Class 12 Chapter 5 Solution
কয়েকটি প্রধান রাজনৈতিক মতাদর্শ
1. Long Question Answer
1. আধুনিক উদারনীতিবাদের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করো। অথবা, সংশোধনমূলক উদারনীতিবাদের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।
উত্তরঃ আধুনিক উদারনীতিবাদের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ-
উনবিংশ শতকের শেষ দশকে সাবেকি উদারনীতিবাদ তার গুরুত্ব অনেকটা হারিয়ে ফেলে। এই সময় টি এইচ গ্রিন, ম্যাক্সইভার এবং ল্যাস্কি প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ইতিবাচক ধারণা নিয়ে উদারনীতিবাদের নতুন ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন। একে ইতিবাচক বা আধুনিক উদারনীতিবাদ (Positive or Modern Liberalism) বলা হয়।
[1] রাষ্ট্র সমষ্টিগত মঙ্গলের প্রকাশ: ইংল্যান্ডের ভাববাদী দার্শনিক টি এইচ গ্রিন বলেন, জনগণের সম্মতিই হল রাষ্ট্রের ভিত্তি, বলপ্রয়োগ নয় (Will, not force, is the basis of State.)। গ্রিন রাষ্ট্রকে সমষ্টিগত মঙ্গলের প্রকাশ বলে বর্ণনা করেন। গ্রিনের মতে, রাষ্ট্র কখনও নিজেই নিজের লক্ষ্য হতে পারে না। রাষ্ট্র হল ব্যক্তিবর্গের পূর্ণ নৈতিক বিকাশের হাতিয়ার মাত্র। গ্রিনের অভিমত তাঁর “সাধারণ ইচ্ছা”র ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। তিনি মনে করতেন সাধারণ ইচ্ছা তথা সদিচ্ছা প্রতিষ্ঠার জন্যই স্বাধীনতার প্রয়োজন। রাষ্ট্র এই সদিচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করবে না। রাষ্ট্র এর প্রতিবন্ধকতাসমূহ অপসারণ করবে। তাঁর মতে, নাগরিকরা নিজেদের স্বার্থরক্ষা ছাড়া অন্য কোনো কারণে রাষ্ট্রের বিরোধিতা করতে পারে না। অবশ্য স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধাচরণ করাকে তিনি অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি না দিলেও কর্তব্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
[2] বহুত্ববাদী দৃষ্টিতে রাষ্ট্র: আধুনিক উদারনীতিবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ম্যাক্সইভার, ল্যাস্কি, বার্কার প্রমুখ এই অভিমত প্রকাশ করেন যে, ব্যক্তির বহুমুখী জীবনের সম্পূর্ণ বিকাশ রাষ্ট্র একা করতে পারে না। এজন্য মানুষ সমাজের অভ্যন্তরে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় প্রভৃতি সংঘ বা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে থাকে। রাষ্ট্রের মতো এইসব সংঘ বা > প্রতিষ্ঠানগুলি সমান গুরুত্বপূর্ণ ও স্বাধীন। এদেরও রাষ্ট্রের মতো সার্বভৌম ক্ষমতা + থাকা উচিত। বহুত্ববাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, রাষ্ট্র ব্যক্তির বাহ্যিক আচরণ ল নিয়ন্ত্রণ করলেও অন্তর্জীবনের ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ম্যাক্সইভারের ভাষায়, ‘পেনসিল কাটার জন্য কুঠার যেমন অনুপযুক্ত, সেরকম ব্যক্তির অন্তর্জীবনের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলির বিকাশে রাষ্ট্রও অনুপযুক্ত।’
[3] রাষ্ট্র জনগণের সেবকঃঅধ্যাপক ম্যাক্সইভারের মতে, রাষ্ট্র জনগণের সেবা করে বলেই তার নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। রাষ্ট্র সমাজের ‘এজেন্ট’ হিসেবে জনগণের অধিকারসমূহ সৃষ্টি করে। রাষ্ট্র জনগণ অপেক্ষা বড়ো হতে পারে না। ম্যাক্সইভার ধর্ম, নৈতিকতা, প্রথা ও সংস্কৃতির ওপর রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের বিরোধী ছিলেন। রাষ্ট্রের কাজকর্মকে আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা এবং প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ তথা কৃষি ও শিল্পের বিকাশসাধনে সীমিত রাখার তিনি পক্ষপাতী ছিলেন।
[4] সমাজস্থ নাগরিকদের স্বার্থরক্ষা: অধ্যাপক হ্যারল্ড ল্যাস্কি ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রকাশিত শীর্ষক গ্রন্থ ‘The State in theory and practice’- এ রাষ্ট্রকে একটি জাতীয় সমাজ বলে অভিহিত করেন। রাষ্ট্র আইনসংগতভাবে বলপ্রয়োগের অধিকারী-এই ক্ষমতা সার্বভৌমিকতা নামে পরিচিত। ল্যাস্কির মতে, রাষ্ট্রকে সমাজস্থ নাগরিকদের স্বার্থরক্ষায় কাজ করতে হয়। জনগণের ব্যাপক অংশের সর্বাধিক পরিমাণ সামাজিক মঙ্গলসাধন রাষ্ট্রের প্রধান কাজ। ল্যাস্কি অবশ্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণাকে জনগণের শেষ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার সপক্ষে রায় দেন।
[5] জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রতত্ত্ব: রাশিয়ায় ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরবর্তীকালে উদারনীতিবাদের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেলে উদারনীতিবাদের সমর্থকরা জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র তত্ত্ব প্রচার করেন। সমাজতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের মধ্যবর্তী পর্যায়ে অবস্থিত এই তত্ত্বে একটা মাঝামাঝি অবস্থার কথা বলা হয়। এই মতবাদে মিশ্র অর্থব্যবস্থা চালু করে জনকল্যাণ সাধন সম্ভব বলে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। জনকল্যাণকর রাষ্ট্রতত্ত্বে উদারনীতিবাদের মৌল নীতিগুলির মধ্যে নাগরিকদের রাজনৈতিক ও পৌর অধিকারের স্বীকৃতি, সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার, নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা, বহুদলীয় ব্যবস্থা, শান্তিপূর্ণ ও সাংবিধানিক পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তন প্রভৃতি গৃহীত হয়।
প্রশ্ন 2. উদারনীতিবাদের অর্থ ও সংজ্ঞা দাও। উদারনীতিবাদের উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তরঃ উদারনীতিবাদ: অর্থ ও সংজ্ঞা-
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক আলোচনায় উদারনীতিবাদের একটি সবিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। রাষ্ট্রের কার্যাবলি এবং প্রকৃতি-সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ হল উদারনৈতিক মতবাদ। উদারনৈতিক মতবাদ দীর্ঘকাল ধরে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর চিন্তাভাবনায় বিকশিত হওয়ার ফলে এর কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা প্রদান করা একটি দুরূহ ব্যাপার। বস্তুত রাষ্ট্রবিজ্ঞানে উদারনীতিবাদের সাধারণ অর্থ হল রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিস্বাধীনতার নীতি প্রতিষ্ঠা। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার (Encyclopedia Britannica) বক্তব্য অনুযায়ী, উদারনীতিবাদ হল এমন এক ধারণা যা সরকারি কাজের নীতি ও পদ্ধতিরূপে, সমাজ গঠনের নীতিরূপে এবং ব্যক্তি ও সমাজের এক জীবনাদর্শরূপে ‘স্বাধীনতা’-কে প্রতিষ্ঠিত করে (Liberalism is an idea committed to freedom as a method and policy in government, as an organising principle in society, and a way of life for the individual and the community.)¹।
উদারনীতিবাদের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে হবহাউস (Hobhouse) তাঁর ‘Liberalism’ গ্রন্থে বলেছেন, ব্যক্তিত্বের আত্মপরিচালনার ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে সমাজ গঠনের আদর্শকে উদারনীতিবাদ বলে (Liberalism denotes an attitude which seeks to make possible those social conditions in which the individuality of all men may be best realised.)2। হ্যারল্ড ল্যাস্কি উদারনীতিবাদ বলতে স্বাধীনতার অনুশাসনকে বুঝিয়েছেন। উদারনীতিবাদ সংকীর্ণ ও ব্যাপক, এই দুই অর্থেই প্রযুক্ত হয়। সংবীর অর্থে উদারনীতিবাদ বলতে এমন এক তত্ত্বকে বোঝায় যা অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ নীতি হিসেবে প্রতিষ্ক করে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখা এবং রাজনৈতির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের শাসক প্রতিনিধিদের নির্বাচন ও অপসারণের ব্যাপারে নাগরিকদের ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সর্বোচ্চ স্থানে প্রতিষ্ঠা করা সংকীর্ণ অর্থে উদারনীতিবাদের প্রধান উদ্দেশ্য। অন্যদিকে, ব্যাপক অর্থে উদারনীতিবাদ হল এমন এক মানসিক ধারণা যা ব্যক্তির অধিকার, স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিত্বের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের পক্ষপাতী। বস্তুতপক্ষে সংকীর্ণ ও ব্যাপক, উভয় ক্ষেত্রেই উদারনীতিবাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল স্বাধীনতা।
উদারনীতিবাদের উৎপত্তি ও বিকাশ-
উদারনীতিবাদ এক প্রাচীন মতবাদ। গ্রিক দার্শনিকদের দুই প্রধান নীতি, চিন্তার স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার মাধ্যমে উদারনীতিবাদের সর্বপ্রথম উৎপত্তি ঘটে। যদিও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে প্রাচীন গ্রিসে চিন্তার স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা সমাজের সমস্ত শ্রেণির মানুষের ছিল না। বস্তুতপক্ষে সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে উদারনীতিবাদ প্রথম বিকশিত হয়। সামন্ততান্ত্রিক স্বৈরাচারী শাসন ও বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মধ্যে দিয়ে উদারনৈতিক মতবাদ জন্মগ্রহণ করে। ইউরোপে মধ্যযুগের নবজাগরণ আন্দোলন ও ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সাফল্যের ফলে উদারনীতিবাদ সুপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দে ‘গৌরবময় বিপ্লবের’ মাধ্যমে উদারনীতিবাদ একটি সুসংহত চেহারা লাভ করে।
অনেকে মনে করেন, ইংল্যান্ডে উদারনীতিবাদের উদ্ভবের কারণ ছিল। শিল্পবিপ্লবের ফলাফল। শিল্পবিপ্লবের পর যে বণিক সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে, তারা রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক সব ক্ষেত্রেই আরও ব্যাপক স্বাধীনতার দাবিদার হয়ে ওঠে। এভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতা সর্বোচ্চ গুরুত্ব লাভ করে। যুক্তিবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন লকের চিন্তাধারার মধ্যে উদারনৈতিক মতবাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ের সন্ধান পাওয়া যায়। লকের মতে, জনগণের সম্মতি হল রাষ্ট্রের মূলভিত্তি। ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ ঘটানোর অধিকার রাষ্ট্রের নেই। রাষ্ট্র ব্যক্তিস্বাধীনতার পথে বাধাগুলি দূর করতে প্রয়াসী হবে। ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণায় এবং ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি মানবাধিকার সংক্রান্ত ঘোষণায় উদারনীতিবাদের আদর্শ বাস্তবরূপ লাভ করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জেরিমি বেত্থাম হিতবাদী দর্শনের সাহায্যে উদারনীতিবাদকে আরও প্রসারিত করেন। বেথামের মতে, রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হল সর্বাধিক ব্যক্তির সর্বাধিক পরিমাণ সুখস্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করা। উদারনীতিবাদের অপর এক প্রবক্তা অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবাধ নীতি বা ‘Laissez-faire’-এর ব্যাখ্যা দেন। তিনি নির্দিষ্ট কতগুলি কার্যাবলির মধ্যে রাষ্ট্রের কার্যকলাপকে সীমিত রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। পরবর্তীকালে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে গ্রিন, ব্রাডলি, বোসানকের হাত ধরে উদারনীতিবাদ আরও সংশোধিত ও পরিবর্তিত হয়। উদারনীতিবাদের সমর্থকরা এই সময় জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র তত্ত্ব প্রচার করেন।
আধুনিক উদারনীতিবাদের মূলনীতি হিসেবে নাগরিকদের রাজনৈতিক ও পৌর অধিকারের স্বীকৃতি, সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার, নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা, বহুদলীয় ব্যবস্থা, শান্তিপূর্ণ ও সাংবিধানিক পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তন, অবাধ বাণিজ্যনীতি ইত্যাদি গৃহীত হয়।
প্রশ্ন3. উদারনীতিবাদের ধারণাটি বিশ্লেষণ করো। উদারনীতিবাদের মূলনীতিগুলি আলোচনা করো।
অথবা, উদারনীতিবাদের মূলসূত্রগুলি ব্যাখ্যা করো।
অথবা, উদারনীতিবাদের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি ব্যাখ্যা করো।
অথবা, উদারনীতিবাদ কাকে বলে? এর বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।
উত্তরঃ উদারনীতিবাদ-
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে উদারনীতিবাদের সাধারণ অর্থ হল রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিস্বাধীনতার নীতি প্রতিষ্ঠা। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা অনুযায়ী, উদারনীতিবাদ হল এমন এক ধারণা যা সরকারি কাজের নীতি ও পদ্ধতিরূপে, সমাজ গঠনের নীতিরূপে এবং ব্যক্তি ও সমাজের এক জীবনাদর্শরূপে ‘স্বাধীনতা’- কে প্রতিষ্ঠিত করে। উদারনীতিবাদে ব্যক্তিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। উদারনীতিবাদ মনে করে আগে ব্যক্তি, পরে রাষ্ট্র। এই তত্ত্ব অনুসারে ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের জন্য ব্যক্তি নয় (Liberalism is an idea committed to freedom as a method and policy in government, as an organising principle in society, and a way of life for the individual and the community)³। উদারনীতিবাদের তিনটি ধারা রয়েছে। সেগুলি হল- ① সাবেকি উদারনীতিবাদ, ② আধুনিক বা সংশোধনমূলক উদারনীতিবাদ এবং ③ নয়া উদারনীতিবাদ।
উদারনীতিবাদের মূলনীতি-
সামগ্রিকভাবে উদারনীতিবাদের মূলনীতিগুলি হল-
[1] আইনের শাসন: উদারনৈতিক মতবাদে আইনের শাসনের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। ব্যক্তির পৌর স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্য আইনকে সবকিছুর উর্ধ্বে প্রতিষ্ঠা করা উচিত বলে এই দর্শনের প্রবক্তারা মনে করেন।
[2] শাসিতের সম্মতি: শাসিতের সম্মতির ওপর প্রতিষ্ঠিত সরকারকে উদারনৈতিক মতবাদে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। এজন্য সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্বমূলক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয়।
[3] অবাধ বাণিজ্যনীতি: উদারনৈতিক মতবাদ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবাধ বাণিজ্যের নীতিকে স্বীকার করে। অ্যাডাম স্মিথের মতে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবাধ প্রতিযোগিতার ফলে সমাজের সর্বাধিক কল্যাণ সাধিত হয়। [4] স্বাধীনতা: উদারনৈতিক মতবাদে স্বাধীন চিন্তা, স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার মতো ব্যক্তিগত স্বাধীনতাগুলিকে অপরিহার্য বলে মনে করা হয়। এ ছাড়া জাতিধর্মবর্ণ এবং স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার কথাও বলা হয়।
[5] আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতা: জাতিগত সাম্য, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্য এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শান্তি ও সহযোগিতাকে উদারনৈতিক মতবাদে স্থান দেওয়া হয়েছে।
[6] রাজনৈতিক সাম্য: আধুনিক উদারনৈতিক মতবাদে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এজন্য জনগণের শাসন বা গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। জনগণের শাসন বলতে এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনকে বোঝায়।
[7] পৌর ও রাজনৈতিক অধিকারের স্বীকৃতি: উদারনৈতিক মতবাদে নাগরিকদের পৌর এবং রাজনৈতিক অধিকারগুলিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে জীবনের অধিকার, চিন্তা ও মত প্রকাশের অধিকার, ধর্মের অধিকার, নির্বাচন করা ও নির্বাচিত হওয়ার অধিকার, পরিবার গঠনের অধিকার প্রভৃতি।
[৪] সাংবিধানিক পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তন: উদারনৈতিক মতবাদে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ কর্তৃক সরকারের পরিবর্তন স্বীকৃত হয়েছে। এজন্য বৈপ্লবিক ও হিংসাত্মক পথের প্রয়োজন হয় না।
[9] আইনের দৃষ্টিতে সাম্য: আইনের দৃষ্টিতে সমতা এবং আইনের দ্বারা সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার বিষয়টি উদারনৈতিক মতবাদে স্বীকৃত হয়েছে। আইনের অনুশাসনের মাধ্যমে উদারনৈতিক গণতন্ত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।
[10] স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা: উদারনৈতিক গণতন্ত্রে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলিকে সংরক্ষণ করে। এ ছাড়া আদালত দেশের সংবিধানের ব্যাখ্যাকর্তা ও অভিভাবক রূপে কাজ করে।
[11] প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার: উদারনৈতিক গণতন্ত্রে সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। জাতিধর্ম, স্ত্রী-পুরুষ, ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের সমানভাবে ভোটদানের অধিকার স্বীকৃত হয়।
[12] জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রনীতি: আধুনিক বা সংশোধনমূলক উদারনৈতিক গণতন্ত্রে জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে গতিশীল করব্যবস্থা, শিল্পবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ, ক্ষেত্রবিশেষে জাতীয়করণ প্রভৃতির কথাও বলা হয়।
[13] বহুদলীয় ব্যবস্থা: আধুনিক উদারনীতিবাদের প্রবক্তারা বহুদলীয় ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রের পক্ষে আদর্শ বলে মনে করেন। তাঁদের মতে, জনগণের বহুমুখী আশা-আকাঙ্ক্ষার রূপায়ণ বহুদলীয় ব্যবস্থার মাধ্যমেই সম্ভব।
[14] ব্যক্তিগত সম্পত্তির স্বীকৃতি: উদারনীতিবাদী দার্শনিকরা ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে স্বীকৃতি দেন। তাঁদের মতে, নাগরিকদের হাতে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার না থাকলে তারা কাজকর্মে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। ফলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন ব্যাহত হবে।
[15] ফ্যাসিবাদ-বিরোধিতা: উদারনীতিবাদ ব্যক্তিস্বাধীনতা-হরণকারী রাষ্ট্রসর্বস্ব ফ্যাসিবাদের তীব্র বিরোধী। ফ্যাসিবাদী তত্ত্বের একদলীয় একনায়কের শাসন, ব্যক্তিপূজা, অগণতান্ত্রিক ও প্রতিক্রিয়াশীল কার্যকলাপ, জাতিবিদ্বেষ, আগ্রাসী যুদ্ধনীতি ইত্যাদিকে উদারনীতিবাদে কঠোর ভাষায় নিন্দা করা হয়।
[16] বহুত্ববাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা: উদারনীতিবাদ বিশ্বাস করে, রাষ্ট্রের বদলে বহুত্ববাদী সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী নিজেদের পারস্পরিক আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়িত করার সুযোগ পেতে পারে।
[17] ন্যূনতম রাষ্ট্র: নয়া উদারনীতিবাদে রাষ্ট্রের ভূমিকার পরিবর্তন ঘটানো হয়। অতি ক্ষমতাশালী ও আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বদলে এক ন্যূনতম রাষ্ট্র বা সীমিত রাষ্ট্রের ধারণাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়। নয়া উদারনীতিবাদ অনুসারে নিরাপত্তা রক্ষা, ন্যায়বিচার এবং প্রতিরক্ষা ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে রাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা থাকবে না।
[18] পুঁজির বিশ্বায়ন: নয়া উদারনীতিবাদ সারা বিশ্ব জুড়ে পুঁজির অবাধ চলাচলের পক্ষপাতী।
[19] মুক্ত বাজার অর্থনীতি: নয়া উদারনীতিবাদে মুক্তবাজার অর্থনীতিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
প্রশ্ন 4. উদারনীতিবাদের তিনটি ধারা বলতে কী বোঝায়? সাবেকি উদারনৈতিক মতবাদের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করো।
উত্তরঃ উদারনীতিবাদের তিনটি ধারা-
রাষ্ট্রপ্রকৃতি-সম্পর্কিত উদারনৈতিক মতবাদের তিনটি ধারা রয়েছে। এদের মধ্যে একটি হল চিরাচরিত বা সাবেকি উদারনৈতিক মতবাদ (Traditional Liberal theory), দ্বিতীয়টি আধুনিক বা ইতিবাচক উদারনৈতিক মতবাদ (Modern Liberal theory) এবং তৃতীয়টি হল নয়া উদারনীতিবাদ (Neo-Liberalism)। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন লক, জেরিমি বেত্থাম, জেমস মিল, জন স্টুয়ার্ট মিল, স্পেন্সার, মতেস্কু প্রমুখ হলেন চিরাচরিত বা সাবেকি উদারনৈতিক মতবাদের মুখ্য প্রবক্তা। অন্যদিকে হবহাউস, গ্রিন, ম্যাক্সইভার, বার্কার, ল্যাস্কি, ওয়েলডন, ম্যাকফারসন, জন ডিউই, মরিস র্যাফেল, কোহেন প্রমুখ চিন্তাবিদ আধুনিক উদারনৈতিক মতবাদের প্রবক্তারূপে পরিচিত। নয়া উদারনীতিবাদের প্রধান প্রবক্তারা হলেন এফ এ হায়েক, জন রলস, রবার্ট নজিক এবং ইশিয়া বারলিন।
সাবেকি উদারনৈতিক মতবাদের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ-
[1] প্রাকৃতিক অধিকার সংরক্ষণে রাষ্ট্রের উৎপত্তি: সাবেকি উদারনীতিবাদে এটা বলা হয় যে জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকারের ন্যায় ব্যক্তির প্রাকৃতিক অধিকারগুলি রক্ষার জন্য চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের উৎপত্তি ঘটে। এই কারণে রাষ্ট্র ও ব্যক্তির সঙ্গে যে সম্পর্ক তা পুরোপুরি চুক্তিগত। স্বাভাবিকভাবে রাষ্ট্র যদি চুক্তি অনুযায়ী কাজ না করে, তাহলে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠার অধিকার জন্মায়।
[2] জনগণের সম্মতিই রাষ্ট্রের মূলভিত্তি: রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে উদারনীতিবাদের এই সাবেকি ধারণার সম্যক পরিচয় সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন লকের চিন্তাধারায় দেখতে পাওয়া যায়। লকের মতে, জনগণের সম্মতিই হল রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব জনগণের কল্যাণসাধনের ওপর নির্ভরশীল। রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে তার কর্তৃত্ব প্রয়োগ করে এবং আইনের অনুশাসনের ওপর ভিত্তি করে সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রক্ষমতা প্রাকৃতিক আইনের দ্বারা সীমাবদ্ধ। প্রাকৃতিক অধিকারগুলির পশ্চাতে প্রাকৃতিক আইনের সমর্থন থাকে বলে এগুলি অলঙ্ঘনীয়। রাষ্ট্র বহুমুখী মতামত প্রকাশে কোনো অন্তরায় হিসেবে কাজ করে না। রাষ্ট্রের কাজ হবে প্রধানত ইতিবাচক। ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার অধিকার রাষ্ট্রের নেই। রাষ্ট্র ব্যক্তিস্বাধীনতার পথে বাধাগুলি দূর করতে প্রয়াসী হবে।
[3] সর্বাধিক ব্যক্তির সর্বাধিক সুখস্বাচ্ছন্দ্য: ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জেরিমি বেন্থাম হিতবাদী দর্শনের সাহায্যে উদারনীতিবাদকে আরও প্রসারিত করেন। ব্যোমের মতে, রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হল সর্বাধিক ব্যক্তির সর্বাধিক পরিমাণ সুখস্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করা। তিনি রাষ্ট্রকে সর্বপ্রকার অধিকারের উৎসভূমি হিসেবে অভিহিত করেন। মানুষ তার অধিকার, স্বাধীনতা ও সুখস্বাচ্ছন্দ্যের জন্য রাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করতে পারে বলে তিনি মনে করতেন। বেত্থাম মনে করতেন, রাষ্ট্র মূলত একটি আইন প্রণয়নকারী সংস্থা ছাড়া আর কিছু নয়। এই কারণে তাঁর অভিমত ছিল ব্যক্তির সর্বাধিক পরিমাণ সুখস্বাচ্ছন্দ্যের মাপকাঠির বিচার ব্যক্তি নিজেই করবে, রাষ্ট্র নয়। বেত্থাম ব্যক্তিগত কর্মোদ্যোগে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের বিরোধী ছিলেন।
[4] অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবাধ নীতি: উদারনীতিবাদের অপর এক প্রবক্তা অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবাধ নীতি বা ‘Laissez-faire’- এর ব্যাখ্যা দেন। কতকগুলি নির্দিষ্ট কার্যাবলির মধ্যে রাষ্ট্রের কার্যকলাপকে সীমিত রাখার পক্ষপাতী ছিলেন স্মিথ। তাঁর মতে, রাষ্ট্রের প্রধান কাজ হল বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিহত করা এবং অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা।
[5] ব্যক্তির নৈতিক উন্নতিসাধন: সাবেকি উদারনীতিবাদের অন্যতম প্রবক্তা জন স্টুয়ার্ট মিল, ব্যক্তির নৈতিক উন্নতিসাধনকে রাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য বলে ব্যাখ্যা করেন। রাষ্ট্রপ্রকৃতিকে মিল ব্যক্তিস্বাধীনতার দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেন। অবশ্য রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণকে ক্ষতিকারক বলে আখ্যায়িত করলেও তার প্রয়োজনীয়তাকে মিল পুরোপুরি উপেক্ষা করতে পারেননি। তাঁর মতে ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সুরক্ষিত করার জন্যই রাষ্ট্রের প্রয়োজন। রাষ্ট্রীয় কাজক্সা শুধুমাত্র গঠনমূলক বা ইতিবাচক বিষয়গুলির মধ্যে সীমিত থাকবে। এর মধ্যে রয়েছে সমাজের সমষ্টিগত মঙ্গলের জন্য আবশ্যিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ওপর নিয়ন্ত্রণ, একচেটিয়া কারবারের ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ, শিশুদের স্বার্থে প্রয়োজনীয় কারখানা আইন নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি।
প্রশ্ন 5. নয়া উদারনীতিবাদের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করো।
উত্তরঃ নয়া উদারনীতিবাদের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ-
[1] ন্যূনতম কর্মসূচিসম্পন্ন রাষ্ট্র: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে যুদ্ধোত্তর শিল্পসমাজে উদারনৈতিক জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রগুলি কল্যাণমূলক কর্মসূচি রূপায়ণ করতে গিয়ে অতি ক্ষমতাশালী ও আমলাতান্ত্রিক হয়ে ওঠে। জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র ক্রমশ ব্যক্তির প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে এক নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থায় রূপান্তরিত হয়। এই পটভূমিকায় উদারনীতিবাদী দর্শনের অনুসারী নবপ্রজন্মের চিন্তাবিদরা রাষ্ট্রের কর্মপরিধিকে পুনরায় সীমিত করে এক ন্যূনতম কর্মসূচিসম্পন্ন রাষ্ট্র (Minimal State) বা সীমিত রাষ্ট্রের ধারণাকে ফিরিয়ে নিয়ে এসে নয়া উদারনীতিবাদের (Neo-Liberalism) পত্তন করেন।
[2] রাষ্ট্রের ভূমিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা: নয়া উদারনীতিবাদে রাষ্ট্রের ভূমিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়। তবে এই রাষ্ট্র কোনো ক্ষমতাকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান বা স্বৈরী প্রতিষ্ঠান নয়। নয়া উদারনীতিবাদের রাষ্ট্র হল ‘ন্যূনতম রাষ্ট্র’ (Minimal State)। নয়া উদারনীতিবাদীদের মতে, ব্যক্তিস্বাধীনতার আরও সম্প্রসারণ এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার জন্য উদার পরিবেশ সংরক্ষণের জন্যই রাষ্ট্রের প্রয়োজন। রাষ্ট্রের একমাত্র কাজ হবে নাগরিকদের নিরাপত্তা প্রদান এবং ন্যায়সংগতভাবে অর্জিত নাগরিকদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ। বস্তুত, রাষ্ট্রের হাতে শুধুমাত্র নিরাপত্তামূলক কাজের দায়িত্বটুকু ন্যস্ত করতে চেয়েছেন নয়া উদারনীতিবাদীরা। এজন্য রাষ্ট্রকে তাঁরা ‘Protective Agency’র চেয়ে বেশি কিছু ভাবেননি।
[3] তিনটি কাজ: নয়া উদারনীতিবাদের প্রবক্তাদের মতে, নিরাপত্তা রক্ষা (Protection), ন্যায়বিচার (Justice) এবং প্রতিরক্ষা (Defence)-মূলক কাজ ছাড়া রাষ্ট্রের আর-কোনো কাজ থাকতে পারে না (the State has no legitimate powers beyond the functions of protection, justice and defence)।
[4] অবাধ বাণিজ্য নীতির পুনরুজ্জীবন: অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কোনোরকম রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ নয়া উদারনীতিবাদীরা স্বীকার করেননি। তাঁরা সাবেকি উদারনীতিবাদের অবাধ বাণিজ্য নীতির (Laissez-faire) পুনরুজ্জীবনের পক্ষপাতী। নয়া উদারনীতিবাদের বক্তব্য অনুসারে ব্যক্তিকে প্রকৃত উন্নতি ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে পৌঁছোতে হলে তার অর্থনৈতিক জীবনকে সর্বপ্রকার নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হতে হবে (….man’s economic activity must be actively liber- ated from all restrictions to enable him to achieve true progress and prosperity)। নয়া উদারনীতিবাদে মুক্ত বাজার অর্থনীতিকে (Free Mar- ket Economy) স্বীকৃতি দেওয়া হয়। নয়া উদারনীতিবাদ মনে করে যে, একমাত্র অনিয়ন্ত্রিত বাজার অর্থনীতি প্রাচুর্য, দক্ষতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম।
[5] প্রাকৃতিক অধিকার তত্ত্বের সমর্থন: রবার্ট নজিক তাঁর ‘Anarchy, State, and Utopia’ শীর্ষক গ্রন্থে জন লকের ‘প্রাকৃতিক অধিকার’ (Natu- ral Rights) তত্ত্বের প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানিয়ে এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, নাগরিকদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জন ও ভোগের অধিকার (Right to acquire and hold property) এবং চুক্তির স্বাধীনতা (Freedom of Contract) অলঙ্ঘনীয়। রাষ্ট্র কোনোক্রমেই এতে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। এমনকি ধনীদের ওপর কর আরোপ করার নীতিকে উদারনীতিবাদীরা কঠোরভাবে নিন্দা করেন। তাঁদের মতে, যদি রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতা থেকে সব নাগরিকদের মুর নিন্দা যায়, তাহলে তাঁরা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নিজেদের সর্বোত্তম বিকাশ ঘটাতে পারবেন (Ifall the individuals are free from State compulsor they will put their best into the system.)
প্রশ্ন 6. রাষ্ট্রের প্রকৃতি-সম্পর্কিত নয়া উদারনীতিবাদী তত্ত্ব আলোচনা করো।
উত্তরঃ নয়া উদারনীতিবাদ
নয়া উদারনীতিবাদ হল সাবেকি উদারনীতিবাদের একটি নতুন রূপ। একে সাবেকি উদারনীতিবাদের উত্তরসূরিও বলা হয়। রাষ্ট্রের কাজকর্মের পরিধিকে একেবারে সংকুচিত করে মুক্ত বাজার অর্থনীতি প্রবর্তন করে, ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে এই মতবাদের সূচনা ঘটে। নয়া উদারনীতিবাদ সবরকম রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বিরোধী। ব্যক্তিজীবনে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণকারী ভূমিকার অবসান চায় এই মতবাদ। এই কারণে নয়া উদারনীতিবাদে ন্যূনতম কর্মসূচিসম্পন্ন রাষ্ট্র বা সীমিত রাষ্ট্রের (Minimal State) ধারণার ওপর জোর দেওয়া হয়।
১৯৭০-এর দশকে নয়া উদারনীতিবাদের জন্ম হয়। অনেকে একে উদারনীতিবাদের মুক্তি বা লিবারেটারিয়ানিজম (Libertarianism) বলে থাকেন। নয়া উদারনীতিবাদের প্রবক্তাদের মধ্যে রয়েছেন এফ এ হায়েক, জন রলস, মিলটন ফ্রিডম্যান, ইশিয়া বারলিন, রবার্ট নজিক প্রমুখ।
অন্যান্য ধরনের উদারনীতিবাদের সঙ্গে তুলনা
সাবেকি উদারনীতিবাদ এবং আধুনিক বা সংশোধিত উদারনীতিবাদের সঙ্গে নয়া উদারনীতিবাদের পার্থক্য রয়েছে। সাবেকি উদারনীতিবাদের সীমিত রাষ্ট্রের ধারণা বা অবাধ অর্থনৈতিক নীতির (Laissez-faire) সঙ্গে নয়া উদারনীতিবাদের মিল থাকলেও, উনবিংশ শতাব্দীর আধুনিক উদারনীতিবাদের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। আধুনিক উদারনীতিবাদে রাষ্ট্রকে যেভাবে সমষ্টিগত মঙ্গলের প্রকাশ বলে অভিহিত করে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের প্রচার করা হয়েছে, নয়া উদারনীতিবাদ তার সম্পূর্ণ বিরোধী। এখানে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির বদলে এসেছে বাজার অর্থনীতি। রাষ্ট্রের কাজকর্ম এখানে এতটাই সীমিত যে তাকে নিছক একটি রক্ষামূলক সংস্থার (Protective Agency) চেয়ে বেশি কিছু ভাবা হয়নি। গণতান্ত্রিক আদর্শ, সামাজিক ন্যায়, মানবিক অধিকার, বহুত্ববাদ প্রভৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নয়া উদারনীতিবাদের প্রবক্তারা নতুন যুগের আশা- আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক নির্ধারণ করেছেন।
মূল বক্তব্য
নয়া উদারনীতিবাদের মূল বক্তব্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-
[1]সীমিত রাষ্ট্র: নয়া উদারনীতিবাদে সীমিত রাষ্ট্র বা ন্যূনতম কর্মসূচিসম্পন্ন রাষ্ট্র (Minimal State)-এর কথা বলা হয়। এই রাষ্ট্রের প্রধান কাজ হবে নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধান ও তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ। নয়া উদারনীতিবাদীরা মনে করেন, নিরাপত্তা রক্ষা, ন্যায়বিচার এবং প্রতিরক্ষামূলক কাজ ছাড়া রাষ্ট্রের আর-কোনো কাজ থাকতে পারে না।
[2] মুক্ত বাজার অর্থনীতি: নয়া উদারনীতিবাদের প্রবক্তারা সাবেকি উদারনীতিবাদের অবাধ বাণিজ্য নীতির (Laissez-faire) পুনরুজ্জীবনের পক্ষপাতী। অর্থাৎ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণকে তাঁরা অনুমোদন করেননি। তাঁদের মতে, ব্যক্তিকে প্রকৃত উন্নতি ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে পৌঁছোতে হলে, তার অর্থনৈতিক জীবনকে সবরকম নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হতে হবে। নয়া উদারনীতিবাদে মুক্ত বাজার অর্থনীতিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। নয়া উদারনীতিবাদ মনে করে একমাত্র অনিয়ন্ত্রিত বাজার অর্থনীতি প্রাচুর্য, দক্ষতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম।
[3] প্রাকৃতিক অধিকার তত্ত্বের সমর্থন: নয়া উদারনীতিবাদের প্রবক্তা রবার্ট নজিক তাঁর ‘Anarchy, State, and Utopia’ গ্রন্থে জন লক-এর স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক অধিকার তত্ত্বের প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানিয়ে এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, নাগরিকদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জন ও ভোগের অধিকার (Right to acquire and hold property) এবং চুক্তির স্বাধীনতাকে (Freedom of Contract) লঙ্ঘন করা যাবে না। রাষ্ট্র কোনোভাবেই এতে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। এমনকি ধনীদের ওপর কর আরোপ করার নীতিকেও নজিক কঠোরভাবে নিন্দা করেছেন। তাঁর মতে, যদি সব ব্যক্তিকে রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত রাখা যায় তাহলে তারা সেই ব্যবস্থায় তাদের সর্বোত্তম বিকাশ ঘটাতে পারে।
পন্ডিতদের মতে, জন লক-এর প্রাকৃতিক অধিকারের (Natural Right) ধারণাকে বিংশ শতাব্দীর পশ্চিমি দুনিয়ার অভিজ্ঞতায় নতুনভাবে দেখতে চেয়েছেন নজিক। জন লক তাঁর তত্ত্বে প্রকৃতির রাজ্যে ব্যক্তির যে তিনটি অধিকারকে অলঙ্ঘনীয় বলে রায় দিয়েছিলেন, সেই জীবনের অধিকার, স্বাধীনতার অধিকার এবং সম্পত্তির অধিকারকে রক্ষা করাই হল ‘ন্যূনতম রাষ্ট্র’- এর একমাত্র কাজ।
[4] রাষ্ট্র মূলত একটি অনৈতিক সংগঠন: আদর্শবাদীরা রাষ্ট্রকে একটি নৈতিক প্রতিষ্ঠানরূপে অভিহিত করেছেন। নয়া উদারনীতিবাদী তত্ত্বের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা রবার্ট নজিক মনে করেন, রাষ্ট্র মূলত একটি অনৈতিক (Immoral) সংগঠন। কারণ একমাত্র রাষ্ট্রের হাতেই রয়েছে বলপ্রয়োগের একচেটিয়া অধিকার। তাই রাষ্ট্র তার ভূখণ্ডে বসবাসকারী ব্যক্তিদের রক্ষা করার যুক্তিতে ব্যক্তির অধিকার লঙ্ঘন করে থাকে। তবে নৈরাজ্যবাদীদের মতো নজিক অবশ্য রাষ্ট্রব্যবস্থার পুরোপুরি অবসান চাননি। তিনি এমন এক ‘ন্যূনতম রাষ্ট্র’ (Minimal State)-এর ধারণায় বিশ্বাস করেন যা কখনও ব্যক্তির অধিকারকে লঙ্ঘন করে না।
[5] মৌলিক স্বাধীনতার নীতি প্রতিষ্ঠা: মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন রলস নয়া উদারনৈতিক চিন্তাভাবনাকে নতুনভাবে উপস্থাপিত করেছেন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর A Theory of Justice গ্রন্থে রলস নয়া উদারনীতিবাদের ন্যায়নীতি সম্পর্কে বিশদে আলোচনা করেছেন। পরে ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে Political Liberalism গ্রন্থে তাঁর নয়া উদারনীতিবাদী দর্শনের তিনি বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন। রলসের ‘ন্যায়’সম্পর্কিত ধারণার প্রথম নীতি হল সকলের জন্য সমান মৌলিক স্বাধীনতা। তাঁর মতে, ব্যাপকতম মৌলিক স্বাধীনতায় প্রতিটি মানুষের সমান অধিকার থাকবে। রলসের বক্তব্য অনুসারে মৌলিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রগুলি হল-ভোটদানের স্বাধীনতা, সরকারি কাজে অংশগ্রহণের স্বাধীনতা, বাক্ ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, সমবেত হওয়ার স্বাধীনতা, বিচারবুদ্ধি ও বিবেকের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ভোগদখলের স্বাধীনতা ইত্যাদি। রলস মনে করতেন, সমস্ত সামাজিক মূল্যবোধ-স্বাধীনতা ও সুযোগ, আয় ও সম্পদ এবং আত্মমর্যাদার উপাদানগুলিকে সমভাবে বণ্টন করতে হবে (All social values-liberty
[6] আইনের শাসন ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের নিশ্চয়তা: নয়া উদারনীতিবাদের প্রবক্তা এফ এ হায়েক তাঁর The Constitution of Liberty গ্রন্থে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা প্রকাশ করে আইনের শাসন ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের নিশ্চয়তার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর আধুনিক উদারনীতিবাদের জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণাকে বাতিল করে হায়েক তাঁর নয়া উদারনীতিবাদী তত্ত্বের ব্যাখ্যা দেন। ব্যক্তিমানুষের ব্যক্তিগত সামর্থ্যের ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপকে তিনি অনুমোদন করেননি। এই কারণে হায়েক জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সামগ্রিকতাবাদী শাসনে বিশ্বাস করতেন না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে মেনে নিয়ে আইনের শাসন চাইলেও হায়েক সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি দমনপীড়নমূলক আইনের পক্ষপাতী নন। তাঁর তত্ত্বে হায়েক এটা মনে করিয়ে দিয়েছেন, ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সুরক্ষিত রাখাই রাষ্ট্রের একমাত্র কাজ।
7. মার্কসবাদ কাকে বলে? মার্কসবাদের উৎসগুলি কী কী?
উত্তরঃ মার্কসবাদ-
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মার্কসীয় মতবাদ এক সর্বাধুনিক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। মার্কসবাদে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী রাজনৈতিক আলোচনা করা হয়নি। মার্কসবাদ সমগ্র মানবসমাজের বিকাশের ধারাকে বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করেছে। এই দৃষ্টিকোণ সম্পূর্ণ মৌলিক।
মার্কসবাদ বলতে কী বোঝায় এই সম্পর্কে এককথায় উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। লেনিনের মতে, মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গি ও শিক্ষামালাই হল মার্কসবাদ (Marx- ism is the system of the views and teachings of Marx)। এমিল বার্নসের মতে, আমাদের এই জগৎ এবং তার অংশ মানবসমাজ সম্পর্কে সাধারণ তত্ত্ব হল মার্কসবাদ। কার্ল মার্কসের (১৮১৮-১৮৮৩ খ্রি.) নাম অনুসারে এর নামকরণ হয়েছে। বিগত শতাব্দীর (ঊনবিংশ) মধ্য ও শেষ ভাগে ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের সঙ্গে একযোগে মার্কস এই তত্ত্ব রচনা করেন। মানবসমাজের উৎপত্তি, বিকাশ, প্রকৃতি ও ভবিষ্যৎ নিয়ে মার্কস ও এঙ্গেলস এক গভীর অনুসন্ধানমূলক গবেষণায় লিপ্ত হন। এই গবেষণার শেষে তাঁরা সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে সামাজিক পরিবর্তন কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। বহিঃপ্রকৃতি যেভাবে কতকগুলি পরিবর্তনের নিয়ম মেনে পরিবর্তিত হয়, সামাজিক পরিবর্তনও সেভাবে ঘটে থাকে। এই সত্যকে কেন্দ্র করে সমাজ সম্বন্ধে এক বিজ্ঞানসম্মত তত্ত্ব কার্ল মার্কস গড়ে তোলেন এবং একে মার্কসবাদ বলা হয়। এই প্রসঙ্গে মিলিব্যান্ড-এর বক্তব্য অনুসরণ করে বলা যায় যে, মার্কস নিজে কখনও ‘মার্কসবাদ’ শব্দটি প্রয়োগ করেননি। মৃত্যুর পর (১৮৮৩ খ্রি.) এঙ্গেলস এই কথাটি ব্যবহার করেন। পরবর্তীকালে লেনিন তা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেন।
মার্কসবাদের উৎস-
মার্কসবাদ কোনো একটি উৎস থেকে সৃষ্টি হয়নি। মার্কসের চিন্তার উপাদানগুলি বিভিন্ন উৎস থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। মার্কসবাদের প্রধান তিনটি উৎস হল- ① জার্মান দর্শন, ② ব্রিটিশ অর্থশাস্ত্র এবং (3)ফরাসি সমাজতন্ত্র।
প্রথম উৎস হিসেবে জার্মান ভাববাদী দার্শনিক হেগেলের তত্ত্ব ‘দ্বন্দ্বমূলক ভাববাদ’ মার্কসকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। অবশ্য মার্কস অপর একজন জার্মান দার্শনিক ফয়েরবাখ (Feuerbach)-এর বস্তুবাদী চিন্তাধারা থেকেও অনুপ্রাণিত হন। এর ফলে তিনি হেগেল ও ফয়েরবাখের চিন্তার ইতিবাচক দিকগুলি নিয়ে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ রচনা করেন। মার্কসবাদের দ্বিতীয় উৎস হল ব্রিটিশ অর্থশাস্ত্র। রবার্ট ওয়েন (Robert Owen) ও উইলিয়াম টমসন (Wil- liam Thompson)-এর রচনা, টমাস হজস্কিন (Thomas Hodgskin)-এর ‘মূল্যের উৎস হল শ্রমিক’ এবং অ্যাডাম স্মিথ (Adam Smith) ও ডেভিড রিকার্ডো (David Ricardo)-র ‘মূল্যের শ্রম-তত্ত্ব’ মার্কসের ‘উদ্বৃত্ত মূল্য’-এর তত্ত্বকে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। মার্কসবাদের তৃতীয় উৎস হল ফরাসি সমাজতন্ত্র। শ্রেণিসংগ্রাম এবং সাম্যবাদী সমাজের প্রতিষ্ঠা-সম্পর্কিত তত্ত্ব রচনা করতে গিয়ে ফরাসি সমাজতন্ত্রী সাঁ সিমোঁ (Saint Simon), শার্ল ফুরিয়ে (Charles Fourier), কাবে (Cabet) প্রমুখের লেখা থেকে মার্কস প্রভাবিত হয়েছিলেন।
8. মার্কসবাদের মূলসূত্রগুলি আলোচনা করো।
অথবা, মার্কসবাদের মূলসিদ্ধান্তগুলি লেখো।
উত্তরঃ মার্কসবাদের মূলসূত্র-
এমিল বার্নসের মতে, মার্কসবাদ হল আমাদের এই জগৎ এবং তারই অংশ
মানবসমাজ সম্বন্ধে সাধারণ তত্ত্ব। এর নামকরণ হয়েছে কার্ল মার্কস-এর (১৮১৮-১৮৮৩ খ্রি.) নামানুসারে। এই মতবাদের মূলসূত্রগুলি হল-
[1] দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ: দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ হল মার্কসীয় তত্ত্বের প্রধান ভিত্তি। মার্কসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ হেগেলের দ্বন্দ্বমূলক ভাববাদ থেকে উপাদান গ্রহণ করলেও তা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মূল বক্তব্য হল জগৎ প্রকৃতিগতভাবে বস্তুময়। জগতের প্রতিটি বস্তু পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল ও পরস্পরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই বস্তুজগৎ অনড় বা অচল নয়, তা সতত পরিবর্তনশীল। মার্কসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের তিনটি মৌলিক নিয়ম রয়েছে-
1. বৈপরীত্যের দ্বন্দ্ব: দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ বিশ্বাস করে যে, প্রতিটি বস্তু ও ঘটনার মধ্যে পরস্পরবিরোধী ধর্ম একই সঙ্গে অবস্থান করে। তার ফলে দেখা দেয় অন্তর্দ্বন্দ্ব। যেমন পুঁজিবাদী সমাজে পুঁজিমালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব রয়েছে। এই অন্তর্দ্বন্দ্ব সমাজ পরিবর্তনের মূল কারণ হিসেবে কাজ করে।
ii. পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তন: দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ অনুসারে বিপরীতধর্মী শক্তিগুলির দ্বন্দ্বের ফলে বস্তুজগতে পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তন ঘটে। এই গুণগত পরিবর্তন বস্তুর আমূল পরিবর্তন ঘটাতে সাহায্য করে। মার্কসের মতে, পুঁজিবাদী সমাজের পরিমাণগত পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় আকস্মিকভাবে বিপ্লবের মাধ্যমে যে গুণগত পরিবর্তন ঘটে তার ফলে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার পত্তন হয়। এভাবে সমাজের পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তন ঘটে।
iii. অস্বীকৃতির অস্বীকৃতি: দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মতে পুরাতনের অস্বীকৃতি ছাড়া নতুনের আবির্ভাব ঘটতে পারে না। নতুন ক্রমে পুরোনো হয়। তখন তারও বদল ঘটে। এভাবে দাস সমাজব্যবস্থাকে অস্বীকার করে সামন্ড সমাজের বিকাশ, সামন্ত সমাজকে অস্বীকার করে পুঁজিবাদের বিকাশ, আবার পুঁজিবাদকে অস্বীকার করে সমাজতন্ত্রের বিকাশ ঘটে।
[2] ঐতিহাসিক বস্তুবাদ: মার্কসের তত্ত্বের মূলনীতিগুলির মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হল ঐতিহাসিক বস্তুবাদ।
i. মূল কাঠামো ও উপরিকাঠামো: মার্কস সর্বপ্রথম বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে ইতিহাসের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন যে, রাজনীতি-ধর্ম-দর্শন প্রভৃতি চিন্তাধারা নয়, সমাজের মূল কাঠামো বা প্রকৃত বুনিয়াদ হল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। এই বুনিয়াদের ওপর গড়ে ওঠে ধর্ম, নৈতিকতা, আইন, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান (যেমন রাষ্ট্র) ইত্যাদি যাবতীয় উপরিকাঠামো।
ii. মানব ইতিহাসের পরিবর্তনের কারণ: মার্কসীয় মতবাদ অনুসারে, মানবসমাজের বিকাশের ইতিহাস হল উৎপাদন-ব্যবস্থার বিকাশের ইতিহাস। মানবসমাজের পরিবর্তনের মুখ্য কারণ উৎপাদন-শক্তি এবং উৎপাদন-সম্পর্কের দ্বন্দ্ব। মার্কসের মতে, আদিম যৌথ সমাজজীবনে উৎপাদনের উপাদানের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা না থাকায় সমাজে শ্রেণিশোষণ ছিল না। দাস সমাজব্যবস্থায় দাসমালিকরা উৎপাদনের উপকরণের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা কায়েম করে। ক্রমে সামন্ত সমাজব্যবস্থায় উৎপাদনের উপকরণের মালিক হয়ে ওঠে সামন্তপ্রভুরা। যন্ত্রশিল্পের উদ্ভব ঘটলে সামন্ডসমাজের অবসান ঘটে এবং পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় দ্বন্দ্ব ও সংকট তীব্র আকার ধারণ করলে বিপ্লবের মাধ্যমে পুঁজিবাদী সমাজের অবসান এবং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পত্তন ঘটে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উৎপাদনের উপকরণের ওপর সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সবরকম শোষণের সমাপ্তি ঘটে। এভাবে মার্কস তাঁর ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সাহায্যে সমাজবিবর্তনের ধারার একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেন।
[3] উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব: পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় শোষণের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্বের অবতারণা করা হয়।
মার্কসের বক্তব্য হল যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ও শ্রমের সংমিশ্রণে যে দ্রব্য উৎপাদিত হয় তার সমস্তটাই আসলে শ্রমিকের শ্রমের ফসল। পুঁজিবাদী সমাজে উৎপাদনের উপাদানের মালিক হল পুঁজিপতি শ্রেণি। জীবনধারণের জন্য তাদের কাছে শ্রমিকরা শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য থাকে। কিন্তু শ্রমিক সারা দিনের শ্রমে যা উৎপাদন করে সেই মূল্যের মাত্র সামান্য একটি অংশ সে মজুরি হিসেবে পায়। বাকি অংশটুকু উদ্বৃত্ত মূল্য হিসেবে থেকে যায়। এই উদ্বৃত্ত মূল্য শ্রমিক পায় না, তা যায় মালিকের কাছে। পুঁজিপতি শ্রেণির মুনাফার উৎস হল এই উদ্বৃত্ত মূল্য। মার্কসীয় তত্ত্ব অনুযায়ী, শ্রমিক তার মজুরির সমমূল্যের দ্রব্য উৎপাদন করতে যেটুকু সময় কাজ করে তাকে আবশ্যিক শ্রম-সময় বলে। বাকি উদ্বৃত্ত মূল্যটুকু তৈরি করতে শ্রমিককে যতটুকু অতিরিক্ত সময় কাজ করতে বাধ্য করা হয় তাকে উদ্বৃত্ত শ্রম-সময় বলে।
[4] শ্রেণিসংগ্রাম: মার্কস ও এঙ্গেলসের লেখা ‘দ্য কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’- র সূচনা বাক্যটি হল-‘আজ পর্যন্ত (আদিম সাম্যবাদী সমাজের পর থেকে) যতগুলি সমাজ দেখা গেছে, তাদের সকলের ইতিহাস শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস।’ মার্কসীয় দর্শনে শ্রেণি ও শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শ্রেণি বলতে বোঝায় একই প্রণালীতে জীবনযাত্রা নির্বাহকারী সমাজের এক-একটি অংশ। যেমন-পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় যে গোষ্ঠী শ্রমদান করে, তাকে বলা হয় শ্রমিক শ্রেণি। মার্কসীয় মতে, বিনা সংগ্রামে বা সংঘাতে, মসৃণ পথে সমাজের পরিবর্তন ঘটে না, সমাজের বিকাশ ঘটে শ্রেণিসংগ্রামের ফলেই। তাই তাঁরা শ্রেণিসংগ্রামকে সমাজবিকাশের চালিকা শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেন।
মার্কসীয় মত অনুসারে শ্রেণির বিভাজন দুই প্রকার-মুখ্য এবং গৌণ। যে শ্রেণিদের বাদ দিয়ে উৎপাদন-ব্যবস্থা চলতে পারে না তারা মুখ্য শ্রেণি। যেমন, পুঁজিবাদী সমাজে পুঁজিপতি ও শ্রমিক শ্রেণি। আর অন্যরা হল গৌণ শ্রেণি।
অতীতকালে শ্রেণির অস্তিত্ব ছিল না। মার্কসের মতে, পৃথিবীতে প্রথম শ্রেণিবিভক্ত সমাজ দেখা যায় দাস সমাজে। এই সমাজে দুটি মুখ্য শ্রেণি ছিল দাস ও দাসমালিক। দাস সমাজেই শুরু হল এক শ্রেণি কর্তৃক অপর শ্রেণির শোষণ। এই সমাজে দাস ও দাসমালিকদের মধ্যে শ্রেণিদ্বন্দ্ব তীব্র হয়।
দাস সমাজের পরবর্তী পর্যায়ে সমাজ বিভক্ত হয় শোষক সামন্তপ্রভু ও শোষিত ভূমিদাস শ্রেণিতে। এই দুই শ্রেণির মধ্যে শ্রেণিদ্বন্দ্বও চলতে থাকে।
এরপর গড়ে ওঠে পুঁজিবাদী সমাজ। এই সমাজ বুর্জোয়া ও সর্বহারা, এই দুই পরস্পরবিরোধী শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। শ্রেণিদ্বন্দ্ব তীব্রতর হয়ে ওঠে এবং সর্বহারা শ্রেণি পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা উচ্ছেদের জন্য অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আদর্শগত সংগ্রাম চালাতে থাকে। মার্কসীয় মতে পুঁজিপতি বা বুর্জোয়া শ্রেণি সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হলে সর্বহারার একনায়কত্বে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে এবং শ্রেণিদ্বন্দ্বের অবসান ঘটবে। পরিশেষে সাম্যবাদী সমাজে শ্রেণিহীন এবং শোষণহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠবে।
[5] রাষ্ট্র-সম্পর্কিত তত্ত্ব: মার্কসীয় মতবাদ অনুযায়ী রাষ্ট্রের আবির্ভাব আকস্মিকভাবে ঘটেনি। উৎপাদন-ব্যবস্থার প্রকৃতিগত পরিবর্তনের ফলে সমাজবিবর্তনের একটি বিশেষ অধ্যায়ে রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এই সময়ে সমাজ সম্পত্তিবান শোষকশ্রেণি এবং সম্পত্তিহীন শোষিতশ্রেণি, এই দুই পরস্পরবিরোধী শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
i. বলপ্রয়োগ ও শ্রেণিশোষণের হাতিয়ার: মার্কসের মতে, সম্পত্তি- মালিকানার নিরাপত্তার জন্য যে বলপ্রয়োগমূলক হাতিয়ারের প্রয়োজন হয় তা হল রাষ্ট্র। রাষ্ট্র নামক হাতিয়ারের সাহায্যে সমাজে প্রভুত্বকারী সংখ্যালঘু সম্পত্তিবান শ্রেণি তার বিরোধী সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্পত্তিহীন শ্রেণিকে শোষণ করে। এভাবে দাস সমাজ, সামন্ত সমাজ ও পুঁজিবাদী সমাজে রাষ্ট্র উৎপাদন-ব্যবস্থার মালিকদের স্বার্থে সংখ্যাগরিষ্ঠকে শোষণ করার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে।
ii. রাষ্ট্র প্রকৃতির পরিবর্তন: মার্কসের মতে, বুর্জোয়া রাষ্ট্রের ধ্বংসের ফলে ‘সর্বহারার একনায়কত্ব’ প্রতিষ্ঠিত হলে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠিত হবে। রাষ্ট্র সেখানে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে না, বরং সাম্যবাদী সমাজের ভিত্তি রচনা করবে।
iii. রাষ্ট্রের বিলুপ্তি: সাম্যবাদী সমাজে সবরকম শ্রেণিশোষণের সমাপ্তি ঘটার ফলে রাষ্ট্রযন্ত্রের কোনো প্রয়োজন থাকবে না। তখন স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রের বিলুপ্তি ঘটবে।
[6] বিপ্লবের তত্ত্ব: মার্কসের মতবাদ অনুযায়ী, বিপ্লব হল এমন এক সামাজিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে পুরোনো সমাজব্যবস্থার পরিবর্তে নতুন প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।
i. বিপ্লবের কারণ: মার্কসবাদে বলা হয়েছে, বিপ্লবের কারণ হল প্রচলিত উৎপাদন-সম্পর্কের সঙ্গে নতুন উৎপাদিকাশক্তির বিরোধ। নতুন উৎপাদন-শক্তির সঙ্গে পুরোনো উৎপাদন-সম্পর্কের এই সংঘর্ষের ফলে পুরোনো সমাজব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে নতুন সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠে।
ii. বিপ্লবের চালিকাশক্তি: মার্কস বিপ্লবকে ইতিহাসের চালিকাশক্তি (Loco- motive of History) বলে বর্ণনা করেছেন। তাঁর মতে, বিপ্লবের চালিকাশক্তি হিসেবে যে শ্রেণি কাজ করে তার মাধ্যমে বিপ্লবের প্রকৃতি নির্ধারিত হয়। যেমন-বুর্জোয়া বিপ্লবের মূল চালিকাশক্তি বুর্জোয়া শ্রেণি, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের চালিকাশক্তি হল শ্রমিক ও কৃষক সম্প্রদায়।
iii. বিপ্লবের শর্ত: বিপ্লবের জন্য মার্কসীয় তত্ত্বে দু-ধরনের শর্তপূরণের কথা বলা হয়েছে-① বিষয়গত অবস্থা, ② বিষয়ীগত অবস্থা। বিষয়গত অবস্থা হল বৈপ্লবিক পরিস্থিতি। দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা অনুসারে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়। এই বৈপ্লবিক পরিস্থিতি না থাকলে বিপ্লব ঘটতে পারে না। অন্যদিকে বিষয়ীগত উপাদানগুলি হল জনগণের বৈপ্লবিক চেতনা ও সংগ্রামী মানসিকতা, বিপ্লবী রাজনৈতিক দল প্রভৃতি।
iv. বিপ্লবের প্রকৃতি: মার্কসীয় তত্ত্ব অনুসারে বিপ্লব সবরকম সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক শোষণের অবসান ঘটিয়ে এক শোষণমুক্ত শ্রেণিহীন সমাজ গঠন করবে। বিপ্লব রক্তপাতহীন বা রক্তাক্ত, শান্তিপূর্ণ বা হিংসাত্মক উভয়ই হতে পারে। লেনিনের মতে, বিপ্লব হিংসার তাণ্ডব নয়, বিপ্লব হল উৎপীড়িত ও শোষিতের মহোৎসব।
v. বিপ্লবের প্রকারভেদ: দুই ভিন্ন ধরনের বিপ্লবের কথা মার্কসবাদে বলা হয়-সমাজতান্ত্রিক ও অসমাজতান্ত্রিক। এই দুই বিপ্লবের প্রকৃতি ভিন্ন। অসমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পুরোনো সমাজের সঙ্গে আপস করে উৎপাদনের উপকরণের ব্যক্তিগত মালিকানার রূপকে সংস্কার করে মাত্র। অন্যদিকে উৎপাদনের উপাদানের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান ঘটায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। এই বিপ্লব হল শোষিত মানুষের স্থায়ী মুক্তির জন্য শোষকশ্রেণির বিরুদ্ধে পরিচালিত প্রথম বিপ্লব।
উত্তরঃ গান্ধিবাদ
প্রচলিত অর্থে রাষ্ট্রদার্শনিক বলতে যা বোঝায়, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি (১৮৬৯-১৯৪৮) তা ছিলেন না। তাঁকে প্লেটো, অ্যারিস্টট্ল, মিল বা ব্যোমের মতো রাষ্ট্রবিজ্ঞানীও বলা যায় না। কোনো রাজনৈতিক মতবাদ বা দর্শনের প্রতিষ্ঠা তিনি করতে চাননি। নিজের রাজনৈতিক দর্শনকে প্রচার করা বা তাকে প্রতিষ্ঠা করে যাওয়ার জন্য একদল অনুগামী তৈরি করে যাওয়ারও কোনো ইচ্ছে তাঁর ছিল না। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শক্তির হাত থেকে পরাধীন ভারতকে শৃঙ্খলমুক্ত করার জন্য স্বাধীনতা সংগ্রামের লড়াইয়ে নেমে গান্ধিজি এক আদর্শ সমাজ ও আদর্শ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন। এই স্বপ্নের কথা তাঁর চিন্তাধারায় তিনি বহুভাবে ব্যক্ত করেন। পরবর্তীকালে তা ‘গান্ধিবাদ’ (Gandhism) নামে পরিচিতি লাভ করে। শুধু ভারতের প্রেক্ষিতে ভারতবাসীর দিকে তাকিয়ে নয়, সারা বিশ্বের প্রেক্ষিতে বিশ্ববাসীর দিকে তাকিয়ে গান্ধিজি এমন কতকগুলি মৌলিক ধারণা ব্যক্ত করে গেছেন যা মানুষের কাছে ‘গান্ধিবাদ’ বলে স্বীকৃতি পেয়েছে।
9. গান্ধিজির সত্যাগ্রহ নীতির অর্থ ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো।
উত্তরঃ গান্ধিজির সত্যাগ্রহ নীতির অর্থ ও প্রকৃতি-
গান্ধিজির তত্ত্বের একটি অন্যতম প্রধান নীতি হল সত্যাগ্রহ। পন্ডিতদের মতে, সত্য প্রতিষ্ঠায় জিশুর আত্মত্যাগ, গৌতম বুদ্ধের অহিংসা ও প্রেমের বাণী এবং রাস্কিন, থোরো ও টলস্টয়ের চিন্তাধারার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে গান্ধিজি সত্যাগ্রহ- সম্পর্কিত ধারণাটি গড়ে তোলেন। এর পাশাপাশি গীতা ও উপনিষদ সম্বন্ধে তাঁর গভীর অধ্যয়ন ও দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকাকালীন বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে ‘নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ’ আন্দোলনের অভিজ্ঞতা তাঁর সত্যাগ্রহ-সম্পর্কিত ধারণাকে সমৃদ্ধ করেছিল।
অর্থ
‘সত্যাগ্রহ’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ হল সত্যের প্রতি আগ্রহ। সত্যাগ্রহ হল এক সুসংহত জীবনদর্শন, সত্য প্রতিষ্ঠার নৈতিক সংগ্রামে এক নিরস্ত্র প্রতিরোধ।
পন্ডিতরা গান্ধিজির সত্যাগ্রহকে ব্রিটিশরাজের বিপক্ষে চালিত রাজনৈতিক সংগ্রামের এক কৌশল বলে আখ্যা দিয়েছেন। তাঁদের মতে, এ হল অহিংস উপায়ে সংগ্রামের পথ।
গান্ধিজি তাঁর হিন্দ স্বরাজ গ্রন্থে সত্যাগ্রহের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, “সত্যাগ্রহ হল ব্যক্তির আত্মপীড়নের মাধ্যমে স্বাধিকার অর্জনের এক প্রচেষ্টা।” গান্ধিজির কাছে সত্যাগ্রহ ছিল সত্য, অহিংসা ও আত্মত্যাগের যোগফল। তাঁর মতে, সত্যাগ্রহ বলতে বোঝায় সকল অন্যায়, অবিচার, নিপীড়ন ও শোষণের বিরুদ্ধে পবিত্র আত্মশক্তির প্রতিরোধ (Satyagraha means the exercise of the purest soul-force against all injustice, oppression and exploitation.)।
গান্ধিজি মনে করতেন, সত্যাগ্রহ হল যে-কোনো ব্যক্তির এক সহজাত জন্মগত অধিকার। এ শুধু পবিত্র অধিকার নয়, পবিত্র কর্তব্যও।
প্রকৃতি
গান্ধিজি তাঁর রচনায় সত্যাগ্রহের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যেসব দিকের কথা উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-
[1] আত্মিক শক্তির সংগ্রাম: গান্ধিজির মতে, সত্যাগ্রহ হল আত্মিক শক্তির এক সংগ্রাম। এ হল এমন এক ধরনের সংগ্রাম যেখানে প্রচলিত অর্থে জয়পরাজয় বলে কিছু নেই। সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করাই হল এই সংগ্রামের মূল উদ্দেশ্য।
[2] নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ নয়, সর্বশক্তি দিয়ে অন্যায়কে অস্বীকার: গান্ধিজির অভিমত অনুসারে সত্যাগ্রহ নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ নয়, এ হল সর্বশক্তি দিয়ে অন্যায়কে অস্বীকার করার সংগ্রাম। নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ হল দুর্বল, ভীরু ও কাপুরুষের অস্ত্র, সত্যাগ্রহ তা নয়। নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বিপক্ষের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ থাকতে পারে, তবে সত্যাগ্রহে এসবের স্থান নেই। সত্যাগ্রহ হল – সদিচ্ছা ও ভালোবাসার সাহায্যে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে অন্যায়কে অস্বীকার করার এক পদ্ধতি।
[3] জন্মগত অধিকার: গান্ধিজি মনে করতেন, সত্যাগ্রহ হল মানুষের সহজাত জন্মগত অধিকার (Satyagraha is an inherent birth right of a person)। এ হল প্রতিটি মানুষের কাছেই জন্মগতভাবে এক অর্জিত অধিকার। এই কারণে গান্ধিজি একে পবিত্র অধিকার ও পবিত্র কর্তব্য বলে অভিহিত করেন।
[4] সত্যাগ্রহ ও প্রতিপক্ষ: প্রতিপক্ষের সঙ্গে সংঘাতের পথে গিয়ে তার ওপর চরম আঘাত হানা সত্যাগ্রহের কাজ নয়। সত্যাগ্রহের পথ আলাদা। সেখানে অহিংসা, প্রেম ও ভালোবাসার সাহায্যে প্রতিপক্ষের হৃদয় জয় করাই হল মূল উদ্দেশ্য। তাই গান্ধিজি সত্যাগ্রহীকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, এ কাজে অধৈর্য হলে চলবে না। অধৈর্য হওয়ার অর্থ হল হিংসার আশ্রয় গ্রহণ করা। অন্যায়কারী প্রতিপক্ষকে বিব্রত করার মনোভাব সত্যাগ্রহীর থাকা উচিত নয়।
[5] একটি সৃজনশীল পদ্ধতি: গান্ধিজি মনে করতেন, সত্যাগ্রহ হল এক সৃজনশীল পদ্ধতি। আপাতদৃষ্টিতে সত্যাগ্রহীর কিছু দাবি আদায় করার লক্ষ্য থাকলেও মূল উদ্দেশ্য হল প্রতিপক্ষের মনে শুভবোধ জাগ্রত করে তার হৃদয়ের পরিবর্তন ঘটানো। এই কারণে সত্যাগ্রহকে একটি সৃজনশীল পদ্ধতি বলে অভিহিত করা হয়। গান্ধিজি এ কথা স্পষ্টভাবে বলেছেন, সত্যাগ্রহ ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়, ব্যক্তির নীতি, কর্মপদ্ধতি ও কাজের বিরুদ্ধে।
[6] সত্যাগ্রহ দুর্বলের জন্য নয়: গান্ধিজি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, সত্যাগ্রহে দুর্বলতা, ভীরুতা ও কাপুরুষতার কোনো জায়গা নেই। তাঁর মতে, যারা ভীরু, কাপুরুষ ও দুর্বল তারা আর যাই হোক সত্যাগ্রহী হতে পারবে না। সত্যাগ্রহ মানে সত্যকে জয় না করা পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য। এই কাজ দুর্বল চিত্ত মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়।
[7] সত্যাগ্রহ ও অহিংসা: সত্যাগ্রহের সঙ্গে অহিংসার একটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। সত্যাগ্রহী কখনও হিংসাকে প্রশ্রয় দেবে না। সে হবে অহিংসার পূজারি। প্রতিপক্ষকে সে যেমন ঘৃণা করবে না, তেমনি তাকে অতিরিক্ত শ্রদ্ধাও করবে না। এভাবে অহিংসা দিয়ে হিংসাকে জয় করার জন্য তাকে প্রস্তুত থাকতে হবে। এ ছাড়া গান্ধিজি সত্যাগ্রহীদের আত্মপীড়নের জন্য তৈরি থাকতেও বলেছিলেন। তিনি মনে করতেন, অন্যায়ের প্রতিরোধ করার জন্য সত্যাগ্রহী আত্মবিসর্জন দিতেও বিন্দুমাত্র ভয় পাবে না।
[8] সত্যাগ্রহের বিধি: গান্ধিজি তাঁর রচনায় সত্যাগ্রহের বিধি সম্পর্কে অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছিলেন, “ভয় কাকে বলে সত্যাগ্রহী জানে না। অতএব প্রতিপক্ষকে বিশ্বাস করতে সে কখনোই শঙ্কিত হবে না। প্রতিপক্ষ তাকে যদি কুড়িবারও ঠকায়, তবুও একুশবারের বার সত্যাগ্রহী তাকে বিশ্বাস করার জন্য প্রস্তুত থাকবে। কারণ সত্যাগ্রহের আদর্শের মূল কথা হল মানুষের প্রকৃতিতে নিয়ত আস্থা রাখা।” 6
[9] সত্যাগ্রহের কলাকৌশল: গান্ধিজি সত্যাগ্রহের কলাকৌশলের কথাও লিপিবদ্ধ করে গেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কতকগুলি কৌশল হল- ① বিবেকের বিরুদ্ধে কোনো কিছু না করা, ② প্রলোভনের ফাঁদে পা না দেওয়া, ③ বিজয়ীর আধিপত্যের সামনে মাথা নত না করা, ④ জনগণের কাছে যে ব্যাপারগুলি মৌলিক গুরুত্বের, সেগুলি কষ্টস্বীকারের মধ্য দিয়ে অর্জন করা, ⑤ সত্যাগ্রহে উচ্ছৃঙ্খলতার কোনো জায়গা নেই, ⑥ সত্যাগ্রহের জন্য চরম ত্যাগ স্বীকার করতে এমনকি মৃত্যুবরণ করতেও প্রস্তুত থাকা।
[10] সত্যাগ্রহের চরিত্র: গান্ধিজি বলেছেন, সত্যাগ্রহের চরিত্রই হল সত্যাগ্রহের সৌন্দর্য, এটা আপনা-আপনিই আসে, এর সন্ধান করতে হয় না। নিরন্তর সত্যসন্ধান ও সত্যে উপনীত হওয়ার দৃঢ় সিদ্ধান্তের নামই সত্যাগ্রহ।