WBCHSE Class 12 Political Science Chapter 8 Solution | Bengali Medium

Class 12 Political Science Solution

ভারতের আইন বিভাগ

1. MCQs Question Answer

1. ভারতের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের নাম হল- 

A) লোকসভা ✔

B) রাজ্যসভা 

C) বিধানসভা 

D) বিধান পরিষদ

2. ভারতের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের নাম হল-

A) সিনেট

B) লর্ডসভা

C) রাজ্যসভা ✔

D) বিধান পরিষদ 

3. লোকসভার সর্বাধিক সদস্যসংখ্যা হল-

A) ৫৫০ জন

B) ৫৫২ জন ✔

C) ৫৫৫ জন

D) ৫৬০ জন

4. লোকসভার বর্তমান সদস্যসংখ্যা হল-

A) ৫৪৫ জন ✔

B) ৫৫০ জন

C) ৫৫৫ জন

D) ৫৫৩ জন

5. ভারতের রাজ্যসভার সদস্যসংখ্যা-

A) ২৫০ জন ✔

B) ২৬০ জন

C) ২৭৫ জন

D) ২৮০ জন

6. রাজ্যসভার বর্তমান সদস্যসংখ্যা হল-

A) ২৩০ জন

B) ২৩৫ জন

C) ২৪০ জন

D) ২৪৫ জন ✔

7. রাষ্ট্রপতি লোকসভায় কতজন ইঙ্গ-ভারতীয় সদস্য নিয়োগ করতে পারেন?

A) ১ জন

B) ২ জন ✔

C) ৩ জন

D) ৪ জন

৪. রাজ্যসভায় রাষ্ট্রপতি কতজন সদস্য মনোনীত করতে পারেন?

A) ২ জন

B) ৪ জন ✔

C) ৬ জন

D) ১২ জন

9. লোকসভার সদস্য হওয়ার জন্য পদপ্রার্থীর ন্যূনতম বয়স হতে হবে-

A) ১৮ বছর

B) ২৫ বছর ✔

C) ২৮ বছর

D) ৩০ বছর

10. রাজ্যসভার সদস্য হওয়ার জন্য পদপ্রার্থীর ন্যূনতম বয়স হতে হবে-

A) ১৮ বছর

B) ২০ বছর

C) ২৫ বছর

D) ৩০ বছর ✔

11. অঙ্গরাজ্যগুলি থেকে লোকসভায় নির্বাচিত হন সর্বাধিক-

A) ৫০০ জন 

B) ৫৩০ জন ✔

C) ৫৫০ জন

D) ৫৫২ জন

12. ভারতের পার্লামেন্টের নেতা হলেন-

A) রাষ্ট্রপতি 

B) উপরাষ্ট্রপতি

C) প্রধানমন্ত্রী ✔

D) স্পিকার

13. সর্বভারতীয় রাষ্ট্রকৃত্যক গঠন করতে পারে-

A) রাজ্যসভা ✔

B) লোকসভা 

C) রাষ্ট্রপতি

D) প্রধানমন্ত্রী

14. অর্থ বিলের প্রশ্নে সার্টিফিকেট দিতে পারেন-

A) \রাষ্ট্রপতি

B) উপরাষ্ট্রপতি

C) স্পিকার ✔

D) অর্থমন্ত্রী

15. লোকসভার সাধারণ কার্যকালের মেয়াদ হল-

A) ৪ বছর

B) ৫ বছর ✔

C) ৬ বছর

D) ৭ বছর

16. রাজ্যসভার সদস্যদের কার্যকালের স্বাভাবিক সময়সীমা হল-

A) ৪ বছর

B) ৫ বছর

C) ৬ বছর ✔

D) ৭ বছর

17. যার সম্মতি ছাড়া সংসদ চত্বরে কোনো সাংসদকে গ্রেফতার করা যায় না তিনি হলেন-

A) রাষ্ট্রপতি

B) স্পিকার ✔

C) প্রধানমন্ত্রী

D) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

18. ভারতে সাধারণ বিল পাসের পর্যায় আছে- 

A) ৫টি

B) ৬টি

C) ৭টি ✔

D) ১০টি

19. শুধুমাত্র রাজ্যসভা যে পদাধিকারীকে পদচ্যুত করতে পারে, তিনি হলেন- 

A) রাষ্ট্রপতি

B) উপরাষ্ট্রপতি ✔

C) প্রধানমন্ত্রী

D) রাজ্যপাল

20. শুধুমাত্র লোকসভা যে বিল উত্থাপন করতে পারে, সেটি হল-

A) অর্থ বিল ✔

B) ভূমিবিল

C)  রাজ্য পুনগঠন বিল

D)  বিবাহ বিষয়ক বিল

21. ২ বছর অন্তর অবসর নিতে হয় রাজ্যসভার-

A) ১৩ সদস্যকে ✔

B) ১৪ সদস্যকে

C) ২৩ সদস্যকে

D) ১২সদস্যকে

22. পদাধিকার বলে রাজ্যসভার সভাপতি হন-

A) রাষ্ট্রপতি

B) উপরাষ্ট্রপতি ✔

C) রাজ্যপাল

D) প্রধানমন্ত্রী

23. রাজ্যসভায় যিনি সভাপতিত্ব করেন তাকে বলা হয়-

A) সভাপতি

B) চেয়ারম্যান ✔

C) স্পিকার

D) চেয়ারপার্সন

24. দ্বিকক্ষবিশিষ্ট রাজ্য আইনসভা আছে যে রাজ্যে-

A) পশ্চিমবঙ্গে

B)  ত্রিপুরায়

C)  বিহারে ✔

D)  ওড়িশায়

25. পার্লামেন্টের কোনো কক্ষের সদস্য না হয়েও কোনো ব্যক্তি মন্ত্রী হতে পারেন-

 A) ৩ মাসের জন্য

B)  ৫ মাসের জন্য

C) ৬ মাসের জন্য ✔

D) ৮ মাসের জন্য

26. স্বাধীনতার পর ভারতের প্রথম লোকসভা নির্বাচন হয়-

A)  ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে

B)  ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ✔

C)  ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে

D)  ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে

27. ভারতীয় সংবিধানের কোন্ অংশে পার্লামেন্ট সম্পর্কে আলোচন আছে?

A)  দ্বিতীয় অংশে

B)  তৃতীয় অংশে

C)  চতুর্থ অংশে

D)  পঞ্চম অংশে ✔

28. ভারতীয় সংবিধানের কত নং ধারা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় আইনসভা রাষ্ট্রপতি এবং পার্লামেন্টের দুটি কক্ষ নিয়ে গঠিত?

A)  ৭৮ নং ধারা 

B) ৭৯ নং ধারা ✔

C)  ৮০ নং ধারা

D)  ৮১ নং ধারা

29. ভারতীয় সংবিধানের কোন অংশে কেন্দ্রীয় আইনসভাকে পার্লামেন্ট বলে অভিহিত           করা হয়েছে?

A) পঞ্চম ✔

B) ষষ্ঠ

C) সপ্তম

D) অষ্টম

30. লোকসভার সদস্যদের ক-টি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়?

A) সাত

B) পাঁচ

C)  দুই

D)  তিন ✔

31. সংবিধান অনুসারে কত সাল পর্যন্ত রাজ্যসভার সদস্যসংখ্যা অপরিবর্তিত থাকবে?

A) ২০২০ সাল

B) ২০২২ সাল

C) ২০২৬ সাল ✔

D) ২০৩৫ সাল 

32. ভারতীয় সংবিধানের কততম সংশোধন অনুযায়ী ২০২৬ সাল পর্যন্ত রাজ্যসভার সদস্যসংখ্যা অপরিবর্তিত রাখার কথা বলা হয়েছে? 

A) ৮৪তম ✔

B) ৮৫তম

C) ৮৬তম

D) ৮৭তম

33. ভারতীয় সংবিধানের ৮৪তম সংশোধন কোন্ সালে হয়?

A) ২০০০ সাল

B) ২০০১ সাল ✔

C) ২০০২ সাল 

D) ২০০৩ সাল 

34. বর্তমানে একজন সাংসদের মাসিক বেতন কত?

A) ২০,০০০ টাকা

B)  ৫০,০০০ টাকা ✔

C)  ৪৫,০০০ টাকা

D)  ৩০,০০০ টাকা

35.  রাজ্যসভার সদস্যগণ কত বছরের জন্য নির্বাচিত বা মনোনীত হন?

A) ২ বছর

B) ৪ বছর

C) ৫ বছর ✔

D) ৬ বছর

36. বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত সাংসদের মাসিক পেনশন কত?

A) ১০,০০০ টাকা

B) ২০,০০০ টাকা ✔

C) ৩০,০০০ টাকা

D) ৪০,০০০ টাকা

37. রাজ্যসভার এক-তৃতীয়াংশ সদস্য কত বছর অন্তর অবসর গ্রহণ করেন?

A) ২ বছর ✔

B) ৩ বছর

C) ৪ বছর

D) ৫ বছর

38. প্রতি ২ বছর অন্তর রাজ্যসভার কত সংখ্যক সদস্য নির্বাচিত হন?

A) অৰ্ধেক সদস্য

B) এক-তৃতীয়াংশ সদস্য ✔

C) এক-চতুর্থাংশ সদস্য

D) এক-পঞ্চমাংশ সদস্য

39. অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ নির্বাচনের বিষয়টি উল্লেখিত রয়েছে সংবিধানের কত নম্বর ধারায়?

A) ৯১ নং

B) ৯৩ নং ✔

C) ৯৫ নং

D) ৯৬ নং

40. বর্তমানে রাজ্যসভার চেয়ারম্যানের মাসিক বেতন কত?

A) ১,০০,০০০ টাকা

B) ১,১০,০০০ টাকা

C) ১,১৫,০০০ টাকা

D) ১,২৫,০০০ টাকা ✔

41. লোকসভার অধ্যক্ষকে ‘সমগ্র কক্ষের মর্যাদা ও স্বাধীনতার প্রতিভূ’ বলেছেন-

A) মতিলাল নেহরু

B) ইন্দিরা গান্ধি

C) লালবাহাদুর শাস্ত্রী

D) জওহরলাল নেহর ✔

42. সংবিধান অনুযায়ী বর্তমানে লোকসভায় কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল থেকে সর্বাধিক কতজন সদস্য নির্বাচিত হতে পারেন?

A) ১৫ জন

B) ১৭ জন

C) ১৮ জন

D) ২০ জন ✔

43. লোকসভা নির্বাচনে কত সাল পর্যন্ত তপশিলি জাতি ও উপজাতির জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে?

A)  ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত

B)  ২০২০ সালের ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত

C)  ২০২০ সালের ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত

D)  ২০২০ সালের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ✔

44. ভারতীয় সংবিধানের কততম সংশোধনের মাধ্যমে লোকসভায় তপশিলি জাতি ও উপজাতির জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে?

A) ৯৩তম

B) ৯৪তম

C) ৯৫তম ✔

D) ৯৬তম

45. ভারতীয় সংবিধানের ৯৫তম সংশোধন কোন্ সালে সম্পাদিত হয়?

A) ২০০৯ সাল ✔

B) ২০১০ সাল

C) ২০১১ সাল

D) ২০১২ সাল

46. রাজ্যসভার সদস্য হওয়ার জন্য প্রার্থীর বয়সের ঊর্ধ্বসীমা কত হবে?

 A) ৭০ বছর

B)  ৭২ বছর

C)  ৬৪ বছর

D)  কোনো ঊর্ধ্বসীমা নেই ✔

47. লোকসভার সদস্য হওয়ার জন্য কোনো প্রার্থীর বয়সের ঊর্ধ্বসীমা কত হবে?

A) ৬৮ বছর

B) ৭০ বছর

C) ৮৫ বছর

D) কোনো উর্ধ্বসীমা নেই ✔

48. কেন্দ্রীয় তালিকায় ক-টি বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে?

A) ৭০টি

B) ৮০টি

C) ৯০টি

D) ১০০টি ✔

49. বর্তমানে রাজ্য-তালিকায় কতগুলি বিষয় আছে?

A) ৫০টি

B) ৬০টি

C) ৬১টি ✔

D) ৬২টি

50. বর্তমানে যুগ্ম-তালিকায় কতগুলি বিষয় আছে?

A) ৪৯টি

B) ৫০টি

C) ৫১টি

D) ৫২টি ✔

51. ভারতীয় সংবিধানের কত নং ধারা অনুযায়ী পার্লামেন্ট যে-কোনো কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের হাইকোর্টের ক্ষমতার পরিধি সম্প্রসারণ করতে পারে?

A) ২২৭ নং ধারা

B) ২২৮ নং ধারা

C) ২২৯ নং ধারা

D) ২৩০ নং ধারা ✔

52. ভারতীয় সংবিধানের কত নং ধারা অনুযায়ী সংসদ কোনো রাজ্যের নাম, সীমানা ইত্যাদির পরিবর্তন করতে পারে?

A) ২ নং

B) ৩ নং ✔

C) ৪ নং

D) ৫ নং

53. ভারতীয় সংবিধানের কত নং ধারা অনুযায়ী পার্লামেন্ট জাতীয় স্বার্থে রাজ্য-তালিকাভুক্ত বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে পারে?

A) ২৪৭ নং

B) ২৪৮ নং

C) ২৪৯ নং ✔

D) ২৫০ নং

54. ভারতীয় সংবিধানের কত নং ধারা অনুযায়ী সংসদ সর্বভারতীয় কৃত্যক গঠন করতে পারে?

A)  ৩১১ নং ধারা

B)  ৩১২ নং ধারা ✔

C) ৩১৩ নং ধারা

D) ৩১৪ নং ধারা

55. লোকসভার অধ্যক্ষের অপসারণ-সংক্রান্ত প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য কত দিনের নোটিশ দিতে হয়?

A) ১০ দিন

B) ১২ দিন

C) ১৪ দিন ✔

D) ২১ দিন

56. বর্তমানে লোকসভার অধ্যক্ষের মাসিক বেতন কত?

A)  ১,২৫,০০০ টাকা ✔

B)  ১,৩০,০০০ টাকা

C)  ১,৪০,০০০ টাকা

D)  ১,৫০,০০০ টাকা

57. সংবিধান অনুযায়ী কোনো বিল অর্থ বিল কি না, সেই সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী কে?

A) কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী

B) প্রধানমন্ত্রী

C) রাষ্ট্রপতি

D) লোকসভার অধ্যক্ষ ✔

58. লোকসভায় কমপক্ষে কতজন সদস্যের উপস্থিতিকে কোরাম বলে?

A) এক-তৃতীয়াংশ

B) এক-চতুর্থাংশ

C) এক-পঞ্চমাংশ

D) এক-দশমাংশ ✔

59. সংসদীয় কমিটিগুলির প্রধান কে?

A)  সংসদীয় মন্ত্রী

B)  লোকসভার অধ্যক্ষের ✔

C)  রাজ্যসভার চেয়ারম্যান

 D) প্রধানমন্ত্রী

60. লোকসভার কোনো সদস্য পদত্যাগ করলে সেই পদত্যাগ স্বেচ্ছামূলক কি না তা দেখার দায়িত্ব কার?

A) রাষ্ট্রপতির

B) প্রধানমন্ত্রীর

C) লোকসভার অধ্যক্ষের ✔

D) সংসদীয় মন্ত্রীর

61. ভারতীয় সংবিধানের কততম সংশোধন অনুযায়ী লোকসভার কোনো সদস্যের পদত্যাগ স্বেচ্ছামূলক কি না তা অধ্যক্ষ দেখবেন?

A) ৩৩তম ✔

B) ৩৪তম

C) ৩৫তম

D) ৩৬তম

62. ভারতীয় সংবিধানের ৩৩তম সংশোধন কত সালে হয়?

A) ১৯৭১ সালে

B) ১৯৭২ সালে

C) ১৯৭৩ সালে

D) ১৯৭৪ সালে ✔

63. ভারতে দলত্যাগ-বিরোধী আইন কোন্ সালে প্রণীত হয়?

A)  ১৯৮৩ সালে

B) ১৯৮৪ সালে

 C) ১৯৭৬ সালে ✔

D)  ১৯৮৫ সালে

64. ভারতীয় সংবিধানের কততম সংশোধনীর মাধ্যমে দলত্যাগ-বিরোধী আইন প্রণীত হয়?

A) ৫১তম

B) ৫২তম ✔

C) ৫৩তম

D) ৫৪তম

65. সংবিধান অনুযায়ী ভারতে দলত্যাগ-বিরোধী আইন কাদের প্রয়োগ করার কথা?

 A) প্রধানমন্ত্রীর

 B) রাষ্ট্রপতির

C)  আইনমন্ত্রীর

D)  আইনসভার সভাপতিদের ✔

66. দলত্যাগ-বিরোধী আইন আদালতে বিচারযোগ্য, এই সম্পর্কে ভারতীয় সুপ্রিমকোর্ট কবে রায় দেয়? 

A) ১৯৯১ সালের ১১ নভেম্বর 

B) ১৯৯১ সালের ১২ নভেম্বর ✔

C) ১৯৯১ সালের ১৩ নভেম্বর

D) ১৯৯১ সালের ১৪ নভেম্বর

67. লোকসভার প্রথম অধ্যক্ষ কে?

A) জি ভি মভলঙ্কব় ✔

B) পি এ সাংমা

C) সঞ্জীব রেড্ডি

D) জি বালাযোগী

68. নিরপেক্ষভাবে অধ্যক্ষের কাজ পরিচালনা করার জন্য সঞ্জীব রেড্ডি কবে কংগ্রেসের সদস্যপদ ত্যাগ করেন?

A) ১৯৬৭ সালে ✔

B) ১৯৬৮ সালে 

C) ১৯৬৯ সালে 

D) ১৯৭০ সালে 

69. কত সালের নির্বাচনে লোকসভার দ্বিতীয় বৃহত্তম মোর্চার নেতা ভি পি সিংকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করা হয়?

A) ১৯৮৪ সালে 

B) ১৯৮৭ সালে

C) ১৯৮৯ সালে ✔

D) ১৯৯১ সালে

70. সংসদীয় কর্মপদ্ধতি-সংক্রান্ত নিয়মাবলির উদ্ভব কোন্ দেশে হয়?

A) ব্রিটেনে ✔

B) আমেরিকায় 

C) ভারতে

D) ফ্রান্সে

71. ‘রবার্টস্ রুল্স অব অর্ডার’ কত সালে লিপিবদ্ধ হয়?

A) ১৮৭৫ সালে 

B) ১৮৭৬ সালে ✔

C) ১৮৭৭ সালে

D) ১৮৭৮ সালে

72. ‘রাষ্ট্রপতিসহ সংসদ’ কথাটির অর্থ হল-

A) রাষ্ট্রপতিসহ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা

B) রাষ্ট্রপতিসহ লোকসভা

C) রাষ্ট্রপতিসহ লোকসভা ও রাজ্যসভা ✔

D) রাষ্ট্রপতিসহ রাজ্যসভা

73. ভারতের রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচিত করেন-

A)  জনগণ

B)  সংসদ সদস্যবৃন্দ

C)  রাজ্যের আইনসভার সদস্যবৃন্দ

D)  সংসদের উভয়কক্ষের নির্বাচিত সদস্যবৃন্দ এবং রাজ্য বিধানসভার নির্বাচিত সদস্যবৃন্দ✔

74. ভারতের উপরাষ্ট্রপতি হলেন-

A)  রাজ্যসভার সভাপতি ✔

B)  কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভারপ্রধান

C)  কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার সদস্য

 D) লোকসভার অধ্যক্ষ

75 . লোকসভার স্পিকারকে নির্বাচিত করেন-

A)  লোকসভার নির্বাচিত সদস্যগণ ✔

B)  সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি

C)  প্রধানমন্ত্রী

D)  রাষ্ট্রপতি

76. সংসদের উভয়কক্ষের যৌথ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন- 

A) উপরাষ্ট্রপতি 

B) স্পিকার ✔

C) রাজ্যপাল 

D) রাষ্ট্রপতি

77. সংসদের উভয়কক্ষের যৌথ অধিবেশন আহ্বান করেন- 

A) রাষ্ট্রপতি ✔

B) স্পিকার 

C) উপরাষ্ট্রপতি 

D) প্রধানমন্ত্রী

78. রাজ্যসভার অঙ্গরাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল থেকে নির্বাচিত হতে পারেন অনধিক-

A) ২৩০ জন

B) ২৩৩ জন

C) ২৩৮ জন ✔

D) ২৪৫ জন

79. প্রতি দু-বছর 13   অংশ সদস্য অবসর গ্রহণ করেন- 

A) লোকসভা থেকে

B) রাজ্যসভা থেকে ✔

C) বিধানসভা থেকে

D) বিধান পরিষদ থেকে

৪০. লোকসভার সচিবালয়ের প্রধান হলেন-

A) স্পিকার ✔

B) প্রধানমন্ত্রী

C) রাষ্ট্রপতি 

D) উপরাষ্ট্রপতি

81 . লোকসভায় নির্ণায়ক ভোট প্রদান করার ক্ষমতা রয়েছে-

A)  স্পিকারের ✔

B)  রাষ্ট্রপতির

C)  প্রধানমন্ত্রীর

D)  উপরাষ্ট্রপতির

82. ভারতে কেন্দ্রীয় তালিকাভুক্ত বিষয়ে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা অর্পণ কর হয়েছে- 

A) লোকসভা ও রাজ্যসভার হাতে ✔

B) লোকসভার হাতে

C) বিধানসভা ও বিধান পরিষদের হাতে

D) রাষ্ট্রপতির হাতে

83. My Presidential Years গ্রন্থটির রচয়িতা হলেন-

A) হিদায়েতুল্লা

B) রাধাকৃষ্ণাণ

C) রামস্বামী ভেঙ্কটরমন ✔

D) সঞ্জীব রেড্ডি

84. ভারতীয় পার্লামেন্টের জনপ্রতিনিধিকক্ষের নাম হল-

A)  রাজ্যসভা

B)  বিধানসভা

C)  বিধান পরিষদ 

D)  লোকসভা ✔

85. লোকসভার স্পিকারকে পদচ্যুত করতে হলে প্রস্তাব আকারে নোটি দিতে হয়-

A)  ৭ দিন আগে

B) ১৪ দিন আগে ✔

C)  ২০ দিন আগে

D)  ১ মাস আগে

86. কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা তার কাজকর্মের মধ্যে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী থাকে-

A) লোকসভার কাছে ✔

B) রাজ্যসভার কাছে

C) রাষ্ট্রপতির কাছে

D) স্পিকারের কাছে

87. লোকসভা বা বিধানসভায় অধ্যক্ষের অনুপস্থিতিতে সভাপত্যি করেন-

A)  স্পিকার

B) ডেপুটি স্পিকার ✔

C) চেয়ারম্যান

D) সভার নেতা

৪৪. যুগ্ম তালিকাভুক্ত বিষয়ে আইনপ্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে-

A) কেন্দ্রীয় আইনসভার হাতে

B) রাজ্য আইনসভার হাতে

C) কেন্দ্র ও রাজ্য আইনসভার হাতে ✔

D) রাষ্ট্রপতির হাতে

89. অর্থ বিলের উল্লেখ রয়েছে সংবিধানের-

A) ১০৮ নং ধারায়

B) ১১০ ধং ধারায় ✔

C) ১২০ নং ধারায়

D) ১২১ নং ধারায়

90. ২০০১ খ্রিস্টাব্দে যে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে লোকসভার সদস সংখ্যা ২০২৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অনধিক ৫৫২-এর মধ্যে সীমিত রাখ হয়েছে, তা হল-

A) ৮০ তম 

B) ৮২ তম

C) ৮৪ তম ✔

D) ৮৬ তম

91. সংবিধানের ১২০নং ধারা অনুযায়ী পার্লামেন্টে ব্যবহার্য ভাষা হল-

A) বাংলা ও হিন্দি

B)  হিন্দি ও ইংরেজি ✔

C) সংস্কৃত ও হিন্দি

D) সংস্কৃত ও ইংরেজি

92. লোকসভার প্রথম স্পিকার ছিলেন-

A) মীরা কুমার

B) সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়

C) পি এ সাংমা

D) জি ভি মভলঙ্কর ✔

93. ‘Hung Parliament’ বা ‘ত্রিশঙ্কু পার্লামেন্ট’ বলতে বোঝায়- 

A)  সংসদে যখন শুধুমাত্র একটি দলের একক সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকে

B)  সংসদে যখন একাধিক দল জোটবদ্ধ হয়ে সরকার গঠন করে

C)  সংসদে যখন কোনো দলেরই সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে না ✔

D)  কোনোটিই নয়

94. অধ্যক্ষ বা স্পিকার ভোটাভুটির অংশগ্রহণ করে নির্ণায়ক ভোট কাস্টিং ভোট’ দেন-

A)  যখন পক্ষে-বিপক্ষে সমান সংখ্যক ভোট পড়ে অচলাবস্থা দেখা দেয় ✔

B)  যখন কোনো সদস্যকে বহিষ্কার করা হয়

C)  যখন কোনো বিল পাস করা হয়

D)  যখন অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে ভোট হয়

 95. ভারতের কেন্দ্রীয় আইনসভাকে বলা হয়ー

A) পার্লামেন্ট ✔

B) সিনেট

C) জাতীয় সভা

D) জাতীয় কক্ষ

96. পার্লামেন্ট প্রণীত আইন অসাংবিধানিক হলে বাতিল করতে পারেন-

A) রাষ্ট্রপতি

B) প্রধানমন্ত্রী

C) উপরাষ্ট্রপতি

D) সুপ্রিমকোর্ট ✔

97. যে বিলে রাষ্ট্রপতি বা রাজ্যপাল স্বাক্ষর দিতে বাধ্য থাকেন, তা হল-

A) অর্থ বিল ✔

B) সাধারণ বিল

C) অন্যান্য বিল

D) অর্থ সংক্রান্ত অন্যান্য বিল

98. উপরাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করার প্রস্তাব এককভাবে গ্রহণ করতে পারে- 

A) রাজ্যসভা ✔

B) লোকসভা

C) রাষ্ট্রপতি

D) সুপ্রিমকোর্ট

99. ভারতের পার্লামেন্ট গঠিত হয়-

A) শুধুমাত্র লোকসভা নিয়ে

B) শুধুমাত্র রাজ্যসভা ও লোকসভা নিয়ে

C)  লোকসভা ও রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে

D) লোকসভা, রাজ্যপাল ও রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে ✔

100. ভারতের অবশিষ্ট বিষয়ে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা অর্পিত হয়েছে-

A) পার্লামেন্টের হাতে

B) রাজ্য আইনসভারগুলির হাতে

C) পার্লামেন্ট ও রাজ্য আইনসভাগুলির হাতে ✔

D) কেবল লোকসভার হাতে

101. কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে হাইকোর্ট স্থাপন করতে কিংবা কোনো একটি অধস্তন আদালতকে হাইকোর্টের মর্যাদায় উন্নীত করতে পারে-

A) লোকসভা

B) রাজ্যসভা

C) রাষ্ট্রপতি

D) পার্লামেন্ট ✔

102. ভারতে নতুন রাজ্য গঠনের ক্ষমতা রয়েছে শুধুমাত্র-

A) লোকসভার

B) শুধুমাত্র রাজ্যসভার

C) পার্লামেন্টের ✔

D) রাষ্ট্রপতির

103. সংবিধানের ‘মৌলকাঠামো’ অপরিবর্তিত রেখে পার্লামেন্ট সংবিধানের যে-কোনো অংশ সংশোধন করতে পারে, বলে সুপ্রিমকোর্ট রায় দিয়েছিল-

A) এ কে গোপালন মামলায় (১৯৫০)

B) কেশবানন্দ ভারতী মামলায় (১৯৭৩) ✔

C) মানেকা গান্ধি মামলায় (১৯৭৮)

D) মিনার্ভা মিলস মামলায় (১৯৮০)

104. কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভাকে পদত্যাগ করতে হয়-

A) রাষ্ট্রপতির আস্থা হারালে

B) জনগণের আস্থা হারালে

C) রাজ্যসভার আস্থা হারালে

D) লোকসভার আস্থা হারালে ✔

105. যে-কোনো ধরনের জরুরি অবস্থার ঘোষণাকে অবশ্যই অনুমোদিত হতে হয়-

A) কেবল লোকসভায়

B) কেবল রাজ্যসভায়

C) লোকসভা, রাজ্যসভা ও রাজ্য বিধানসভায়

D) লোকসভা ও রাজ্যসভায় ✔

106. লোকসভার সদস্যদের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে সুষ্ঠুভাবে সভার কাজ পরিচালনা করার দায়িত্ব রয়েছে-

A) রাষ্ট্রপতির

B) প্রধানমন্ত্রীর

C) বিরোধী দলনেতা বা নেত্রীর

D) অধ্যক্ষের ✔

107. লোকসভার বর্তমান (২০১৫) স্পিকারের নাম-

A) সুমিত্রা মহাজন ✔

B) মীরা কুমার

C) বালাযোগী

D) গিরিধারী গোমাঙ্গী

108. “লোকসভার অধ্যক্ষের সঙ্গে রাজনীতির সংস্পর্শ ত্যাগ করার কোনে প্রয়োজনীয়তা নেই”-মন্তব্যটি করেছেন-

A)  জি ভি মভলঙ্কর ✔

B)  সঞ্জীব রেড্ডি

C)  সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়

D) পি এ সাংমা

109. কেন্দ্রীয় সরকার লোকসভায় আস্থা হারিয়েছে কি না সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কক্ষের নিয়মানুযায়ী যে প্রস্তাব উত্থাপনের ব্যবস্থা করা হয়, তাকে বলে-

A) ছাঁটাই প্রস্তাব

B) মুলতুবি প্রস্তাব

C) অনাস্থা প্রস্তাব ✔

D) দৃষ্টি-আকর্ষণী প্রস্তাব

110. ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের নাম হল-

A) লর্ডসভা

B) কমন্স সভা ✔

C) সেনেট

D) লোকসভা

111. কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা দায়িত্বশীল থাকে-

A) পার্লামেন্টের কাছে

B) লোকসভার কাছে ✔

C)  রাজ্যসভার কাছে

D) সুপ্রিমকোর্টের কাছে

112. রাষ্ট্রপতি কর্তৃক লোকসভায় কতজন সদস্য মনোনীত হন?

A) ২ জন ✔

B) ৩ জন

C) ৪ জন

D) ৫  জন

113. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভার নিম্ন কক্ষের নাম হল-

A) জনপ্রতিনিধি সভা ✔

B) লোকসভা

C) বিধানসভা

D) সিনেট

114. পার্লামেন্টের যৌথ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন-

A) রাষ্ট্রপতি

B) প্রধানমন্ত্রী

C) লোকসভার স্পিকার ✔

D)  উপরাষ্ট্রপতি

115. ভারতের লোকসভার অধ্যক্ষ নির্বাচিত হন-

A)  রাষ্ট্রপতির দ্বারা

B)  প্রধানমন্ত্রীর দ্বারা

C)  লোকসভার সদস্যদের দ্বারা ✔

D)  লোকসভা ও রাজ্যসভার সদস্যদের দ্বারা

116.রাজ্যসভার সভাপতি হলেন-

A) প্রধানমন্ত্রী

B) অধ্যক্ষ

C) উপরাষ্ট্রপতি ✔

D) রাষ্ট্রপতি

117. অর্থ বিল প্রথম উপস্থাপিত হয়-

A) লোকসভায় ✔

B) রাজ্যসভায়

C) সুপ্রিমকোর্টে

D) হাইকোর্টে

118. রাজ্যসভার সদস্যদের কার্যকাল হল-

A) ৪ বছর

B) ৫ বছর

C) ৬ বছর ✔

D) ৭ বছর

119. কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন-

A)  রাষ্ট্রপতি

B)  প্রধানমন্ত্রী ✔

C)  ক্যাবিনেট সচিব

D)  স্পিকার

120. রাজ্য আইনসভার উচ্চকক্ষ হল-

A)  লোকসভা

B)  বিধান পরিষদ ✔

C)  রাজ্যসভা

D)  বিধানসভা

121. রাজ্য আইনসভার নিম্নকক্ষ হল-

A) বিধানসভা ✔

B) লোকসভা

C) রাজ্যসভা

D) বিধান পরিষদ

122. বিধানসভার নেতা হলেন-

A) প্রধানমন্ত্রী

B) মুখ্যমন্ত্রী ✔

C) রাষ্ট্রপতি

D) রাজ্যপাল

123. বিধানসভার যিনি সভা চালান, তাঁকে বলা হয়-

A)  স্পিকার ✔

B) সভাপতি

C) চেয়ারম্যান

D) চেয়ারপার্সন

124. বিধানসভার সদস্য হওয়ার জন্য পদপ্রার্থীর ন্যূনতম বয়স হল-

A) ১৮ বছর

B) ২০ বছর

C) ২৫ বছর ✔

D) ৩০ বছর

125.অঙ্গরাজ্যের বিধানসভার সর্বাধিক সদস্যসংখ্যা হল

A)  ৩০০ জন

B)  ৪০০ জন

C) ৫০০ জন ✔

D) ৫৫০ জন

126. বিধানসভার অধিবেশন আহ্বান করেন-

A) রাজ্যপাল

B) মুখ্যমন্ত্রী

C)  স্পিকার

D)  মুখ্যসচিব ✔

127. পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় নির্বাচিত মোট সদস্য হল-

A) ২৯৪ ✔

B) ১৮০

C) ১৬০

D) ২৯৫

128. সাধারণত ১ বছরে যতবার বিধানসভার অধিবেশন ডাকতে হয়-

A) ২ বার ✔

B) ৩ বার

C) ৪ বার

D) ৫ বার

129. পশ্চিমবঙ্গের আইনসভার দ্বিতীয় কক্ষ বিলুপ্ত হয়-

A)  ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে

B)  ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে

C)  ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে ✔

D)  ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে

130. বিধানসভায় রাজ্যপাল যতজন ইঙ্গ-ভারতীয় সদস্য নিয়োগ করেন-

A) ১ জন ✔

B) ২ জন

C) ৩ জন

D) ৪ জন

131. রাজ্য মন্ত্রীসভার বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন-

A) রাজ্যপাল

B) স্পিকার

C) মুখ্যমন্ত্রী ✔

D) মুখ্যসচিব

132. বিধানসভার বিভিন্ন কমিটির সভাপতিরা নিযুক্ত হন-

A) স্পিকারের দ্বারা ✔

B) রাজ্যপালের দ্বারা

C) মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারা

D) মুখ্যসচিবের দ্বারা

133. বিধানসভা কর্তৃক গৃহীত বিল বিধান পরিষদ আটকে রাখতে পারে-

A)  ৭ দিন পর্যন্ত

B)  ১২ দিন পর্যন্ত

C)  ১৪ দিন পর্যন্ত ✔

D)  ১৫ দিন পর্যন্ত

134. সংবিধানের কত নম্বর ধারা অনুযায়ী প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের একটি করে আইনসভা রয়েছে?

A) ১৬০ নং

B) ১৬৭ নং

C) ১৬৮(১) নং ✔

D) ১৮০ (১) নং

135. নিম্নলিখিত কোন্ রাজ্যের আইনসভা এককক্ষবিশিষ্ট?

A) পাঞ্জাব ✔

B) বিহার

C) মহারাষ্ট্র

D) কর্ণাটক

136. বর্তমানে ভারতের ক-টি রাজ্যের আইনসভা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট?

A) ৪টি

B) ৫টি

C) ৬টি

D) ৭টি ✔

137. লোকসভায় অঙ্গরাজ্যগুলির প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে বৃহত্তম রাজ্য উত্তরপ্রদেশের আসন সংখ্যা-

A) ৬০

B) ৭০

C) ৮০ ✔

D) ৯০

138. সংবিধান অনুযায়ী রাজ্য বিধানসভার সর্বনিম্ন সদস্যসংখ্যা কত হতে পারে?

A) ৬০ জন ✔

B) ৬৫ জন

C) ৮০ জন

D) ৯০ জন

139. ভারতীয় সংবিধানের কত নং ধারাতে রাজ্য আইনসভার সর্বাধিক ও সর্বনিম্ন সদস্যসংখ্যা কত হতে পারে তার উল্লেখ আছে?

A) ১৬৮ নং ধারা

B) ১৬৯ নং ধারা

C) ১৭০ নং ধারা ✔

D) ১৭১ নং ধারা

140. ভারতীয় সংবিধানের কততম সংশোধন অনুযায়ী ২০২৬ সাল পর্যন্ত রাজ্য বিধানসভার সদস্যসংখ্যা অপরিবর্তিত থাকবে?

A) ৮১তম

B) ৮২তম

C) ৮৩তম

D) ৮৪তম ✔

141. ভারতীয় সংবিধানের ৮৪তম সংশোধনের মাধ্যমে কত সাল পর্যন্ত বিধানসভাগুলির সদস্যসংখ্যা অপরিবর্তিত রাখার কথা বলা হয়েছে?

A) ২০২৫ সাল

B) ২০২৬ সাল

C) ২০২৭ সাল

D) ২০২৮ সাল

142. ভারতীয় সংবিধানের কততম সংশোধন অনুযায়ী ২০২০ সালের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বিধানসভা নির্বাচনে তপশিলি জাতি ও উপজাতির জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে?

A) ৯৩ তম

B) ৯৪ তম

C) ৯৫ তম ✔

D) ৯৬ তম

2. Long Question Answer

প্রশ্ন 1. ভারতীয় পার্লামেন্টের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতাগুলি আলোচনা করো।

অথবা, ভারতের পার্লামেন্টের কার্যাবলি আলোচনা করো।

অথবা, ভারতীয় পার্লামেন্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনা করো।

অথবা, ভারতের আইনবিভাগের ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনা করো। 

অথবা, ভারতীয় পার্লামেন্টের গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনা করো।

উত্তর: সংসদ বা পার্লামেন্টের গঠন

ভারতের কেন্দ্রীয় আইনসভা পার্লামেন্ট বা সংসদ নামে অভিহিত। সংবিধানের পঞ্চম অংশে এ কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ভারতের পার্লামেন্ট রাষ্ট্রপতি ও দুটি কক্ষ নিয়ে গঠিত। পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভা (Council of States) এবং নিম্নকক্ষ লোকসভা (House of the People)-রূপে পরিচিত।

[1] রাজ্যসভার গঠন: পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভা অনধিক ২৫০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হয়। এদের মধ্যে ১২ জন সাহিত্য, বিজ্ঞান, সমাজসেবা, চারুকলা প্রভৃতি ক্ষেত্র থেকে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত হন। অন্য সদস্যরা রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলি থেকে পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হন। বর্তমানে রাজ্যসভার সদস্যসংখ্যা ২৪৫। রাজ্যগুলির বিধানসভার নির্বাচিত প্রতিনিধিরা একক হস্তান্তরযোগ্য ভোটের ভিত্তিতে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের নিয়মানুযায়ী রাজ্যসভার সদস্যদের নির্বাচন করেন। কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ক্ষেত্রে একটি নির্বাচক সংস্থা (Electoral College) রাজ্যসভার প্রতিনিধিদের নির্বাচন করেন। পদাধিকার বলে ভারতের উপরাষ্ট্রপতি রাজ্যসভার সভাপতি বা চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত হন। উপরাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে রাজ্যসভার সহসভাপতি সভার কাজ পরিচালনা করেন।

[2] লোকসভার গঠন: লোকসভা হল পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ। সংবিধান অনুসারে, লোকসভা অনধিক ৫৫২ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হতে পারে। লোকসভার সদস্যদের মধ্যে অঙ্গরাজ্যগুলির নির্বাচিত প্রতিনিধি, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির নির্বাচিত প্রতিনিধি, জাতীয় রাজধানী অঞ্চল দিল্লির নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং রাষ্ট্রপতির মনোনীত প্রতিনিধি থাকেন। সংবিধান অনুযায়ী ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলি থেকে অনধিক ৫৩০ জন নির্বাচিত প্রতিনিধি, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ও জাতীয় রাজধানী অঞ্চল থেকে অনধিক ২০ জন নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং রাষ্ট্রপতির মনোনীত দুজন ইঙ্গ-ভারতীয় সদস্যকে নিয়ে লোকসভা গঠিত। বর্তমানে লোকসভার মোট সদস্যসংখ্যা ৫৪৫। লোকসভার প্রথম অধিবেশনে সদস্যরা নিজেদের মধ্যে থেকে একজনকে স্পিকার ও একজনকে ডেপুটি স্পিকার হিসেবে নির্বাচন করেন। লোকসভার কাজকর্ম পরিচালনা করেন স্পিকার বা অধ্যক্ষ।

সংসদের ক্ষমতা ও কার্যাবলি

ভারতে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ার ফলে তত্ত্বগতভাবে সংসদ প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী। ভারতীয় সংসদের উল্লেখযোগ্য ক্ষমতা ও কাজগুলি হল-

[1] আইন প্রণয়ন: সংসদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল আইন প্রণয়ণ করা। যেসব বিষয়ে সংসদের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা আছে, সেগুলি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হল।

i. কেন্দ্রীয় তালিকাভুক্ত বিষয়ে: সংবিধানের সপ্তম তপশিলে বর্ণিত আইন প্রণয়নের যে তিনটি তালিকা রয়েছে তার মধ্যে কেন্দ্রীয় তালিকায়। ৯৯টি বিষয়ে সংসদ এককভাবে আইন প্রণয়ন করতে পারে।

ⅱ. যুগ্ম-তালিকাভুক্ত বিষয়ে: যুগ্ম তালিকাভুক্ত ৫২টি বিষয়ে সংসদ বাঙ আইনসভাগুলির সঙ্গে যৌথভাবে আইন প্রণয়ন করতে পারে। এই যা তালিকাভুক্ত বিষয়ে সংসদ প্রণীত আইনের সঙ্গে রাজ্য অহিনসভ আইনের বিরোধ ঘটলে সংসদ প্রণীত আইনই বলবৎ থাকে, রাজ্য আধু বাতিল বলে গণ্য হয়।

iii. রাজ্য-তালিকাভুক্ত বিষয়ে: পার্লামেন্ট কয়েকটি ক্ষেত্রে রাজ তালিকাভুক্ত ৬১টি বিষয়েও আইন প্রণয়নের অধিকারী। ① জ্য অবস্থা ঘোষিত হলে বা রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা জারি হয়ে ② রাজ্যসভায় উপস্থিত এবং ভোটদানকারী দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যে ② রাজ্যসহীত প্রস্তাব অনুযায়ী জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে, ও দুই ততোধিক রাজ্য আইনসভা প্রস্তাব গ্রহণ করে সংসদকে তাদের রাজে জানালে, ④ আন্তর্জাতিক সন্ধি বা চক্তির শর্তাদি রূপায়ণ করার জা পার্লামেন্ট রাজ্য-তালিকাভুক্ত বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে পারে।

iv. অবশিষ্ট বিষয়ে: কেন্দ্রীয় তালিকা, রাজ্য-তালিকা বা যুগ্ম-তালিকা অন্তর্ভুক্ত নয়, এমন বিষয়গুলি বা অবশিষ্ট বিষয়গুলির ক্ষেত্রে আদি প্রণয়নের যাবতীয় ক্ষমতা কেন্দ্রীয় আইনসভা বা সংসদকে দেজা হয়েছে।

[2] শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ: সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতি অনুযায়ী পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সদস্যদের নিয়ো মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রীসভা হল দেশে শাসন বিভাগের কর্ণধার। সংবিধান অনুসারে সমগ্র মন্ত্রীসভাকে তার নীতি। কাজকর্মের জন্য পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভার কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হয়। লোকসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থনের ওপর মন্ত্রীসভার স্থায়িত্ব নির্ধা করে। পার্লামেন্ট আরও যেসব উপায়ে শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করে তার মধে রয়েছে রাষ্ট্রপতির ভাষণে উল্লিখিত সরকারি নীতি ও কর্মসূচি নিয়ে তর্কবিতর সরকারের প্রস্তাবিত বাজেটের সমালোচনা, মুলতুবি প্রস্তাব উত্থাপন, দৃষ্ট আকর্ষণী নোটিশ দিয়ে নিন্দাসূচক প্রস্তাব বা সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তার আনা, পার্লামেন্টের বিভিন্ন কমিটির পেশ করা রিপোর্টের ওপর বিতর্ক প্রভৃতি।

[3] আয়ব্যয় নিয়ন্ত্রণ: ভারতের সংবিধানে কেন্দ্রীয় সরকারের আয়ব্যয় নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা পার্লামেন্টকে দেওয়া হয়েছে। এই ক্ষমতা জনগণের প্রত্যঙ্গ ভোটে নির্বাচিত পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভার সদস্যদের দেওয়া হয়েছে অর্থ-সংক্রান্ত বিষয়ে পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার কার্যত কোনো ক্ষমতা এন বললেই চলে। সংবিধানের ২৬৫ এবং ২৬৬ নং ধারা অনুযায়ী, কর আরোপ, র সংগ্রহ বা সরকারের ব্যয়বরাদ্দ পার্লামেন্টের আইন ছাড়া করা যায় না। সরকার আয়ব্যয় ব্যবস্থা পার্লামেন্ট কর্তৃক নির্ধারিত পথে পরিচালিত হচ্ছে কি নার দেখার জন্য লোকসভায় দুটি গরুত্বপূর্ণ কমিটি রয়েছে। সেগুলি হল- সরকারি হিসাব-পরীক্ষা কমিটি (Public Accounts Committee) এবং আনুমানিক ব্যয়-পরীক্ষা কমিটি (Estimates Committee)

[4] নির্বাচন ও অপসারণ: রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে পার্লামেন্টের উভয়কক্ষের নির্বাচিত সদস্যরা অংশ নিয়ে থাকেন। উপরাষ্ট্রপতি লোকসভা ও রাজ্যসভার সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতিকে পার্লামেন্ট সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগে ‘ইমপিচমেন্ট’ পদ্ধতিতে পদচ্যুত করতে পারে। তা ছাড়া সুপ্রিমকোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতি, মুখ্য নির্বাচন কমিশনার, ভারতের বাড় নিয়ন্ত্রক ও মহাগণনা পরীক্ষক প্রমুখকে অযোগ্যতা বা অসদাচরণের অভিযোগে পদচ্যুত করার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করার ক্ষমতাও পার্লামেন্টের রয়েছে।

[5]  সংবিধান সংশোধন: সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে পার্লামেন্টের দুটি কক্ষের সমান ক্ষমতা রয়েছে। সংবিধানের ৩৬৮ নং ধারা অনুযায়ী, কয়েকটি ক্ষেত্রে সাধারণ পদ্ধতিতে এবং কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে গোলামেন্ট সংবিধান সংশোধনের ব্যাপারে একক ক্ষমতা ভোগ করো কয়েকটি নির্দিষ্ট বিষয়ে সংবিধান সংশোধনের জন্য অঙ্গরাজ্যগুলির আইনসভার অনুমোদন দরকার হয়।

[6]ভাবি ধরনের বুরি ঘাষণা অনুমোদন: ভারতের রাষ্ট্রপতি কর্তৃক জাতীয় জন্মরির রাষ্ট্রপতি সাংবিধানিক অচলাবস্থাজনিত জরুরি অবস্থা এবং আর্থিক জরুরি অবস্থার ঘোষণা পার্লামেন্টের দুটি কক্ষে অনুমোদিত হতে হয়; তা না হলে জরুরি অবস্থার ঘোষণা বাতিল বলে গণ্য হয়।

[7] তথ্য সরবরাহ ও জনমত গঠন: সরকারি নীতি ও কাজকর্ম সম্পর্কে পার্লামেন্টে যেসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করা হয় তার ফলে জনগণ বিভিন্ন বিষয়ে অবহিত হওয়ার সুযোগ পান। পার্লামেন্টের সদস্যরা সভায় বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা ও বিতর্কে অংশগ্রহণ করে সুষ্ঠু জনমত গঠনে সচেষ্ট হন। বর্তমানে দূরদর্শন পার্লামেন্টের অধিবেশন সরাসরি সম্প্রচার করে থাকে। এ ছাড়া সংবাদপত্রে ও অন্যান্য গণমাধ্যমে এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় যার ফলে শক্তিশালী জনমত গঠিত হয়।

[৪] বিচার-সংক্রান্ত ক্ষমতা: পার্লামেন্টের কিছু ক্ষেত্রে বিচারবিষয়ক ক্ষমতাও রয়েছে। পার্লামেন্ট কোনো আদালতকে হাইকোর্টের পর্যায়ে উন্নীত করতে পারে। কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে হাইকোর্ট স্থাপন করা অথবা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে অবস্থিত হাইকোর্টের ক্ষমতা বৃদ্ধি করার ব্যাপারেও পার্লামেন্ট কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারে। পার্লামেন্টের অবমাননা বা অধিকার ভঙ্গের অভিযোগে পার্লামেন্টের সদস্য অথবা সদস্য নন এমন যে-কোনো ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা পার্লামেন্টের রয়েছে।

[9] অন্যান্য ক্ষমতা: উপরে উল্লেখ করা ক্ষমতাগুলি ছাড়াও সংসদের আরও কয়েকটি ক্ষমতা রয়েছে। এগুলি হল-

i. সংবিধানের ২ এবং ৩ নং ধারা অনুসারে পার্লামেন্ট আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নতুন রাজ্য গঠন করতে পারে বা প্রয়োজন হলে কোনো রাজ্যের পুনর্গঠন করতে পারে।

ii. রাজ্যের সীমানার হ্রাসবৃদ্ধি বা নাম পরিবর্তনের ক্ষমতাও পার্লামেন্টের রয়েছে।

iii. পার্লামেন্ট কোনো রাজ্য আইনসভার দ্বিতীয় কক্ষের প্রবর্তন বা বিলোপসাধন করতে পারে।

iv. পার্লামেন্ট সর্বভারতীয় চাকরির ক্ষেত্রে বসবাসগত যোগ্যতার শর্ত নির্ধারণ করার অধিকারী।

উপসংহার: উপরোক্ত আলোচনার শেষে এটা স্পষ্ট যে, ভারতের পার্লামেন্ট এক প্রভূত ক্ষমতাসম্পন্ন আইনসভা। তবে পার্লামেন্টের এসব ক্ষমতা ও কাজকর্মকে বাস্তবে নিয়ন্ত্রণ করে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা তথা কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেট।

প্রশ্ন 2. রাজ্যসভার গঠন এবং ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনা করো।

উত্তর: রাজ্যসভার গঠন

ভারতের কেন্দ্রীয় আইনসভার উচ্চকক্ষ হল রাজ্যসভা। সংবিধানের ৮০ নং খরা অনুযায়ী, অনধিক ২৫০ জন সদস্য নিয়ে রাজ্যসভা গঠিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় সাধারণত অইনসভার উচ্চকক্ষ রাজ্যগুলির সমপ্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে গঠিত হয়। ভারতে এই নীতিটি স্বীকৃত হয়নি। এখানে রাজ্যের জনসংখ্যার ভিত্তিতে রাজ্যসভার আসনসংখ্যা নির্দিষ্ট করা হয়েছে। বর্তমানে বাজ্যসভার মোট সদস্যসংখ্যা হল ২৪৫। এদের মধ্যে ১২ জন সদস্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত। সাহিত্য, বিজ্ঞান, চারুকলা, সমাজসেবা ইত্যাদি ক্ষেত্রে কৃতী ব্যক্তিদের মধ্যে থেকে রাষ্ট্রপতি এই ১২ জন সদস্যকে মনোনীত করেন। সাধারণত প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি এই মনোনয়ন করে থাকেন। অবশিষ্ট সদস্যরা ভারতের বিভিন্ন রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলি থেকে নির্বাচিত। হন। সংবিধানের ৮০(৪) নং ধারা অনুযায়ী এই নির্বাচন ব্যবস্থা একক হস্তান্তরযোগ্য ভোটের ভিত্তিতে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের নিয়মানুযায়ী পরিচালিত হয়। অঙ্গরাজ্যের ক্ষেত্রে বিধানসভার নির্বাচিত সদস্যরা এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ক্ষেত্রে পার্লামেন্ট প্রণীত আইন অনুযায়ী গঠিত নির্বাচক সংস্থার প্রতিনিধিরা রাজ্যসভার সদস্যদের নির্বাচন করেন।

রাজ্যসভা একটি স্থায়ী সভা হিসেবে বিবেচিত হয়। রাজ্যসভার সদস্যদের কার্যকাল ৬ বছর। প্রতি দু-বছর অন্তর এক-তৃতীয়াংশ সদস্যের কার্যকাল শেষ হয়, তারপর শূন্য পদগুলিতে নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়।

পদাধিকার বলে ভারতের উপরাষ্ট্রপতি হলেন রাজ্যসভার সভাপতি। তিনি রাজ্যসভার অধিবেশনগুলিতে সভাপতিত্ব করেন। রাজ্যসভার সহসভাপতি বা ডেপুটি চেয়ারম্যান সভার সদস্যদের মধ্যে থেকে নির্বাচিত হন। সংবিধান অনুসারে রাজ্যসভার কোরাম বা ন্যূনতম সদস্যের উপস্থিতির হার বর্তমানে মোট সদস্যসংখ্যার এক-দশমাংশ।

রাজ্যসডার ক্ষমতা ও কার্যাবলি

রাজ্যসভার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা ও কার্যাবলি হল-

[1] আইন প্রণয়ন: পার্লামেন্টে সাধারণ বিল পাসের ব্যাপারে রাজ্যসভার প্রয়োজনীয় ক্ষমতা রয়েছে। রাজ্যসভা যে-কোনো সাধারণ বিল উত্থাপন করতে পারে। রাজ্যসভার অনুমোদন ছাড়া কোনো সাধারণ বিল পার্লামেন্টে পাস হয় না। কোনো বিল নিয়ে রাজ্যসভা ও লোকসভার মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিলে রাষ্ট্রপতি উভয়কক্ষের যৌথ অধিবেশন আহ্বান করেন।

অর্থ বিলের ব্যাপারে রাজ্যসভার কোনো প্রকৃত ক্ষমতা নেই। কোনো অর্থ বিল প্রত্যাখ্যান করা বা সংশোধন করার ক্ষমতা রাজ্যসভার নেই। রাজ্যসভায় অর্থ বিল পাঠানো হয় শুধুমাত্র অনুমোদনের জন্য। রাজ্যসভাকে ১৪ দিনের মধ্যে অর্থ বিল সম্পর্কে তার মতামত জানাতে হয়।

[2] সংবিধান সংশোধন: রাজ্যসভার হাতে সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতাও রয়েছে। তবে এই ক্ষমতা রাজ্যসভা যৌথভাবে লোকসভার সঙ্গে ভোগ করে থাকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ৪৪তম সংবিধান সংশোধনী বিলের পাঁচটি ধারা রাজ্যসভার অনুমতির অভাবে বাতিল হয়ে যায়।

[3] নির্বাচন ও অপসারণ: রাষ্ট্রপতির নির্বাচন ও পদচ্যুতির বিষয়ে এবং উপরাষ্ট্রপতির নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাজ্যসভার সাংবিধানিক ক্ষমতা রয়েছে। এই ক্ষমতা রাজ্যসভা যৌথভাবে লোকসভার সঙ্গে ভোগ করে থাকে। তবে উপরাষ্ট্রপতির পদচ্যুতি-সংক্রান্ত প্রস্তাব উত্থাপনের বিষয়ে রাজ্যসভা একক ক্ষমতার অধিকারী। এ ছাড়া সুপ্রিমকোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতি, মুখ্য নির্বাচন কমিশনার, নিয়ন্ত্রক ও মহাগণনা পরীক্ষক প্রমুখ পদাধিকারীদের অপসারণের ক্ষেত্রেও রাজ্যসভার প্রয়োজনীয় ক্ষমতা রয়েছে।

[4] রাজ্য-তালিকাভুক্ত বিষয়ে আইন প্রণয়নের প্রস্তাব উত্থাপন: রাজ্যসভার উপস্থিত ও ভোটদানকারী সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ যদি প্রস্তাব গ্রহণ করে যে, জাতীয় স্বার্থে রাজ্য-তালিকার কোনো বিষয়ে পার্লামেন্টের আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন, তাহলে পার্লামেন্ট সে-বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে পারে।

[5] সর্বভারতীয় কৃত্যক গঠনের প্রস্তাব উত্থাপন: রাজ্যসভায় উপস্থিত ও ভোটদানকারী সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থনে যদি এরূপ প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় যে, জাতীয় স্বার্থে পার্লামেন্টের এক বা একাধিক সর্বভারতীয় কৃত্যক (All India Services) গঠন করা দরকার, তাহলে পার্লামেন্ট সে-বিষয়ে আইন প্রণয়ন করার অধিকারী হতে পারে।

[6] অন্যান্য ক্ষমতা: অন্যান্য যেসব বিষয়ে রাজ্যসভা ক্ষমতা ভোগ করে, সেগুলি হল রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ঘোষিত জরুরি অবস্থা অনুমোদন, অঙ্গ-রাজ্যের নাম ও সীমানা পরিবর্তন, অঙ্গরাজ্যে বিধান পরিষদ সৃষ্টি বা বিলোপ, হাইকোর্টের এক্তিয়ার বৃদ্ধি প্রভৃতি।

উপসংহার: রাজ্যসভার ক্ষমতার পর্যালোচনা করতে গিয়ে কে ভি রাও বলেন, রাজ্যসভার গঠনপ্রকৃতি পক্ষপাতদুষ্ট। এই কারণে রাজ্যসভা কখনও কার্যকর ভূমিকা নিতে পারেনি। সমালোচকদের মতে, এর ফলে ভারতে যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতি লঙ্ঘিত হয়েছে। অঙ্গরাজ্যগুলির সমপ্রতিনিধিত্বের নীতি গৃহীত না হওয়ায় জনবহুল রাজ্যের প্রতিনিধিরা সংখ্যাধিক্যের জোরে বিশেষ প্রাধান্য ভোগ করে থাকেন। তা ছাড়া রাজ্যসভার সদস্যদের পরোক্ষ নির্বাচন পদ্ধতিও অগণতান্ত্রিক বলে সমালোচকরা মনে করেন।

প্রশ্ন 3. লোকসভার গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনা করো।

উত্তর: লোকসডার গঠন

ভারতীয় পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভা জনগণের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে গঠিত হয়। এই কারণে লোকসভাকে জনপ্রতিনিধি কক্ষ (Pop- ular House) বলে অভিহিত করা হয়। লোকসভা সর্বাধিক ৫৫২ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হয়। তার মধ্যে নির্বাচিত সদস্যসংখ্যা অনধিক ৫৫০ জন এবং ২ জন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত সদস্য। বর্তমানে অঙ্গরাজ্যগুলি থেকে ৫৩০ জন, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলি থেকে ১৩ জন এবং রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত দুজন ইঙ্গ-ভারতীয় সদস্যকে নিয়ে সর্বমোট ৫৪৫ জন সদস্য লোকসভায় রয়েছেন।

লোকসভার কার্যকালের মেয়াদ পাঁচ বছর। রাষ্ট্রপতি লোকসভার অধিবেশন আহ্বান করে থাকেন। লোকসভার প্রথম অধিবেশনে সদস্যরা নিজেদের মধ্যে থেকে একজনকে অধ্যক্ষ (Speaker) এবং একজনকে উপাধ্যক্ষ (Deputy Speaker) নির্বাচন করেন।

লোকসডার ক্ষমতা ও কার্যাবলি

লোকসভার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা ও কার্যাবলি হল-

[1] আইন প্রণয়ন: আইনসভার জনপ্রতিনিধি কক্ষরূপে লোকসভার প্রধান কাজ হল আইন প্রণয়ন। সাধারণ বিল উত্থাপন ও অনুমোদনের ক্ষেত্রে লোকসভার প্রয়োজনীয় ক্ষমতা রয়েছে। সাধারণ বিলের বিষয়ে কিছু ক্ষেত্রে রাজ্যসভার তুলনায় লোকসভার প্রাধান্য দেখা যায়।

[2] অর্থ-সংক্রান্ত ক্ষমতা: অর্থ বিলের ব্যাপারে লোকসভা অনন্য ক্ষমতার অধিকারীরূপে গণ্য। অর্থ বিল একমাত্র লোকসভাতেই উত্থাপিত হতে পারে। তা ছাড়া কোনো বিল অর্থ বিল কি না, সে বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিলে লোকসভার অধ্যক্ষের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। কোনো অর্থ বিল প্রত্যাখ্যান বা সংশোধন করার ক্ষমতা পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভাকে দেওয়া হয়নি। লোকসভায় পাস হওয়া অর্থ বিল সম্পর্কে রাজ্যসভাকে ১৪ দিনের মধ্যে তার মতামত জানাতে হয়। বিলটি এই সময়ের মধ্যে ফেরত না এলে তা গৃহীত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়।

সরকারের আয়ব্যয় নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও লোকসভার কর্তৃত্ব লক্ষ করা যায়। লোকসভার অনুমোদন ছাড়া সরকার কোনো অর্থব্যয়, নতুন কর ধার্য অথবা পুরোনো করের পুনর্বিন্যাস বা বিলোপ ঘটাতে পারে না। এ ছাড়া মঞ্জুরিকৃত অর্থ নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় করা হয়েছে কি না বা সরকারি আয়ব্যয় ব্যবস্থা যথাযথভাবে পরিচালিত হয়েছে কি না, তা দেখার জন্য রাজ্যসভার সঙ্গে যুগ্মভাবে লোকসভা সরকারি হিসাব-পরীক্ষা কমিটি (Public Accounts Commit- tee) এবং আনুমানিক ব্যয়-পরীক্ষা কমিটি (Estimates Committee)র মাধ্যমে তদারক করতে পারে।

[3] মন্ত্রীসভা গঠন ও নিয়ন্ত্রণ: লোকসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সদস্যদের নিয়ে মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। রাষ্ট্রপতি লোকসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের বা জোটের নেতা বা নেত্রীকে মন্ত্রীসভা গঠনের জন্য আহ্বান করেন। সাধারণত লোকসভার

সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা জোট থেকেই প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রীরা নিযুক্ত হন। অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও ঘটতে পারে, যেমন-কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ‘সংযুক্ত প্রগতিশীল জোট’ (UPA)-এর নেতা হিসেবে রাজ্যসভার সদস্য ড. মনমোহন সিং-এর প্রধানমন্ত্রী-পদে নিযুক্তি।

কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা শুধুমাত্র পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভার কাছে দায়বদ্ধ। লোকসভায় মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাস হলে সমগ্র মন্ত্রীসভাকে পদত্যাগ করতে হয়। কাজেই মন্ত্রীসভার স্থায়িত্ব লোকসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থার ওপর নির্ভরশীল।

[4] শাসন বিভাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ: লোকসভার সদস্যদের সরকার বা শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রয়েছে। লোকসভার অধিবেশন চলাকালীন মন্ত্রীদের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা, মুলতুবি প্রস্তাব উত্থাপন, সরকারি নীতি ও কর্মসূচির সমালোচনা, নিন্দাসূচক প্রস্তাব বা অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন, সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদনের মাধ্যমে সরকারি কাজকর্মের মূল্যায়ন প্রভৃতির মাধ্যমে লোকসভার সদস্যরা মন্ত্রীসভা বা শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।

[5] নির্বাচন ও পদচ্যুতি: রাষ্ট্রপতির নির্বাচন ও পদচ্যুতির বিষয়ে এবং উপরাষ্ট্রপতির নির্বাচনের ক্ষেত্রে লোকসভার প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক ক্ষমতা রয়েছে। রাজ্যসভায় উত্থাপিত উপরাষ্ট্রপতির পদচ্যুতি-সংক্রান্ত প্রস্তাব লোকসভায় সম্মতি ছাড়া কার্যকরী হয় না। এ ছাড়া সুপ্রিমকোর্ট এবং হাইকোর্টের বিচারপতি, মুখ্য নির্বাচন কমিশনার, নিয়ন্ত্রক ও মহাগণনা পরীক্ষক প্রমুখ পদাধিকারীকে অপসারণের ক্ষমতাও লোকসভার রয়েছে।

[6] সংবিধান সংশোধন: সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে লোকসভা উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার সঙ্গে সমান ক্ষমতা ভোগ করে। উভয়কক্ষের সম্মতি ছাড়া সংবিধান সংশোধন করা যায় না।

[7] শাস্তি প্রদান: রাজ্যসভার সঙ্গে যুগ্মভাবে লোকসভার কোনো সদস্য বা সদস্য নন এমন ব্যক্তিকে আইনসভার অবমাননা বা অধিকারভঙ্গের অভিযোগে শাস্তি দিতে পারে লোকসভা।

[৪] জরুরি অবস্থার ঘোষণা অনুমোদন: রাষ্ট্রপতি কর্তৃক জাতীয় জরুরি অবস্থা, আর্থিক জরুরি অবস্থা এবং অঙ্গরাজ্যগুলিতে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থাজনিত জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিষয়টি লোকসভার অনুমোদনসাপেক্ষ। ৪৪তম সংবিধান সংশোধনী অনুযায়ী, জাতীয় জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের ব্যাপারে লোকসভা কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করলে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করতে বাধ্য থাকেন।

[9] নতুন রাজ্য গঠন ও রাজ্য পুনর্গঠন: নতুন রাজ্য গঠন, রাজ্য পুনর্গঠন অথবা কোনো রাজ্যের সীমানার হ্রাসবৃদ্ধি, নাম পরিবর্তন ইত্যাদি ক্ষেত্রেও লোকসভা ক্ষমতা ভোগ করে।

[10] অন্যান্য ক্ষমতা: কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে হাইকোর্ট স্থাপন, কেন্দ্রশাসিত

অঞ্চলে হাইকোর্টের ক্ষমতার পরিধি বাড়ানো প্রভৃতি বিষয়ে লোকসভা উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার সঙ্গে যুগ্ম ক্ষমতার অধিকারী। এ ছাড়া রাজ্য আইনসভার উচ্চকক্ষ বিধান পরিষদের প্রবর্তন বা বিলোপসাধন, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বসবাসগত যোগ্যতা নির্ধারণ প্রভৃতি বিষয়ে লোকসভার প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক ক্ষমতা রয়েছে।

উপসংহার: ভারতের সংসদীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। দেশের সংসদীয় গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে লোকসভা এক ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে চলেছে।

প্রশ্ন 4. ভারতের পার্লামেন্টের দুটি কক্ষের মধ্যে সাংবিধানিক সম্পর্ক আলোচনা করো।

অথবা, ভারতীয় সংসদের দুটি কক্ষের সম্পর্ক আলোচনা করো।

অথবা, ভারতের সংসদের রাজ্যসভা ও লোকসভার পারস্পরিক সম্পর্ক ব্যাখ্যা করো।

অথবা, ভারতের সংসদের উভয় কক্ষের পারস্পরিক সম্পর্ক আলোচনা করো।

উত্তর:  রাজ্যসভা ও লোকসভার সাংবিধানিক সম্পর্ক 

ভারতের কেন্দ্রীয় আইনসভা বা পার্লামেন্ট দ্বিকক্ষবিশিষ্ট। এই দুটি কক্ষের মধ্যে নিম্নকক্ষ হল লোকসভা এবং উচ্চকক্ষ হল রাজ্যসভা। রাজ্যসভা যেখানে অনধিক ২৫০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হতে পারে, সেখানে লোকসভার সদস্যসংখ্যা সর্বাধিক ৫৫২ জন হতে পারে। রাজ্যসভার সদস্যদের নির্বাচন অঙ্গরাজ্যগুলির আইনসভার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের একক হস্তান্তরযোগ্য ভোটের ভিত্তিতে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের নিয়মানুযায়ী হয়ে থাকে। অন্যদিকে, লোকসভার সদস্যরা সরাসরি সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটের ভিত্তিতে নির্বাচিত হন। তা ছাড়া রাজ্যসভায় মোট ১২ জন সদস্যকে মনোনীত করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির রয়েছে। তিনি বিজ্ঞান, সাহিত্য, সমাজসেবা, চারুকলা প্রভৃতি ক্ষেত্রে কৃতী ব্যক্তিদের মধ্যে থেকে এই মনোনয়ন দেন। লোকসভায় শুধুমাত্র ইঙ্গ-ভারতীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকে রাষ্ট্রপতি দুজনকে মনোনীত করেন। কার্যকালের দিক থেকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় রাজ্যসভা স্বায়ী কক্ষ এবং রাজ্যসভার সদস্যদের মেয়াদ ছয় বছর। প্রতি দু-বছর অন্তর এক- তৃতীয়াংশ সদস্য অবসর নেন। কিন্তু লোকসভা স্থায়ী কক্ষ নয়, লোকসভার কার্যকালের মেয়াদ পাঁচ বছর। স্বাভাবিকভাবে সদস্যদের কার্যকালের মেয়াদও পাঁচ বছর। কার্যকাল শেষ হওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশক্রমে রাষ্ট্রপতি লোকসভা ভেঙে দিতে পারেন।

লোকসভা ও রাজ্যসভার মধ্যে যে সাংবিধানিক সম্পর্ক রয়েছে তাকে তিনটি দিক থেকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। যথা- [1] যেক্ষেত্রে রাজ্যসভা ও লোকসভা উভয়ে সমান ক্ষমতার অধিকারী, [2] যেক্ষেত্রে রাজ্যসভা লোকসভার চেয়ে বেশি ক্ষমতার অধিকারী এবং [3] যেক্ষেত্রে লোকসভা রাজ্যসভার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতার অধিকারী।

[1] রাজ্যসভা ও লোকসভার সমক্ষমতা: কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাজ্যসভা ও লোকসভা সমান ক্ষমতা ভোগ করে।

i. পার্লামেন্টে বিলগ্রহণ-সংক্রান্ত ক্ষমতার ক্ষেত্রে একমাত্র অর্থ বিল ছাড়া রাজ্যসভা ও লোকসভা অন্যান্য বিলের ব্যাপারে সমান ক্ষমতার অধিকারী।

ii. সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রেও দুটি কক্ষ সমান ক্ষমতা ভোগ করে থাকে। উভয়কক্ষের সম্মতি ছাড়া সংবিধান সংশোধন করা যায় না।

iii. রাষ্ট্রপতির নির্বাচন ও পদচ্যুতির বিষয়ে এবং উপরাষ্ট্রপতির নির্বাচনের ক্ষেত্রে উভয়কক্ষ সমান ক্ষমতার অধিকারী। এ ছাড়া সুপ্রিমকোর্ট এবং হাইকোর্টের বিচারপতিদের অপসারণ, মুখ্য নির্বাচনি অফিসার, নিয়ন্ত্রক ও মহাগণনা পরীক্ষক প্রমুখ পদাধিকারীকে অপসারণ করার ক্ষেত্রে রাজ্যসভা ও লোকসভার সমান ক্ষমতা রয়েছে।

iv. আইনসভার অবমাননা বা অধিকারভঙ্গের অভিযোগে কোনো সদস্য বা সদস্য নন এমন ব্যক্তিকে উভয়কক্ষের শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে।

V. কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে হাইকোর্ট স্থাপন এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে হাইকোর্টের ক্ষমতার পরিধি বাড়ানো প্রভৃতি বিষয়ে দুটি কক্ষ সমান ক্ষমতার অধিকারী।

vi.  রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ঘোষিত জরুরি অবস্থা অনুমোদনের ব্যাপারেও লোকসভা ও রাজ্যসভার সমান ক্ষমতা রয়েছে।

[2] রাজ্যসভার প্রাধান্য: যেসব বিষয়ে রাজ্যসভার একক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেগুলি হল-

i. রাজ্যসভায় উপস্থিত ও ভোটদানকারী সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য যদি এমন প্রস্তাব গ্রহণ করেন যে, জাতীয় স্বার্থে রাজ্য-তালিকার কোনো বিষয়ে পার্লামেন্টের আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন, তাহলে পার্লামেন্ট সেই বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে পারে। এভাবে রাজ্যসভার একক প্রস্তাবের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রীয় ক্ষমতা-বণ্টন ব্যবস্থার রদবদল ঘটানো সম্ভব (২৪৯ নং ধারা)।

ii. রাজ্যসভায় উপস্থিত ও ভোটদানকারী সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থে পার্লামেন্ট এক বা একাধিক সর্বভারতীয় চাকরি সৃষ্টির জন্য আইন প্রণয়ন করতে পারে (৩১২ নং ধারা)।

iii. উপরাষ্ট্রপতির পদচ্যুতি-সংক্রান্ত প্রস্তাব শুধুমাত্র রাজ্যসভায় উত্থাপন করা যায়। এ ছাড়া আইনসভার স্থায়ী কক্ষ হিসেবে রাজ্যসভা লোকসভার তুলনায় একটি স্বতন্ত্র মর্যাদা ভোগ করে।

[3] লোকসভার প্রাধান্য: যেসব বিষয়ে লোকসভার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেগুলি হল-

i. অর্থ বিল একমাত্র লোকসভাতেই উত্থাপিত হতে পারে। তা ছাড়া কোনো বিল অর্থ বিল কি না সে বিষয়ে মতবিরোধ ঘটলে লোকসভার অধ্যক্ষের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হয়। অর্থ বিল লোকসভায় গৃহীত হওয়ার পর রাজ্যসভার কাছে সুপারিশের জন্য পাঠানো হয়। কোনো অর্থ বিল প্রত্যাখ্যান বা সংশোধন করার ক্ষমতা রাজ্যসভার নেই। রাজ্যসভাকে অর্থ বিল সম্বন্ধে ১৪ দিনের মধ্যে তার মতামত জানাতে হয়। বিলটি এই সময়ের মধ্যে ফেরত না এলে তা গৃহীত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। অর্থ বিলের ব্যাপারে রাজ্যসভার সুপারিশ গ্রহণ করা লোকসভার পক্ষে বাধ্যতামূলক নয়।

ii. কোনো সাধারণ বিল নিয়ে লোকসভা ও রাজ্যসভার মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে তা মীমাংসার জন্য রাষ্ট্রপতি উভয়কক্ষের এক যৌথ অধিবেশন ডাকতে পারেন। এই অধিবেশনে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে বিলটির ভাগ্য নির্ধারিত হয়। তবে এক্ষেত্রে লোকসভার মতামতই জয়ী হয়, কারণ সদস্যসংখ্যায় লোকসভা রাজ্যসভার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি।

iii. ৪৪তম সংবিধান সংশোধনী অনুযায়ী, জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের ব্যাপারে লোকসভা কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করলে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করতে বাধ্য থাকবেন।

iv. কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা তার কাজকর্মের জন্য শুধুমাত্র লোকসভার কাছেই দায়বদ্ধ থাকে। মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার ক্ষমতা একমাত্র লোকসভারই রয়েছে। এই কারণে লোকসভার আস্থা হারালে মন্ত্রীসভার পতন ঘটে।

উপসংহার: ভারতীয় পার্লামেন্টের দুই কক্ষের মধ্যে সাংবিধানিক সম্পর্ক বিশ্লেষণের শেষে বলা যায় যে, কিছু ক্ষেত্রে সমমর্যাদাসম্পন্ন হলেও সামগ্রিক দিক থেকে লোকসভা রাজ্যসভা অপেক্ষা অনেক বেশি ক্ষমতার অধিকারী। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কক্ষ হিসেবে লোকসভার গুরুত্ব স্বভাবতই বেশি। ভারতীয় সংবিধানের রচয়িতারা সংসদীয় গণতান্ত্রিক। শাসনব্যবস্থার রীতিনীতির ভিত্তিতেই দুটি কক্ষের মধ্যে সাংবিধানিক সম্পর্কের রূপরেখা স্থির করেছিলেন।

প্রশ্ন 5. লোকসভার স্পিকারের ক্ষমতা ও কার্যাবলি এবং পদমর্যাদা পর্যালোচনা করো।

অথবা, লোকসভার অধ্যক্ষের কার্যাবলি আলোচনা করো।

অথবা, লোকসভার স্পিকারের ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনা করো।

অথবা, ভারতের সংসদীয় ব্যবস্থায় লোকসভার অধ্যক্ষের ভূমিকা বিশ্লেষণ করো।

অথবা, লোকসভার অধ্যক্ষের ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনা করো।

উত্তর: লোকসভার স্পিকারের ক্ষমতা ও কার্যাবলি

ভারতের সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় স্পিকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। জওহরলাল নেহরুর মতে, লোকসভার স্বাধীনতা ও সম্ভ্রমের মূর্ত প্রতীক হলেন স্পিকার। লোকসভা যেহেতু সমগ্র জাতির প্রতিনিধিত্ব করে, তাই লোকসভার সভাপতি হিসেবে স্পিকার সমগ্র জাতির স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে কাজ করেন। সংবিধান অনুসারে স্পিকারকে অবশ্যই লোকসভার সদস্য হতে হয়। লোকসভা নির্বাচনের পর নবগঠিত সভার সদস্যরা নিজেদের মধ্যে থেকে একজনকে স্পিকার নির্বাচন করেন (৯৩ নং ধারা)। সাধারণত লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মনোনীত প্রার্থী স্পিকার হিসেবে নির্বাচিত হয়ে থাকেন। স্পিকারের কার্যকাল সম্পর্কে সংবিধানে কিছু বলা না হলেও লোকসভার মেয়াদ অর্থাৎ পাঁচ বছর পর্যন্ত তিনি স্বপদে অধিষ্ঠিত থাকেন। অবশ্য লোকসভার সদস্যদের স্পিকারকে অপসারণ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ভারতের সংবিধানে স্পিকার এক বিশেষ মর্যাদা ও ক্ষমতার অধিকারী। তাঁর পদমর্যাদা সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতির সমতুল্য বলে অনেকে মনে করেন। স্পিকারের ক্ষমতার উৎস হল ভারতের সংবিধান এবং লোকসভার কার্যপরিচালনা-সংক্রান্ত বিধি। কিছু অলিখিত ক্ষমতাও তাঁর রয়েছে।

[1] সভা পরিচালনা: সুশৃঙ্খলভাবে সভা পরিচালনা করা স্পিকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এর অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলি হল-

i. লোকসভায় কোন্ প্রস্তাবগুলি উত্থাপন করা হবে, কোন্ নোটিশ আলোচনার জন্য গ্রহণ করা হবে, কী প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হবে, কোন্ সংশোধনী প্রস্তাব বৈধ বলে বিবেচিত হবে ইত্যাদি বিষয়ে স্পিকারের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত।

ii. সভায় বক্তৃতা দেওয়ার ব্যাপারে এবং দৃষ্টি-আকর্ষণী প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য সদস্যদের অবশ্যই স্পিকারের কাছে অনুমতি নিতে হয়।

iii. সদস্যদের বক্তৃতায় একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি, অপ্রাসঙ্গিক বা অশালীন মন্তব্য এবং আপত্তিকর আচরণ ইত্যাদি বিষয়ের প্রতি স্পিকার বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখেন।

iv. সভায় সব সদস্য যাতে সমান সুযোগ পেতে পারেন সেদিকেও স্পিকারের লক্ষ থাকে। সভার কাজকর্ম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য সংসদীয় রীতি-বিরোধী আচরণ দেখলে তিনি কোনো সদস্যকে মৃদু তিরস্কার করতে পারেন, এমনকি শাস্তিও দিতে পারেন।

v. লোকসভায় বিশৃঙ্খল আচরণ করলে স্পিকার যে-কোনো সদস্যকে সভা থেকে বহিষ্কারের নির্দেশ দিতে পারেন।

vi. সভায় তুমুল বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে স্পিকার সাময়িকভাবে সভা মুলতুবি করে দিতে পারেন।

vii. লোকসভার ‘কোরাম’ অর্থাৎ নির্দিষ্ট সংখ্যক সদস্য হাজির না থাকলে তিনি সভার কাজ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে পারেন।

viii. সাধারণভাবে ভোটাভুটির সময়ে স্পিকার নিরপেক্ষ থাকেন। তবে পক্ষে বিপক্ষে সমান সংখ্যক ভোট পড়ে অচলাবস্থা দেখা দিলে স্পিকার এবং ‘নির্ণায়ক ভোট’ (Casting Vote) দিতে পারেন।

ix. সভায় সদস্যদের ভোটাধিকার প্রয়োগের ব্যাপারে স্পিকারের সিন্ধান্ত চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়।

x. সভার কার্যপদ্ধতি-সংক্রান্ত সমস্ত নিয়মকানুনের যথাযথ ব্যাখ্যা দেওয়ার ক্ষমতাও স্পিকারের রয়েছে।

xi. কোনো আলোচনা বন্ধ করার প্রস্তাবগ্রহণের ব্যাপারে স্পিকারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

xii. স্পিকার তাঁর পূর্ব-ঘোষিত কোনো সিদ্ধান্ত স্বাধীনভাবে পুনর্বিবেচনা করয়ে পারেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, স্পিকারের কোনো সিদ্ধান্তকে আদালয়ে চ্যালেঞ্জ জানানো যায় না। এ বিষয়ে আদালতের কোনো এক্তিয়ার নেই।

[2] লোকসভার সদস্যদের অধিকার রক্ষা: অধিকার ভঙ্গ বা লোকসভা অবমাননার দায়ে তিনি যে-কোনো ব্যক্তি বা সাংসদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। লোকসভা অবমাননার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সাংসদকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতাও স্পিকারের রয়েছে। অবশ্য লোকসভ অধিবেশনের সমাপ্তির পর সংশ্লিষ্ট আটক ব্যক্তিকে মুক্তি দেওয়ার সংস্থান আছে। তা ছাড়া স্পিকারের অনুমতি ছাড়া লোকসভার কোনো সদস্যকে পার্লামেন্টের ভেতরে গ্রেফতার করা যায় না।

[3] অর্থ বিল-সম্পর্কিত ক্ষমতা: অর্থ বিল নিয়ে কোনো বিরোধ দেখ দিলে স্পিকার তার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করে থাকেন। লোকসভায় অনুমোদনের পর অর্থ বিলটিকে যখন রাজ্যসভায় পাঠানো হয়, তখন বিলটি যে একটি অর্থ বিল সে-সম্পর্কে স্পিকার একটি প্রমাণপত্র দিয়ে থাকেন।

[4] লোকসভা ও রাষ্ট্রপতির সংযোগ রক্ষা: লোকসভা ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে তিনিই সংযোগ রক্ষা করে থাকেন। রাষ্ট্রপতির দেওয়া বাণী, বক্তব্য, বার্তা ইত্যাদি স্পিকার নিজে লোকসভায় উত্থাপন করেন। অন্যদিকে আবার রাষ্ট্রপতির কাছে লোকসভার বক্তব্য স্পিকারের মাধ্যমেই পেশ করা হয়।

[5] সংসদীয় কমিটির প্রধান হিসেবে ভূমিকা: সংসদীয় কমিটিগুলির প্রধান হলেন স্পিকার। তিনি বিভিন্ন সংসদীয় কমিটির সভাপতিদের নিয়োগ করেন। এই কমিটিগুলি স্পিকারের নিয়ন্ত্রণাধীনে দায়িত্ব পালন করে। গুরুত্বপূর্ণ কমিটিগুলির সভায় স্পিকার সভাপতিত্ব করেন। এর মধ্যে রয়েছে বিধি- সম্পর্কিত কমিটি (Rules Committee), সভার কর্মপদ্ধতি পরিচালনা- সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি (Business Advisory Committee) প্রভৃতি।

[6] অন্যান্য ক্ষমতা: উপরের ক্ষেত্রগুলি ছাড়াও আরও কিছু ক্ষেত্রে স্পিকারের ক্ষমতা লক্ষ করা যায়।

i. পার্লামেন্টের যৌথ অধিবেশনে স্পিকারই সভাপতিত্ব করেন।

ii. যে-কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সদস্যদের অবহিত করার উদ্দেশ্যে স্পিকার আলোচনা করতে পারেন।

iii. কোনো  সদস্যের পক্ষে হিন্দি বা ইংরেজিতে ভাষণ দেওয়া সম্ভব নাহারে। মাই ভাষায় ভাষণদানের ব্যাপারে স্পিকারে ভাষণ দেওয়া অসম্ভবন। পরে সেই বক্তৃতা ইংরেজি বা হিন্দিতে অনুবাদের তিনি ব্যবস্থা করেন।

iv. হিসেবে স্পিকার সভার নিরাপত্তার ব্যবস্থা, সদস্যদের জীবন ও সম্মান রক্ষা এবং সদস্যদের আবাসন-সংক্রান্ত ব্যবস্থা করেন।

v. সাধারণ দর্শক ও সাংবাদিকদের জন্য বসবার ব্যবস্থা স্পিকার করে থাকেন।

vi. সংসদীয় কার্যবিবরণী সংরক্ষণের দায়িত্বও স্পিকারের।

vii. সদস্যদের পদত্যাগপত্র স্পিকারের কাছেই জমা দিতে হয়। তিনি পদত্যাগের কারণ অনুসন্ধান করে যদি দেখেন যে তা জোর করে করানো হয়েছে তাহলে সংশ্লিষ্ট পদত্যাগপত্রটি স্পিকার গ্রহণ নাও করতে পারেন। 

viii. দলত্যাগ-বিরোধী আইন অমান্য করলে অভিযুক্ত সদস্যের সদস্যপদ বাতিল করার ক্ষমতা স্পিকারের রয়েছে।

স্পিকারের পদমর্যাদা

ভারতের সংবিধানে স্পিকারের পদটিকে যথেষ্ট মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। সংবিধান জয়িতারা স্পিকারের এই পদটিকে যতটা সম্ভব স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সংসদীয় গণতন্ত্রে ক্ষমতাসীন দলের পাশাপাশি বিরধী দলের একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। স্পিকারেরার পাশাপাশি বিরাধী দলকে উপযুক্ত ভূমিকা পালনের সুযোগ দেয়। স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে গল পরিচালনা করে স্পিকারকে বিরোধী দলগুলির আস্থা অর্জন করতেভাবে তবে দল নিরপেক্ষতার কোনো ঐতিহ্য ভারতের সংসদীয় ব্যবস্থায় স্পিকারের ক্ষেত্রে এখনও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়নি।

উপসংহার: ভারতের সংসদীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বর্তমানে জোট সরকারের। যুগ শুরু হওয়ায় সভা পরিচালনার বিষয়ে স্পিকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। স্পিকারের যোগ্য নেতৃত্ব, সহমর্মিতা, নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি, বিচক্ষণতা ইত্যাদি বিষয়গুলির ওপর তাঁর কাজকর্মের সাফল্য নির্ভরশীল।

প্রশ্ন 6.  লোকসভার স্পিকারের নিরপেক্ষতা সম্পর্কে আলোচনা করো।

উত্তর: লোকসভার স্পিকারের নিরপেক্ষতা

গ্রেট ব্রিটেনের কমন্সসভার স্পিকারের আদলে ভারতের লোকসভার স্পিকারের নিরপেক্ষ দিকটি গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। অবশ্য ব্রিটেনে সুদীর্ঘকালব্যাপী যে নিরপেক্ষ ঐতিহ্য স্পিকার পদটিকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে ভারতে তেমনটা হয়নি। ব্রিটেনের একজন প্রাক্তন স্পিকার ক্লিফটন ব্রাউন একসময় বলেছিলেন, ‘আমি স্পিকার হিসেবে সরকারি দলের লোক নই, আমি বিরোধী দলেরও লোক নই; আমি পুরোপুরি কমন্সসভার লোক এবং সর্বোপরি আমি কমন্সসভার পিছনের সারির সদস্যদের লোক।’

সাংবিধানিক ব্যবস্থা

ভারতের সংবিধান-রচয়িতারা স্পিকারের নিরপেক্ষতার ওপর গুরুত্ব দিতে চেয়েছিলেন। দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে স্পিকার যাতে নিরপেক্ষভাবে তাঁর ভূমিকা পালন করতে পারেন সেজন্য সংবিধান-প্রণেতারা কতকগুলি বিশেষ ভাবস্থার কথা সংবিধানে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এই ব্যবস্থাগুলি হল- 

[1]  স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বেতন, ভাতা ইত্যাদি ভারতের সঞ্চিত তহবিল থেকে দেওয়া হয়। এসব ব্যয়ের জন্য পার্লামেন্টের অনুমোদনের দরকার হয় না।

[২] স্পিকারকে সহজে পদচ্যুত করা যায় না। এজন্য বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়। এই পদ্ধতি অনুসারে স্পিকারের বিরুদ্ধে পদচ্যুতির প্রস্তাব আনতে হলে কমপক্ষে ১৪ দিন আগে নোটিশ দিতে হয়। 

[3]  লোকসভার বিতর্ক বা কোনো সমালোচনায় স্পিকার অংশগ্রহণ করেন না।

[4] লোকসভায় কোনো প্রস্তাবের পক্ষে বা বিপক্ষে স্পিকার ভোট দেন না। অবশ্য কোনো প্রস্তাবের পক্ষে ও বিপক্ষে সমানসংখ্যক ভোট পড়লে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় তা দূর করার জন্য স্পিকার একটি নির্ণায়ক ভোট বা কাস্টিংার সৃষ্টি হয় তা দূর করবে তাঁর অপসারণ-সম্পর্কিত কোনো প্রস্তাবের ক্ষেত্রে স্পিকারের নির্ণায়ক ভোট দেওয়ার ক্ষমতা নেই।

[5] স্পিকারের কাজকর্মকে আদালতের এক্তিয়ার-বহির্ভূত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

স্পিকারের ভূমিকা

স্পিকারের নিরপেক্ষতা বিরোধী দলকে উপযুক্ত ভূমিকা পালনের সুযোগ দেয়। স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে সভা পরিচালনা করে স্পিকারকে বিরোধী দলগুলির আস্থা অর্জন করতে হয়। ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি একসময় বলেছিলেন, দলনিরপেক্ষতা হল আইনসভার সভাপতির আবশ্যিক যোগ্যতা। প্রাক্তন স্পিকার জি ভি মভলঙ্কর বিরোধী দলের অধিকার সংরক্ষণে স্পিকারের ভূমিকা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, স্পিকার এমন কোনো কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলবেন না যাতে তাঁর পদের মর্যাদা ও নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ণ হয়।

মূল্যায়ন

ভারতের স্পিকারের নিরপেক্ষতার বিষয়টি একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, নিরপেক্ষতাই হল ভারতের লোকসভার স্পিকারের সবচেয়ে মূল্যবান দিক। কিন্তু নিরপেক্ষতার আদর্শটি কতখানি বাস্তবায়িত হয়েছে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। অধ্যাপক জোহারি এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন যে, নির্দলীয় ব্যক্তি হিসেবে স্পিকারের সুস্থ ঐতিহ্য গড়ে তোলার বিষয়টি থেকে আমরা এখনও বহু দূরে রয়েছি (“We have remained from being able to develop the sound tradition of his [speaker’s] being a non-party man.”)।

লোকসভার প্রথম স্পিকার জি ভি মভলঙ্কর ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্পিকারের দলনিরপেক্ষতাকে বাস্তবসম্মত বলে মনে করেননি। তাঁর বক্তব্য ছিল, ভারতে স্পিকারের নিরপেক্ষতার কোনো ধারাবাহিক ঐতিহ্য গড়ে ওঠেনি। এই কারণে সম্পূর্ণ দলনিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করা স্পিকারের পক্ষে সম্ভব নয়। মভলংকর প্রস্তাব দিয়েছিলেন, স্পিকার লোকসভার ভিতরে রাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকবেন এবং সভার বাইরে রাজনীতি করতে পারবেন। পরবর্তীকালে ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে তদানীন্তন স্পিকার সঞ্জীব রেড্ডি স্পিকার হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পরই দলনিরপেক্ষতার আদর্শ প্রতিষ্ঠায় কংগ্রেস দলের সদস্যপদ ত্যাগ করেছিলেন। অবশ্য নিরপেক্ষতার এই আদর্শ তিনি বেশি দিন বজায় রাখতে পারেননি। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তিনি কংগ্রেস দলের প্রার্থী হন।

অনেকে মনে করেন, নিরপেক্ষতা লোকসভার স্পিকারের সবচেয়ে মূল্যবান দিক হলেও তা প্রধানত পার্টি আনুগত্যের জন্য বজায় রাখা যায়নি। স্পিকারের পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্ত ও মনোভাবের জন্য বিরোধী পক্ষের সদস্যরা লোকসভায় বহুবার সভাকক্ষ ত্যাগ করেছেন। বিরোধীদের সভাকক্ষ ত্যাগের ঘটনা স্পিকারের দলনিরপেক্ষ না থাকার বিষয়টির ইঙ্গিত দেয়। অনেক সময় এটা দেখা গেছে প্রাক্তন স্পিকার ক্ষমতাসীন দলের সৌজন্যে অবসরগ্রহণের পরে রাজ্যপাল বা রাষ্ট্রদূত বা মন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেছেন। তা ছাড়া স্পিকারের নির্বাচনের বিষয়টি যেহেতু এখনও ভারতের লোকসভায় সম্পূর্ণ দলীয় নির্বাচন তাই স্পিকার তাঁর পদে নির্বাচিত হওয়ার পরেও নিজের নিরপেক্ষতার বিষয়টিকে পুরোপুরি মেনে চলতে পারেন না। নিরপেক্ষতা যে ভারতের লোকসভার স্পিকারের সবচেয়ে মূল্যবান দিক সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু নিরপেক্ষতার সেই ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা করা খুব সহজবোধ্য নয়। এক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখেছেন বিগত লোকসভার (২০০৪-২০০৯) স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন পরমাণু চুক্তিকে কেন্দ্র করে যে অনাস্থা প্রস্তাব বিরোধীরা লোকসভায় নিয়ে আসে তাতে ইউপিএ জোটের অন্যতম শরিক সিপিআই(এম)-ও যোগ দেয়। এই ইস্যুতে সিপিআই(এম) কংগ্রেসের ওপর থেকে সমর্থন তুলে নেয় এবং দলীয় সদস্য হিসেবে অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের ওপর চাপ দেয়। কিন্তু স্পিকার দলীয় চাপের কাছে নতিস্বীকার না করে স্পিকারের নিরপেক্ষতার ঐতিহ্য মেনে চলার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তাঁর এই অনড় মনোভাবের জন্য সিপিআই(এম) তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করে। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় তবুও তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে সরে যাননি। ২০০৮ খ্রিস্টাব্দের এই পদক্ষেপ ভারতের লোকসভার স্পিকারের নিরপেক্ষতার আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করে। সোমনাথ

চট্টোপাধ্যায় এই প্রগতিশীল পদক্ষেপ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় নিরপেক্ষতা হল ভারতের লোকসভার স্পিকারের সবচেয়ে মূল্যবান দিক।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, সংসদীয় গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যকে আরও সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করার জন্য স্পিকারের নিরপেক্ষতা একান্ত অপরিহার্য। লোকসভার কাজকর্মকে আরও গতিশীল করে গড়ে তুলতে হলে স্পিকারের নিরপেক্ষতা অত্যন্ত জরুরি।

প্রশ্ন 7.  ভারতীয় পার্লামেন্টের সাংবিধানিক মর্যাদা বিশ্লেষণ করো।

উত্তর:  ভারতীয় পার্লামেন্টের সাংবিধানিক মর্যাদা

ভারতীয় পার্লামেন্ট সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় এক ব্যাপক সাংবিধানিক ক্ষমতার অধিকারী। তবে ভারতীয় পার্লামেন্টের এই ক্ষমতা অবাধ বা অনিয়ন্ত্রিত নয়। ভারতীয় পার্লামেন্টের সাংবিধানিক মর্যাদাকে অনেক সময় ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এবং মার্কিন আইনসভা কংগ্রেসের সঙ্গে তুলনা করে বিচারবিশ্লেষণ করা হয়। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতীয় পার্লামেন্ট ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মতো ব্যাপক সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নয়, আবার মার্কিন আইনসভা কংগ্রেসের মতো দুর্বল প্রকৃতিরও নয়। বিষয়টি এখানে পর্যালোচনা করে দেখা যেতে পারে।

ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ও ভারতীয় পার্লামেন্ট

সংসদীয় শাসনব্যবস্থার ঐতিহ্যপূর্ণ প্রাচীন দেশ হল গ্রেট ব্রিটেন। ব্রিটেনে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত হয়েছে। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট বলতে নিম্নকক্ষ কমন্সসভা এবং উচ্চকক্ষ লর্ডসভাসহ রাজা বা রানিকে বোঝায়। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অসীম ক্ষমতা রয়েছে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রণয়ন করা আইনের বৈধতা সম্পর্কে ব্রিটিশ আদালতে কোনো প্রশ্ন তোলা যায় না। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রণীত যাবতীয় আইন আদালতের কাছে বৈধ বলে বিবেচিত হয়। ব্রিটেনের বিচার বিভাগ পার্লামেন্টের আইনকে ব্যাখ্যা করতে পারলেও তাকে বাতিল করতে পারে না। এভাবে ব্রিটেনে পার্লামেন্টের অপ্রতিহত ক্ষমতার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই কারণে ব্রিটিশ সংবিধান বিশেষজ্ঞ ডাইসি মন্তব্য করেছিলেন যে, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট যদি এমন আইন প্রণয়ন করে যে, নীল চোখবিশিষ্ট সব শিশুকে হত্যা করা হবে তাহলে সেই আইনের বিরোধিতা করার ক্ষমতা কারুর নেই।

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এই অনিয়ন্ত্রিত এবং অপ্রতিহত ক্ষমতা ভারতীয় পার্লামেন্টের নেই। ভারতীয় পার্লামেন্টকে সংবিধানের অধীনে থেকে কাজ করতে হয়। সংবিধানকে লঙ্ঘন করে কোনো আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ভারতীয় পার্লামেন্টের নেই। ভারতীয় পার্লামেন্ট-প্রণীত আইনের বৈধতা বিচার করে দেখার ক্ষমতা সুপ্রিমকোর্টের রয়েছে। সংবিধানে এই ক্ষমতা সুপ্রিমকোর্টকে দেওয়া হয়েছে। ভারতের পার্লামেন্টের কোনো আইন যদি সংবিধানকে লঙ্ঘন করে তাহলে সেই আইনকে বাতিল করার ক্ষমতা সুপ্রিমকোর্টের রয়েছে। বস্তুত আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ভারতীয় পার্লামেন্ট ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মতো সার্বভৌম সংবিধান ব্রিটিশ সংসদীয় ব্যবস্থার অনেক নীতি গ্রহণ করলেও আইন প্রণয়নের

ক্ষমতার অধিকারী নয়। এ কে গোপালন বনাম মাদ্রাজ রাজ্য মামলায় (১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে) এই প্রসঙ্গে স্পষ্ট অভিমত প্রকাশ করে বলা হয়েছিল ভারতীয়

ক্ষেত্রে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমিকতার নীতিকে স্বীকৃতি দেয়নি। বস্তুত ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্বের বদলে সংবিধানের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

মার্কিন কংগ্রেস ও ভারতীয় পার্লামেন্ট

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে সে দেশের বিচার বিভাগের শীর্ষ আদালত সুপ্রিমকোর্টকে মার্কিন আইনসভা কংগ্রেসের ওপর স্থান দেওয়া হয়েছে। মার্কিন আইন বিভাগ কংগ্রেসের প্রণয়ন করা যে-কোনো আইনকে সংবিধান লঙ্ঘনের

দায়ে অথবা ন্যায়নীতি লঙ্ঘনের দায়ে বাতিল করে দেওয়ার ক্ষমতা মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের রয়েছে। অনেকে মার্কিন সুপ্রিমকোর্টকে ‘অনির্বাচিত শক্তিশালী তৃতীয় কক্ষ’ বলে অভিহিত করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিমকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি চার্লস হিউজেস মন্তব্য করেছিলেন সুল্লিমরা সংবিধানের অধীন, কিন্তু বিচারপতিরা যা বলেন তাই সংবিধান” (“We আমরা der the constitution, but the constitution is what the Judges say it is.”)। 

প্রসঙ্গত বলা যায়, ভারতীয় সংসদীয় ব্যবস্থায় সুপ্রিমকোর্টের হাতে এরকম কোনো ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। সুপ্রিমকোর্ট শুধুমাত্র সংবিধান লঙ্ঘনের এরিক ছাড়া অন্য কোনো কারণে পার্লামেন্টের আইনকে বাতিল করতে পারে না। ভারতীয় সংবিধানে আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের ক্ষমতা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। সংবিধান অনুসারে কোনো বিভাগের ক্ষমতা অসীম বা অনিয়ন্ত্রিত নয়। তবে ভারতীয় পার্লামেন্টের সাংবিধানিক মর্যাদা মার্কিন আইনসভার মতো দুর্বল প্রকৃতির নয় এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে। ভারতীয় সংসদীয় ব্যবস্থায় আইন বিভাগ পার্লামেন্টের হাতে সরকার গঠনের যে চূড়ান্ত ক্ষমতা রয়েছে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থায় কোনোভাবেই দেখা যায় না। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাস করে সরকারের পতন ঘটানোর ব্যাপারেও ভারতের আইনসভার নিম্নকক্ষ লোকসভা যে ক্ষমতা ভোগ করে তা মার্কিন আইনসভার নিম্নকক্ষ জনপ্রতিনিধি সভার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

মূল্যায়ন

ভারতীয় পার্লামেন্টের সাংবিধানিক মর্যাদার বিচারবিশ্লেষণের বিষয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞদের অভিমত হল, আপাতদৃষ্টিতে যে ক্ষমতা ভারতীয় পার্লামেন্টের হাতে রয়েছে তা অনেকটাই তত্ত্বগত ক্ষমতা। কার্যত কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা বা ক্যাবিনেট পার্লামেন্টকে নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে এই ক্ষমতা ভোগ করে থাকে। সংসদীয় ব্যবস্থার পীঠস্থান গ্রেট ব্রিটেনে বহুকাল আগেই ক্যাবিনেটের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভারতেও সেই ধারা লক্ষ করা যায়। আধুনিক বিশ্বের সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দেশগুলিতে যেভাবে দলব্যবস্থা ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছে সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা জোটের প্রতিনিধিত্বকারী কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেটই শেষকথা বলার অধিকারী।

সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্রিটেনে যেহেতু কোনো লিখিত সংবিধান নেই এবং ‘বিচারবিভাগীয় সমীক্ষার নীতিরও কোনো স্বীকৃতি সে দেশে নেই, তাই সেখানে পার্লামেন্ট চরম সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হতে পেরেছে। ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রকৃতিগতভাবে এ দিক থেকে সম্পূর্ণ আলাদা বলে ভারতীয় পার্লামেন্টের ক্ষেত্রে এমনটা দেখা যায় না। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থা হল রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থার আদর্শ প্রতিনিধি, এই কারণে প্রকৃতিগতভাবে সে দেশের আইন বিভাগ সংসদীয় শাসনব্যবস্থার আইন বিভাগের চেয়ে যথেষ্ট দুর্বল প্রকৃতির।

উপসংহার: সবশেষে বলা যায়, ভারতের পার্লামেন্ট হল দেশের সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী সংস্থা। সাংবিধানিক গন্ডির মধ্যে থেকে পার্লামেন্টকে এই কাজ করতে হয়। তাই নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ভারতীয় সংবিধানকে চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী বলা যেতে পারে।

প্রশ্ন ৪. ভারতীয় সংসদের (পার্লামেন্টের) ক্ষমতা হ্রাসের মূল কারণগুলি কী কী?

উত্তর: ভারতীয় সংসদের ক্ষমতা হ্রাস

বর্তমানে বিশ্বে সংসদীয় গণতান্ত্রিক কাঠামোর দেশগুলিতে আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখা দিয়েছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক কে সি হোয়ার (KC Wheare)-এর ভাষায়, আইনসভার ক্ষমতা কিছু

puspa kakati, 3:46 PM

ক্ষেত্রে বিশেষত শাসন বিভাগের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়ে হ্রাস পেয়েছে (… legislature has declined in cert powers in relation to the executive.”) 1 certain respects and particularly in

ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থাতেও অন্যান্য সংসদীয় কাঠামোর মতো বর্তমানে পার্লামেন্ট বা সংসদের ক্ষমতার হ্রাস ঘটেছে। তত্ত্বগতভাবে তা রয়ে পার্লামেন্ট, বিশেষত লোকসভা বিপুল ক্ষমতার অধিকারী হলেও কার্যত কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেট বা মন্ত্রীসভা বর্তমানে ক্ষমতার শীর্ষে অধিষ্ঠিত রয়েছে। ব্রিটেনের মতো ভারতেও ক্যাবিনেটের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। কেউ কেউ বর্তমানে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ক্যাবিনেটের অস্বাভাবিক ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে পার্লামেন্টকে একটি বিতর্কসভা বলে অভিহিত করেছেন। ভারতের পার্লামেন্টের এই ক্ষমতা হ্রাসের পেছনে যেসব কারণ রয়েছে সেগুলি এখানে পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা যেতে পারে।

[1] সাংসদের প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতার অভাব: ভারতীয় সংসদে সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার জন্য শিক্ষাগত কোনো বিশেষ যোগ্যতার দরকার পড়ে না। সংবিধান নির্দেশিত সাধারণ যোগ্যতার অধিকারী যে-কোনো ব্যক্তি সংসদের সদস্যরূপে নির্বাচিত হতে পারেন। এর ফলে বর্তমান সংসদীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আইন প্রণয়নের জন্য যে বিশেষ জ্ঞান ও দক্ষতার প্রয়োজন তা এসব সাধারণ সদস্যদের থাকে না। এই কারণে আইন প্রণয়ন-সম্পর্কিত কাজকর্মের যাবতীয় দায়িত্ব মন্ত্রীসভা বা ক্যাবিনেটের সদস্যরা পালন করে থাকেন। এভাবে আইন প্রণয়নের কাজে ক্রমশ পার্লামেন্টের বদলে ক্যাবিনেটের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

[2] শৃঙ্খলাবদ্ধ দলব্যবস্থার প্রভাব: ভারতের সংসদীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সুশৃঙ্খল দলব্যবস্থার প্রভাবের ফলে পার্লামেন্টের ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দল বা জোটের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নিয়ে মন্ত্রীসভা বা ক্যাবিনেট গঠিত হয়। ক্ষমতাসীন দল বা জোটের শীর্ষস্থানীয় এই নেতাদের সিদ্ধান্ত বা নির্দেশকে পার্লামেন্টের দলীয় সদস্যরা উপেক্ষা করতে পারেন না। এই কারণে ক্যাবিনেটের সিদ্ধান্তকে অমান্য করার কোনো উপায় ক্ষমতাসীন দলীয় সাংসদদের থাকে না। তাঁরা প্রায় বিনা বাধায় ক্যাবিনেটের যাবতীয় সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে বাধ্য হন।

তা ছাড়া সাম্প্রতিককালে ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জোট ব্যবস্থার প্রচলনের ফলে, ক্ষমতাসীন জোট বা শাসক দলগুলির ন্যূনতম অভিন্ন কর্মসূচি (Common Minimum Programme) রূপায়ণে সরকারকে বাধ্য থাকতে হয়। ক্ষমতাসীন জোটের শীর্ষস্থানীয় নেতা বা নেত্রীর নির্দেশ পার্লামেন্টে দলীয় সাংসদদের মেনে চলতে হয়। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান সংসদীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পার্লামেন্ট ক্ষমতাসীন জোট বা শাসক দলগুলির রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত রূপায়ণের যন্ত্রে পর্যবসিত হয়েছে। এর ফলে পার্লামেন্টের ভূমিকার ক্রমশ অবনতি ঘটেছে।

[3] অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব: একটি জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের রাষ্ট্রীয় কর্মক্ষেত্রের পরিধি বর্তমানে বৃদ্ধি পাওয়ায় এককভাবে পার্লামেন্টের পক্ষে যথাযথ আইন প্রণয়ন সম্ভব নয়। এই কারণে পার্লামেন্ট আইনের মূল নীতিগুলি নির্ধারণ করার পর তার পরিপূর্ণ রূপদানের ক্ষমতা শাসন বিভাগের হাতে তুলে দিয়েছে। এর ফলে শাসন বিভাগ বিভিন্ন ধরনের নিয়মকানুন, উপ-আইন, আদেশ বা নির্দেশ জারি করে থাকে। শাসন বিভাগ-প্রণীত এসব আইনকে ‘অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইন’ বলা হয়। সম্প্রতি এই ধরনের আইনের পরিধি বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। এর ফলে একদিকে ক্যাবিনেটের ক্ষমতা ও প্রাধান্য বেড়ে যাচ্ছে অন্যদিকে তেমনই পার্লামেন্টের ক্ষমতা ও মর্যাদা হ্রাস পাচ্ছে।

[4] অউিন্যার প্রাধান্য: পার্লামেন্টের অধিবেশন স্থগিত থাকাকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্র্যাভেন্সর প্রাধান্যনেটের সুপারিশক্রমে রাষ্ট্রপতির অর্ডিন্যান্স জড়ি কারন মন্ত্রীসভা বা ক্যাবিনেট্রেনের অর্ডিন্যান্সকে পরবর্তীকালে পার্লামেন্ট অনুমোদন করতে বাধ্য হয়। এর ফলে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে পার্লামেন্টের ক্ষমতা সংকুচিত হয়ে পড়েছে বলে অনেকে মনে করেন।

[5] বিচার বিভাগের ভূমিকা: ভারতীয় সংসদ বা পার্লামেন্টের ক্ষমতা হ্রাসের পেছনে বিচার বিভাগের ভূমিকাকেও দায়ী করা হয়। পার্লামেন্ট প্রণীত যে-কোনো আইন সংবিধান-বিরোধী হলে তাকে অসাংবিধানিকতার দায়ে বাতিল করে দেওয়ার ক্ষমতা ভারতীয় বিচার বিভাগের শীর্ষ আদালত সুপ্রিমকোর্টের হাতে রয়েছে। কেশবানন্দ ভারতী (১৯৭৩ খ্রি.) মামলার রায় দিতে গিয়ে সুপ্রিমকোর্ট ঘোষণা করেছিল যে, সংবিধানের মৌল কাঠামো রদবদলের কোনো ক্ষমতা পার্লামেন্টের নেই। পরে পার্লামেন্ট কর্তৃক ৪২তম সংবিধান সংশোধনীতে (১৯৭৬ খ্রি.) কেশবানন্দ ভারতী মামলার রায় অতিক্রম করতে গিয়ে যথাক্রমে ৫ এবং ৫৫ নং ধারায় বলা হয় যে, নির্দেশমূলক নীতি কার্যকর করার উদ্দেশ্যে কোনো আইন তৈরি হলে আদালত তার বিচার করতে পারবে না। আরও বলা হয় যে, পার্লামেন্ট সংবিধানের যে-কোনো বিষয় সংশোধনের অধিকারী। এই সম্পর্কে আদালতে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না। পরে ১৯৮০ সালে মিনার্ভা মিলস ও অন্যান্য বনাম ভারত সরকার মামলায় সুপ্রিমকোর্ট উত্ত দুটি ধারাকে বাতিল করে দেয়। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে সুপ্রিমকোর্টের এই ধরনের রায়দানের ফলে ভারতের পার্লামেন্টের ক্ষমতা যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছে।

[6] প্রশাসনিক আদালতের প্রভাব: ভারতে প্রশাসনিক আদালত (Administrative Tribunal) চালু হওয়ার ফলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা বা ক্যাবিনেটের ক্ষমতার বৃদ্ধি ঘটেছে। প্রশাসনিক আদালত চালু হওয়ায় মন্ত্রীদের হাতে প্রশাসনিক বিরোধ নিষ্পত্তির বিভাগীয় ক্ষমতা ন্যস্ত হয়েছে। এর ফলে পার্লামেন্টের ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে।

[7] জনসংযোগের অভাব: অন্যান্য সংসদীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার মতো

ভারতেও আইন বিভাগের চেয়ে শাসন বিভাগের ওপর জনগণের আস্থা বেশি দেখা যায়। বস্তুত, জনগণের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সঙ্গে শাসন বিভাগের সম্পর্ক যতখানি ঘনিষ্ঠ তেমনটা লোকসভা বা রাজ্যসভা সাংসদদের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। বর্তমানে মন্ত্রীসভা বা ক্যাবিনেট জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রবিন্দু বলে বিবেচিত হয়। সাধারণ নাগরিকরা নিজেদের নিত্যদিনের অভাব-অভিযোগ ও দুঃখ-দুর্দশার প্রতিকারের জন্য সরকারের বিভিন্ন দফতর ও বিভাগীয় মন্ত্রীদের ওপরই বেশি নির্ভরশীল। জনগণের এই মানসিকতাকে পার্লামেন্টের ক্ষমতা ও মর্যাদা হ্রাসের একটি অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

উপসংহার: উপরোক্ত আলোচনার শেষে এ কথা স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, বর্তমানে ভারতীয় সংসদের ক্ষমতা যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছে। তত্ত্বগতভাবে ভারতে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা গৃহীত হলেও বাস্তবে পার্লামেন্টের যাবতীয় ক্ষমতা ক্যাবিনেটের হাতে স্থানান্তরিত হয়েছে। যুক্তরাজ্যের মতো ভারতেও শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে ক্যাবিনেটের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। অবশ্য সাম্প্রতিককালে ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জোট সরকারের প্রচলন ঘটায় ক্যাবিনেটের পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পথে বাধার সৃষ্টি হয়েছে। ২০০৫ সালের ইউপিএ সরকারের দৃষ্টান্ত এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। বামপন্থীরা ইউপিএ জোটে প্রত্যক্ষভাবে সামিল না হয়ে বাইরে থেকে সমর্থন জুগিয়েছিল ও সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। এক্ষেত্রে ২০০৫ সালে গৃহীত ভারতীয় পেটেন্ট বিলের কথা উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে। বামপন্থীদের চাপেই ইউপিএ সরকার এই বিলটির প্রয়োজনীয় সংশোধন করতে বাধ্য হয়।

প্রশ্ন 9. ভারতের পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে আলোচনা করো।

উত্তর: ভারতের পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব

সংসদীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পার্লামেন্ট বা সংসদের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে। সংসদীয় বা পার্লামেন্ট-শাসিত ব্যবস্থায় আইন প্রণয়নের পাশাপাশি দেশের শাসনব্যবস্থা পরিচালনার ক্ষেত্রেও পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ লক্ষ করা যায়। পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের নির্বাচনে যে দল বা জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে তারাই সরকার গঠন করে। এই সরকার সম্পূর্ণভাবে পার্লামেন্টের কাছে দায়বদ্ধ থাকে। অন্যভাবে বলা যায়, পার্লামেন্ট-শাসিত ব্যবস্থায় সরকার যতদিন পর্যন্ত পার্লামেন্টের, বিশেষত নিম্নকক্ষের আস্থাভাজন থাকবে ততদিন ক্ষমতায় টিকে থাকবে। সংসদীয় ব্যবস্থার পীঠস্থান হল গ্রেট ব্রিটেন। ভারতের সংবিধানে ব্রিটিশ ব্যবস্থার অনুকরণে সংসদীয় ব্যবস্থার কাঠামো গৃহীত হয়েছে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে সার্বভৌম বলা হয়। পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্বের ধারণা ব্রিটেন থেকে এসেছে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে সার্বভৌম আইন প্রণয়নকারী সংস্থা বলার মূল কারণগুলি হল-① পার্লামেন্ট যে-কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারে, ② পার্লামেন্ট যে-কোনো আইন সংশোধন করতে পারে, ③ পার্লামেন্ট যে-কোনো আইন বাতিল করতে পারে এবং ④ ব্রিটিশ বিচার বিভাগ পার্লামেন্টের আইনকে ব্যাখ্যা করতে পারলেও তাকে কোনোভাবেই বাতিল করতে পারে না।

সংবিধান বিশেষজ্ঞদের অভিমত হল ভারতে পার্লামেন্টের পরিবর্তে সংবিধানে সার্বভৌমিকতাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। যাই হোক, বিষয়টি যেসব দিক থেকে বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে সেগুলি হল-

[1] সুপ্রিমকোর্টের নিয়ন্ত্রণ: ভারতের পার্লামেন্ট তার ইচ্ছামতো যে-কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারে না। পার্লামেন্টের কোনো আইন সংবিধানকে লঙ্ঘন করলে তা বাতিল করে দেওয়ার ক্ষমতা সুপ্রিমকোর্টের রয়েছে। সেক্ষেত্রে অসাংবিধানিকতার দায়ে আইনটি সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃক অবৈধ বলে ঘোষিত হয়। কাজেই আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ভারতের পার্লামেন্টের ক্ষমতা অনিয়ন্ত্রিত বা অবাধ নয়।

[2] সাংবিধানিক নিয়ন্ত্রণ: ভারতের পার্লামেন্ট যে-কোনো আইন সংশোধন করতে পারে না। ভারতের পার্লামেন্টকে সাংবিধানিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থেকে কাজ করতে হয়। এই কারণে সংবিধান সংশোধন বা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে পার্লামেন্টের ক্ষমতাকে সীমিত করা হয়েছে। সংবিধান হল দেশের সর্বোচ্চ আইন। কিন্তু এই সর্বোচ্চ আইন বা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে (basic structure) সংশোধন বা পরিবর্তনের ক্ষমতা পার্লামেন্টকে দেওয়া হয়নি। প্রসঙ্গত বলা যায়, ১৯৭৩ সালে কেশবানন্দ ভারতী বনাম কেরল রাজ্য মামলায় সুপ্রিমকোর্ট রায় দেয় যে, সংবিধানের মৌলিক কাঠামো অপরিবর্তিত রেখে পার্লামেন্ট সংবিধানের যে-কোনো অংশের পরিবর্তন করতে সক্ষম। পরে ১৯৭৬ সালে ৪২তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে পার্লামেন্টের হাতে ব্যাপক ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয় এবং একই সঙ্গে পার্লামেন্ট কর্তৃক গৃহীত কোনো সংশোধনী আইনের ক্ষেত্রে আদালতের বৈধতা বিচারের ক্ষমতাকে বাতিল করে দেওয়া হয়। কিন্তু, ১৯৮০ সালে মির্নাভা মিলস্ মামলায় সুপ্রিমকোর্ট ৪২তম সংবিধান সংশোধনীর এই ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। ফলে সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে পার্লামেন্টের অবাধ ও অসীম ক্ষমতা বাতিল বলে ঘোষিত হয়।

[3] সংবিধানের সার্বভৌমত্ব: অনেকে মনে করেন, ব্রিটিশ সংবিধান মূলত অলিখিত ও সুপরিবর্তনীয় হওয়ার কারণে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সার্বভৌম আইন প্রণয়নকারী সংস্থায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু ভারতে একটি লিখিত সংবিধান আছে, এই সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে পার্লামেন্টের ক্ষমতা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। সংবিধান-নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে থেকেই ভারতীয় পার্লামেন্টকে কাজ করতে হয়। বস্তুত, ভারতের পার্লামেন্টের ক্ষমতা লিখিত সংবিধানের দ্বারা সীমাবদ্ধ। এই কারণে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্বের বদলে সংবিধানের সার্বভৌমত্বের কথা বলা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এ কে গোপালন বনাম মাদ্রাজ ব্রাজ্য মামলায় (১৯৫০) বিচারপতি মুখার্জি বলেন, ভারতের সংবিধান লিখিত সংবিধান, যদিও এই সংবিধান ব্রিটেনের সংসদীয় শাসনব্যবস্থার অনেক নীতিন গ্রহণ করেছে, তবুও আইন প্রণয়নের ব্যাপারে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের

সার্বভৌমিকতার নীতিটি গ্রহণ করেনি। ভারতে পার্লামেন্টের পরিবর্তে সংবিধানের সার্বভৌমিকতাকেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

[4] যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতা বণ্টন: ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সুনির্দিষ্টভাবে বণ্টন করে দেওয়া হয়েছে। এজন্য সংবিধানে আইন প্রণয়নের তিনটি তালিকার এ সংস্থান রয়েছে। ভারতীয় পার্লামেন্ট কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে আইন প্রণয়ন করতে  পারবে তা এই তালিকাতেই নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার  নিয়ম অনুসারে পার্লামেন্ট এককভাবে সংবিধানের সমস্ত ধারা সংশোধন করতে পারে না; এজন্য কতকগুলি বিষয় সংশোধনের ক্ষেত্রে অন্তত অর্ধেক রাজ  আইনসভার অনুমোদনের ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। 

[5] মন্ত্রীসভা বা ক্যাবিনেটের নিয়ন্ত্রণ: বর্তমানে পার্লামেন্টের [5] ডীয়ের বিষয়টিকে নিছক একটি তত্ত্বগত ধারণা বলে অভিহিত করা হয়। সাবতে পার্লামেন্টের এই ধরনের কোনো ক্ষমতা নেই। এমনকি গ্রেট ব্রিটেনেও বাজমেন্টের সার্বভৌমত্ব বর্তমান ক্যাবিনেটের সার্বভৌমত্বে পরিণত হয়েছে। পার্লামেন্টে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সেই দলের নেতা বা নেত্রীদের নিয়ে ক্যাবিনেট বা মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর ক্যাবিনেট বাস্তরে সংসদীয় ব্যবস্থায় পার্লামেন্টের যাবতীয় ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। পার্লামেন্টের মূল কাজ হল আইন প্রণয়ন। কিন্তু আইন প্রণয়নের প্রধান উদ্যোগ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা গ্রহণ করে থাকে। পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা জোটের নেতাও নেত্রীরা মন্ত্রী হিসেবে যে বিল পার্লামেন্টে উত্থাপন করেন তাতে অসম্মতি জানানোর ক্ষমতা সরকারি দল বা জোটের সদস্যদের থাকে না। অনেক সময় লোকসভা ভেঙে দেওয়ার ভয় দেখিয়েও প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টে ক্ষমতাসীন দল বা জোটের সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।

উপসংহার: উপরোক্ত আলোচনার শেষে একথা বলা যায় যে, ভারতীয় পার্লামেন্টকে পুরোপুরি সার্বভৌম আইন প্রণয়নকারী সংস্থা হিসেবে অভিহিত করা যায় না। কারণ ভারতীয় পার্লামেন্টকে সংবিধানের অধীনে থেকে যাবতীয় কার্যাবলি সম্পাদন করতে হয়।

প্রশ্ন 10 পার্লামেন্টের সদস্যদের বিশেষাধিকার সম্পর্কে আলোচনা করো।

উত্তর: পার্লামেন্টের সদস্যদের বিশেষাধিকার

সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনসভার কাজকর্ম যথাযথভাবে পালন করার জন্য আইনসভার সদস্যদের কয়েকটি বিশেষ অধিকার ভোগের সুযোগসুবিধ রয়েছে। আরস্কাইন মে (Erskine May) তাঁর Parliamentary Practice গ্রন্থে এই বিশেষাধিকারের সংজ্ঞা নির্দেশ করতে গিয়ে বলেছেন, আইনসভার প্রতিটি কক্ষ সামগ্রিকভাবে এবং সদস্যরা ব্যক্তিগতভাবে যে অধিকার ভোগ করে থাকেন তা-ই হল আইনসভার বিশেষ অধিকার। এসব অধিকার ছাড়া আইনসভা এবং তার সদস্যরা তাদের কাজকর্ম যথাযথভাবে পালন করতে পারেন না।

সংবিধানের ১০৫ নং ধারায় ভারতের পার্লামেন্ট এবং তার সদস্যদের বিশেষাধিকার সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সংবিধানের ১০৫(৩) নং ধারায় পার্লামেন্টকে বিশেষাধিকার-সম্পর্কিত আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী এই সমস্ত বিশেষ অধিকারকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়-[1] ব্যক্তিগত অধিকার ও অব্যাহতি এবং [2] সমষ্টিগত অধিকার ও অব্যাহতি।

[1] ব্যক্তিগত অধিকার ও অব্যাহতি

i. বাকস্বাধীনতা: পার্লামেন্টের সদস্যরা সংবিধানের ১০৫(১) নং ধারা অনুযায়ী পার্লামেন্টের সভাকক্ষের ভেতরে বাক্স্বাধীনতার অধিকার ভোগ করে থাকেন। অবশ্য বাস্বাধীনতার এই অধিকারটি অবাধ নয়। সদস্যদের সংশ্লিষ্ট কক্ষের নিয়মকানুনগুলি মেনে চলতে হয়। লোকসভার

স্পিকার এবং রাজ্যসভার সভাপতি এই বাকস্বাধীনতার অধিকারকে নিয়ন্ত্রণ করেন। যেমন-কোনো সদস্য অন্য কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে মানহানিকর উক্তি করলে তা সভার কার্যবিবরণী থেকে বাদ দেওয়া হয়, অথবা ওই সদস্যকে উক্তি প্রত্যাহার করে নিতে বা উক্তির জন্য দুঃখপ্রকাশ করতে বলা হয়। পার্লামেন্টের ভেতরে বা কোনো কমিটিতে বক্তৃতা বা ভোট দেওয়ার জন্য কোনো ব্যক্তিকে আদালতে অভিযুক্ত করা যায় না।

ii. গ্রেফতার না হওয়ার স্বাধীনতা: পার্লামেন্টের অধিবেশন চলাকালীন গ্রেফতার না হওয়ার স্বাধীনতাও সদস্যরা ভোগ করে থাকেন। অধিবেশন

আরম্ভ হওয়ার ৪০ দিন আগে এবং অধিবেশন শেষ হওয়ার ৪০ দিনের মধ্যে কোনো সদস্যকে দেওয়ানি মামলার অভিযোগে গ্রেফতার করা যায় না। তবে ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে এবং নিবর্তনমূলক আটক আইনের হাত থেকে কোনো সদস্যকে অব্যাহতির সুযোগ দেওয়া হয়নি। এই ব্যাপারেও কিছু বিধিনিষেধ আছে। যেমন-① আইনসভার সীমানার মধ্যে কোনো সদস্যকে গ্রেফতার করা যাবে না। ② লোকসভার স্পিকার বা রাজ্যসভার চেয়ারম্যানের অনুমতি ছাড়া আইনসভার সীমানার মধ্যে কোনো সদস্যকে দেওয়ানি বা ফৌজদারি সমন দেওয়া যায় না। যদি কোনো সদস্যকে গ্রেফতার করা হয় সেক্ষেত্রে লোকসভার স্পিকার বা রাজ্যসভার চেয়ারম্যানকে জানাতে হয়। মুক্তি দেওয়ার পরও জানাতে হয়। ④ পার্লামেন্টের অধিবেশন চলাকালীন কোনো সদস্যকে আদালতে জুরি হিসেবে দায়িত্ব পালনে বাধ্য করা যায় না। এ ছাড়া কোনো সদস্যকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য আদালতে হাজির থাকতে বাধ্য করা যায় না।

[2] সমষ্টিগত অধিকার ও অব্যাহতি

i. কার্যক্রম রচনা ও রূপায়ণের অধিকার: আইনসভার কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য লোকসভা ও রাজ্যসভা তাদের নিজস্ব কর্মসূচি, অভ্যন্তরীণ কার্যপদ্ধতি প্রভৃতি স্বাধীনভাবে নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কার্যক্রম রচনা ও রূপায়ণের অধিকার প্রতিটি কক্ষের রয়েছে।

ii. বহিরাগতদের উপস্থিতি নিয়ন্ত্রণের অধিকার: আইনসভার উভয়কক্ষে আলোচনা চলাকালীন বহিরাগত ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকতে পারেন। কিন্তু প্রয়োজন হলে আইনসভা যে-কোনো বহিরাগত ব্যক্তির উপস্থিতি নিষিদ্ধ করতে পারে। এমনকি যে-কোনো কক্ষ গোপনে সভার কাজ চালাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে।

iii. কার্যবিবরণী প্রকাশ-সংক্রান্ত অধিকার: আইনসভায় যেসব বিতর্ক ও আলোচনা হয় তা প্রকাশ করার ব্যাপারে প্রতিটি কক্ষের সমান অধিকার রয়েছে। সভাপতি বা স্পিকার বিশেষ কোনো বিষয়কে সংবাদপত্রে প্রকাশের অনুমতি নাও দিতে পারেন। তা ছাড়া আইনসভা-সংক্রান্ত সংবাদ বিকৃতভাবে প্রকাশ করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনসভা অবমাননার অভিযোগ আনা যায়। আইনসভার এই ধরনের কার্যবিবরণী সরকারি তত্ত্বাবধান ছাড়াই সংবাদপত্রে স্বাধীনভাবে প্রকাশ করা যায়।

iv.আইনসভা ছাড়াই ননার দায়ে শাস্তিবিধানের অধিকার: অধিকারভজ্ঞা বা অবমাননার জন্য সদস্য বা অন্য যে-কোনো ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা আইনসভার প্রতিটি কক্ষের রয়েছে। লোকসভার স্পিকার বা রাজ্যসভার চেয়ারম্যান এই ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকেন। অধিকারভঙ্গ বা আইনসভা অবমাননার বিষয়টি বিচারবিবেচনা করে পার্লামেন্টের বিশেষ অধিকার রক্ষা কমিটি। এই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়। তা ছাড়া কোনো সদস্য সভার কাজে বাধা সৃষ্টি করলে রবকে সাময়িকভাবে অধিকারভঙ্গ বা অবমাননার জন্য মামলা সৃষ্টি করলে তাকে সাময়িকভার বিচারে এক্তিয়ার বহির্ভুত।

পার্লামেন্টের অধিকারভঙ্গ বা অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত সদস্য, বা সদস্য নন এমন ব্যক্তিকে যেসব ① শাস্তি দেওয়ার বিধান রয়েছে তা হল- কক্ষে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দিয়ে সভার তরফ থেকে স্পিকার বা সভাপতি তাকে তিরস্কার ও সতর্ক করতে পারেন। ② অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বাধ্যতামূলকভাবে কক্ষে উপস্থিত করিয়ে তীব্র ভর্ৎসনা করা হতে পারে। ও অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পার্লামেন্ট জেল হাজতে পাঠাতে পারে। কারাদন্ড দেওয়ার ক্ষমতাও পার্লামেন্টের আছে। আইনসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্পিকার বা চেয়ারম্যান অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতার করার নির্দেশও দিতে পারেন।

v. কার্যকাল বৃদ্ধির অধিকার: পার্লামেন্ট তার গঠন ও কার্যকাল সম্পর্কে ক্ষেত্রবিশেষে নিজের কর্তৃত্ব কায়েম করতে পারে। জরুরি অবস্থা জারি থাকার সময় পার্লামেন্ট তার কার্যকালের মেয়াদ আইন পাস করে একবছর পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে পারে।

মূল্যায়ন: সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, পার্লামেন্ট এবং পার্লামেন্টের সদস্যদের বিশেষাধিকার ও অব্যাহতি ভোগের ক্ষেত্রটি অসীম বা অনিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত নয়। সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে শাসন বিভাগ খুব সহজেই আইন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়। অনেক সময় সংকীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিশেষাধিকার-সংক্রান্ত ক্ষমতার অপপ্রয়োগ দেখা যায়। পার্লামেন্টের সদস্যরা যে ব্যাপক বিশেষাধিকার ও অব্যাহতি ভোগ করে থাকেন সেগুলি আইনের দ্বারা লিপিবদ্ধ করা উচিত বলে অনেকে মনে করেন। এর ফলে বিশেষাধিকারের পরিধি নিয়ে অস্পষ্টতা দূর হতে পারে। এই প্রসঙ্গে পাইলির অভিমত হল, নাগরিকরা জানতে পারবে সংসদীয় বিশেষাধিকার ও অব্যাহতি ভোগের সুযোগ তাদের বাক্ ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার মৌলিক অধিকারকে কতটা নিয়ন্ত্রিত করেছে (“…The citizen will know how far do these Parliamentary privileges restrict his fundamental right to freedom of speech and expression.”)।

প্রশ্ন 11. ভারতীয় পার্লামেন্টের কমিটি ব্যবস্থার পর্যালোচনা করো।

উত্তর:  ডারতীয় পার্লামেন্টের কমিটি ব্যবস্থা

সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আইন প্রণয়নের যাবতীয় দায়িত্ব পার্লামেন্ট বা আইনসভার হাতে ন্যস্ত রয়েছে। কিন্তু আধুনিক জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রে পার্লামেন্টের পক্ষে স্বল্পকালীন সময়ের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে খুঁটিনাটি বিচারবিশ্লেষণ করে আইন প্রণয়ন করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। এই কারণে সংসদীয় গণতন্ত্রে কমিটি ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে।

ভারতীয় আইনসভা বা পার্লামেন্টের কমিটিগুলিকে সাধারণভাবে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়-① স্থায়ী কমিটি (Standing Committee) এবং ② অস্থায়ী কমিটি (Ad hoc Committee)।

লোকসভার স্থায়ী কমিটি

[1] আনুমানিক ব্যয়-পরীক্ষা কমিটি: লোকসভার স্থায়ী কমিটিগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল আনুমানিক ব্যয়-পরীক্ষা কমিটি (Estimate Commit- tee)। সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে লোকসভার ৩০ জন সদস্যকে নিয়ে আনুমানিক ব্যয়-পরীক্ষা কমিটি গঠিত হয়। সদস্যদের কার্যকাল ১ বছর। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা এই কমিটির সদস্য হতে পারেন না। লোকসভার স্পিকার কমিটির সদস্যদের মধ্যে থেকে একজনকে সভাপতি বা চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ করে থাকেন। সরকারি আনুমানিক ব্যয়-পরীক্ষা কী আকারে লোকসভায় পেশ করা যাবে, সে বিষয়ে কমিটি সুপারিশ দান করতে পারে।

[2] সরকারি হিসাব-পরীক্ষা কমিটি: পার্লামেন্টের মোট ২২ জন সদস্যকে নিয়ে একক হস্তান্তরযোগ্য প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে সরকারি হিসাব-পরীক্ষা কমিটি (Public Accounts Committee) গঠিত হয়। এর মধ্যে ১৫ জন সদস্য লোকসভা থেকে এবং বাকি ৭ জন সদস্য রাজ্যসভা থেকে নির্বাচিত হন। সরকারি হিসাব-পরীক্ষা কমিটির সদস্যদের কার্যকালের মেয়াদ ১ বছর। সংসদীয় রীতি অনুসারে লোকসভার অধ্যক্ষ বিরোধী দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্য থেকে একজনকে কমিটির সভাপতি হিসেবে নিয়োগ করে থাকেন।

সরকারি হিসাব-পরীক্ষা কমিটির হাতে যেসব ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- সরকারের যাবতীয় ব্যয় এবং আর্থিক লেনদেনের হিসাব পরীক্ষা করে দেখা। সরকারের বিশেষ রাজস্ব ব্যয়-সংক্রান্ত হিসাব (Appropriation Accounts) এবং নিয়ন্ত্রক ও মহাগণনা পরীক্ষার রিপোর্ট পরীক্ষা করে দেখাও কমিটির অন্যতম কাজ।

[3] লোকসভার কার্যপরিচালনার নিয়ম-সংক্রান্ত কমিটি: লোকসভার কাজকর্ম যাতে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা যায় সেই উদ্দেশ্যে লোকসভার কার্যপরিচালনার নিয়ম-সংক্রান্ত কমিটি (Rules Committee) গঠিত হয়। ১৫ জন সদস্যবিশিষ্ট এই কমিটির সদস্যবৃন্দ লোকসভার স্পিকার কর্তৃক মনোনীত হন। পদাধিকার বলে স্পিকার নিজে এই কমিটির সভাপতি হিসেবে কাজ করে থাকেন। লোকসভার সুষ্ঠু পরিচালনার স্বার্থে প্রয়োজনীয় নতুন নিয়মকানুন রচনা, প্রচলিত নিয়মকানুনের পরিবর্তন ইত্যাদি সম্পর্কে পার্লামেন্টের কাছে সুপারিশ প্রদান করা কমিটির অন্যতম কাজ।

[4] কার্যপরিচালনা-সম্পর্কিত পরামর্শদাতা কমিটি: লোকসভার কার্যপরিচালনা-সম্পর্কিত বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার জন্য ১৫ জন সংসদ সদস্যকে নিয়ে কার্যপরিচালনা-সম্পর্কিত পরামর্শদাতা কমিটি (Business Advisory Committee) গঠিত হয়। লোকসভার স্পিকার নিজে পদাধিকার বলে এই কমিটির সভাপতি হিসেবে কাজ করেন। তিনি বিভিন্ন দলের নেতৃস্থানীয় সদস্যদের এই কমিটিতে নিয়োগ করে থাকেন। লোকসভায় কোন্ বিলকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে ইত্যাদি বিষয়ে সভার কাছে সুপারিশ দান করা কমিটির গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

[5] বেসরকারি বিল ও প্রস্তাব-সংক্রান্ত কমিটি: বেসরকারি সদস্যদের বিল ও প্রস্তাব-সংক্রান্ত কমিটি (Committee on Private Members Bills and Resolution) লোকসভার স্পিকার কর্তৃক মনোনীত অনধিক ১৫ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হয়। এই কমিটির কার্যকালের মেয়াদ ১ বছর। লোকসভার সহকারী স্পিকার এই কমিটির সভাপতি হিসেবে কাজ করেন। কমিটির উল্লেখযোগ্য কার্যাবলির মধ্যে রয়েছে-① লোকসভায় বেসরকারি বিল উত্থাপনের জন্য নোটিশ দেওয়া এবং এই বিলগুলিকে যথাযথভাবে পরীক্ষা করে দেখা, ② গুরুত্ব অনুসারে বিলগুলিকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা, ③ কোন্ বিলের আলোচনার জন্য কত সময় ধার্য করা যাবে সেসম্পর্কে সুপারিশ পেশ করা, ④ কোনো বিলের বিশেষ কোনো ধারা লোকসভার আইন প্রণয়ন ক্ষমতার এক্তিয়ার-বহির্ভূত হলে তা বিচার করে দেখা, ⑤ কোনো বিলে সংবিধান সংশোধনী প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত হলে তা পরীক্ষা করে দেখে সেই সম্পর্কে লোকসভায় সুপারিশ প্রদান করা ইত্যাদি।

[6] সদস্যদের অনুপস্থিতি-সংক্রান্ত কমিটি: লোকসভার স্পিকার কর্তৃক মনোনীত অনধিক ১৫ জন সদস্যকে নিয়ে সদস্যদের অনুপস্থিতি- সংক্রান্ত কমিটি (Committee on Absence of Members) গঠিত হয়। এই কমিটির কার্যকালের মেয়াদ ১ বছর। অধিবেশনের সময় অনুপস্থিতির কারণে পেশ করা সদস্যদের আবেদনপত্রগুলি পরীক্ষা করে দেখা কমিটির প্রধান কাজ। তা ছাড়া দীর্ঘদিন (একাদিক্রমে ৬০ দিন বা তার বেশি) কোনো সদস্য অনুপস্থিত থাকলে তার আসনটি শূন্য ঘোষিত হবে কি না সে বিষয়ে বিচারবিবেচনা করে লোকসভার কাছে রিপোর্ট পেশ করাও কমিটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

[7] আবেদন-সম্পর্কিত কমিটি: লোকসভার স্পিকারের দ্বারা মনোনীত অনধিক ১৫ জন সদস্যকে নিয়ে আবেদন-সম্পর্কিত কমিটি (Committee on Petitions) গঠিত হয়। কোনো নতুন আইন প্রণয়ন বা অন্য কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য লোকসভার কাছে পাঠানো জনগণের আবেদনগুলি পরীক্ষা করে দেখে সভার কাছে সেসম্বন্ধে রিপোর্ট পেশ করা কমিটির প্রধান কাজ।

[৪] বিশেষ অধিকার-সম্পর্কিত কমিটি: লোকসভার স্পিকারের দ্বারা মনোনীত ১৫ জন সদস্যকে নিয়ে অধিবেশনের শুরুতে বিশেষ অধিকার- সম্পর্কিত কমিটি (Committee of Privileges) গঠিত হয়। কমিটির সভাপতিকে স্পিকার মনোনীত করেন। লোকসভার সদস্যরা যেসব ব্যক্তিগত এবং সামগ্রিক সুযোগসুবিধা ও অব্যাহতি ভোগ করে থাকেন সেই সম্বন্ধে এবং সামলের কোনো অভিযোগ সভায় উঠলে বিষয়টিকে বিশেষ অধিকার সম্পর্কিত কমিটির কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কমিটি এই সম্পর্কে লোকসভার কাছে যে রিপোর্ট পেশ করে, তার ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

[9] সরকারি প্রতিশ্রুতি-সংক্রান্ত কমিটি: লোকসভার স্পিকার কর্তৃক মনোনীত ১৫ জন সদস্যদের নিয়ে সরকারি প্রতিশ্রুতি-সংক্রান্ত কমিটি (Com- mittee on Assurances) ১ বছর কার্যকালের মেয়াদে গঠিত হয়। প্রসঙ্গত বলা যায়, কোনো মন্ত্রী এই কমিটির সদস্য হতে পারেন না। লোকসভায় প্রদত্ত মন্ত্রীদের প্রতিশ্রুতিগুলি খতিয়ে দেখে তা কতখানি বাস্তবে রূপায়িত হয়েছে সেই সম্পর্কে সভার কাছে রিপোর্ট পেশ করা কমিটির প্রধান কাজ।

[10] অধস্তন আইন-সম্পর্কিত কমিটি: জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রে শাসন বিভাগ কর্তৃক প্রণীত অপিত ক্ষমতাপ্রসূত আইন (Delegated Legislation) বা অধস্তন আইনগুলি (Subordinate Legislation) যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে কি না, তা দেখা অধস্তন আইন-সংক্রান্ত কমিটি (Committee on Subordinate Legislation)-র প্রধান কাজ। লোকসভার স্পিকার ১৫ জন সদস্যদের নিয়ে ১ বছর কার্যকালের মেয়াদে এই কমিটিকে নিযুক্ত করেন। সাধারণত বিরোধী দলের কোনো নেতাকে এই কমিটির সভাপতি হিসেবে মনোনীত করা হয়।

[11] সরকারি উদ্যোগাধীন প্রতিষ্ঠান-সম্পর্কিত কমিটি: লোকসভার ১০ জন সদস্য এবং রাজ্যসভার ৫ জন সদস্যকে নিয়ে সরকারি উদ্যোগাধীন প্রতিষ্ঠান-সম্পর্কিত কমিটি (Committee on Public Undertaking) গঠিত হয়। সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে সদস্যরা নির্বাচিত হন, এক- পঞ্চমাংশ সদস্য প্রতি বছর অবসর গ্রহণ করে থাকেন। এই কমিটির প্রধান কাজ হল সরকারি উদ্যোগাধীন প্রতিষ্ঠানগুলির হিসাবপত্র পরীক্ষা করা, এই প্রতিষ্ঠানগুলির সম্পর্কে ব্যয়-নিয়ন্ত্রক ও মহাগণনা পরীক্ষকের রিপোর্ট পরীক্ষা করা, সরকারি উদ্যোগাধীন প্রতিষ্ঠানগুলি সঠিক বাণিজ্যিক নীতি অনুসারে পরিচালিত হচ্ছে কি না ইত্যাদি দেখা।

[12] গ্রন্থাগার-সংক্রান্ত কমিটি: স্পিকার কর্তৃক মনোনীত লোকসভার ৫জন সদস্য এবং রাজ্যসভার ৪ জন সদস্যকে নিয়ে গ্রন্থাগার-সংক্রান্ত কমিটি (Library Committee) গঠিত হয়। লোকসভার ডেপুটি স্পিকার পদাধিকার বলে এই কমিটির সভাপতি নিযুক্ত হন। কমিটির প্রধান কাজ হল পার্লামেন্টের গ্রন্থাগার-সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয়ের তত্ত্বাবধান এবং গ্রন্থাগারের উন্নতি সম্পর্কে লোকসভার কাছে সুপারিশ করা।

[13] সদস্যদের বেতন ও ভাতা-সংক্রান্ত যুগ্ম কমিটি: স্পিকার কর্তৃক মনোনীত লোকসভার ১৫ জন সদস্য এবং রাজ্যসভার ৫ জন সদস্যকে নিয়ে পার্লামেন্টের সদস্যদের বেতন ও ভাতা-সংক্রান্ত যুগ্ম কমিটি (Committee on Salaries and Allowances of Members of the Parliament) গঠিত হয়। সদস্যদের বেতন, ভাতা ইত্যাদি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করা কমিটির প্রধান কাজ।

[14] কক্ষ-সংক্রান্ত কমিটি: লোকসভার সদস্যদের বাসস্থানের ব্যবস্থাসহ অন্যান্য সুযোগসুবিধার বিষয় পরীক্ষা করে দেখার জন্য কক্ষ-সংক্রান্ত কমিটি (House Committee) গঠিত হয়। স্পিকার কর্তৃক মনোনীত মোট ১২ জন সাংসদ নিয়ে ১ বছরের কার্যকালের মেয়াদে এই কমিটি গঠিত হয়।

লোকসভার অস্থায়ী কমিটি

লোকসভার অস্থায়ী কমিটিগুলির মধ্যে রয়েছে- [1] সিলেক্ট কমিটি (Select Committee) ও [2] অনুসন্ধান কমিটি (Committee on Inquiry)।

[1] সিলেক্ট কমিটি: লোকসভায় কোনো বিল বিচারবিবেচনার জন্য সিলেক্ট কমিটি (Select Committee)-তে প্রেরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে এই কমিটি গঠিত হয়। বিলের প্রস্তাবক কমিটি সদস্যদের নাম প্রস্তাব করে থাকেন। স্পিকার কমিটির সদস্যদের মধ্যে থেকে একজনকে সভাপতি হিসেবে মনোনীত করেন। কমিটির প্রধান কাজ হল সংশ্লিষ্ট বিলটির বিভিন্ন ধারা-উপধারা পরীক্ষা করে দেখে প্রয়োজন মনে করলে কিছু অংশের পরিবর্তন বা নতুন কোনো প্রস্তাব সংযোজন সম্পর্কে লোকসভার কাছে সুপারিশ করা। প্রসঙ্গত বলা যায়, রিপোর্ট পেশ করার পর কমিটির কার্যকাল শেষ হয়ে যায়।

[2] অনুসন্ধান কমিটি: কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে অনুসন্ধান করে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য এই কমিটি গঠিত হয়। বিশেষ কোনো ব্যাপারে অনুসন্ধানের কাজ শেষ করার পর তা নিয়ে লোকসভার কাছে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করা অনুসন্ধান কমিটি (Committee on Inquiry)-র প্রধান কাজ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রিপোর্ট পেশের পর কমিটির কার্যকাল শেষ হয়।

প্রশ্ন 12 ভারতীয় পার্লামেন্ট কোন্ কোন্ উপায়ে মন্ত্রীপরিষদকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে?

উত্তর:  পার্লামেন্ট কর্তৃক মন্ত্রীপরিষদ নিয়ন্ত্রণ

ভারতে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে। সংসদীয় শাসনব্যবস্থার অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে মন্ত্রীপরিষদকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা সংসদ বা পার্লামেন্টের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। ভারতের পার্লামেন্ট যেসব উপায়ে মন্ত্রীপরিষদকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম সেগুলি এই প্রসঙ্গে পর্যায়ক্রমে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে-

[1] পার্লামেন্টের সদস্য হওয়ার বাধ্যবাধকতা: সংসদীয় শাসনব্যবস্থার রীতি অনুযায়ী মন্ত্রীপরিষদের সদস্যদের পার্লামেন্টের যে-কোনো কক্ষের সদস্য হতে হয়। অবশ্য পার্লামেন্টের কোনো কক্ষের সদস্য নন, এমন ব্যক্তিও মন্ত্রীসভার সদস্য হিসেবে নিযুক্ত হতে পারেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ৬ মাসের মধ্যে অতি অবশ্যই পার্লামেন্টের সদস্যরূপে নির্বাচিত হতে হয়। কাজেই মন্ত্রীপরিষদের সদস্যদের পার্লামেন্টের সদস্য হওয়া বাধ্যতামূলক। ভারতীয় সংসদকে নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়ে মন্ত্রীপরিষদের এটি একটি অপরিহার্য শর্ত।

[2] সরকারের আয়ব্যয়ের ওপর সংসদীয় নিয়ন্ত্রণ: সংসদীয় শাসনব্যবস্থার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল সরকারি আয়ব্যয়ের ওপর আইনসভার সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ। ভারতে সরকারি আয়ব্যয়ের ওপর পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণকে সংবিধানে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। পার্লামেন্টের প্রণীত আইনের সমর্থন ছাড়া সরকার কোনোপ্রকার কর ধার্য বা প্রচলিত করের হার পরিবর্তন বা বিলোপ করতে পারে না। সরকারের ব্যয়-সংক্রান্ত বিষয়টিও পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণাধীনে রাখা হয়েছে। ২৬৩ (৩) নং ধারায় সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, পার্লামেন্টের আইনি অনুমোদন ছাড়া ভারতের সঞ্চিত তহবিল থেকে সরকার কোনো অর্থ ব্যয় করতে পারবে না।

[3] মন্ত্রীসভা নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন পদ্ধতি: ভারতীয় সংবিধানের বিধি অনুসারে মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্ত বা নীতিকে বিধিবদ্ধ রূপ দেওয়ার জন্য পার্লামেন্টের অনুমোদন আবশ্যক। মন্ত্রীসভাকে অন্য যেসব উপায়ে পার্লামেন্ট নিয়ন্ত্রণ করে থাকে তার মধ্যে রয়েছে-অধিবেশন চলাকালীন মন্ত্রীদের প্রশ্ন-জিজ্ঞাসা, রাষ্ট্রপতির ভাষণে উল্লিখিত সরকারি নীতি ও কর্মসূচি নিয়ে তর্কবিতর্ক, সরকারের প্রস্তাবিত বাজেটের ত্রুটিবিচ্যুতির ওপর সমালোচনা, বিল নিয়ে আলোচনার সময় প্রস্তাব উত্থাপন, কোনো গুরুত্বপূর্ণ জরুরি বিষয়ে আলোচনার জন্য মুলতুবি প্রস্তাব আনয়ন, দৃষ্টি-আকর্ষণী নোটিশ দিয়ে নিন্দাসূচক প্রস্তাব বা সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন। এ ছাড়া বর্তমানে আইনসভার কাজকর্মের পরিধি বৃদ্ধি পাওয়ায় পার্লামেন্টের সদস্যদের নিয়ে গঠিত

কমিটিগুলির মাধ্যমে মন্ত্রীসভাকে কাজকর্ম সম্পাদন করতে হয়। বলা বাহুল্য যে, এর ফলে পার্লামেন্ট মন্ত্রীসভার ওপর তার নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারে।

[4] পার্লামেন্টের কাছে মন্ত্রীপরিষদের দায়বদ্ধতা: সংসদীয় কাঠামোর রীতি অনুযায়ী পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সদস্যদের নিয়েই মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন এই মন্ত্রীসভা হল দেশের শাসন বিভাগের কর্ণধার। সংবিধান অনুসারে, সমগ্র মন্ত্রীসভাকে তার নীতি ও কাজকর্মের জন্য পার্লামেন্টের কাছে, বিশেষত লোকসভার কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হয়। লোকসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থনের ওপর মন্ত্রীসভার কার্যকাল নির্ভর করে। সংসদীয় শাসনব্যবস্থার এটি একটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।

মূল্যায়ন: তত্ত্বগতভাবে মন্ত্রীপরিষদকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে পার্লামেন্টের ক্ষমতা থাকলেও, বাস্তবে কার্যত পার্লামেন্টের ক্ষমতা ও কাজকর্মকে নিয়ন্ত্রণ করে মন্ত্রীসভা বা ক্যাবিনেট। সংসদীয় শাসনব্যবস্থার সাম্প্রতিক প্রবণতা অনুযায়ী ভারতে বর্তমানে ক্যাবিনেটের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তা ছাড়া দলব্যবস্থার প্রচলনের ফলে মন্ত্রীসভা খুব সহজেই পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভার ওপর তার প্রভাব বজায় রাখতে সক্ষম হয়। কারণ লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা জোটের নেতা বা নেত্রীদের নিয়ে মন্ত্রীসভা গঠিত হয়ে থাকে। এজন্য দলীয় নেতৃত্বের বিরোধিতা করা থেকে সাধারণ সদস্যরা বিরত থাকেন। এ ছাড়া সংবিধান অনুযায়ী মন্ত্রীসভার কোনো প্রস্তাব লোকসভায় বাতিল হয়ে গেলে সমগ্র মন্ত্রীসভাকে পদত্যাগ করতে হয়। সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী লোকসভা ভেঙে দেওয়ার সুপারিশ করেন, তার ফলে সদস্যদের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। অনেক সময় প্রধানমন্ত্রী নিজে সমগ্র মন্ত্রীসভার তরফ থেকে পদচ্যুতির ভয় দেখিয়েও পার্লামেন্টকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এসব কারণে বাস্তবে পার্লামেন্টের ওপর মন্ত্রীসভার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে-একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। অবশ্য সাম্প্রতিককালে লোকসভা নির্বাচনে কোনো দল এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে না পারায় ন্যূনতম অভিন্ন কর্মসূচির ভিত্তিতে কেন্দ্রে বিভিন্ন দলের জোট বা মোর্চা সরকার গঠনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রীসভাকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে পার্লামেন্টের ক্ষমতা ও কাজকর্ম নতুন মাত্রা লাভ করেছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ২০০৫ সালে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন সংযুক্ত প্রগতিশীল জোট বা ইউপিএ সরকারের কথা উল্লেখ করা যায়। বামপন্থী দলগুলি এই জোটের শরিক হলেও সরকারে অংশগ্রহণ করেনি। ফলে লোকসভায় বামপন্থী লবিকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার ক্ষমতা নিরঙ্কুশভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। ২০০৫ সালে লোকসভায় গৃহীত ভারতীয় পেটেন্ট বিলটির কথা এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে। লোকসভায় বামপন্থী দলগুলির চাপে ইউপিএ সরকার এই বিলটির প্রয়োজনীয় সংশোধন করতে বাধ্য হয়।

প্রশ্ন 13. ভারতীয় সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা আলোচনা করো।

উত্তর: ভারতীয় সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা

সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বিরোধী দলের ভূমিকা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বিরোধী দল এই ধরনের শাসনব্যবস্থার অপরিহার্য শর্ত হিসেবে বিবেচিত হয়।

সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারি ক্ষমতা দখলের জন্য রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচনি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়। অংশগ্রহণকারী দলগুলির মধ্যে নির্বাচনে যে দল বা দলীয় জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সেই দল বা দলীয় জোট সরকার গঠন করে। অন্যদিকে অবশিষ্ট দলগুলির মধ্যে সর্ববৃহৎ দলটি এককভাবে বা সংখ্যালঘু দলগুলি জোটবদ্ধভাবে সংসদে বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা পালন করে।

বিরোধী দলের গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্ম বা দায়িত্ব

সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বিরোধী দলের বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মৌল দায়িত্ব রয়েছে। এগুলি হল-

[1] সরকারকে সংযত রাখা: বিরোধী দল সংসদে তার ইতিবাচক ভূমিকা পালনের মাধ্যমে সরকারকে সংযত থাকতে বাধ্য করে। এর ফলে গণতন্ত্রের স্বরূপকে অক্ষুণ্ণ রাখা সম্ভব হয়। বিরোধী দল সংসদে প্রস্তাব উত্থাপন, আলাপ- আলোচনা, তর্কবিতর্ক প্রভৃতির মাধ্যমে জনগণের অভিযোগ তুলে ধরে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে। জনবিরোধী কোনো কাজ করে থাকলে সরকারের কড়া সমালোচনা করে বিরোধী দল। সংসদের বাইরে জনসভায় কিংবা সংবাদপত্রে বা প্রচার পুস্তিকায় সরকারি ত্রুটিবিচ্যুতি তুলে ধরে সরকারকে ক্ষমতার অপব্যবহার করতে সক্রিয়ভাবে বাধাদান করে বিরোধী দল। বিরোধী দলের এই ধরনের সক্রিয়তার ফলে সরকার সংযত হয়ে চলতে বাধ্য হয়।

[2] বিকল্প নীতি ও কর্মসূচি ঘোষণা: সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধী দলের মুখ্য উদ্দেশ্য হল সরকারি ক্ষমতা দখল করা। এজন্য বিরোধী দলকে সবসময় সরকার গঠনে প্রস্তুত থাকতে হয়। সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় বিরোধী দল হল বিকল্প সরকার। ব্রিটেনের মতো ভারতে বিরোধী দল কোনো ছায়া ক্যাবিনেট গঠন না করলেও জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সমস্যার প্রশ্নে বিরোধী দলকে বিকল্প নীতি ও কর্মসূচি ঘোষণা করতে হয়। নির্বাচকমণ্ডলী যাতে সাধারণ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলকে পরাজিত করে সরকার পরিবর্তনের পক্ষে রায় দেয়, সেই জন্য বিরোধী দলকে সংসদের অভ্যন্তরে দলীয় বিকল্প নীতি উপস্থাপন করে যুক্তিযুক্তভাবে তা তুলে ধরতে হয়।

[3] জাতীয় সংকটে সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা: সংসদে সরকারি দলের সমালোচনা করা বিরোধী দলের প্রধান কাজ হলেও সংসদীয় কাজকর্ম যাতে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয় সেই জন্য বিরোধী দলকে সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করতে হয়। সরকার এবং বিরোধী দলের মধ্যে সহমতের ভিত্তিতে সংসদীয় গণতন্ত্র সাফল্য লাভ করে এবং সংসদীয় মূল্যবোধ সুরক্ষিত করা সম্ভব হয়। বিতর্ক ও সমালোচনাকে কেন্দ্র করে যাতে অচলাবস্থা সৃষ্টি না হয় সেই জন্য বিরোধী দলকে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে হয়। জাতীয় সংকটের সময় বিরোধী দলকে সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসতে হয়। বস্তুতপক্ষে, ক্ষমতাসীন দলকে যেমন এটা মেনে নিতে হয় যে সরকার-বিরোধী সমালোচনার অধিকার সংখ্যালঘিষ্ঠ বিরোধী দলের আছে, অন্যদিকে তেমনই বিরোধী দলকে এটা উপলব্ধি করতে হয় যে ক্ষমতাসীন দলেরও নির্দিষ্ট নীতি ও কর্মসূচি রূপায়ণের জন্য সুষ্ঠুভাবে সরকার পরিচালনার অধিকার রয়েছে।

[4] ব্যক্তিস্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষা: বিরোধী দল সংসদের অভ্যন্তরে সরকারের কঠোর সমালোচনার মাধ্যমে যেভাবে তার ভূমিকা পালন করে তাকে অনেকে ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভ বলে বর্ণনা করেছেন। বিরোধী দলের মাধ্যমে সংবিধানে উল্লিখিত মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করে। সমালোচনার মাধ্যমে বিরোধী দল সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতাকে রোধ করতে সক্ষম হয়। তাই বিরোধী দলের স্বাধীনতার ওপর কোনো বিধিনিষেধ আরোপিত হলে তাকে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য কবলিত স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ বলে মনে করা হয়। প্রকৃতপক্ষে সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় বিরোধী দলের গুরুত্ব ও তাৎপর্যের স্বীকৃতি অত্যন্ত আবশ্যক।

বিরোধী দলের ভূমিকার তারতম্য

সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রকৃতির তারতম্য অনুযায়ী বিরোধী দলের ভূমিকারও তারতম্য ঘটে। একসময় অধ্যাপক অ্যালান বলের দেওয়া সংজ্ঞা অনুযায়ী ভারতের দলব্যবস্থাকে ‘Dominant Party System’ বা প্রভুত্বকারী দলব্যবস্থা বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। কারণ দীর্ঘকাল যাবৎ ভারতে বিরোধী দলের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত দুর্বল, অন্যদিকে একটিমাত্র রাজনৈতিক দল দীর্ঘদিন সরকারি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেছে। অবশ্য এ কথা সত্যি যে সংসদীয়

গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে বিরোধী দল শক্তিশালী না হলে তা যথার্থ ভূমিকা পালন করতে পারে না। সাম্প্রতিককালে এই অবস্থার পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। ভারতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে সাংবিধানিক ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে এই বিষয়ে সুস্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায়।

[1] শক্তিশালী বিরোধী দলের দীর্ঘকালীন অনুপস্থিতি: ভারতে পার্লামেন্টের প্রথম সাধারণ নির্বাচন হয় ১৯৫২ সালে। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত পনেরো বার লোকসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। লোকসভার প্রথম থেকে অষ্টম সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত পার্লামেন্টে রাজনৈতিক দলগুলির ক্ষমতা দখলের অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ভারতে বহুকাল যাবৎ কোনো শক্তিশালী বিরোধী দলের আবির্ভাব ঘটেনি। কংগ্রেস দলের সাংসদের সংখ্যাধিক্য বিরোধী দলগুলির অস্তিত্বকে দুর্বল করে দিয়েছিল। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, পঞ্চম এবং সপ্তম লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস দল দুই-তৃতীয়াংশ আসন লাভ করে ক্ষমতা দখল করেছে। অষ্টম লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস দল এককভাবে ৪০১টি আসন দখল করে তিন-চতুর্থাংশের অধিক আসন করায়ত্ত করতে সক্ষম হয়। অষ্টম লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে কোনো রাজনৈতিক দল বিরোধী দলের স্বীকৃতি পায়নি।

[2] বিরোধী দলগুলির দুর্বলতা: অষ্টম লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত (ষষ্ঠ বাদে) যা দেখা যায় তা হল, বিরোধী দলগুলির দুর্বলতা এবং অনৈক্যের জন্য ক্ষমতাসীন দল হিসেবে কংগ্রেস তাদের সমালোচনাকে কোনো গুরুত্ব দেয়নি। বরং এটা বলা চলে যে, বিরোধীদের দাবিদাওয়া উপেক্ষিত হয়েছে। বস্তুত স্বাধীনতা লাভের পর অ-কংগ্রেসি দলগুলির মধ্যে ঐক্য ছিল না। তারা কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। ফলশ্রুতিস্বরূপ কংগ্রেস দল নিজেদের ক্ষমতা বজায় রাখতে পেরেছে। ভারতীয় সংসদীয় ব্যবস্থায় বিরোধী দলের ভূমিকা এসময় চোখে পড়েনি। দীর্ঘকালব্যাপী একদলীয় প্রাধান্য এবং নিজেদের অনৈক্য ও দুর্বলতার জন্য বিরোধী দলগুলি সরকারের কাছে যথোচিত মর্যাদা পায়নি।

[3] বিরোধী দলের অবস্থান পরিবর্তন: প্রকৃতপক্ষে নবম লোকসভা নির্বাচনের (১৯৮৯ খ্রি.) পর থেকে সংসদীয় ব্যবস্থায় বিরোধী দলের অবস্থান পরিবর্তিত হতে শুরু করে। কংগ্রেস এই নির্বাচনে পরাজিত হয়। তবে একক বৃহত্তম দল হিসেবে কংগ্রেস দলের নেতা রাজীব গান্ধি সংবিধানসম্মতভাবে বিরোধী দলনেতার স্বীকৃতি লাভ করেন। ভারতীয় জনতা পার্টি ও বামফ্রন্টের সমর্থনে কয়েকটি দলের সম্মিলনে গঠিত রাষ্ট্রীয় মোর্চা বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং-এর নেতৃত্বে মন্ত্রীসভা গঠন করে। এই সময় বিরোধী দলের সর্বপ্রথম একটা শক্তিশালী ও সুসংহত অবস্থান লক্ষ করা যায়। অবশ্য নবম লোকসভায় রাষ্ট্রীয় মোর্চা সরকার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯০ সালে ভি পি সিং সরকার আস্থা ভোটে পরাজিত হলে সরকারের পতন ঘটে।

[4] বৃহত্তম বিরোধী দলের আত্মপ্রকাশ: ১৯৯১ সালে দশম লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস সরকার গঠন করলেও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। পরে অবশ্য কংগ্রেসের সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ২৬৬-এ দাঁড়ায়। দশম লোকসভা নির্বাচনে ১২০টি আসন লাভ করে ভারতীয় জনতা পার্টি বৃহত্তম বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বিজেপির পরিষদীয় দলনেতা হিসেবে অটলবিহারী বাজপেয়ী বিরোধী দলনেতার স্বীকৃতি পান।

[5] ত্রিশঙ্কু সংসদে বিরোধী দল: ১৯৯৬ সালে একাদশতম লোকসভানির্বাচনে সংসদে কোনো দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় হাং পার্লামেন্ট বা ত্রিশঙ্কু  সংসদ গঠিত হয়। রাষ্ট্রপতি ড. শংকরদয়াল শর্মা সংসদের একক বৃহত্তম দল হিসেবে ভারতীয় জনতা পার্টির (মোট আসন ১৮৫) পরিষদীয় দলনেতা অটলবিহারী বাজপেয়ীকে সরকার গঠনে আমন্ত্রণ জানান। সেই সঙ্গে বাজপেয়ী সরকারের শপথ গ্রহণের পর প্রথম অধিবেশনে কংগ্রেস দল (১৪০টি আসন) বিরোধী দল হিসেবে মান্যতা পায় এবং কংগ্রেস দলনেতা পি ভি নরসিমা রাও বিরোধী দলনেতা হিসেবে স্বীকৃতি পান। বাজপেয়ী সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রপতি যুক্তফ্রন্টের নেতা জনতা দলের এইচ ডি দেবগৌড়াকে সরকার গঠনে আমন্ত্রণ জানান এবং ১৯৯৬-এর ১২ জুনের মধ্যে আস্থা ভোট নিতে বলেন। দেবগৌড়া সরকারের আমলে পুনরায় বিরোধী দলের পরিবর্তন ঘটে। ভারতীয় জনতা পার্টি বিরোধী দলের স্বীকৃতি লাভ করে এবং অটলবিহারী বাজপেয়ী বিরোধী দলনেতা হিসেবে স্বীকৃত হন। ১৯৯৮ সালে দ্বাদশ লোকসভা নির্বাচনে শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে কংগ্রেসের আত্মপ্রকাশ ঘটে। যদিও দ্বাদশ লোকসভার মেয়াদ ছিল মাত্র ১৩ মাস, তবুও এই স্বল্প সময়ে বাজপেয়ী সরকারকে শক্তিশালী বিরোধী দলের সম্মুখীন হতে হয়। বর্তমানে পঞ্চদশ লোকসভায় (২০০৯ খ্রি.) বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট শক্তিশালী বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে চলেছে।

উপসংহার: ভারতীয় সংসদীয় ব্যবস্থায় বিরোধী দলের ভূমিকা সাম্প্রতিককালে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। ১৯৯৬ সালের একাদশতম লোকসভা নির্বাচনে, ১৯৯৮ সালে দ্বাদশ লোকসভা নির্বাচনে, ১৯৯৯ সালের ত্রয়োদশ লোকসভা নির্বাচনে, ২০০৪ সালের চতুর্দশ লোকসভা নির্বাচনে এবং সম্প্রতি ২০০৯ সালের পঞ্চদশ লোকসভা নির্বাচনে আঞ্চলিক দলগুলির ভূমিকা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে একদলীয় একাধিপত্যের অবসান ও জোট রাজনীতির সূচনা ঘটেছে। এর ফলে আঞ্চলিক দলগুলি যেভাবে জাতীয় দলগুলির হাত থেকে রাজনৈতিক উদ্যোগ ছিনিয়ে নিয়েছে। তাতে আগামী দিনে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে নিঃসন্দেহে এক নতুন মাত্রা যোগ হতে চলেছে। এই প্রেক্ষাপটে ভারতীয় সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা আরও উজ্জ্বলতর হবে বলে আশা করা যায়।

প্রশ্ন 14. ভারতের পার্লামেন্টে আইন পাসের পদ্ধতি আলোচনা করো।

অথবা, ভারতের সংসদে সাধারণ বিল পাসের পদ্ধতি আলোচনা করো।

অথবা, ভারতীয় পার্লামেন্টে আইন প্রণয়ন পদ্ধতি আলোচনা করো।

উত্তর:  

পার্লামেন্টে সাধারণ বিল পাসের পদ্ধতি ভারতীয় পার্লামেন্টে আইন প্রণয়ন পদ্ধতি

ভারতীয় সংবিধানে ১০৭ নং ধারা থেকে ১২২ নং ধারায় পার্লামেন্টের আইন পাসের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আইন প্রণয়ন পার্লামেন্টের একটি প্রধান কাজ। কোনো কক্ষে বিল উত্থাপন করা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাভ পর্যন্ত বিলকে কয়েকটি পর্যায় অতিক্রম করতে হয়।

সরকারি বা বেসরকারি যে-কোনো বিল উত্থাপনের আগে একটি প্রস্তুতি পর্ব চলে। বেসরকারি বিল উত্থাপনের একমাস আগে একটি নোটিশ দিতে হয়। সংসদের যে-কোনো কক্ষে সাধারণ বিল উত্থাপন করা যায়। বেসরকারি বিলের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কক্ষের অনুমতির প্রয়োজন হয়। সরকারি বিল উত্থাপনের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন সংশ্লিষ্ট দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী। সরকারি বিল উত্থাপন করার আগে সেই সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় ক্যাবিনেট। ক্যাবিনেটের অনুমোদনের পর পার্লামেন্টের সম্মতি গ্রহণের জন্য রাজ্যসভা অথবা লোকসভা যে-কোনো কক্ষে বিলটি উত্থাপিত হয়। একটি সাধারণ বিল সাতটি পর্যায় পার হয়ে আইনে পরিণত হয়।

[1] প্রথম পর্যায়: বিলের প্রথম পর্যায়ে রয়েছে বিল উত্থাপন ও বিলের প্রথম পাঠ। বিলটি যদি লোকসভায় উত্থাপিত হয় তাহলে স্পিকারের কাছে এবং রাজ্যসভায় উত্থাপিত হলে চেয়ারম্যানের কাছে অনুমতি নিয়ে উত্থাপককে সভায় বিল পেশ করতে হয়। এই পর্যায়ে শুধুমাত্র বিলের ‘Title’ বা শিরোনাম পাঠ করা হয়। কোনো আলোচনা বা বিতর্ক এই পর্যায়ে হয় না। তবে উত্থাপক প্রয়োজনবোধে বিলটির উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে পারেন। নিয়মানুসারে উত্থাপিত হওয়ার পর বিলটি সরকারি গেজেটে প্রকাশিত হয়।

[2] দ্বিতীয় পর্যায়: বিল উত্থাপনের কয়েকদিন পর বিলের দ্বিতীয় পাঠ শুরু হয়। এই পর্যায়ে উত্থাপক বিল সম্পর্কে যে-কোনো একটি প্রস্তাব পেশ করতে পারেন। যেমন-

i. বিলটি সভায় বিচারবিবেচনার জন্য গ্রহণ করা হোক,

ii. পার্লামেন্টের সিলেক্ট কমিটিতে বিলটি পাঠানো হোক,

iii. পার্লামেন্টের উভয়কক্ষের যুক্ত কমিটির কাছে বিলটি পাঠানো হোক,

iv. জনসাধারণের মতামত জানার জন্য বিলটি প্রচার করা হোক।

[3] তৃতীয় পর্যায়: বিলের তৃতীয় পর্যায়ে বিলটি নিয়ে সামগ্রিক বিচারবিবেচনা করা হয়। বিলের এই পর্যায়কে কমিটি পর্যায় বলে। কোনো বিল সিলেক্ট কমিটির কাছে পাঠানো হলে সংশ্লিষ্ট বিল নিয়ে কমিটি ব্যাপক আলোচনা করতে পারে, কিন্তু বিলের নীতি বা উদ্দেশ্য পরিবর্তনের ক্ষমতা কমিটির নেই। অবশ্য বিলের কোনো অংশের সংশোধনের জন্য কমিটি তার প্রস্তাব রাখতে পারে। কমিটি প্রয়োজনবোধে বিলের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গ, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির বক্তব্য শুনতে পারে অথবা কোনো সাক্ষ্য গ্রহণ করতে পারে বা বিশেষ কারণে সরকারকে সংশ্লিষ্ট দলিল ও তথ্য পেশ করতেও বলতে পারে। কমিটি সবশেষে বিলটির সম্পর্কে তার সুচিন্তিত মতামত সংসদে উপস্থাপন করে।

[4] চতুর্থ পর্যায়: এই পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট বিলের প্রতিটি ধারা-উপধারা নিয়ে সবিস্তার আলোচনা ও তর্কবিতর্ক হয়। সভার যে-কোনো সদস্য বিলটির ওপর সংশোধনী প্রস্তাব আনতে পারেন। অবশ্য সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপনের কমপক্ষে একদিন আগে সভায় বিজ্ঞপ্তি দিতে হয়। আলোচনা ও তর্কবিতর্কের শেষে বিলের প্রতিটি ধারা ও উপধারা নিয়ে ভোটাভুটির পর বিলের দ্বিতীয় পাঠের সমাপ্তি ঘটে।

[5] পঞ্চম পর্যায়: এই পর্যায়ে বিলের তৃতীয় পাঠ অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় পাঠ শেষ হওয়ার পর যে-কোনো দিন বিলের তৃতীয় পাঠের সূচনা করে সংশ্লিষ্ট কক্ষে বিলটি গ্রহণ করার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়। এই পর্যায়ে বিলের ধারা-উপধারা নিয়ে কোনোরকম আলোচনা বা তর্কবিতর্ক হয় না, এমনকি সংশোধনী প্রস্তাবও উত্থাপন করা যায় না। বিলটি গৃহীত হবে না প্রত্যাখ্যাত হবে তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য বিলটিকে সমর্থন করলে বিলটি গৃহীত হয়। অন্যদিকে সমর্থন না পেলে বিলটি বাতিল বলে গণ্য হয়। এইভাবে বিলটি লোকসভায় গৃহীত হলে স্পিকারকে অথবা রাজ্যসভায় গৃহীত হলে চেয়ারম্যানকে সেই সম্পর্কে সার্টিফিকেট দিতে হয়।

[6] ষষ্ঠ পর্যায়: বিল পাসের ষষ্ঠ পর্যায়ে রয়েছে অপর কক্ষের অনুমোদনের বিষয়টি। বিলটি যে-কোনো একটি কক্ষে গৃহীত হওয়ার পর তা অনুমোদনের জন্য অপর কক্ষে যায়। সেই কক্ষেও বিলটিকে উপরোক্ত পর্যায়গুলি অতিক্রম করতে হয়। কোনোরকম সংশোধনী ছাড়াই বিলটি অপর কক্ষে গৃহীত হলে বিল অনুমোদনের ষষ্ঠ পর্যায় শেষ হয়। অপর কক্ষ অবশ্য বিলে সম্মতি না দিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করতে বা সংশোধনী প্রস্তাব আনতে অথবা ছয় মাসের জন্য আটকে রাখতে পারে। তবে কোনো বিল নিয়ে দুটি কক্ষের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিলে সে সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতি উভয়কক্ষের যৌথ অধিবেশন ডাকতে পারেন। যৌথ অধিবেশনে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে বিলটি অনুমোদিত হয়।

[7] সপ্তম পর্যায়: সপ্তম ও শেষ পর্যায় হল রাষ্ট্রপতির সম্মতি জ্ঞাপনের পর্যায়। পার্লামেন্টের উভয়কক্ষে বিলটি গৃহীত হওয়ার পর তা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়। রাষ্ট্রপতি সংশ্লিষ্ট বিলটিতে সম্মতি দিলে বিলটি তৎক্ষণাৎ আইনে পরিণত হয়। অবশ্য রাষ্ট্রপতির অসম্মতি জানানোর ক্ষমতাও রয়েছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রপতি কোনো বিলকে পুনর্বিবেচনার জন্য পার্লামেন্টের কাছে ফেরত পাঠাতেও পারেন। তবে পার্লামেন্ট সংশ্লিষ্ট বিলটিকে পুনরায় অনুমোদন করে পাঠালে রাষ্ট্রপতি তাতে সম্মতি দিতে বাধ্য থাকেন। এভাবে একটি বিল লোকসভা, রাজ্যসভা ও রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে আইনে পরিণত হয়।

প্রশ্ন 15. সরকারের আয়ব্যয়ের ওপর পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে আলোচনা করো।

উত্তর: সরকারের আয়ব্যয়-সংক্রান্ত বিষয়গুলির ওপর পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ

ভারত সরকারের আয়ব্যয়ের ওপর সংসদীয় নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাকে সংবিধানে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। সরকারি আয়ব্যয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ বলতে রাজস্ব ও আয়ব্যয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণকে বোঝায়। অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো ভারতেও সরকারি আয়ব্যয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা আইনসভা বা পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভার হাতে রয়েছে। জনগণের দ্বারা সরাসরি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত এই জনপ্রিয় কক্ষ সরকারি আয়ব্যয় ও রাজস্বের ওপর কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার এই বিষয়ে কোনো কার্যকর ক্ষমতা নেই। রাজ্যসভায় অর্থ বিল উত্থাপন করা যায় না। সরকারি আয়ব্যয় ও রাজস্ব সংক্রান্ত বিষয়ে রাজ্যসভা শুধুমাত্র মতামত জানাতে পারে। এই মতামত ১৪ দিনের মধ্যে জানাতে হয়। লোকসভা এই মতামত গ্রহণে বাধ্য নয়।

আয়ব্যয় ও রাজস্ব নিয়ন্ত্রণে লোকসভার ক্ষমতা

ভারতের সংবিধান অনুযায়ী লোকসভার হাতে সরকারি আয়ব্যয় ও রাজস্ব নিয়ন্ত্রণের জন্য যেসব ক্ষমতা রয়েছে তা হল-

[1] রাজস্ব নিয়ন্ত্রণ: সংবিধানের ২৬৫ নং ধারায় সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে পার্লামেন্টের প্রণীত আইনের সমর্থন ছাড়া সরকার কোনো প্রকার কর ধার্য বা প্রচলিত করের হার পরিবর্তন অথবা বিলোপ করতে পারবে না।

[2] সরকারি ব্যয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ: সরকারের ব্যয়-সংক্রান্ত বিষয়টিও পার্লামেন্ট বা লোকসভার নিয়ন্ত্রণাধীনে রাখা হয়েছে। সংবিধানের ২৬৬ (৩) নং ধারায় সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, পার্লামেন্টের আইনের অনুমোদন ছাড়া ভারতের সঞ্চিত তহবিল থেকে সরকার কোনো অর্থ ব্যয় করতে পারবে না। সংবিধানের ১১৪(৩) নং ধারা অনুযায়ী পার্লামেন্টের হাতে এই ধরনের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রয়েছে। এরূপ আইনকে বিশেষ রাজস্ব আদায়-সংক্রান্ত আইন বা ‘Appropriation Act‘ বলা হয়। প্রতি বছর পার্লামেন্টকে এই ধরনের আইন পাস করতে হয়। বিনিয়োগ বিল নিয়ে আলোচনা করার সময় দাবিকৃত অর্থের পরিমাণ হ্রাস করার ব্যাপারে ও ব্যয়মঞ্জুরি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের ব্যাপারে পার্লামেন্ট তার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে।

[3] বাজেট অনুমোদন: বাৎসরিক বাজেট পাসের মাধ্যমেও লোকসভা সরকারি আয়ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা ভোগ করে। প্রতি আর্থিক বছরের জন্য সরকারকে লোকসভায় বাজেট পেশ করতে হয়। বাজেটে সরকারি ব্যয়বরাদ্দ ও রাজস্ব-সংক্রান্ত দাবি উল্লেখ করা হয়। পার্লামেন্ট তা অনুমোদন করার পর সেই অনুযায়ী সরকারের আয়ব্যয় পরিচালিত হয়।

[4] অনুদানের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ: অনুদান (Grants) অনুমোদনের মাধ্যমেও পার্লামেন্ট সরকারের অর্থ-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, গণনা অনুদান (Votes on Account), অনুপূরক অনুদান (Supplementary Grants), অতিরিক্ত অনুদান (Additional Grants), প্রত্যয়ানুদান (Votes of Credit), ব্যতিক্রমী অনুদান (Exceptional Grants) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

[5] আয়ব্যয় পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ: সরকারি অর্থ ব্যয়ের সমস্ত খুঁটিনাটি দিকের হিসাবপত্র পরীক্ষা করে দেখা পার্লামেন্টের পক্ষে কার্যক্ষেত্রে সম্ভব নয় বলে তিন ধরনের ব্যবস্থার মাধ্যমে পার্লামেন্ট সরকারের আয়ব্যয় পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে-[i] আনুমানিক ব্যয়- পরীক্ষা কমিটি (Estimates Committee), [ii] সরকারি হিসাব-পরীক্ষা কমিটি (Public Accounts Committee), [iii] ভারতের নিয়ন্ত্রক ও মহাগণনা পরীক্ষক (Controller and Auditor General of India)।

 i.আনুমানিক ব্যয়-পরীক্ষা কমিটি: আনুমানিক ব্যয়-পরীক্ষা কমিটি সরকারের বিভিন্ন বিভাগের আনুমানিক ব্যয়ের হিসাব পর্যালোচনা করে সম্ভাব্য ব্যয়সংকোচ সম্পর্কে লোকসভার কাছে রিপোর্ট পেশ করে। বিভাগীয় প্রশাসনের উন্নতি, দক্ষতা বৃদ্ধি ও পরিচালন ব্যবস্থার সংস্কার সম্পর্কে সুপারিশ পেশ করাও কমিটির একটি অন্যতম কাজ। প্রশাসন পরিচালনার ব্যাপারে নৈপুণ্য নিশ্চিত করে ব্যয়সংক্ষেপের জন্য কমিটি বিকল্প নীতির বিষয়েও সুপারিশ করে থাকে। তা ছাড়া প্রস্তাবিত ব্যয়ের অর্থ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যথাযথভাবে বণ্টিত হয়েছে কি না তা বিচার করে দেখাও কমিটির একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

ii . সরকারি হিসাব-পরীক্ষা কমিটি: পার্লামেন্ট কর্তৃক অনুমোদিত বার্ষিক ব্যয়বরাদ্দ অনুযায়ী সরকারের বিভিন্ন বিভাগ যথাযথভাবে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করেছে কি না, তা পরীক্ষা করে দেখার দায়িত্ব সরকারি হিসাব- পরীক্ষা কমিটির হাতে ন্যস্ত রয়েছে। সরকারি হিসাব-পরীক্ষা কমিটির প্রধান কাজ হল সরকারের যাবতীয় ব্যয় ও আর্থিক লেনদেন পরীক্ষা করে দেখা। ভারত সরকারের বিনিয়োগ, হিসাব এবং নিয়ন্ত্রক ও মহাগণনা পরীক্ষকের রিপোর্ট কমিটি পরীক্ষা করে দেখে। সবদিক বিচারবিবেচনা করার পর কমিটি পার্লামেন্টের কাছে রিপোর্ট পেশ করে। সরকারি ব্যয়ের হিসাব পরীক্ষায় কমিটি সাধারণত যে মূল বিষয়গুলি পর্যালোচনা করে তা হল-① যে উদ্দেশ্য ও যে খাতে পার্লামেন্ট ব্যয় অনুমোদন করেছে তা যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়েছে কি না, ② পার্লামেন্ট যে বিভাগকে যে পরিমাণ অর্থ মঞ্জুর করেছে সেই বিভাগ সেই অর্থ ভারতের সঞ্চিত তহবিল থেকে তুলেছে কি না, ③ কোনো বিভাগ মঞ্জুরিকৃত অর্থের চেয়ে বেশি ব্যয় করেছে কি না, যদি করে থাকে তাহলে তার পেছনে কোনো যুক্তিসংগত কারণ আছে কি না, সরকারের কোনো বিভাগ বরাদ্দকৃত অর্থের অপচয় করেছে কি না।

iii. ভারতের নিয়ন্ত্রক ও মহাগণনা পরীক্ষক: ভারতের নিয়ন্ত্রক ও মহাগণনা পরীক্ষক সরকারি ব্যয়ের হিসাব-পরীক্ষকরূপে মূল দায়িত্ব পালন করেন। সরকারি ব্যয়বরাদ্দের দাবির ভিত্তিতে পার্লামেন্ট কর্তৃক মঞ্জুরীকৃত অর্থ নির্দিষ্ট খাতে ও উদ্দেশ্যে ব্যয় করা হয়েছে কি না, নিয়ন্ত্রক ও মহাগণনা পরীক্ষক তা পরীক্ষা করে দেখে থাকেন। প্রতি বছরের হিসাব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করে দেখার পর তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে রিপোর্ট পেশ করেন। রাষ্ট্রপতি রিপোর্টটি পার্লামেন্টের কাছে পেশ করার ব্যবস্থা করেন। নিয়ন্ত্রক ও মহাগণনা পরীক্ষকের দু-ধরনের দায়িত্ব রয়েছে- ① ভারতের সঞ্চিত তহবিল থেকে আইনের অনুমোদন ছাড়া যাতে কোনো অর্থ ব্যয়িত না হয় তা দেখা, ② সংসদীয় অনুমোদন অনুসারে বিভিন্ন খাতে মঞ্জুরিকৃত অর্থ যথাযথভাবে ব্যয়িত হয়েছে কি না তা পরীক্ষা করা।

সীমাবদ্ধতা

সরকারি আয়ব্যয় নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে লোকসভার ক্ষমতার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। এগুলি হল-

[1] কর ধার্য বা কর হার পরিবর্তনের অক্ষমতা: সরকার প্রস্তাব না করলে

লোকসভা নিজস্ব উদ্যোগে কোনো প্রকার কর ধার্য বা প্রচলিত কর হার পরিবর্তন করতে পারে না। সেই সঙ্গে সরকার কোনো বিষয়ে ব্যয়বরাদ্দের দাবি পেশ না করলে লোকসভা কোনো ব্যয়বরাদ্দ করতে পারে না। তা ছাড়া লোকসভা সরকারের ব্যয়বরাদ্দ দাবির পরিমাণ বাড়াতে পারে না, কমাতে বা প্রত্যাখ্যান করতে পারে মাত্র।

[2] আলোচনার জন্য সময়ের স্বল্পতা: সরকারের ব্যয়বরাদ্দ দাবি নিয়ে আলোচনার জন্য পার্লামেন্টে যে সময় নির্দিষ্ট থাকে তা বিস্তারিত আলোচনার পক্ষে একেবারেই যথেষ্ট নয়। সময়ের অভাবের জন্য লোকসভার স্পিকার গিলোটিন পদ্ধতি প্রয়োগ করে মাত্র একদিনে তাড়াহুড়ো করে অধিকাংশ ব্যয়বরাদ্দের দাবি পাস করার ব্যবস্থা করেন। এভাবে প্রায় বিনা আলোচনায় কোটি কোটি টাকার দাবি অনুমোদিত হয়ে যায়।

[3] সঙ্কিত তহবিলের ব্যবস্থা: সংবিধান অনুযায়ী কতকগুলি ক্ষেত্রে ব্যয়নির্বাহের জন্য ভারতের সঞ্চিত তহবিল থেকে অর্থ প্রদান করার ব্যবস্থা রয়েছে। ওইসব খাতে বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থ ব্যয়ের ব্যাপারে পার্লামেন্টের কোনো অনুমোদনের প্রয়োজন হয় না।

[4] তত্ত্বগত নিয়ন্ত্রণ: আনুমানিক ব্যয়-পরীক্ষা কমিটি, সরকারি হিসাব-পরীক্ষা কমিটি এবং ভারতের নিয়ন্ত্রক ও মহাগণনা পরীক্ষকের মাধ্যমে সরকারি আয়ব্যয়ের ওপর পার্লামেন্টের, বিশেষত লোকসভার যে নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয় তা অনেকটাই তত্ত্বগত। বাস্তবে এই সংস্থাগুলির কোনো কার্যকরী ভূমিকা নেই বলে অনেকে মনে করেন। লোকসভায় আনুমানিক ব্যয়-পরীক্ষা কমিটির রিপোর্টের ওপর কোনো আলোচনা ও বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয় না। তা ছাড়া আনুমানিক ব্যয়-পরীক্ষা কমিটি একটি আর্থিক বছরের আনুমানিক হিসাবপত্রের সমস্ত দিক সবিস্তারে খতিয়ে দেখতে পারে না। সরকারি গাণিতিক কমিটি সংশ্লিষ্ট আর্থিক বছরে সরকারি ব্যয় নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয় না, কারণ অনুমোদিত অর্থ বিভিন্ন খাতে খরচ হয়ে যাওয়ার পর কমিটি কাজ শুরু করে।  এ ছাড়া সরকারি কোনো বিভাগ অপচয় করলে কমিটি সেসম্পর্কে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না।

ভারতের নিয়ন্ত্রক ও মহাগণনা পরীক্ষকের কাজকর্মের মূল্যায়নে দেখা যায়, সরকারি দফতরগুলি সঞ্চিত তহবিল থেকে খুশিমতো অর্থ ব্যয় করে, সে সম্পর্কে তাঁর বিশেষ কিছুই করার থাকে না। তিনি শুধুমাত্র অর্থ ব্যয়িত হওয়ার পর সেই ব্যয় পরীক্ষা করে রাষ্ট্রপতির কাছে রিপোর্ট পেশ করেন।

[5] সদস্যদের উপযুক্ত জ্ঞান এবং সময়ের অভাব: অনেকে মনে করেন বাজেটের মতো জটিল বিষয়কে যথাযথভাবে বিচারবিবেচনা করে দেখার মতো ক্ষমতা লোকসভার সাধারণ সদস্যদের থাকে না। আর্থিক নীতি, বিভিন্ন খাত, উপখাত ইত্যাদির আনুমানিক ব্যয়ের হিসাব নিয়ে পর্যালোচনার জন্য বিশেষীকৃত জ্ঞানের প্রয়োজন হয়। তা ছাড়া সাধারণত সরকারি আয়ব্যয়-সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় আলোচনার জন্য নির্দিষ্ট থাকে মাত্র ২৯ দিন। এই সময়ও যথেষ্ট নয়।

[6] ক্যাবিনেটের নিয়ন্ত্রণ: সবশেষে বলা যায় যে, সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় সংসদ বা পার্লামেন্টের হাতে যে ক্ষমতা থাকে তা চূড়ান্ত নয়। বস্তুত ক্যাবিনেট পার্লামেন্টকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় ক্যাবিনেটের প্রাধান্য একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ভারতেও ক্যাবিনেটের প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পার্লামেন্টে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সেই দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নিয়ে ক্যাবিনেট গঠিত হয়। এই কারণে সরকারি আয়ব্যয়ের বিষয়ে ক্যাবিনেটের পেশ করা প্রস্তাব পার্লামেন্টের অনুমোদন অতি সহজেই লাভ করে।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, সরকারি আয়ব্যয়ের ওপর পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি তত্ত্বগত নয়, এর বাস্তব দিকও আছে। লোকসভায় এই বিষয়ে বিরোধী দলের গঠনমূলক আলোচনা, সদস্যদের তর্কবিতর্ক ইত্যাদি জনমতের ওপর প্রভাব ফেলে। এর গুরুত্ব উপেক্ষা করা যায় না।

প্রশ্ন 16. অর্থ বিল কী? ভারতের পার্লামেন্টে অর্থ বিল কীভাবে পাস করা হয়? অথবা, অর্থ বিল কী? ভারতীয় পার্লামেন্টে বা সংসদে অর্থ বিল পাসের পদ্ধতি আলোচনা করো। 

উত্তর: অর্থ বিলের সংজ্ঞা

সংবিধানের ১১০ নং ধারায় অর্থ বিলের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এই ধারায় উল্লিখিত সাতটি বিষয় বা তার মধ্যে যে-কোনো একটিকে নিয়ে রচিত বিলকে অর্থ বিল বলা হয়। এগুলি হল-

[1] কোনো করধার্য, বিলোপ, প্রত্যাহার, পরিবর্তন ও নিয়ন্ত্রণ,

[2] সরকারি ঋণ গ্রহণ-সম্পর্কিত আইনগত ব্যবস্থা বা গৃহীত ঋণের দায়দায়িত্ব-সম্পর্কিত কোনো আইনের সংশোধন,

[3] ভারতের সঞ্চিত তহবিল বা আকস্মিক ব্যয় তহবিল থেকে অর্থের বিনিয়োগ,

[4] ভারতের সঞ্চিত তহবিল বা আকস্মিক ব্যয় তহবিল থেকে অর্থ প্রদান বা প্রত্যাহার,

[5] কোনো ব্যয়কে ভারতের সঞ্চিত তহবিলের ব্যয় বলে ঘোষণা বা সঞ্চিত তহবিলের ব্যয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি,

[6] রাষ্ট্রের সঞ্চিত তহবিল খাতে অর্থপ্রাপ্তি বা ওই অর্থের তত্ত্বাবধান বা অর্থপ্রদান অথবা কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারগুলির হিসাব পরীক্ষা,

[7] উপরোক্ত বিষয়গুলির সঙ্গে সম্পর্কিত যে-কোনো বিষয়।

অর্থ বিল সম্পর্কে স্পিকারের সিদ্ধান্ত

১১০(২) নং ধারায় বলা হয়েছে যে, জরিমানা বা অন্য কোনো অর্থদণ্ড ধার্য, লাইসেন্স বা সেবার জন্য ফি দাবি বা প্রদান অথবা স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বা সংস্থা কর্তৃক স্থানীয় উদ্দেশ্যে কোনো কর ধার্য, বিলোপ, প্রত্যাহার, কর হার পরিবর্তন বা নিয়ন্ত্রণকে অর্থ বিল বলা যাবে না। কোনো বিল অর্থ বিল কি না তা নিয়ে মতবিরোধ দেখা দিলে লোকসভার স্পিকারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এক্ষেত্রে একটি প্রমাণপত্র স্পিকার দিয়ে থাকেন।

অর্থ সংক্রান্ত বিল

সংবিধানের ১১৭ নং ধারা অনুসারে যেসব বিলের ক্ষেত্রে স্পিকারকে সার্টিফিকেট দিতে হয় না সেগুলি অর্থ সংক্রান্ত বিল। অর্থ সংক্রান্ত বিলের দুটি শ্রেণি রয়েছে- প্রথম শ্রেণিভুক্ত অর্থ-সংক্রান্ত বিল এবং ② দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত অর্থ সংক্রান্ত বিল। প্রথম শ্রেণিভুক্ত অর্থ-সংক্রান্ত বিলে ১১০(১) নং ধারায় বর্ণিত বিষয়গুলি ছাড়াও অন্যান্য আর্থিক বিষয়গুলিকে স্থান দেওয়া হয়েছে। যেমন, কর আরোপ বা বিলোপের প্রস্তাব-সংক্রান্ত কোনো বিলে অন্য কোনো বিষয়ের উল্লেখ থাকলে তাকে প্রথম শ্রেণিভুক্ত অর্থ-সংক্রান্ত বিল বলা হয়। অন্যদিকে, দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত অর্থসংক্রান্ত বিল হল সেইসব সাধারণ বিল যেগুলিকে আইনে পরিণত করে কার্যকর করতে গেলে ভারতের সঞ্চিত তহবিল থেকে অর্থ ব্যয়ের দরকার হয়। প্রথম শ্রেণিভুক্ত অর্থ-সংক্রান্ত বিলের সঙ্গে দুটি ক্ষেত্রে অর্থ বিলের মিল দেখা যায়, যেমন-① অর্থ বিলের মতো এসব বিল রাজ্যসভায় উত্থাপন করা যায় না, শুধুমাত্র লোকসভাতেই উত্থাপন করা যায়, অর্থ বিলের মতো এসব বিল শুধুমাত্র রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে উত্থাপন করা যায়।

অর্থ বিল ও অর্থ সংক্রান্ত বিলের মধ্যে পার্থক্য

অর্থ বিল ও অর্থ সংক্রান্ত বিলের মধ্যে কতকগুলি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্যগুলি হল-

[1] ভারতীয় সংবিধানের ১১০ (১) নং ধারায় বর্ণিত বিষয়গুলির যে-কোনো একটি বা একাধিক বিষয় যে বিলের অন্তর্ভুক্ত থাকে তাকেই শুধুমাত্র অর্থ বিল বলা হয়। অর্থ বিল নিয়ে সংশয় দেখা দিলে লোকসভায় স্পিকারকে সার্টিফিকেট দিতে হয়। কিন্তু অর্থ সংক্রান্ত বিলের ক্ষেত্রে এই ধরনের প্রক্রিয়ার প্রয়োজন হয় না।

[2] প্রথম শ্রেণিভুক্ত অর্থ সংক্রান্ত বিলগুলিকে সংশোধন ও প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতা রাজ্যসভার রয়েছে। সাধারণ বিল পাসের পদ্ধতি এই ধরনের বিলের ক্ষেত্রেও অনুসৃত হয়। কিন্তু অর্থ বিলের ক্ষেত্রে রাজ্যসভার হাতে সংশোধন ও প্রত্যাখ্যান করার কোনো ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। অর্থ বিলের ব্যাপারে লোকসভার একক প্রাধান্য স্বীকৃত হয়েছে।

[3] দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত অর্থ সংক্রান্ত বিল সাধারণ বিলের মতোই পার্লামেন্টের যে-কোনো কক্ষে উত্থাপিত হতে পারে। এই ধরনের বিলে অর্থ বিলের কোনো বিষয় লিপিবদ্ধ থাকে না। এই ধরনের বিল পাসের ক্ষেত্রে লোকসভার সঙ্গে রাজ্যসভারও সমান ক্ষমতা রয়েছে। রাজ্যসভা এই

ধরনের বিল উত্থাপন, সংশোধন বা প্রত্যাখ্যান করতে পারে। তবে এই সব বিল আইনে পরিণত হলে ভারতের সঞ্চিত তহবিল থেকে অর্থব্যয়ের সংস্থান রাখা হয়। এই কারণে এই সব বিল উত্থাপনে রাষ্ট্রপতির সুপারিশ আবশ্যিক। দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত অর্থ সংক্রান্ত বিল পাসের পদ্ধতি সাধারণ বিল পাসের পদ্ধতির মতোই।

অর্থ বিল পাসের পদ্ধতি

পার্লামেন্টে অর্থ বিল পাসের পদ্ধতি সম্বন্ধে ১০৯ নং ধারায় আলোচনা করা হয়েছে। আইনে পরিণত হওয়ার আগে অর্থ বিলকে তিনটি পর্যায় অতিক্রম করতে হয়-

[1] অর্থ বিল শুধুমাত্র লোকসভাতেই উত্থাপন করা যায়। রাজ্যসভায় কোনো অর্থ বিল উত্থাপন করা যায় না। রাষ্ট্রপতির সুপারিশে শুধুমাত্র মন্ত্রীরা এই অর্থ বিল উত্থাপন করেন। সাধারণ বিল পাসের জন্য প্রতিটি বিলকে যেভাবে প্রথম ও দ্বিতীয় পাঠ, কমিটি পর্যায়, তৃতীয় পাঠ প্রভৃতি পর্যায় অতিক্রম করতে হয় অর্থ বিলের ক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটে।

[2] অর্থ বিল লোকসভায় গৃহীত হলে তা রাজ্যসভার কাছে সুপারিশের জন্য পাঠানো হয়। অর্থ বিলকে প্রত্যাখ্যান বা সংশোধন করার কোনো ক্ষমতা রাজ্যসভার নেই। রাজ্যসভাকে ১৪ দিনের মধ্যে সুপারিশসহ অর্থ বিল লোকসভায় পাঠিয়ে দিতে হয়। ওই সময়ের মধ্যে যদি বিলটি ফেরত না আসে তাহলে ধরে নেওয়া হয় যে পার্লামেন্টের উভয়কক্ষে বিলটি গৃহীত হয়েছে। অর্থাৎ, ১৪ দিনের বেশি রাজ্যসভা কোনো অর্থ বিলকে আটকে রাখতে পারে না।

[3] পার্লামেন্টে অর্থ বিল গৃহীত হওয়ার পর তা রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য পাঠানো হয়। রাষ্ট্রপতি কোনো অর্থ বিলকে পুনর্বিবেচনার জন্য পার্লামেন্টে ফেরত পাঠাতে পারেন না। অর্থ বিলে রাষ্ট্রপতির সম্মতি গ্রহণের বিষয়টি একটি নিছক আনুষ্ঠানিক ব্যাপারমাত্র।

মূল্যায়ন: ভারতে অর্থ বিল অনুমোদনের ব্যাপারে লোকসভার সামগ্রিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু লোকসভার এই প্রাধান্য মন্ত্রীপরিষদ-চালিত সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বহুলাংশে তত্ত্বগত বলে অনেকে মনে করেন। বস্তুত, অর্থ বিল সম্পর্কিত লোকসভার আলোচনা আনুষ্ঠানিক প্রকৃতির। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলীয় সদস্যরা মন্ত্রীদের উত্থাপিত অর্থ বিল কার্যত বিনা আলোচনায় পাস করানোর জন্য তৎপর থাকেন। তা ছাড়া অর্থ বিল নিয়ে আলোচনার জন্য বরাদ্দ সময় অত্যন্ত অল্প। তা ছাড়া অর্থ বিলের প্রকৃতি এমনিতেই জটিল হওয়ায় তা আলোচনার জন্য যে ধরনের বিশেষীকৃত জ্ঞানের প্রয়োজন হয়, অধিকাংশ সদস্যদের তা নেই। প্রকৃতপক্ষে, অর্থ বিলের বিষয়ে লোকসভার পরিবর্তে প্রধানত মন্ত্রীসভা যাবতীয় কর্তৃত্ব ভোগ করে থাকে।

প্রশ্ন17. ভারতের পার্লামেন্টে সরকারি হিসাব-পরীক্ষা কমিটির গঠন ও কার্যাবলি আলোচনা করো।

উত্তর: সরকারি হিসাব-পরীক্ষা কমিটির গঠন

ভারতে সরকারি হিসাব-পরীক্ষা কমিটির প্রর্বতন হয় ১৯২৩ সালে। পরবর্তীকালে স্বাধীনতা লাভের পর সরকারি হিসাব-পরীক্ষা কমিটি সংসদীয় কমিটিগুলির মধ্যে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কমিটির স্বীকৃতি লাভ করে। বর্তমানে সরকারি হিসাব-পরীক্ষা কমিটির মোট সদস্যসংখ্যা ২২ এর মধ্যে ১৫ জন সদস্য একক হস্তান্তরযোগ্য প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে লোকসভা কর্তৃক নির্বাচিত হন এবং অবশিষ্ট ৭ জন রাজ্যসভা কর্তৃক সহযোগী সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। সদস্যদের কার্যকালের মেয়াদ ১ বছর। সংসদীয় প্রথা অনুসারে লোকসভার অধ্যক্ষ বিরোধী পক্ষের নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে থেকে একজনকে কমিটির সভাপতি হিসেবে মনোনীত করেন।

সরকারি হিসাব-পরীক্ষা কমিটির কার্যাবলি

পার্লামেন্টের অনুমোদিত বার্ষিক ব্যয়বরাদ্দ অনুসারে সরকারের বিভিন্ন দফতর যথাযথভাবে অর্থ ব্যয় করছে কি না তা পরীক্ষা করে দেখার দায়িত্ব সরকারি হিসাব-পরীক্ষা কমিটির হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ভারত সরকারের বিনিয়োগ হিসাব ও ব্যয়- নিয়ন্ত্রক এবং মহাগণনা পরীক্ষকের রিপোর্ট খতিয়ে দেখাই হল এই কমিটির মূল কাজ। কমিটি সব কিছু পর্যালোচনা করে দেখার পর পার্লামেন্টের কাছে রিপোর্ট পেশ করে থাকে। এই রিপোর্ট তৈরি করার সময় প্রধানত যেসব বিষয়ের ওপর সরকারি হিসাব-পরীক্ষা কমিটিকে নজর রাখতে হয়, সেগুলি হল-

[1] পার্লামেন্ট যে বিভাগকে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করেছে সেই বিভাগের আধিকারিকরা সরকারি কাজে খরচ করার উদ্দেশ্যে সেই অর্থ ভারতের সঞ্চিত তহবিল থেকে তুলেছেন কি না,

[2] পার্লামেন্ট যে উদ্দেশ্যে অর্থ বরাদ্দ করেছে, সেই উদ্দেশ্যের বাস্তবায়নের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ খরচ হয়েছে কি না,

[3] কোনো বিভাগ বরাদ্দকৃত অর্থের অতিরিক্ত খরচ করেছে কি না এবং যদি তা করে থাকে তবে সেই অতিরিক্ত অর্থ খরচের পেছনে কোনো যুক্তিসংগত কারণ আছে কি না,

[4] সরকারের কোনো বিভাগ বা দফতর সরকারি অর্থের অপচয় করেছে কি না।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সরকারি হিসাব-পরীক্ষা কমিটির অধিবেশনে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের সচিবরা উপস্থিত থেকে তাঁদের নিজ নিজ বিভাগ সম্পর্কে কমিটির যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য থাকেন। ব্যয় নিয়ন্ত্রক ও মহাগণনা পরীক্ষকের অধীনস্থ বিশেষজ্ঞরা কমিটির কাজকর্মে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করেন।

পার্লামেন্টে রিপোর্ট পেশ

সরকারি হিসাব-পরীক্ষা কমিটি সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থের ব্যয় পরীক্ষা করে দেখার পর সেসম্পর্কে বিস্তারিত রিপোর্ট পার্লামেন্টের কাছে উপস্থাপিত করে। কমিটির রিপোর্টের প্রতিলিপি প্রত্যেক সদস্যকে বিলি করা হয়। কমিটির রিপোর্ট নিয়ে পার্লামেন্ট আলোচনা করতে পারে। রিপোর্টে সরকারের কোনো বিভাগ সম্পর্কে কমিটির বিরূপ মন্তব্য থাকলে পার্লামেন্টে বিরোধী দল বা জোটের সদস্যরা তাকে হাতিয়ার করে সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাতে পারে। এই কারণে সরকারকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ব্যয়-সংক্রান্ত কাজকর্ম করতে হয়। এভাবে সরকারি হিসাব-পরীক্ষা কমিটির রিপোর্ট সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করার কাজে পার্লামেন্টকে সহায়তা করে।

কমিটির সীমাবদ্ধতা

সরকারি হিসাব-পরীক্ষা কমিটির কাজকর্মের সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। এগুলি হল-

[1] কমিটি শুধুমাত্র সরকারের খরচ করে ফেলা অর্থের পর্যালোচনা করে দেখে। এক্ষেত্রে কোনো অপচয় হয়ে থাকলে কমিটি অপচয় রোধে সেই মুহূর্তে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। এই কারণে অনেকে কমিটির কাজকে পোস্ট মর্টেম বা ময়নাতদন্ত বলে অভিহিত করেছে।

[2] কোনো বিষয়ের ওপর নির্দিষ্ট ব্যয়কে বাতিল করার ক্ষমতা কমিটির নেই। কমিটি শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট ব্যয়ের ত্রুটিবিচ্যুতিগুলি তুলে ধরে মন্তব্য করতে পারে।

[3] সরকারি অর্থ ব্যয় সংক্রান্ত নীতি সম্পর্কে কমিটি কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারে না। কমিটির কাজ ব্যয়ের পদ্ধতির ক্ষেত্রে সীমিত।

[4] বিভাগীয় প্রশাসন সম্পর্কে কমিটি কোনো পর্যালোচনা করতে পারে না।

[5] কমিটির রিপোর্ট খুঁটিয়ে দেখার মতো সময় বা ইচ্ছা পার্লামেন্টের থাকে না।

মূল্যায়ন: সরকারি হিসাব-পরীক্ষা কমিটির ভূমিকা উপেক্ষণীয় নয়। অনেকের মতে, সরকারের আয়ব্যয়-সম্পর্কিত ত্রুটিবিচ্যুতি পরীক্ষার মাধ্যমে এই ধরনের কমিটি সরকারকে সংযত থাকতে বাধ্য করে। সরকারি অর্থের ব্যয় সংক্রান্ত পরীক্ষার কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনা করে কমিটি শাসন বিভাগের কাজকর্মের উৎকর্ষতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। বস্তুত, কমিটির সুপারিশ ও সমালোচনা তৎকালীন আর্থিক বছরে সরকারি ব্যয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলেও পরবর্তী আর্থিক বছরে সরকারি ব্যয়ের ওপর তার প্রভাব পড়ে। তা ছাড়া পার্লামেন্টের কাছে পেশ করা কমিটির রিপোর্ট সরকারের ওপর যে নৈতিক চাপ সৃষ্টি করে। তার একটা ইতিবাচক দিকও রয়েছে। সর্বোপরি এটা মনে করা হয়, কমিটি সরকারের বিভিন্ন বিভাগকে মিতব্যয়ী হতে সচেতন করে।

প্রশ্ন 18. রাজ্য বিধান পরিষদের গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনা করো।

উত্তর: রাজ্য বিধান পরিষদের গঠন

ভারতীয় অঙ্গরাজ্যের দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার উচ্চকক্ষকে বিধান পরিষদ বলা হয়।

[1] সদস্যসংখ্যা: সংবিধানের ১৭১ নং ধারায় বিধান পরিষদের গঠন সম্পর্কে বলা হয়েছে। বিধান পরিষদের সদস্যসংখ্যা সংশ্লিষ্ট রাজোর বিধানসভার সদস্যসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের বেশি হবে না। অবশ্য ১৭১(১) নং ধারায় এ কথা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, বিধান পরিষদের মোট সদস্যসংখ্যা কোনো অবস্থাতেই ৪০-এর কম হবে না।

[2] সদস্য নির্বাচন ও মনোনয়ন: রাজ্য বিধান পরিষদ একই সঙ্গে নির্বাচিত ও মনোনীত-উভয় ধরনের সদস্যদের নিয়ে গঠিত। সাধারণত পরিষদের ছয় ভাগের মধ্যে পাঁচ ভাগ সদস্য পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হন এবং অবশিষ্ট এক ভাগ সদস্য রাজ্যপাল কর্তৃক মনোনীত হন। বিধান পরিষদের ① এক-তৃতীয়াংশ সদস্য পুরসভা, জেলা পরিষদ এবং অন্যান্য স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনমূলক প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হন, প্রায় এক তৃতীয়াংশ সদস্য রাজ্য বিধানসভার সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হন, ③ অন্যদিকে, প্রায় এক-দ্বাদশাংশ সদস্যকে তিন বছর আগে যাঁরা স্নাতক হয়েছেন তাঁরা নির্বাচন করেন, ④ প্রায় এক-দ্বাদশাংশ সদস্য অন্ততপক্ষে তিন বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মাধ্যমিক এবং উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির শিক্ষকদের দ্বারা নির্বাচিত হন, ⑤ অবশিষ্ট সদস্য মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাজ্যপাল কর্তৃক মনোনীত হন।

[3] কার্যকাল: রাজ্য আইনসভার স্থায়ী কক্ষরূপে গণ্য হওয়ায় বিধন পরিষদকে ভেঙে দেওয়া যায় না। বিধান পরিষদের সদস্যদের কার্যকালের মেয়াদ ছয় বছর, প্রতি দুই বছর অন্তর এক-তৃতীয়াংশ সদস্য অবসর নেন।

[4] সভাপতি ও সহসভাপতি: বিধান পরিষদের কাজকর্ম পরিচালনার জন্য সদস্যরা নিজেদের মধ্যে থেকে একজন সভাপতি এবং একজন সহসভাপতি | নির্বাচন করেন। সভাপতির অনুপস্থিতিতে সহসভাপতি সভার কাজকর্ম পরিচালনা করে থাকেন। কোনো প্রস্তাব বা বিলের ওপর ভোটাভুটির সময় সভাপতিকে নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে চলতে হয়। তবে পক্ষে ও বিপক্ষে সমান সংখ্যক ভোট পড়লে তাঁর নির্ণায়ক ভোট দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। বিধান পরিষদে ১৪ দিনের নোটিশ দিয়ে প্রস্তাব উত্থাপন করে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থনে সভাপতি অথবা সহসভাপতিকে পদচ্যুত করা যায়।

রাজ্য বিধান পরিষদের ক্ষমতা ও কার্যাবলি

বিধান পরিষদের ক্ষমতা ও কার্যাবলি অত্যন্ত সীমিত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-

[1] অর্থ বিল ছাড়া অন্য যে-কোনো বিল বিধান পরিষদে উত্থাপন করা যায়। সংবিধান-বিশেষজ্ঞদের মতে, আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ভারতীয় পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভা যে ধরনের ক্ষমতা ভোগ করে বিধান পরিষদের হাতে তেমন কোনো ক্ষমতা নেই।

[2] রাজ্য আইনসভার উচ্চকক্ষ বিধান পরিষদের আর্থিক ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত। কোনো অর্থ বিল বিধান পরিষদে উত্থাপন করা যায় না। বিধানসভা কর্তৃক গৃহীত অর্থ বিল বিধান পরিষদে পাঠানো হলে ১৪ দিনের মধ্যে সুপারিশসহ বা সুপারিশ ছাড়া বিলটিকে বিধানসভার কাছে ফেরত দিতে বিধান পরিষদ বাধ্য থাকে। বিধান পরিষদের সুপারিশ মানতে বিধানসভা বাধ্য নয়।

[3] রাজ্যের শাসন বিভাগ বা মন্ত্রীসভাকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনো ক্ষমতা রাজ্য বিধান পরিষদের হাতে দেওয়া হয়নি। অবশ্য বিধান পরিষদের হাতে দৃষ্টি- আকর্ষণী প্রস্তাব উত্থাপন, প্রশ্ন জিজ্ঞাসা ও সমালোচনার ক্ষমতা রয়েছে।

উপসংহার: ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রে রাজ্য আইনসভার উচ্চকক্ষ হিসেবে বিধান পরিষদের যৌক্তিকতা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। এই কারণে পশ্চিমবঙ্গসহ অনেক রাজ্যে বিধান পরিষদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়েছে। বর্তমানে (জানুয়ারি, ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে) মাত্র পাঁচটি রাজ্যে-উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক এবং জম্মু ও কাশ্মীরে বিধান পরিষদের অস্তিত্ব রয়েছে।

প্রশ্ন 19. রাজ্য বিধানসভার গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনা করো। অথবা, ভারতের যে-কোনো অঙ্গরাজ্যের বিধানসভার গঠন ও কার্যাবলি আলোচনা করো।

উত্তর:  বিধানসভার গঠন

রাজ্য আইনসভার জনপ্রতিনিধি কক্ষের নাম হল বিধানসভা। সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে বিধানসভার সদস্যরা জনসাধারণের দ্বারা সরাসরি নির্বাচিত হন। সংবিধানের ১৭০ নং ধারায় বিধানসভা গঠনের বিষয়টি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে-

[1] সদস্যসংখ্যা: সংবিধান অনুযায়ী সর্বাধিক ৫০০ এবং সর্বনিম্ন ৬০ জন সদস্য নিয়ে বিধানসভা গঠিত হয়। তবে পরবর্তীকালে বিভিন্ন সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে কয়েকটি রাজ্যের বিধানসভার সর্বনিম্ন সদস্যসংখ্যা নির্ধারিত হয়েছে, যেমন- সিকিম ৩০ জন, মিজোরাম, অরুণাচল প্রদেশ ও গোয়া- ৪০ জন, নাগাল্যান্ড- ৪৬ জন।

বিধানসভার মোট আসনসংখ্যার মধ্যে তপশিলি জাতি এবং তপশিলি উপজাতিদের জন্য কিছু নির্দিষ্ট সংখ্যক আসন সংরিক্ষত। এ ছাড়া রাজ্যপাল ইঙ্গ-ভারতীয় সম্প্রদায় থেকে একজন সদস্য মনোনয়ন করতে পারেন। এই ব্যবস্থা ২০২০ সালের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বলবৎ করা হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য বিধানসভার নির্বাচিত সদস্যসংখ্যা বর্তমানে ২৯৪। ত্রিপুরা বিধানসভার নির্বাচিত সদস্যসংখ্যা হল ৬০।

[2] কার্যকাল ও অধিবেশন: বিধানসভার সাধারণ কার্যকালের মেয়াদ পাঁচ বছর। রাজ্যপাল রাজ্য বিধানসভার অধিবেশন আহ্বান করেন। সাধারণত বছরে অন্তত দুবার বিধানসভার অধিবেশন ডাকতে হয়। রাজ্যপাল বিধানসভার অধিবেশন স্থগিত রাখতে পারেন বা প্রয়োজন মনে করলে বিধানসভা ভেঙে দিতেও পারেন।

[3] স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার: সংবিধানের ১৭৮ নং ধারা অনুসারে রাজ্য বিধানসভার প্রথম অধিবেশনে সদস্যরা নিজেদের মধ্যে থেকে একজনকে স্পিকার এবং অন্য একজনকে ডেপুটি স্পিকার হিসেবে নির্বাচন করেন। স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারকে তাঁরা প্রয়োজনবোধে পদচ্যুতও করতে পারেন। স্পিকারের অনুপস্থিতিতে ডেপুটি স্পিকার সভার কাজকর্ম পরিচালনা করেন।

বিধানসডার ক্ষমতা ও কার্যাবলি

বিধানসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারে।

[1] আইন প্রণয়ন: সংবিধান অনুযায়ী সমগ্র রাজ্য বা রাজ্যের যে-কোনো অংশের জন্য আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা রাজ্য বিধানসভার রয়েছে। রাজ্য- তালিকাভুক্ত সমস্ত বিষয়ে এককভাবে আইন প্রণয়নের অধিকারী হল বিধানসভা। যুগ্ম-তালিকাভুক্ত বিষয়েও বিধানসভা আইন প্রণয়ন করতে পারে।

[2] শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ: বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা জোটের সদস্যদের নিয়ে রাজ্য মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। রাজ্য মন্ত্রীসভার স্থায়িত্ব বিধানসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থার ওপর নির্ভরশীল। সংসদীয় গণতন্ত্রের নীতি অনুযায়ী, রাজ্য বিধানসভা রাজ্য মন্ত্রীসভার প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করলে মন্ত্রীসভাকে পদত্যাগ করতে হয়।

সংসদীয় গণতন্ত্রে রাজ্যের শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা সর্বতোভাবে বিধানসভা ভোগ করে থাকে। প্রশ্ন জিজ্ঞাসা, মূলতুবি প্রস্তাব উত্থাপন, ছাঁটাই প্রস্তাব উত্থাপন, অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন প্রভৃতির সাহায্যে বিধানসভা রাজ্যের মন্ত্রীসভাকে নিয়ন্ত্রণ করে। রাজ্য মন্ত্রীসভা যৌথভাবে বিধানসভার কাছে দায়বদ্ধ থাকায় মন্ত্রীসভা সমস্ত কাজের জন্য বিধানসভার কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। বিধানসভায় কোনো মন্ত্রীর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হলে সমগ্র মন্ত্রীসভাকে পদত্যাগ করতে হয়। তবে বিধানসভার শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করার এই ক্ষমতা অনেকটাই তাত্ত্বিক, এর সঙ্গে বাস্তবের মিল নেই। বস্তুত, সংসদীয় রাজনীতিতে দলব্যবস্থা কায়েম থাকায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা জোট সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

[3] অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতা: সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতি অনুসারে রাজ্যের অর্থ- সংক্রান্ত যাবতীয় ক্ষমতা একমাত্র বিধানসভার হাতেই রয়েছে। অর্থ বিলের বিষয়ে রাজ্য বিধানসভার স্পিকারকে একটি সার্টিফিকেট দিতে হয়। বাজেট অনুমোদনের মাধ্যমে বিধানসভা রাজ্য সরকারের কর আরোপ, কর সংগ্রহ ও ব্যয়বরাদ্দের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে। বিধানসভার অনুমোদন ছাড়া রাজ্য সরকার কোনো কর আরোপ, কর বিলোপ বা কর হারের পরিবর্তন ঘটাতে পারে না।

[4] সংবিধান সংশোধন: সংবিধান সংশোধনের মূল ক্ষমতা পার্লামেন্টের হাতে থাকলেও রাজ্য বিধানসভার হাতে কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সংবিধান সংশোধন করতে গেলে ২৮টি রাজ্য আইনসভার মধ্যে অন্তত অর্ধেকের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। এই বিষয়গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কেন্দ্র-রাজ্যের ক্ষমতাবণ্টন, রাষ্ট্রপতির নির্বাচন, সুপ্রিমকোর্ট ও হাইকোর্ট-সম্পর্কিত বিষয় প্রভৃতি।

[5] অন্যান্য ক্ষমতা: অন্যান্য যেসব ক্ষমতা বিধানসভার রয়েছে, সেগুলি হল-

i. বিধানসভা বিভিন্ন বিষয়ে সংবাদ ও তথ্য সরবরাহের ব্যাপারে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। বিধানসভায় প্রশ্নোত্তরকালে মন্ত্রীরা যেসব তথ্য জানান তা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ায় জনগণ সেই সব বিষয়ে অবহিত হয়।

ii. বিধানসভার সদস্যরা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ও রাজ্যসভার প্রতিনিধিদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে থাকেন।

iii. রাজ্য-জনপালন কৃত্যক কমিশন এবং রাজ্যের কনট্রোলার ও অডিটর জেনারেলের রিপোর্ট বিধানসভায় পর্যালোচনা করা হয়।

iv. কোনো রাজ্যের নাম বা ভৌগোলিক সীমার পরিবর্তন কিংবা পুনর্গঠনজনিত বিল পার্লামেন্টে উত্থাপিত হওয়ার আগে রাষ্ট্রপতি বিধানসভার সদস্যদের মতামত জেনে নেন।

v.  গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করার ক্ষমতাও বিধানসভার রয়েছে।

প্রশ্ন 20. রাজ্যের আইনসভায় আইন প্রণয়নের পদ্ধতি আলোচনা করো।

উত্তর: রাজ্যের আইনসভায় আইন প্রণয়ন পদ্ধতি

ভারতীয় সংবিধান অনুসারে, রাজ্যগুলির আইনসভার আইন প্রণয়নের পদ্ধতি পার্লামেন্টের আইন প্রণয়ন পদ্ধতির অনুরূপ। রাজ্য আইনসভাগুলি শুধুমাত্র রাজ্য-তালিকা এবং যুগ্ম-তালিকাভুক্ত বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে পারে। সাধারণ বিল রাজ্য আইনসভার দুটি কক্ষের মধ্যে যে-কোনো কক্ষে উত্থাপন করা যায়। তবে যেসব রাজ্যে আইনসভার উচ্চকক্ষ বিধান পরিষদের বিলুপ্তি ঘটানো হয়েছে, সেখানে শুধুমাত্র বিধানসভাতেই সমস্ত বিল উত্থাপিত হয়।

সাধারণ বিল দু-ধরনের হয়-① সরকারি বিল ও② বেসরকারি বিল। সরকারি বিল রাজ্যের মন্ত্রীরা উত্থাপন করেন। অন্যদিকে বেসরকারি বিল বিধানসভার সাধারণ সদস্যরা উত্থাপন করতে পারেন। রাজ্য আইনসভায় একটি বিলকে আইনে পরিণত হতে হলে কয়েকটি পর্যায় অতিক্রম করতে হয়।

[1] প্রথম পর্যায় (প্রথম পাঠ): বিল পাসের প্রথম পর্যায় হল বিল উত্থাপন। অধ্যক্ষ বা স্পিকারের অনুমতি নিয়ে রাজ্য আইনসভার সদস্যরা বিলটি উত্থাপন করেন। এই সময় বিলের ওপর কোনোরকম আলোচনা হয় না। তবে উত্থাপক বিলটির উদ্দেশ্য, প্রকৃতি বা মূলনীতি সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য রাখতে পারেন। উত্থাপনের পর বিলটি সরকারি গেজেটে প্রকাশিত হয়। এইভাবে বিলের প্রথম পর্যায় শেষ হয়।

[2] দ্বিতীয় পর্যায় (দ্বিতীয় পাঠ): প্রথম পর্যায় শেষ হওয়ার কয়েকদিন পর বিলটির দ্বিতীয় পাঠ শুরু হয়। এই পর্যায়ে উত্থাপক বিলটির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কয়েকটি প্রস্তাব পেশ করতে পারেন। যেমন-① সংশ্লিষ্ট কক্ষে বিলটি বিচারবিবেচনা করা হোক। ② বিলটিকে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানো হোক। ③ বিলটির সম্পর্কে জনমত যাচাই করার ব্যবস্থা করা হোক। যদি আইনসভার দ্বিতীয় কক্ষ থাকে, তাহলে উত্থাপক আর-একটি প্রস্তাব পেশ করতে পারেন। সেটি হল দুই কক্ষের যুক্ত কমিটিতে বিলটি পাঠানো হোক।

[3] তৃতীয় পর্যায় (কমিটি পর্যায়): বিলটি নিয়ে সভায় সরাসরি বিচারবিবেচনার সিদ্ধান্ত যদি গৃহীত হয়, তাহলে বিলটির ধারা-উপধারা নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলে। আবার যদি জনমত গ্রহণের জন্য বিলটির প্রচারের প্রস্তাব গৃহীত হয়, তাহলে জনমত নির্ধারণের জন্য তার প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। আবার বিলটিকে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে কয়েকজন সদস্য নিয়ে একটি কমিটি গঠিত হয়। কমিটি সামগ্রিকভাবে বিচারবিবেচনা করে বিলের যে-কোনো অংশ সংশোধন করার জন্য সুপারিশ করতে পারে। অবশ্য কমিটি বিলের মূলনীতি ও উদ্দেশ্য-সংক্রান্ত কোনো অংশের সংশোধনের জন্য সুপারিশ করতে পারে না।

[4] চতুর্থ পর্যায় (রিপোর্ট পর্যায়): কমিটি কর্তৃক তৈরি করা রিপোর্ট আলোচনার জন্য গ্রহণের মাধ্যমে চতুর্থ পর্যায় শুরু হয়। এই পর্যায়ে বিলটির প্রতিটি ধারা-উপধারা নিয়ে খুঁটিনাটি আলোচনা করা হয় এবং প্রতিটি ধারার ওপর ভোট গ্রহণ করা হয়। এই স্তরে সংশোধনী প্রস্তাবও উত্থাপন করা যায়। কিন্তু সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণ করা বা না করা স্পিকারের ইচ্ছাধীন। এইভাবে বিলটির সমস্ত ধারা-উপধারা নিয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত সমাপ্ত হলে বিলের দ্বিতীয় পাঠ শেষ হয়।

[5] পঞ্চম পর্যায় (তৃতীয় পাঠ): পঞ্চম পর্যায়ে প্রস্তাবক সংশ্লিষ্ট কক্ষে বিলটি গ্রহণের জন্য প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এই পর্যায়ে বিলের কোনো ধারা-

উপধারার ওপর সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করা যায় না। বিলটি গৃহীত হবে, ন বর্জন করা হবে, সেই সম্পর্কে এই পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কেবলমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের সম্মতি পেলেই এই পর্যায়ে বিলটি গৃহীত হয়।

[6] ষষ্ঠ পর্যায় (দ্বিতীয় কক্ষের সম্মতি): যে কক্ষে বিলটি উত্থাপি হয়েছিল সেই কক্ষে বিলটি গৃহীত হওয়ার পর বিলটিকে অন্য কক্ষের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। তবে অঙ্গরাজ্যের আইনসভা এককক্ষবিশিষ্ট হলে সেই কক্ষেই বিলটি গৃহীত হয়। রাজ্য আইনসভা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হলে অন্য কক্ষে বিলটি পাসের জন্য আগের মতোই বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করতে হয়।

[7] সপ্তম পর্যায় (রাজ্যপালের সম্মতি): অঙ্গরাজ্যের আইনসভা এককক্ষবিশিষ্ট হলে সেই কক্ষে এবং দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হলে দুটি কক্ষে বিলটি পাস হওয়ার পর তা রাজ্যপালের কাছে পাঠানো হয়। রাজ্যপাল সম্মতি দিলে বিলটি আইনে পরিণত হয়। তিনি সম্মতি দিতে পারেন, আবার নাও দিতে পারেন। আবার প্রয়োজনবোধে বিলটিকে তিনি পুনর্বিবেচনার জন্য আইনসভায় ফেরত পাঠাতে পারেন। তবে বিলটি যদি আইনসভায় দ্বিতীয়বার গৃহীত হয়, তাহলে রাজ্যপাল বিলে সম্মতি দিতে বাধ্য থাকেন। আবার রাজ্যপাল ইচ্ছা করলে বিলটিতে নিজে সম্মতি না দিয়ে তা রাষ্ট্রপতির বিচারবিবেচনার জন্য তাঁর কাছে পাঠিয়ে দিতে পারেন। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির সম্মতি ছাড়া বিলটি আইনে পরিণত হয় না। এইভাবে রাজ্য আইনসভা ও রাজ্যপালের সম্মতিলাভ করলেই সংশ্লিষ্ট বিলটি আইনে পরিণত হয়।

প্রশ্ন 21 রাজ্য আইনসভা কর্তৃক রাজ্য সরকারকে নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি আলোচনা করো।

উত্তর: রাজ্য আইনসভা কর্তৃক রাজ্য সরকার নিয়ন্ত্রণ

ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলিতে কেন্দ্রের মতোই সংসদীয় শাসনব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। সংসদীয় শাসনব্যবস্থার রীতি অনুসারে, কেন্দ্রের আইনসভার মতো রাজ্য আইনসভাও রাজ্যের শাসন বিভাগ বা রাজ্য সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। অবশ্য এই ধরনের ক্ষমতার অধিকারী কেবল রাজ্য বিধানসভা। বিধান পরিষদের এক্ষেত্রে কোনো দায়িত্ব থাকে না। প্রসঙ্গত বলা যায়, ভারতে এখনও ৬টি অঙ্গরাজ্যে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট রাজ্য আইনসভার অস্তিত্ব বজায় আছে। এই রাজ্যগুলি হল-বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক এবং জম্মু ও কাশ্মীরে। যাই হোক, রাজ্য আইনসভা যেভাবে রাজ্য সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তা পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা যেতে পারে।

[1] রাজ্য মন্ত্রীসভা গঠনে রাজ্য আইনসভার ভূমিকা: সংসনীয় শাসনব্যবস্থার বিধি অনুযায়ী রাজ্য আইনসভার নিম্নকক্ষ রাজ্য বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দল বা জোটের নেতা বা নেত্রীকে দিয়ে রাজ মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। রাজ্য মন্ত্রীসভা গঠনে রাজ্য বিধানসভার কার্যকরী ভূমিকা রয়েছে। বস্তুত মন্ত্রীসভা গঠনের পুরো বিষয়টি রাজ্য বিধানসভার ওপর নির্ভরশীল।

[2] রাজ্য বিধানসভায় রাজ্য মন্ত্রীসভার দায়বদ্ধতা: সংসদীয় গণতান্তির ব্যবস্থায় শাসন বিভাগ আইনসভার নিম্নকক্ষের কাছে দায়বদ্ধ থাকে। প্রজাতি সংবিধান অনুসারে, রাজ্য আইনসভার নিম্নকক্ষ বিধানসভার কাছে হাথ মন্ত্রীসভাকে দায়বদ্ধ থাকতে হয়। বস্তুত, রাজ্য বিধানসভার সংখ্যাগরি সদস্যের সমর্থনের ওপরেই রাজ্য মন্ত্রীসভার অস্তিত্ব নির্ভরশীল। এই আ বিধানসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন হারালে মন্ত্রীসভাকে পদত্যাগ প্র হয়। এভাবে রাজ্য আইনসভা রাজ্য সরকারের ওপর কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ প্রতিকার করতে সক্ষম হয়।

[3] সরকারের অর্থ-সংক্রান্ত ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ: কেন্দ্রীয় আইনা মতো রাজ্য আইনসভার হাতে রাজ্য সরকারের অর্থ-সংক্রান্ত আামাতার সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ আরোপের ব্যবস্থা বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। রাজ্য বিদ সম্মতি ছাড়া রাজ্য সরকার কোনো নতুন কর প্রবর্তন, প্রচলিত কর হারের   পরিবর্তন বা কোনো করের বিলোপসাধন বা সরকারি কোশাগার থেকে কোনো প্রকার অর্থ ব্যয় করতে পারে না। সংবিধানের ২৬৬(৩) নং ধারা অনুসারে আইনের সমর্থন ছাড়া ভারতের সঞ্চিত তহবিল থেকে অর্থ ব্যয় করা যায় না। এ ছাড়া বাৎসরিক বাজেট অনুমোদনের মাধ্যমেও রাজ্য আইনসভা রাজ্য সরকারের অর্থ ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সর্বোপরি, বরাদ্দকৃত অর্থ রাজ্য সরকার নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় করেছে কি না তা তদারকি করা এবং সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে অপচয় ও দুর্নীতি প্রতিরোধ করার ক্ষমতা ও দায়িত্ব রাজ্য আইনসভার হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। এসব কাজকর্ম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য কেন্দ্রের মতো রাজ্য আইনসভাতেও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কমিটি রয়েছে। এগুলি হল- ① আনুমানিক ব্যয়-হিসাব কমিটি, ② সরকারি হিসাব-পরীক্ষা কমিটি এবং ③ ভারতের নিয়ন্ত্রক ও মহাগণনা পরীক্ষক।

[4] রাজ্য মন্ত্রীসভাকে নিয়ন্ত্রণ: ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের সংসদীয় ব্যবস্থার রীতি অনুযায়ী কেন্দ্রের মতো রাজ্যেও মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্ত বা নীতিকে বিধিবদ্ধ রূপ দেওয়ার জন্য রাজ্য আইনসভার অনুমোদন আবশ্যক। রাজ্য মন্ত্রীসভাকে অন্যান্য যেসব উপায়ে রাজ্য আইনসভা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, তার মধ্যে রয়েছে-অধিবেশন চলাকালীন মন্ত্রীদের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা, রাজ্যপালের ভাষণে উল্লিখিত সরকারি নীতি ও কর্মসূচি নিয়ে তর্কবিতর্ক, সরকারের প্রস্তাবিত বাজেটের ত্রুটিবিচ্যুতির ওপর সমালোচনা, বিল নিয়ে আলোচনার সময় প্রস্তাব উত্থাপন, গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে আলোচনার জন্য মূলতুবি প্রস্তাব আনয়ন, দৃষ্টি-আকর্ষণী নোটিশ দিয়ে নিন্দাসূচক প্রস্তাব বা সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন প্রভৃতি।

[5] রাজ্য মন্ত্রীসভার যৌথ দায়িত্বশীলতা: সংবিধানের ১৬৪(২) নং ধারা অনুসারে রাজ্য মন্ত্রীসভাকে তার যাবতীয় কাজকর্মের জন্য বিধানসভার কাছে জবাবদিহি করতে হয়। রাজ্য মন্ত্রীসভা কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্তগুলি বিভাগীয় মন্ত্রীরা বিধানসভায় পেশ করেন। এক্ষেত্রে কোনো মন্ত্রীর প্রস্তাব বিধানসভায় প্রত্যাখ্যাত হলে সমগ্র মন্ত্রীসভাকে পদত্যাগ করতে হয়। একে রাজ্য মন্ত্রীসভার যৌথ দায়িত্বশীলতা বলা হয়।

মূল্যায়ন: তত্ত্বগতভাবে রাজ্য সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে রাজ্য আইনসভার উল্লিখিত ক্ষমতা থাকলেও বাস্তবে রাজ্য আইনসভার ক্ষমতা ও কাজকর্মকে নিয়ন্ত্রণ করে রাজ্য-মন্ত্রীসভা বা ক্যাবিনেট। সংসদীয় শাসনব্যবস্থার সাম্প্রতিক প্রবণতা অনুযায়ী ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলিতেও ক্যাবিনেটের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তা ছাড়া দলব্যবস্থার প্রচলনের ফলে রাজ্য বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দলের প্রতিনিধি হিসেবে রাজ্য মন্ত্রীসভা খুব সহজেই বিধানসভায় তাদের প্রভাব বজায় রাখতে সক্ষম হয়। বিধানসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে মন্ত্রীদের কথা বিধানসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা মেনে চলতে বাধ্য হন। এই কারণে বলা যায়, তত্ত্বগতভাবে রাজ্য বিধানসভার হাতে রাজ্য সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা থাকলেও কার্যত রাজ্য মন্ত্রীসভা বা ক্যাবিনেট রাজ্য আইনসভাকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। অবশ্য সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে বিধানসভার নির্বাচনে কোনো দল এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে না পারায় বহুদলীয় জোট বা মোর্চা নিয়ে সরকার গঠনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিহার বা উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলিতে ত্রিশঙ্কু বিধানসভা গঠিত হওয়ায় সরকার গঠনে জোট বা মোর্চার গুরুত্ব বাড়ছে। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য আইনসভা কর্তৃক রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি নতুন মাত্রা লাভ করেছে।

প্রশ্ন 22 রাজ্য আইনসভার সদস্যদের বিশেষাধিকার সম্পর্কে আলোচনা করো।

উত্তর: রাজ্য আইনসভার সদস্যদের বিশেষাধিকার

সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনসভার কাজকর্ম যথাযথভাবে পালন করার জন্য আইনসভার সদস্যদের কতকগুলি বিশেষ অধিকার ভোগের সুযোগসুবিধা

রয়েছে। আরস্কাইন মে (Erskine May) এই বিশেষ অধিকারের সংজ্ঞা নির্দেশ করতে গিয়ে বলেছেন আইনসভার প্রতিটি কক্ষ সমষ্টিগতভাবে এবং আইনসভার সদস্যরা ব্যক্তিগতভাবে যেসব অধিকার ভোগ করে থাকেন সেগুলিই হল আইনসভার বিশেষ অধিকার। এসব অধিকার ছাড়া আইনসভা এবং তার সদস্যরা তাঁদের কাজকর্ম যথাযথভাবে সম্পাদন করতে পারেন না।

সংবিধানের ১৯৪ নং ধারায় রাজ্য আইনসভা ও তার সদস্যদের বিশেষ অধিকারের কথা বলা হয়েছে। এই সমস্ত বিশেষ অধিকারকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়-① ব্যক্তিগত অধিকার ও অব্যাহতি, ② সমষ্টিগত অধিকার ও অব্যাহতি।

ব্যক্তিগত অধিকার

[1] বাল্বাধীনতার অধিকার: সংবিধানের ১৯৪(১) নং ধারা অনুযায়ী রাজ্য আইনসভার সদস্যদের বাকস্বাধীনতার অধিকার আইনসভার কক্ষে স্বীকৃত হয়েছে। অবশ্য বাস্বাধীনতার এই অধিকারটি অবাধ নয়। কারণ সদস্যদের সংশ্লিষ্ট কক্ষের নিয়মকানুনগুলি মেনে চলতে হয়। বিধানসভার স্পিকার এবং বিধান পরিষদের সভাপতি এই বাক্স্বাধীনতার অধিকার নিয়ন্ত্রণ করেন। যেমন, কোনো সদস্য অন্য কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে মানহানিকর উক্তি করলে তা সভার কার্যবিবরণী থেকে বাদ দেওয়া হয় অথবা ওই সদস্যকে উক্তি প্রত্যাহার করে নিতে হয় বা উক্তির জন্য দুঃখপ্রকাশ করতে হয়।

[2] আদালতে অভিযুক্ত না হওয়ার অধিকার: রাজ্য আইনসভার ভেতরে বা কোনো কমিটিতে বক্তৃতা বা ভোট দেওয়ার জন্য কোনো সদস্যকে আদালতে অভিযুক্ত করা যায় না। আইনসভার প্রকাশিত প্রতিবেদন, কার্যবিবরণী, কাগজপত্র ইত্যাদির জন্য কোনো ব্যক্তিকে আদালতে অভিযুক্ত করা যায় না।

[3] গ্রেফতার না হওয়ার অধিকার: রাজ্য আইনসভার অধিবেশন চলাকালীন গ্রেফতার না হওয়ার স্বাধীনতাও সদস্যরা ভোগ করে থাকেন। অধিবেশন আরম্ভ হওয়ার ৪০ দিন আগে এবং অধিবেশন শেষ হওয়ার ৪০ দিনের মধ্যে কোনো সদস্যকে দেওয়ানি মামলার অভিযোগে গ্রেফতার করা যায় না। তবে ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে এবং নিবর্তনমূলক আটক আইনের হাত থেকে কোনো সদস্যকে অব্যাহতির সুযোগ দেওয়া হয়নি। এই ব্যাপারেও কিছু বিধিনিষেধ আছে। যেমন, আইনসভার সীমানার মধ্যে কোনো সদস্যকে গ্রেফতার করা যাবে না। এমনকি বিধানসভার স্পিকার বা বিধান পরিষদের সভাপতির অনুমতি ছাড়া আইনসভার সীমানার মধ্যে কোনো সদস্যকে দেওয়ানি বা ফৌজদারি সমন দেওয়া যায় না। তা ছাড়া যদি কোনো সদস্যকে গ্রেফতার করা হয় সেক্ষেত্রে বিধানসভার স্পিকার এবং বিধান পরিষদের সভাপতিকে জানাতে হয়। মুক্তি দেওয়ার পরও এভাবে জানাতে হয়।

[4] জুরি হিসেবে দায়িত্বপালনের অধিকার: কোনো রাজ্য আইনসভার অধিবেশন চলাকালীন কোনো সদস্যকে আদালতে জুরি হিসেবে দায়িত্বপালনে বাধ্য করা যায় না। এ ছাড়া কোনো সদস্যকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য আদালতে হাজির থাকতে বাধ্য করা যায় না।

সমষ্টিগত অধিকার

[1] কার্যক্রম রচনা ও রূপায়ণ: রাজ্য আইনসভার কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য বিধানসভা ও বিধান পরিষদ তাদের নিজস্ব কর্মসূচি, অভ্যন্তরীণ কার্যপদ্ধতি প্রভৃতি স্বাধীনভাবে নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কার্যক্রম রচনা ও রূপায়ণের অধিকার প্রতিটি কক্ষের রয়েছে।

[2] বহিরাগত ব্যক্তির উপস্থিতি নির্দিষ্টকরণ: রাজ্য আইনসভার উভয়কক্ষে আলোচনা চলাকালীন বহিরাগত ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকতে পারেন। কিন্তু প্রয়োজন হলে আইনসভা যে-কোনো বহিরাগত ব্যক্তির উপস্থিতি নিষিদ্ধ করতে পারে। এমনকি গোপনে সভার কাজ চালাবার সিদ্ধান্ত যে-কোনো কক্ষ গ্রহণ করতে পারে।

[3] সভার কার্যবিবরণী প্রকাশ: রাজ্য আইনসভায় যেসব বিতর্ক ও আলোচনা হয় তা প্রকাশ করার ব্যাপারে প্রতিটি কক্ষের সমান অধিকার রয়েছে। সভাপতি বা স্পিকার বিশেষ কোনো বিষয়কে সংবাদপত্রে প্রকাশের অনুমতি দিতে নাও পারেন। তা ছাড়া আইনসভা-সংক্রান্ত সংবাদ বিকৃতভাবে প্রকাশ করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সংস্থার বিরুদ্ধে আইনসভা অবমাননার অভিযোগ আনা যেতে পারে। আইনসভার কার্যবিবরণী সরকারি তত্ত্বাবধান ছাড়াই সংবাদপত্রে স্বাধীনভাবে প্রকাশ করা যায়।

[4] অধিকার ভঙ্গ বা অবমাননার দায়ে শাস্তিপ্রদান: অধিকার ভঙ্গ বা অবমাননার জন্য সদস্য বা অন্য যে-কোনো ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা রাজ্য আইনসভার প্রতিটি কক্ষের রয়েছে। বিধানসভার স্পিকার বা বিধান পরিষদের সভাপতি এই ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকেন। অধিকারভঙ্গ বা অবমাননার বিষয়টি নিয়ে বিবেচনা করে আইনসভার বিশেষ অধিকার রক্ষা কমিটি। এই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়। তা ছাড়া কোনো সদস্য সভার কাজে বাধা সৃষ্টি করলে তাকে সাময়িকভাবে অধিকারভঙ্গ বা বিধানসভা অবমাননার জন্য যে শাস্তি দেওয়া হয় তা আদালতের বিচারের এক্তিয়ার-বহির্ভূত। রাজ্য আইনসভা সাধারণত তিন প্রকার শাস্তি দিতে পারে-

i. অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সংশ্লিষ্ট কক্ষে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দিয়ে সভার তরফ থেকে স্পিকার অথবা সভাপতি তাঁকে তিরস্কার ও সতর্ক করতে পারেন।

ii. অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বাধ্যতামূলকভাবে কক্ষে উপস্থিত করিয়ে তীব্র ভর্ৎসনা করা হতে পারে, অথবা সভাপতি তাকে তিরস্কার ও সতর্ক করতে পারেন।

iii. অভিযুক্ত ব্যক্তিকে রাজ্য আইনসভা জেলে পাঠাতে পারে। কারাদণ্ড দেওয়ার ক্ষমতা আইনসভার আছে। আইনসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্পিকার বা সভাপতি অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতার করার নির্দেশও দিতে পারেন।

মূল্যায়ন: রাজ্য আইনসভার সদস্যরা যে ব্যাপক বিশেষাধিকার ও অব্যাহতি ভোগ করে থাকেন সেগুলি আইনের দ্বারা লিপিবদ্ধ করা উচিত বলে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। বিশেষাধিকারের পরিধি নিয়ে অস্পষ্টতাও এর ফলে দূর হতে পারে। ভারতীয় প্রেস কমিশনের মতে, ভারতের আইনসভাগুলি তাদের বিশেষাধিকার নিয়ে অতিমাত্রায় সচেতন থাকার জন্য যথাযথ সমালোচনার অনেক সময় কণ্ঠরোধ করা হয়।

প্রশ্ন 23. সংসদীয় কার্যপদ্ধতি বলতে কী বোঝায়? জিরো আওয়ার, অনাস্থা প্রস্তাব কাকে বলে?

উত্তর: সংসদীয় কার্যপদ্ধতি

ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বলা হয় সংসদীয় গণতন্ত্র (Parliamentary Democracy)। আরও সহজভাবে বলতে গেলে বলা যেতে পারে সংসদ-

চালিত গণতন্ত্র। ভারতের কেন্দ্রীয় আইনসভাকে বলা হয় সংসদ বা ‘Parlia- ment’। ভারতীয় সংবিধানে সংসদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রীসহ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা তাদের কাজকর্মের জন্য সংসদের কাছে দায়বদ্ধ থাকে। কোনো কারণে সংসদের আস্থা হারালে সমগ্র মন্ত্রীসভাকে পদত্যাগ করতে হয়।

কেন্দ্রীয় আইনসভা হিসেবে সংসদের একটি কার্যপদ্ধতি রয়েছে। সংসদ কীভাবে চলবে, অধিবেশনের সময় সদস্যরা কীভাবে প্রস্তাব উত্থাপন করবেন, বাজেট পাসের সময় তাঁদের ভূমিকা কী, অনাস্থা প্রস্তাব, ছাঁটাই প্রস্তাব, মুলতুবি প্রস্তাব, দৃষ্টি-আকর্ষণী বিজ্ঞপ্তি কীভাবে আনা যায় ইত্যাদি যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয়ের নিয়মকানুন বা পদ্ধতির কথা সংবিধানে লিখিত রয়েছে। সংসদ পরিচালনার এসব নিয়মকানুন বা পদ্ধতিকেই সাধারণভাবে সংসদীয় কার্যপদ্ধতি বলে অভিহিত করা হয়।

জিরো আওয়ার

সংসদীয় কার্যপদ্ধতির একটি অন্যতম বিষয় হল ‘জিরো আওয়ার’। সংসদীয় বিধিব্যবস্থায় অবশ্য ‘জিরো আওয়ার’-এর কোনো উল্লেখ নেই। তবে লিখিত নিয়মকানুন হিসেবে উল্লিখিত না হলেও সংসদীয় ব্যবস্থায় রীতিনীতি ও প্রথার ভিত্তিতে এর উদ্ভব ঘটেছে বলে মনে করা হয়। সংসদে বেসরকারি কর্মসূচি ও সরকারি কর্মসূচির মধ্যবর্তী সময়টিকে ‘জিরো আওয়ার’ বলা হয়ে থাকে।

সংসদের দৈনন্দিন পরিষদীয় কাজকর্মের দুটি পর্যায় রয়েছে। এর মধ্যে একটি হল সরকারি কাজকর্ম (Government Business) এবং অন্যটি হল বেসরকারি কাজকর্ম (Non-government Business)। সংসদে প্রতিদিনের পরিষদীয় কাজকর্ম প্রশ্নোত্তর পর্ব দিয়েই শুরু হয়। প্রশ্নোত্তর পর্বের কর্মসূচি হল বেসরকারি কর্মসূচি। প্রশ্নোত্তর পর্ব ছাড়াও মুলতুবি প্রস্তাব, দৃষ্টি-আকর্ষণী প্রস্তাব, উল্লেখ পর্ব ইত্যাদিও বেসরকারি কর্মসূচিরূপে পরিচিত। সভার নিয়মানুসারে প্রথমে হয় বেসরকারি কাজকর্ম তারপরে সরকারি কাজকর্ম। বেসরকারি কর্মসূচি শেষ হওয়ার পর সরকারি কর্মসূচি শুরু হয়। এই দুই কর্মসূচির মাঝখানে আলাদা কোনো সময় বরাদ্দ নেই। এই সময় না থাকার ব্যাপারটাই হল ‘জিরো আওয়ার’, অর্থাৎ বেসরকারি ও সরকারি কর্মসূচির মাঝখানের ফাঁকা সময়টুকু হল ‘জিরো আওয়ার’। এই সময়টি হল শূন্য সময় এবং এরপর থেকে পুরো ১ ঘণ্টা ধরে আইনসভার যে-কোনো কক্ষের কাজকর্ম চলতে থাকে বলে এই সময়টিকে জিরো আওয়ার বলা হয়। সংসদের কার্যপদ্ধতি-সম্পর্কিত নিয়মাবলিতে প্রতিটি কর্মসূচির জন্য সময় নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে, কিন্তু যেহেতু ‘জিরো আওয়ার’ বলে কোনো কিছুর উল্লেখ নেই তাই তার জন্য কোনো সময়ও বরাদ্দ নেই। কাজেই বেসরকারি কর্মসূচি শেষ হওয়ার ঠিক পরেই এবং সরকারি কাজকর্ম শুরু হওয়ার ঠিক আগের পর্বটিই হল জিরো আওয়ার।

পার্লামেন্টে জিরো আওয়ারের জন্য ১ ঘণ্টা সময় নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে। এই সময়টা হল দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভাতেও এই সময় নির্দিষ্ট রয়েছে। সাধারণত খুব জরুরি বা গুরুত্বপূর্ণ কোনো ঘটনা সভায় উত্থাপন করা দরকার মনে হলে সদস্যরা জিরো আওয়ারে তা উত্থাপন করতে পারেন। এজন্য স্পিকারের কাছে আগাম নোটিশ দেওয়া বা অনুমতি নেওয়ার কোনো প্রয়োজন হয় না।

জিরো আওয়ারের জন্য পার্লামেন্টের মূল্যবান সময় অপচয় হয়, বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের আলোচনা পিছিয়ে যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সদস্যরা গুরুত্বহীন বিষয় উত্থাপন করে ব্যক্তিগত বা দলগত স্বার্থে ‘জিরো আওয়ার’-কে ব্যবহার করেন ইত্যাদি সমালোচনা অনেকে করে থাকেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বলা যায় যে, ভারতীয় সংসদীয় কার্যপদ্ধতিতে জিরো আওয়ার বর্তমানে অপরিহার্য পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।

অনাস্থা প্রস্তাব

সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় অনাস্থা প্রস্তাবের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংসদীয় ব্যবস্থায় শাসন বিভাগ বা সরকারকে আইনসভার কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হয়। আইনসভার আস্থা হারালে সরকারকে পদত্যাগ করতে হয়।

এককথায় বলা যেতে পারে সংসদীয় ব্যবস্থায় সরকার যতদিন আইনসভার আস্থাভাজন থাকবে ততদিন ক্ষমতায় টিকে থাকবে। আইনসভা কোনো কারণে সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করলে সরকারকে পদত্যাগ করে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে হয়।

সংসদীয় ব্যবস্থার দেশ হিসেবে ভারতেও এই নিয়ম চালু রয়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভার কাছে দায়বদ্ধ। লোকসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থা হারালে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা বা সরকারকে পদত্যাগ করতে হয়। অনাস্থা প্রস্তাবের বিষয়টি লোকসভার সংসদীয় কার্যপদ্ধতি-সম্পর্কিত ১৯৮ নং বিধিতে আলোচিত হয়েছে। প্রসঙ্গত বলা যায়, অনাস্থা প্রস্তাব-সম্পর্কিত নিয়মকানুন লোকসভা এবং রাজ্য বিধানসভাগুলিতে প্রায় একই রকমের।

পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভায় অনাস্থা প্রস্তাবের নিয়মগুলি হল-

[1] অধিবেশন শুরু হওয়ার অন্তত ১০ ঘণ্টা আগে সচিবের কাছে অনাস্থা প্রস্তাবের নোটিশ দিতে হয়।

[2] অনাস্থা প্রস্তাব সমগ্র মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে আনতে হয়। কোনো একজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনা যায় না।

[3] স্পিকার নিজে অথবা তাঁর অনুমতিক্রমে প্রস্তাবের উত্থাপক অনাস্থা প্রস্তাব পাঠ করতে পারেন।

[4] লোকসভার অন্তত ৫০ জন সদস্যের অনুমতি পেলে অনাস্থা প্রস্তাব আলোচনার জন্য গৃহীত হয়।

[5] অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর আলোচনার তারিখ এবং সময় স্পিকার ঠিক করেন।

[6] স্পিকারের সম্মতি পাওয়ার পর নির্দিষ্ট দিনে অনাস্থা প্রস্তাবের উত্থাপক সভায় প্রস্তাবটি পেশ করেন। সাধারণত অনাস্থা প্রস্তাবের অতি-সংক্ষিপ্ত বয়ানটি হল, ‘এই সভা মন্ত্রীসভার প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করছে’।

[7] অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে, বিপক্ষে আলোচনা এবং তর্কবিতর্কের শেষে স্পিকার এই সম্পর্কে সভার সিদ্ধান্ত জানার জন্য ভোটাভুটির ব্যবস্থা করেন।

[৪] সভায় উপস্থিত ও ভোটদানকারী সদস্যদের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার সমর্থনে অনাস্থা প্রস্তাব পাস হলে মন্ত্রীসভার পতন ঘটে।

প্রশ্ন 24. সংসদীয় কার্যপদ্ধতির সংজ্ঞা দাও। ছাঁটাই প্রস্তাব কাকে বলে?

উত্তর: সংসদীয় কার্যপদ্ধতি

পৃষ্ঠা নং 167-এর বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক । নং প্রশ্নের উত্তরের ‘সংসদীয় কার্যপদ্ধতি’ শীর্ষক অংশ দ্যাখো।

ছাঁটাই প্রস্তাব

লোকসভায় বাজেট পাসের সময় ব্যয়বরাদ্দের দাবি নিয়ে আলোচনায় বিরোধীরা কোনো বিষয়ে বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়ার জন্য যে প্রস্তাব উত্থাপন করে, সাধারণভাবে তাকে ছাঁটাই প্রস্তাব বলা হয়। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, বাজেট পাসের সময় লোকসভা প্রস্তাবিত ব্যয়বরাদ্দের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে পারে না, অবশ্য বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে বা প্রত্যাখ্যান করার ব্যাপারে লোকসভার ক্ষমতা রয়েছে। সাধারণত বিরোধী সদস্যরা প্রস্তাবিত বাজেটের কোনো বিষয়ে বরাদ্দ কমিয়ে ফেলার জন্য ছাঁটাই প্রস্তাব উত্থাপন করে থাকেন।

লোকসভার নিয়ম অনুসারে তিন ধরনের ছাঁটাই প্রস্তাব আনা যেতে পারে-[1] ব্যয়সংক্ষেপ-সংক্রান্ত ছাঁটাই প্রস্তাব (Economy Cut), [2] নীতি অনুমোদন-সম্পর্কিত ছাঁটাই প্রস্তাব (Disapproval of Policy Cut) এবং [3] প্রতীকী ছাঁটাই প্রস্তাব (Token Cut)।

[1] ব্যয়সংক্ষেপ-সংক্রান্ত ছাঁটাই প্রস্তাব: প্রস্তাবিত বাজেটে কোনো ব্যয়বরাদ্দের দাবি মাত্রাতিরিক্ত বলে মনে হলে তা কমিয়ে ফেলার জন ব্যয়সংক্ষেপ-সংক্রান্ত ছাঁটাই প্রস্তাব আনা যেতে পারে। এতে কোনো বিশেষ খাতে বরাদ্দের পরিমাণের একটি নির্দিষ্ট অংশ হ্রাস করার প্রস্তাব আনা হয় যেমন, এই ধরনের ছাঁটাই প্রস্তাবে বলা হতে পারে প্রতিরক্ষা খাতে সরকারের ব্যয়ের দাবির পরিমাণ ১০ কোটি টাকা কমানো হোক।

[2] নীতি অনুমোদন-সম্পর্কিত ছাঁটাই প্রস্তাব: কোনো বিশেষ খাতে সরকারের ব্যয়বরাদ্দের দাবিকে অস্বীকার করার জন্য বিরোধীরা নীতি অনুমোদন-সম্পর্কিত ছাঁটাই প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারে। এক্ষেত্রে সরকারি ব্যয়ের দাবিকে ছাঁটাই করে নামমাত্র অঙ্কে কমিয়ে ফেলার কথা বলা হয়। যেমন এটা বলা হতে পারে যে গ্রামোন্নয়নের জন্য সরকারের ব্যয়ের দাবিকে ছাঁটাই করে ১ টাকা করা হোক।

[3] প্রতীকী ছাঁটাই প্রস্তাব: সাধারণত সরকারের কোনো অযৌক্তিক ব্যয়বরাদ্দের দাবির বিরুদ্ধে বিরোধী পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানানোর জন্য এ ধরনের প্রতীকী ছাঁটাই প্রস্তাব তোলা হয়। এতে কোনো নির্দিষ্ট খাতে সরকারের তরফ থেকে যে পরিমাণ অর্থ অনুমোদনের জন্য দাবি করা হয় তার সামান্য কিছু অংশ কমিয়ে ফেলার প্রস্তাব করা হয়। যেমন, এক্ষেত্রে বলা হতে পারে সরকারের মোট ব্যয়বরাদ্দের দাবির পরিমাণ থেকে ১০০ টাকা ছাঁটাই করা হোক।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সরকারের ব্যয়বরাদ্দের দাবি সম্পর্কে বিরোধীদের উত্থাপিত ছাঁটাই প্রস্তাবের ভাগ্য লোকসভার সদস্যদের ভোটাভুটির মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। কোনো ছাঁটাই প্রস্তাব যদি লোকসভার সদস্যদের ভোটে পাস হয়ে যায় তাহলে প্রধানমন্ত্রীসহ সমগ্র মন্ত্রীসভাকে পদত্যাগ করতে হয়। কারণ লোকসভায় বিরোধীদের আনা ছাঁটাই প্রস্তাব পাস হওয়ার অর্থ হল সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ। সংবিধান অনুসারে লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থা হারালে পদত্যাগ ছাড়া সরকারের পক্ষে আর কোনো রাস্তা খোলা থাকে না।

প্রশ্ন 25. মুলতুবি প্রস্তাব ও দৃষ্টি-আকর্ষণী প্রস্তাব সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।

উত্তর: মুলতুবি প্রস্তাব

লোকসভার সংসদীয় কার্যপদ্ধতিতে মুলতুবি প্রস্তাবের একটি স্বতন্ত্র তাৎপর্য রয়েছে। সাধারণত লোকসভা চলাকালীন কোনো জরুরি বিষয় উত্থাপনের একটি মাধ্যম হল মুলতুবি প্রস্তাব। সভার নির্দিষ্ট কর্মসূচি মুলতুবি রেখে এই ধরনের প্রস্তাব আলোচনার জন্য গৃহীত হয় বলে একে মুলতুবি প্রস্তাব বলে। মুলতুবি প্রস্তাব উত্থাপন করে যে বিষয় সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় তার জবাব সরকার পক্ষকে তক্ষুনি বা সেই দিনেই দিতে হয়। বিরোধী পক্ষ সাধারণত মুলতুবি প্রস্তাব উত্থাপন করে থাকে। তাই সরকার পক্ষ সবসময় চেষ্টা করে মুলতুবি প্রস্তাব যাতে সভায় আলোচনার জন্য গৃহীত না হয়। অধিবেশন শুরুর আগেই মুলতুবি প্রস্তাবের নোটিশ দিতে হয়।

মুলতুবি প্রস্তাবের তিনটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে-① প্রস্তাবটি হল সুনির্দিষ্ট, ② বিষয়টিকে অত্যন্ত জরুরি প্রকৃতির হতে হবে, ③ জনস্বার্থের দিক থেকেও বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ হতে হবে।

এ ছাড়া মুলতুবি প্রস্তাব পেশ করার বিষয়ে কতকগুলি শর্ত পূরণ করতে হয়। এগুলি হল-

[1] একদিনের অধিবেশনে একটির বেশি মুলতুবি প্রস্তাব পেশ করা যায় না।

[2] একটির বেশি বিষয় আলোচনাতেও অন্তর্ভুক্ত করা যায় না।

[3] প্রস্তাবটি সাম্প্রতিক বিষয়ের ওপর হতে হয়।

[4] আদালতের বিচারাধীন কোনো বিষয়কে মুলতুবি প্রস্তাব আকারে উত্থাপন করা যায় না।

[5] কোনো বিষয় ইতিপূর্বে সভায় আলোচিত হয়ে গেলে তা প্রস্তাব হিসেবে আনা যায় না।

সংসদীয় কার্যপদ্ধতিতে মুলতুবি প্রস্তাবের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। বিরোধী পক্ষ এই প্রস্তাবের মাধ্যমে সরকারের সমালোচনা করার ও ত্রুটিবিচ্যুতিগুলি তুলে ধরার তাৎক্ষণিক সুযোগ লাভ করে। অবশ্য মুলতুবি প্রস্তাবে সরকার পক্ষের পরাজয় ঘটলে মন্ত্রীসভাকে পদত্যাগ করতে হয় না। তবে এর ফলে সরকারের নৈতিক পরাজয় ঘটে।

দৃষ্টি-আকর্ষণী প্রস্তাব

সংসদীয় কার্যপদ্ধতিতে দৃষ্টি-আকর্ষণী প্রস্তাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রস্তাবের মাধ্যমে বিধায়ক বা সাংসদরা জনস্বার্থের সঙ্গে জড়িত জরুরি বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকেন বলে একে দৃষ্টি-আকর্ষণী প্রস্তাব বলা হয়। দৃষ্টি-আকর্ষণী প্রস্তাবের মাধ্যমে বিরোধী পক্ষের সদস্যরা সরকারের কাজকর্মের ত্রুটিবিচ্যুতি, ব্যর্থতা, দুর্নীতি প্রভৃতি বিষয় তুলে ধরতে পারেন। অন্যদিকে, সরকারি পক্ষের সদস্যরা এর মাধ্যমে সরকারি কাজকর্মের সাফল্যকে সভায় তুলে ধরার সুযোগ পান।

দৃষ্টি-আকর্ষণী প্রস্তাব উত্থাপনের বিষয়ে কয়েকটি নিয়ম বা শর্ত রয়েছে। যেমন-

[1] প্রস্তাবটিকে জনস্বার্থের সঙ্গে জড়িত এবং জরুরি বিষয়ের হতে হয়,

[2] প্রস্তাবটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য মন্ত্রীকে দেওয়া হবে কি না, প্রস্তাবটি নিয়ে কোনোরকম আলোচনা হবে কি না সে ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা স্পিকার বা অধ্যক্ষের হাতে রয়েছে,

[3] দৃষ্টি-আকর্ষণী প্রস্তাবের নোটিশ লিখিতভাবে সভার সচিবের কাছে জমা দিতে হবে,

[4] একইদিনে একাধিক নোটিশ জমা পড়লে স্পিকার বা অধ্যক্ষ তার মধ্যে থেকে যেটি খুব জরুরি সেটি অনুমোদন করেন,

[5] দৃষ্টি-আকর্ষণী প্রস্তাব যে দফতরের মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য উত্থাপন করা হয়, স্পিকার সেই মন্ত্রীকে উত্তর দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়ে থাকেন। তবে সংশ্লিষ্ট দফতরের মন্ত্রী প্রস্তাব উত্থাপনের দিন বা অন্য যে-কোনো দিন উত্তর দিতে পারেন।

দৃষ্টি-আকর্ষণী প্রস্তাব নিয়ে কোনো বিতর্ক বা ভোটাভুটি হয় না। বিধায়ক বা সাংসদ প্রস্তাবের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকেন। এক্ষেত্রে মন্ত্রী লিখিতভাবে তাঁর বক্তব্য জানিয়ে থাকেন।