WBCHSE Class 12 Political Science Chapter 1 Solution | Bengali Medium

Class 12 Chapter 1 Solution

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক

1. Long Question Answer

1. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করো। অথবা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বলতে কী বোঝ? আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে পার্থক্য কী?  [HS ’15; নমুনা প্রশ্ন; Patha Bhavan]

উত্তরঃআন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি

বিষয় হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে অনেক সময় আন্তর্জাতিক রাজনীতির সমার্থক বলে মনে করা হয়, এর ফলে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিখ্যাত লেখক হ্যান্স জে মর্গেনথাউ তাঁর Politics Among Nations গ্রন্থে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বদলে আন্তর্জাতিক রাজনীতি শব্দটি ব্যবহার করেছেন। অধ্যাপক পামার ও পারকিনস, হলসটি এবং শ্লেইচার প্রমুখ লেখকরা তা করেননি। তাঁরা মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি দুটি আলাদা বিষয়, তাই এদের মধ্যে পার্থক্যও বিদ্যমান। তা ছাড়া, এঁরা বিশ্বাস করেন আন্তর্জাতিক রাজনীতির চেয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিধি অনেক ব্যাপক, তাই আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে কখনোই আন্তর্জাতিক রাজনীতির অন্তর্ভুক্ত করে দেখা ঠিক নয়। বস্তুত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে প্রকৃতিগত পার্থক্য রয়েছে।

2. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে পার্থক্য

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে যেসব পার্থক্য রয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-

[1] আলোচনাক্ষেত্রের পরিধিগত পার্থক্য: পণ্ডিতদের মতে, আন্তর্জাতিক রাজনীতির তুলনায় আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনাগত পরিধি অনেক ব্যাপক। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শুধু যে রাষ্ট্রগুলির মধ্যেকার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে তাই নয়, অ-রাষ্ট্রীয় (Non-state) সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানগুলি নিয়েও আলোচনা করে। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শুধুমাত্র রাজনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে না, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবিক সম্পর্ক নিয়েও বিচারবিশ্লেষণ করে। অধ্যাপক পামার ও পারকিনসের মতে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক উভয় ধরনের বিষয় নিয়েই আলোচনা করে। বস্তুত আন্তর্জাতিক রাজনীতি হল রাজনৈতিক সম্পর্কের আলোচ্যসূচির একটি অংশ মাত্র। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পণ্ডিতরা মনে করেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিষয়বস্তুর পরিধি অত্যন্ত সীমিত।

[2] বিষয়বস্তুগত পার্থক্য: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তববাদী তত্ত্বের প্রবক্তা হ্যান্স জে মর্গেনথাউ আন্তর্জাতিক রাজনীতি বলতে প্রধানত ক্ষমতার লড়াইকে বুঝিয়েছেন। তাঁর মতে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি শুধুমাত্র ক্ষমতাকেন্দ্রিক বিষয়গুলির সঙ্গে জড়িত, ক্ষমতাকে ধরে রাখার জন্য বা নতুন করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য বিরোধ ও সংঘর্ষের ধারণা এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। অন্যদিকের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সহযোগিতামূলক ও প্রতিযোগিতামূলক সম্পর্ক, শত্রুতা ও মিত্রতামূলক সম্পর্ক, সংঘর্ষ ও সমন্বয় সব কিছু নিয়েই আলোচনা করে। কাজেই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়বস্তু অনেক ব্যাপক এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিষয়বস্তু সে তুলনায় যথেষ্ট সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে সীমিত।

[3] দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য: আন্তর্জাতিক রাজনীতির সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দৃষ্টিভঙ্গিজনিত পার্থক্য বিদ্যমান। কে জে হলসটি-র মতে, আন্তর্জাতিক রাজনীতির আলোচনাকে অনেক সময় পররাষ্ট্র সম্পর্কিত আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়। এখানে মূলত বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতার উপাদান, পারস্পরিক সম্পর্ক ও ক্রিয়াকলাপ প্রভৃতি ওপরে বেশি জোর দেওয়া হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়টি তা নয়, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সঙ্গে রাজনীতি, অর্থনীতি, আইন, যোগাযোগ ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক সংগঠন, বিশ্বযুদ্ধ প্রভৃতি বিষয়গুলি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত।

3. আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অর্থ বিশ্লেষণ করো। অথবা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বলতে কী বোঝায় তা আলোচনা করো।

উত্তরঃ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অর্থ

সমাজে মানুষের সঙ্গে মানুষের যেমন একটা পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে, আন্তর্জাতিক সমাজে রাষ্ট্রগুলির মধ্যেও তেমনই একটা পারস্পরিক সম্পর্ক দেখা যায়। আধুনিক পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনো রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না। নিজেদের অস্তিত্বের কারণে আন্তর্জাতিক সমাজে রাষ্ট্রগুলিকে পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে হয়। রাষ্ট্রগুলির এই পারস্পরিক সম্পর্ককে সাধারণভাবে ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্ক’ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে।

[1] বিভিন্ন লেখকের বক্তব্য: অধ্যাপক কে জে হলসটি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বলতে রাষ্ট্রসমষ্টি নিয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার পর্যালোচনাকে বুঝিয়েছেন। অনেকে অবশ্য আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে শুধুমাত্র রাষ্ট্রসমষ্টির পারস্পরিক সম্পর্ক বলে অভিহিত করতে চাননি। এই প্রসঙ্গে পামার ও পারকিনস, স্ট্যানলি হফম্যান প্রমুখ লেখকের কথা উল্লেখ করা যায়। পামার ও পারকিনস মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি বৃহত্তর ধারণা। এর মধ্যে শুধুমাত্র রাষ্ট্রগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক একমাত্র আলোচ্য বিষয় হতে পারে না। পামার ও পারকিনস-এর মতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্বের সব মানুষ ও গোষ্ঠীর যাবতীয় সম্পর্ককে বোঝায় (International Relations is a term properly embracing the totality of the relations among people and groups in the world society)¹। স্ট্যানলি হফম্যান আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে শুধুমাত্র রাষ্ট্রসমূহের সম্পর্ক বলে মেনে নিতে চাননি। তাঁর মতে, আন্তর্জাতিক সমাজে রাষ্ট্রই যে একমাত্র প্রভাববিস্তারকারী হিসেবে কাজ করে তা নয়, রাষ্ট্রের পাশাপাশি ব্যক্তি, মতাদর্শ, স্বার্থগোষ্ঠী প্রভৃতির ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

[2] আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে অনেকে সমার্থক বলে মনে করেন। হ্যান্স জে মর্গেনথাউ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিবর্তে আন্তর্জাতিক রাজনীতি কথাটি ব্যবহার করেছেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতি জড়িত থাকলেও এদের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি | বলতে আন্তর্জাতিক সমাজের রাজনীতিকে বোঝায়। তুলনামূলকভাবে

আন্তর্জাতিক রাজনীতি আলোচনার ক্ষেত্র সুনির্দিষ্ট ও সংকীর্ণ। এখানে রাষ্ট্রগুলির সম্পকের একমাত্র আলোচ্য বস্তু হল রাজনীতি। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এদিক থেকে দেখতে গেলে বহু বিস্তৃত একটি ধারণা। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক রাষ্ট্রগুলির মধ্যে রাজনীতি ছাড়াও অন্যান্য সম্পর্ক নিয়েও আলোচনা করে। এর মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক, সামাজিক সম্পর্ক, সাংস্কৃতিক ও মানবিক সম্পর্ক প্রভৃতি। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শুধুমাত্র রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক, বিভিন্ন রাষ্ট্রের পারস্পরিক সমস্যা ইত্যাদি আলোচনায় সীমিত থাকে না। রাষ্ট্র ছাড়াও অ-রাষ্ট্রীয় সংগঠন ও বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানের বিষয়েও আলোচনা করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক। যেমন, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনায় বহু আগেই সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনের আলোচনাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরে আঞ্চলিক সংগঠনগুলিও এর আলোচ্যসূচির আওতায় আসে যেমন-জোটনিরপেক্ষ গোষ্ঠী, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, আরব লিগ, আফ্রিকান ঐক্য সংস্থা, আসিয়ান, সার্ক প্রভৃতি। বর্তমানে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা, আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার, বিশ্বব্যাংকও এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্ব মানবাধিকার গোষ্ঠীর কার্যকলাপ, এমনকি সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর কার্যকলাপও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচ্যসূচিতে স্থান পেয়েছে। কাজেই, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি বিস্তৃত ধারণা। যে বিষয়গুলি আন্তর্জাতিক সমাজকে প্রভাবিত করে, সেগুলি এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। এক্ষেত্রে বলা যায় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি দ্রুত পরিবর্তনশীল বিষয়।

[3] গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা: সবশেষে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা যায়, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক হল এমন একটি বিষয় যা পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্ক, অ-রাষ্ট্রীয় সংস্থা, আন্তর্জাতিক সংগঠন, যুদ্ধ ও শান্তি, নিরস্ত্রীকরণ, জোটগঠন, আণবিক সন্ত্রাস-সহ সমগ্র আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার যাবতীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করে।

4. একটি স্বতন্ত্র পাঠ্যবিষয় হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশ কীভাবে হয়েছে তা আলোচনা করো।

অথবা, একটি পাঠ্যবিষয়রূপে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশের বিষয়টি আলোচনা করো।

উত্তরঃ একটি স্বতন্ত্র পাঠ্যবিষয় হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশ

আধুনিককালে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সূচনা হয়েছে মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর। অবশ্য বহু আগে অনেক বিখ্যাত লেখক তাঁদের রচনায় আন্তর্জাতিক ‘সম্পর্ক নিয়ে কিছু মৌলিক চিন্তাভাবনার কথা তুলে ধরেছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন চিনের মেনসিয়াস, ভারতের কৌটিল্য, ইতালির মেকিয়াভেলি প্রমুখ।

[1] জাতি-রাষ্ট্রের উদ্ভব ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক: পণ্ডিতদের মতে, আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার উৎপত্তির ফলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সূচনা হয়। এই কারণে ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দকে এক বিশেষ সন্ধিক্ষণ বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে। তার আগে রাষ্ট্রব্যবস্থা যে ছিল না তা নয়, তবে প্রাচীন গ্রিস, চিন, ভারত ও মিশরে যে রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল তাকে কোনোভাবেই আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা বলা যায় না। যাকে আমরা ভূখণ্ডকেন্দ্রিক সার্বভৌম জাতি-রাষ্ট্র (Territorial Sovereign Nation State) বলছি, তার উৎপত্তি ঘটে ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে। ইউরোপের নবজাগরণ ও ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ফসল হল আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। এই আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রগুলি নিজেদের সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে একে অপরের সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে যে পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তোলে তা থেকেই প্রথম আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক বা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সূচনা ঘটে। তাই জাতি-রাষ্ট্রের উদ্ভবের সময়কে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আদিকাল বলে অভিহিত করা হয়।

[2] শিল্পবিপ্লব ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক: অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে যে শিল্পবিপ্লব ঘটে তা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলে অনেকে মনে করেন। শিল্পবিপ্লবের ফলে এক রাষ্ট্রের সঙ্গে অন্য রাষ্ট্রের যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি ঘটে এবং এর ফলে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তোলার বিষয়টি আরও সহজ হয়। রাষ্ট্রগুলি নিজেদের চনা মধ্যে দূরত্বের বাধা অতিক্রম করে আরও কাছাকাছি চলে আসে। এর ফলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।

 [3] প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৯) ও যুদ্ধ-পরবর্তী ঘটনাবলির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পর্যালোচনার র্কর বিষয়টি নতুন মাত্রা লাভ করে। এই সময় থেকেই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাত্ত্বিক আলোচনার সূত্রপাত ঘটে। শুরু হয় নতুন চিন্তাভাবনার।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন যে চোদ্দো দফা প্রস্তাব রেখেছিলেন তা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে। উইলসনের চোদ্দো দফা প্রস্তাবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল-সমস্তরকম গোপন কূটনীতির অবসান, এই উপনিবেশগুলির স্বাধীনতা, সমস্ত রাষ্ট্রগুলিকে নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন এক গড়ে তোলা ইত্যাদি। উইলসনের এই চোদ্দো দফা প্রস্তাবকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে মনে করা হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে জাতিসংঘ (League of Nations)-এর প্রতিষ্ঠা,বৃহৎ শক্তিরূপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ, বুশ বিপ্লবের ফলস্বরূপ সোভিয়েত ইউনিয়নের উদ্ভব ইত্যাদি ঘটনার ফলে আলোচ্য বিষয় হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার (১৯২০ খ্রি.) পর থেকে শুরু হয়ে যায় প্রকাশ্য কূটনীতি (Open Diplomacy)-র যুগ। আন্তর্জাতিক সম্পর্কচর্চায় তার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। প্রসঙ্গত বলা যায়, বিষয় হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কচর্চা এই সময় থেকেই শুরু হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালের এই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি স্বতন্ত্র পাঠ্যবিষয়রূপে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে পড়াশোনা আরম্ভ হয়। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ব্রাইস আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপরে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমন্ত্রিত হন। পরের বছর তাঁর বক্তৃতামালা International Relations নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া প্রকাশিত হয় ই এ ওয়ালশ- এর সম্পাদনায় The History and Nature of International Relations (১৯২২ খ্রি.) এবং আর এল বিউয়েল-এর লেখা International Relations (১৯২৫ খ্রি.) প্রভৃতি।

4] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-৪৫ খ্রি.) পর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি স্বতন্ত্র পাঠ্যবিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই সময় আন্তর্জাতিক রাজনীতির আমূল পটপরিবর্তন ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২৪ অক্টোবর ৫১টি রাষ্ট্রকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় এই সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ (UNO)। এই সময় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ইউরোপের এর। প্রাধান্য খর্ব হয়। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পুঁজিবাদী জোটের রাষ্ট্রগুলি এবং অন্যদিকে সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক জোটের রাষ্ট্রসমূহ-এই পরস্পরবিরোধী দুই জোটের মধ্যে আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিভক্ত হয়ে পড়ে। একে আন্তর্জাতিক রাজনীতির দ্বিমেরুকরণ বলা হয়। এক মেরুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অন্য মেরুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন। দুই মহাশক্তিধর এই রাষ্ট্রের মধ্যে ক্ষমতা প্রদর্শন ও মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার যে রেষারেষি চলে তার ফলে এক ধরনের লড়াই দেখা দেয়। এই লড়াইকে বলা হয় ঠান্ডা লড়াই। ঠান্ডা লড়াই হল এমন এক অবস্থা, যাকে এককথায় বলা যেতে পারে না যুদ্ধ না শান্তি। এক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আরও এক ধরনের জোট দেখা দেয়, এদের নিজোট বা জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলা হয়। যেহেতু এই রাষ্ট্রগুলি মার্কিন বা সোভিয়েত-কোনো জোটের মধ্যে যেতে চায়নি, তাই এদের যে নিজোট বা জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলা হয়। ভারত, যুগোশ্লাভিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভরে মিশর-সহ কয়েকটি দেশ এই নির্জেটি বা জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন গড়ে তোলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই পটপরিবর্তন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। এই সময় থেকেই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এক স্বতন্ত্র বিষয়সূচি গড়ে ওঠে।

[5] নয়া বিশ্বব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৪৬ বছর পরে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এক নতুন দিকে মোড় নেয়। এই সময় ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এক নতুন বিশ্বব্যবস্থা (New World Order) গড়ে ওঠে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিবর্তনে তার প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘকাল যাবৎ চলে আসা ঠান্ডা লড়াইয়ের পরিসমাপ্তি ঘটে এই সময়। সারা বিশ্বে একক মহাশক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্ষমতার মেরুকরণ একমুখী হওয়ায় এই সময় থেকে একমেরু বিশ্ব (Unipolar World)-এর আত্মপ্রকাশ ঘটে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনা আগে যেমন রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলোচনার মধ্যে সীমিত ছিল, এই সময় থেকে তারও পরিবর্তন ঘটে। রাষ্ট্রগুলির মধ্যে যে পারস্পরিক সম্পর্ককে এতকাল আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একমাত্র মূল আলোচ্য বিষয় হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছিল সেই দৃষ্টিভঙ্গিরও বদল ঘটে। যারা রাষ্ট্র নয় অথচ রাষ্ট্রের মতোই আন্তর্জাতিক সমাজকে প্রভাবিত করতে সক্ষম, সেইসব অ- রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের (Non-state Actors)-ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যেমন-সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ, আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা, বিশ্বব্যাংক, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন প্রভৃতি।

[6] বিশ্বায়ন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক: বিশ্বায়নের যুগে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিবর্তনে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শুরু হয়েছিল জাতি-রাষ্ট্রের আলোচনাকে কেন্দ্র করে। সেখানে এখন বহু বিষয় এর আলোচ্যসূচির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আসলে যে জাতি-রাষ্ট্রের প্রভাব এককালে বিশাল ছিল, তা এখন স্তিমিত হয়ে এসেছে। অনেকে মনে করেন বিশ্বায়নের যুগে রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতার বিষয়টি সংকটাপন্ন। বর্তমানে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা (WTO)-র নীতিনির্দেশ মেনে রাষ্ট্রগুলিকে আর্থিক নিয়মকানুন ঠিক করতে হয়। তাই রাষ্ট্র আর কোনোভাবেই আলোচনার মূল কেন্দ্রে থাকতে পারে না। এই পরিস্থিতিতে বিশ্বায়নের যুগে অধ্যাপক জন বেইলি এবং স্টিভ স্মিথ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনায় যেসব নতুন বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছেন তার মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থতত্ত্ব, পরিবেশগত সমস্যাসমূহ, পারমাণবিক অস্ত্রের প্রসারণ, সন্ত্রাসবাদ, আঞ্চলিকতাবাদ, বিশ্ববাণিজ্য ও অর্থ, দারিদ্র্য, উন্নয়ন ও ক্ষুধা মানবাধিকার, নারী-পুরুষের বৈষম্য প্রভৃতি।

5.আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রকৃতি ও পরিধি বিশ্লেষণ করো। অথবা, একটি স্বতন্ত্র পাঠ্যবিষয় হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রকৃতি আলোচনা করো।

অথবা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বলতে কী বোঝ? এর বিষয়বস্তু আলোচনা করো। [Hare School]

উত্তরঃ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক

প্রাচীনকাল থেকেই আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক বিষয়ে আলোচনার সন্ধান পাওয় যায়। চিনের দার্শনিক মেনসিয়াস, মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের প্রধানমন্ত্রী কৌটিল এবং ইতালির দার্শনিক মেকিয়াভেলির রচনার কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় পরবর্তী সময়ে ১৬৪৮ সালে জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব, অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশে এক তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিংশ শতাব্দীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বেকি কূটনীতির দ্বারা পরিচালিত হত। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পর্যালোচনা গুরুত্ব লাভ করে। অবশ্য এ সময় প্রান্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলোচনাকে প্রাধান্য দেওয়া হত। বস্তুত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি স্বতন্ত্র পাঠ্যবিষয় হিসেবে তিষ্ঠা পায়।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কোনো সুস্পষ্ট সংজ্ঞা না থাকলেও সাধারণভাবে লা যায় যে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক হল এমন একটি বিষয় যা পৃথিবীর বিভিন্ন তাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্ক, অ-রাষ্ট্রীয় সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক সংগঠন, যুদ্ধ ও শান্তি, নিরস্ত্রীকরণ, জোটগঠন, আণবিক সন্ত্রাস-সহ সমগ্র প্রান্তর্জাতিক ব্যবস্থার যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করে।

নান্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রকৃতি

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ই এইচ কার-এর মতে, দীর্ঘকাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূল বিষয় ছিল যুদ্ধ প্রতিরোধের উপায় অনুসন্ধান। লার্কে ও সৈয়দ এই অভিমত পাষণ করেন যে, দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী যুগে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বলতে টিনৈতিক ইতিহাস বোঝাত। এসময় আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রকৃতি নির্ণয়ে টিনীতিকরা মুখ্য ভূমিকা পালন করতেন। অনেকে মনে করতেন, আন্তর্জাতিক নাইন ও সংগঠনের সাহায্যে যাবতীয় আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধান সম্ভব। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে লিগ অব নেশন্স প্রতিষ্ঠার ফলে এই ধারণা মূর্ত হয়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক রাজনীতির আমূল টিপরিবর্তনের ফলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির আত্মপ্রকাশ ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ (UNO) প্রতিষ্ঠার অল্প সময়ের মধ্যেই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দ্বিমেরুকরণ (Bi-polarisation) এটে। এর ফলশ্রুতিস্বরূপ উদ্ভব হয় ঠান্ডা লড়াই (cold war)-এর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী এই সময়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের তত্ত্বগত আলোচনার পুত্রপাত ঘটে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক বাস্তবতার বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রধান আলোচ্য হয়ে ওঠে। বস্তুত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি সতত পরিবর্তনশীল ও গতিশীল বিষয়। বিগত বিশ শতকের তিনের দশক থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি স্বতন্ত্র পাঠ্যবিষয় হিসেবে আন্তর্জাতিক সমাজের পরিবর্তনশীল ধারাকে অনুসরণ করে চলেছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গতিশীল প্রকৃতির দিকে লক্ষ রেখে অনেকে এই অভিমত পাষণ করেন যে, একটি পরিবর্তনশীল পাঠ্যবিষয়রূপে আন্তর্জাতিক সম্পর্কী এখনও এক পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে।

১৯৩৫ সালে স্যার আলফ্রেড জিমার্ন আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে বাষ্ট্রবিজ্ঞানের অংশ হিসেবে গণ্য করার পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। কিন্তু ব বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি স্বতন্ত্র বিষয়সূচি রয়েছে। বহুকাল ধরে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অংশ হিসেবে থাকলেও বর্তমানে তা একটি স্বতন্ত্র বিষয়রূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। পামার এবং পারকিনসের মতে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এমন কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আছে যা তাকে অন্যান্য বিষয় থেকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে অনেকের মতে, কতকগুলি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হলে তবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে স্বতন্ত্র শাস্ত্রের মর্যাদা দেওয়া যায়। যেমন, একটি নির্দি আলোচ্যসূচি (Subject matter) ছাড়াও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একা সুস্পষ্ট ধারণা-কাঠামো (Conceptual Framework) থাকা প্রয়োজন। ছাড়া একটি স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এক সুবিন্যস্ত তাত্ত্বি ভিত্তি থাকাও আবশ্যক বলে মনে করা হয়।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিধি

রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, ধারাবাহিক চর্চা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে বর্তমান আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি নির্দিষ্ট আলোচ্যসূচি তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। তবে এমন একটি গতিশীল বিষয়ের ক্ষেত্রে আলোচ্যসূচির নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। কারণ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচ্যসূচি দ্রুত পরিবর্তনশীল। এ ছাড়া একটি স্বতন্ত্র পাঠ্যবিষয়রূপে গড়ে ওঠার জন্য যে সুস্পষ্ট ধারণা-কাঠামো ও সুবিন্যস্ত তাত্ত্বিক ভিত্তি থাকা দরকার তা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আছে বলে দাবি করা হয়। আবদুল এ সৈয়দ-এর মতে, তত্ত্ব ছাড়া আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অনুধাবন সম্ভব নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে কুইনসি রাইট, মর্টন ক্যাপলান, চার্লস মেকল্যান্ড, কেনেথ টম্পসন প্রমুখ লেখক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার (International System) তত্ত্বগত আলোচনার সূত্রপাত করেন। তবে ক্রমবর্ধমান জটিলতা এবং পরিবর্তনশীল বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে কোনো তত্ত্বের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।

[1] সাধারণ অনুমান ও বিধি: একটি স্বতন্ত্র বিষয়ের ক্ষেত্রে যেভাবে তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে সাধারণ অনুমান ও বিধি গড়ে তোলা হয় সেই পদ্ধতিকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কঠোরভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। কুইনসি রাইট তাঁর The Study of War গ্রন্থে ১৪৮০ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে সংঘটিত ২৭৮টি যুদ্ধ পর্যালোচনার পরে কিছু সাধারণ বিধি ও অনুমান গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির পটপরিবর্তনের ফলে তা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। মর্গেনথাউ-এর মতে আন্তর্জাতিক রাজনীতি দ্রুত পরিবর্তনশীল। এই কারণে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সাধারণ বিধি ও অনুমানের কার্যকারিতা সম্পর্কে সংশয়ের অবকাশ থেকে যায়। মর্গেনথাউ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষণে বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারী। তিনি আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে অন্যান্য রাজনীতির মতোই ক্ষমতার লড়াই বলে মনে

করেন। তাঁর মতে, “International Politics, like all politics, is strug- gle for power.”। স্ট্যানলি এইচ হফম্যান-এর বক্তব্য হল, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সেইসব উপাদান ও কাজকর্মের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত যা বিশ্বের মূল একক হিসেবে বিভিন্ন রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি ও ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে (“The dis- cipline of International relations is concerned with the factors and activities which affect the external policies and power of the basic Units into which the World is divided”)।

[2] নয়া বিশ্বব্যবস্থা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক সমাজ এবং রাজনীতি ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হওয়ার ফলে পুরোনো জাতীয় রাষ্ট্র নতুন রাজনৈতিক রূপ নিয়েছে। অসংখ্য অ-রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা বা কারক (Non-State Actors) আন্তর্জাতিক সমাজকে প্রভাবিত করে চলেছে। ফলে জাতীয় অর্থনীতির পুনর্বিন্যাস ঘটেছে। জাতীয় রাষ্ট্রের অপ্রতিরোধ্য সার্বভৌম ক্ষমতা বজায় রাখা যাচ্ছে না। স্বেচ্ছায় বা চাপের ফলে রাষ্ট্রগুলি আঞ্চলিক গোষ্ঠী গড়ে তুলতে বাধ্য হয়েছে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ফলে ঠান্ডা যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটায় একমুখী বিশ্ব (Unipolar World) গড়ে উঠেছে। নয়া বিশ্বব্যবস্থায় বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা (WTO), বিশ্বব্যাংক (World Bank), আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার (IMF) প্রভৃতির পৃষ্ঠপোষকতায় বিশ্বায়নের প্রভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলির অর্থনীতির দ্রুত পটপরিবর্তন ঘটে চলেছে। পারমাণবিক যুদ্ধের ভীতি, আণবিক সন্ত্রাস, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, মহাশক্তিধর (Super Power) রাষ্ট্র হিসেবে মার্কিনি আধিপত্য, সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের নিষ্ক্রিয়তা ইত্যাদির ফলে জাতীয় রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতার সাবেকি সংজ্ঞার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রকৃতি ও পরিধি এক নতুন সন্ধিক্ষণ পর্বের (Transition Period) সম্মুখীন হয়েছে।

[3] আন্তঃবিজ্ঞানমূলক বিষয়: বর্তমানে কোনো রাষ্ট্র তার পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণ করতে গিয়ে শুধুমাত্র নিজের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, ভৌগোলিক অবস্থান তথা সামরিক সামর্থ্যের বিশ্লেষণ করে ক্ষান্ত হয় না। এর পাশাপাশি অন্যান্য রাষ্ট্রের জনমত, মানবসম্পদ, সামরিক সামর্থ্য, প্রাকৃতিক সম্পদ, ভৌগোলিক অবস্থান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার উদ্ভাবন ইত্যাদি বিষয়গুলিও পর্যালোচনা করে দেখে। এই কারণে ওলসন বলেছেন যে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে একটি আন্তঃবিজ্ঞানমূলক (Interdisciplinary) বিষয়রূপে গণ্য করা উচিত। সিসিল ভি ক্র্যাব-এর মতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞরা অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব, গণিতশাস্ত্র, পরিসংখ্যান, নৃতত্ত্ব এবং যোগাযোগ বিজ্ঞানের কাছ থেকে সাহায্য গ্রহণ করে বিষয়টিকে সমৃদ্ধ করেছেন। বর্তমানে আন্তর্জাতিক

সম্পর্কের গবেষণা অন্যান্য বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গবেষণায় অন্যান্য সমাজবিজ্ঞানের অবদান থাকলেও রাজনৈতিক উপাদানের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

6. আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিভিন্ন তত্ত্বগুলির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও। অথবা, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিভিন্ন তাত্ত্বিক ধারা আলোচনা করো।

উত্তরঃ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিভিন্ন তত্ত্ব

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি গতিশীল বিষয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রকৃতি ও পরিধি নিয়ত পরিবর্তনশীল। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনাকে কোনো একটি গণ্ডির মধ্যে সীমিত করে রাখা সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা যেভাবে দ্রুত বদলে যাচ্ছে তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচ্য বিষয়সূচিরও পরিবর্তন ঘটছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই গতিশীল বিষয়কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে, এর খুঁটিনাটি দিকগুলি বিচারবিশ্লেষণ করতে গিয়ে কিছু তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পণ্ডিতরা বিভিন্ন তত্ত্বের মাধ্যমে এই বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করে দেখতে চেয়েছেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষণে যেসব তত্ত্বের পরিচয় পাওয়া যায় তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বগুলি হল- [1] বাস্তববাদ, [2] উদারনীতিবাদ, [3] বহুত্ববাদ, [4] বিশ্ব-ব্যবস্থাজ্ঞাপক মতবাদ।

[1] বাস্তববাদ: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিভিন্ন তত্ত্বের মধ্যে বাস্তববাদী তত্ত্ব সবচেয়ে প্রভাবশালী তত্ত্বরূপে স্বীকৃত। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষমতাকেন্দ্রিক বিশ্লেষণে এই তত্ত্বের সন্ধান কৌটিল্য, মেকিয়াভেলি ও হক্সের রচনায় পাওয়া যায়। আধুনিককালে ই এইচ কার, হাবার্ট বাটারফিল্ড, সোয়ার্জেন বার্গার, জর্জ এফ কেন্নান, মার্টন রাইট, ফ্রেডারিক স্যুমান, কেনেথ টম্পসন, বারটান্ড রাসেল, হ্যান্স জে মর্গেনথাউ প্রমুখের রচনার হাত ধরে এই তত্ত্বের বিকাশ ঘটে। মর্গেনথাউ তাঁর Politics Among Nations এবং The Decline of Democratic Politics গ্রন্থে এই তত্ত্বের বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে আন্তর্জাতিক আইনকে লঙ্ঘন করে যাবতীয় শান্তিকামী উদ্যোগকে বিফল করে জাতীয় রাষ্ট্রগুলি কেন আবার একটি মহাযুদ্ধে লিপ্ত হল তার বাস্তবসম্মত ব্যাখ্যা দিতে গিয়েই বাস্তববাদী তত্ত্বের জন্ম হয়। ক্ষমতা অর্জন ও ক্ষমতা অনুশীলনের সাহায্যে পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করাই হল এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। বাস্তববাদ মনে করে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ক্ষমতার লড়াইকে কেন্দ্র করেই চালিত হয়। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, পারস্পরিক বিদ্বেষ, দ্বিচারিতা প্রভৃতি বিষয় মানবপ্রকৃতির মধ্যে দেখা যায়। বাস্তববাদী তত্ত্ব অনুসারে মানব প্রকৃতির মধ্যে নিহিত এই বিধিগুলি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আচরণকেও প্রভাবিত করে। যেমন- বিদেশনীতির বিশ্লেষণে দেখা যায়, রাষ্ট্রনায়করা মুখে নৈতিকতার কথা বললেও বাস্তবে ভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।

বাস্তববাদের প্রধান প্রবক্তা মর্গেনথাউ এই তত্ত্বের ছয়টি মৌলিক নীতির কথা ঘোষণা করেন। এই নীতিগুলি হল-① রাজনীতি বৈষয়িক বিধির দ্বারা চালিত হয়। রাজনীতির সঙ্গে বিষয়-আশয়ের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ② জাতীয় স্বার্থের ধারণা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় স্বার্থের ধারণা ছাড়া আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে অনুসন্ধান করা সম্ভব নয়। ③ জাতীয় স্বার্থের ধারণা কোনো অনড় ধারণা নয়। জাতীয় স্বার্থ কখনো স্থায়ীভাবে চিরকালের

জন্য নির্দিষ্ট থাকে না। পরিস্থিতি অনুযায়ী এর পরিবর্তন ঘটে। ④ রাষ্ট্রের কাজকর্মের মধ্যে কোনো সর্বজনীন নৈতিক ধারণাকে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। বাস্তববাদ মনে করে, রাষ্ট্রীয় নীতিকে বাস্তবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে, প্রয়োজনে বাস্তবের সঙ্গে আপসও করা যেতে পারে। ⑤ কোনো জাতির নৈতিক আশা-আকাঙ্খাকে সর্বজনীন বলে গণ্য করা যায় না। ক্ষমতাকেন্দ্রিক

স্বার্থের ধারণাই প্রধান বিচার্য বিষয়। ⑥ রাজনৈতিক বাস্তবতাকে ক্ষমতাকেন্দ্রিক স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচারবিবেচনা করে দেখতে হবে।

 [2] উদারনীতিবাদ: আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষণে উদারনীতিবাদের ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে এই তত্ত্বের উদ্ভব ঘটে। উদারনৈতিক আন্তর্জাতিকতাবাদের মধ্যেই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উদারনীতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির উৎস নিহিত রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উদারনীতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রধান প্রবক্তা প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯১৯ সালে বিশ্বশান্তির উদ্দেশ্যে পেশ করা উইলসনের ১৪ দফা কর্মসূচির মাধ্যমে উদারনীতিবাদের তাত্ত্বিক সূচনা ঘটে।

আন্তর্জাতিক উদারনীতিবাদের মূল নীতিগুলি হল-① আন্তর্জাতিক সমাজের বহুজাতিভিত্তিক বাস্তবতাকে স্বীকৃতিদান। ② যুদ্ধ বা যুদ্ধ সংক্রান্ত প্রস্তুতি বর্জন। ③বিভিন্ন জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে স্বীকৃতিদান। ④ আন্তর্জাতিক বিবাদের শান্তিপূর্ণ সমাধান ইত্যাদি।

প্রসঙ্গত বলা যায়, উদারনীতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে উদারনৈতিক আন্তর্জাতিকতাবাদের আদর্শ তুলে ধরে, তা ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে চরম সংকটের সম্মুখীন হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিশেষত ন্যাৎসিবাদ ও ফ্যাসিবাদ এই আদর্শকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়। পরবর্তীকালে ১৯৭০-এর দশকে নয়া উদারনীতিবাদের সূচনা ঘটে। তারপর

7. ক্ষমতা বা শক্তির (Power) সংজ্ঞা দাও। ক্ষমতার প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো। ই এইচ কার শক্তিকে ক-টি ভাগে ভাগ করেছেন? আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ক্ষমতার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করো। 

উত্তরঃ ক্ষমতা বা শক্তির সংজ্ঞা

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তি বা ক্ষমতার (Power) ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক রাজনীতির মুখ্য উপাদান হল শক্তি। সাধারণভাবে শক্তি ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে নয়া উদারনীতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ করা হয়।

[3] বহুত্ববাদ: আন্তর্জাতিক উদারনীতিবাদের একটি নতুন ধারা হল বহুত্ববাদ। ১৯৭০-এর দশকে বহুত্ববাদ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি মৌলিক তত্ত্বরূপে আত্মপ্রকাশ করে। বহুত্ববাদ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের একক প্রাধান্যের জায়গায় বিভিন্ন ধরনের অ-রাষ্ট্রীয় (Non-state) আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ওপরে গুরুত্ব দেয়। বহুত্ববাদ মনে করে, আধুনিক সমাজে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সব ধরনের কাজকর্ম রাষ্ট্র একা করে উঠতে পারে না, রাষ্ট্রের পক্ষে এককভাবে সব ধরনের প্রয়োজনীয় পরিসেবা দেওয়া সম্ভব নয়। বহুত্ববাদী লেখকদের মতে, আধুনিক আন্তর্জাতিক সমাজে এমন অনেক সমস্যা রয়েছে যার সমাধান রাজনীতিবিদের পক্ষে করে ওঠা দুষ্কর, এর জন্য প্রয়োজন বিশেষজ্ঞদের। বহুত্ববাদের অন্যতম প্রবক্তা ডেভিড মিত্রানি এবং আর্নস্ট হাস আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে সার্বভৌম রাষ্ট্রের পরিপূরক সত্তা হিসেবে দেখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এই তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা রবার্ট কেওহেন এবং জোশেফ নাই তাঁদের রচনায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সাময়িক রাজনৈতিক দিকের বদলে অর্থনৈতিক সম্পর্কের দিকটির ওপরেই বেশি গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন। বহুত্ববাদ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বৃহৎ শক্তি বা অতিবৃহৎ শক্তির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার দিকটিকেই তুলে ধরতে চায়। বস্তুত আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উপাদান হিসেবে রাষ্ট্রের পাশাপাশি অ-রাষ্ট্রীয় সংস্থার ভূমিকা গুরুত্ব সহকারে বিশ্লেষণ করাই বহুত্ববাদের মূল উদ্দেশ্য।

[4] বিশ্ব-ব্যবস্থাজ্ঞাপক তত্ত্ব: বিশ্ব-ব্যবস্থাজ্ঞাপক তত্ত্বের প্রধান প্রবক্তা হলেন ইমানুয়েল ওয়ালারস্টাইন। এ ছাড়া এই তত্ত্বের সঙ্গে আরও যাঁদের নাম যুক্ত রয়েছে তাঁরা হলেন আন্দ্রে ফ্রাঙ্ক, রউল প্রেবিশ প্রমুখ। মূলত মার্কসবাদের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত এই তত্ত্ব পৃথিবীব্যাপী উন্নয়ন ও অনুন্নয়নের মূল কারণ অনুসন্ধান করতে চায়। এর পাশাপাশি বর্তমান বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদের স্বরূপ উদ্‌ঘাটনেও তাঁদের সমান আগ্রহ।

বিশ্ব-ব্যবস্থাজ্ঞাপক তত্ত্ব মনে করে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে ক্ষমতার স্তরবিন্যাস মূলত অর্থনৈতিক কাঠামোর দ্বারাই নির্ধারিত হয়ে থাকে। বিশ্বব্যবস্থা হল-বিশ্ব-অর্থনীতির এক প্রতিভূ মাত্র। আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় অঞ্চল এবং প্রান্তিক অঞ্চলের পাশাপাশি সহাবস্থানের দিকটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কেন্দ্রীয় অঞ্চলগুলি উন্নত অর্থনৈতিক কাজকর্মের ভরকেন্দ্র। এখানকার শিল্প, পরিসেবা, কৃষি সব কিছুই খুব উন্নত। অন্যদিকে প্রান্তিক অঞ্চলগুলি স্বভাবতই অনুন্নত। এদের ভূমিকা কাঁচামাল এবং সস্তা শ্রম বা শ্রমিক সরবরাহ করা। ওয়ালারস্টাইনের মতে, কেন্দ্রীয় ও প্রান্তিক অঞ্চলের সম্পর্ক প্রধানত শোষণমূলক। তবে বিশ্ব-ব্যবস্থাজ্ঞাপক তত্ত্বের প্রবক্তারা বিশ্বাস করেন, বিশ্বের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা একদিন এমন এক সংকটে এসে দাঁড়াবে যেখানে ক্ষমতাবান রাষ্ট্রগুলির বিকল্প হিসেবে উঠে আসবে উন্নয়নশীল দুনিয়া। কাজেই | বিশ্বব্যবস্থার পুঁজিবাদী কাঠামো চিরস্থায়ী নয়, তার পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী।

বা ক্ষমতা বলতে কোনো কিছু করার সামর্থ্যকে বোঝায়। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তা অন্য অর্থে ব্যবহৃত হয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশারদ হ্যান্স জে মর্গেনথাউ তাঁর Politics Among Nations গ্রন্থে শক্তি বা ক্ষমতার সংজ্ঞা নির্দেশ করতে গিয়ে বলেছেন, শক্তি বা ক্ষমতা বলতে অন্যের মন ও কাজের ওপর নিয়ন্ত্রণকে বোঝায়। তাঁর মতে, এক জাতির মন ও কাজের ওপর অন্য জাতির ক্ষমতা বা শক্তি প্রয়োগ হল জাতীয় শক্তি (National power)।

8. ক্ষমতা বা শক্তির প্রকৃতি

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ কৌলম্বিস এবং উল্‌ল্ফ তাঁদের An Intro- duction to International Relations গ্রন্থে এই অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, অবনতিতে সম্পদের যেমন গুরুত্ব, রাজনীতিতে ক্ষমতা বা শক্তির সেইরূপ গুরুত্ব। অবশ্য শক্তি ও বলপ্রয়োগ সমার্থক নয়। বলপ্রয়োগ বলতে কোনো জাতির সামরিক সামর্থ্যকে বোঝানো হয়। কিন্তু শক্তি বা ক্ষমতা আরও ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। শক্তির সঙ্গে শুধুমাত্র বলপ্রয়োগের মতো নেতিবাচক ধারণা জড়িত থাকে না, অনেক ইতিবাচক ধারণাও যুক্ত থাকে। যেমন, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে অথবা অর্থনৈতিক সাহায্য ও উন্নয়নমূলক প্রকল্পে সহযোগিতামূলক কাজকর্মের মাধ্যমে নিজের বক্তব্যের অনুকূলে অন্যকে নিয়ে আসা ইত্যাদি। অনেকে শক্তি ও প্রভাবকে সমার্থক মনে করেছেন। কিন্তু প্রভাব ও শক্তি সমার্থক নয়। কৌলম্বিস এবং উল্ফের মতে, শক্তি বা ক্ষমতা হল প্রভাব ও বলপ্রয়োগের মধ্যবর্তী একটি ধারণা। শক্তি বা ক্ষমতার সঙ্গে সামর্থ্যের বিষয়টিও জড়িত।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তি বা ক্ষমতার ধারণার সঙ্গে দুটি অনুমান যুক্ত রয়েছে। সেগুলি হল-① ক্ষমতা বা শক্তি বলতে যুদ্ধ করার ক্ষমতা বা সামরিক সামর্থ্যকে বোঝায়। ② শক্তি বা ক্ষমতাকে পরিমাপ করা যায়।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞদের মতে, আধুনিক পারমাণবিক যুগে এই দুটি অনুমান অচল। অর্গানস্কি প্রমুখের মতে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু বোধগম্যহীন উপাদান ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত থাকায় এর পরিমাপ করা কষ্টসাধ্য। তা ছাড়া বিভিন্ন দেশের সরকারের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সামরিক ক্ষমতার গুরুত্ব থাকলেও অসামরিক উপাদানের গুরুত্বও কম নয়।

বিশ্বরাজনীতিতে শক্তি বা ক্ষমতার ধারণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষমতাকে কেন্দ্র করেই বিশ্বরাজনীতি আবর্তিত হয়। আর এই ক্ষমতার মাপকাঠিতেই বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রকে অতিবৃহৎ শক্তি, বৃহৎ শক্তি, মাঝারি শক্তি, ক্ষুদ্র শক্তি ইত্যাদি স্তরে বিন্যস্ত করা হয়।

শক্তি বা ক্ষমতার শ্রেণিবিভাজন

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শক্তি বা ক্ষমতার শ্রেণিবিভাজন করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিখ্যাত লেখক ই এইচ কার তিনটি প্রধান ক্ষমতার কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলি হল- [1] সামরিক শক্তি, [2] অর্থনৈতিক শক্তি এবং [3] জনমত গঠনের শক্তি।

[1] সামরিক শক্তি: আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটি রাষ্ট্র কতটা শক্তিশালী তা প্রধানত রাষ্ট্রের সামরিক শক্তির ওপর নির্ভর করে। অতীতের মতো বর্তমানেও যে রাষ্ট্র সামরিক শক্তিতে শক্তিশালী সেই রাষ্ট্রকে অতিবৃহৎ শক্তির (Super Power) মর্যাদায় ভূষিত করা হয়। জোশেফ ফ্র্যাঙ্কেল তাঁর International Relations গ্রন্থে বলেছেন যে, কোনো রাষ্ট্রের কামান ও বিমানের সামর্থ্য না থাকলে নরম ধাঁচের কূটনীতিও সফল হতে পারে না।

[2] অর্থনৈতিক শক্তি: আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সামরিক শক্তির মতো অর্থনৈতিক

শক্তিও একটি বিচার্য বিষয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞদের মতে যুদ্ধ ও শান্তি যে সময়ই হোক না কেন, অর্থনৈতিক সামর্থ্যের প্রয়োজন রয়েছে। প্রতিরক্ষাজনিত প্রস্তুতি, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ, প্রযুক্তিবিদ্যা ও বৈজ্ঞানিক গবেষণার অগ্রগতি প্রভৃতি বিষয়ে অর্থনৈতিক শক্তি একান্ত আবশ্যক। এমনকি পররাষ্ট্রনীতির সাফল্যের জন্যও অর্থনৈতিক শক্তি বা ক্ষমতার প্রয়োজন আছে বলে অনেকে মনে করেন।

[3] জনমত গঠনের শক্তি: আধুনিককালে বিশ্বরাজনীতিতে কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে জনমত গঠনের বিষয়টিও শক্তি বা ক্ষমতার একটি উপাদানরূপে বিবেচিত হয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এটা দেখা গেছে, যে রাষ্ট্রের হাতে বিশ্বজনমত গঠনের ক্ষমতা রয়েছে সেই রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অধিকতর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম।

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ক্ষমতার গুরুত্ব

ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক রাজনীতি চালিত হয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা নির্ধারণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল পারে না।

[1] আন্তর্জাতিক রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তববাদী তত্ত্বের প্রবক্তাদের মতে, ক্ষমতা সম্পর্কিত ধারণা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে খুবই প্রাসঙ্গিক। জাতীয়তাবাদ ও সার্বভৌমত্বের মতো জাতীয় শক্তিকে তাঁরা রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে অভিহিত করেছেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তববাদী লেখকদের মতে, ক্ষমতা বা শক্তি হল এমন একটি মাধ্যম যার সাহায্যে কোনো রাষ্ট্র তার অভ্যন্তরীণ নীতি ও পররাষ্ট্রনীতিকে বাস্তবে প্রয়োগ করে থাকে। ক্ষমতা অর্জন, প্রয়োগ এবং তার প্রতিষ্ঠা হল আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয়। হ্যান্স জে মর্গেনথাউ তাঁর Politics Among Nations গ্রন্থে আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে ক্ষমতার লড়াই বলে আখ্যা দিয়েছেন।

[2] রাষ্ট্রের প্রকৃতি নির্ধারণকারী: রাষ্ট্রের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা অক্ষুণ্ণ রাখার স্বার্থে ক্ষমতা বা শক্তির ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষণে রাষ্ট্রগুলিকে ‘শক্তি’ (Power) বলে অভিহিত করা হয়েছে। যেমন-ক্ষুদ্র শক্তি, মাঝারি শক্তি, বৃহৎ শক্তি ও অতিবৃহৎ শক্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন অতিবৃহৎ শক্তি (Super power) হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবলুপ্তির পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একক মহাশক্তিধর রাষ্ট্ররূপে আবির্ভূত হয়েছে।

[3] পররাষ্ট্রনীতির প্রধান লক্ষ্য: রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাষ্ট্রগুলির পররাষ্ট্রনীতির প্রধান লক্ষ্য হল ক্ষমতা অর্জন করা। মর্গেনথাউ-এর মতে, শক্তিধর রাষ্ট্রগুলি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তাদের লক্ষ্যপূরণের জন্য ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটিয়ে থাকে। বস্তুত, ক্ষমতা অর্জন না করতে পারলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে তার অস্তিত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ছোটো-বড়ো প্রতিটি রাষ্ট্রের একমাত্র উদ্দেশ্য হল ক্ষমতা অর্জন করা।

9. আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তি বা ক্ষমতার উপাদানগুলি বিশ্লেষণ করো। অথবা, ক্ষমতার মূল উপাদানগুলি আলোচনা করো। [Sri Ramkrishna Shikshalaya, Howrah; Shambazar AV School] 

অথবা, জাতীয় ক্ষমতার মূল উপাদানগুলি আলোচনা করো। 

উত্তরঃ শক্তি বা ক্ষমতার উপাদান

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তি বা ক্ষমতার একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। অর্গানস্কি তাঁর World Politics শীর্ষক গ্রন্থে এই অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল ক্ষমতা বা শক্তি (Power)। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি রাষ্ট্র কী ভূমিকা নেবে তা প্রধানত ক্ষমতা বা শক্তির দ্বারা নির্ধারিত হয় (One of the most important characteris- tics of a nation is its power, for power is a major determinant of the part that the nation will play in international relations)²। হ্যান্স জে মর্গেনথাউ আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব হিসেবে (…a struggle for power) ব্যাখ্যা করেছেন। শক্তি বা ক্ষমতার উপাদান হিসেবে যেসব বিষয়ের কথা উল্লেখ করা হয় সেগুলি হল-

[1] ভৌগোলিক উপাদান: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশারদ মর্গেনথাউ-এর মতে, ভৌগোলিক উপাদান হল এমন এক স্থায়ী উপাদান যার ওপরে কোনো জাতির শক্তি নির্ভরশীল। ভৌগোলিক উপাদানের মধ্যে রয়েছে দেশের অবস্থান, আয়তন, ভূপ্রকৃতি এবং জলবায়ু।

i. অবস্থান: অনুকূল ভৌগোলিক অবস্থান দেশের সামরিক ও নিরাপত্তাজনিত ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। যেমন-বর্তমান একমের বিশ্বের অতিবৃহৎ শক্তি (Super power) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বদিকে তিন হাজার মাইল এবং পশ্চিমদিকে ছ-হাজার মাইল জলপথ তাকে নিরাপত্তার দিক থেকে সুবিধাজনক জায়গায় রেখেছে। অবশ্য পরমাণু অস্ত্রের ক্রমবর্ধমান প্রসারের যুগে এই জাতীয় ভৌগোলিক অবস্থানের যথার্থ উপযোগিতা সম্পর্কে প্রশ্ন থেকেই যায়।

ii. আয়তন: ভূভাগের বিশাল আয়তন সামরিক দিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থার সৃষ্টি করে বলে মনে করা হয়।

iii. ভূপ্রকৃতি: আধুনিক বিশ্বে জাতীয় শক্তির অগ্রগতির ক্ষেত্রে ভূপ্রকৃতিরও অবদান রয়েছে। যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ভূপ্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। পাহাড়-পর্বত, মরুভূমি, অরণ্য, সমুদ্র ও নদনদীর বাহুল্য যে- কোনো দেশের অর্থনৈতিক বিকাশ তথা রাজনৈতিক ঐক্য, এমনকি জাতীয় প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে।

iv. জলবায়ু: জলবায়ু মানুষের কর্মক্ষমতা নির্ধারণ করে জাতীয় শক্তিকে প্রভাবিত করে থাকে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞদের মতে নাতিশীতোয় জলবায়ু কোনো দেশের বৃহৎ শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশের পক্ষে সহায়ক।

[2] জনসংখ্যা: জনসংখ্যা বা মানবসম্পদ জাতীয় শক্তির অন্যতম নির্ণায়ক উপাদান। প্রতিরক্ষা, আর্থিক বিকাশ এবং দেশগঠনের ক্ষেত্রে শক্তিশালী, দক্ষ ও শিক্ষিত জনগণের কার্যকরী ভূমিকা রয়েছে। অনেকের মতে, অর্থনৈতিক সম্পদের ব্যবহার ও আর্থিক বিকাশের জন্য জনসংখ্যা যেমন প্রয়োজন, তেমনই অতিরিক্ত জনস্ফীতিও আবার অর্থনৈতিক অবনমন ডেকে আনে।

[3] প্রাকৃতিক সম্পদ: আধুনিক বিশ্বে কোনো দেশকে শক্তিশালী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে গেলে তাকে অতি অবশ্যই প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হতে হবে। আধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় উচ্চমানের ইস্পাত, খনিজ তেল, ইউরেনিয়াম, প্লুটোনিয়াম প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদের অত্যন্ত প্রয়োজন। প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে কৃষিজ দ্রব্য ও খাদ্যশস্যেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। খাদ্যশস্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জন কোনো একটি দেশের জাতীয় শক্তি ও সামর্থ্য অর্জনের ক্ষেত্রে সহায়ক উপাদান হিসেবে স্বীকৃত। প্রযুক্তিবিদ্যার বিকাশ, শিল্পোন্নয়ন ইত্যাদির জন্য প্রাকৃতিক সম্পদের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য।

[4] অর্থনৈতিক সামর্থ্য: অর্থনৈতিক সামর্থ্য ছাড়া কোনো দেশের পক্ষে জাতীয় শক্তিতে সমৃদ্ধ হওয়া সম্ভব নয়। বর্তমান বিশ্বে শিল্পোন্নত দেশগুলি এই কারণে জাতীয় শক্তির দিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। বস্তুত যে- কোনো দেশের অর্থনৈতিক বিকাশের হার অনুকূল না হলে তার পক্ষে মানবসম্পদ ও প্রাকৃতিক সম্পদের সদ্ব্যবহার করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া এই সম্পদকে কাজে লাগানোর জন্য প্রযুক্তিবিদ্যার জ্ঞান প্রয়োজন। এই প্রযুক্তিবিদ্যাগত জ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতি ঘটিয়ে জাপান বর্তমানে নিজেকে অর্থনৈতিক দিক থেকে শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে।

 [5] সামরিক ব্যবস্থা: বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে শক্তিশালী সামরিক ব্যবস্থা না থাকলে কোনো দেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজেকে

10. জাতীয় স্বার্থের ধারণা বিশ্লেষণ করো।

অথবা, জাতীয় স্বার্থের সংজ্ঞা দাও। কীভাবে তুমি জাতীয় স্বার্থের

শ্রেণিবিভাজন করবে?

উত্তরঃ জাতীয় স্বার্থের ধারণা

বিদেশনীতির অন্যতম নির্ধারক ও নিয়ন্ত্রক হিসেবে জাতীয় স্বার্থের গুরুত্ব নিয়ে কোনো সংশয় না থাকলেও জাতীয় স্বার্থ বলতে ঠিক কী বোঝায় সে-বিষয়ে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। একটি দেশের সামারক স্থলবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর ওপর নির্ভর করে না। পারমাণবিক বোমা, আন্তর্দেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র ও অন্যান্য শক্তিশালী মারণাস্ত্রের ওপর বর্তমানে একটি দেশের সামরিক শক্তি নির্ভর করে। আধুনিক বিশ্বে পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত না হলে কোনো দেশের পক্ষে বৃহৎ শক্তিতে পরিণত হওয়া সম্ভব নয়।

[6] সরকারের প্রকৃতি: হ্যান্স মর্গেনথাউ-এর মতে, একটি উৎকৃষ্ট সরকার ছাড়া পররাষ্ট্রনীতির সার্থক রূপায়ণ সম্ভবপর নয়। সরকারের প্রকৃতির ওপর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা নির্ভর করে। অবশ্য সরকারের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি আমলাবর্গের সক্রিয়তার কথাও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।

[7] জাতীয় চরিত্র বা জাতীয় বৈশিষ্ট্য ও আত্মবিশ্বাস: কোনো দেশের শক্তি অর্জনের বিষয়টি সেই দেশের জনগণের জাতীয় চরিত্র বা জাতীয় বৈশিষ্ট্য ও আত্মবিশ্বাসের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। জাতীয় চরিত্র বা জাতীয় বৈশিষ্ট্য ও আত্মবিশ্বাসের তারতম্যের ফলে জাতীয় শক্তির তারতম্য ঘটে বলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। প্রবল দেশপ্রেম ও সুদৃঢ় মনোবলের জন্যেই ভিয়েতনামের মতো দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বৃহৎ শক্তিধর দেশের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে সাফল্যের সঙ্গে লড়াই চালাতে পেরেছিল।

[৪] কূটনীতি: অনেকে কূটনীতিকে জাতীয় শক্তির মস্তিষ্করূপে বর্ণনা করেছেন। মর্গেনথাউ-এর মতে, যেসব উপাদান নিয়ে কোনো জাতির শক্তি গড়ে ওঠে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল কূটনীতি। কূটনীতির মাধ্যমে একটি দেশ তার জাতীয় শক্তির অন্যান্য উপাদানকে সার্থকভাবে প্রয়োগ করতে পারে।

11.ক্ষমতা বলতে কী বোঝ? ক্ষমতার উপাদানগুলি বিশ্লেষণ করো।

[ABTA Inter School Test; Bethune Collegiate School] 

অথবা, ক্ষমতা কাকে বলে? ক্ষমতার উপাদানগুলি বিশ্লেষণ করো।

[HS ’16; The Scottish Church Collegiate School; Sarada Prasad Institution]

উত্তরঃ ক্ষমতা

পৃষ্ঠা নং 6-এর বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক । নং প্রশ্নের উত্তরের ‘ক্ষমতা বা শক্তির সংজ্ঞা’ শীর্ষক অংশ দ্যাখো।

ক্ষমতার উপাদানসমূহ

পৃষ্ঠা নং 7-এর বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক ২ নং প্রশ্নের উত্তর দ্যাখো।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞরা একমত হতে পারেননি। বস্তুত, জাতীয় স্বার্থের ধারণা অত্যন্ত অস্পষ্ট হওয়ায় এর সর্বজনগ্রাহ্য কোনো সংজ্ঞা নির্ধারণ করা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য।

পল সিবিউরি দুটি অর্থে জাতীয় স্বার্থের ধারণাকে ব্যাখ্যা করেছেন, তাঁর মতে-① জাতীয় স্বার্থ হল কিছু আদর্শস্থানীয় উদ্দেশ্যের সমষ্টি। ② জাতীয় স্বার্থ হল সেইসব উদ্দেশ্যের সমষ্টি যা প্রতিটি জাতি ও তার নেতৃবৃন্দ সবসময় অনুসরণ করে।

হার্টম্যান বলেছেন, জাতীয় স্বার্থ হল তা-ই যাকে প্রতিটি রাষ্ট্র অর্জন ও সংরক্ষণ করতে বিশেষভাবে আগ্রহী। কোনো রাষ্ট্র যখন অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কস্থাপনে সচেষ্ট হয়, তখনই এই স্বার্থের উন্মেষ ঘটে। হ্যান্স জে মর্গেনথাউ রাজনৈতিক বাস্তবতার দৃষ্টিকোণ থেকে জাতীয় স্বার্থের ধারণা ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, যে-কোনো রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি হল জাতীয় স্বার্থ। কোনো রাষ্ট্র জাতীয় স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে বিদেশনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থির করে না। প্রতিটি রাষ্ট্রের কতকগুলি ন্যূনতম স্বার্থ থাকে, যেমন- ভৌগোলিক অখণ্ডতা বজায় রাখা, প্রচলিত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে রক্ষা করা এবং রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক সত্তা অক্ষুণ্ণ রাখা। এই সমস্ত স্বার্থপূরণ করাই যে-কোনো রাষ্ট্রের লক্ষ্য। মর্গেনথাউ-এর অভিমত হল, জাতীয় স্বার্থের ধারণার সঙ্গে দেশের অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত রয়েছে। বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ তার সামর্থ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া বাঞ্ছনীয়। মর্গেনথাউ আরও মনে করেন যে, জাতীয় স্বার্থের ধারণা শুধু যে নিজের জাতির স্বার্থের ধারণা সম্পর্কে সচেতন করে তাই নয়, অন্য জাতির স্বার্থ সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল করে।

জোশেফ ফ্র্যাঙ্কেলের বক্তব্য অনুযায়ী, সংক্ষেপে এবং স্পষ্ট করে জাতীয় স্বার্থের ধারণা ব্যাখ্যা করা সহজ নয়। কোনো নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ বলতে কী বোঝায় তা বলাও সম্ভব নয়। তবে বিদেশনীতি রূপায়ণের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের ধারণা যে মুখ্য ভূমিকা পালন করে সে বিষয়ে তিনি দ্বিমত পোষণ করেননি। জাতীয় স্বার্থ শুধু যে একটি দেশের আশা-আকাঙ্ক্ষার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে তাই নয়, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও অন্য রাষ্ট্রের ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়ার ওপরও তা নির্ভরশীল। ফ্র্যাঙ্কেলের মতে, জাতীয় স্বার্থ হল বিদেশনীতির মুখ্য ধারণা (National interest is the key concept in foreign policy)’। তিনি এই অভিমতও পোষণ করেন যে, জাতীয় স্বার্থের ধারণা জাতীয় মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত।

প্রকৃত অর্থে জাতীয় স্বার্থ হল জাতীয় উন্নয়ন, জাতীয় নিরাপত্তা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ইত্যাদি ন্যূনতম রাষ্ট্রীয় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সমষ্টি যেগুলি অর্জনের জন্য প্রতিটি রাষ্ট্রই সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করে। মানবসমাজে যেমন ব্যক্তিগত লাভক্ষতির ধারণার দ্বারা ব্যক্তির আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রিত হয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তেমনই রাষ্ট্রও মূলত জাতীয় স্বার্থের দ্বারা চালিত হয়। জাতীয় স্বার্থরক্ষা করাই হল প্রত্যেক দেশের বিদেশনীতির মূল লক্ষ্য। জাতীয় স্বার্থের ধারণার মধ্যে রাষ্ট্রের নিজস্ব লাভক্ষতির হিসেবনিকেশ নিহিত থাকে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনা নিয়ন্ত্রণকারী একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল জাতীয় স্বার্থের ধারণা।

জাতীয় স্বার্থের শ্রেণিবিভাগ

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রেক্ষিতে জাতীয় স্বার্থকে নিম্নলিখিত কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যেতে পারে-

[1] মৌলিক বা মুখ্য স্বার্থ: একটি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব যেসব স্বার্থের ওপর নির্ভরশীল সেইসব স্বার্থকেই মৌলিক বা মুখ্য জাতীয় স্বার্থ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। এইসব স্বার্থরক্ষা করতে না পারলে একটি রাষ্ট্রের অস্তিত্বই বিপন্ন হতে পারে। স্বাভাবিক কারণেই এই ধরনের জাতীয় স্বার্থরক্ষার জন্য রাষ্ট্র যে- কোনো মূল্য দিতে প্রস্তুত থাকে। শুধু তাই নয়, এই ধরনের স্বার্থরক্ষার জন্য রাষ্ট্র যুদ্ধে যেতেও দ্বিধা করে না। অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সীমানাগত, রাজনৈতিক ইত্যাদি স্বার্থ হল এই শ্রেণিভুক্ত।

[2] গৌণ স্বার্থ: গৌণ জাতীয় স্বার্থ হল সেইসব স্বার্থ যেগুলি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষার সঙ্গে জড়িত না হলেও সেগুলি রক্ষা করাকে রাষ্ট্র কর্তব্য হিসেবে বিবেচনা করে। এই ধরনের জাতীয় স্বার্থপূরণ করতে রাষ্ট্র আগ্রহী হলেও এগুলি সংরক্ষণের জন্য রাষ্ট্র কখনোই যুদ্ধে যেতে চায় না। গৌণ জাতীয় স্বার্থের দৃষ্টান্ত হিসেবে কূটনৈতিক কর্মীদের কূটনৈতিক সুযোগসুবিধার নিশ্চিতকরণ, বিদেশি কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক বা অন্যান্য সম্পর্ক গড়ে তোলা ইত্যাদি বিষয়ের কথা বলা যায়।

[3] স্থায়ী স্বার্থ: প্রতিটি রাষ্ট্রের এমন কিছু স্বার্থ থাকে যেগুলি অপরিবর্তনীয় ও দীর্ঘমেয়াদি এবং যেগুলির পরিবর্তন হয়ে থাকে অত্যন্ত ধীর গতিতে। এই ধরনের স্বার্থকেই একটি রাষ্ট্রের স্থায়ী জাতীয় স্বার্থ হিসেবে নির্দিষ্ট করা যেতে পারে। যেমন, জাতীয় স্বার্থে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোনো রাষ্ট্রের নিজের প্রভাব সম্প্রসারণের প্রচেষ্টা।

[4] পরিবর্তনীয় স্বার্থ: এই শ্রেণির জাতীয় স্বার্থ হল সেইসব স্বার্থ যেগুলি কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে কোনো রাষ্ট্রের জাতীয় কল্যাণের পক্ষে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই ধরনের স্বার্থেরও পরিবর্তন ঘটে। সাধারণভাবে রাজনৈতিক মতাদর্শ, বিদেশনীতি নির্ধারকদের ব্যক্তিত্ব ইত্যাদির দ্বারা এই ধরনের স্বার্থ নির্ধারিত হয়ে থাকে।

[5] সাধারণ স্বার্থ: সাধারণ জাতীয় স্বার্থ বলতে একটি রাষ্ট্রের সেইসব স্বার্থকে বোঝায় যেগুলির অগ্রাধিকার রাষ্ট্র তার গুরুত্ব অনুযায়ী নির্ধারণ করে। ইতিবাচক শর্তযুক্ত এই ধরনের জাতীয় স্বার্থ বহুসংখ্যক রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে একইভাবে প্রযুক্ত হতে পারে। যেমন, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার সঙ্গে বিভিন্ন রাষ্ট্রের স্বার্থ সমানভাবে যুক্ত থাকে।

[6] সুনির্দিষ্ট স্বার্থ: স্থান ও সময়ের মানদণ্ডে সাধারণ জাতীয় স্বার্থের যুক্তিসংগত সম্প্রসারণে নির্ধারিত স্বার্থগুলিকেই সুনির্দিষ্ট জাতীয় স্বার্থ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিকাশশীল দেশগুলির সাধারণ স্বার্থরক্ষার নির্দিষ্ট কোনো প্রচেষ্টাকে এই শ্রেণিভুক্ত বিষয় হিসেবে উল্লেখ করা যায়।

12.জাতীয় স্বার্থের প্রকৃতি বা ধারণা বিশ্লেষণ করো।

উত্তরঃ জাতীয় স্বার্থের প্রকৃতি

জাতীয় স্বার্থের কোনো সর্বজনগ্রাহ্য অর্থনির্ধারণ একটি জটিল বিষয় বলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। পল সিবিউরি দুটি অর্থে জাতীয় স্বার্থকে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, জাতীয় স্বার্থ হল একটি আদর্শ স্থানীয় উদ্দেশ্যের সমষ্টি। দ্বিতীয়ত, জাতীয় স্বার্থ হল সেই সমস্ত উদ্দেশ্যের সমষ্টি যা জাতি এবং তার নেতৃবৃন্দ অনুসরণ করে থাকেন।

[1] বাস্তববাদী দৃষ্টিকোণ: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তববাদী দৃষ্টিকোণের প্রবক্তা হ্যান্স জে মর্গেনথাউ জাতীয় স্বার্থের ধারণার ব্যাখা দিতে গিয়ে রাজনৈতিক বাস্তবতাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। জাতীয় স্বার্থের বিশ্লেষণে নৈতিক বা মতাদর্শগত মানদণ্ডকে তিনি গ্রহণ করেননি। মর্গেনথাউ-এর মতে, ক্ষমতাকেন্দ্রিক স্বার্থের প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রনেতারা তাদের কাজকর্ম পরিচালনা করে থাকেন। তাঁর বক্তব্য হল, যে-কোনো রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি হল জাতীয় স্বার্থ। কোনো রাষ্ট্র জাতীয় স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে বিদেশনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থির করে না। প্রতিটি রাষ্ট্রের কতকগুলি ন্যূনতম স্বার্থ থাকে, যেমন-ভৌগোলিক অখণ্ডতা বজায় রাখা, প্রচলিত রাজনৈতিক- অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে রক্ষা করা এবং রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক সত্তা অক্ষুণ্ণ রাখা। এই সমস্ত স্বার্থ পূরণ করাই যে-কোনো রাষ্ট্রের লক্ষ্য। মর্গেনথাউ মনে করেন জাতীয় স্বার্থের ধারণার সঙ্গে রাষ্ট্রের অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত রয়েছে। বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ তার সামর্থ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া বাঞ্ছনীয়। মর্গেনথাউ এই অভিমতও ব্যক্ত করেন যে, জাতীয় স্বার্থের ধারণা শুধু যে নিজের জাতির স্বার্থের ধারণা সম্পর্কে সচেতন করে তাই নয়, অন্য জাতির স্বার্থ সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল করে। আধুনিক বিশ্বে এই সংগতি রক্ষাকে রাজনৈতিক নীতিবোধের একটি প্রয়োজনীয় শর্ত এবং রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষার একটি প্রয়োজনীয় উপাদান বলে মনে করা হয়।

[2] ফ্র্যাঙ্কেলের অভিমত: জোশেফ ফ্র্যাঙ্কেলের অভিমত হল, বিদেশনীতি রূপায়ণের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের ভূমিকা প্রধান। অবশ্য জাতীয় স্বার্থের ধারণার কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয় বলেও তিনি মনে করেন। জাতীয় স্বার্থ শুধু যে একটি দেশের আম ওঠে তাই নয়, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও অন্য রাষ্ট্রের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ওপরেও তা নির্ভরশীল। ফ্র্যাঙ্কেলের মতে, জাতীয় স্বার্থ হল পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে মূল ধারণা। জাতীয় স্বার্থ হল জাতীয় মূল্যবোধের সমষ্টি-(National interest is the key concept in foreign policy. In essence it amounts to the sum total of all the national values…) ।

[3] জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে জড়িত বিষয়: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞদের মতে, জাতীয় স্বার্থের ধারণার সঙ্গে যেসব বিষয় জড়িত তার মধ্যে রয়েছে-জাতীয় নিরাপত্তা, জাতীয় উন্নয়ন, মতাদর্শগত প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি। অবশ্য জাতীয় মর্যাদা বৃদ্ধি ও প্রভাব বিস্তার, এমনকি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রাধান্যবিস্তারও এর সঙ্গে জড়িত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষেত্রে মতাদর্শগত প্রাধান্য প্রতিষ্ঠাও স্বার্থের অন্তর্ভুক্ত ছিল। একটি দেশের পররাষ্ট্র বা বিদেশনীতি কোনো পরিস্থিতিতেই জাতীয় স্বার্থের বহির্ভূত হতে পারে না। আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্ক রচনার ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ মুখ্য নির্ধারকের ভূমিকা পালন করে। রাষ্ট্রগুলির মধ্যে বিভিন্ন সময়ে যে সামরিক ও অর্থনৈতিক জোট গঠন করা হয়, সেক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের ধারণা প্রাধান্য পায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে মার্কিন ও সোভিয়েত নেতৃত্বের দ্বারা গঠিত যথাক্রমে ন্যাটো (NATO) এবং ওয়ারশ চুক্তির (Warsaw Pact) কথা উল্লেখ করা যায়। সমাজতন্ত্রী চিন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্ক, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন ও পশ্চিম জার্মানির পারস্পরিক সম্পর্কও জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে চালিত হয়। এ ছাড়া বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে • তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির জোটনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণের ঘটনাও জাতীয় স্বার্থের ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হয়।

[4] একমেব্রু বিশ্বে জাতীয় স্বার্থ: সাম্প্রতিককালের একমের বিশ্বে (Unipolar world) আণবিক মারণাস্ত্রের প্রসার, অতিবৃহৎ শক্তি (Super power) হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য প্রভৃতির প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাষ্ট্র তাদের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে নয়া বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধান করে চলেছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দ্বিমেরুপ্রবণতা (Bi-polarism), বহুকেন্দ্রিক প্রবণতা (Polycentrism) ও একমের প্রবণতা (Unipolarism)-এর মূলে জাতীয় স্বার্থের ধারণা সক্রিয় উপাদান হিসেবে কাজ করেছে বলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রবক্তারা মনে করেন।

13. জাতীয় স্বার্থের সংজ্ঞা দাও। বিদেশনীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের ভূমিকা পর্যালোচনা করো। 

উত্তরঃ জাতীয় স্বার্থের সংজ্ঞা

জাতীয় স্বার্থের সংজ্ঞা নিয়ে বিশেষজ্ঞগণ একমত নন। হার্টম্যান বলেছেন, জাতীয় স্বার্থ হল তা-ই যাকে প্রতিটি রাষ্ট্র অর্জন ও সংরক্ষণ করতে বিশেষভাবে আগ্রহী। কোনো রাষ্ট্র যখন অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কস্থাপনে সচেষ্ট হয় তখনই এই স্বার্থের উন্মেষ ঘটে। অধ্যাপক ফ্র্যাঙ্কেল মনে করেন, জাতীয় স্বার্থ হল জাতীয় মূল্যবোধের সমষ্টি। তাঁর মতে, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক যেভাবে ব্যক্তিগত লাভক্ষতির হিসেবনিকেশ দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে, আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কও সেভাবে জাতি-রাষ্ট্রের লাভক্ষতির অঙ্ককে সামনে রেখে পরিচালিত হয়। ফ্র্যাঙ্কেল, এই লাভক্ষতির হিসাবকে জাতীয় স্বার্থরূপে অভিহিত করতে চেয়েছেন। বাস্তববাদী তত্ত্বের প্রবক্তা মর্গেনথাউ-এর অভিমত অনুসারে যে- কোনো রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি হল জাতীয় স্বার্থ। প্রতিটি রাষ্ট্র ভৌগোলিক অখণ্ডতা বজায় রাখা, প্রচলিত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে রক্ষা করা এবং রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক সত্তা অক্ষুণ্ণ রাখার মতো কয়েকটি ন্যূনতম স্বার্থপূরণ করতে চায়।

সুতরাং, উপরোক্ত আলোচনা থেকে জাতীয় স্বার্থের একটি মোটামুটি গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দেওয়া যেতে পারে। জাতীয় স্বার্থ বলতে জাতীয় নিরাপত্তা, জাতীয় উন্নয়ন, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ইত্যাদি ন্যূনতম রাষ্ট্রীয় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে বোঝায়, যেগুলি পূরণের জন্য প্রতিটি রাষ্ট্রই সক্রিয় উদ্যোগ নেয়।

বিদেশনীতি নির্ধারণে জাতীয় স্বার্থের ভূমিকা

কোনো দেশের বিদেশনীতি নির্ধারণে ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নির্ণয়ে সেই দেশের জাতীয় স্বার্থ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। জাতীয় স্বার্থকেই প্রতিটি রাষ্ট্র বিদেশনীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে ভিত্তিগত উপাদান হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। তাই কোনো দেশের বিদেশনীতি তথা বৈদেশিক সম্পর্ক জাতীয় স্বার্থ-বহির্ভূত অন্য কোনো শর্ত মেনে গড়ে ওঠে না।

প্রকৃতপক্ষে, জাতীয় স্বার্থের প্রেক্ষাপটেই পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলি একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হয় এবং সেইমতো নিজেদের বিদেশনীতি গ্রহণ করে থাকে। বলা বাহুল্য, প্রতিটি রাষ্ট্রের বিদেশনীতি গড়ে ওঠে তার জাতীয় স্বার্থকে চরিতার্থ করার জন্য। জাতীয় স্বার্থের মধ্যে জাতীয় আশা, আকাঙ্ক্ষা, রুচি, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ এবং বিকাশের ইঙ্গিত নিহিত থাকে। একটি রাষ্ট্রের এই সমস্ত স্বার্থপূরণ নির্ভর করে সেই রাষ্ট্রের সঠিক বিদেশনীতির ওপর। আজকের আন্তর্জাতিক পরিবেশে পৃথিবীর প্রায় সব রাষ্ট্রই গৃহীত ও অনুসৃত বিদেশনীতির মধ্যে দিয়ে সর্বাধিক পরিমাণে নিজ নিজ জাতীয় স্বার্থকে চরিতার্থ করার চেষ্টা করে থাকে। তা ছাড়া প্রতিটি রাষ্ট্রই আন্তর্জাতিক পরিবেশে তার নিজস্ব ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়া কীভাবে বজায় রাখবে তা জাতীয় স্বার্থের ধারণার ওপর নির্ভর করে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থকরা মনে করেন যে, কোনো রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির মূল ভিত্তি হল জাতীয় স্বার্থ। কোনো রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি জাতীয় স্বার্থের ধারণাকে অতিক্রম করে গড়ে ওঠেনি বা গড়ে ওঠা সম্ভবও নয়। কারণ, আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের ধারণা মুখ্য ভূমিকা পালন করে। যেমন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমানে অবলুপ্ত) পৃথক পৃথকভাবে যে দুটি সামরিক ও অর্থনৈতিক জোট গঠিত হয়েছিল, সেই দুটিরই মূল উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের জাতীয় স্বার্থকে সুরক্ষিত ও প্রসারিত করা। আবার ওই সময় সোভিয়েত ও মার্কিন জোটের বাইরে অবস্থানকারী রাষ্ট্রগুলিও জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনেই জোটনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করেছিল।

4. জাতীয় স্বার্থের উপাদানসমূহ বিশ্লেষণ করো। জাতীয় স্বার্থরক্ষার পদ্ধতিগুলি কী কী?[Patha Bhavan]

উত্তরঃ জাতীয় স্বার্থের উপাদানসমূহ

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের লেখকদের মতে, জাতীয় স্বার্থ সম্পর্কিত ধারণাটি একমাত্রিক নয়, বহুমাত্রিক। জাতীয় স্বার্থের উপাদানগুলিও তাই। কোনো একটিমাত্র উপাদানের সাহায্যে জাতীয় স্বার্থ তৈরি হয় না। জাতীয় স্বার্থের বহুবিধ উপাদান রয়েছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-

[1] ভৌগোলিক অখণ্ডতা: দেশের প্রতিরক্ষা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতাকে নিয়ে জাতীয় স্বার্থের প্রধান উপাদান গঠিত হয়। অনেকে একে জাতীয় নিরাপত্তা বলে অভিহিত করেছেন। দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নটিও এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে একটি দেশ সমস্ত রকমের বৈদেশিক নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকতে চায়। এই কারণে যে-কোনো মূল্যে নিজের স্বাধীন অস্তিত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা বজায় রাখার বিষয়টিকেই আধুনিক বিশ্বের দেশগুলি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়।

[2] আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধান: জাতীয় স্বার্থের অন্যতম উপাদান হল আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধান। বিশ্বের ছোটো বড়ো বিভিন্ন রাষ্ট্রকে নিয়ে যে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, তার সঙ্গে মেলবন্ধন করাই হল এর মুখ্য উদ্দেশ্য। বর্তমান বিশ্বে কোনো দেশ, সে ছোটো-বড়ো যাই হোক না কেন, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার বাইরে বিচ্ছিন্ন হয়ে টিকে থাকতে পারে না। তাই জাতীয় স্বার্থের বিষয়টিকে সামনে রেখে বিদেশনীতি অনুসরণের মাধ্যমে বিভিন্ন রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করতে চায়।

[3] অর্থনৈতিক উন্নয়ন: অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়টিকে জাতীয় স্বার্থের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে মনে করা হয়। বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে জাতীয় স্বার্থের উপাদান হিসেবে অর্থনীতির ক্ষেত্রটি নতুন মাত্রা লাভ করেছে। প্রতিযোগিতানির্ভর বিশ্ববাণিজ্যে নিজের স্থান অক্ষুণ্ণ রাখা, বহির্বাণিজ্যের বাজারে প্রবেশাধিকার অর্জন করা, অবাধ বাণিজ্য ও বিদেশি পুঁজি লগ্নির সুযোগ গ্রহণ করা ইত্যাদি বিষয়ে ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সব রাষ্ট্রের বিপুল আগ্রহ লক্ষ করা যায়।

[4] সাংস্কৃতিক বিনিময়: জাতীয় স্বার্থের উপাদান হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের একটি ভূমিকা রয়েছে। বর্তমান যুগে কূটনীতি, অর্থনীতি ও প্রতিরক্ষার পরে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিশ্বায়নের নয়া ব্যবস্থায় তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির ফলে এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের বিষয়টি আরও সহজতর হয়েছে। বিদেশের মাটিতে মেলা, উৎসব, প্রদর্শনী, আলোচনাচক্র ইত্যাদি অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের পথ প্রশস্ত করা হয়। সাংস্কৃতিক বিনিময়ের সাহায্যে এক দেশ অন্য দেশের কাছে তার সংস্কৃতির প্রচারের মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে মজবুত করে জাতীয় স্বার্থের লক্ষ্য পূরণ করতে চায়।

[5] আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ: আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটি দেশ বিভিন্ন ধরনের আন্তর্জাতিক সংগঠনে কতখানি সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারছে তার ওপর সেই দেশের জাতীয় স্বার্থপূরণের বিষয়টি অনেকাংশে নির্ভরশীল। এই কারণে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের বিষয়টিকে জাতীয় স্বার্থের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে মনে করা হয়। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ ছাড়াও বিভিন্ন অঞ্চলে বর্তমান বিশ্বে যেসব আঞ্চলিক সংগঠন গড়ে উঠেছে, সেখানে জাতীয় স্বার্থপূরণের বিষয়টি একটি ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। উদাহরণ হিসেবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, আসিয়ান, সার্ক, ওপেক, আফ্রিকান ঐক্য সংস্থা প্রভৃতির কথা উল্লেখ করা যায়।

[6] বিশ্বজনমত: আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের অন্যতম উপাদান হিসেবে বিশ্বজনমতের কথা উল্লেখ করা হয়। আন্তর্জাতিক সংকটের মোকাবিলায় বিভিন্ন রাষ্ট্র বিশ্বজনমত গঠনের মাধ্যমে নিজেদের জাতীয় স্বার্থপূরণের লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দুই মহাশক্তিধর রাষ্ট্রই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে এই ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে দেখা গেছে। সাম্প্রতিককালে সন্ত্রাসবাদ কবলিত বিশ্বে বিভিন্ন রাষ্ট্র নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে বিশ্বজনমত গঠনে প্রয়াসী হয়েছে। এই প্রসঙ্গে, ২০১১ খ্রিস্টাব্দে মুম্বাই বিস্ফোরণের পরে পাক সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারতের ভূমিকার কথা উল্লেখ করা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মতো বৃহৎ শক্তিগুলির কাছে ভারত বারে বারে পাক মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদের স্বরূপ তুলে ধরতে চেয়েছে।

পরিশেষে বলা যায়, জাতীয় স্বার্থের উপাদানগুলিকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ছোটো-বড়ো সব রাষ্ট্র বিশেষ গুরুত্ব দিলেও কখন কোন্ উপাদানকে প্রাধান্য দেওয়া হবে তা অনেকটাই আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। তবে একথা সুস্পষ্টভাবে বলা যায় যে জাতীয় স্বার্থের উপাদান একমুখী নয়, বহুমুখী। তাই এক্ষেত্রে একটিমাত্র উপাদানের ভূমিকা যথেষ্ট নয়।

জাতীয় স্বার্থরক্ষার পদ্ধতিসমূহ

জাতীয় স্বার্থরক্ষার কতকগুলি বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-

[1] পররাষ্ট্রনীতি: ফ্র্যাঙ্কেলের মতে, জাতীয় স্বার্থের ধারণা পররাষ্ট্রনীতির একটি প্রধান বিবেচ্য বিষয়। পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে একটি মৌলিক নির্ধারক হল জাতীয় স্বার্থ। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোনো রাষ্ট্র নিঃস্বার্থভাবে অপর কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে না। মূলত জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতেই রাষ্ট্রগুলি আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধান সম্পর্কে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে।

[2] প্রচার: প্রচারের সাহায্যে একটি দেশ তার জাতীয় স্বার্থসমন্বিত পররাষ্ট্রনীতির অনুকূলে অন্যান্য দেশের মতামত গড়ে তোলে। পররাষ্ট্রনীতি রূপায়ণের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হল রাজনৈতিক প্রচার। প্রচারের মাধ্যমে একটি রাষ্ট্র তার গৃহীত নীতিকে বহির্বিশ্বের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে চায়।

[3] জোটগঠন: আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থরক্ষার অন্যতম একটি উপায় বা পদ্ধতি হল জোটগঠন। মূলত, জাতীয় স্বার্থপূরণের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রগুলি জোটগঠন করে থাকে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলির জোট ন্যাটো (NATO) এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিকে নিয়ে গঠিত ওয়ারশ (Warsaw) জোটের কথা উল্লেখ করা যায়।

[4] অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও ঋণ: অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও ঋণ প্রদানের মাধ্যমে ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রগুলি তাদের জাতীয় স্বার্থপূরণের লক্ষ্যে কাজ করে। প্রধান আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থরক্ষার কৌশল হিসেবে উন্নত দেশগুলি উন্নয়নশীল দেশগুলিকে অর্থনৈতিক সাহায্য ও ঋণ প্রদান করে থাকে। এভাবে উন্নত দেশগুলি আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়ে ঋণগ্রহীতা উন্নয়নশীল দেশগুলির সমর্থন অতি সহজেই অর্জন করতে সক্ষম হয়।

[5] বলপ্রয়োগ: আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শক্তিধর ও অতিবৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রগুলি অনেক সময় নিজেদের জাতীয় স্বার্থপূরণে অন্যান্য রাষ্ট্রের ওপর বলপ্রয়োগ বা বলপ্রয়োগের ভীতি প্রদর্শন করে থাকে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, অতীতে নিকারাগুয়া, অ্যাঙ্গোলা, গ্রেনাডার ওপর এবং সম্প্রতি ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে ইরাকের ওপর মার্কিনি আগ্রাসনের কথা বলা যায়।

14. বিশ্বায়নের সংজ্ঞা দাও। বিশ্বায়নের বিভিন্ন রূপ নিয়ে পর্যালোচনা করো।  [নমুনা প্রশ্ন] অথবা, বিশ্বায়নের সংজ্ঞা লেখো। বিশ্বায়নের বিভিন্ন রূপ পর্যালোচনা করো।  [HS ’17] অথবা, বিশ্বায়ন বলতে কী বোঝ? বিশ্বায়নের বিভিন্ন প্রকারগুলি উল্লেখ করো।

উত্তরঃ বিশ্বায়নের সংজ্ঞা

বর্তমান বিশ্বের এক বহু আলোচিত শব্দ হল গ্লোবালাইজেশন (Globalisa- tion); যার বাংলা প্রতিশব্দ বিশ্বায়ন বা ভুবনায়ন। সাম্প্রতিককালের বহু ব্যবহৃত ও পরিচিত শব্দ হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বায়নের কোনো সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা নেই। সহজ কথায় বিশ্বায়ন সমগ্র বিশ্বজুড়ে প্রযুক্তি ও বাণিজ্যের বিস্তারের কথা বলে। অর্থনীতির প্রেক্ষাপট থেকে বিশ্বায়নের মূলকথা হল মুক্ত বা খোলাবাজার অর্থনীতি। বিশ্বায়ন চায় সমগ্র বিশ্বকে একটি বাজারে পরিণত করতে, যেখানে দেশের বাজার আর বিশ্বের বাজারের মধ্যে কোনো বাধার প্রাচীর থাকে না। কোনো দেশ যে জিনিস ভালো উৎপাদন করবে, সে তা বিদেশে রপ্তানি করবে এবং বিদেশি মুদ্রা রোজগার করবে। উলটোদিকে, যা সে উৎপাদন করতে পারবে না, সেই জিনিসগুলি সে বিদেশ থেকে আমদানি করবে। অর্থাৎ, বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্র পরস্পর পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। পণ্য, পরিসেবা, প্রযুক্তি, তথ্য ইত্যাদি বিষয়গুলি বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের মধ্যেই অবাধে আদানপ্রদান করা যাবে। বস্তুত যখন দেশে বাণিজ্যিক লেনদেন ও আদানপ্রদানের ওপর কৃত্রিম কোনো বাধানিষেধ থাকে না, যখন বিভিন্ন দেশের মধ্যে মূলধন, শ্রম ইত্যাদির গমনাগমন বাজারি শক্তির স্বাধীন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার দ্বারা নির্ধারিত হয়, তখনই বিশ্বায়ন ঘটে। বিশ্বায়ন হল বিশ্বজুড়ে প্রসারিত একটি প্রক্রিয়া যার দ্বারা রাষ্ট্র সংক্রান্ত সমস্ত সংকীর্ণ ধারণার অবসান ঘটে এবং অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী অবাধ আদানপ্রদানের পথ সহজ হয়। জোশেফ স্টিগলিৎস-এর মতে, বিশ্বায়ন হল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও জনগণের মধ্যে এমন ঘনিষ্ঠ সংহতিসাধন যা পরিবহণ ও যোগাযোগের ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে হ্রাস করেছে এবং দ্রব্যসামগ্রী, পরিসেবা, পুঁজি, জ্ঞান এমনকি পৃথিবী জুড়ে মানুষের অবাধ যাতায়াতের অধিকারের ওপর আরোপিত কৃত্রিম বাধানিষেধকেও অতিক্রম করেছে।

 15. বিশ্বায়নের প্রকৃতি আলোচনা করো।

উত্তরঃ বিশ্বায়নের প্রকৃতি

বিশ্বায়ন কোনো নতুন ধারণা নয়। বিশ্বায়ন একটি আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া যা বহু পূর্বেও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বজায় ছিল। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াকে নতুনভাবে প্রয়োগের কাজ গত শতাব্দীতে, বিশেষত ১৯৯০-এর পর শুরু হয়। রোল্যান্ড রবার্টসন-এর মতে বিশ্বায়ন এক নয়া বিশ্বব্যবস্থা (New World Order) প্রসারের ধারণার সঙ্গে জড়িত। পুঁজির অবাধ চলাচল, মুক্তবাজার অর্থনীতি, উদারীকরণ ও বেসরকারিকরণ প্রভৃতি ধারণার সঙ্গে বিশ্বায়ন ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত। বিশ্বায়নের প্রকৃতিকে মূলত যে সমস্ত দিক থেকে আলোচনা করা যেতে পারে সেগুলি হল- 

 [1] অর্থনৈতিক দিক: বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার মূলভিত্তি হল তার অর্থনৈতিক প্রকৃতি। আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার (IMF), বিশ্বব্যাংক (World Bank) এবং পাটি (General Agreement on Trade and Tariff) চুপ্তির পরবর্তী পর্যায়ে গঠিত বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা (WTO) অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের প্রক্রিয়াকে বাস্তবায়িত করে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার প্রধান দিকগুলির মধ্যে। রয়েছে বিশ্ববাণিজ্যের দ্রুত প্রসার, লগ্নি পুঁজির অবাধ আদানপ্রদান, বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে অভিগমন ও নির্গমন, এক দেশ থেকে অন্য দেশে অর্থ ও অন্যান্য বিনিময় মাধ্যমের সঞ্চালন, বহুজাতিক বাণিজ্য সংস্থার অবাধ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, বিভিন্ন দেশের মধ্যে প্রযুক্তির আদানপ্রদান, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি ও তথ্যমাধ্যমের বিস্তার প্রভৃতি।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ মোগেনস বুখ হানসেন তাঁর দ্য ডব্লিউটিও এগ্রিমেন্টস অন এগ্রিকালচার অ্যান্ড ইটস ইমপ্যাক্ট অন ডেভেলপিং কানট্রিজ (The WTO Agreements on Agriculture and its impact on Developing Countries) শীর্ষক রচনায় বিশ্বায়নের আর্থিক দিকটি – পর্যালোচনা করতে গিয়ে বলেছেন- “বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা নির্দেশিত উদার • অর্থনীতির পথে চলতে গিয়ে ধনী বিশ্ব আরও ধনী হচ্ছে, তাদের পার্থিব সুখের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে দরিদ্র বিশ্ব দরিদ্রতর হচ্ছে। উন্নয়নশীল বিশ্ব না উন্নত বিশ্বের প্রয়োজনে তাদের কাঁচামাল জোগান দেওয়ার এবং উন্নত বিশ্বের । অপ্রয়োজনীয় উদ্বৃত্ত সামগ্রী ফেলার কলোনিতে পরিণত হচ্ছে”।

[2] রাজনৈতিক দিক: রাজনৈতিক দিক থেকে বিশ্বায়ন জাতি-রাষ্ট্রের (Nation State) সংকট সৃষ্টি করেছে বলে অনেকে মনে করেন। জাতি-রাষ্ট্রগুলির সাবেকি চূড়ান্ত রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার ধারণা বিশ্বায়নের যুগে বহুলাংশে অচল ল হয়ে পড়েছে। বিশ্বায়ন জাতি-রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতাকে খর্ব করে রাষ্ট্রকে ‘একটি ■ বাজারকেন্দ্রিক সংগঠন’-এ পরিণত করেছে। অবশ্য জাতি-রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ প বিলোপসাধন বা বিশ্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কোনো কর্মকাণ্ড বিশ্বায়নে দেখা যায় না। অধ্যাপক হলটন তাঁর গ্লোবালাইজেশন অ্যান্ড দ্য নেশন স্টেট (Globalisation and The Nation State) শীর্ষক রচনায় জাতি-রাষ্ট্রের ওপর বিশ্বায়নের প্রভাব এক পর্যালোচনা করতে গিয়ে বলেছেন-জাতি-রাষ্ট্রগুলি যে পৃথিবীতে বাস করে তার পরিবর্তন ঘটে চলেছে। বিশ্বায়ন হল এই পরিবর্তনের একটি প্রধান উৎস। এ বিশ্বায়নের বিভিন্ন দিক জাতি-রাষ্ট্রগুলির ভূমিকা ও পারস্পরিক সম্পর্কের এর পরিবর্তন সাধন করেছে। এই ধরনের পরিবর্তন নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মধ্যে রাষ্ট্রের চরম ই সার্বভৌমত্বের চিরাচরিত ধারণার অবসান ঘটাতে পারে।

জোশেফ এস নাই এবং জন ডি জোনাহিউ তাঁদের গভর্নেন্স অ্যাজ এ গ্লোবালাইজিং ওয়ার্ল্ড (Governance as a Globalising World) শীর্ষক এক সম্পাদিত গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন- “বিশ্বায়নের যুগে মূলধনের খা সচলতা (Mobility of Capital), এক দেশ থেকে অন্য দেশে দক্ষ শ্রমিকের দ্রুত নির্গমন, তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে অর্থ ও শেয়ার হস্তান্তর ইত্যাদি বিষয়গুলি সরকারের কর আরোপ করার চিরাচরিত ক্ষমতাকে ব্যাহত করেছে”।

[3] সাংস্কৃতিক দিক: সাংস্কৃতিক দিক থেকে বিশ্বায়নের প্রধান লক্ষ্য হল সারা বিশ্বে এক সমজাতীয় সংস্কৃতি (homogeneous culture) গড়ে তোলা। । সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন ইনটারনেট-সহ অত্যাধুনিক গণমাধ্যমের সহায়তায় এক পণ্যমুগ্ধ ভোগবাদী সংস্কৃতির প্রচার শুরু করেছে, এর ফলে আঞ্চলিক ও জাতীয় সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য ক্ষুন্ন হতে বসেছে। বিশ্বায়ন বহুমুখী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসমূহকে এক ছাঁচে ঢেলে যে সমজাতীয় সংস্কৃতি গড়ে তুলতে চায় তাকে অনেকে মার্কিনি ম্যাকডোনাল্ড সংস্কৃতি বলে আখ্যা দিয়েছেন। এভাবে সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন তৃতীয় বিশ্বের বৈচিত্র্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে এক সংকটের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে। কে এম পানিজর বিশ্বায়ন, সংস্কৃতি ও পণ্যায়ন সংক্রান্ত তাঁর এক প্রবন্ধে এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বহুজাতিক সংগঠনগুলি বিশেষভাবে সক্রিয়। আজ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে যে সাংস্কৃতিক আক্রমণ চলেছে সেটি সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠার এক প্রচেষ্টা। অবশ্য সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন বিশ্বের জাতি-রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন ঘটাতে এবং স্বল্পব্যয়ে উন্নত সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে সাহায্য করেছে বলে অনেকে মনে করেন।

[4] পরিবেশগত দিক: পরিবেশবিদদের মতে, বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া বিশ্বের পরিবেশগত ক্ষেত্রে এক সংকট সৃষ্টি করেছে। কর্পোরেট বিশ্বের আধিপত্য প্রাকৃতিক পরিবেশকে শুধু যে বিনষ্ট করে চলেছে তাই নয়, তাকে পণ্যায়িতও করেছে। পরিবেশবিদ বন্দনা শিবা তাঁর গ্লোবালাইজেশন অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট (Globalisation and Environment) শীর্ষক এক নিবন্ধে লিখেছেন- “পৃথিবীর মূল সম্পদগুলি হল স্থল, জল এবং পরিবেশগত বৈচিত্র্য। বিশ্বায়নের প্রভাবে এই স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক উপাদানগুলি পণ্যে রূপান্তরিত হচ্ছে। নতুন ধরনের সম্পদ হিসেবে এই উপাদানগুলি উপজাতি ও কৃষক সম্প্রদায়ের অধিকার থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে বিশ্বায়িত কর্পোরেশনগুলির নিজস্ব সম্পত্তিতে পরিণত হচ্ছে। বিশ্বায়িত বাণিজ্যের চুক্তিগুলি জাতীয় সংবিধানকে অবনমিত করে, যার অর্থ নাগরিকদের জীবনের প্রতি অধিকার, স্থল, জল এবং পরিবেশগত বৈচিত্র্যের প্রতি অধিকারের অবলুপ্তি”।

16. বর্তমান যুগে বিশ্বায়নের প্রভাব বা ফলাফল পর্যালোচনা করো।

উত্তরঃ বিশ্বায়নের প্রভাব বা ফলাফলসমূহ

বিশ্বায়ন (Globalisation) একটি আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া। জোশেফ স্টিগলিৎস- এর মতে, বিশ্বায়ন বলতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের দেশ ও জনগণের মধ্যে এক নিবিড় সংযোগসাধনের প্রক্রিয়াকে বোঝায়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বায়নের প্রভাব বা ফলাফল পর্যালোচনায় উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলি হল-

[1] উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে বৈষম্য বৃদ্ধি: বিশ্বায়নের ফলে উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে বৈষম্য প্রকট হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার, বিশ্বব্যাংক এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা কর্তৃক গৃহীত বৈষম্যমূলক নীতির ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি উন্নত দেশগুলির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এডওয়ার্ড এস হারমানের মতে বিশ্বে সবচেয়ে ধনী ও দরিদ্র দেশে বসবাসকারী মানুষের আয়ের ফারাক ১৯৬০ সালে ৩০:১ থেকে বেড়ে ১৯৯৫ সালে ৮২:১-এ দাঁড়িয়েছে।

 [2] বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাসম্পদ অধিকারের (TRIPS) প্রয়োগ: বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা বাণিজ্যিক বিশ্বায়নের নীতিকে কার্যকরী করার জন্য বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাসম্পদ অধিকারের যে চুক্তি বলবৎ করেছে তার ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলি এই অধিকার অনুযায়ী পেটেন্ট, কপিরাইট, ট্রেডমার্ক, ব্যাবসায়িক গোপনীয়তার সুরক্ষা প্রভৃতি বিষয় কতটা নিজেদের এক্তিয়ারে সংরক্ষিত রাখতে পারবে তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। তা ছাড়া এসব ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতাতেও তারা টিকে থাকতে পারছে না।

[3] বহুজাতিক সংস্থার আধিপত্য বিস্তার: বিশ্বায়নের ফলে বাণিজ্য সম্পর্কিত বিনিয়োগ ব্যবস্থা (Trade Related Investment Measures or TRIMS) গৃহীত হওয়ায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহুজাতিক সংস্থা বা কর্পোরেট বিশ্বের আধিপত্য বিস্তৃত হয়েছে। সারা বিশ্ব জুড়ে বৃহৎ বহুজাতিক সংস্থাগুলি উন্নয়নশীল দেশগুলির ক্ষুদ্র সংস্থাগুলিকে অধিগ্রহণ বা সংযুক্তির মাধ্যমে দখল করে নিয়ে তাদের ওপর আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়েছে। কোনো কোনো বহুজাতিক সংস্থার বার্ষিক আয় একটি রাষ্ট্রের জাতীয় আয়কেও ছাড়িয়ে গেছে। যেমন, মার্কিনি বহুজাতিক সংস্থা জেনারেল মোটরসের বার্ষিক আয় নরওয়ের জাতীয় আয়কে অতিক্রম করেছে। আবার মার্কিনি তেল সংস্থা এক্সনের বার্ষিক আয় ভেনেজুয়েলার জাতীয় আয়ের চেয়ে অনেক বেশি।

[4] নয়া ঔপনিবেশিক অর্থনীতির এবং উত্তর-দক্ষিণ সংঘাতঃ বিশ্বায়নের ফলে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা উন্নত ও ধনী দেশগুলির কুক্ষিগত হওয়ায় রা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নয়া ঔপনিবেশিক অর্থনীতি এবং ‘উত্তর-দক্ষিণ’ সংঘাতের অ উদ্ভব ঘটেছে। উন্নত দেশগুলি উন্নয়নশীল বিশ্বের বাণিজ্যিক সম্প্রসারণে সম্পূর্ণ বি নেতিবাচক অবস্থান গ্রহণ করেছে। উন্নত দেশগুলির কর্তৃত্বাধীন বিশ্ববাণিজালে সংস্থা যেভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলির ওপর শ্রমখরচ (Labour Cost) সংক্রান্ত বিধান, অভিন্ন শ্রমিক স্বার্থ সম্পর্কিত নীতিগ্রহণ, কৃষিক্ষেত্রে ভরতুকি কমানো প্রভৃতি বিষয়ে চাপ সৃষ্টি করে চলেছে, তার ফলে উত্তর (উন্নত) বনাম দক্ষিণ (উন্নয়নশীল) সংঘাত তীব্রতর হয়ে দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ মোগেনস বুখ হানসেনের মতে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার নি নির্দেশিত উদার অর্থনৈতিক পথে চলতে গিয়ে ধনী বিশ্ব আরও ধনী হচ্ছে- অন্যদিকে দরিদ্র বিশ্ব দরিদ্রতর হচ্ছে।

[5] সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধি: আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার বিশ্বব্যাংক এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার নির্দেশে উন্নয়নশীল দেশগুলি যে কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস (Structural Adjustment)-এ হাত দিয়েছে তার ফলে ব্যাপকভাবে কর্মী সংকোচন, ছাঁটাই, লে অফ, লক আউট, রাষ্ট্রায়ত ক্ষেত্রের বিলগ্নিকরণ, জাতীয় ব্যয়ের সংকোচন ইত্যাদি পন্থা অনুসৃত হচ্ছে। কাঠামোগত এই পুনর্বিন্যাসের ফলে বেকারত্ব, দারিদ্র্য প্রভৃতি বৃদ্ধি পেয়েছে। আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সংকট দেখা দিয়েছে।

[6] সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সংকট: বিশ্বায়নের ফলে সারা বিশ্বজুড়ে সাংস্কৃতিক সমতা তৈরির চেষ্টা চলেছে। ইনটারনেট-সহ অত্যাধুনিক গণমাধ্যমের সহায়তায় এক পণ্যমুগ্ধ ভোগবাদী সংস্কৃতির নিরন্তর প্রচারের ফলে আঞ্চলিক ও জাতীয় সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য ক্ষুণ্ণ হতে বসেছে। বিশ্বায়ন বৈচিত্র্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসমূহকে এক ছাঁচে ঢেলে এক ধরনের সাংস্কৃতিক সমতা চাপিয়ে দিতে চায়। অনেকে একে মার্কিনি ম্যাকডোনাল্ড সংস্কৃতির আখ্যা দিয়েছেন। এর ফলে তৃতীয় বিশ্বের বহুমুখী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এক সংকটের সম্মুখীন হয়েছে।

[7] জাতি-রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের সংকট: বিশ্বায়নের প্রভাবে জাতি-রাষ্ট্রের (Nation State) সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব তার নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মধ্যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ ও নাগরিকবৃন্দের ওপর চূড়ান্তভাবে প্রযোজ্য হয়। বিশ্বায়ন জাতি-রাষ্ট্রের এই ভূখণ্ডকেন্দ্রিক সর্বব্যাপী ক্ষমতাকে খর্ব করে রাষ্ট্রকে একটি ‘বাজারকেন্দ্রিক সংগঠনে’ পরিণত করেছে। এর ফলে সার্বভৌমত্বের ধারণার বদল ঘটেছে।

[৪] পরিবেশদূষণ: বিশ্বায়নের ফলে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে বহুজাতিক সংস্থাগুলি এই সমস্ত এলাকায় যেসব শিল্প গড়ে তুলছে, সেগুলির কারণে যথেচ্ছভাবে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। বস্তুত, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে – পরিবেশের ব্যাপারে উন্নত বিশ্বের মতো কোনো কঠোর আইন এখানে না থাকায় বহুজাতিক সংস্থাগুলি খুব সহজেই এখানে পরিবেশদূষণকারী শিল্প গড়ে তুলতে পারছে। তা ছাড়া বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার অবাধ বাণিজ্যনীতির সুযোগে উন্নত দেশগুলির উৎপাদন কেন্দ্রের বর্জ্য পদার্থ উন্নয়নশীল দেশে পরিত্যক্ত হওয়ার ফলে সেখানকার পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *