন্দোলন: ভারত ছাড়ো আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সারা ভারতজুড়ে এক জাতীয় জাগরণ শুরু হয়। ভারত থেকে ব্রিটিশদের বিতাড়নের লক্ষ্যে সকল ভারতবাসী এক জাতি এক প্রাণ হয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করে। সাধারণ কংগ্রেসকর্মী ছাড়াও ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, ছোটো ব্যবসায়ী ও কারিগরাও একত্রিত হয়ে এই আন্দোলনে সামিল হয়। এই আন্দোলন প্রমাণ করে যে স্বাধীনতার জন্য আপামর ভারতবাসী সবধরনের অত্যাচার লাঞ্ছনা মেনে নিতে এমনকি মৃত্যুবরণ করতেও প্রস্তুত। বড়োলাট লিনলিথগো স্বীকার করেছিলেন যে, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহের পর ইংরেজরা এর থেকে বড়ো সরকার বিরোধী কোনো প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়নি। জওহরলাল নেহরু বলেছেন-“নেতা নেই, সংগঠন নেই, উদ্যোগ-আয়োজন কিছু নেই, কোনো মন্ত্র বলা নেই, অথচ একটা অসহায় জাতি স্বতঃস্ফূর্তভাবে কর্মপ্রচেষ্টার অন্য কোনো পথ না পেয়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠল-এ সত্যই বিস্ময়ের ব্যাপার।’

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের গুরুত্ব

TOPIC A-এর 6 নং রচনাধর্মী প্রশ্নের উত্তরের ‘ভারত ছাড়ো বা আগস্ট আন্দোলনের গুরুত্ব’ শীর্ষক অংশটি দ্যাখো।

8. ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ঐতিহাসিক তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো এবং এই আন্দোলনে মহিলাদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো। 

উত্তর: ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ঐতিহাসিক তাৎপর্য

TOPIC [A]-এর 6 নং রচনাধর্মী প্রশ্নের উত্তরের ‘ভারত ছাড়ো বা আগস্ট আন্দোলনের গুরুত্ব’ শীর্ষক অংশটি দ্যাখো।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনে মহিলাদের অংশগ্রহণ

 ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ভারত জুড়ে শুরু হয় ব্রিটিশবিরোধী ভারত ছাড়ো আন্দোলন। এই আন্দোলনে নারীরা বিপুলভাবে অংশগ্রহণ করে।

1 অংশগ্রহণের প্রকৃতি: ভারত ছাড়ো আন্দোলনে শহরের নারীরা ছাড়াও গ্রামের নারীরা সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত নারীরা প্রকাশ্যে এই আন্দোলনে অংশ নেয়। পাশাপাশি বাংলার মেদিনীপুর-সহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে কৃষক পরিবারের রমণীরাও এই আন্দোলনে যোগ দেন। আসামে ১৩ বছরের কিশোরী কনকলতা বড়ুয়া, পাঞ্জাবের গৃহবধূ ভোগেশ্বরী ফুকোননি, নাগাভূমিতে রানি গুইডালো প্রমুখ এই আন্দোলনে যোগ দিয়ে সাহসী ভূমিকা পালন করেন।

2 নেতৃত্ব: ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নারীরা সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দেন। বাংলার মেদিনীপুরের তমলুকে থানা দখলে নেতৃত্ব দেন কৃষক পরিবারের বিধবা বৃদ্ধা মাতঙ্গিনী হাজরা। উত্তর ভারতে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন অরুণা আসফ আলি ও সুচেতা কৃপালিনী। ঊষা মেহতা বোম্বাইয়ে গোপন বেতারকেন্দ্র গড়ে তোলেন ও এই আন্দোলনের সপক্ষে প্রচার চালান। বাংলায় এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন লীলা রায়। অরুণা আসফ আলি বোম্বাইয়ে আগস্ট ক্লান্তি ময়দানে তেরঙ্গা পতাকা তোলেন।

3 সংগ্রামী রূপ: নারীসমাজ এই প্রথম জাতীয় আন্দোলনে তীব্র সংগ্রামী রূপ ও মানসিকতা নিয়ে আবির্ভূত হয়। আন্দোলন চলাকালে নারীরা পুরুষদের সঙ্গে সমানভাবে তাল মিলিয়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শুধু তাই নয়, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী পুরুষদের মতো নারীরাও সমানভাবে ব্রিটিশদের অত্যাচার ও নিপীড়নের শিকার হয়।

4 গুরুত্ব: প্রথমত, ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ সমগ্র নারীসমাজকে স্বাধীনতা লাভের প্রশ্নে আগ্রহী করে তোলেন। দ্বিতীয়ত, সমাজের প্রায় সকল স্তরের নারীদের অংশগ্রহণের ফলে এই আন্দোলন সর্ববৃহৎ গণ আন্দোলনের রূপ নেয়। তৃতীয়ত, নারীদের অংশগ্রহণের জন্যই ভারতবাসীর স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়ে ধরা পড়ে, যার প্রভাব পড়ে ব্রিটিশ প্রশাসনের ওপরেও।

প্রশ্ন9. ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সামাজিক ভিত্তি আলোচনা করো।

উত্তর: ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সামাজিক ভিত্তি

1 শ্রমিকদের ভূমিকা: শ্রমিকশ্রেণি সক্রিয়ভাবে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দিয়ে এই আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তুলেছিল। [i] আমেদাবাদের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলির শ্রমিকরা তীব্র প্রতিবাদ গড়ে তোলে এবং কারখানাগুলিকে ৩ মাস বন্ধ করে রাখে। [ii] জামশেদপুরে প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক কংগ্রেসি নেতৃবৃন্দের পরিচালনায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে শামিল হয়। [iii] আমেদাবাদে সুতাকলের শ্রমিকরাও সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। [iv] বাংলার হাওড়া, কলকাতা, হুগলি ও মেটিয়াবুরুজের বস্ত্র শিল্প ও ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প কারখানাগুলির শ্রমিকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধর্মঘট ডাকে।

2 কৃষকদের ভূমিকা: ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দিয়ে কৃষকরা গৌরবজনক ভূমিকা পালন করেছিল। মধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক কৃষক এমনকি খেতমজুররাও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগদান করে ও এই আন্দোলনকে জঙ্গি রূপ দেয়। [i] বিহারের পালামৌ জেলার কৃষকরা আগস্ট আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। [ii] বোম্বাইয়ে খান্দেশ ও সাঁতারার কৃষকরা এই আন্দোলনে শামিল হয়। [iii] বাংলার মেদিনীপুর জেলার কাঁথি ও তমলুকের কৃষকরা ব্রিটিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তমলুক থানা দখল করতে গিয়ে শহিদ হন বৃদ্ধা মাতঙ্গিনী হাজরা। [iv] বীরভূম, ঢাকা, ফরিদপুর, বরিশাল, দিনাজপুর, বর্ধমান, হুগলি, হাওড়া প্রভৃতি জেলার কৃষকগণও স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আন্দোলনকে গণমুখী করে তোলে। তাই ম্যাক্স হারকোট বলেছেন-“এই আন্দোলন ছিল মূলত কৃষক বিদ্রোহ, জাতীয় বিদ্রোহ নয়।’

3 নারীদের ভূমিকা: ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় বেশিরভাগ জাতীয় নেতা কারারুদ্ধ ছিলেন। তাই প্রথম কোনো জাতীয় আন্দোলনে নারীরা সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দেন। বোম্বাইয়ে অরুণা আসফ আলি এবং ঊষা মেহতা, আসামে কনকলতা বড়ুয়া, পাঞ্জাবে রাজকুমারী অমৃতা কাউর ও ভোগেশ্বরী ফুকোননী, বাংলার মেদিনীপুরে মাতঙ্গিনী হাজরা, করাচিতে হেম কালানি, ঢাকায় আশালতা সেন, সুচেতা কৃপালানী প্রমুখ এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এই সময় আন্দোলনের প্রচারকাজ পরিচালনার জন্য গোপনে বেতার কেন্দ্র চালানো হত। এই বেতার কেন্দ্র পরিচালনার ভার নেন ঊষা মেহতা। মেদিনীপুরে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার গঠিত হলে তার সঙ্গে যুক্ত নারীরা এক সামরিক সংগঠন গঠন করে যা ভগিনী সেনা নামে পরিচিত। গান্ধিবুড়ি নামে খ্যাত তিয়াত্তর বছরের মাতঙ্গিনী হাজরা কুড়ি হাজার নারীকে নিয়ে গঠিত এই সেনাদলকে নেতৃত্ব দেন। ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি বাংলার দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। অরুণা আসফ আলি নারীদের নিয়ে বৈপ্লবিক কাজকর্ম সংগঠিত করেন।

4 ছাত্রদের ভূমিকা: ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হলে ছাত্র সমাজ সর্বশক্তি নিয়ে এই আন্দোলন পরিচালনা করে। কলকাতায় ও ঢাকায় ব্যাপক ছাত্র ধর্মঘট শুরু হলে পুলিশ ছাত্রদলের ওপর বর্বর আক্রমণ চালায়। মেদিনীপুরের কাঁথি, তমলুক, মহিষাদল, নন্দীগ্রাম প্রভৃতি অঞ্চলে আন্দোলন জঙ্গি রূপ ধারণ করে। আন্দোলনকারীরা থানা ও সরকারি ভবন দখল করে এবং রেললাইন ও টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়। পূর্ব বাংলার ফরিদপুর, বরিশাল, ময়মনসিংহ, যশোহর, খুলনা ইত্যাদি অঞ্চলে ছাত্ররা একটানা ধর্মঘট পালন করে। বাংলার পুলিন সেন, উপেন জানা, বীরেন মাল, গোরাচাঁদ ঘোড়ুই প্রমুখ ছাত্ররা অনুভব করেন যে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মোকাবিলার জন্য অস্ত্র প্রয়োজন। উত্তরপ্রদেশের বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ভারত ছাড়ো আন্দোলন প্রসারের লক্ষ্যে উত্তরপ্রদেশের গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে। এলাহাবাদ, বারাণসী, কানপুর, লখনউ প্রভৃতি অঞ্চলে ছাত্র আন্দোলন জঙ্গি রূপ নেয়। মহারাষ্ট্রের আহম্মদনগর, গুজরাটের আমেদাবাদ, বোম্বাই-সর্বত্র ছাত্ররা ব্যাপকভাবে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশ নেয়।

5 মুসলিম সম্প্রদায়ের ভূমিকা: ভারত ছাড়ো আন্দোলনে মুসলিম সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ আশানুরূপ ছিল না। মুসলিম লিগ বোম্বাই অধিবেশনে (১৯৪২ খ্রি.) এই আন্দোলনের নিন্দা করে। লিগ নেতা মহম্মদ আলি জিন্না এই আন্দোলন থেকে মুসলিম সম্প্রদায়কে দূরে থাকার নির্দেশ দেন। তা সত্ত্বেও মুসলিম সমাজের বেশ কিছু মানুষ এই আন্দোলনে যোগ দেয়। লিগের বহু কর্মী গোপনে আন্দোলন পরিচালনায় সহায়তা করেন। তবে এক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল আন্দোলনের সময় কোনো হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়নি বা লিগ কর্মীরা ইংরেজদের হয়ে গুপ্তচরের কাজ করেনি।

6 সরকারি কর্মীদের ভূমিকা: ভারতের ব্রিটিশ প্রশাসনের বিভিন্ন পদে নিযুক্ত কর্মচারীরা ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যথেষ্ট সাড়া দিয়েছিল। পুলিশকর্মীরাও গোপনে আন্দোলনকে নানাভাবে সহায়তা করেছিল।

প্রশ্ন10. ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সামাজিক ভিত্তি আলোচনা করো। এই আন্দোলনের গুরুত্ব লেখো।

 ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সামাজিক ভিত্তি

Topic [A] -এর 9 নং রচনাধর্মী প্রশ্নের উত্তরের 1, 2, 3 ও 4 নং পয়েন

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের গুরুত্ব

Topic [A] -এর 6 নং রচনাধর্মী প্রশ্নের উত্তরের ‘ভারত ছাড়ো বা আগস্ট আন্দোলনের গুরুত্ব’ শীর্ষক অংশের 2, 3, 4 ও 5 নং পয়েন্ট দ্যাখো।

প্রশ্ন11. ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সুভাষচন্দ্র বসুর ভূমিকা কী ছিল? অথবা, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সুভাষচন্দ্র বসুর অবদান পর্যালোচনা করো। [HS ’18]

উত্তর: ভূমিকা: ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস যাঁর নামটি এক বিশাল জ্যোতিষ্কের মতো চিরদিন ভাস্বর হয়ে থাকবে তিনি হলেন সুভাষচন্দ্র বসু। দুঃসাধ্যের সাধক, দুর্গম পথের নির্ভীক এই যাত্রীকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ আশীর্বাদ করে বলেছিলেন- “সুভাষচন্দ্র, বাঙালি কবি আমি, বাংলা দেশের হয়ে তোমাকে দেশনায়কের পদে বরণ করি।”

স্বাধীনতা সংগ্রামে সুভাষচন্দ্রের ভূমিকা

1 রাজনীতিতে অংশগ্রহণ: ছাত্রজীবন থেকেই সুভাষচন্দ্র ইংরেজ শাসনবিরোধী এক তীব্র মনোভাব পোষণ করতেন। তাই তিনি ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের লোভনীয় চাকরিকে প্রত্যাখ্যান করেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের অনুপ্রেরণায় তিনি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। কংগ্রেসের মধ্যে – যে বামপন্থী চিন্তাধারার অনুপ্রবেশ ঘটে তাতে জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে তিনিও নেতৃত্ব দেন।

2 গান্ধিজির সঙ্গে মতবিরোধ: ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে হরিপুরা কংগ্রেসে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। সুভাষচন্দ্রের সংগ্রামী দৃষ্টিভঙ্গি গান্ধিজি ও – তাঁর অনুগামীদের ক্ষুদ্ধ করে। গান্ধিজি ত্রিপুরি কংগ্রেসে (১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দ) সভাপতি হিসেবে পট্টভি সীতারামাইয়ার নাম প্রস্তাব করেন। কিন্তু সুভাষচন্দ্র পুনরায় সভাপতি নির্বাচিত হন। এতে গান্ধিজি ও তাঁর সমর্থকরা সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে কোনোরকম সহযোগিতা না করার সিদ্ধান্ত নেন। ফলে বাধ্য হয়ে সুভাষচন্দ্র সভাপতির পদ ত্যাগ করেন। জাতীয় আন্দোলনকে গতিশীল ও সংগ্রামমুখী করে তুলতে তিনি ফরওয়ার্ড ব্লক নামে একটি নতুন দল গঠন করেন (২২ জুন, ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দ)। পরিণতি হিসেবে সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হন।

3 ভারত ত্যাগ: ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সুভাষের যুদ্ধবিরোধী মনোভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে ব্রিটিশ তাঁকে ভারত রক্ষা আইন-এ গ্রেফতার করে (২ জুলাই, ১৯৪০ খ্রি.)। মুক্তির দাবিতে সুভাষ কারাগারের মধ্যেই আমৃত্যু অনশন করেন। স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটলে পুলিশ তাঁকে স্বগৃহে অন্তরিন করে রাখে (৫ ডিসেম্বর, ১৯৪০ খ্রি.)। কিন্তু ব্রিটিশের কড়া প্রহরা এড়িয়ে, জিয়াউদ্দিনের ছদ্মবেশে সুভাষ দেশত্যাগ করেন (১৭ জানুয়ারি, ব্রি ১৯৪১ খ্রি.)। 

4 জার্মানিতে কার্যকলাপ: দিল্লি ১ আফগানিস্তানের থেকে সুভাষ পৌঁছোন কাবুলে। কাবুল থেকে তিনি রাশিয়ায় যান ভারতবাসীর বাধীনতালাভে রুশ সাহায্যের লক্ষ্যে। কিন্তু বুশ রাষ্ট্রপ্রধান স্টালিন এসময় এশিয়ার ওপর কয়েছিনির সম্ভাব্য আক্রমণের পরিস্থিতিতে ইংটোলিন এসময় * মিত্রতা আশা করেছিলেন। তাই সাহায্যের কোনো আশ্বাস না পেয়ে তিনি ছি বিমানযোগে জার্মানির বার্লিনে চলে আসেন (২৮ মার্চ, ১৯৪১ খ্রি.)। বার্লিনে সহযোগিতায় ব্রিটিশবিরোধী প্রচার ও বন্দি ৪০০ ভারতীয় সেনাদের নিয়ে একটি মুক্তি সেনা গঠনের প্রয়াস চালাতে থাকেন। জার্মানির বিদেশ দাওনিয়ে তথ্যকেন্দ্রের সহায়তায় সুভাষচন্দ্র গঠন করেন ওয়ার্কিং গ্রুপ ইন্ডিয়া, যা পরে ‘স্পেশাল ইন্ডিয়া ডিপার্টমেন্ট’-এ রূপান্তরিত হয়। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের শেষার্ধে সুভাষচন্দ্র বার্লিনে গিরিজা মুখার্জি, এম. আর. ব্যাস, এ. সি. এন. নাম্বিয়ার-সহ ২০ জন ভারতীয়কে নিয়ে গঠন করেন ‘ফ্রি ইন্ডিয়া সেন্টার’। এর মুখপত্র হয় * ইংরেজি ও হিন্দি দ্বিভাষিক পত্রিকা ‘আজাদ হিন্দ’। জার্মানির হাতে বন্দি ভারতীয় সৈন্যদের নিয়ে সুভাষ ‘ইন্ডিয়ান লিজিয়ন’ বা ‘ফ্রি ইন্ডিয়া আর্মি’ নামে এক সেনাদল গঠন করেন (ডিসেম্বর, ১৯৪২ খ্রি.)। এটাই ছিল আজাদ হিন্দ -” ফৌজ গঠনের প্রথম পরিকল্পনা। ‘উল্লম্ফনকারী ব্যাঘ্র’ ছিল সেনাবাহিনীর প্রতীক। এই সেনাদল, সুভাষচন্দ্রের দেশপ্রেম ও বিপ্লবী আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে সর্বপ্রথম তাঁকে নেতাজি অভিধায় ভূষিত করে এবং ‘জয়হিন্দ’ ও ধ্বনি দিয়ে অভিবাদন জানায়। ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামকে গতিশীল করে – তোলার উদ্দেশ্যে তিনি ‘আজাদ হিন্দ রেডিয়ো’, ‘ন্যাশনাল কংগ্রেস রেডিয়ো’ ও আজাদ মুসলিম রেডিয়ো’ নামে তিনটি গোপন প্রচার কেন্দ্র থেকে ফারসি, ইংরেজি, হিন্দি, গুজরাতি, বাংলা ভাষাতে নিয়মিত প্রচারের ব্যবস্থা করেছিলেন।

5 জাপানি সরকারের প্রতিশ্রুতি আদায়: এদিকে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের – জুন মাসে জার্মানির হঠাৎ রাশিয়া আক্রমণ এবং ওই বছর ৭ ডিসেম্বর ব্রিটেন ও আমেরিকার বিরুদ্ধে জাপানের যুদ্ধ ঘোষণায় বিশ্বযুদ্ধের পট পরিবর্তন ঘটে। সুভাষচন্দ্র উপলব্ধি করেন যে ভারতের মুক্তি প্রচেষ্টায় জাপানি সহযোগিতাই অধিকতর কার্যকারী হবে। ঠিক এই সময় জাপান-প্রবাসী বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সুভাষচন্দ্র ৩ মাসের অধিক সময় ধরে এক দুঃসাহসিক সাবমেরিন অভিযান শেষে টোকিও উপস্থিত হন (১৩ জুন, ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ)। ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নে সুভাষচন্দ্র পরপর দু-বার জাপানি প্রধানমন্ত্রী হিদেকি তোজো (Hideki Tojo)-র সঙ্গে দেখা করেন। জাপানের আইনসভা ডায়েট (Diet)-এ সুভাষচন্দ্রের উপস্থিতিতে তোজো ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য জাপানের তরফে সুভাষকে নিঃশর্ত সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে জাপানি সরকারের সর্বতোভাবে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি নিয়ে সুভাষচন্দ্র সিঙ্গাপুরে যান।

6 আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠা: সিঙ্গাপুরে ৪ জুলাই রাসবিহারী সুভাষচন্দ্রের হাতে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স লিগ বা ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘের দায়িত্বভার অর্পণ করেন। পরে ২৫ আগস্ট নেতাজি আনুষ্ঠানিকভাবে আজাদ হিন্দ ফৌজ-এর সর্বাধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন এবং ২১ অক্টোবর আজাদ হিন্দ সরকার নামে অস্থায়ী ভারত সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর আজাদ হিন্দ সরকার ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।

7 দিল্লি অভিযান: ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে ৪ জানুয়ারি নেতাজি রেঙ্গুনে এসে তাঁর সামরিক দপ্তর স্থাপন করেন। ইতিমধ্যে আজাদ হিন্দ ফৌজ পাঁচটি ব্রিগেডে বিভক্ত হয়ে যায়, যথা-গান্ধি ব্রিগেড, আজাদ ব্রিগেড, নেহরু

ব্রিগেড, সুভাষ ব্রিগেড, ঝাঁসির রানি ব্রিগেড। সুভাষচন্দ্র সেনাদলের সামনে ধ্বনি দেন ‘দিল্লি চলো’। জাপানি নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায়, নেতাজির বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এবং উজ্জীবনী মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে আজাদ হিন্দ বাহিনী প্রবল বিক্রমে যুদ্ধ চালায়। তারা মণিপুরের কোহিমা শহরটি দখল করে (৬ এপ্রিল, ১৯৪৪ খ্রি.) জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে এবং রাজধানী ইম্ফল দখলের জন্য অগ্রসর হয়। শেষ পর্যন্ত বিশ্বযুদ্ধে জাপান তথা অক্ষশক্তির পরাজয় আসন্ন হয়ে পড়লে আজাদ হিন্দ সেনাদল দিল্লি পর্যন্ত পৌঁছোতে ব্যর্থ হয়।

মূল্যায়ন: সুভাষচন্দ্র ও তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ ও সংগ্রাম তাৎক্ষণিক বিচারে ভারতকে স্বাধীন করতে পারেনি সত্য, কিন্তু তাঁর পরিকল্পনা, দেশপ্রেম, আদর্শ ও আত্মত্যাগ স্বাধীনতা অর্জনের পথকে যে প্রশস্ত ও সুগম করেছিল এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

প্রশ্ন12. আজাদ হিন্দ বাহিনীর প্রেক্ষিতে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সুভাষচন্দ্র বসুর অবদান আলোচনা করো।

 অথবা, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও তাঁর নেতৃত্বাধীন আজাদ হিন্দ ফৌজের অবদান উল্লেখ করো।

অথবা, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে সুভাষচন্দ্র বসু ও আজাদ হিন্দ বাহিনীর অবদান লেখো।

ভূমিকা: আজাদ হিন্দ সেনারা দিল্লি পর্যন্ত পৌঁছোতে পারেনি ঠিকই, কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে আজাদ হিন্দ বাহিনীর অবদান ভারতের ইতিহাসের পাতায় চিরকাল সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে।

উত্তর: আজাদ হিন্দ বাহিনীর প্রেক্ষিতে সুভাষচন্দ্রের অবদান

1 সুভাষচন্দ্রের দেশত্যাগ: ভারত রক্ষা আইনে গ্রেফতার করে (১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ২ জুলাই) পরে সুভাষচন্দ্রকে কলকাতার এলগিন রোডে তাঁর নিজের ঘরে অন্তরিন রাখা হয় (১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে ৫ ডিসেম্বর)। ব্রিটিশের কড়া প্রহরা এড়িয়ে মহম্মদ জিয়াউদ্দিনের ছদ্মবেশে সুভাষচন্দ্র দেশত্যাগের জন্য বেরিয়ে পড়েন।

2 বিদেশের সাহায্যলাভের প্রচেষ্টা

i . রাশিয়ায়: সুভাষচন্দ্র ‘সিনর অরল্যান্ডো ম্যাৎসোটা’ ছদ্মনাম নিয়ে কাবুল থেকে বার্লিন যাওয়ার পথে মস্কোতে কিছুদিন অবস্থান করেন। মস্কোয় তিনি রুশ নেতাদের কাছে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু রুশ রাষ্ট্রপ্রধান স্টালিনের কাছ থেকে কোনোরকম সহযোগিতার আশ্বাস পাননি।

ii. জার্মানিতে: সুভাষচন্দ্র এরপর বিমানযোগে জার্মানির বার্লিনে এসে পৌঁছোন (১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ২৮ মার্চ)। বার্লিনে তিনি গিরিজা মুখার্জি, এম.আর. ব্যাস ও এ. সি. এন. নাম্বিয়ার-সহ ২০ জন ভারতীয়কে নিয়ে গড়ে তোলেন ‘ফ্রি ইন্ডিয়া সেন্টার’। পরবর্তী কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ইউরোপ ও উত্তর আফ্রিকায় ভারতীয় যুদ্ধবন্দিদের নিয়ে গঠন করেন ‘ইন্ডিয়ান লিজিয়ন’ বা ‘ফ্রি ইন্ডিয়া আর্মি’ (১৯৪২ খ্রি.)। সুভাষচন্দ্র হিটলারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিবেনট্রপ-এর সঙ্গে দেখা করেন ও ভারতীয় মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে এক পরিকল্পনা পেশ করেন। জার্মান সরকার সুভাষচন্দ্রের পরিকল্পনার অন্যান্য শর্তগুলি মেনে নিলেও ভারতের স্বাধীনতা সম্পকিত বিষয়ে কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে রাজি হয়নি।

iii. জাপানে: সুভাষচন্দ্র জাপানের প্রধানমন্ত্রী মার্শাল তোজোর আমন্ত্রণে জাপান যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

[a] অনুপ্রবেশ: সুভাষচন্দ্র জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুঃসাহসিক সাবমেরিন অভিযানে প্রায় কয়েক হাজার মাইল পথ অতিক্রম করে জাপানের টোকিও-তে এসে পৌঁছোন (১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ১৩ জুন)। সেখানে তিনি প্রধানমন্ত্রী তোজোর সঙ্গে দেখা করলে জাপানি পার্লামেন্ট ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সর্বতোভাবে সহায়তাদানের নীতি ঘোষণা করে। শুরু হয় সুভাষের স্বপ্নের অভিযান।

[b] আই. এন. এ.-এর নেতৃত্ব গ্রহণ: ব্যাংকক শহরে এক সম্মেলনে (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জুন) রাসবিহারীর সভাপতিত্বে গড়ে ওঠে ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘ বা ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স লিগ। এরপর ক্যাপটেন মোহন সিং-এর সক্রিয় সহযোগিতায় ২৫ হাজার ভারতীয় সেনা (পরে বেড়ে হয় ৪০ হাজার) নিয়ে ভারতীয় জাতীয় বাহিনী (Indian National Army) বা আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠিত হয়। সুভাষচন্দ্র জাপানে এলে রাসবিহারি বসু সুভাষকে ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স লিগের দায়িত্ব গ্রহণের আহ্বান জানান। সুভাষচন্দ্র সেই ডাকে সাড়া দিয়ে সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় রাসবিহারী বসুর হাত থেকে নেতৃত্ব গ্রহণ করেন (১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২৫ আগস্ট)।

[c] আই. এন. এ.-এর পুনর্গঠন: আজাদ হিন্দ বাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণ করার পর সুভাষচন্দ্র একে নতুন করে সাজিয়ে তোলেন। আজাদ হিন্দ বাহিনীকে তিনি গান্ধি ব্রিগেড, আজাদ ব্রিগেড, নেহরু ব্রিগেড প্রভৃতি ব্রিগেডে ভাগ করেন। বালক, বালিকাদের নিয়ে ‘বাল-সেনাদল’ এবং নারীদের নিয়ে ‘ঝাঁসির রানি ব্রিগেড’ গঠিত হয়। প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও শেষপর্যন্ত অনুগামীদের অনুরোধে নেতাজি নিজের নামে ‘সুভাষ ব্রিগেড’ গঠন করেন।

[d] আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠা: ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২১ অক্টোবর নেতাজি আজাদ হিন্দ সরকার গঠন করার কথা ঘোষণা করেন।

[e] সরকারের লক্ষ্য: নেতাজি ঘোষণা করেন আজাদ হিন্দ সরকারের প্রধান লক্ষ্য হল ভারত থেকে ব্রিটিশ শাসনের উৎখাত করা।

3 ভারত অভিযান: ২৩ অক্টোবর ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে আজাদ হিন্দ সরকার ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। নেতাজি রেঙ্গুনে তাঁর প্রধান সামরিক দপ্তর গড়ে তোলেন ও শুরু করেন তাঁর বহু কাঙ্ক্ষিত ভারত অভিযান। বীর আজাদ হিন্দ সেনারা তাইপোং থেকে যাত্রা শুরু করে পাহাড়, পর্বত নদী টপকে প্রায় ৪০০ মাইল পথ পায়ে হেঁটে ভারত সীমান্তের দিকে পাড়ি দেন। কক্সবাজার থেকে ৫০ মাইল দূরে মৌডক নামক স্থানে ব্রিটিশ ঘাঁটি লক্ষ্য করে আক্রমণ চালায় আজাদ হিন্দ সেনারা। ক্যাপটেন সুরজমলের নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ সেনারা মৌডক জয় করে। অবশেষে কোহিমা পর্যন্ত এসে ভারতের মাটিতে তেরঙা নাসার ল জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে (৬ এপ্রিল, ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দ)।

4 আত্মত্মসমর্পণ: অবশেষে জাপান মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করলে সমাবর্তে (আগস্ট, ১৯৪৫ খ্রি.) জাপানিদের দ্বারা অস্ত্র ও খাদ্য হয়ে যায়। ফলে আজাদ হিন্দ সেনারা অস্ত্র ত্যাগ করতে বাধ্য হন। সরবরাহ বন্ধ মূল্যায়ন: নেতাজীর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ বাহিনি চরম আত্মত্যাগের মধ্য বাধ্য হয় দিয়ে ভারতবাসীর স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে। তাই গান্ধিজি আজাদ হিন্দ বাহিনীর মূল্যায়নে বলেছিলেন-যদিও আজাদ হিন্দ ফৌজ বোং’ বিম তাদের আশু লক্ষ্যে পৌঁছোতে পারেনি, তবুও তারা এমন অনেক কিছু আরশেষে করেছে, যেজন্য তারা গর্ববোধ করতে পারে।

প্রশ্ন13. আজাদ হিন্দ বাহিনীর ভারত অভিযানের বর্ণনা দাও।

সূচনা: সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ বাহিনীর ভারত অভিযান এক চোখে- স্মরণীয় ঘটনা। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর আজাদ হিন্দ সেনারা পূর্ব সীমান্ত পৌঁছো দিয়ে ভারতে ঢুকে দিল্লির লালকেল্লা অধিকার করবে।

উত্তর: আজাদ হিন্দ বাহিনীর ভারত অভিযান

1 যুদ্ধ পরিকল্পনা: সুভাষচন্দ্র বসু ও জাপানি সেনাধ্যক্ষ কাওয়াবের মধ্যে এক যুদ্ধ পরিকল্পনা রচিত হয়। এই পরিকল্পনায় ঠিক হয় আজাদ হিন্দ বাহিনীর সুভাষ ব্রিগেড ও ৩১ নং জাপানি বাহিনী মিলিতভাবে আরাকান ফ্রন্টে অভিযান করবে এবং ইম্ফলের দিকে এগিয়ে যাবে। সামরিক অভিযানের সুবিধার্থে ভারতের নিকটবর্তী রেঙ্গুনে প্রধান সামরিক দপ্তর গড়ে তোলা হয়।

2 অভিযানের সূচনা: আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিভিন্ন ব্রিগেডের মধ্যে সুভাষ ব্রিগেডের প্রথম দলটি তাইপুং থেকে যাত্রা শুরু করে (১৯৪৩ খ্রি., ৯ নভেম্বর)। আজাদ হিন্দ ফৌজের দুটি ডিভিশনের ২০ হাজার সেনার মধ্যে প্রথম ডিভিশনটি পরিচালনা করেন মেজর জেনারেল জামান কিয়ানি। দ্বিতীয় ডিভিশনটির পরিচালনা করেন কর্নেল শাহনওয়াজ।

3 রেঙ্গুনে পদার্পণ: জাপানি নেতাদের সহযোগিতা, নেতাজির বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও উজ্জীবনী মন্ত্রে দীক্ষিত আজাদ হিন্দ সেনারা ১৯৪৪-এর জানুয়ারিতে রেঙ্গুনে এসে উপস্থিত হয়। রেঙ্গুনে আজাদ হিন্দ সেনারা ২৪ টি ভাগে ভাগ হয়ে গিয়ে অভিযান শুরু করে।

4 ভারত সীমান্তে অভিযান: রেঙ্গুন থেকে পায়ে হেঁটে আজাদ হিন্দ সেনারা ভারত সীমান্তের দিকে এগিয়ে চলে। সেসময় দৈনিক ৮০ পাউন্ড ওজনের জিনিসপত্র কাঁধে নিয়ে গড়ে ২৫ মাইল করে হেঁটে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলাই ছিল দৈনন্দিন কাজ। জাপানি সেনারা যে পথ ৫দিনে অতিক্রম করত, তাড়াতাড়ি সীমান্তে পৌঁছোনোর আগ্রহে আজাদ হিন্দ সেনারা সেপথ দুদিনে অতিক্রম করে।

5 সীমান্তে প্রবেশ: কক্সবাজার থেকে ৫০ মাইল দূরে মৌডকে ব্রিটিশ ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায় আজাদ হিন্দ বাহিনী। অতর্কিত এই আক্রমণে ব্রিটিশ সেনারা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ ফেলে পালিয়ে যায়, সেগুলি দখল করে নেয় আজাদ হিন্দ সেনারা।

6 মৈরাং-এ জাতীয় পতাকা উত্তোলন: একে একে কোহিমা দুর্গ ও ডিমাপুর-কোহিমা রোডের একটি ক্যান্টনমেন্ট দখল করে আজাদ হিন্দ সেনারা (১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ৪ এপ্রিল)। মণিপুরের অন্তর্গত কোহিমা

কবরটিও তারা দখল করে নেয়। মণিপুরের মৈরাং-এ জাতীয় পতাকা তোলা 2 নৌব হয় (১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ১৪ এপ্রিল)। শুরু হয় মণিপুরের রাজধানী ইম্ফল বীরত্বপূর্ণ লড়াই।

7 আত্মসমর্পণ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের কোণঠাসা পরিস্থিতি এবং খেলের প্রত্যাবর্তনে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনারা অরক্ষিত হয়ে পড়ে। ফলে খাদ্য ও অস্ত্রের জোগান বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে তীর বর্ষা নেমে যাওয়ায় এবং ছড়িয়ে প বৃনিতম প্রয়োজনীয় খাদ্য ও যুদ্ধ সরঞ্জামের অভাবে আজাদ হিন্দ সেনারা বাধ্য হয় পিছু হটতে। ইম্ফল বা মণিপুর সীমান্তে ব্রিটিশ সেনাপতি স্লিম ও ভূনের নেতৃত্বে ব্রিটিশ সেনারা এগিয়ে আসে। ব্রিটিশের ভারী ট্যাংক, কামান এবং বিমান বাহিনীর আক্রমণে আজাদ হিন্দ সেনাদের অগ্রগতি ব্যাহত হয়। অবশেষে জাপান মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করলে (১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট) আজাদ হিন্দ সেনারা অস্ত্র ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। সহকর্মীদের পরামর্শে নেতাজি আত্মসমর্পন থেকে বিরত থাকেন।

8 নেতাজির অন্তর্ধান: আজাদ হিন্দ সেনাদের আত্মসমর্পণের ফলে নেতাজির দিল্লি দখল অধরা থেকে যায়। কিন্তু তিনি ভেঙে না পড়ে, দু- চোখে নতুন স্বপ্ন নিয়ে বার্মা (এখনকার মায়ানমার) থেকে সায়গন পৗঁছোন। কথিত আছে, যে এরপর ফরমোজার কাছে তাই-হোকুতে এক বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়। যদিও ভারতবাসী এ কথা আজও বিশ্বাস করে না। সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ সেনাদের অবদানকে স্বীকার করে যে স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে, তাতে ঐক্য (ইত্তেফাক), বিশ্বাস (ইৎমাদ) হতে ও আত্মোৎসর্গ (কুরবানি) শব্দগুলি উল্লিখিত আছে। শব্দগুলি আজও আজাদ ছিন্দ যোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।

উপসংহার: আজাদ হিন্দ সেনারা দিল্লি পর্যন্ত পৌঁছোতে পারেনি বটে, কিন্তু তাদের ভারত অভিযানের সামগ্রিক প্রচেষ্টা মূল্যহীন নয়। ভারতের পরাধীনতা মোচনের লক্ষ্যে আজাদ হিন্দ সেনাদের ভারত অভিযান সমকাল ও পরবর্তীকালের প্রজন্মকেও গভীর দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ করে।

প্রশ্ন14. ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে আজাদ হিন্দ বাহিনীর ভূমিকার মূল্যায়ন করো। আজাদ হিন্দ বাহিনীর ব্যর্থতার কারণগুলি লেখো।

উত্তর: স্বাধীনতা সংগ্রামে আজাদ হিন্দ বাহিনীর ভূমিকার মূল্যায়ন

1. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপন: ধর্ম ও জাতিভেদ ভুলে মাতৃভূমির মুক্তিযজ্ঞে সমস্ত সম্প্রদায়ের আজাদ হিন্দ সেনা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই চালিয়েছিল। তাদের এই লড়াই আপামর ভারতবাসীর অন্তরে একতা ও সম্প্রীতির মনোভাব গড়ে দেয়।

2 নৌবাহিনীতে প্রভাব: আজাদ হিন্দ সেনাদের চরম আত্মত্যাগ ও বীরত্বপূর্ণ লড়াই ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে প্রভাব ফেলে। আজাদ হিন্দ সেনাদের লড়াই ভারতীয় নৌসেনাদের অন্তরে বিদ্রোহী মনোভাব জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। আজাদ হিন্দ বাহিনীর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে কিছুকাল পরে ভারতে নৌবিদ্রোহ ঘটে এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীতে প্রবল অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে।

3 স্বাধীনতার সমস্যা আন্তর্জাতিক স্তরে উত্থাপন: ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্ন আজাদ হিন্দ বাহিনীর জন্যই আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গে রূপান্তরিত হয়। দীর্ঘদিন ধরে ভারতের স্বাধীনতাকে অবদমিত করে রেখে ব্রিটিশ সরকার যে অন্যায় করে আসছিল এ সত্য বিশ্ববাসীকে অনুভব করানোর কৃতিত্ব আজাদ হিন্দ বাহিনীর প্রাপ্য।

4 বিদেশের মাটিতে বৃহত্তর সংগ্রাম: আজাদ হিন্দ বাহিনীর সংগ্রামই ছিল বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে ভারতের স্বাধীনতার জন্য সবথেকে বড়ো মুক্তিসংগ্রাম। আজাদ হিন্দ সেনাদের এই লড়াই ভারতবাসীকে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে শিখিয়েছিল।

5 ভারতবাসীর দেশাত্মবোধের উজ্জীবন: যুদ্ধবন্দি আজাদ হিন্দ সেনাদের বিচারের জন্য দিল্লির লালকেল্লায় নিয়ে যাওয়া হয়। বিচার চলাকালীন তাদের বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের কাহিনি যত প্রকাশিত হতে থাকে ততই আপামর ভারতবাসী দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ ও উজ্জীবিত হতে শুরু করে। এই পরিস্থিতিকে পেন্ডেরেল মুন আগ্নেয়গিরির কিনারার সঙ্গে তুলনা করেছেন। ব্রিটিশ লেখক ফিলিপ ম্যাসন-এর মতে এই ঐতিহাসিক বিচার ব্রিটিশ শাসনের মৃত্যুঘণ্টা ধ্বনিত করে।

আজাদ হিন্দ বাহিনীর ব্যর্থতার কারণসমূহ

আজাদ হিন্দ বাহিনীর ভারত অভিযান ব্যর্থতার কারণ হল-

1 পরনির্ভরশীলতা: আজাদ হিন্দ বাহিনীর ব্যর্থতার জন্য অনেকে সুভাষচন্দ্রকেও অনেকাংশে দায়ী করেছেন। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ (জানুয়ারি) পর্যন্ত তিনি জার্মানির সাহায্য লাভের জন্য বার্লিনে অবস্থান করেন। কিন্তু সেই সাহায্য লাভে ব্যর্থ হলে আজাদ হিন্দ সেনাবাহিনী খাদ্য, অস্ত্রশস্ত্র এমনকি রণকৌশলের জন্য জাপানের ওপর নির্ভরশীল হতে শুরু করে। এই পরনির্ভরশীলতাই আজাদ হিন্দ বাহিনীর ব্যর্থতার অন্যতম কারণ।

2 ভারত থেকে সহযোগিতার অভাব: আজাদ হিন্দ বাহিনীর ভারত অভিযানকে স্বাগত জানিয়ে তাদের সঙ্গে ভারতের জাতীয় নেতৃবৃন্দ যোগসূত্র গড়ে তোলার কোনো প্রচেষ্টাই গ্রহণ করেনি। এসময়ে প্রয়োজন ছিল দেশের মধ্য থেকে একটা গণ অভ্যুত্থান ঘটানো। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা না ঘটায় একা আজাদ হিন্দ সেনারা তাদের লক্ষ্যে পৌঁছোতে ব্যর্থ হয়।

3 ভ্রান্ত সময় নির্বাচন: বার্মা সীমান্ত ধরে যে সময়ে ভারত অভিযানের পরিকল্পনা রচিত হয়েছিল, তার কিছুদিন পরেই বর্ষা নেমে যাওয়ায় দুর্গম পার্বত্য সংকুল পথ ধরে এগিয়ে চলা প্রায় অসম্ভব ছিল। যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে, খাদ্য ও অস্ত্র সরবরাহ, সমস্ত কিছুতেই তীব্র সংকট দেখা দেয়। তা ছাড়া মিত্রপক্ষ যখন সুবিধাজনক অবস্থায় তখন আজাদ হিন্দ সেনাদের অভিযান শুরু করা ঠিক হয়নি।

4 অন্তর্দ্বন্দ্ব ও ভ্রান্ত রণনীতি: জাপানি সেনাপতি মুতাগোচিদের সঙ্গে অন্যান্য সেনানায়কের বিরোধিতার ফলে সেনাবাহিনী কোহিমা পর্যন্ত এগিয়েও ডিমাপুর আক্রমণ করেনি। ডিমাপুর ছিল ব্রিটিশের রসদ ভান্ডার। তাই তা অধিকার করে নিতে পারলে ইম্ফল জয় অনেক সহজ হত। মার্কিন গবেষক ড. জয়েস লেব্রা এ প্রসঙ্গে লিখেছেন-বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে সেনা সমাবেশ না করে একটি নির্দিষ্ট স্থানে কেন্দ্রীভূত হয়ে লড়াই করার প্রয়োজন ছিল। এই অন্তর্দ্বন্দ্ব ও ভ্রান্ত রণনীতি আজাদ হিন্দ সেনাদের ব্যর্থতার জন্য অনেকটাই দায়ী ছিল।

5 জাপানের অসহযোগিতা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষার্ধে বার্মা (মায়ানমার) সীমান্তে ইম্ফল অধিকার করার সময় আজাদ হিন্দ সেনারা যেভাবে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য মরিয়া ছিল জাপানিরা সেভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। উলটে জাপান এখানকার সৈন্যদের তুলে নিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গনে পাঠিয়ে দেয়। সেনানায়ক শাহনওয়াজ খান তাঁর ‘My Memories of INA and Netaji’ গ্রন্থে লিখেছেন-জাপানিরা প্রয়োজনীয় রসদ ও সাহায্য না দিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে আজাদ হিন্দ বাহিনীকে ব্যর্থতার দিকে ঠেলে দিয়েছিল।

প্রশ্ন 15. আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানীদের বিচারকে কেন্দ্র করে ভারতবাসীর প্রতিক্রিয়া আলোচনা করো। রশিদ আলি কেন পালিত হয়?

সূচনা: ভারতের বাইরে থেকে মুক্তি সংগ্রাম চালিয়ে ভারতবাসীর স্বাধীনতা প্রাপ্তিকে এগিয়ে আনতে পেরেছিল আজাদ হিন্দ বাহিনীর নির্ভিক সেনারা। তাই এই দেশপ্রেমিক যোদ্ধাদের বন্দি করে বিচার শুরু হলে ভারতবাসী তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়ে।

উত্তর: আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানীদের বিচার ও ভারতবাসীর প্রতিক্রিয়া

1 বিচার শুরু: ৫ নভেম্বর (১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ) দিল্লির লালকেল্লায় আজাদ হিন্দ সেনাদের বিচার শুরু হয়। ২০ হাজার বন্দি আজাদ হিন্দ সেনার মধ্যে প্রকাশ্যে মাত্র কয়েকশো জনের বিচারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যে তিন সেনাপতির প্রথম (শাহনওয়াজ খান, পি. কে. সেহেগল, জি. এস. ধিলন) বিচারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাঁদের একজন মুসলমান, একজন হিন্দু ও অন্যজন শিখ। এইভাবে বেছে বেছে তিন ধর্মের তিনজন মানুষের বিচারের প্রহসনে হিন্দু-মুসলমান-শিখ নির্বিশেষে গোটা ভারত গর্জে ওঠে। 

2 আজাদ হিন্দ সেনাদের সমর্থনে সর্বস্তরের মানুষ: এই বিচারকে কেন্দ্র করে সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। পোস্টার-পত্রপত্রিকা- পুস্তিকা, সভাসমিতি ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে খেটেখাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে বিত্তশালী ভারতীয় পর্যন্ত ব্রিটিশবিরোধী প্রতিবাদে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসে। জাতিধর্মবর্ণ, সামাজিক অবস্থান ও রাজনৈতিক মতপার্থক্য নির্বিশেষে সারা ভারতের মানুষই এই আন্দোলনে শামিল হয়।

i. কংগ্রেস আইনজীবীদের সমর্থন: আজাদ হিন্দ সেনাদের পক্ষে আইনজ্ঞ হিসেবে এগিয়ে আসেন ভুলাভাই দেশাই, জওহরলাল নেহরু, অরুণা আসফ আলি, তেজবাহাদুর সপ্পু, কৈলাসনাথ কাটজু প্রমুখের মতো কংগ্রেসের প্রথম সারির আইন বিশেষজ্ঞ। জওহরলাল নেহরু দীর্ঘ ২৫ বছর পর নিজের গায়ে তুলে নেন আইনজীবীর পোশাক।

ii. ভারতীয় সেনাদের সমর্থন: শুধু সাধারণ মানুষই নন, ব্রিটিশের সামরিক উর্দি পরা ভারতীয় সেনারা পর্যন্ত সামরিক শৃঙ্খলাকে লঙ্ঘন করে আজাদ হিন্দ বন্দিদের সমর্থনে ডাকা সভায় দলে দলে যোগ দিতে শুরু করে। কলকাতা, এলাহাবাদ, কানপুরের বিমানবাহিনীর কর্মচারীরা আজাদ হিন্দ সেনার সমর্থনে অর্থ সংগ্রহেও নামে। কেবল পদাতিক নয়, সেনাবাহিনীর তিনটি শাখাতেই এর প্রভাব লক্ষ

করা যায়।

3. বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কার্যকলাপ: কংগ্রেসের পাশাপাশি মুসলিম লিগ, হিন্দু মহাসভা, অকালি দল, শিখ লিগ, কমিউনিস্ট পার্টি, বার্মা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ, ইউনিয়নিস্ট পার্টি, জাস্টিস পার্টি প্রভৃতি সমস্ত নারা রাজনৈতিক দল মতপার্থক্য ভুলে আজাদ হিন্দ সেনাদের মুক্তির দাবিতে হাত সোচ্চার হয়ে ওঠে। এ ব্যাপারে ভাইসরয় ওয়াভেল শান্ত রাজনৈতিক দল একই পদ্ধতি অনুসরণ করেছে। তবে সবার চেয়ে বেশি এক সোচ্চার কংগ্রেস। দেশের বিভিন্ন পৌরসভা, জেলাবোর্ড, প্রবাসী ভারতীয়, ন্থ বিভিন্ন গুরুদ্বার কমিটি, বোম্বাই ও কলকাতার চিত্রতারকারা এমনকী বে বোম্বাই ও অমরাবতীর টাঙ্গাওয়ালারাও অর্থ সাহায্য করে। লিখেছেন-সমস্ত

4 গণবিক্ষোভ: জাতিধর্মবর্ণ, সামাজিক অবস্থান ও রাজনৈতিক মতপার্থক্য নির্বিশেষে আসমুদ্রহিমাচল ভারতবর্ষ ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শামিল হয়। আজাদ হিন্দ সেনাদের বিচারের সাহায্যের জন্য দেশের নানাস্থান থেকে আর্থিক সাহায্য আসতে থাকে। দেশজুড়ে পালিত হয় ‘আজাদ হিন্দ দিবস’ ও ‘আজাদ হিন্দ সপ্তাহ’। ‘জয়হিন্দ’, ‘আজাদ হিন্দ সেনাদের মুক্তি চাই’, ‘লালকেল্লা ভেঙে ফ্যালো’ ইত্যাদি নানা ধ্বনিতে ভারত । মুখরিত হয়ে ওঠে। ছোটোবড়ো অসংখ্য মিছিল ও সভাসমিতি দেশজুড়ে সংগঠিত হতে থাকে। সবচেয়ে বড়ো সভাটি আয়োজিত হয় দক্ষিণ কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে। কয়েক লক্ষ মানুষের ওই সমাবেশে ভাষণ দেন নেতাজি-অগ্রজ শরৎচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরু ও বল্লভভাই প্যাটেল।

5 কলকাতায় ছাত্র আন্দোলন: কলকাতার আন্দোলনই ছিল দেশের মধ্যে সবচেয়ে প্রবল। এখানে আন্দোলনে ছাত্ররা খুবই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল। ২১ নভেম্বর (১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ) প্রাদেশিক ছাত্র কংগ্রেস, ছাত্র ব্লক ■ (ফরওয়ার্ড ব্লকের ছাত্র সংগঠন), ছাত্র ফেডারেশন (কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন) এবং ইসলামিয়া কলেজ (বর্তমান মৌলানা আজাদ কলেজ)-সহ নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা মিছিল বের করে। তারা ডালহৌসি স্কোয়ারে ঢুকতে গেলে পুলিশ গুলি চালায়। এতে ক্যালকাটা টেকনিকাল স্কুলের ছাত্র রামেশ্বর ব্যানার্জি এবং শ্রমিক আবদুস সালাম মারা যান। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরের দু-দিন কলকাতা জুড়ে চলে প্রচণ্ড বিক্ষোভ। ট্রাম, বাস, ট্রেন, ট্যাক্সি, রিকশা-সহ বাজারহাট, স্কুলকলেজ, কলকারখানা সব কিছু বন্ধ থাকে।

রশিদ আলি দিবস

১ ডিসেম্বর (১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে) সরকার ঘোষণা করে যে, হত্যা ও নৃশংস ব্যবহারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ছাড়া সব বন্দিকেই মুক্তি দেওয়া হবে। কিন্তু পরের বছর ১১ থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি কলকাতা আবার বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে আজাদ হিন্দ ফৌজের ক্যাপটেন রশিদ আলির বিচারকে কেন্দ্র করে। আজাদ হিন্দ বাহিনীর ক্যাপটেন রশিদ আলিকে বিচারে ৭ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে ১১ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় ব্যাপক ছাত্রধর্মঘট, ১২ তারিখে রশিদ আলি দিবস পালিত হয় এবং সাধারণ ধর্মঘট কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী শিল্পাঞ্চলকে অচল করে দেয়। ওইদিন সন্ধ্যায় ওয়েলিংটন স্কোয়ারে এক বিশাল সমাবেশে লিগ, কংগ্রেস, কমিউনিস্ট নেতারা বক্তব্য রাখার পর ডালহৌসি স্কোয়ারের দিকে মিছিল এগিয়ে গেলে কলকাতার অসামরিক প্রশাসন-ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। সেনাবাহিনী কলকাতার শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব নেয়। ওই ক-দিনের সংঘর্ষে সরকারি হিসেবে ৮৪ জন নিহত ও ৩০০ জন আহত হয়। কিশোরকবি সুকান্ত ভট্টাচার্য কলকাতার এই গণ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতেই সেদিন লিখেছিলেন, বিদ্রোহ আজ, বিদ্রোহ চারিদিকে, আমি যাই তারই দিন পঞ্জিকা লিখে।”

পেসংহার: এই আন্দোলনের তীব্রতা ও ব্যাপকতায় বিস্মিত ব্রিটিশ সরকার শরপর্যন্ত আজাদ হিন্দ সেনাদের বিচার বাতিল করতে বাধ্য হয়। অমলেশ রিপাঠী বলেছেন- “মৃত (?) সুভাষ, জীবিত সুভাষের চেয়ে ঢের বেশি বোম্ব শক্তিশালী প্রতিপন্ন হয়েছিলেন।”

16. ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের নৌবিদ্রোহ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো।

কিনা: নৌবিদ্রোহ ভারতবাসীর স্বাধীনতালাভকে নিঃসন্দেহে ত্বরান্বিত করেছিল। কারণ এই বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ দ্রুত ভারত ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়।

উত্তর: নৌবিদ্রোহ (১৯৪৬ খ্রি.)

বিদ্রোহের সূচনা: ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে বোম্বাই বন্দরে বয়াল ইন্ডিয়ান নেভির ‘তলোয়ার’ জাহাজের রেডিয়ো অপারেটর বলাই দত্ত স্লোগান লেখেন ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’, ‘British Quit India’, বি বন্দেমাতরম্’, ‘জয়হিন্দ’ ইত্যাদি। এই অপরাধে নৌকর্তৃপক্ষ বলাই দত্তকে পাচ্যুত করে। এর প্রতিবাদে রয়াল ইন্ডিয়ান নেভির প্রধান এম. এস. খানের নেতৃত্বে ১৫০০ নাবিক বিদ্রোহ ঘোষণা করে (১৮ ফেব্রুয়ারি)। বোম্বাইয়ের ২১২টি জাহাজে এবং করাচির হিন্দুস্থান জাহাজে এই বিদ্রোহের সূচনা ঘটে।

2. বিদ্রোহের কারণ

1. আই. এন. এ. সেনাদের বিচার: যুদ্ধবন্দি আইনে আই. এন. এ.-র তিন সেনাপতি গুরুদয়াল সিং ধিলন, প্রেম সেহগল, শাহনওয়াজ খানকে দিল্লির লালকেল্লায় নিয়ে আসা হয় প্রকাশ্য বিচারের জন্য। ৫৭ দিন ধরে চলা এই মামলায় (৫ নভেম্বর-৩১ ডিসেম্বর, ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ) আজাদ হিন্দ সেনাদের বীরত্বপূর্ণ লড়াই ও আত্মত্যাগের কাহিনি প্রকাশিত হয়, যা নৌসেনাদের উদ্বুদ্ধ করে।

ii. ব্রিটিশ কর্মচারীদের খারাপ ব্যবহার: নৌসেনাবাহিনীতে জাতিগত বিদ্বেষের কারণে ইংরেজ নৌ-অফিসাররা ভারতীয় নাবিকদের অকারণে গালিগালাজ, অপমান ও খারাপ ব্যবহার করত।

iii. বেতন বৈষম্য: সমযোগ্যতা সত্ত্বেও ভারতীয় নৌকর্মচারীদের কখনোই ব্রিটিশ কর্মচারীদের সমপরিমাণ বেতন দেওয়া হত না। একই কাজে এই ধরনের বৈষম্যে ভারতীয় নৌসেনাদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হয়।

iv. নিম্নমানের খাদ্য সরবরাহ: বহুবার ভালো খাবারের আবেদন করেও ভারতীয় নৌসেনারা তা পায়নি, ফলে তাদের মনে এক ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছিল।

V. পদোন্নতির ও পুনর্বাসনের সুযোগ না থাকা: ভারতীয় নৌকর্মচারীদের কোনোদিনই পদোন্নতি হত না। চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে ভারতীয় নৌসেনাদের পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না।

vi. দক্ষিণ এশিয়ার মুক্তিসংগ্রাম: কাম্পুচিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস ও মায়ানমারে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে যে মুক্তিসংগ্রাম আন্দোলন গড়ে ওঠে ভারতীয় সেনাদের ওপরও তার প্রভাব পড়ে।

3 বিদ্রোহের প্রসার: তলোয়ার জাহাজের বিদ্রোহের পর শীঘ্রই বোম্বাইয়ের আরও ২২টি জাহাজে নাবিকরা বিদ্রোহ শুরু করে। ক্রমে করাচি, কলকাতা, মাদ্রাজ, কোচিন, জামনগর, চট্টগ্রাম, বিশাখাপত্তনম, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ প্রভৃতি স্থানে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ‘ইংরেজ ভারত ছাড়ো’ ধ্বনিতে বিদ্রোহীরা মুখরিত হয়। করাচিতে ব্রিটিশ জাহাজে অগ্নিসংযোগ করা হয়।

4 স্ট্রাইক কমিটির দাবি: নৌসংগ্রাম পরিচালনা ও বিভিন্ন বিদ্রোহী কেন্দ্রের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য বিদ্রোহীরা একজোট হয়ে নৌসেনা কেন্দ্রীয় ধর্মঘট সমিতি (Naval Central Strike Committee) গঠন করে (১৯ ফেব্রুয়ারি)। এই কমিটির প্রেসিডেন্ট হন এম. এস. খান, ভাইস- প্রেসিডেন্ট হন মদন সিং। স্ট্রাইক কমিটি বেশ কিছু দাবি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করে।

5 আন্দোলনের অবসান: ব্রিটিশ সেনাবাহিনী বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হলে নৌসেনাধ্যক্ষ অ্যাডমিরাল গডফ্রের নির্দেশে ডক অঞ্চলে বিমান থেকে গোলা বর্ষণ করা হয়। অবশেষে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের নির্দেশে বিদ্রোহীরা আত্মসমর্পণ করে (২৩ ফেব্রুয়ারি)।

6 গুরুত্ব

i. আলাপ-আলোচনার ওপর গুরুত্ব: নৌবিদ্রোহের গুরুত্ব উপলব্ধি করেই ব্রিটিশ এই প্রথম আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরে গুরুত্ব আরোপ করে।

ii. ব্রিটিশ ভীতির অবসানে: নৌসেনাদের বিদ্রোহ সাধারণ মানুষের মনে ব্রিটিশ ভীতি দূর করেছিল। দেশীয় সেনা ও সাধারণ প্রজাদের মধ্যে ব্যবধান দূর হয়েছিল।

iii. হিন্দু-মুসলিম ঐক্যসাধনে: হিন্দু-মুসলিম নাবিক, এমনকি সাধারণ হিন্দু-মুসলিম প্রজারাও বিদ্রোহে সাম্প্রদায়িক ঐক্যের পরিচয় দিয়েছিল।

উপসংহার: নৌবিদ্রোহের জন্যই ব্রিটিশ প্রশাসন শীঘ্রই ক্যাবিনেট মিশন বা মন্ত্রী মিশনকে ভারতে পাঠাতে বাধ্য হয়েছিল।

প্রশ্ন17.  ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে নৌবিদ্রোহের কারণ কী ছিল? এই বিদ্রোহের গুরুত্ব আলোচনা করো।

অথবা, ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে নৌবিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল আলোচনা করো।

উত্তর: নৌবিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল

নৌবিদ্রোহের কারণের জন্য TOPIC [A]-এর 16 নং রচনাধর্মী প্রশ্নের উত্তরের ‘বিদ্রোহের কারণ’ শীর্ষক অংশটি দ্যাখো।

নৌবিদ্রোহের গুরুত্বের জন্য TOPIC [A]-এর 16 নং রচনাধর্মী প্রশ্নের উত্তরের ‘গুরুত্ব’ শীর্ষক অংশটি দ্যাখো।

প্রশ্ন18. ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রেক্ষাপট ও ব্রিটিশের ভূমিকা লেখো

সূচনা: যুদ্ধকালীন সময়ে ভারতের রাজনীতিতে এক অচলাবস্থা তৈরি হয়। কংগ্রেস এবং লিগের মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধি পায়। জিন্না পাকিস্তান দাবিতে অটল থাকায় এই দূরত্ব বৃদ্ধি পায়। অপর দিকে বড়োলাট লিনলিথগোর স্থলে নতুন বড়োলাট ওয়াভেল ভারত নিয়ে উদ্ভূত সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ নেন। তিনি লন্ডনের ব্রিটিশ মন্ত্রীসভাকে ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার অনুরোধ জানান।

উত্তর: হস্তান্তরের প্রেক্ষাপট ও ব্রিটিশের ভূমিকা

1 ওয়াভেল পরিকল্পনা: বড়োলাট ওয়াভেল ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুন কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের কাছে একটি সূত্র উত্থাপন করেন, সেটিই ‘ওয়াভেল পরিকল্পনা’ নামে খ্যাত। তিনি বলেন- [i] নতুন সংবিধান গৃহীত না হওয়া পর্যন্ত ভারতীয় নেতাদের নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হবে। [ii] বড়োলাটের শাসন পরিষদে বর্ণহিন্দু ও মুসলমান সদস্যের সংখ্যা সমান থাকবে। [iii] একমাত্র বড়োলাট ও প্রধান সেনাপতি ছাড়া শাসন পরিষদের অন্য সমস্ত সদস্য হবে ভারতীয়। [iv] ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে পর্যন্ত ভারতের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব ব্রিটিশের হাতেই থাকবে। [v] সরকার যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি ক্ষমতা হস্তান্তর করবে এবং সংবিধান রচনার কাজ আরম্ভ করবে।

2 সিমলা বৈঠক

i. আলোচ্য বিষয়: ওয়াভেলের পরিকল্পনা মেনে সিমলায় এক বৈঠক বসে (১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৫ জুন)। কংগ্রেস, মুসলিম লিগ ও অন্যান্য দলের নেতাদের এই সম্মেলনে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। সিমলা বৈঠকে বড়োলাট ওয়াভেলের পরিকল্পনাগুলি আলোচিত হয়। তবে এই বৈঠকের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল দুটি- প্রথমটি ছিল, বড়োলাটের কাউন্সিল বা শাসন পরিষদ যে সমস্ত নীতির ভিত্তিতে কাজ করবে সেগুলি ঠিক করা। দ্বিতীয়টি ছিল, কাউন্সিল কীভাবে গঠিত হবে বা এই কাউন্সিলের কারা সদস্য হবে তা ঠিক করা।

ii. পরিণতি: জিন্না যখন বড়োলাটের কার্যনির্বাহক সমিতিতে লিগের দ্বারা মুসলিম সদস্য নিয়োগের দাবি জানান তখন কংগ্রেস সে দাবি মেনে নিতে চায়নি। এ ছাড়া ব্রিটেনের রক্ষণশীল দলও ভারত ত্যাগ করতে রাজি ছিল না। ফলে সিমলা বৈঠক ব্যর্থ হয়।

3 ক্যাবিনেট মিশন বা মন্ত্রী মিশন

i. উদ্দেশ্য: মন্ত্রী মিশনের উদ্দেশ্য ছিল দুটি- [a] ভারতকে স্বাধীনতাদান এবং ভবিষ্যৎ সংবিধান রচনার জন্য যে গণপরিষদ তৈরি হবে তার গঠন, পদ্ধতি ও নীতি নির্ধারণ করা। [b] ভারতের সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলির বৃহত্তর মতৈক্যের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তীকালের জন্য একটি জনপ্রতিনিধিভিত্তিক সরকার গঠন করা।

ii. প্রস্তাব: এই মিশনের প্রধান প্রস্তাবগুলি ছিল-[a] ভারতে একটি দ্বিস্তর বিশিষ্ট যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হবে। দেশীয় রাজ্যগুলি এই যুক্তরাষ্ট্রে যোগ দিতে পারবে। [b] কেন্দ্র ও প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে। কেবলমাত্র পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও যোগাযোগ বিষয়ক ক্ষমতা থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর। প্রদেশগুলিতে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তিত হবে। [c] প্রদেশগুলিকে তিনটি বিভাগেই বিভক্ত করা হবে। [d] ভারত যুক্তরাষ্ট্রে যোগদানে ইচ্ছুক দেশীয় রাজ্য ও প্রদেশগুলির নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান রচনার জন্য গণপরিষদ গঠিত হবে। [e] নতুন সংবিধান চালু হলে যে-কোনো নির্বাচিত প্রাদেশিক আইনসভা ইচ্ছা করলে যে-কোনো বিভাগে যোগ দিতে কিংবা যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতেও পারবে। [f] যতদিন না নতুন সংবিধান প্রণীত হয়, ততদিন ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার গঠন করা হবে।

4 মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা:

i. মাউন্টব্যাটেনের লক্ষ্য: ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেনের লক্ষ্য ছিল অখণ্ড ভারত। তাই ২৪ মার্চ থেকে ৬ মে -র মধ্যে তিনি ভারতীয় নেতৃমণ্ডলী ও রাজন্যবর্গের সঙ্গে ১৩৩টি বৈঠক করেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত এই নতুন বড়োলাট বুঝে নেন যে, ভারত বিভাগ ছাড়া ভারতীয় সমস্যার কোনো সমাধান নেই।

ii. বিভিন্ন প্রস্তাব: মাউন্টব্যাটেনের প্রস্তাবে বলা হয়- [a] ভারতবর্ষকে বিভক্ত করে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি ডোমিনিয়নের সৃষ্টি করা হবে। ডোমিনিয়ন দুটি সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নিজ নিজ অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিষয়সমূহ পরিচালনা করবে। [b] মুসলমান প্রধান প্রদেশ-সিন্ধু, ব্রিটিশ অধিকৃত বালুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পশ্চিম পাঞ্জাব ও পূর্ব বাংলা নিয়ে পাকিস্তান গড়া হবে। [c] পাঞ্জাব ও বাংলাকে বিভক্ত করে কোন্ অঞ্চলকে কোন্ ডোমিনিয়নের সঙ্গে যুক্ত করা হবে তা নির্ধারণের জন্য একটি ‘সীমানা নির্ধারণ কমিশন’ ক্ষমতা হস্তান্তরের আগেই গঠিত হবে। [d] আসামের শ্রীহট্ট জেলা কোন্ ডোমিনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হবে তা গণভোটে স্থির হবে। [e] দেশীয় রাজ্যগুলি নিজ নিজ রাজ্যে সার্বভৌম ক্ষমতা লাভ করবে এবং ইচ্ছা করলে তারা যে-কোনো ডোমিনিয়নে যোগ দিতে পারবে। [f] প্রতি ডোমিনিয়নের নির্বাচিত  গণপরিষদ নিজ এলাকার সংবিধান রচনা করবে। [৪] যতদিন না সংবিধান রচিত হচ্ছে ততদিন ব্রিটিশ সরকার নিযুক্ত একজন গভর্নর- জেনারেল ওই ডোমিনিয়নে থাকবেন। [h] স্বাধীনতা-লাভের নর প্রতি ডোমিনিয়নের নির্বাচিত আইনসভা নিজ নিজ দেশের জন্য আইন দুই রচনা করবে।

উপসংহার: ভারতবাসীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সদিচ্ছা না থাকলেও সমকালীন ভারতের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি ব্রিটিশকে স্বাধীনতা দানের সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য করে।

19. রাজাজি সূত্র বা সি. আর. ফর্মুলা সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও। ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের ওপর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

উত্তর: রাজাজি সূত্র বা সি. আর. ফর্মুলা

1 পরিচয়: ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময়ও মুসলিম লিগের অনড় দাবি ছিল পৃথক পাকিস্তান রাষ্ট্রের গঠন। এই লক্ষ্যের বাস্তবায়নেই তাদের যাবতীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। এই অবস্থায় স্বাধীন ভারতকে দ্বিখণ্ডিত না করে, অথচ জিন্নার দাবির কিছু অংশ বাস্তবায়িত করে গান্ধি অনুগামী মাদ্রাজের চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী এক সমাধানসূত্র প্রকাশ করেন (মার্চ, ১৯৪৪ খ্রি.)। তাঁর এই সমাধানসূত্র ‘রাজাজি সূত্র’ বা সি. আর. ফর্মুলা (C. R. Formula) নামে পরিচিত।

2 প্রস্তাবসমূহ: [i] কংগ্রেসের স্বাধীনতার দাবিকে মুসলিম লিগ পূর্ণভাবে সমর্থন করবে এবং কংগ্রেসের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করবে। [ii] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের অধিবাসীদের গণভোট গ্রহণ করে দেখা হবে যে তারা পৃথক রাষ্ট্র গঠনের পক্ষপাতী কিনা। [iii] গণভোট গ্রহণের আগে সব দলকে তাদের বক্তব্য প্রচারের সুযোগ দেওয়া হবে। [iv] মুসলিম-প্রধান অঞ্চলগুলি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে মত দিলে দুটি পৃথক রাষ্ট্র গঠিত হবে। দেশভাগ হলেও প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য, যোগাযোগ ও অন্যান্য বিষয়ে উভয় অংশই সমানভাবে জড়িত, এইসব বিষয় যৌথভাবে পরিচালিত হয়। [v] ব্রিটিশ সরকার ভারতকে স্বাধীনতা দিলে তবেই এই প্রস্তাব কার্যকরী হবে।

3 প্রস্তাবের ব্যর্থতা: গান্ধিজি ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ৬ মে জেল থেকে ছাড়া পান। এরপর তিনি রাজাজির প্রস্তাব অনুসারে ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বোম্বাইয়ে জিন্নার বাসগৃহে ২১ বার বৈঠক করেন। কিন্তু জিন্না বিভিন্ন কারণে রাজাজি সূত্র প্রত্যাখ্যান করেন।

ভারতীয় স্বাধীনতা আইন

1 আইন পাস: ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের বলে ভারত ও পাকিস্তান দুই আলাদা ডোমিনিয়নের হাতে আলাদা-আলাদাভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয় মাউন্টব্যাটেন প্রস্তাবের অন্তর্ভুক্ত প্রদেশগুলি। আর অবশিষ্ট অংশ নিয়ে গঠিত হয় ভারতবর্ষ।

2 আইনের ধারা: [i] ভারতবর্ষকে বিভক্ত করা হবে এবং ১৯৪৭খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট ‘ভারত’ ও ‘পাকিস্তান’ নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করবে। [ii] দুটি রাষ্ট্রের ওপর থেকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সমস্ত অধিকার লুপ্ত হবে। উভয় রাষ্ট্রই স্বাধীনভাবে তাদের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রীয় ব্যাপার পরিচালনা করবে এবং সংবিধান রচনা করবে। [iii] দেশীয় রাজ্যগুলির রাজারা ভারত বা পাকিস্তান যে-কোনো ডোমিনিয়নে যোগ দিতে পারবে। [iv] আসামের শ্রীহট্ট জেলায় গণভোটে স্থির হবে তা ভারত বা পাকিস্তান কোন্ ডোমিনিয়নে থাকবে। [v] দেশীয় রাজ্যগুলির ওপর ব্রিটেনের সার্বভৌম অধিকার লুপ্ত হবে।

3 স্বাধীনতার স্বরূপ: পলাশির যুদ্ধে বিপর্যস্ত ভারতের যে স্বাধীনতার সূর্যাস্ত ঘটেছিল তারপর সূর্যোদয় ঘটে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট। ভারতবাসীর এই স্বাধীনতা বহু আকাঙ্ক্ষিত হলেও তার মধ্যে বিষাদের সুর ছিল। কারণ টুকরো করা স্বাধীনতা ভারতবাসীকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নিতে হয়েছিল। স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্নর-জেনারেল হিসেবে শপথ নেন মাউন্টব্যাটেন এবং প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে ভারতীয় মন্ত্রীসভা শপথ গ্রহণ করে। এর আগে ১৪ আগস্ট ডোমিনিয়ন পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর-জেনারেল হিসেবে শপথ নেন মহম্মদ আলি জিন্না। ঐক্যবদ্ধ ও অখণ্ড ভারত দ্বিবিভক্ত হয়ে দুটি আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে-যা ভারতবাসীর কাছে কাঙ্ক্ষিত ছিল না।

প্রশ্ন ২০ মন্ত্রী মিশনের পরিকল্পনা কী ছিল? এই মিশনের ত্রুটি ও গুরুত্ব লেখো। 3+5

উত্তর: মন্ত্রী মিশনের পরিকল্পনা বা সুপারিশ বা প্রস্তাবসমূহ

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট এটলির পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ব্রিটিশ প্রতিনিধিদল ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে ভারতে আসে। ভারত-সচিব স্যার পেথিক লরেন্স, নৌবাহিনীর প্রধান এ.ভি. আলেকজান্ডার ও বাণিজ্য বোর্ডের সভাপতি স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্লিপস-ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার এই তিনজন সদস্যকে নিয়ে প্রতিনিধিদল গঠিত হয়। এটি মন্ত্রী বা ক্যাবিনেট মিশন নামে পরিচিত হয়। কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মতভেদের পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রী মিশন বা ক্যাবিনেট মিশন তার নিজস্ব সুপারিশ ঘোষণা করে। এই সুপারিশে বলা হয়-

1 যুক্তরাষ্ট্র গঠন: ভারতবর্ষে একটি যুক্তরাষ্ট্র (Federal Union) গঠিত হবে। দেশীয় রাজ্যগুলি পরবর্তীকালে এই যুক্তরাষ্ট্রে যোগ দিতে পারবে।

2 ক্ষমতা বণ্টন: কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারগুলির মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন করা হবে। প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগের দায়িত্ব পাবে কেন্দ্র এবং অন্যান্য বিষয় থাকবে প্রদেশের হাতে।

3 প্রদেশ গঠন: ব্রিটিশ ভারতের প্রদেশগুলিকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করা হবে-[i] হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ছয়টি প্রদেশ নিয়ে গঠিত হবে প্রথম অঞ্চল, [ii] মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ তিনটি প্রদেশ নিয়ে গঠিত হবে দ্বিতীয় অঞ্চল এবং [iii] বাংলা ও আসাম নিয়ে গঠিত হবে তৃতীয় অঞ্চল।

4 গণপরিষদ গঠন: প্রদেশগুলির নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে সংবিধান রচনার জন্য গণপরিষদ গঠিত হবে।

5 যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগের অধিকার: নতুন সংবিধান অনুসারে নির্বাচনের পর কোনো রাজ্য ইচ্ছা করলে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করতে পারবে।

6 অন্তর্বর্তী সরকার: নতুন সংবিধান চালু না হওয়া পর্যন্ত প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত একটি অন্তর্বর্তী জাতীয় সরকার শাসন পরিচালনা করবে।

ত্ৰোটি

1 ভারত বিভাজনের পথ প্রস্তুত: মন্ত্রী মিশন সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ভারত ভাগের প্রস্তাব রাখেন। মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাবে প্রদেশগুলিকে হিন্দু প্রধান ও মুসলিম প্রধান- এই দু-ভাগে ভাগ করার উল্লেখ থাকায় পরোক্ষভাবে ভারত বিভাজনের পথই প্রস্তুত হয়।

2 দুর্বল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো: মন্ত্রী মিশন প্রদেশগুলিকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান এবং কেন্দ্রের হাতে শুধুমাত্র পররাষ্ট্র, দেশরক্ষা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার দায়িত্ব অর্পণের সিদ্ধান্ত নেয়। এতে দুর্বল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর রূপরেখা ফুটে ওঠে।

গুরুত্ব

১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাবগুলি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

1 অবিভক্ত রাখার প্রয়াস: মিশন স্পষ্টই বুঝে গিয়েছিল যে, ভারত ভেঙে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। তাই ভারতকে অবিভক্ত রেখে স্বাধীনতা দেওয়া- এটাই ছিল ব্রিটিশ সরকারের শেষ আন্তরিক প্রয়াস।

2 প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার: এই প্রথম দেশীয় রাজ্যের জনগণকে প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার দেওয়া হয়।

3 অসাম্প্রদায়িক শাসনতান্ত্রিক পদক্ষেপ: এতদিন শাসনতান্ত্রিক আলোচনার ক্ষেত্রে ভারতের বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকে কেন্দ্র করে নানা জটিলতার সৃষ্টি হত। এর থেকে মুক্তি পেতে মন্ত্রী মিশন হিন্দু, মুসলিম ও পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে শিখ ছাড়া অন্য কোনো সম্প্রদায়কে স্বীকৃতি না দিয়ে এক ইতিহাস সৃষ্টি করে।

4 অ-ভারতীয় সদস্য গ্রহণ: গণপরিষদে কোনো অ-ভারতীয় সদস্য গ্রহণের প্রস্তাব ছিল না।

5 গণপরিষদের ক্ষমতা: ভারতীয় শাসনতন্ত্র রচনার ক্ষেত্রে গণপরিষদকেই সার্বভৌম ক্ষমতা দেওয়া হয়।

প্রশ্ন21. গণপরিষদ গঠনের প্রেক্ষাপট আলোচনা করো। গণপরিষদের দুজন সদস্যের নাম করো। 6+2 

উত্তর: গণপরিষদ গঠনের প্রেক্ষাপট

ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় আন্দোলনকারী ভারতীয়দের দীর্ঘকালের দাবি ছিল যে ভারতীয় সংবিধান রচনার জন্য ভারতীয়দের নিয়ে গ একটি গণপরিষদ বা সংবিধান সভা গঠন করতে হবে। সেই দাবি অনুসারে ল, স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে গণপরিষদ গঠিত হয়।

1 সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা: মহম্মদ আলি জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিম লিগ ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে পৃথক পাকিস্তানের দাবিতে ‘লাহোর প্রস্তাব’ গ্রহণ করে এবং এই দাবি আদায়ের লক্ষ্যে অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে। পৃথক পাকিস্তান আদায়ের দাবিতে ব্যাপক প্রচার চালিয়ে মুসলিম জনমত গড়ে তোলা শুরু ■ হয়। ফলে দেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। পাকিস্তান দাবিকে সামনে রেখে লিগ ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক – আইনসভার নির্বাচনে অংশ নেয়। এই নির্বাচনে কংগ্রেস ও লিগ নিজ নিজ ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাফল্য পায়।

2 অন্তর্বর্তী মন্ত্রীসভা: মন্ত্রী মিশনের (১৯৪৬ খ্রি.) প্রস্তাব অনুসারে একটি সর্বদলীয় অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কথা ছিল। লিগ এই অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ না দিয়ে পৃথক পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবিতে সোচ্চার হয়। এই পরিস্থিতিতে বড়োলাট লর্ড ওয়াভেল ১২ আগস্ট (১৯৪৬ খ্রি.) কংগ্রেস নেতা জওহরলাল নেহরুকে মন্ত্রীসভা গঠনের আহ্বান জানালে জিন্নার নেতৃত্বাধীন মুসলিম লিগ অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পড়ে।

3 লিগের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম: ওয়াভেল কংগ্রেস নেতা জওহরলাল নেহরুকে অন্তর্বর্তী সরকারের মন্ত্রীসভা গঠনের আহ্বান জানালে মুসলিম লিগ সরকারের বিরুদ্ধে ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রামের’ (Direct Action) ডাক দেয়। সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ডাক দিলেও কার্যত তা হিন্দুদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। বাংলার লিগ সরকারের প্রত্যক্ষ প্ররোচনায় পুলিশ ও প্রশাসনকে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় রেখে কলকাতায় পাঁচদিন ধরে (১৬-২০ আগস্ট) ব্যাপক দাঙ্গা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকাণ্ড চলতে থাকে। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ‘কলকাতা হত্যাকাণ্ড’ (Great Calcutta Killing) নামে পরিচিত। ইংরেজ ঐতিহাসিক মোসলে লিখেছেন যে, “এই ক-দিনে কলকাতার ছ-হাজার লোক ছোরা, বন্দুক, লাঠি বা অগ্নিদাহে নিহত হয় এবং বিশ হাজার নারী ধর্ষিতা ও বিকলাঙ্গ হয়।”

4 দাঙ্গার বিস্তার: কলকাতার দাঙ্গার রক্তের দাগ শুকোতে না। পৃ শুকোতেই বোম্বাই (১ সেপ্টেম্বর), নোয়াখালি ও ত্রিপুরা (১০ অক্টোবর), বিহার (২৫ অক্টোবর), যুক্তপ্রদেশের গড়মুক্তেশ্বর (নভেম্বর), পাঞ্জাব (মার্চ, তি ১৯৪৭ খ্রি.) প্রভৃতি স্থানে দ্রুত সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। [i]) নোয়াখালি ও ত্রিপুরার দাঙ্গা বীভৎস আকার ধারণ করে। স্টেটসম্যান পত্রিকার মতে, এই দাঙ্গার প্রধান লক্ষ্য ছিল লুটপাট এবং মানুষকে ধর্মান্তরিত করা। [ii] নোয়াখালির দাঙ্গার বদলা হিসেবে বিহারে হিন্দুরা দাঙ্গা শুরু করে প্রচুর মুসলিমকে হত্যা করে। [iii] বিহারের পর গড়মুক্তেশ্বরে হিন্দু তীর্থযাত্রীরা প্রায় ১ হাজার মুসলিমকে হত্যা করে। [iv] পাঞ্জাবের লাহোর, অমৃতসর, মূলতান, আটক, রাওয়ালপিণ্ডি প্রভৃতি স্থানে ব্যাপক নরহত্যা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

5 অন্তর্বর্তী সরকার গঠন: হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মধ্যেই বড়োলাট লর্ড ওয়াভেলের আহ্বানে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ২ সেপ্টেম্বর কংগ্রেস নেতা জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে কেন্দ্রে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। মুসলিম লিগ প্রথমে অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ না দিলেও কংগ্রেসের ক্ষমতা বিপুল বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কায় লিগে ৫ জন সদস্য ২৬ অক্টোবর মন্ত্রীসভায় যোগ দেয়। তবে তাঁদের মূল লক্ষ্যই ছিল সরকারি কাজে নানাভাবে বাধার সৃষ্টি করা এবং এর দ্বারা সরকারকে অচল করে দিয়ে ভারত বিভাগকে অনিবার্য করে তোলা। গান্ধিজির জীবনীকার ও ব্যক্তিগত সচিব প্যারেলাল বলেন, “যেদিন মুসলিম লিগ অন্তর্বর্তী সরকারে যোগদান করল সেদিনই অখন্ড ভারত গঠনের লড়াই চিরতরে পরাজিত হল।”

6 গণপরিষদ গঠন: অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠার পর সংবিধান সভা বা গণপরিষদ গঠনের উদ্দেশ্যে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে প্রাদেশিক আইনসভার বিধায়কদের ভোটদানের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে কংগ্রেস বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং গণপরিষদ গঠিত হয়। ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ গণপরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হন। ৯ ডিসেম্বর (১৯৪৬ খ্রি.) দিল্লিতে গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসলে লিগ এই অধিবেশনে যোগ না দিয়ে পৃথক পাকিস্তানের দাবিতে জোর প্রচার চালাতে থাকে এবং গণপরিষদ ভেঙে দেওয়ার দাবি জানায়।

গণপরিষদের সদস্য

গণপরিষদের দুজন সদস্যের নাম হল বল্লভভাই প্যাটেল ও জওহরলাল নেহরু।

প্রশ্ন22. ভারতের গণপরিষদ গঠনের প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করো। ভারতের গণপরিষদের প্রকৃতি আলোচনা করো।

উত্তর: গণপরিষদ গঠনের প্রেক্ষাপট

TOPIC [A]-এর 21 নং রচনাধর্মী প্রশ্নের উত্তরের ‘গণপরিষদ গঠনের প্রেক্ষাপট’ শীর্ষক অংশের 2,3 ও 5 নং পয়েন্ট দ্যাখো।

গণপরিষদের প্রকৃতি

নির্বাচিত ভারতীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত যে সংস্থাটি দেশের সংবিধান রচনা করে তা হল গণপরিষদ। গণপরিষদে একদলীয়, দক্ষিণপন্থী, পুঁজিবাদী শ্রেণির প্রতিনিধিবর্গেরও সমাবেশ ঘটেছিল। প্রাদেশিক আইনসভাগুলির বিধায়কগণ গণপরিষদের সদস্যদের নির্বাচিত করে। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট থেকে গণপরিষদ সার্বভৌম পরিষদের মর্যাদা লাভ করে। গণপরিষদের প্রকৃতি বিশ্লেষণে দেখা যায়-

1 প্রকৃতি

i. জনপ্রতিনিধিত্বহীন: ভারতীয় গণপরিষদকে কোনোভাবেই জনপ্রতিনিধিত্বমূলক পরিষদ বলা চলে না। কেন-না সদস্যগণ ভারতীয়দের দ্বারা সরাসরি নির্বাচিত ছিলেন না। অর্থাৎ গণপরিষদের সদস্যগণ সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সরাসরি ভারতীয়দের দ্বারা নির্বাচিত হননি। তাই প্রকৃতিগত বিচারে গণপরিষদ জনপ্রতিনিধিত্বহীন এক পরিষদ।

ii. আইনবিদদের প্রাধান্য: গণপরিষদ ছিল আইনবিদদের প্রাধান্যবিশিষ্ট এক পরিষদ। সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে মূলত যে ২১জন সদস্য মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন, তার মধ্যে ১১ জনই ছিলেন বিশিষ্ট আইনবিদ। এই আইনবিদগণ সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকেই বিভিন্ন ধারা-উপধারাগুলির বিচারবিবেচনাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। আইভর জেনিংস তাই গণপরিষদকে ‘আইনজীবীদের স্বর্গ’ বলে উল্লেখ করেছেন।

iii. একদলীয়: সকল রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি না থাকায় ভারতীয় গণপরিষদ সর্বজনীন চরিত্র লাভ করতে পারেনি। দেশবিভাগের ফলে লিগের সদস্যরা পাকিস্তানে চলে গেলে ভারতীয় গণপরিষদ সম্পূর্ণরূপে একটি একদলীয় সংস্থায় পরিণত হয়। সোমনাথ লাহিড়ি কমিউনিস্ট দলের তরফে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হলেও দেশবিভাগজনিত কারণে তাঁকে সদস্যপদ হারাতে হয়।

2 আপসমুখী: ভারতীয় গণপরিষদ ছিল ব্রিটিশদের সঙ্গে কংগ্রেসি নেতৃবৃন্দের আপসরফার ফল। গণপরিষদে দেশীয় রাজন্যবর্গের তরফে যোগদানকারী প্রতিনিধিবর্গ সর্বদা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাকে রক্ষা করার প্রয়াস চালান। দেশীয় রাজন্যবর্গের স্বার্থ রক্ষার ফলশ্রুতি হিসেবে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে আপস করা হয়। যেমন-দেশীয় রাজন্যবর্গকে ভাতা, খেতাব, উপাধি প্রভৃতি দান তারই নিদর্শন।

3 অগণতান্ত্রিক: দেশীয় রাজন্যবর্গকে গণপরিষদে ৯৩ জন সদস্য মনোনয়নের ক্ষমতা দেওয়ার ফলে গণপরিষদ তার গণতান্ত্রিক প্রকৃতি হারায়। এ প্রসঙ্গে দামোদর স্বরূপ শেঠ সমালোচনার সুরে বলেছেন- দেশবাসীর শতকরা ১৪ ভাগ কর্তৃক পরোক্ষভাবে নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে গঠিত গণপরিষদ কখনোই সকল দেশবাসীর হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না।

প্রশ্ন23.  সংবিধান সভা কীভাবে গঠিত হয়? ভারতীয় গণপরিষদের লক্ষ্যগুলি কী ছিল?

উত্তর: সংবিধান সভার গঠন

1 বিভিন্ন সম্মেলনের দাবি মেনে: ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের এক সম্মেলনে গণপরিষদ গঠনের পক্ষে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর তিন বছর পরে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে রামগড় কংগ্রেস সম্মেলনে কংগ্রেস কার্যকরী সমিতি গণপরিষদ গঠনের পক্ষে জোরালো অভিমত ব্যক্ত করে। অবশেষে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে ভারতের সংবিধান রচনার বিষয়টি নীতিগতভাবে মেনে নেয়।

2 কূপল্যান্ড পরিকল্পনার বিকল্প হিসেবে: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন চার্চিল মন্ত্রীসভার সদস্য স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস ভারতে আসেন (১৯৪২ খ্রি., ২৩ মার্চ)। ক্লিপস ভারতবাসীর কাছে তাঁর বিভিন্ন প্রস্তাব পেশ করেন। প্রস্তাবে বলা হয়-ব্রিটিশ সরকার ও গণপরিষদের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। কিন্তু মুসলিম লিগ পৃথক গণপরিষদ গঠনের দাবি জানায়। পাশাপাশি জাতীয় কংগ্রেসও ক্লিপস প্রস্তাবকে অগ্রাহ্য করে। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ কূপল্যান্ডকে ভারতে পাঠায়। কুপল্যান্ড ঐকমত্যের ভিত্তিতে কংগ্রেস ও লিগের কাছে ক্ষুদ্র আকারের গণপরিষদ গঠনের প্রস্তাব রাখেন। এই প্রস্তাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার পরিবর্তে ঐকমত্যের ভিত্তিতে গণপরিষদ গঠনের উল্লেখ থাকায় কূপল্যান্ড পরিকল্পনাও শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়।

3 মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাব মেনে: [i] ব্রিটিশ শাসিত প্রদেশ ও দেশীয় রাজ্যগুলি তাদের মোট জনসংখ্যার নির্দিষ্ট অনুপাত অনুযায়ী গণপরিষদে আসন লাভ করবে। প্রতিটি প্রদেশ ১০ লক্ষ জন পিছু একজন করে প্রতিনিধি গণপরিষদে পাঠাতে পারবে। [ii] গণপরিষদের সকল আসন সাধারণ শ্রেণি (অ-শিখ, অ-মুসলমান), শিখ ও মুসলমান-এই তিন সম্প্রদায়ের মধ্যে আনুপাতিক হারে ভাগ করে দেওয়া হবে। [iii] প্রাদেশিক আইনসভাগুলিতে প্রত্যেকটি সম্প্রদায়ের সদস্যবৃন্দ একক হস্তান্তরযোগ্য সমানুপাতিক ভোটাধিকার প্রয়োগ করে নিজ নিজ প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারবে। [iv] দেশীয় রাজ্যগুলি থেকে ৯৩ জন প্রতিনিধি পাঠানো যাবে।

4 নির্বাচনের মাধ্যমে: ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে গণপরিষদ গঠন করার জন্য এক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। চিফ কমিশনার শাসিত ৪টি আসন সমেত ব্রিটিশ-ভারত থেকে মোট ২৯৬ জন প্রতিনিধি নির্ধারণের জন্য এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে দলগত বিচারে কংগ্রেস শতকরা ৬৯ ভাগ আসন লাভের মাধ্যমে নিরঙ্কুশ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে। অর্থাৎ ২৯২টি প্রাদেশিক আসনের মধ্যে কংগ্রেস পায় ২০৮টি এবং মুসলিম লিগ পায় ৭৩টি আসন। সংবিধান রচনার লক্ষ্যে গঠিত খসড়া কমিটি (১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট) গণপরিষদের কাছে খসড়া সংবিধান পেশ করে। দীর্ঘ আলাপ- আলোচনার পর রচিত হয় ভারতীয় সংবিধান।

ভারতীয় গণপরিষদের লক্ষ্য

সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে গণপরিষদের মূল লক্ষ্য ছিল স্বাধীন ভারতের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক রূপরেখা তৈরি। এর পাশাপাশি ভারতের সংবিধান ন্যায়বিচার, স্বাধীন চিন্তা ও মতপ্রকাশ, স্বাধীনভাবে ধর্মাচরণ ইত্যাদির অধিকার দিতে চেয়েছিল ভারতীয় নাগরিকদের। সকল নাগরিক যাতে সমান সুযোগ পায় এবং সমাজে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, গণপরিষদের সদস্যগণ তাও উদ্দেশ্যরূপে গ্রহণ করেছিলেন। ভারতীয় সংবিধানের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যগুলি হল-

1 আর্থসামাজিক উন্নতি: গণপরিষদের সর্বপ্রধান লক্ষ্য ছিল স্বাধীন ভারতের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটানো। জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, ভারতের নবগঠিত সংবিধান ভারতবাসীর স্বাধীনতা রক্ষা করবে, ক্ষুধার্তের অন্ন জোগাবে, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দেবে এবং প্রত্যেকের আত্মবিকাশের ব্যবস্থা করবে। ড. সর্বপল্লি রাধাকৃয়াণ বলেন, গণপরিষদের মূল লক্ষ্য হবে ভারতের আর্থসামাজিক বিপ্লব সাধন।

2 গণতান্ত্রিক, সার্বভৌম রাষ্ট্রগঠন: ভারতের সংবিধান প্রণেতাগণ গণপরিষদের রাজনৈতিক লক্ষ্য বর্ণনা করে বলেন যে, ভারত আত্মপ্রকাশ করবে এক স্বাধীন, সার্বভৌম, ধর্মনিরপেক্ষ, প্রজাতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র হিসেবে। যেখানে থাকবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা ও সংসদীয় গণতন্ত্রের অস্তিত্ব।

3 সামাজিক লক্ষ্য: সামাজিক ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি তফশিলি জাতি, উপজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির জন্য বিশেষ শশ সংরক্ষণ ব্যবস্থা, শিশু ও নারীকল্যাণ, অস্পৃশ্যতা বিলোপ ইত্যাদি বিষয়গুলি গণপরিষদে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে।

প্রশ্ন ২4. ভারতের গণপরিষদ (সংবিধান সভা) সম্পর্কে যা জান লেখো।

সূচনা: স্বাধীন ভারতের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক রূপরেখা তৈরির লক্ষ্যে গঠিত হয় ভারতের গণপরিষদ বা সংবিধান সভা।

উত্তর: ভারতের গণপরিষদ

1 গঠন: ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে মন্ত্রী মিশনের পরিকল্পনা অনুসারে চারটি মূলনীতির ভিত্তিতে ভারতীয় গণপরিষদ গঠনের ব্যবস্থা হয়। এই চারটি মূলনীতি হল-[i] ব্রিটিশ শাসিত প্রদেশ ও দেশীয় রাজ্যগুলি থেকে জনসংখ্যার অনুপাতে সদস্য নির্বাচিত হয়ে গণপরিষদে আসবেন। [ii] গণপরিষদের সব আসন সাধারণ (General), মুসলমান, শিখ-এই তিন সম্প্রদায়ের মধ্যে আনুপাতিক হারে বিভক্ত হবে। [iii] প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যগণ নিজ নিজ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন। [iv] দেশীয় রাজ্যগুলি ৯৩ জন প্রতিনিধি পাঠাতে পারবে। এদের ৫০ শতাংশ নির্বাচিত ও ৫০ শতাংশ মনোনীত সদস্য হবেন।

2 উদ্দেশ্য: স্বাধীনতালাভের মধ্যে দিয়ে জাতীয় বিপ্লবের কাজ সম্পূর্ণ হলেও সামাজিক বিপ্লবসাধনের কাজ বাকি রয়ে যায়। গণপরিষদ গঠনের মধ্যে দিয়ে ভারতে দুঃখদারিদ্র্যের অবসান ঘটানো, যাবতীয় বৈষম্য লোপ ও শোষণের অবসান ঘটাতে চাওয়া হয়।

3 সদস্যদের নির্বাচন: গণপরিষদের মোট আসন সংখ্যা ছিল ৩৮৯ জন। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যদের দ্বারা পরোক্ষভাবে গণপরিষদ গঠনের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে গণপরিষদের ২৯৬ জন সদস্য নির্বাচিত হন। নির্বাচনে কংগ্রেস বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। দলগত বিচারে কংগ্রেস ৭০ শতাংশ আসনে বিজয়ী হয়। গণপরিষদে বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি নির্বাচিত হয়ে আসেন। তাঁরা হলেন বল্লভভাই প্যাটেল, জওহরলাল নেহরু, বি. আর. আম্বেদকর, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী, কৃষ্ণস্বামী আয়ার প্রমুখ।

4 কার্যাবলি

i. সভাপতি নির্বাচন: গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর। ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ গণপরিষদের প্রথম স্থায়ী সভাপতি নির্বাচিত হন।

ⅱ. বিভিন্ন কমিটি গঠন: ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন বসে। সেখানে কয়েকটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন হয়, যেমন কার্যনির্বাহক কমিটি, কেন্দ্রীয় ক্ষমতা সম্পর্কিত কমিটি, মৌলিক অধিকার বিষয়ক কমিটি ইত্যাদির

iii. খসড়া সংবিধান প্রণয়ন: গণপরিষদের পঞ্চম অধিবেশনে (১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে) মাউন্টব্যাটেনকে স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্নর-জেনারেল নিয়োগ করা হয়। কেন্দ্রীয় আইনসভার প্রথম অধ্যক্ষ (Speaker) হিসেবে জি. ভি. মাভলঙ্কর নির্বাচিত হন। গণপরিষদই প্রথম আইনসভা হিসেবে কাজ শুরু করে। পঞ্চম অধিবেশনে সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। ড. বি. আর. আম্বেদকর খসড়া কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। মোট ১৬৫ দিন ধরে ১১টি অধিবেশনে খসড়া সংবিধান রচনার কাজ সম্পূর্ণ করা হয়। বিভিন্ন সংশোধনী প্রস্তাব আলোচনার পর ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬ নভেম্বর গণপরিষদে ভারতের সংবিধান গৃহীত হয়।

iv. নতুন সংবিধান গ্রহণ: গণপরিষদের শেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি। এই অধিবেশনে নতুন সংবিধান কার্যকর হয়। ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ। 

5 প্রকৃতি

i. জনপ্রতিনিধিত্বহীন: ভারতীয় গণপরিষদকে কোনোভাবেই জনপ্রতিনিধিত্বমূলক বলা চলে না। কেন-না সদস্যগণ ভারতীয়দের দ্বারা সরাসরি নির্বাচিত ছিলেন না। অর্থাৎ গণপরিষদের সদস্যগণ সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সরাসরি ভারতীয়দের দ্বারা নির্বাচিত হননি। তাই প্রকৃতিগত বিচারে গণপরিষদ জনপ্রতিনিধিত্বহীন এক পরিষদ।

ii. আইনবিদদের প্রাধান্য: গণপরিষদ ছিল আইনবিদদের প্রাধান্যবিশিষ্ট এক পরিষদ। সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে মূলত যে ২১জন সদস্য মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন, তার মধ্যে ১১ জনই ছিলেন বিশিষ্ট আইনবিদ। এই আইনবিদগণ সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকেই বিভিন্ন ধারা-উপধারাগুলির বিচারবিবেচনাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। আইভর জেনিংস তাই গণপরিষদকে ‘আইনজীবীদের স্বর্গ’ বলে উল্লেখ করেছেন।

ii. একদলীয়: সকল রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি না থাকায় ভারতীয় গণপরিষদ সর্বজনীন চরিত্র লাভ করতে পারেনি। দেশবিভাগের ফলে লিগের সদস্যরা পাকিস্তানে চলে গেলে ভারতীয় গণপরিষদ সম্পূর্ণরূপে একটি একদলীয় সংস্থায় পরিণত হয়। সোমনাথ লাহিড়ি *কমিউনিস্ট দলের তরফে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হলেও দেশবিভাগজনিত কারণে তাঁকে সদস্যপদ খোয়াতে হয়।

প্রশ্ন25. মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা কী? এই পরিকল্পনার মাধ্যমে কীভাবে 25 ভারত বিভাগ করা হয়? 

অথবা, মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনার মূল বিষয় কী ছিল? এই পরিকল্পনার ফল কী হয়েছিল?

উত্তর: মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা

1 পরিচয়: জিন্নার পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবি এবং তাতে জওহরলাল ও প্যাটেলের সম্মতি থাকায় মাউন্টব্যাটেনের উপদেষ্টা ইস্মে ভারতভাগের পরিকল্পনা ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাঠান (১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৬ মে)। পার্লামেন্টে প্রস্তাবটি ‘ভারতীয় স্বাধীনতা আইন’রূপে পাস হয় (যদিও রাজকীয় সম্মতি লাভ করে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৮ জুলাই) যা ‘মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা’ হিসেবে পরিচিত ছিল।

2 বিভিন্ন প্রস্তাব: মাউন্টব্যাটেনের প্রস্তাবে বলা হয়- [i] ভারতবর্ষকে বিভক্ত করে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি ডোমিনিয়নের সৃষ্টি করা হবে। ডোমিনিয়ন দুটি সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নিজ নিজ অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিষয়সমূহ পরিচালনা করবে। [ii] মুসলমান প্রধান প্রদেশ-সিন্ধু, ব্রিটিশ অধিকৃত বালুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পশ্চিম পাঞ্জাব ও পূর্ব বাংলা নিয়ে ‘পাকিস্তান’ গড়া হবে। [iii] পাঞ্জাব ও বাংলাকে বিভক্ত করে কোন্ অঞ্চলকে কোন্ ডোমিনিয়নের সঙ্গে যুক্ত করা হবে তা নির্ধারণের জন্য একটি ‘সীমানা নির্ধারণ কমিশন’ ক্ষমতা হস্তান্তরের আগেই গঠিত হবে। [iv] আসামের শ্রীহট্ট জেলা কোন্ ডোমিনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হবে তা গণভোটে স্থির হবে। [v] দেশীয় রাজ্যগুলি নিজ নিজ রাজ্যে সার্বভৌম ক্ষমতা লাভ করবে এবং ইচ্ছা করলে তারা যে-কোনো ডোমিনিয়নে যোগ দিতে পারবে। [vi] প্রতি ডোমিনিয়নের নির্বাচিত গণপরিষদ নিজ এলাকার সংবিধান রচনা করবে। [vii] যতদিন না সংবিধান রচিত হচ্ছে ততদিন ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক নিযুক্ত একজন গভর্নর-জেনারেল ওই ডোমিনিয়নের শাসনে থাকবেন। [viii] স্বাধীনতালাভের পর ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কোনো আইন ওই দুই ডোমিনিয়নে বলবৎ থাকবে না। প্রতি ডোমিনিয়নের নির্বাচিত আইনসভা নিজ নিজ দেশের জন্য আইন রচনা করবে।

মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনার মাধ্যমে ভারত বিভাজন পদ্ধতি

1 শীর্ষনেতৃবর্গের সঙ্গে আলোচনার সূত্রে: ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন প্রায় দেড় মাসের মধ্যে (১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মার্চ থেকে ৬ মে মধ্যে) গান্ধিজি, জওহরলাল, বল্লভভাই প্যাটেল, জিন্না ও দেশীয় রাজাদের সঙ্গে প্রায় ১৩৩ বার বৈঠকে বসেন। ভারত বিভাজন আটকানোর বিভিন্ন উদ্যোগ সত্ত্বেও জিন্না তাঁর পাকিস্তান দাবিতে অনড় থাকেন। মাউন্টব্যাটেন উপলব্ধি করেন যে, ক্যাবিনেট মিশন বা মন্ত্রী মিশন নির্ধারিত ব্যবস্থাপনার পরিবর্তে এক বিকল্প পরিকল্পনা রচনা করা দরকার। 

2 বলকান পরিকল্পনা রচনার মাধ্যমে: বিকল্প পরিকল্পনা হিসেবে মাউন্টব্যাটেন বলকান পরিকল্পনা (Plan Balkan) অনুসরণ করেন। এই পরিকল্পনায় পাঞ্জাব ও বাংলা ভাগের প্রস্তাব রাখা হয় এবং বলা হয় যেসকল প্রদেশ সাংবিধানিক সভায় যোগ দেবে তাদেরও ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। কিন্তু নেহরু ও জিন্না এই পরিকল্পনাকে গ্রহণ না করায় বলকান পরিকল্পনা কার্যকারিতা হারায়।

3 প্ল্যান পার্টিশানের রূপায়ণের দ্বারা: মাউন্টব্যাটেন ভারত বিভাজন লক্ষ্যে প্ল্যান পার্টিশান নামক এক পরিকল্পনা পেশ করেন। নেহরু ও ভি. পি. মেননের (রায়বাহুদুর মেননের) সাহায্য নিয়ে তিনি এই পরিকল্পনা রচনা করেন। এই পরিকল্পনায় বলা হয়-ভারত ও পাকিস্তান দু-পক্ষের ডোমিনিয়ন সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে।

4 ভারতীয় স্বাধীনতা আইন পাসের মাধ্যমে: মাউন্টব্যাটেনের প্রস্তাব মেনে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় স্বাধীনতা বিল রচনা করে। ব্রিটেনের আইনসভায় পাস হওয়ার (১৬ জুলাই) পর সম্রাট ষষ্ঠ জর্জ বিলটিতে সম্মতি জ্ঞাপন করেন (১৮ জুলাই)। বিলটি আইনে পরিণত হলে বড়োলাট মাউন্টব্যাটেন তা কার্যকর করে ইন্ডিয়া ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন ডোমানিয়নের প্রতিষ্ঠা ঘটান।

5 কংগ্রেস ও লিগের সাহায্য নিয়ে: গান্ধিজি ও মৌলানা আজাদ দেশভাগের ঘোর বিরোধী হলেও নেহরু ও প্যাটেলের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস কার্যকরী সমিতি শেষপর্যন্ত ভারত বিভাজনে সায় দিয়েছিল। মুসলিম লিগও মাউন্টব্যাটেন প্রস্তাব মেনে নিলে ভারত বিভাজন সম্ভব হয়।

প্রশ্ন26. মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা কী? এই পরিকল্পনার বিষয়ে ভারতীয় নেতাদের প্রতিক্রিয়া কী ছিল?

অথবা, মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা কী? এই পরিকল্পনার বিষয়ে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের কী মনোভাব ছিল? 

উত্তর: মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা

TOPIC [A]-এর 25 নং রচনাধর্মী প্রশ্নের উত্তরের ‘মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা’ শীর্ষক অংশটি দ্যাখো।

মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা ও ভারতীয় নেতাদের প্রতিক্রিয়া

মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনার বিরোধীতা করেছিল ভারতের বিভিন্ন দল ও সম্প্রদায়ের নেতৃবর্গ।

1 জওহরলাল নেহরু এক নেতার ভাষনে আক্ষেপের সুরে বলেন-আমি এই প্রস্তাব (ভারত বিভাজনে) হৃদয়ের কোনো আনন্দের সঙ্গে তুলছি না। যদিও এ বিষয়ে আমার মনে কোনো সংশয় নেই যে এটি হল শ্রেষ্ঠ বিকল্প।

2 মহাত্মা গান্ধি মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে • বলেন-আমি স্পষ্ট রূপে দেখতে পাচ্ছি সমস্যা সমাধানের পক্ষে আমরা ভুলভাবে এগোচ্ছি।

3 মৌলানা আবুল কালাম আজাদ এই পরিকল্পনা মেনে দেশভাগ হলে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন-দেশভাগ হল এক দৈব দুর্বিপাক।

4 সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল দেশভাগের এই পরিকল্পনাকে মন থেকে মেনে নিতে না পারলেও বলেন-দেশভাগ ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না।

5 ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দেশভাগের নির্দেশ সম্বলিত এই পরিকল্পনার প্রতি প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন-গৃহযুদ্ধের থেকে দেশভাগ ভালো।

6 মহম্মদ আলি জিন্না বলেন-মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনায় ঘোষিত পাকিস্তান আসলে বিকলাঙ্গ ও কীটদগ্ধ।

প্রশ্ন27. ক্ষমতা হস্তান্তর ও ভারতীয়দের অংশগ্রহণের ওপর আলোকপাত করো।

সূচনা: দেশব্যাপী একাধিক গণ আন্দোলনের জেরে ব্রিটিশ ক্ষমতা হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রেক্ষাপটে ভারতীয়দের উদ্যোগ ও অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত।

উত্তর: ক্ষমতা হস্তান্তর ও ভারতীয়দের অংশগ্রহণ

1 ওয়াভেল পরিকল্পনা ও সিমলা বৈঠকের ক্ষেত্রে:

i. ভারতীয়দের প্রতি প্রস্তাব: জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মতভেদের কারণে ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কাজ ব্যাহত হচ্ছিল। এই অচলাবস্থার অবসানের জন্য বড়োলাট ওয়াভেল ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সঙ্গে আলোচনা করে একটি পরিকল্পনা পেশ করেন। এই পরিকল্পনায় কিছু প্রস্তাব রাখা হয়। এই প্রস্তাবগুলি আলোচনা করার জন্য বড়োলাট ওয়াভেল সিমলাতে সর্বদলীয় নেতাদের একটি বৈঠক ডাকেন (২৫ জুন, ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ)।

ii. ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া

[a] মুসলিম লিগ: মুসলিম লিগের তরফে জিন্না সিমলা প্রস্তাব সমর্থনের জন্য দুটি শর্ত আরোপ করেন। প্রথমত, তিনি বলেন-বড়োলাটের শাসন পরিষদের প্রস্তাবিত পাঁচজন মুসলমান সদস্যের প্রত্যেককেই মুসলিম লিগভুক্ত হতে হবে। দ্বিতীয়ত, বড়োলাটের ভোটদানের অধিকারের মধ্যে মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

[b] কংগ্রেস: জাতীয় কংগ্রেস জিন্নার দাবি অগ্রাহ্য করে। কংগ্রেসের তরফ থেকে বলা হয়, যেহেতু কংগ্রেসে বহু জাতীয়তাবাদী মুসলমান সদস্য রয়েছে তাই বড়োলাটের শাসন পরিষদে মুসলমান সদস্য মনোনয়ন করবে কংগ্রেস। বড়োলাটের শাসন পরিষদের সদস্য কারা হবেন সে বিষয়ে কংগ্রেস বড়োলাটকে এক তালিকা পাঠায়। সেই তালিকাতে ছিল দুজন হিন্দু, একজন মুসলমান, একজন পারসি ও একজন খ্রিস্টান।

(c) শিখ ও সংখ্যালঘুদের পাক্ষে: শিখ নেতা তারা সিং ও সংখ্যালঘু নেতা শিবরাজ কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের প্রাধান্যের বিরোধিতা করেন। তাঁরা নিজ নিজ সদস্যদের বড়োলাটের শাসন পরিষদে অন্তর্ভুক্তির দাবিতে সরব হন।

2 মন্ত্রী মিশন বা ক্যাবিনেট মিশন

। ক্ষমতা হস্তান্তরের উদ্যোগ: ক্যাবিনেট মিশনের সদস্যরা জাতীয় নেতৃবর্গের সঙ্গে আলোচনা চালান। মন্ত্রী মিশন তার পরিকল্পনায় বেশ কিছু সুপারিশ উল্লেখ করে।

ii. প্রতিক্রিয়া

[a] কংগ্রেসের: মন্ত্রী মিশনের পরিকল্পনায় অন্তর্বর্তী সরকারে কংগ্রেস ও লিগকে সমমর্যাদা দেওয়ায় কংগ্রেস ক্ষুদ্ধ হয়। এ ছাড়াও গণপরিষদের প্রকৃত ক্ষমতা কেমন হবে, তা নিয়েও কংগ্রেস সন্দেহ প্রকাশ করে।

[b] মুসলিম লিগোর: মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাবে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে প্রদেশগুলিকে ভাগ করার কথা বলা হয়। এই প্রাদেশিক বিভাজন নীতি পাকিস্তান গঠনের উপযোগী হবে মনে করে মুসলিম লিগ একে স্বাগত জানায়।

3. অন্তর্বর্তীকালীন সরকার

i. সরকারে কংগ্রেসের অংশগ্রহণ: জওহরলালের নেতৃত্বে কেন্দ্রে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয় (১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ২ সেপ্টেম্বর)। এই সরকারের উপসভাপতি বা প্রধানমন্ত্রী হন জওহরলাল নিজে। মন্ত্রীসভার ১২ জন সদস্যের মধ্যে ৬ জন ছিলেন কংগ্রেসের।

ii. মুসলিম লিগের ভূমিকা: বড়োলাট ওয়াভেলের অনুরোধে লিগের ৫ জন সদস্য মন্ত্রীসভায় যোগ দেয়। মন্ত্রীসভায় যোগ দিলেও লিগের মন্ত্রীরা একটি পৃথক গোষ্ঠী হিসেবে কাজ করত।

4 মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা

i. দেশভাগের ঘোষণা: মুসলিম লিগের প্রত্যক্ষ সংগ্রামের জেরে দেশজুড়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়। ভারতীয়দের হাতে দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে মাউন্টব্যাটেন তাঁর পরিকল্পনায় দেশভাগের কথা ঘোষণা করেন।

ii. প্রতিক্রিয়া

[a] কংগ্রোদের: মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনায় দেশবিভাগের উল্লেখ থাকায় গান্ধিজি এবং মৌলানা আবুল কালাম আজাদ এর বিরোধিতা করেন।

[b] মুসলিম লিগোর: মুসলিম লিগ মাউন্টব্যাটেন প্রস্তাবিত দেশভাগের ঘোষণাকে স্বাগত জানায়। মাউন্টব্যাটেন লিগ নেতাদের জানান অখণ্ড পাকিস্তান দেওয়া সম্ভব নয়। দ্বিখণ্ডিত বাংলা ও পাঞ্জাবকে পাকিস্তানভুক্ত করা হবে। দেশভাগের সিদ্ধান্তে খুশি হলেও তাই জিন্না মাউন্টব্যাটেন ঘোষিত পাকিস্তানকে বিকলাঙ্গ ও কীটদগ্ধ (Truncated and Moth-eaten) আখ্যা দেন।

[c] কমিউনিস্ট দলের: কমিউনিস্ট দল ভারত ও পাকিস্তান দুই আলাদা রাষ্ট্রের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিরোধিতা করে।

 উপসংহার: শেষপর্যন্ত  ক্ষমতা হস্তান্তরের ফলে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শক্তির হাত থেকে ভারত মুক্ত হল বটে। কিন্তু অখণ্ড ভারত দু-টুকরো হল।

প্রশ্ন28. রাজাজি সূত্র বলতে কী বোঝ? ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রেক্ষাপট রচনায় ওয়াভেল পরিকল্পনা পর্যালোচনা করো।

উত্তর: রাজাজির সূত্র

Topic [A]-এর 19 নং রচনাধর্মী প্রশ্নের উত্তরের ‘রাজাজি সূত্র বা সি. আর. ফর্মুলা’ শীর্ষক অংশটি দ্যাখো।

ওয়াডেল পরিকল্পনা

1 পটভূমি: বড়োলাট হিসেবে ভারতের শাসনভার গ্রহণ করে ওয়াভেল বুঝতে পারেন শীঘ্রই ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হতে চলেছে। কিন্তু জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মতভেদের কারণে ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কাজ ব্যাহত হচ্ছিল। এই অচলাবস্থার অবসানের জন্য বড়োলাট লর্ড ওয়াভেল ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সঙ্গে আলোচনা করে একটি পরিকল্পনা পেশ করেন। এটি ‘ওয়াভেল পরিকল্পনা’ (১৯৪৫ খ্রি.) নামে খ্যাত।

 2 প্রস্তাবসমূহ: এই পরিকল্পনায় বলা হয়- [i] শীঘ্রই সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর ও সংবিধান রচনার কাজ শুরু করবে; [ii] নতুন সংবিধান রচিত না হওয়া পর্যন্ত ভারতীয় নেতাদের নিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হবে; [iii] কেন্দ্রীয় পরিষদে বর্ণহিন্দু ও মুসলমান সদস্যদের সংখ্যা সমান থাকবে; [iv] বড়োলাট এবং প্রধান সেনাপতি ছাড়া সমস্ত সদস্যই হবেন ভারতীয়; [v] ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে পর্যন্ত প্রতিরক্ষার দায়িত্ব ইংরেজ সরকারের হাতেই ন্যস্ত থাকবে।

3 সিমলা বৈঠক: এই প্রস্তাবগুলি আলোচনা করার জন্য লর্ড ওয়াভেল সিমলাতে ভারতীয় নেতাদের একটি বৈঠক ডাকেন (২৫ জুন, ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে)। কংগ্রেসের পক্ষে মৌলানা আজাদ ও মুসলিম লিগের পক্ষে জিন্না এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

4 পরিণতি: জিন্না তাঁর পাকিস্তান দাবি থেকে সরে আসতে অসম্মত হন। তিনি দাবি করেন যে, কেন্দ্রীয় পরিষদে সকল মুসলিম সদস্যকে মুসলিম লিগের সভ্যদের মধ্যে থেকে গ্রহণ করতে হবে। কংগ্রেস এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে। শিখরাও পৃথক অঞ্চলের দাবি জানায়। ভারতের রাজনৈতিক দলগুলি একমত না হওয়ায় সিমলা বৈঠক ব্যর্থ হয়।

29. এশিয়াবাসীদের জন্য এশিয়া নীতি বলতে কী বোঝ? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান কেন এই নীতি গ্রহণ করে?

উত্তর: এশিয়াবাসীদের জন্য এশিয়া নীতি

‘এশিয়াবাসীদের জন্য এশিয়া’-এই নীতির অর্থ হল এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তি নয় এশিয় রাজনৈতিক শক্তিই শাসন করবে।

ইতিপূর্বে চিনের কাছে জাপান যে একুশ দফা দাবি করেছিল তাকে এশিয়ার মনরো নীতি অর্থাৎ এশিয়াবাসীদের জন্য এশিয়া বলে অভিহিত করা হয়। এই স্লোগানের আড়ালে জাপানের প্রকৃত বক্তব্য ছিল ‘পশ্চিমি শক্তিগুলি নয়, এশিয়ায় কর্তৃত্ব করবে জাপান’।

জাপানের এই নীতি গ্রহণের কারণ/ এশিয়াবাসীদের জন্য এশিয়া-উদ্দেশ্য বা কারণ

জাপানের এই নীতি গ্রহণের কয়েকটি উদ্দেশ্য হল-

1. পশ্চিমি শক্তির প্রতিরোেধ: জাপান মনে করত এশিয়ার কোনো অংশে ১ ইউরোপীয় শক্তিগুলির উপনিবেশ স্থাপনের অধিকার নেই । শুধু এশীয়রাই এশিয়া শাসন করার অধিকারী। তাই ইতিপূর্বে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যে * সমস্ত ইউরোপীয় শক্তিগুলি উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল সেগুলির অবসান ঘটানোর        লক্ষ্যে জাপান সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির খলে জাপান নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়।

2. জাপানি সম্প্রসারণ নীতি: এশীয়দের জন্য এশিয়া এই স্লোগান তুলে জাপান আসলে এশিয়া জুড়ে এক বৃহৎ জাপানি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিল। বিশেষত পূর্ব এশিয়ায় জাপান নিজের সাম্রাজ্যবাদী আকাঙ্ক্ষা চারিতার্থ করতে চেয়েছিল। এই লক্ষ্যে জাপানের প্রধানমন্ত্রী হিদেকি তোজো ‘বৃহত্তর পূর্ব এশিয়া সম্মেলন’ (১৯৪৩ খ্রি.)-এ এক বক্তৃতায় বলেন পূর্ব এশিয়ায় ‘এশিয়াবাসীদের জন্য এশিয়া’ নীতির দ্বারা তাঁদের সম্প্রসারণের আশা পরিচালিত হয়েছে।

3. এশীয় ঐক্যগঠন: এশীয়দের জন্য এশিয়া এই স্লোগান তুলে জাপান এশীয় শক্তিগুলিকে একজোট করতে চেয়েছিল। জাপান চেয়েছিল এশীয় শক্তিগুলি একজোট হয়ে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলিকে প্রতিরোধ করুক। তাই জাপান পশ্চিমি দেশগুলির বিরুদ্ধে এশিয়ার দেশগুলির যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে উৎসাহিত করে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজের অধিকারকে সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাপান এই অঞ্চলের রাজনৈতিক শক্তি ও জাতিগুলিকে মিত্র শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে সামিল করানোর প্রচেষ্টা চালায়।

4 এশিয়ার নেতৃত্ব গ্রহণ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে জাপান মিত্র শক্তির বিরুদ্ধে অক্ষশক্তি জোটে যোগ দিয়েছিল। জাপান চেয়েছিল মিত্রশক্তি পক্ষ ইউরোপ ও আমেরিকার কর্তৃত্বাধীন এশিয় অঞ্চলগুলিতে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে। পশ্চিমি শক্তিগুলিকে সরিয়ে বৃহত্তর পূর্ব এশিয়ায় আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জাপান নিজের একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রতিষ্ঠায় উন্মুখ হয়ে উঠেছিল। জাপান চেয়েছিল এশিয়ার নেতৃত্বভার থাকুক তার হাতে।

5 প্রাকৃতিক সম্পদ লাভ: আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স-সহ ইউরোপীয় শক্তিগুলি পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে একটানা প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলন ও কাঁচামাল সংগ্রহ করে নিজের দেশে নিয়ে যায়। এইভাবে ইউরোপীয় দেশগুলিতে সহজে শিল্পের বিকাশ ঘটানো হয়। জাপান এটা মেনে নিতে পারেনি কারণ জাপান মনে করত এশিয়া ভূখণ্ডের যাবতীয় সম্পদ ও কাঁচামালের ওপর অধিকার রয়েছে একমাত্র এশীয়দেরই। ইউরোপীয়দের এই অবৈধ হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার বিরুদ্ধে জাপান সচেষ্ট হয়ে ওঠে এবং স্লোগান তোলে এশীয়দের জন্য এশিয়া।

29’এশীয়দের জন্য এশিয়া’-এই উক্তির আড়ালে জাপানি সাম্রাজ্যবাদের পরিচয় দাও।

সূচনা: এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে জাপান নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল। শুধু তাই নয় জাপান চেয়েছিল ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির সমকক্ষ হয়ে উঠতে। এই আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার লক্ষ্যে জাপান স্লোগান তুলেছিল এশীয়দের জন্য এশিয়া।

উত্তর: এশীয়দের জন্য এশিয়া’-ব্যাখ্যা

1. প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত জাপানি সাম্রাজ্যবাদ

1. সাম্রাজ্যবাদী পদক্ষেপ গ্রহণ: ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে চিন জাপান যুদ্ধ শুরু হয়। এশিয়া ভূখণ্ডে জাপান আধিপত্য বিস্তার করতে গেলে চিন ও জাপানের মধ্যে এই বিরোধের সূচনা ঘটে। এশিয়া ভুখণ্ডে রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে জাপান চেয়েছিল কোরিয়াকে পরাজিত করতে। কিন্তু কোরিয়া জাপানের হাতে চলে যাক চিন তা চায়নি। তাই চিন জাপান যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। চিন জাপান যুদ্ধে চিনের পরাজয় ও শিমোনোসেকির সন্ধির ফলে চিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ii . জাপানি সাম্রাজ্যবাদের তীব্রতা বৃদ্ধি: রুশ-জাপান যুদ্ধে জেতার পর জাপানের সাম্রাজ্যবাদের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। ইতিপূর্বেই শিমোনোসেকির সন্ধি বলে জাপান ফরমোজা দ্বীপের অধিকার লাভ করেছিল। পরে পোর্টসমাউথের সন্ধি বলে জাপান কোরিয়ার ওপর নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। রুশ জাপান যুদ্ধের পর দক্ষিণ মাঞ্জুরিয়াতে জাপানের প্রভাব স্বীকৃতি পায়। শিমোনোসেকির সন্ধির পর সুকৌশলে জাপান শান্টুং অঞ্চল নিজের অধিকারে আনে।

iii . একুশ দফা দাবি: শান্টুং প্রদেশে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার পর জাপান চীনের কাছে একুশ দফা দাবি পেশ করে। পরবর্তীকালে ভার্সাই সন্ধিতে জাপানের একুশ দফা দাবিগুলির মধ্যে বেশ কিছু দাবি মেনে নেওয়া হয়। দূর প্রাচ্যে জাপান এক প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

2 দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত জাপানি সাম্রাজ্যবাদ

i. ওয়াশিংটন সম্মেলন: ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানকে ইঙ্গ-জাপান চুক্তি বাতিলের প্রস্তাব পাঠায়। কিন্তু জাপান এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি। তাই মার্কিন উদ্যোগে আয়োজিত হয় ওয়াশিংটন সম্মেলন’ (১৯২১ খ্রি.)। এই সম্মেলনের মধ্যে জাপানের সামরিক শক্তি হ্রাস ও সাম্রাজ্যবাদী নীতিতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।

ii. জাপানের মাঞ্চুরিয়া অধিকার: জাপান নিজের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নিদর্শন হিসেবে চিনের মাঞ্চুরিয়া অঞ্চলটি অধিকার করে নেয় (১৯৩২ খ্রি.)। সোভিয়েত রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি জাপানের সমালোচনা করে। রাষ্ট্রসংঘ ও লিটন কমিশনের প্রতিবেদনের মাধ্যমে জাপানের মাঞ্জুরিয়া অধিগ্রহণকে সমালোচনা করেন।

iii. জাপানের মনরো নীতি: মাঞ্জুরিয়া অধিকার করার পর রাষ্ট্রসংঘের ভূমিকায় জাপান ক্ষুদ্ধ হয়। প্রতিবাদ হিসেবে জাপান রাষ্ট্রসংঘের সদস্যপদ ত্যাগ করেন। পূর্ব এশিয়াতে জাপান নিজের প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে এক নতুন নীতি গ্রহণ করে। এই নীতির নাম ‘জাপানি মনরো ডকট্রিন ফর ইস্ট এশিয়া’। এই নীতি ঘোষণা করে জাপান হুঁশিয়ারি দিয়ে বলে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ যেন পূর্ব এশিয়াতে কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে।

iv. পূর্ব এশিয়ার নতুন বিধান: জাপানের প্রধানমন্ত্রী পূর্ব এশিয়ার নতুন বিধান (New Order of East Asia) ঘোষণা করেন (১৯৩৬ খ্রি.)। এই ঘোষণার উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের অবসান ঘটিয়ে জাপানি সাম্রাজ্যবাদ প্রবর্তন করা। জাপানের এই উদ্যোগে শঙ্কিত হয়ে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ চিনের পাশে দাঁড়ায়।

v. ইন্দোচিন দখল: পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের প্রতিরোধ অগ্রাহ্য করে জাপান ইন্দোচিনের দখল নেয়। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে যাবতীয় রপ্তানিসামগ্রী বন্ধ করে দেয়। ফলে জাপান-মার্কিন সম্পর্ক তিক্ততায় পরিণত হয়।

Vi. প্রশান্ত মহাসাগরীয় যুদ্ধ: জাপান প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটি পার্ল হারবারে বোমা নিক্ষেপ করে মার্কিন বিরোধী অক্ষশক্তিজোটে যোগ দেয়। জাপানের সামরিক বাহিনী প্রথম দিকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ, ইন্দো-বর্মা সীমান্ত, অ্যালিসিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, সোলেমনস, নিউ গিনি প্রভৃতি অঞ্চল দখল করে নেয়। পরে অবশ্য জাপান প্রশান্ত মহাসাগরের মিডওয়ে দ্বীপের যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পরাজিত হয়।

উপসংহার: শেষপর্যন্ত জাপানের হিরোসিমা ও নাগাসাকি শহরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আণবিক বোমা নিক্ষেপ করলে জাপান আত্মসমর্পণ করে।

30. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাপানিদের অগ্রগতি পর্যালোচনা করো।

সূচনা: ইউরোপের মাটিতে ইউরোপীয় দেশগুলি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যস্ত থাকায় তাদের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উপনিবেশগুলি অরক্ষিত হয়ে পড়ে। এই সুযোগে জাপান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নিজের সাম্রাজ্য বিস্তারের উদ্যোগ নেয়।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাপানিদের অগ্রগতি

1 চিনে আক্রমণ

i. সূচনা: ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ জুড়ে জাপানি সেনারা চিনে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালায়। জাপানের সেনাবাহিনী চিনের পিকিং শহরের দক্ষিণে মার্কোপোলো সেতুর কাছে অবস্থানরত চিনা সেনাদের আক্রমণ করে। পিকিং শহরের সীমান্তবর্তী লুকো-চিয়াও (Luko- Chiao) নামে গ্রামটিতে শুরু হয় চিনা ও জাপানি সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষ (১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ৭ জুলাই)।

ii. অধিকার প্রতিষ্ঠা: জাপানি সেনারা পিকিং ও তিয়েনসিন এই দুটি শহরের দখল নেয়। দীর্ঘস্থায়ী এই যুদ্ধে সাংহাই, নানকিং, পিকিং, ক্যান্টন এবং উয়ান থেকে সেচুয়ান পর্যন্ত বিশাল ভূখণ্ডের ওপর জাপান নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে।

2 এশিয়ার বিস্তার নীতির বৃহত্তর পরিকল্পনা: ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ জাপান এশিয়াতে জাপানি সাম্রাজ্য বিস্তারের লক্ষ্যে বৃহত্তর পরিকল্পনা গ্রহণ করে। জাপানের এই পরিকল্পনার নাম ছিল ‘বৃহত্তর পূর্ব এশিয়া যৌথ অগ্রগতি বলয়’ (The Greater East Asia Co-prosperity Sphere)। শিরটোরি তোসিও নামে জাপানের এক প্রভাবশালী আমলা সর্বপ্রথম এই নীতি উত্থাপন করেন। এই পরিকল্পনার বাস্তব রূপায়ণ ঘটান জাপানের বিদেশমন্ত্রী মাৎসুওকা (Matsuoka)। এই পরিকল্পনার মূল কথা ছিল-জাপান কেবলমাত্র মাঞ্জুকুয়ো এবং চিনের মধ্যে জাপানি সম্প্রসারণবাদকে আটকে রাখবে না। সে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলেও তার সাম্রাজ্যবাদের প্রসার ঘটাবে।

3. জার্মান সাহায্য

1. জাপ-জার্মান মিত্রতা: এশিয়াজুড়ে সফলভাবে জাপানি সাম্রাজ্যবাদের বিস্তারের লক্ষ্যে জাপানি মন্ত্রীসভার এক উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলন আয়োজিত হয়। এই সম্মেলনে (১৯৪০ খ্রি., ১৯ জুলাই) জাপ-জার্মান মিত্রতাকে আরও সুদৃঢ় করার অঙ্গীকার নেওয়া হয়। এশিয়া মহাদেশে ইঙ্গ-ডাচ-ফরাসি-পোর্তুগিজ উপনিবেশগুলির ওপর আঘাত হানার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এশিয়ায় জাপানি বিস্তার নীতিকে সমর্থন জানায় জার্মানি। এক্ষেত্রে জার্মানির উদ্দেশ্য ছিল এশিয়ার রণাঙ্গনে ব্রিটেন ব্যস্ত থাকলে ইউরোপে জার্মানির বিরুদ্ধ পক্ষ মিত্রশক্তিজোটের দুর্বলতা বাড়বে।

ii . ত্রিপাক্ষিক সামরিক চুক্তি: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সের পরাজয় ঘটলে জাপান ইটালি ও জার্মানির সঙ্গে ‘রোম-বার্লিন-টোকিও চুক্তি’ (১৯৪০ খ্রি., ২৭ সেপ্টেম্বর)-তে আবদ্ধ হয়। এই চুক্তি ‘ত্রিপাক্ষিক অক্ষ চুক্তি’ (Tripartite Axis Pact) বা ‘অ্যান্টি কমিন্টার্ন চুক্তি’ নামেও পরিচিত। এই চুক্তির পরেই জাপান একে একে সুমাত্রা, সিঙ্গাপুর, ফিলিপিনস, বোর্নিয়ো এবং জাভায় ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণাধীন বন্দরগুলি ধ্বংস করে দেয়।

Iii. বিভিন্ন অঞ্চল দখল: সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি গ্রহণ করে জাপান একের পর এক শ্যামদেশ (থাইল্যান্ড), হংকং, মালয়, সিঙ্গাপুর, পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ (ইন্দোনেশিয়া) দখল করে।

4. ইন্দোচিনে অনুপ্রবেশ

i. কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকাকালীন জাপান ফরাসি নিয়ন্ত্রিত ইন্দোচিনে নিজের কর্তৃত্ব স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সের পতন ঘটলে জাপান ইন্দোচিনে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে।

i. ভিয়েতমিনদের বিরোধিতা: হো-চি-মিনের নেতৃত্বে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা চলাকালীন আন্নাম, টংকিং, কোচিন-চিন একজোট হয়ে ভিয়েতনাম নামে এক স্বশাসিত রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। হো-চি-মিন ভিয়েতনামি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গঠন। করেন ‘ভিয়েতমিন’ (Vietminh) বা ‘ভিয়েতনামি স্বাধীনতা লিগ’ (League for Vietnamese Independence)। এই মুক্তিযোদ্ধারা জাপানিদের হাত শুরু করে।

iii. ইন্দোচিন ত্যাগ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তিজোট শেষপর্যন্ত পরাজিত হয়। জাপান আত্মসমর্পণ করে। ফলে সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে জাপান সরে আসতে বাধ্য হয়।

উগসংহার: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একেবারে শেষপর্বে (১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাপানি রণকৌশলের বদল ঘটে। জাপান বিস্তার নীতির পরিবর্তে আত্মরক্ষানীতি গ্রহণ করে।

31. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির সঙ্গে জাপানিদের সংযোগজনিত ধারা বিশ্লেষণ করো।

সূচনা: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আই. এন. এ. (Indian National Army) জাপানি সাহায্যে ভারতের মুক্তি অর্জনে সচেষ্ট হলে উভয়ের মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হয়।

1. দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইন্দোচিনে ইউরোপীয় উপনিবেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতি আলোচনা করো।

সূচনা: ইন্দোচিন বলতে আন্নাম, টংকিং এবং কোচিন চিনকে বোঝায়। এই ইন্দোচিনের অধিবাসীরা দীর্ঘদিন বিভিন্ন ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির অধীনে পরাধীন ছিল। দীর্ঘ সংগ্রামের পর এই অঞ্চল ঔপনিবেশিক শক্তির হাত থেকে মুক্তি পায়।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইন্দোচিনে ইউরোপীয় উপনিবেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতি

ফরাসি সাম্রাজ্যবাদ: উনিশ শতক নাগাদ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্তর্গত সমগ্র ইন্দোচিন উপদ্বীপ অঞ্চলটি ফরাসি সাম্রাজ্যবাদী শাসনের আওতায় আসে। মূলত উনিশ শতকে তৃতীয় নেপোলিয়ানের আমলেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের সূচনা ঘটে। এর মধ্যে আবার বিংশ শতকের প্রথম দিক থেকে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ইন্দোচিনে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূচনা ঘটে।

2 জাপানি সাম্রাজ্যবাদ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে জাপান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তার সাম্রাজ্য বিস্তার নীতির প্রয়োগ ঘটাতে শুরু করে। এদিকে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়কালে জার্মান আক্রমণে ফ্রান্স কোণঠাসা হয়ে পড়লে সেই সুযোগে জাপান সমগ্র ইন্দোচিনে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। ফলে ইন্দোচিন জাপানি সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের শিকার হয়। জাপানি সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে ইন্দোচিনবাসী একজোট হয়। ফলস্বরূপ বিশিষ্ট কমিউনিস্ট নেতা হো-চি-মিন (নগুয়েন-আই-কুয়োক)-এর নেতৃত্বে ইন্দোচিন, ভিয়েতনাম নামে আত্মপ্রকাশ করে।

3 ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা: ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে পট্সডাম সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল জাপান ইন্দোচিন থেকে সরে গেলে ইন্দোচিনের উত্তরাঞ্চলে জাতীয়তাবাদী কুয়োমিং তাং চিন ও দক্ষিণাঞ্চলে ব্রিটেন দায়িত্ব নেবে। এদিকে হো-চি-মিন-এর নেতৃত্বে হ্যানয় অঞ্চলে অস্থায়ী গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। হো-চি-মিন এই প্রজাতন্ত্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। পরবর্তী সময়ে ভিয়েতনাম থেকে ব্রিটিশ ও চিনা সামরিক বাহিনী সরে যায়। এই সুযোগে ফ্রান্স পুনরায় ভিয়েতনামে নিজের আধিপত্য  প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অগ্রসর হয়। কিন্তু হো-চি-মিন ভিয়েতনামে ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠায় বাধা দেন। অবশেষে ভিয়েতমিন গেরিলা বাহিনীর আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ফ্রান্স ভিয়েতমিনের 10 সঙ্গে এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয় (১৯৪৬ খ্রি., মার্চ)। চুক্তির শর্তানুসারে হো-চি-মিন এর গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রকে ইন্দোচিন ফেডারেশন এবং ফরাসি ইউনিয়নের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু অচিরেই এই চুক্তিকে অবজ্ঞা করে ফ্রান্স ভিয়েতনামে নিজের ক্ষমতা সুপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। আমেরিকাও ফ্রান্সের এই উদ্যোগকে সমর্থন করে। এমনকি ব্রিটেনও ইন্দোচিনে ফ্রান্সকে তার পর্বতন সাম্রাজ্যের পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে সমর্থন জানায়।

4 মার্কিনি হস্তক্ষেপ

1. ফ্রান্সকে সাহায্য: ইন্দোচিনে হো-চি-মিন-এর নেতৃত্বাধীন সরকারকে সাম্যবাদী সোভিয়েত ও চিন সমর্থন জানালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফ্রান্সকে সরাসরি সাহায্য করার নীতি গ্রহণ করে।

ii. প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ: জেনেভা সম্মেলন (১৯৫৪ খ্রি., ২০ জুলাই)-এ গৃহীত সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে ভিয়েতনামে দীর্ঘ ফরাসি সাম্রাজ্যবাদী শাসনের অবসান ঘটে। তারপরই সাম্যবাদের প্রসার রোধের লক্ষ্যে আমেরিকা সরাসরি ভিয়েতনাম সংকটে অংশগ্রহণ করে। মার্কিন প্রশাসন প্রথমেই দক্ষিণ ভিয়েতনামে বাও-দাই সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে। দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিযুক্ত করে ফ্রান্স বিরোধী ও সাম্যবাদ বিরোধী নেতা ন-দিন-দিয়েমকে।

iii. সিয়াটো গঠন: উত্তর ভিয়েতনামে হো-চি-মিনের সরকারকে চিন ও সোভিয়েত তার সাহায্য অব্যাহত রাখে। পক্ষান্তরে ইন্দোচিন-সহ সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে সাম্যবাদ মুক্ত করার লক্ষ্যে মার্কিন উদ্যোগে গঠিত হয় সিয়াটো (SEATO)¹¹ বা ‘দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা’। এদিকে দিয়েমের মার্কিন তোষণে দক্ষিণ ভিয়েতনামে গণ অসন্তোষ দেখা দেয়। দক্ষিণ ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসনের বিরোধিতার লক্ষ্যে গঠিত হয় জাতীয় মুক্তি মোর্চা (NLF) 12।

iv. মার্কিনদের পরাজয়: দক্ষিণ ভিয়েতনামে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দিয়েম সরকারের পতন ঘটে। দক্ষিণ ভিয়েতনামের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় জেনারেল নগুয়েন ভ্যান থিউ-এর হাতে। ভিয়েতকং বাহিনী ও উত্তর ভিয়েতনামের বাহিনীর মিলিত আক্রমণে মার্কিনিরা পিছু হটে। প্যারিস সম্মেলনে (১৯৭৩ খ্রি., ২৩ জানুয়ারি) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম এবং ভিয়েতকং-এর প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী মার্কিন প্রশাসন তাদের সৈন্য ও পরামর্শদাতাদের ভিয়েতনাম থেকে সরিয়ে নিতে রাজি হয়।

উপসংহার: শেষপর্যন্ত উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম ঐক্যবদ্ধ হয়। আত্মপ্রকাশ ঘটে সংযুক্ত, স্বাধীন, সার্বভৌম সমাজবাদী ভিয়েতনাম রাষ্ট্রের।

32. দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইন্দোনেশিয়ায় ইউরোপীয় উপনিবেশ বিস্তারের বর্ণনা দাও।

সূচনা: জাভা, সুমাত্রা, দক্ষিণ বোর্নিয়ো, সেলিবিস, বালি, লম্বাক, ফ্লোরেস, মালাক্কা দ্বীপপুঞ্জ ও পশ্চিম ইরিয়ন এবং তিমোর দ্বীপের অংশবিশেষ নিয়ে ইন্দোনেশিয়া গঠিত। বাণিজ্যের লক্ষ্যে এখানে একের পর এক ইউরোপীয় শক্তির আগমন ঘটে।

ইন্দোনেশিয়ায় ইউরোপীয় উপনিবেশের পরিবর্তিত প্রাথমিক পরিস্থিতি

1 ইন্দোনেশিয়ার ঔপনিবেশিক পরিস্থিতি

i. পোর্তুগিজ শক্তি

[a] অনুপ্রবেশ: ষোড়শ শতক থেকে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে দক্ষিণ- পূর্ব এশিয়ার গুরুত্ব বাড়তে থাকে। ইউরোপীয় বণিক গোষ্ঠীগুলির সমুদ্র বাণিজ্যের প্রধান গন্তব্যস্থল হয়ে ওঠে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। মূলত মশলা বাণিজ্যের তাগিদেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইন্দোনেশিয়ায় একাধিক ইউরোপীয় শক্তি আসে। এক্ষেত্রে সবার আগে পোর্তুগিজদের অনুপ্রবেশ ঘটে।

[b] মালাক্কা অধিগ্রহণ: মশলা বাণিজ্যের লক্ষ্যে পোর্তুগিজরা ইন্দোনেশিয়াতে আসে। সমকালীন বিশ্ববাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র মালাক্কা দ্বীপ তারা অধিগ্রহণ করে (১৫১১ খ্রি.)।

[c] স্থানীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ: ইন্দোনেশিয়ার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপরাজ্যের অধিকাংশে মুসলিম শাসকদের আধিপত্য বজায় ছিল। আচে (Acheh) রাজ্যের সুলতান পোর্তুগিজদের বিরোধিতা করলেও টারনেট (Ternate) ও টিডোর (Tidore)-সহ একাধিক দ্বীপরাজ্যের সুলতানগণ পোর্তুগিজদের সাহায্য করেন।

[d] আধিপত্যের অবস্থান: পোর্তুগিজদের তরফে ইন্দোনেশিয়ার অধিবাসীদের ওপর জোর করে খ্রিস্টধর্ম চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা মুসলিম শাসক ও প্রজাদের মনে সন্দেহ তৈরি করে। সুলতান বাবুল্লাহর নেতৃত্বে পোর্তুগিজ বিরোধিতা চরমে পৌঁছোয়। শেষপর্যন্ত পোর্তুগিজদের প্রভাব কমতে থাকে এবং পোর্তুগিজ আধিপত্যের অবসান ঘটে।

ii. ওলন্দাজ বা ডাচ শক্তি

[a] অনুপ্রবেশ: সপ্তদশ শতকের শেষদিকে পোর্তুগিজ ও ইংরেজদের বিতাড়িত করে ওলন্দাজ বা ডাচরা এককভাবে ইন্দোনেশিয়াতে অবিসংবাদিত ঔপনিবেশিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

[b] কোম্পানি প্রতিষ্ঠা: পোর্তুগিজদের সঙ্গে দ্বন্দ্বকালে ওলন্দাজ বাণিজ্য ব্যাহত হতে থাকে। তা ছাড়া যুদ্ধকালে মূল্যবৃদ্ধিও চরমে পৌঁছোয়। এই পরিস্থিতিতে ওলন্দাজরা গঠন করে ‘ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ বা VOC (Vereenigde Oostindische Com-pagnie)

[c] কোম্পানি শাসনের অবসান: ইউরোপীয় রাজনীতিতে ডাচরা ব্রিটিশের কাছে পর্যুদস্ত হয়। এর জেরে ইন্দোনেশিয়ার বাণিজ্যে ডাচদের একাধিপত্যের অবসান ঘটে (১৭৮৪ খ্রি.)।

2 ইন্দোনেশীয় জাতীয়তাবাদ

i. উন্মেষ: ইন্দোনেশিয়ায় উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে প্রথম জাতীয়তাবাদী জাগরণ ঘটে ‘বুদি উতোমা’ নামে এক সংস্কারধর্মী ও শিক্ষামূলক সংগঠন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে (১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ)। একই সময়ে স্থানীয় শাসকগোষ্ঠী বা ৰূপতি (ভূপতি)-দের উদ্যোগে গড়ে ওঠে ‘শশাঙ্ক পূর্নামা’ (একটি সূচনা) নামে আর-একটি সংগঠন। এই দুই সংগঠন মিলে ইন্দোনেশিয়াতে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটায়।

ii. প্রসার: পূর্ব জাভার অধিবাসী জওয়েস ডেকার নামে এক সাংবাদিক এক ডাচ বিরোধী সংঘবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তোলেন। তিনি ডেকার ‘ইন্ডিজ পার্টি’ (ইন্দিশে পারতিজ) নামে এক দল গঠন করেন। এই দলের লক্ষ্য ছিল-[a] আইনের চোখে সমস্ত জাতির সমতার স্বীকৃতি, [b] সমান শ্রমের ক্ষেত্রে সমান বেতন দান, [c] হল্যান্ডের হাত থেকে মুক্তিলাভ।

পসংহার: পরবর্তীকালে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন জাভা থেকে ধীরে ইউনিয়ন পরে ইন্দোনেশিয়ার অন্যান্য দ্বীপগলিতে ছড়িয়ে পড়ে। মাতৃভাষায় মুদ্রণ গঠন কা বস্থার প্রচলন, বেতার ব্যবস্থার প্রবর্তন, পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতি (Partai ন্দানেশিয়ায় জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রসার ঘটাতে সাহায্য করে।

33. দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্তর্গত ইন্দোনেশিয়াতে ইউরোপীয় উপনিবেশের বিরুদ্ধে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পরিবর্তিত পরিস্থিতি পর্যালোচনা করো।

সূচনা: প্রাচীন যুগে ইন্দোনেশিয়ায় হিন্দু রাজারা রাজত্ব করতেন। ষোড়শ শতকের শেষ দিকে স্পেনীয়, ইংরেজ এবং ডাচ (ওলন্দাজ) শক্তিবর্গ ইন্দোনেশিয়াতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। শেষপর্যন্ত ডাচ বণিক কোম্পানি (Netherlands United East India Company) ইন্দোনেশিয়াতে নিজেদের উপনিবেশ গড়ে তুলতে সফল হয়।

ইন্দোনেশিয়া: প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পরিবর্তিত পরিস্থিতি

1 ডাচ শাসন: ডাচ কোম্পানির শাসনের অবসানের পর ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে ডাচ সরকার প্রত্যক্ষভাবে ইন্দোনেশিয়ার শাসনভার হাতে নেয়। ডাচ শাসনব্যবস্থায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রতি অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। বাস্তবে আবিষ্কৃত তৈলখনি থেকে তেল রপ্তানি করে এবং উৎপাদিত রবার বিক্রয় করে ডাচ সরকার ফুলেফেঁপে উঠলেও জনকল্যাণমূলক কর্মসূচিগুলি অবহেলিতই থেকে যায়।

2 ইন্দোনেশীয় জাতীয়তাবাদ

i. উন্মেষ: ইন্দোনেশিয়াতেও উপনিবেশবাদ বিরোধিতা শুরু হয়। ডাচ সরকারের সেনাদের সঙ্গে ইন্দোনেশীয়দের ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কিছু লড়াই বাধে, যেমন-জাভার যুদ্ধ, সুমাত্রায় সংঘটিত পার্দেরি যুদ্ধ এবং আচে যুদ্ধ প্রভৃতি। এই লড়াইগুলিকে ‘Pre-Nationalist Movement’ বা প্রাক্-জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বলা যায়।

ii. রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা: ইতিপূর্বে ইন্দোনেশিয়ায় গড়ে ওঠে বেশ কয়েকটি জাতীয়তাবাদী প্রতিষ্ঠান, যেমন-বুদি উতোমা (বুদ্ধি উত্তম), সারেকত ইসলাম (মুসলিম জাতীয়তাবাদী সংগঠন), কমিউনিস্ট দল PKI (Partai Komunis Indonesia) প্রভৃতি। এই সমস্ত দলগুলির নেতৃত্বে ডাচ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই শুরু হয়। জাতীয়তাবাদী নেতা ড. সুকর্ণ-এর নেতৃত্বে ইন্দোনেশিয়ায় ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের ৪ জুলাই ‘ইন্দোনেশীয় জাতীয়তাবাদী দল’ প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলিম জাতীয়তাবাদী সংগঠন সারেকত ইসলাম ইন্দোনেশিয়ায় স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তনের দাবি জানায়।

3. কলোনিয়াল কাউন্সিল গঠন: ইন্দোনেশিয়ার উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম সফলতা ছিল এক কলোনিয়াল কাউন্সিল বা ভোকস্রাদ (Volksraad) গঠন (১৯১৮ খ্রি.)। 4

4. উপনিবেশ বিরোধী জাতীয় আন্দোলন: হল্যান্ডে ইন্দোনেশিয়ার প্রবাসী ছাত্ররা পেরহিম্পোনান ইন্দোনেশিয়া বা ইন্দোনেশীয় ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করেন। পরে সুকর্ণ ইন্দোনেশীয় ইউনিয়নের সদস্যদের নিয়ে গঠন করেন (১৯২৭ খ্রিস্টাব্দ, ৪ জুলাই) ইন্দোনেশীয় জাতীয় দল বা PNI (Partai Nasional Indonesia)। এই দল সর্বপ্রথম দেশজুড়ে এক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়। জাতীয় দলের শক্তিবৃদ্ধিতে ভীত হয়ে ডাচ সরকার সুকর্ণ-সহ অন্য তিন নেতাকে কারারুদ্ধ করে। এসময়ে হল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাপ্রাপ্ত মহম্মদ হাত্তা PNI দলকে নেতৃত্ব দেন।

5 জাপানি সাম্রাজ্যবাদ কায়েম: থাইল্যান্ড অধিকার করার পর জাপানি সেনারা ইন্দোনেশিয়ার দখল নেয় (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৯ মার্চ)। ফলে ইন্দোনেশিয়ায় জাপানি ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ কায়েম হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে জাপানের পরাজয় আসন্ন হলে জাপান ইন্দোনেশিয়া ত্যাগ করে।

6 ব্রিটিশ সমরবাহিনীর দখলদারি: জাপান সরে দাঁড়ালে পট্সডাম চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটিশ বাহিনী আপাতভাবে ইন্দোনেশিয়ার দখলদারি নেয়।

7 ডাচ শাসনের পুনঃপ্রতিষ্ঠা: ব্রিটিশ মদতে সুমাত্রা ও জাভা ছাড়া ইন্দোনেশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলগুলিতে ডাচ কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তীব্র রূপ নিলে ব্রিটিশের মধ্যস্থতায় ডাচ- ইন্দোনেশীয় চুক্তি (লিঙ্গজ্যোতি) স্বাক্ষরিত হয় (১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১২ নভেম্বর)। চুক্তির শেষে ব্রিটিশ সেনাদল ইন্দোনেশিয়া ত্যাগ করে।

৪ ডাচ শাসনের অবসান: সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের (UNO) মধ্যস্থতায় ইংল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়া উভয় পক্ষের মধ্যে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে একটি সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৭ ডিসেম্বর ডাচরা ইন্দোনেশিয়া ত্যাগ করে। স্বাধীন United States of Indonesia বা USI- এর প্রথম রাষ্ট্রপতি হন সুকর্ণ আর প্রধানমন্ত্রী হন সুতান জাহরির।

34. ইন্দোনেশিয়ার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ড. সুকর্ণ-এর ভূমিকা লেখো।

অথবা, ইন্দোনেশিয়ার মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতায় ড. সুকর্ণ-এর অবদান আলোচনা করো। 

সূচনা: জাভা, সুমাত্রা, বোর্নিয়ো এবং একশোরও বেশি ছোটো-বড়ো দ্বীপ নিয়ে গঠিত ইন্দোনেশিয়া একটি দ্বীপ রাষ্ট্র। আঠারো শতক থেকে এই দ্বীপ রাষ্ট্রে ডাচ বা ওলন্দাজদের উপনিবেশ গড়ে ওঠে। অনেক ঘাতপ্রতিঘাত পেরিয়ে শেষপর্যন্ত ড. সুকর্ণ-এর নেতৃত্বে ইন্দোনেশিয়া স্বাধীনতা ফিরে পায়।

ইন্দোনেশিয়ার জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও সুকর্ণ

1 PNI দলগঠন: ইতিপূর্বে হল্যান্ডে গঠিত (১৯২২ খ্রি.) ইন্দোনেশিয় ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন পেশায় ইঞ্জিনিয়ার সুকর্ণ। সুকর্ণ-এর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে PNI দল। অল্পদিনের মধ্যে এই দল ইন্দোনেশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হয়ে ওঠে। সুকর্ণের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এই রাজনৈতিক দলটি ইন্দোনেশিয়ার পূর্বেকার রাজনৈতিক দল PKI-এর জনপ্রিয়তাকে ছাপিয়ে যায়।

2 ঔপনিবেশিক সরকারের বিরোধিতা: সুকর্ণ-এর নেতৃত্বে PNI দল ইন্দোনেশিয়ার সকল অকমিউনিস্টদের একজোট করে এবং অসহযোগীতার নীতি গ্রহণ করে। এই দল কৃষক ও শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও মর্যাদা বৃদ্ধির ওপর জোর দেয়। পাশাপাশি এই দল সাম্রাজ্যবাদ ও ধনতন্ত্রের বিরোধিতা করে।

3 জাতীয়তাবাদের ভিত্তি স্থাপন: সুকর্ণ-এর নেতৃত্বে ইন্দোনেশিয়ার জাতীয়তাবাদী দল দলীয় পতাকা হিসেবে লাল ও সাদা পতাকা গ্রহণ করে।n ইন্দোনেশীয় ভাষা ও জাতীয় সংগীত ‘ইন্দোনেশিয়া বয়া’ (বৃহত্তর ইন্দোনেশিয়া) গ্রহণ করে। এইভাবে এই দল ইন্দোনেশিয়াবাসীর অন্তরে জাতীয়তাবাদের বীজ বপন করে।

4 আন্দোলন দমন: ডাচ সরকার ইন্দোনেশিয়ার জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমনের লক্ষ্যে সুকর্ণ-সহ চারজন জাতীয় নেতাকে বন্দি করে, জাতীয় দল ভেঙে দিয়ে তাকে বেআইনি ঘোষণা করে। এই সময়ে এই দলের দুই নেতা মহম্মদ হাত্তা ও সুতান জাহরির বিদেশে শিক্ষা শেষ করে দেশে ফিরে আসেন ও জাতীয় আন্দোলন পরিচালনার ভার নেন।

5 পারতাই ইন্দোনেশিয়া গঠন: বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে সুকর্ণ পুনরায় জাতীয় আন্দোলনে মনোনিবেশ করেন। তিনি ইন্দোনেশিয়ার বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীগুলিকে একজোট করে পারতাই ইন্দোনেশিয়া নামে এক গণ সংগঠন গড়ে তোলেন। ডাচ সরকারের কুনজরে পরে তিনি পুনরায় বন্দি হন এবং তাঁকে বিদেশে নির্বাসনে পাঠানো হয়। এদিকে হাত্তা ও জাহরিরকেও নিউগিনিতে বন্দি শিবিরে পাঠানো হয়।

6 জাপানের ইন্দোনেশিয়া দখল: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে জার্মানি হল্যান্ড দখল করে নিলে (১৯৪০ খ্রি.) ইন্দোনেশিয়ায় হল্যান্ডের ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটে। এই সুযোগে জাপান ইন্দোনেশিয়া দখল করে নেয় (১৯৪২ খ্রি.)। জাপান ঔপনিবেশিক সরকার সুকর্ণকে নির্বাসন থেকে মুক্তি দেয়। জাপানি কর্তৃপক্ষ সুকর্ণ ও হাত্তাকে ব্যবহার করে ইন্দোনেশিয়াবাসীর সাহায্য লাভের চেষ্টা করে।

7 প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা: জাপানকে যুদ্ধে সাহায্য দানের আশ্বাস দিয়ে সুকর্ণ এক লক্ষ সেনাবিশিষ্ট এক সামরিক সংগঠন গড়ে তোলার সুযোগ পান। এ ছাড়াও তিনি জাতীয়তাবাদীদের নিয়ে গোপনে স্বাধীনতার প্রস্তুতি চালিয়ে যান। শেষপর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান হেরে গেলে সুকর্ণ স্বাধীনতার জন্য এক প্রস্তুতি কমিটি গঠন করেন (১৯৪৫ খ্রি., ১৪ আগস্ট)। এর তিনদিন পরে অর্থাৎ ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ১৭ আগস্ট সুকর্ণ-এর নেতৃত্বে ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা ঘোষিত হয় ও এক প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। সুকর্ণ-এর নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী নেতারা সরকারের পাঁচটি নীতি অর্থাৎ পঞ্চশীল ঘোষণা করেন। এগুলি ছিল-জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ, সম্মতি, সামাজিক ন্যায়বিচার ও ঈশ্বর বিশ্বাস। স্বাধীনতা ঘোষণার পর নতুন সরকার কয়েকটি সমস্যার মুখোমুখি হয়, যথা-

ইন্দোনেশীয় ভাষা ও জাতীয় সংগীত ‘ইন্দোনেশিয়া বয়া’ (বৃহত্তর ইন্দোনেশিয়া) গ্রহণ করে। এইভাবে এই দল ইন্দোনেশিয়াবাসীর অন্তরে জাতীয়তাবাদের বীজ বপন করে।

4 আন্দোলন দমন: ডাচ সরকার ইন্দোনেশিয়ার জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমনের লক্ষ্যে সুকর্ণ-সহ চারজন জাতীয় নেতাকে বন্দি করে, জাতীয় দল ভেঙে দিয়ে তাকে বেআইনি ঘোষণা করে। এই সময়ে এই দলের দুই নেতা মহম্মদ হাত্তা ও সুতান জাহরির বিদেশে শিক্ষা শেষ করে দেশে ফিরে আসেন ও জাতীয় আন্দোলন পরিচালনার ভার নেন।

5 পারতাই ইন্দোনেশিয়া গঠন: বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে সুকর্ণ পুনরায় জাতীয় আন্দোলনে মনোনিবেশ করেন। তিনি ইন্দোনেশিয়ার বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীগুলিকে একজোট করে পারতাই ইন্দোনেশিয়া নামে এক গণ সংগঠন গড়ে তোলেন। ডাচ সরকারের কুনজরে পরে তিনি পুনরায় বন্দি হন এবং তাঁকে বিদেশে নির্বাসনে পাঠানো হয়। এদিকে হাত্তা ও জাহরিরকেও নিউগিনিতে বন্দি শিবিরে পাঠানো হয়।

6 জাপানের ইন্দোনেশিয়া দখল: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে জার্মানি হল্যান্ড দখল করে নিলে (১৯৪০ খ্রি.) ইন্দোনেশিয়ায় হল্যান্ডের ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটে। এই সুযোগে জাপান ইন্দোনেশিয়া দখল করে নেয় (১৯৪২ খ্রি.)। জাপান ঔপনিবেশিক সরকার সুকর্ণকে নির্বাসন থেকে মুক্তি দেয়। জাপানি কর্তৃপক্ষ সুকর্ণ ও হাত্তাকে ব্যবহার করে ইন্দোনেশিয়াবাসীর সাহায্য লাভের চেষ্টা করে।

7 প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা: জাপানকে যুদ্ধে সাহায্য দানের আশ্বাস দিয়ে সুকর্ণ এক লক্ষ সেনাবিশিষ্ট এক সামরিক সংগঠন গড়ে তোলার সুযোগ পান। এ ছাড়াও তিনি জাতীয়তাবাদীদের নিয়ে গোপনে স্বাধীনতার প্রস্তুতি চালিয়ে যান। শেষপর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান হেরে গেলে সুকর্ণ স্বাধীনতার জন্য এক প্রস্তুতি কমিটি গঠন করেন (১৯৪৫ খ্রি., ১৪ আগস্ট)। এর তিনদিন পরে অর্থাৎ ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ১৭ আগস্ট সুকর্ণ-এর নেতৃত্বে ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা ঘোষিত হয় ও এক প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। সুকর্ণ-এর নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী নেতারা সরকারের পাঁচটি নীতি অর্থাৎ পঞ্চশীল ঘোষণা করেন। এগুলি ছিল-জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ, সম্মতি, সামাজিক ন্যায়বিচার ও ঈশ্বর বিশ্বাস। স্বাধীনতা ঘোষণার পর নতুন সরকার কয়েকটি সমস্যার মুখোমুখি হয়, যথা-

পঞ্চশীলের বিরোধিতা, PNI দলের বিভাজন ও PIR গঠন, কমিউনিস্টদের অভ্যুত্থান ও ক্যাবিনেট সদস্যদের অপহরণ পরিকল্পনা প্রভৃতি।

৪ ওলন্দাজদের ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে জাপান হেরে গেলে ওলন্দাজরা পুনরায় ইন্দোনেশিয়ায় নিজেদের ঔপনিবেশিক শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠায় তৎপর হয়। সুমাত্রা ও জাভা বাদে ইন্দোনেশিয়ার অবশিষ্ট অংশ ওলন্দাজদের অধীনে চলে যায়। এক্ষেত্রে ব্রিটিশ সৈন্যরা ডাচদের পূর্ণ মদত জোগায়। শুধু তাই নয় জাভায় ঢুকে ব্রিটিশ সেনারা দু-লক্ষ ওলন্দাজ বন্দিদের মুক্ত করে। এই প্রেক্ষাপটে রানি উইলহেল মিনা ইন্দোনেশিয়া সম্পর্কে এক ঘোষণা জারি করেন। এই সময়ে সমগ্র ইন্দোনেশিয়া দু-ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এর এক ভাগ ছিল সুকর্ণ-এর প্রজাতন্ত্রের অধীনে আর অপর ভাগে ছিল মিত্র শক্তির সাহায্য নিয়ে হল্যান্ডদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ। এই প্রেক্ষাপটে ব্রিটেনের মধ্যস্থতায় ইন্দোনেশিয়া ও হল্যান্ডের মধ্যে লিঙ্গজ্যোতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় (২৫ মার্চ, ১৯৪৭ খ্রি.)। এই চুক্তিতে ঠিক হয়- [i] জাভার বিভিন্ন অঞ্চল নিয়ে এক সংবিধান সভা ডাকা হবে। [ii] হল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়াকে নিয়ে একটি ইউনিয়ন গঠন করা হবে যে ইউনিয়নে থাকবে প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক ও অর্থ দপ্তর। স্বাভাবিকভাবেই ইন্দোনেশিয়ার জাতীয়তাবাদীরা এই চুক্তি মেনে নেয়নি।

9 মার্কিন উদ্যোগ ও ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা লাভ: লিঙ্গজ্যোতি চুক্তি স্বাক্ষরের তিন মাসের মধ্যে ডাচ সরকার ইন্দোনেশিয়ায় পুলিশি শাসন কায়েম করেন। ভারত-সহ এশিয়ার দেশগুলি ঐক্যবদ্ধভাবে ডাচদের বিরোধিতা করে ও ইন্দোনেশিয়ার প্রতি সমর্থন জানায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও হল্যান্ড কূটনৈতিক চাপ দিয়ে ইন্দোনেশিয়ায় ডাচ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানে উদ্যোগী হয়।

উপসংহার: UNO-এর মধ্যস্থতায় ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে একটি সন্ধি স্বাক্ষরিত হয় এবং ইন্দোনেশিয়া স্বাধীনতা পায়। গঠিত হয় যোলোটি অঙ্গরাজ্য বিশিষ্ট ইউনাইটেড স্টেটস অব ইন্দোনেশিয়া। স্বাধীন ইন্দোনেশিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি হন ড. সুকর্ণ এবং প্রধানমন্ত্রী হন মহম্মদ হাত্তা। ড. সুকর্ণ-এর নেতৃত্বে ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় আন্দোলন বিশ্বের অন্যান্য দেশের পরাধীন জাতিগুলিকে উদ্বুদ্ধ করে।

5. Fill in The Blanks

1. আগস্ট আন্দোলন বা ভারত ছাড়ো আন্দোলনের অগ্রগতি ঘটেছিল

(A) বাংলায় ✓

(B) তামিলনাডুতে

(C) অন্ধ্রপ্রদেশে

(D) কেরালায়

2. প্রতিষ্ঠাকালে ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘ বা ‘ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স লিগ’-এর সদস্য সংখ্যা ছিল

(A) ১০ হাজার

(B) ১৫ হাজার

(C) ২০ হাজার

(D) ২৫ হাজার ✓

3. লিনলিথগো প্রস্তাবটি                   প্রস্তাব নামে পরিচিত।

(A) জুলাই প্রস্তাব

(B) আগস্ট প্রস্তাব ✓

(C) ক্রিপস প্রস্তাব

(D) লাহোর প্রস্তাব

4. জাতীয় কংগ্রেসের হরিপুরা ও ত্রিপুরি অধিবেশনে পরপর দুবার

(A) সুভাষচন্দ্র বসু ✓

(B) পট্টভি সীতারামাইয়া

(C) জওহরলাল নেহর

(D) রাজেন্দ্র প্রসাদ

5. ‘India Wins Freedom’ নামক আত্মজীবনীটির রচয়িতা হলেন

(A) মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ✓

(B) মহাত্মা গান্ধি

(C) নেতাজি সুভাষচন্দ্র

(D) জওহরলাল নেহরু

6. ক্লেমেন্ট এটলি ছিলেন ব্রিটেনের                 | 

(A) সমাজতান্ত্রিক দলের নেতা 

(B) গণতান্ত্রিক দলের নেতা

(C) শ্রমিক দলের নেতা ✓

(D) কমিউনিস্ট দলের নেতা

7. ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’ ঘোষণা করেছিলেন                |

(A) নেতাজি

(B) বল্লভভাই প্যাটেল

(C) গান্ধিজি ✓

(D) লক্ষ্মীবাই

৪. ভারত ছাড়ো আন্দোলন চলার সময় নাগপুর ‘হিন্দুস্থান রেড আমি’ গঠন করেন              

(A) মদনলাল ধিংড়া

(B) মদনলাল বাগড়ি ✓

(C) মানবেন্দ্রনাথ রায়

(D) ভগৎ সিং

9. ‘সিয়ারাম’ ও ‘পরশুরাম’ নামে দুই বৈপ্লবিক দলের প্রভাবে               ভারত ছাড়ো আন্দোলন চরমে পৌঁছোয়।

(A) বাংলায়

(B) বিহারে ✓

(C) ওড়িশায়

(D) যুক্তপ্রদেশে

10. ক্রিপস মিশন ভারতে আসে            |

(A) ১৯৪২ খ্রি. ✓

(B) ১৯৪৩ খ্রি.

(C) ১৯৪৪ খ্রি.

(D) ১৯১৪ খ্রি.

11. ক্লিপস মিশনের প্রস্তাবগুলিকে ‘দুভাগ্যজনক প্রস্তাব’ আখ্যা দিয়েছিলেন                   |

(A) সুভাষচন্দ্র বসু

(B) জওহরলাল নেহর

(C) মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি ✓

(D) সরোজিনী নাইডু

12. ভারত ছাড়ো আন্দোলন চলাকালে ‘চারি মল্লা রাজ’ কায়েম হয় ওড়িশার                  |

(A) কটকে

(B) বালেশ্বরে

(C) তালচেরে ✓

(D) চাঁদিপুরে

13.              ছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের ঝাঁসি বাহিনীর নেত্রী।

(A) লক্ষ্মীবাই

(B) মাতঙ্গিনী হাজরা

(C) লক্ষ্মী স্বামীনাথন ✓

(D) শাহনওয়াজ খান

14. ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে নৌবিদ্রোহ ঘটেছিল বোম্বাইয়ের                 নামক জাহাজে।

(A) তলোয়ার ✓

(B) ভিক্টোরিয়া

(C) আটল্যান্টা

(D) ময়ূরাক্ষী

15. সুভাষচন্দ্র কাবুল থেকে বার্লিনের উদ্দেশ্যে রওনা দেন                ছদ্মনামে।

(A) পি. এন. ঠাকুর

(B) সিনর অরল্যান্ডো ম্যাৎসোটা ✓

(C) গুমনামি বাবা

(D) করিম গনি

16. ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হওয়া স্বাধীনতা বিলটিতে              সম্মতি জনান |

(A) সম্রাট পঞ্চম জর্জ

(B) সম্রাট ষষ্ঠ জর্জ ✓

(C) সম্রাট তৃতীয় হেনরি

(D) সম্রাট চতুর্থ হেনরি

17. পলাশির যুদ্ধের                    বছর পর ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করে।

(A) ১৮৮

(B) ১৯০ ✓

(C) ১৯২

(D) ১৯৮

18. ফজলুল হক ছিলেন বাংলার                |

(A) কৃষক প্রজা দলের নেতা ✓

(B) শ্রমিক প্রজা দলের নেতা

(C) সোশ্যালিস্ট দলের নেতা

(D) কমিউনিস্ট দলের নেতা

19. স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন                |

(A) সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ✓

(B) আবুল কালাম আজাদ

(C) মহম্মদ আলি জিন্না

(D) লাল বাহাদুর শাস্ত্রী

20. আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠিত হয়                 |

(A) ১৯৪০ খ্রি.

(B) ১৯৪১ খ্রি.

(C) ১৯৪২ খ্রি. ✓

(D) ১৯৪৩ খ্রি.

21. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর সময়ে ভারতের ভাইসরয় ছিলেন                |

(A) বড়োলাট লিনলিথগো ✓

(B) ওয়াভেল

(C) চেমসফোর্ড

(D) লর্ড মাউন্টব্যাটেন

22. সিমলা বৈঠকে আলোচিত হয়              |

(A) মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা

(B) বলকান পরিকল্পনা

(C) ওয়াভেল পরিকল্পনা ✓

(D) লিনলিথগো পরিকল্পনা

23. গান্ধিজির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সর্ববৃহৎ গণ আন্দোলনটি হল              |

(A) খিলাফৎ আন্দোলন

(B) অসহযোগ আন্দোলন

(C) আইন অমান্য আন্দোলন

(D) ভারত ছাড়ো আন্দোলন ✓

24. ভারত ছাড়ো আন্দোলনকালে অন্যতম শহিদ            |

(A) সূর্য সেন

(B) মাতঙ্গিনী হাজরা ✓

(C) প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার

(D) লোকনাথ বল

25. আজাদ হিন্দ সরকার স্থাপন করেন              

(A) রাসবিহারী বসু

(B) সুভাষচন্দ্র বসু ✓

(C) হিদেকি তোজো

(D) লালা লাজপত রায়

26. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন মার্কিন নৌঘাঁটি পার্ল হারবারে আক্রমণ চালায়              |

(A) রাশিয়া

(B) জার্মানি

(C) ফ্রান্স

(D) জাপান ✓

27. ‘উদীয়মান সূর্যের দেশ’ হিসেবে পরিচিত                   |

(A) ইটালি

(B) জার্মানি

(C) জাপান ✓

(D) চিন

28. ‘এশিয়াবাসীদের জন্য এশিয়া’ এই স্লোগান তুলেছিল               |

(A) ভারত

(B) জাপান

(C) চিন ✓

(D) ভিয়েতনাম

29. ‘বৃহত্তর পূর্ব এশিয়ার যৌথ অগ্রগতি বলয়’ পরিকল্পনার কথা সরকারিভাবে ঘোষণা করেন     

(A) ফুসিয়ারো

(B) মাৎসুওকা ✓

(C) শিরটোরি তোসিও

(D) কোনো ফুমিমারো

30. বিংশ শতকের গোড়ার দিকে            চিন দেশের জাতীয়তাবাদীরা ‘পূর্বে চলো’ আন্দোলনের (‘Go East’ movement) ডাক দেন। 

(A) চিন

(B) ভিয়েতনাম ✓

(C) জাপান

(D) ইন্দোনেশিয়া

31. জাপান  খ্রিস্টাব্দে মাঞ্জুরিয়া দখল করে।

(A) ১৯৩০

(B) ১৯৩১ ✓

(C) ১৯৩২

(D) ১৯৩৩

32. মিউনিখ চুক্তি সম্পাদিত হয়               খ্রিস্টাব্দে।

(A) ১৯৩৭

(B) ১৯৩৮ ✓

(C) ১৯৩৯

(D) ১৯৪০

33. ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের পার্ল হারবারের ঘটনার ফলে                 ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক তিক্ত হয়েছিল।

(A) সোভিয়েত রাশিয়া

(B) চিন

(C) ফ্রান্স

(D) জাপান ✓